সিটি ব্যাঙ্ক নিউ ইয়র্কের সহকর্মী লিসা গোল্ডম্যানের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম।
গত শতাব্দীতে জুতো-পালিশওয়ালারা ম্যানহাটানের পথ শোভা বিবর্ধন করত। কাল: দ্বিতীয় দশক। শেয়ার বাজার গরম। সকালবেলা তরুণ নেলসন জুতোর ফিতে বাঁধছে, অফিসে বেরুবে। তার বাবা জন রকিফেলার বললেন “নেলসন, আজকাল শেয়ার বাজার খুব চড়া আর উপদেষ্টার অভাব নেই। তবে তোমাকে যখন ওয়াল স্ট্রিটের জুতো-পালিশওয়ালা বলবে, গাভ, জেনারেল মোটরসের শেয়ার কিনুন, জানবে সেই শেয়ার বিক্রি করার সময় এসে গেছে।”
ভেড়ার দল নাকি একসাথে একমুখে দৌড়োয়। নয়ের দশকে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গেল মস্কোয়। যে কোনো সকালে হিথরোর বিজনেস লাউঞ্জে পাঁচটা চেনা মুখ চোখে পড়ে। আমাদের একই ফ্লাইট। কে কোন সোনার খনির উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়েছে সেটি জানবার অবিশ্যি উপায় নেই – ওয়াল স্ট্রিটের জুতো পালিশওয়ালার মতো জ্ঞান দেওয়ার লোকের কমতি নেই বাজারে।
হে রুশিয়া, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন! মস্কোর পথে পথে ছড়ানো।
ক্যালিফোর্নিয়ায় গোল্ড রাশের কালে কিছু মানুষ সোনা পেয়েছেন, অনেকে হেরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সেদিন আসল পয়সা বানিয়েছেন লেভি জিনস আর পাথরের টুকরো জলে ছেঁকে সোনা খোঁজার পাত্র বা প্যান বানানোর কোম্পানি (যা থেকে প্যানিং ক্রিয়া পদ এসেছে)। সে দুটো বিজয়ী এবং বিজিত উভয়পক্ষের প্রয়োজন।
নাপোলেওঁ এবং হিটলারের মস্কো অভিযানের ব্যর্থতার একটা প্রধান কারণ – সাপ্লাই লাইনের দুর্বলতা। এবারের রাশিয়ান অভিযানে পশ্চিমি বাহিনির এয়ারলাইন, হোটেল এবং সংশ্লিষ্ট আরও অনেক কিছুর সাপ্লাই অন্তহীন।
সিটি ব্যাঙ্কের ক্রেডিট গুরুরা কিঞ্চিৎ শঙ্কিত। একাধিক কর্পোরেটের ঋণ যোগাড় করেছি - কোনো ব্যাঙ্কের ব্যবসায় ঢুকতে মানা। কিন্তু নানা মুনির নানা মত। ব্যাঙ্কিং অরণ্যে আরও অনেক মুনি ঋষির বাস – তাঁদের আশীর্বাদে রাশিয়ান ব্যাঙ্কের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থ সংগ্রহের পুণ্য প্রয়াসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কিছু প্রতিষ্ঠান।
খেলা ভাঙবে শিগগির – আকাশে রক্তিম রেখা কেউ দেখেছেন, কেউ দেখেননি।
টোকো ব্যাঙ্ক
১৯৯৬ নভেম্বর - ১৯৯৭ জানুয়ারি
ব্যাঙ্কারস ট্রাস্ট, আমেরিকান এক্সপ্রেস, সেউল ব্যাঙ্ক, কোরিয়া মারচেন্ট ব্যাঙ্ক, লন্ডন ফরফেটিং কোম্পানি, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্ক, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইজারল্যান্ড, ইত্যাকার মহারথীরা এক সংযুক্ত ঋণ পত্রে সই করে সাড়ে আট কোটি ডলার দিলেন টোকো ব্যাঙ্ককে। বিরাট ধুমধাম করে সই সাবুদ হল। সিটি ব্যাঙ্ক অনুপস্থিত।
ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক টোকো ব্যাঙ্কের বার্ষিক হিসাব পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় কিছু বেয়াড়া ব্যাপার লক্ষ করলেন। কোনো কোনো ঋণের সুরক্ষা হিসেবে বিচিত্র বস্তু দেখা গেল। সাইবেরিয়াতে দুর্গম জায়গায় পার্ক করা বুলডোজারকে বন্ধক রেখে মস্কোতে টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। এমনি আরও অনেক গোঁজামিল। ব্যাপার গুরুতর বুঝে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অন্যান্য রাশিয়ান ব্যাঙ্ককে ডাকলেন এটিকে অধিগ্রহণ করার জন্য। তাঁরা এলেন। খাতা খুলে দেখলেন। আরও চিন্তিত হয়ে খাতা বন্ধ করে চলে গেলেন। টোকো ব্যাঙ্ক বিক্রি হল না। দোকানটাই বন্ধ হয়ে গেল।
