পাভেল বললে, ‘এসো এই জানলার কাছে। তোমাকে একটা জিনিস দেখাই’।
সিটি ব্যাঙ্কের কাটোভিতসে ব্রাঞ্চের ছয় তলার সম্মিলন কক্ষ। পাভেল সেখানকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। স্থানীয় স্টিল মিলের সিএফও আসবেন দেখা করতে। আমাদের মিটিং শুরু হতে একটু দেরি আছে।
-কি দেখতে পাচ্ছ জানলার বাইরে?
-কিছু বাড়ি আর তার পরে মাঠ। চাষের জমি যত দূর দেখা যায়। খুব শিগগির সেখানে শপিং মল তৈরি হবে!
-এবারে মনে কর, এই ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, তার তিনদিকে তিনটি সাম্রাজ্য ছিল। দাঁড়িয়ে আছ প্রাশিয়ার কাটোভিতস নামের একটি বড়সড় গ্রামে। সোজা তাকালে যেদিকে চোখ চলে যায় সেটা রাশিয়ান সাম্রাজ্য। ডানদিকে হাবসবুরগ রাজত্ব। পোল্যান্ড নামের কোনো দেশ নেই কোথাও। জানি তুমি ইতিহাসের ভক্ত। এ দেশটা কতজন কতভাবে ভাগ করে নিয়েছিল, তার একটা চমৎকার নমুনা এখানে দেখতে পাবে!
ভারত বিভাগ হয়েছে একবার। পোল্যান্ড তিন বার। এককালের পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ নিয়ে এই ভাংচুরের খেলা খেলেছে তিন শক্তি – রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া। এ একবার খানিকটা নেয়, তো আরেকজন হাত বাড়ায়। মধ্যিখানে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ১৭৭২ ও ১৭৯৩ (যে বছরে বাংলা-বিহারে কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করলেন) সালে দেশটাকে দু’-দু’-বার ভাগ করেও শান্তি পেলেন না তিন সম্রাট। ১৭৯৫ সালের তৃতীয় পার্টিশনটি এমন সুচারুভাবে সম্পন্ন করলেন, যে পোল্যান্ড নামটা ভূগোলের ম্যাপ থেকে মুছে গেল।
ইউরোপের ইতিবৃত্তে রাজা বদেলেছে। কিছু জমিদারির মালিকানা এদিক-ওদিক হয়েছে। কিন্তু মানচিত্রে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, স্পেনের চেহারা অপরিবর্তিত ৫০০ বছরে। ৪৭ বছরের জন্য ফ্রান্সের দু’টি প্রদেশ, আলসাস (এলসাস) আর লোরেন (লোত্রিঙ্গেন) জার্মান কবলিত হয়। উত্তরে খানিকটা জমি দান করে, বেলজিয়াম নামক একটি আদ্যোপান্ত কৃত্রিম দেশ সৃষ্টিতে ফ্রান্স সহায়তা করে ১৮৩০ নাগাদ। বাকিটুকু হল্যান্ডের অবদান – তার কিছু জমিজিরেত গেল এই অর্থহীন এক্সপেরিমেন্টে। ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের আর কোথাও ফ্রান্স সূচ্যগ্র মেদিনী হারায়নি। স্কটল্যান্ড দখল করে ব্রিটেন তার আয়তন বাড়িয়েছে। পর্তুগাল ও স্পেনের মতই অন্য মহাদেশ বহুগুণে লুণ্ঠন করেছে। উত্তরে গোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানচিত্র বদলায়নি। মাঝেসাঝে সুইডেন রাজত্ব করেছে জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডে। একশ’ বছর ভদকা বাহিনী ফিনল্যান্ড দখলে রেখেছিল। রাশিয়ার কাছে কারেলিয়া হারিয়েও ফিনল্যান্ডের ৯০% জমি আজও সে দেশের আপন। নরওয়ে দখল করেছিল আইসল্যান্ড। আজও আইসল্যান্ড থেকে গেছে আইসল্যান্ডে! বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক হারিয়েছে উপনিবেশ। ফিরে এসেছে আপন ঘরে। সেটি অটুট এবং অক্ষত।
