সেস্ত্ররেতস্ক কোথাও আছে আমি জানি।
তেমনি কোথাও আছে সাভনলিনা। আরও উত্তরে রোভানিয়েমি, মুরমানসক, নারভিক, হামারফেস্ট। অনেকে চেনেন জানেন। রোভানিয়েমিতে লম্ফ দিয়ে সুমেরু বৃত্ত অতিক্রম করেছি অথবা হামারফেসটে গিয়ে মধ্যরাতের সূর্য দেখে এসেছি – একথা শুনলে আসরের বড় বড় গুণী অবধি গল্পের গন্ধে আসন এবং পানীয় এগিয়ে দেবেন।
সেস্ত্ররেতস্ক শুনে হয়তো বলবেন, কী বললেন? রেস্ত? ফুরিয়ে গেছে নাকি?
আনা এবং ইয়েহুভার সঙ্গে সাহিত্য কাফেতে ওলেগ এবং আরেক আনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেদিন দুজনেই দলে ভিড়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আনা মধুর হেসে তাঁদের পাশ কাটালেন। “চেনা তো হল। উনি যদি আবার পিটারে আসেন আর তাঁর হাতে যদি সময় থাকে, তোমরা না হয় আপ্যায়ন কোরো”। এত বলি তিনি ইহুভা ও আমাকে বগলদাবা করে ময়কা নদীর দিকে বেরুলেন।
সে আমলে মোবাইল আসেনি। তবে ওলেগ ও আমি ভূমিতে প্রোথিত বার্তালাপের সুবিধার নম্বর আদান প্রদান করেছি, যাকে আমরা আজকাল ল্যান্ড লাইন বলে অবজ্ঞা করে থাকি। ফলত সেন্ট পিটারসবুর্গ ছাড়ার আগে আবার দেখা হল তাদের সঙ্গে।
সে আমলে নেভস্কি প্রসপেকতের ওপরে হাজারটা কাফে গড়ে ওঠেনি। কফি তখন এক বিরল এবং দুষ্প্রাপ্য পানীয়। কোনো কোনো ধূসর অট্টালিকার এক তলায় চা পাওয়া যেত, যেমন চল্লিশ বছর আগে লন্ডনের হাই স্ট্রিটে ছিল চা আর স্যান্ডুইচের দোকান। ওল্ড কফি ইন এ নিউ কাপ – মতান্তরে স্টারবাক্স বা নেরো আসতে দু’দশক বাকি। সেন্ট পিটারসবুর্গের ফুটপাথে চেয়ার পাতার চল দেখিনি – আপনি সেই দোকানের ভেতরে পাতা গোটা কয়েক কাঠের মোড়ার ওপরে বসতে পারেন, আলো-হাওয়া সেখানে কম, জানালার সাইজ ছোট। আলোর পথ রুদ্ধ করে তাতে আবার গরাদ দেওয়া। নিতান্ত গোমড়া মুখে আপনার কষ্টার্জিত রুবল আগে হাতে নিয়ে এক কাপ চা দিয়েছেন দোকানি। প্রায় তিন দশক আগের পিটারে আমার চেহারা যথেষ্ট কৌতূহল আকর্ষণ করেছে – পাশে বসা সঙ্গীরা বলেছেন, মাত্র আড়াই বছর আগে এটা ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ব্যাপার। এখানে বসার চেষ্টা করলে আপনাকে পুলিশ তাদের নিজের খরচায় প্লেনে তুলে দেশে ফেরত পাঠাত, আমাদের জেলখানায়।
নিশ্চিত বিতর্কের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ বলি – স্বল্প হলেও বাঙালি ভ্রমণকারিদের লেখা বইয়েতে রাশিয়ার যে ছবি আমি দেখেছি, সেখানে এমন কোনো ঘটনার পরিচয় পাইনি। আমার কলেজের এক অর্থনীতির অধ্যাপক তাঁর পার্টির সূত্রে সরকারি আমন্ত্রণে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে একাধিকবার গেছেন। ১৯৯৬ সালে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। নানান কথাবার্তা হল। বললাম, পূর্ব ইউরোপে আসা-যাওয়া করি। জানতে চাইলেন, ওই সব দেশে কী পরিবর্তন ঘটছে। ততদিনে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিংয়ের সুযোগে অনেক দেশকে খুব কাছাকাছি দেখেছি। আমার সেই গল্প শেষ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সার, আপনি তো এতবার এসব দেশ ঘুরে এসেছেন, আপনার চোখে কি কিছুই পড়েনি?”