ঋণদাতাদের স্বাক্ষর সমারোহের খরচা ওঠেনি – এমন কথা দুর্জনে বললেন।
ইনকম ব্যাঙ্ক
মে ১৯৯৮
দের আয়ে পর দুরুস্ত আয়ে। সিটি ব্যাঙ্কের চির প্রতিদ্বন্দ্বী চেজ ম্যানহাটান পেছনে পড়ে থাকবে কেন? একটি পাঁচ কোটি ডলারের ঋণ পত্র সফলতার সঙ্গে ছাড়লেন বাজারে। ঋণ গ্রহীতা ইনকম ব্যাঙ্ক, টপ ফোর ব্যাঙ্ক। তার মালিক এক অলিগার্ক, ভিক্টর ভিনোগ্রাদভ। আগস্ট মাসের তুল কালামের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ১০ কোটি ডলার ধার দিয়ে সেই ব্যাঙ্ককে ডুবে যাওয়া থেকে সাময়িক ভাবে উদ্ধার করে। কিন্তু তাঁদের খাতাপত্র তল্লাশি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেখে যে জুন, জুলাই ১৯৯৮ সালে তারা অত্যন্ত কিছু গোলমেলে ঋণ দিয়েছেন। এর বছর দেড়েক বাদে আধমরা অস্তিত্ব টুকুকে ঘুচিয়ে দিয়ে ইনকম ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হল। ভিনোগ্রাদভ এ শক সামলাতে পারেননি। মারা যান দু’ বছরের ভেতরে।
মেনাতেপ ব্যাঙ্ক
জুন ১৯৯৮
দীর্ঘ দিনের বন্ধু মারটিন চুরদা তখন রাইফআইজেন নামক অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক লগ্নির ব্যাপার দেখে। একদিন ফোন করে জানতে চাইল আমরা মেনাতেপ ব্যাঙ্কের ঋণে যোগ দেব কিনা। তারা সেই ব্যাঙ্কের জন্য তিন কোটি ডলার বাজার থেকে তোলার ম্যানডেট বা আদেশ পত্র পেয়েছে। সাধারণত এমন আমন্ত্রণ সেকালে টেলেক্স দ্বারা আসত। তবে নিতান্ত বন্ধুজনের মধ্যে আমরা আগে ভাগে যাচাই করে নিতাম কার কতটা আগ্রহ। বাজারের হাওয়া বোঝার সুযোগ – মার্কেট রিড। আমি মারটিনকে বললাম, জানি মেনাতেপ তখন রাশিয়ার ষষ্ঠ বৃহৎ ব্যাঙ্ক। কিন্তু আমাদের ব্যাঙ্কের ঋণ দান বা ক্রেডিট দফতর রাশিয়ান ব্যাঙ্কগুলির সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক প্রসারের ক্ষিপ্রতা দেখে একটু শঙ্কিত হয়েছেন। আমরা বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের জন্য আগেই কিছু ঋণ সংগ্রহ করেছি। তবে এখন একটু বিলম্বিত লয়ে চলাই ভালো। আসিবে সময়, তখন আবার দেখা যাবে।
মারটিন আমাকে কন্সতান্তিন কাগালোভস্কি সম্বন্ধে অবহিত করল। তিনি আগে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনের (আই এম এফ) রাশিয়ান কর্তা ছিলেন। ১৯৯৪ সালে সেই পদ ত্যাগ করে কাগালোভস্কি বর্তমানে আছেন মেনাতেপ ব্যাঙ্কের শীর্ষে। এমন সন্দেহাতীত দক্ষ মানুষ পদাধিকারী হলে সে ব্যাঙ্কের সম্মান বাড়ে। কিন্তু আমাদের ক্রেডিট কর্তারা রাশিয়া সম্পর্কে ক্রমশ সন্দিহান হচ্ছেন। কেবলই বলেন, নানান নম্বর তো দেখছি। খুব ব্যবসা বাড়াচ্ছে তাও দেখছি। কিন্তু তার পিছনে ঠিক যে কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না – তাই রাশিয়ান ব্যাঙ্কগুলির সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতিমধ্যে আরও একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল – নানান ব্যাঙ্কে, কনফারেন্সে মেরে কেটে বছর তিরিশ চল্লিশের এমন সব রাশিয়ানের সঙ্গে নিত্যি পরিচয় হচ্ছে, যারা নিজেদের বৈদেশিক বিভাগ বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিঙের মাথা বা গ্লোবাল হেড বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তেঙ্গিজকে চিনতাম – দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্কের লন্ডন শাখায় ঋণ বিভাগে ছিল। মস্কোর এক মিটিঙে সে তার কার্ড এগিয়ে দিল – এমডিএম নামের একটি রাশিয়ান ব্যাঙ্কে সে গ্লোবাল হেড।