সবুজ পাসপোর্ট হাতে, সবুজ পাঞ্জাবি পরে, সীমান্তের ট্রেন থেকে ভিজতে ভিজতে শেয়ালদা স্টেশনে নেমে তারাপদ রায় প্রথম জুতো পালিশওয়ালা দেখেছিলেন, দেখেছিলেন ট্রামগাড়ি আর সেই ট্রামলাইন – যা কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। বছর কুড়ি কেটে গেল, কিন্তু স্বপ্নের, রোমাঞ্চের সেই শহর কোনো রহস্যের জানলা খোলেনি।
শুধু – শুধু জামার রঙ, জুতোর নম্বর বদলিয়ে গেল।
তেমনি পুরোনো প্রাশিয়া আর নতুন পোল্যান্ডের নিয়মিত পালাবদলে জায়গার নাম, দেশের সীমানা, মুদ্রার পরিচয় আর মুখের ভাষা বদলাল – ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটানোর মত। পূর্ব ও পশ্চিম প্রাশিয়ার কাহিনি পড়েছি ইতিহাসের বইতে। সে দেশটা আজ কোনো ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৬ শতকের পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। সুইডেন একদা জার্মানি, পোল্যান্ড, বালটিক দেশগুলিতে দাবড়ে বেড়িয়েছে। এতগুলো দেশের চেহারা, চরিত্র, ভাষা আর ধর্ম ওলটপালট হয়ে গেছে। জার্মান জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম স্তবক গাওয়া হয় না। সেখানে দেশের সীমান্ত নির্ণয় করতে গিয়ে বলা হয়েছিল পশ্চিমে মাস (হল্যান্ডের নদী) থেকে পুবে মেমেল (আজকের লিথুয়ানিয়ার কাউনাস)! শুধু সীমানা নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের যাত্রা – একবার জার্মানি থেকে পোল্যান্ড। পোল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে জার্মানি! বিতর্কের সম্ভাবনা আছে জেনেও বলি, পোল্যান্ড, চেক, বালটিক থেকে আগত জার্মান শরণার্থী সংখ্যা, দুই পক্ষ মিলিয়ে, ভারত-পাকিস্তানের দেশ বিভাগের সংখ্যার প্রায় সমতুল। এই জার্মান জনযাত্রা ছিল একমুখী, পুব থেকে পশ্চিমে। সম্পত্তি বিনিময় হয়নি। মানুষ পুবে যাননি। এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ষাট লক্ষ ইহুদি নিধনের কাহিনি সবার জানা। হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আগে, খাস জার্মানিতে ইহুদির সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। অন্তত দু’লক্ষ সময়মত দেশত্যাগ করতে সক্ষম হন। পোল্যান্ডে প্রায় ৩৫ লক্ষ। ১৯৩৯ সালে ওয়ারশ-র ইহুদি জনসংখ্যা চার লক্ষ। ইউক্রেন রাশিয়া মিলে আরও বিশ লক্ষ। ইহুদি সম্প্রদায় এই সব দেশের মাটি থেকে আজ নির্মূলিত।