তাঁর উত্তর আজও আমার কানে বাজে, “হীরেন, প্রশ্ন করিনি। বিশ্বাস করব বলেই তো গিয়েছিলাম।”
বিভিন্ন দেশের মানুষের ইংরেজি উচ্চারণ শুনে তাদের দেশ নির্ণয় করার একটা হবি আমার অনেকদিনের। পিগম্যালিয়ন পড়ে এবং মাই ফেয়ার লেডি দেখে ওই বাতিকটি জেগেছিল, আজও বদলায়নি। স্বল্প সাক্ষাতে রাস্তাঘাটে বেমক্কা বলে ফেলি – বাড়ি কি কেপ টাউন না জোবুর্গ? তারপর জমে ওঠে – আচ্ছা, আপনি কী করে বুঝলেন, ইত্যাদি চলতে থাকে।
ওলেগ ও আনার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে ধন্দ লাগল – কোথায় শিখলেন রাশিয়ান গন্ধ বিবর্জিত ইংরেজি? উত্তর – বিবিসি। পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আটের দশকের শেষ দিক নাগাদ বাড়িতে কেউ বিদেশি রেডিও শুনছে – এ খবর পেলে পুলিশ হানা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে! সীমিত হলেও এই একই উত্তর অন্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশের মানুষের কাছেও পেয়েছি।
আমার চেয়ে তাদের প্রশ্নের তালিকা দীর্ঘতর। সবে সাম্যবাদী সরকারের অবসান ঘটেছে – গতি বাজারি অর্থনীতির দিকে। ইয়েলৎসিন শক্ত হাতে দেশকে সেদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। লক্ষ্য না হয় বোঝা গেল, কিন্তু সেখানে যাবার পথটি কী?
এই দুনিয়ার খানিকটা দেখে, ঘুরে আমার মনে হয়েছে, যে আড্ডা নামক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের সোল কপিরাইট বাঙালিকে দেওয়া নিতান্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। ইস্তানবুলে বেসিকতাসের চায়ের দোকান বা রেস্তোরাঁয় একবার বসে দেখুন। সরু গলির দু’পাশে লম্বা লম্বা টেবিল পাতা। প্রথমে দু’জন, তারপর সম্পূর্ণ অচেনা আরও দু’জন যোগ দেয়। বেসিকতাস মহল্লার সঙ্গে আমার পরিচয় বাঙ্ক আসিয়ার জেঙ্কের কারণে। বাণিজ্যের ব্যাপারে তার সঙ্গে জানাশোনা – সেটা বন্ধুত্বে গড়িয়েছে। ফুটবলে আমার প্রীতি দেখে সে আমাকে বেসিকতাস ফুটবল টিমের সিজন টিকেট কিনে দিয়েছিল গোল লাইনের পেছনে। খেলা দেখার সুযোগ ক্বচিৎ হয়েছে। লম্বা টেবিলে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে ফুটবল দিয়ে গল্পটা শুরু হয়, তারপরে জগৎ-জীবন বিষয়ে আলোচনা চলে। তাতে যোগ দেয় আরও কিছু লোক। বেঞ্চের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বোঝা যায় না শেষের রাকের দামটা কে দিল। নীল সেতুর কাছে হেরেনঘ্রাখটের পাবে বসে আইএনজি ব্যাঙ্কের জন দে লাঙ্গে আমাকে একদিন বোঝানোর চেষ্টা করছিল, ডাচরা কেন ছোট গ্লাসে বিয়ার পান করে, জার্মানদের মত বিশাল গ্লাসে নয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কতজন ডাচ এক মূর্খ ভারতবাসীকে জ্ঞান বিতরণের প্রয়াসে যোগ দিয়েছিলেন – আজ আর মনে নেই। পোল্যান্ড আরেক জমজমাট পার্টির ত্রিবেণী – উচ, ব্রেসলাউ বা কাটোভিতসে যেখানেই হোক না কেন। কাজের বাহানায় দক্ষিণ জার্মানিতে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের দু’টি শাখায় কিছুদিন কাটাই। আমার সাথীরা আমাকে বারংবার বলেছিলেন, বন্ধুবর্গের সঙ্গে একত্র আলাপন করার স্নিগ্ধ অনুভব আপনি মিউনিক ন্যুরনবের্গে পাবেন। কিন্তু সাবধান, শীতল উত্তরে (ক্যুইলেন নরডেন) সেটি খুঁজবেন না।
সম্পূর্ণ বাজে কথা। আমার হামবুর্গ ব্রেমেনের দিনগুলির স্মৃতি অন্যরকম। তবে উত্তর বা দক্ষিণের সব জার্মান একটা বিষয়ে একমত – এই যে বন্ধুবর্গের সঙ্গে গুলতানি করার উষ্ণ আমেজ, যাকে আমরা জার্মানরা বলি ডি গেম্যুটলিখকাইট, তার অনুবাদ সম্ভব নয় পৃথিবীর যে কোনো ভাষায়। এঁরা কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না, কেন কয়েকজন ইংরেজ কোনো পাবে নিজেদের একটি ছোট্ট গ্রুপে বসে প্রভূত বিয়ার সহযোগে গল্প করাকেই আড্ডা বলে বিবেচনা করে!