দশ বছর বয়েসে মোজার্ট সিম্ফনি লিখেছেন, কারু কাছে পাঠ না নিয়ে। সেটি প্রশ্নের অতীত – তাকে প্রতিভা বলে মানি। কিন্তু ব্যাঙ্কিং-এ খানিকটা অভিজ্ঞতার হয়তো প্রয়োজন আছে। যদিচ ব্যবসা বাড়ানোতে আমরা অত্যন্ত আগ্রহী, কিন্তু ক্রেডিট দফতরকে পথের বাধা বলে মনে করিনি। হয়তো এটা নিতান্ত ভাগ্যের কথা। স্বল্প সময়ের ভেতরে এই ঘটনাগুলি ঘটল –
কাগালভস্কির স্ত্রী নাতাশা গুরফিঙ্কেল কাগালোভস্কা ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্কে পূর্ব ইউরোপ বিভাগের কর্ত্রী ছিলেন। হিসেব থেকে ৫০ কোটি ডলার অদৃশ্য হবার ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল – এই সন্দেহে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। রাশিয়ান মাফিয়ার অন্যতম প্রধান সিমিওন মগিলোভিচের কালো টাকা সাদা করার কাজে নাতাশা ব্রতী ছিলেন বলে শোনা গেল। ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্ক যে ঠিক কী পরিমাণ রাশিয়ানের কত কালো টাকাকে সাদা করেছে তার সম্পূর্ণ হিসেব কখনো পাওয়া যাবে না। (১)
কাগালোভস্কির বিরুদ্ধে মকদ্দমা রুজু করা হয়। আইএমএফ ৫০০ কোটি ডলারের যে আর্থিক সাহায্য রাশিয়াকে দিয়েছিল, তার একটা বিশাল অংশ রাশিয়ান সরকারের কাছে পৌঁছায়নি। সেটি ওই ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্কের কোন গোপন গহ্বরে ঢুকে গেছে। পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতে দাবী করেন রাশিয়ার সহায়তার জন্য প্রদত্ত আই এম এফের বিশাল ঋণের সবটাই ১৮টি রাশিয়ান ব্যাঙ্ক কোনো না কোনো ভাবে হজম করেছে। তিনি এও বললেন, কিছু মাফিয়া সুলভ লোক এক প্রকাণ্ড লুটপাটের তাণ্ডব চালাচ্ছেন। তার সামনে দেশ ও আইন পঙ্গু।
ন্যান্সি টুওমি (উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ পশ্য) নামের এক আমেরিকান ব্যাঙ্কারকে চিনতাম, পূর্ব ইউরোপের পথেঘাটে হোটেলের লবিতে সাক্ষাৎ হত। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনের রিপাবলিক ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের পূর্ব ইউরোপীয় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি ও তাঁর দপ্তরের সবাই কাজ হারালেন।
মেনাতেপ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হল।
বহু বছর বাদে মারটিন ও আমি একটি অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কে একত্র কাজ করি। সে ছিল সিইও, আমি তার বোর্ড ডিরেক্টর। অতএব মারটিনকে ধমকানোর অধিকার ছিলো! মেনাতেপের গল্প নিয়ে খোঁচা দিতে একদিন মারটিন বলল, তোমরা আর যাই বল, আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহের জগতে আমার রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। তিন কোটি ডলার বাজার থেকে তুলেছি। আমাদের রাইফআইজেন ব্যাঙ্কে হইচই পড়ে গেছে তখন। আমেরিকান ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্ক রাশিয়ান ঋণের ম্যানডেট যোগাড় করে টাকা তুলতে সফল। এবার সেটির সই সাবুদ করাতে হবে। ভিয়েনা থেকে ঋণপত্র, উকিল সহ প্লেনে উঠেছি। মস্কো গিয়ে অনুষ্ঠান করব। মেনাতেপ ব্যাঙ্ক সেই ঋণ পত্রে সই করবে – হোটেলের কনফারেন্স রুম, অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রেডি। তারপরে খাওয়া দাওয়া, ভদকা চলবে। মস্কোতে নেমে জানলাম মেনাতেপ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে! এয়ারপোর্ট ছাড়বার প্রয়োজন হয়নি। বিমান বন্দরেই অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্সের জানলায় গিয়ে ভিয়েনা ফেরার সিট বুক করেছি!