সিটি ব্যাঙ্কের দেওয়ালে কাটোভিতসের পুরোনো সাদা-কালো ছবি টাঙানো। এইসব ঐতিহাসিক ছবি সংগ্রহ করার একটা বাতিক ছিল নিউ ইয়র্কের সিটি ব্যাঙ্কের। স্বাভাবিক। যে দেশের নিজের ইতিহাস চারশ’ বছরের, তার কৌতূহল হয় হাজার বছরের ইতিহাসের ছবি দেখার।
পাভেল নিয়ে গেল দেওয়ালের কাছে। ফ্রেমে বাঁধানো কাটোভিতসের একটি বিরাট সিনাগগ। ১৯০০ সালে সম্পূর্ণ হয়। সেকালে জার্মানির সবচেয়ে বড় সিনাগগ। আজকের প্রাগ ও বুদাপেস্টের পুনর্নির্মিত সিনাগগ দু’টি ইউরোপের সবচেয়ে বড়, যদিও কাটোভিতসের সেই সিনাগগের তুলনায় নস্যি। জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯। ৮ সেপ্টেম্বর এই সিনাগগ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করা হয়।
আমি বললাম একটু হেঁটে বেড়াই। পাভেল এল সঙ্গে। আর যে কোনো পুরোনো জার্মান শহরের মতন ছকে বাঁধানো এ শহর। গথিক ধাঁচের বাড়ি, গির্জে। সোজা প্রশস্ত পথ। যেখানে সিনাগগটি ছিল সেখানে একটি চত্বর। ছোট পাথরের স্তম্ভে তার স্মৃতি আর মাটির বেদিতে মেনোরার মত একটি গাছ আঁকা।
সাইলেশিয়ার অর্থনীতি গড়ে ওঠে অঢেল বাদামী কয়লার ভিত্তিতে। এ দেশের গল্প বাবার কাছে শুনেছি বাল্যকালে।
আমাদের পরিবারের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রাম ছেড়ে অন্নসংস্থানের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন। ধানবাদের স্কুল অফ মাইনসে শিক্ষালাভ করে ঝরিয়া অঞ্চলে কয়লা খনিতে কাজ করেন সারাজীবন। সেই পথ ধরেন আমার বড় দাদাও। আমাদের পরিবারে তাই কয়লার অবদান অসামান্য, অনেক ধুলেও পরিষ্কার হওয়ার নয়! অত্যন্ত অল্প বয়সে বাবার কাছে শুনেছিলাম, অনেক দূর পোল্যান্ড নামের এক দেশের সাইলেশিয়া প্রদেশে প্রভূত বাদামী কয়লা পাওয়া যায়। ঝরিয়ার তুলনায় সে কয়লাকে খনি থেকে তুলে আনার খরচ কম। বাবা বলতেন, তবে তার কোয়ালিটি খুব খারাপ, জ্বলে যায় খুব তাড়াতাড়ি – বুঝলি! ঝরিয়ার কয়লা অনেক ভাল!
আমার ফ্রাঙ্কফুর্ট বসবাসকালে দাদা এসেছিলেন সাইলেশিয়ার পথে।
জীবন যে কি বিচিত্র! এবার আমিও!
জবশে / হিনডেনবুরগ
ঝাকশেভোতে গ্রাতসিনা গ্রাবোসকা আমাকে বলেছিল, যদি কখনো ও পাড়া দিয়ে যাই, তাহলে যেন অতি অবশ্য তার শহরে পদার্পণ করি। কাটোভিতসে হতে জবশে গাড়িতে বা ট্রেনে বিশ মিনিটে পৌঁছুনো যায়।
জার্মান শ্লেজিয়েনকে অ্যাংলো স্যাক্সন জিহ্বা সাইলেশিয়া নাম দিয়েছে। পোলিশ নাম স্লন্সক। আজকের সাইলেশিয়া পড়েছে তিনটে দেশের ভাগে। সামান্য অংশ জার্মানিতে। বৃহত্তর অংশ পোল্যান্ডে এবং খানিকটা চেকে। কাটোভিতসে থেকে প্রাগ-ভিয়েনা সমদূরত্বে, প্রায় চারশ’ কিলোমিটার; ওয়ারশ ব্রাতিস্লাভা তিনশ’।