রাশিয়ানরাও নয়।
আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অন্য অনেক দেশের মতন, ভাষায় কুলোলে রাশিয়ানরা আড্ডার ধুনি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন, শুক্কুরবারের বিকেল থেকে রবিবারের সন্ধ্যে অবধি।
আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় সেস্ত্ররেতস্কে।
১৯৯৪ সালের নভেম্বরের শুরুতে একটা কাজে এসেছিলাম হেলসিঙ্কি। তার সঙ্গে রাশিয়া অভিযান জুড়ে দিলে ভ্রমণ-বাবদ ব্যাঙ্কের ব্যয় কম হয়। ভানতা বিমান বন্দর থেকে একটা ছোটো ষোল সিটার প্লেনে আবার গেলাম সেন্ট পিটার্সবুর্গ। যাওয়ার আগে ওলেগকে দিনক্ষণ জানিয়েছি। আনা এবং ইয়েহুভার মত ওলেগও বললে – আমাদের পিটার আপনাকে দেখাব, তবে আমাদের ছোট গেরামেও আসুন, আমাদের চেনা দুনিয়া কেমন বদলাচ্ছে দেখে যাবেন। এঁরা কেউ ব্যবসাবাণিজ্যের সন্ধানে আমার সঙ্গে আলাপ করছেন না। ব্যাঙ্কিং থেকে এঁদের জীবন অনেক দূরে, এ কেবল বন্ধুত্বের আহ্বান।
ব্যক্তিগত কারণে আপন ঘরে ফেরার তাড়া নেই, আমার অপেক্ষায় গৃহে কেউ সন্ধ্যার বাতি জ্বালিয়ে রাখে না।
মাত্র দু’বছর আগে নেমে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাস্তে-হাতুড়ি লাঞ্ছিত পতাকা। বিভিন্ন সোভিয়েত তাদের নাম বদলে আকাশে তুলেছে আপন বর্ণরঞ্জিত পরিচয়। সেসব দেশে শ্রমিক এবং কৃষক দুই-ই আছেন, কিন্তু তাঁদের পতাকা থেকে কাস্তে এবং হাতুড়ি দু’-ই অদৃশ্য। আর কী বদলাল?