অতি লোভে
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার নিজের নয়, অপরের পয়সা বিনিয়োগ করেন, মাঝের দইটুকু নেপোর মতন মারেন। যেমন চার্লি মিলওয়াকি পৌরসভার পেনশন ফান্ডকে রাশিয়ান সরকারি ঋণপত্র বেচে তাঁর বোনাস আদায় করেছিলেন। সে ঋণ ডুবলে চার্লির বোনাস কাটা যায় না।
লোভ বেড়ে গেলে ব্যাংকার আপন মূলধন লাগান, যাকে বলে নিজের খাতায় লেনদেন। এই কম্মটি যে বিভাগে করা হয় তার নাম সেলস অ্যান্ড ট্রেডিং। তুখোড় বিক্রেতারা যে কোনো জিনিস নিয়ে কেনাবেচা করতে পারেন – আলাস্কার আবহাওয়া, পেরুর মাছ থেকে সৌদি তেল, আপনার ই এম আই। আলাস্কার আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে কোনো লেনদেন এতাবৎ না হয়ে থাকলেও এঁরা নিজেরাই বাজার তৈরি করে নেবেন। যে বস্তুটির নাম কেউ শোনেনি, চেহারাটা অবধি জানে না, সেটাও লোকে কিনে ফেলে লাভের আশায়। এই যেমন আজকের বিট কয়েন।
ঠিক দশ বছর বাদে বাড়ি বন্ধকের কাগজ এবং তা থেকে বানানো বন্ড কেনাবেচা করে এঁরা ডেকে আনবেন আরেক অর্থনৈতিক দুর্যোগ – উনিশশ’ তিরিশের বিশ্বমন্দার পরে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কট।
এইটথ এভিনিউর আশি নম্বর বাড়িতে আমাদের সেই চার্লির অফিসের তিন তলায় বসে ব্যাংকারস ট্রাস্টের ট্রেডার গুষ্টি এই লাভজনক ব্যবসাটির ওপর নজর রাখছিলেন। রাশিয়া সম্বন্ধে জ্ঞান গম্মি তাঁদের নেই, কিন্তু সরকারি ঋণপত্র কিনলে যদি ৮৫% বা ১৫০% সুদ মেলে, সে লাভের গুড় অন্যেরা কেন খাবে? আমরাও তো খেতে পারি। ট্রেডারদের নেতা রাশিয়ান সরকারি ঋণপত্রের ব্যবসায়ে আপন মূলধন লগ্নি করার ও স্বল্প মেয়াদি রাশিয়ান ঋণের ঊর্ধ্ব সীমা বাড়ানোর আকুতি নিয়ে হাজির হলেন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরদের কাছে। শুভ লাভের দুর্বার বাসনায় ডিরেক্টররা বললেন – তথাস্তু। ট্রেডার তোমরা এগিয়ে চল। আমাদের ব্যাঙ্ক নিজের খাতায় একটি বিশেষ অঙ্ক অবধি ঝুঁকি নেবে। তবে বাপু মনে রেখ, নব্বুই দিনের মধ্যে এটি বেচে দিতে হবে। এত বলি ডিরেক্টররা পরবর্তী ব্যাঙ্কের পরবর্তী ডিভিডেন্ডের হিসেব নিকেশ করতে বসলেন।
ট্রেডাররা ভাবি বোনাসের পরিমাণ গুণে পরশে ও ফেরারি গাড়ি আগাম বুক করলেন।
গেকোর সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা, দিনের বেলা।
১৭ আগস্ট ১৯৯৮: সে খেলা ভেঙে গেল – রঙ্গমঞ্চ অন্ধকার।
অক্টোবর ১৯৯৮ সালে আমেরিকার সপ্তম বৃহৎ ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্কারস ট্রাস্ট তাঁদের ত্রৈমাসিক রিপোর্টে জানালেন জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে তাঁদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ডলার – প্রায় একশ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। এর প্রায় সবটাই রাশিয়ান ঋণপত্রের ট্রেডিঙের কারণে।