এই অঞ্চলের দুটো ভাগ – উচ্চ বা দক্ষিণ সাইলেশিয়া, যার সদর শহর এই কাটোভিতসে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে গেছে ওডার নদী, একটি সুন্দর উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। একদিকে কয়লা এবং তৎসংলগ্ন শিল্প অন্যদিকে নদী, সবুজ ময়দান, যতদূর দেখা যায় চাষের মাঠ। এঁদের নিজস্ব ভাষা আছে – নিম্ন সাইলেশিয়াতে জার্মান ঘেঁষা। উচ্চ বা দক্ষিণ সাইলেশিয়াতে স্লাভিক ভাষা মিশ্রিত।
জবশে শহরটি প্রাশিয়ান দখলে ছিল ১৭৯৫ থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পরে যে ভোট হয়, তাতে এই অঞ্চল জার্মানিতে থাকবার ইচ্ছে প্রকাশ করে। খানিকটা অংশ নতুন দেশ পোল্যান্ডের সঙ্গে মিশে যায়। যদিও প্রাশিয়ান রাজারা প্রায় সব শহর গ্রামের জার্মান নাম দিয়েছিলেন, এই জবশে শহরের নাম বদল করেন মাত্র ১৯১৫ সালে – বিখ্যাত জেনারেল এবং পরবর্তী কালে জার্মান প্রেসিডেন্টের নামে এর নাম হয় হিনডেনবুর্গ। উত্তর সাইলেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আমরা জানি – প্রাশিয়ান রাজারা চাপিয়ে দেন জার্মান ভাষা, লুথারের ধর্মমত, আইনকানুন। স্কুলে পোলিশ পড়ানো বন্ধ।
আলফাঁস দোদের একটা গল্প মনে পড়ে (লা দেরনিয়ের ক্লাস – শেষ পাঠ)। স্যাডোয়া, সেডান যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ফ্রান্স যে ভার্সাই চুক্তি মেনে নিল, তার মোতাবেক আলসাস ও লোরেন জার্মান কবলিত হল ১৮৭১ সালে। এক সোমবার সকালে প্রত্যহের মত প্রাইমারি স্কুলের শিশুরা তাঁদের বই, সেলেট নিয়ে হাজিরা দিয়েছে স্কুলে। ক্লাসে ঢুকে অবাক হয়ে তারা দেখে – ক্লাসের সামনের বেঞ্চে আসীন গ্রামের বয়স্ক লোকেরা, এমনকি গ্রামের মেয়র। তাঁদের হাতে ফরাসি বর্ণ পরিচয়ের বই।
ফরাসি শিক্ষক নতুন করে অক্ষর চেনালেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজলে বললেন, “এই শেষবারের মত ফরাসি পাঠ হল। আগামীকাল থেকে জার্মান পড়ানো হবে”।
স্বাধীনতার শেষ দিন।
প্রাশিয়ান শাসনে গোটা সাইলেশিয়াতে জার্মান ভাষা বাধ্যতামূলক ছিল। আড়ালে-আবডালে কেউ পোলিশ বললে তাঁরা তেমন গা করতেন না। নাৎসিরা এটাকে আরেক ধাপ উঁচুতে নিয়ে গেল। বাড়ি বাড়ি ঢুকে পোলিশ বইপত্র জ্বালানো হয়। ১৯৩৮ নাগাদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও ইহুদি বিদায়।
১৯৪৫ সালে পাশাটি উলটে গেল। ১৫ লক্ষ জার্মানকে ফেরত পাঠানো হল তাদের দেশে। বাড়িঘর ফেলে। ক্ষতিপূরণের কোনো প্রশ্ন ছিল না। বহু পুরুষের অধিবাসী জার্মানদের আদেশ দেওয়া হল, বাড়ির চাবি, চিঠির বাকসো বা সদর দরোজায় রেখে চলে যেতে। এবার পালটা মার। পোলিশ সরকার জার্মান ভাষাটিকে সমূলে উচ্ছেদ করলেন। শহরের রাস্তার নাম, দেয়ালের পোস্টার পোলিশে নির্দেশিত। স্কুলে জার্মান পড়ানো বাতিল। প্রকাশ্য স্থলে জার্মানে বাক্যালাপ নিষিদ্ধ। জার্মানদের চেয়ে আরেক কাঠি এগিয়ে পোলিশ সরকার ছেলেমেয়ের জার্মান নাম রাখা বেআইনি ঘোষণা করলেন। কারো নাম হেলমুট বা ইনগ্রিড রাখা চলবে না। তালিকা অনুযায়ী উপযুক্ত পোলিশ নাম দিতে হবে। এমনকি পদবী নিয়ে টানাটানি। কয়েকশ’ বছরের অন্যায়ের প্রতিশোধের আগুনটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