আবার সেই ধূলিধূসরিত সেন্ট পিটার্সবুর্গ। মস্কোয় মালিক বদল হয়েছে, কিন্তু বিগত ছ’মাসে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না। সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি কখনো যাইনি। যে সব অফিসে বাণিজ্যের সন্ধানে গেলাম, তাদের চেহারা দেখে অতীতটা অনুমান করা অবশ্য শক্ত হয়নি। চেয়ার টেবিল আমাদের তিরিশ বছর আগের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে মনে করিয়ে দেয়। অফিসের ঘরগুলো বেশ ঠান্ডা। কিছু লোককে পুলওভার এবং বিশ্বাস করুন, হালকা দস্তানা পরে কাজ করতে দেখেছি। লম্বা করিডোর, আবছা অন্ধকার। কর্মীরা যে ঠিক ইউনিফর্ম পরে আছেন তা নয়, তবে দেখলে মনে হয় সকলেই পাড়ার বলরামের দোকান থেকে জুতো-জামা কেনেন।
পিটার পলের দুর্গ দেখালেন আনা। এই সেই দুর্গ – যা কোনোদিন প্রতিরক্ষার কাজে লাগেনি, পরিণত হয়েছে জেলখানায়। দুর্গের প্রথম বন্দি মহান পিটারের পুত্র আলেক্সেই, যিনি পিতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। মারিন্সকি থিয়েটারে চাইকোভস্কির সোয়ান লেক দেখতে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছে।
আনার সঙ্গে ট্রেনে উঠেছি। সেন্ট পিটার্সবুর্গের মেন স্টেশন থেকে সেস্ত্ররেতস্ক তিরিশ কিলোমিটার। ১৮৯৪ সালে এই লাইনে প্রথম ট্রেন চলে। যে রেলগাড়িতে চড়েছি, সেটি সম্ভবত ঐ জমানায় তৈরি – একদা সবল ও সশক্ত ছিল, কিন্তু এখন তার বয়েস অনেক, দেহ হয়েছে জীর্ণ। তিন বছর আগে পূর্ব জার্মানিতে দেখেছি একই ছবি। জানালাগুলো ঠিকমত বন্ধ হয় কিনা সন্দেহ – এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় সেটা বেশ পীড়াদায়ক। কামরার দেওয়ালে রাশিয়ান ও জার্মানে লেখা আছে, ট্রেন হইতে কোনো বোতল বাহিরে নিক্ষেপ করিবেন না। শুধু বোতল কেন? অন্য কিছু নিক্ষেপ করা যেতে পারে? আনাকে জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে করলাম না। খানিক দূরে গালফ অফ ফিনল্যান্ডের জলরেখা দেখা যায়। যদিও নভেম্বরের শীতে জমে আছে পৃথিবী, অনুমান করে নেওয়া যায় বসন্ত এবং গ্রীষ্মে সাগরের নীল জলে সাদা পালের নৌকো চলে, বিচে সুখী জনতার সমাবেশ ঘটে। ট্রেন লাইনের বাঁ দিকে, প্রায় সমান্তরাল চলেছে গাড়ির রাস্তা। বরফ পড়ে এখন শ্বেতশুভ্র বর্ণ ধারণ করেছে।
সুইডেন বনাম রাশিয়ার চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা চলত এই অঞ্চলে। শেষ অবধি মহান পিটার কাপ জিতলেন তাঁর উত্তরের যুদ্ধশেষে (১৭১৪)। দু’শ’ বছর বাদে সেস্ত্ররেতস্ককে মহামতি স্টালিন এক দুর্ভেদ্য দুর্গ বানানোর প্রয়াস শুরু করেন। কালক্রমে এখানেই দেখা দেবে তাঁর আরেক শত্রু – ফিনল্যান্ড। আরও উপরে গেলে ভিবর্গ, যার স্থাপত্য একান্ত সুইডিশ, ভাষা রাশিয়ান। মালিকানা বদলেছে অনেকবার – সুইডেন, রাশিয়া, গ্র্যান্ড ডাচি অফ ফিনল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফিনল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়া! মাথা ঝিমঝিম করে সেই ইতিহাস শুনে।
পূর্ব ইউরোপের ধূসরতা আর সারিবদ্ধ দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি চোখ সওয়া হয়ে গেছে। সেস্ত্ররেতস্ক স্টেশন থেকে আনার বাড়ি অবধি হাঁটতে গিয়ে সেটাকে আরও কর্কশ মনে হল – বরফে ঢাকা পথ, একটা-দুটো গাড়ি চলে যায় তুষার ছড়িয়ে দিয়ে, গাছের পাতা ঝরে গেছে কবে। আজ তার কালো ডাল মুখব্যাদান করে আছে। পরের পর সমান উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। কোনো দোকান চোখে পড়ে না। আনার বাড়ির কাছাকাছি এসে বাড়ির একতলায় দেখা গেল একটি দোকান – রাধা সিনেমার পাশে দেখা সমবায়িকা এর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। আনা বললে, সরকারি মালিকানা এবং পরিচালনায় চলে দু’রকমের দোকান – যেটি সামনে দেখছি, সেটি শস্য-সবজি এবং সামান্য কিছু টিনের খাবার বেচে বাঁধা দরে। আরেকটু এগিয়ে গেলে আরেকটি সমবায়িকা, সেখানে জামাকাপড় – পছন্দের সুযোগ বিশেষ নেই। শার্ট পাবেন তিন অথবা চার রঙের, নির্ধারিত দামে। আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র মেলে অতি সামান্য। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই। জনতাকে সজ্জিত করাটা মূল কথা, ‘এসটাইল’ করা নয়। দু’দিনে আমি সেস্ত্ররেস্কে একটিও চায়ের দোকান দেখিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ভবিষ্যতের গর্ভে।
বাইরের তাপমান শূন্যের নীচে, কতটা নীচে তা জেনে লাভ নেই। চাবি দিয়ে আনা তার ফ্ল্যাটের দরোজা খুলতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা কথাটার মর্মার্থ বুঝলাম। ঘরের ভেতরটা রীতিমত গরম, কিন্তু কীভাবে? ইংল্যান্ডে আমরা সাধারণত যাবতীয় তাপ উৎপাদক ব্যবস্থা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরুই, নহিলে খরচ বাড়ে। খুব শীতের দিনে থার্মোস্ট্যাটে সাত-আট ডিগ্রি সেট করে গৃহত্যাগ করি। এর ফলে বাড়ি ঠিক গরম হয় না, তবে পাইপ জমে যায় না। ঠান্ডা যতই পড়ুক, সারাদিন পুরোদমে হিটিং চালিয়ে রাখার মতন রকিফেলার আমরা কেউ নই। বাড়ি ফিরে তাপমান উঁচুতে বসিয়ে দিই, আসতে আসতে ঘর গরম হয়। সময় লাগে। আমার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগল – আনা কি তার হিটিং একেবারে উঁচু মাত্রায় চালিয়ে রেখে গিয়েছিল সারাদিন? আমাদের সাধ্যে যা কুলোয় না? এরাই কি তাহলে সাম্যবাদী অর্থনীতির রকিফেলার?
ব্যাঙ্কিং বা অর্থনীতির মতন সোভিয়েত ব্যবস্থায় গৃহের উষ্ণতা নির্ধারিত এবং সরবরাহ হয় বাইরের তাপমান বা গৃহবাসীর প্রয়োজন অনুযায়ী নয়, এক কেন্দ্রীয় কমিটি দ্বারা। সেস্ত্ররেতস্ক শহরে জ্বলে কয়েকটি রাবণের চুল্লি – সেখানকার ফুটন্ত জল পাইপলাইন দিয়ে সব অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে ঘর উষ্ণ রাখে, বাথরুমের কল দিয়েও প্রবাহিত হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় স্থির করেন – কবে কোন উষ্ণতায় কত জল সরবরাহ করা হবে। লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন – সকল কৃষক, শ্রমিকের ঘরে সর্বদা মেলে উষ্ণ অভ্যর্থনা, তিনি গৃহে অবস্থান করুন বা না করুন। আমরা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবহার করি আপন প্রয়োজন বিধে। আমাদের গৌরী সেন নেই। মাসের শেষে সে খরচা আমাদেরই দিতে হবে।
রাশিয়ান গ্যাস না হয় সস্তা, তবু অবধারিত প্রশ্ন জাগে মনে – এটি কি অপচয় নয়?
শনিবার দিনটা সেস্ত্ররেতস্ক ঘুরে দেখা গেল। এই বেজায় ঠান্ডায় বিশেষ বোঝা যায় না, কিন্তু এই শহরকে জারেরা কারলোভি ভারির মতন একটি স্পা রেসর্ট বানাতে চেয়েছিলেন – সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে এখানে শ্রমিকদের ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খুব অবাক হলাম একটি সাইনবোর্ড দেখে – সিরিলিক ও ল্যাটিন অক্ষরে লেখা আছে কুরঅরট (Kurort)। কথাটা জার্মান – কুর মানে আরোগ্য, অরট মানে শহর, তার মানে সেই স্পা। বেলজিয়ামে স্পা নামে একটি শহর আছে বটে, তবে সেটি ব্যতিক্রম। জার্মান কোনো শহর বা গ্রামের নাম কুরঅরট হতে পারে না – আরোগ্যের আগে বা পরে একটা জায়গার নাম থাকা আবশ্যক।
শনিবার ছুটির দিন। দেখা গেল সেস্ত্ররেতস্কে চেনা মানুষের ফ্ল্যাটে গিয়ে অনায়াসে করাঘাত করা যায়, বেল বাজানো যায়, ঠিক আমাদের মতন – আরে কী করছেন? কাক দেলা? আমার এক বন্ধু এসেছেন সেস্ত্ররেতস্কে, তাকে নিয়ে এলাম আলাপ করাতে! লন্ডনের লোক!