ব্যাঙ্কারস ট্রাস্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯০৩ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে। বিশ্ব ব্যাঙ্কিঙের প্রবাদ পুরুষ জন পিয়েরপনট মরগান এর অন্যতম হোতা। তাঁদের ব্যবসার পরিচয় নামের ভেতরেই আছে- ট্রাস্ট, অর্থাৎ জনগণের, সরকারের গচ্ছিত মূল্যবান কাগজপত্র সাবধানে সামলানো। পরে তাঁরা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কিং শুরু করেন, আপনার আমার কাছ থেকে টাকা জমা রেখে যদু মধুকে ধার দেওয়া, বন্ধকি কারবার। তার সঙ্গে যোগ হল বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা যার নাম হোলসেল ব্যাঙ্কিং। ১৯৯৭ সালে কেনা হল আরেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক – ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলেক্স ব্রাউন। নতুন নাম হল বি টি আলেক্স ব্রাউন। ১৯৯৮ সালের রাশিয়ান অভিযানে চূড়ান্ত ব্যর্থতার ফলে ব্যাঙ্কারস ট্রাস্ট সকলের ট্রাস্ট বা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে আপন সত্ত্বা খুইয়ে জার্মানির ডয়েচে ব্যাঙ্ক দ্বারা কবলিত হয়। ব্যাঙ্কিং জগত থেকে বি টি আলেক্স ব্রাউন নামটি বিদায় নিয়েছে।
লিভারপুল ফুটবল দলের বন্দনা গীতির প্রথম পংক্তি – কখনো একাকি হাঁটিও না (ইউ নেভার ওয়াক অ্যালোন)।
ব্যাংকারস ট্রাস্ট মস্কোর বাজারে একাকি মরণখেলায় নামেনি। নিউ ইয়র্ক লন্ডন জুরিখের বহু সম্মানিত প্রতিষ্ঠান এই লঙ্কাকাণ্ডে মুখ পুড়িয়েছেন। সেখানে কেবলমাত্র পরের ধনে পোদ্দারি করা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক নয়, আপনার আমার টাকা আমানত নেওয়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও সামিল ছিলেন। নিউ ইয়র্কের সলোমন ভ্রাতৃবৃন্দ ওই জুয়ো খেলে দশ কোটি ডলার, জে পি মরগান ষোল কোটি, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা বাইশ কোটি, রিপাবলিক ব্যাঙ্ক এগারো কোটি, পূর্ব উপকূলের ছোট্ট বোস্টন ব্যাঙ্ক তিন কোটি ডলার লোকসান করলেন। মেরিল গোল্ডম্যান ততোধিক। ব্যাঙ্কিং নামক জুয়ায় যে কোনো আমেরিকান মনোপলি নেই সেটি প্রতিপন্ন করলেন জুরিখের তথাকথিত রক্ষণশীল ব্যাঙ্কাররা – ছ’ মাস বাদে ক্রেদি সুইস ফার্স্ট বোস্টন একশ’ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইজারল্যান্ড প্রায় সত্তর কোটি ডলার রাশিয়ান ব্যবসায় লোকসান করেছেন বলে জানালেন।