পোল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্তের এই সব কাহিনী সর্বজনবিদিত।
এই সময় পুবদিকে চলল আরেক খেলা, যার বিষয়ে আমি অন্তত অবহিত ছিলাম না। গ্রাতসিনাদের বাড়ি ছিল স্টুডেনিকি নামের একটি ছোট শহরে। এককালে সেটা ছিল পোল্যান্ড, আজকের বিয়ালিস্টক শহরের পূর্বে, আজ ইউক্রেনের অন্তর্গত। ১৯৩৯ সালের নাৎসি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি অনুযায়ী এটি রাশিয়ার প্রাপ্য হল।
পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে, নাৎসি বাহিনী যখন ঝটিকা বেগে পোল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্ত দখল করে ওয়ারশর দিকে এগুচ্ছে, সোভিয়েত লাল ফৌজ মলোটভ–রিব্বেনট্রপ চুক্তিমত পোল্যান্ডের পূর্ব দিকে ঢুকে পড়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। হিটলারের সঙ্গে স্টালিনের যে চুক্তি হয়েছিল, পাঁচ বছর বাদে চার্চিল, রুজভেল্ট সেটি সসম্মানে স্বীকার করে নিলেন। সোভিয়েতরা তাদের কবজা করা পোল্যান্ডের অংশ মিলিয়ে দিল বেলারুশের সঙ্গে। স্টালিন বললেন, এতে করে পোল্যান্ড যে জমিটুকু হারাল, তার ক্ষতিপূরণ করা হবে অবশ্যই। তা, সেটা না হয় জার্মানি থেকে কেটে নেওয়া হোক – তাদের কারণেই তো এত রক্তপাত। মানে, আমি যা দখল করেছি, সেটি রাখব। জার্মানি তার আপন জমি ছেড়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ করুক। ফলত, পশ্চিমদিকে পোল্যান্ডের সীমানা ঠেলে দেওয়া হল ওডার নাইসে নদী বরাবর। মিত্রশক্তির দুই নেতা আপন আপন চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে পটসডামে বসে এই অপূর্ব যুক্তিতে সায় দিলেন। আজ ভাবি, রিব্বেনট্রপের ফাঁসি হল আর তাঁর সই করা চুক্তি আবার সমর্থিত হল বিজয়ী পক্ষ দ্বারা। মলোটভ কোন জাদু মন্ত্রবলে ভোল পালটালেন? সেই চুক্তিতে তাঁরও হস্তাক্ষর ছিল!
রাশিয়ানরা এবার সকল পোলিশ জনতাকে তাদের (একদা) অধিকৃত পোল্যান্ড থেকে পশ্চিম-পানে পাঠালেন। যাও পশ্চিমে, জার্মান শত্রু বিতাড়িত। সেখানে তাদের বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। গ্রাতসিনার পিতামাতা চাইলেন রাশিয়ানদের থেকে যতদূরে সম্ভব চলে যেতে। ১৯৪৬ সালে তাঁরা উপনীত হলেন সাইলেশিয়ার এই শহরে। লক্ষ লক্ষ জার্মান চলে গেছেন বাড়িঘর ফেলে। বিনিপয়সায় সেগুলোর দখল নেয়ার পদ্ধতিটি অতি সহজ – পুব থেকে আগত পোলিশ পরিবারগুলি পাড়া ঘুরে দেখে নিন কোন বাড়িটি তার পছন্দ। তারপর পৌরপিতাদের জানান। বাড়ির সঙ্গে গাড়ির চাবিও পেয়ে যাবেন। এবার সপরিবারে সেখানে বাসা বাঁধুন। তাদের গবাদি পশু, ট্রাক্টর, গাড়ি – সবই পাবেন। গাড়ির তেলটা শুধু কিনতে হবে।