দীর্ঘদিন পশ্চিম ইউরোপে বসবাসের ফলে প্রোটোকলের বন্ধনমুক্ত বাঙালি জীবনচেতনা হারিয়ে ফেলেছি। একটা সময় ছিল, যখন রবিবারে পাইকপাড়ার বাড়িতে ঘনঘন বেল বাজত। মা এসে জিজ্ঞেস করতেন, চা মিষ্টি দেব? সেই দিন ফেলে এসেছি বহুকাল।
অয়মারম্ভ।
দু’বছর আগে লৌহ যবনিকা পার হয়ে পোল্যান্ডের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে প্রথম আলাপে তাদের উষ্ণ হৃদয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম। মনে হল, সেই গুলতানি যেন এখানেও ‘চালু আহে’! পরে হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, এস্টোনিয়া-র মত আমার শ্বশুরবাড়ির দেশেও পাব অবারিত আতিথ্য।
আমার কাছে চেক ও লিথুয়ানিয়া বিশাল ব্যতিক্রম, তবে সে প্রসঙ্গ বারান্তরে।
সাম্যবাদী দেশের ফ্ল্যাটগুলির চেহারা, বিন্যাস একই মাপের। সদর দরোজা দিয়ে ঢুকে অনায়াসে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় রান্নাঘরটা কোথায়। ওলেগ এবং তার স্ত্রী ওলগা দু’টি শয়নকক্ষের অধীশ্বর। কোনো অজ্ঞাত কারণে তার বৈঠকখানা একটু বৃহত্তর মনে হল। সেদিনের সন্ধ্যায় ওলেগের আড্ডায় সমবেত বেশ কয়েকজন যাদের সঙ্গে আমার সদ্য পরিচয় হয়েছে সেদিন সকালে। যদিও এঁরা সকলেই সেস্ত্ররেতস্কের বাসিন্দা, কেউ কেউ এসেছেন অনেক দূরের শহর থেকেও – যেমন কাজান, গরকি, কুরস্ক। কিন্তু সকলেই রাশিয়ান। বয়েস হয়তো তিরিশের আশেপাশে, নিকটবর্তী হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার অথবা নার্স। ওলেগ তাদের মধ্যে পদমর্যাদায় সিনিয়র, ঠাট্টা করে তাকে চিফ বা গ্লাভনি (কানে শুনে মনে হয়েছে) বলে ডাকে অনেকে।
প্রথমে সোফায় বিশ্রম্ভালাপ নয়, একেবারে সরাসরি টেবিলে বসেছি ইরিনা, আনা, আন্তন, এলেনা, ওলেগ এমনি কয়েকজন। দু’পক্ষের ঔৎসুক্য অন্তহীন। অনুরোধের আসরে সওয়াল-জবাব চলল অবিরল ধারায়। রাশিয়া আগে এসেছি কিনা – এ প্রশ্নের উত্তরে গর্বের সঙ্গে বলেছি, “হ্যাঁ, এই তো মুরমানসক গেছিলাম গত বছর”। একটু অবাক হয়ে তাঁরা আমাকে নিরীক্ষণ করলেন – ভাবলেন গুল দিচ্ছে না তো। ইরিনা বললে, “কেন গেছিলেন?” এই প্রশ্নের ভেতরে কেজিবি-র (ততদিনে এফএসবি) কোনো বাণ নিহিত আছে কিনা ভাবছি, এমন সময়ে টেবিলে প্রভূত সবুজ শাকসবজি ভর্তি ছোট ছোট প্লেটের আবির্ভাব হল। শাক-মুলো অন্তত চিনলাম। সেগুলো নিয়ে কী করব? শুধু মুখে চিবিয়ে খাব? ভ্রমণে বিশ্ববিজয়ী আমার বড়দাদা বলেছিলেন, টেবিল ম্যানারস শিখবে পাশের লোককে দেখে। সে যা করছে, সেটাই কর তিরিশ সেকেন্ড বাদে। সকলকে দেখলাম শাক-মুলো চিবুতে। কিন্তু ভদকা কত দূরে?