এল টি সি এম (লং টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট) নামক একটি হেজ ফান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। এঁরা আপনার আমার টাকা নিয়ে (ন্যূনতম পঞ্চাশ লক্ষ ডলার অ্যাকাউন্ট পিছু) আপন বুদ্ধিতে সেই টাকা নানান ক্ষেত্রে খাটিয়ে মূল টাকার বহুগুণ বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কীভাবে? সে প্রশ্ন করবে কোন বাতুল? আপনার ধন কেমন ভাবে নিবেশিত হবে তার স্ট্রাটেজি তৈরি করেছিলেন ফান্ডের দুই ডিরেক্টর – অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত মাইরন শোলস এবং রবার্ট মেরটন। নোবেল বিজেতারা আম জনতাকে জানালেন, নির্ভয়ে থাকুন। আমাদের নিবেশন কৌশলটি এমনই ফলপ্রসূ এবং অভ্রান্ত, যে কোনো ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বিপর্যয় না ঘটলে আপনাদের অর্থ এবং তার মুনাফা সুনিশ্চিত থাকবে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী এ ধরণের ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এক শতাব্দীতে একবার মাত্র ঘটতে পারে।
চার বছর বাদে রাশিয়াতে প্রভূত লোকসান করে এল টি সি এম তাঁদের গ্রিনিচ কানেকটিকাটের অফিসে তালা দিলেন।
অন্যত্র
বব ডায়মণ্ড নামক এক প্রবাদ প্রতিম আমেরিকান সে সময়ে তিনশ’ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ ব্যাঙ্ক বারক্লেসের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের প্রধান আধিকারিক। চুটিয়ে ট্রেডিঙ চালাচ্ছেন রাশিয়া সহ ইউরোপের সর্বত্র – বিস্তর প্রফিট। ব্যবসা বাড়ানোর অভিপ্রায়ে অধিকতর ঋণ মঞ্জুরির জন্য বারক্লেস বোর্ডের কাছে নিয়মিত আবেদন করে চলেছেন বব। তাঁর বিভাগের মাসিক লাভের পরিমাণ দেখে অতি প্রসন্ন বোর্ড সেই সীমা বাড়িয়ে যাচ্ছেন।
১৭ই আগস্ট ১৯৯৮ যখন রাশিয়ান সরকার তার আপন রুবল ঋণ শোধে অক্ষমতা প্রকাশ করলো, বারক্লেস সি ই ও মারটিন টেলর হিসাব রক্ষক প্যাটরিক পেরিকে ফোন করে বললেন এতে বারক্লেসের বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে বলে তিনি মনে করেন না। বারক্লেস ধার দেয় ডলারে, রাশিয়ান রুবলে নয়। পেরি তাঁকে জানালেন ঘটনা সঙ্গিন। বারক্লেসের খাতায় অনাদায়ী রাশিয়ান রুবল লোনের পরিমাণ বিশাল। বব ডায়মণ্ড তাঁর দফতরে শুধু যে রুবলের বিরাট খেলা খেলছিলেন তাই নয়, বাজার ঘুরে গেলে এই লোকসান লুকিয়ে রাখার জন্য ট্রেডারদের আদেশ দিয়েছিলেন তারা যেন এগুলোকে সুইস বা জার্মান নামে বুক করে। এর চেয়ে অনেক সামান্য ভুলে কাজ হারিয়েছেন অনেকে। বব ডায়মণ্ড প্রোমোশন পেয়ে একদিন বারক্লেস ব্যাঙ্কের কর্ণধার বা সিইও হবেন। (২)
মারটিন টেলর লিখেছেন বব ডায়মণ্ডকে সেদিন চাকরি থেকে দূর না করে দেওয়াটা তাঁর কর্ম জীবনের সবচেয়ে বড় অনুতাপ। (৩)
রাশিয়ান রুলের খেলায় কোটি কোটি ডলারের লোকসান করে ব্যাংকার ট্রাস্ট থেকে শুরু করে গোল্ডম্যান, চেজ, ক্রেদি সুইস, ইউ বি এস, জে পি মরগান রাশিয়া থেকে ল্যাজ গুটিয়ে প্রস্থান করেছেন, কেউ জেলে যান নি। বাৎসরিক মাইনে হয়তো তেমন বাড়েনি বা বোনাস কাটা পড়েছে সে বছর। তাতে আর কী, আসছে বছর আবার হবে।
টুমরো ইজ অ্যানাদার ডে।
রাশিয়ার শিক্ষা
শোলস/মেরটেনের শতাব্দী কাঁপিয়ে দেওয়া ঘটনা? লেনিনের অভিশাপ?