যে শহরে গ্রাতসিনা বড় হল, তার চারপাশে জার্মান স্মৃতি, স্থাপত্য, স্ট্যাচু। ঘষে ঘষে তোলা হয়েছে বাড়ির নাম। রাস্তার নাম বদলেছে। স্কুলে জার্মান শেখানো বন্ধ। ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় আরও পরে। ঝাকশেভোতে গ্রাতসিনা প্রথম বাদামি চামড়ার মানুষ দেখে। আমাকে। ইংরেজিতে ভাষণ শোনে। সালটা ১৯৯২! তথ্যের খাতিরে বলতে হয়, এই, মাত্র ২০০৪ সালের পরে, জার্মান শিক্ষক পোল্যান্ডের জার্মান পড়ানোর জন্য নিযুক্ত হতে পারেন। ইংরেজি শিক্ষার চল শুরু হয়েছে অবশ্য সাতের দশক থেকে।
জবশের পথে পথে জার্মান গথিক স্থাপত্য পুরোনো ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। পরে আমরা পাশের শহর কোজকো (জার্মান গ্লাতজ), ওপোলে (ওপেলন) গেছি। নদীর এ’পারে পোল্যান্ড, ও’পারে জার্মানি। সে আমাকে বারবার বলেছে, জানি তুমি সর্বত্র জার্মান পদচিহ্ন খুঁজছ।
কিন্তু মনে রেখো, এটা এখন পোল্যান্ড।
আজকের পোলিশ প্রজন্মের কাছে মেনে নেওয়া শক্ত সাইলেশিয়ান স্থাপত্য, শিল্পকলা একান্ত প্রাশিয়ান। অন্য ভাষা বলে, নামের বানান বদল করে, দেয়ালের অক্ষর মুছে ফেলে সে অতীতকে অস্বীকার করা বাতুলতা।
তবু একটা মধুর আমেজে অনেক ঘুরেছি সাইলেশিয়াতে। যুদ্ধের ক্ষত মিলিয়ে গেছে। প্রাশিয়া আজ নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তবু নিঃশব্দ সাক্ষীর মতন দাঁড়িয়ে থাকে প্রাশিয়ান কেল্লার গম্বুজ, পাথরের সেতু। সকালবেলার, গোধূলির আলো খেলে যায় বর্ণময় চত্বরে।
ভ্রতস্লাভ / ব্রেসলাউ
-কতদূর যাচ্ছেন এই রাতের ট্রেনে?
-ব্রেসলাউ।
-ওই নামটা ব্যবহার করবেন না! ভ্রতস্লাভ বলুন।
-কেন? আমরা জার্মানে কথা বলছি তো। তাই। আপনি অন্য দেশের লোক হলে ভ্রতস্লাভ বলতাম।
-জার্মান যখন জানেন, আশা করি আপনি এ অঞ্চলের ইতিহাস খানিকটা জানেন। কয়েকশ’ বছর ধরে আমাদের দেশ ছিল বটে, তবে আমরা সেখানে খুব মধুর স্মৃতি রেখে আসিনি।
-প্রায় পঞ্চাশ বছর তো কেটে গেল।
আমার দিকে সোজা তাকালেন এবার।
-আপনি হানস ফ্রাঙ্কের নাম শুনেছেন?
কয়েক দশকের জার্মান অভিজ্ঞতায়, সে দেশের চেনা বা অচেনা মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ না তোলার অভ্যেস আয়ত্ত করে ফেলেছি। কিন্তু ইনি সে দিকে যেতে চাইছেন।
-আইনজ্ঞ। হানস ফ্রাঙ্ক তৃতীয় রাইখের অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্নর ছিলেন। আমেরিকান সিগারেট ভালবাসতেন শুনেছি।
এবারে আমার প্রশ্ন কর্তা ভ্রূকুটি করলেন। একজন ভারতীয়ের কাছে এমন বেয়াড়া ট্রিভিয়া তিনি আশা করেননি।
-নুরেমবেরগে যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। রায় শোনার পরে তিনি কী বলেছিলেন জানেন?