যে পানীয় প্রস্তুত করার গৌরবে এ দেশ অমরত্বের দাবি রাখে, অকস্মাৎ ছোট ছোট গ্লাসে রাশিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ পানীয় আমার সামনে উপনীত হল। গ্লাসের আকৃতি দেখে ভাবলাম, ভদকা তুমি এত ছোট কেনে? সকলেই সেটি দ্রুত পান করলেন। গ্লাসগুলি টেবিল থেকে অদৃশ্য হল মুহূর্তের মধ্যে।
গরুর ঘাস থেকে মানুষের স্টেজে উঠলাম। এবার আগমন আলুসেদ্ধ গোছের কিছু, তার সঙ্গে বাঁধাকপি। সেগুলো টেবিলে রাখা হয়েছে কি হয়নি, কে বা কারা আবার আমার সামনে হাজির করলেন ভদকার ছোট গ্লাস। মানে কী? এঁরা কি এইভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে ভদকা পান করেন? প্রশ্নটা ডাক্তার সাহেবের জন্যে জমিয়ে রাখলাম।
মাংসের কোনো রান্না এল। তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করার আগেই আবার আবির্ভূত হল সেই ছোট গ্লাসের ভদকা। এমনি চলতে থাকে সারা সন্ধে। ডাক্তার ওলেগ আমাকে পরে বুঝিয়েছিলেন, ভদকা কখনো খালি পেটে খাবেন না। ঐ শাক-মুলো দিয়ে শুরু করে বারে বারে একেকটা পদের সঙ্গে ভদকা পান করবেন। আরেকটা কথা – ভদকা আলু থেকে প্রস্তুত বিশুদ্ধতম অ্যালকোহলিক উৎপাদন। এর সঙ্গে কোনো প্রকারের ভেজাল মেশানো হারগিজ মানা। সেটা ভদকার অপমান।
সম্প্রতি নতুন রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন জার্মানি সফরে গিয়ে ভদকাগ্রস্ত হয়ে তাঁর সম্মানে আয়োজিত মিলিটারি ব্যান্ডের অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে বিদেশীদের কৌতুক এবং রাশিয়ানদের বিড়ম্বনার কারণ হয়েছেন। ওলেগ বললে, এটাই হল ভদকা নিয়মাবলী না মানার পরিণাম!
তিন ধাপে তিন রকম খাবারের সঙ্গে ছোট মাপের গ্লাসে বন্দনা শেষ হলে ‘পর, স্বয়ং ভদকা রূপিণী ভাগীরথী ধরাতলে অবতীর্ণ হলেন শ্বেতশুভ্র বসনে। কখন যে রজনীর মধ্য যাম অতিক্রান্ত হয়েছে জানি না, গল্পের স্রোতে ভাঁটা পড়েনি।
সেই সন্ধ্যের পরে আঠাশ বছর কেটে গেছে। পানশালায়, পার্টিতে আমার আশেপাশে কেউ ভদকা অরেঞ্জ বা ভদকা কিছু অর্ডার করলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। বলেছি ওয়াইনের সঙ্গে যেমন জল চলে না, তেমনি ভদকাতেও কিছু মেশাতে পারেন না! এতে তার ঘোর অপমান হয়। রাশিয়া মাতার নামে শপথ করে বলি – খাঁটি রাশিয়ানদের সঙ্গে টেবিলে বসে আমি এ শিক্ষা অর্জন করেছি! ভদকার এই অসম্মান আপনারা করতে পারেন না!
চোরার কথা বাদ দিন, নিজের ছেলেমেয়ে এ ধরম কাহিনি শোনেনি।
সে রাতে গালফ অফ ফিনল্যান্ড থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাসে আপ্লুত সেস্ত্ররেতস্কের নির্জন পথ দিয়ে আনার সঙ্গে তার আস্তানায় হেঁটে ফিরেছি। তখন রাত দুটো। পরের দিন সকালে মাথা পরিষ্কার, মন ঝরঝরে!
রাশিয়ান আড্ডায় ভদকার উপস্থিতি অনিবার্য, কিন্তু পান প্রথায় তাকে যথাযথ শ্রদ্ধা অর্পণ করলে হ্যাংওভার নাস্তি।