একদিকে ভেঙে পড়ল বাজারি দুনিয়াতে সদ্য পা রাখা রাশিয়ান অর্থ ব্যবস্থা। অন্যদিকে এই অগ্নিকাণ্ডে হাওয়া দিতে কোনো কসুর করেননি লন্ডন নিউ ইয়র্কের ব্যাঙ্কিং বীরবৃন্দ। মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যে মস্কো দেখল সেই বাজারে জুয়ার দান লাগাতে আসা বহু বিশ্ববিখ্যাত ব্যাঙ্ক ও তার নেতাদের আগমন ও প্রস্থান। বিশাল পরিমাণ লোকসান হজম করে প্রায় দু’শ’ বছর আগের ফরাসি ও সাতান্ন বছর আগের জার্মানদের পদচিহ্ন ধরে তাঁরা স্বস্থানে প্রস্থান করেন বা মস্কোতে আপন কর্মপ্রবাহকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনেন।
সিটি ব্যাঙ্ক টিকে রইল তার নিতান্ত বিরক্তিকর একঘেয়ে কায়দার ব্যাঙ্কিং ব্যবসা নিয়ে ।
ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ ক্রেডিট গুরু, দীর্ঘদেহী শীর্ণকায় আর্ট (আর্থার) গ্র্যান্ডিকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম –
কী দেখেছিলেন?
উত্তরে হেসে বলেছিলেন, “কী দেখেছিলাম? দেখেছিলাম তোমাদের মত চট করে খ্যাতি ও বোনাস অর্জনের প্রয়াসে সমবেত নির্মম লোভী মূর্খ কাউবয়দের! তোমরা বাছা ডিলটি করে কেটে পড়বে। ব্যাঙ্কের দীর্ঘ মেয়াদী স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব যে আমাদের!” (৪)
ফুটনোট:
(১) লন্ডনে চেলসির বিখ্যাত কিংস রোডে কনসতানতিন কাগালোভস্কি তাঁর স্ত্রী নাতাশার সঙ্গে যে বাড়িতে পুত্র ফিলিপের সঙ্গে গত পনেরো বছর যাবত বসবাস করছেন তার নাম স্ট্যানলি হাউস। সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো এই বাড়িটি একদা ব্রিটিশ রাজবংশের মালিকানাধীন ছিল। কাগালোভস্কি এটি কিনেছিলেন দেড় কোটি ডলারে, সংস্কারে ব্যয় হয়েছে আরও এক কোটি ডলার। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউনট খুলতে কোনো অসুবিধে হয়নি। লন্ডনের ব্যাঙ্কাররা কখনো তাঁদের জল, বিজলির বিল বা স্যালারি স্লিপ দেখতে চাননি, আয়ের সূত্র নিয়ে প্রশ্ন করেননি।
(২) চোদ্দ বছর বাদে বারক্লেস ব্যাঙ্ক সি ই ও বব ডায়মন্ড একদিন সকালবেলা অফিস যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময়ে দু’জন দূত দুয়ারে এসে হাজির। তাঁরা বার্তা দিলেন – ববের আর বারক্লেস ব্যাঙ্কের অফিসে যাবার প্রয়োজন নেই। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড তাঁকে সে পদে দেখতে চান না। আচানক বারক্লেস ব্যাংক থেকে বিতাড়িত হয়ে আফ্রিকায় ব্যাংকিঙের বিকাশ প্রকল্পে মনঃসংযোগ করলেন। নতুন ব্যাঙ্কের নাম অ্যাটলাস মারা। তার লঞ্চের সময় ওয়াশিংটনে একটি পার্টিতে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম ববের অফিস থেকে। স্থান: হে অ্যাডামস হোটেল, হোয়াইট হাউসের সদর গেটের ঠিক উলটোদিকে। সেদিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কঙ্গো এবং জিমবাবোয়ে বাদে সকল আফ্রিকান রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে বিশাল মিটিং করেছিলেন – হোয়াইট হাউস থেকে দু’ মিনিটের দূরত্বে এই সভায় পদধূলি দিলেন কয়েকজন। অ্যাটলাস মারা ব্যাঙ্কটি ধুঁকছে এখন। বিক্রি হতে হতে যেটুকু বাকি আছে, তার দশ ডলারের শেয়ার নয় সেন্টে পাওয়া যায়।
(৩) আই টু ফেল ফর ডায়মন্ড মিথ – মারটিন টেলর
(৪) সিটি ব্যাঙ্কের দীর্ঘ মেয়াদি স্বাস্থ্য শেষ অবধি রক্ষিত হয়নি। সলোমন স্মিথ বারনি নামক নিউ ইয়র্কের এক ডাকসাইটে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক আমাদের অধিগ্রহণ করে প্রায় দু’শ’ বছরের পুরোনো সংবিধানটি অচল ঘোষণা করলেন। তার পরিণাম ভয়াবহ। লেকিন ওহ কিসসা ফির কভি – দ্যাট ইজ অ্যানাদার স্টোরি