-একমাত্র যুদ্ধবন্দি, যিনি বলেছিলেন, মৃত্যুই আমার প্রাপ্য শাস্তি বা এই রকম কিছু। মনে নেই।
-সেটা ঠিক। কিন্তু হানস ফ্রাঙ্ক আরও বলেছিলেন, এক হাজার বছর কেটে যাবে। জার্মানির কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে না।
ড্রেসডেন থেকে ব্রেসলাউ বা ভ্রতস্লাভ যাচ্ছি সন্ধ্যের ট্রেনে। খাবারের কামরায় এক জার্মান ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ। তিনিও কর্মসূত্রে পোল্যান্ড যাচ্ছেন। টালির ব্যবসা করেন। ব্রেসলাউ বলাটা তিনি পছন্দ করেননি, কারণ সেটা প্রাশিয়ান আমলের নাম। পুরোনো প্রাশিয়ার বহু জায়গার মত, নাম বদলে, সে শহর পোলিশে বর্তমানে ভ্রতস্লাভ রূপে পরিচিত। কিন্তু এই বাহানায় আমাদের আলোচনা বেশ জমে উঠল। আমার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও, বিয়ারের দামটা তিনিই দিলেন। সঙ্গে যোগ করলেন, আমরা জার্মানরা আমাদের বিয়ারের যতই বড়াই করি না কেন, পোলিশ বিয়ারটা পাতে দেওয়া যায়! কিছু অর্বাচীন জার্মান নিতান্ত অন্যায়ভাবে চেক বিয়ারের সুখ্যাতি করে।
সেটা কি ওই সুদেতেনল্যান্ডের খাতিরে? আরেকটা বিপজ্জনক আলোচনায় না ঢোকাই ভাল ভেবে মুখে কুলুপ দিলাম।
একজন ভারতীয় ড্রেসডেন থেকে ভ্রতস্লাভ যাচ্ছে। সে আবার জার্মান বলে! তাঁর বিস্ময়ের ও প্রশ্নের অন্ত নেই। জানালাম, ড্রেসডেনে এসেছিলাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক এক বাৎসরিক সম্মিলনীতে। সরকারি নাম ফরফেটিং সমিতি, যারা আমদানি-রপ্তানির কাগজপত্র নিয়ে বাণিজ্য করে। আমাদের এবারের বাৎসরিক সম্মিলনী ছিল ড্রেসডেনে। আগামী বছর অস্ট্রিয়াতে হবে।
জানতে চাইলেন, ফরফেটিং বস্তুটি কী। গভীরতায় না গিয়ে বললাম, এই ধরুন টালি বেচে আপনি নিলেন ক্রেতার ঝুঁকি। সে যথাসময়ে আপনার টাকাটি ফেরত দেবে কি না দেবে – সেই দুশ্চিন্তায় না থেকে, খানিকটা কম মূল্যে সেটি আমাদের বেচলেন আপনর পাওনা উশুল! এবার সিটি ব্যাঙ্ক সেটি নিজের খাতায় না রেখে সে ঝুঁকি আরেক ব্যাঙ্ককে বিক্রি করল। মানে এই ধরুন, আপনি টালি বেচলেন ভ্রতস্লাভের খদ্দেরকে, সে বেচল ওপোলের পৌরসভাকে। ওই টালি কেনাবেচার মতন আর কি!
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং যে একটি চতুর ছলনার গেরেম্ভারি নাম সেকথা বলে আর কী হবে।
যুদ্ধের শেষের দিকে ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫, মিত্রশক্তির ভীষণতম বম্বিং হয় ড্রেসডেনের ওপর। কোনো লড়াকু নাৎসি নয়, সৈন্য নয়, ২৫০০০ সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারান। ট্রেন স্টেশনটি বাদে সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো ছাউনি আক্রান্ত হয়নি। এমনকি এলবে নদীর ওপারে নয়স্টাড বা ড্রেসডেনের শিল্পাঞ্চলের ওপরে একটি বোমাও পড়েনি। শহর প্রায় মাটিতে মিশে যায়। ব্রিটিশ হাওয়া বাহিনীর প্রধান হ্যারিস, এই কীর্তির জন্য বম্বার হ্যারিস নামের খ্যাতি অর্জন করেন। যখন জার্মানি প্রায় বিধ্বস্ত, প্রতিরোধ শূন্য, সে সময় এই প্রাণঘাতী আক্রমণের কী প্রয়োজন ছিল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকশন ব্যবহারের মহতী অধ্যায় রচিত হবে মাস কয়েক বাদে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ।
এই অনাবশ্যক রক্তপাতেরও একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া পরিশিষ্ট আছে। ১৯৪৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির এই বিধ্বংসী বোমাবর্ষণে ড্রেসডেনের সবচেয়ে বিশাল প্রাচীন গির্জেটি (ফ্রাউয়েন কিরশে) ভস্মীভূত হয়। এর চুড়োয় ছিল একটি স্বর্ণকলস। নয়ের দশকে গির্জের পুনর্নির্মাণের সময় ইস্ট লন্ডনের এক স্বর্ণকার একটি বহুমূল্য স্বর্ণকলস দান করেন ড্রেসডেনকে। তিনি বলেন, তাঁর দেশের অন্যায়ের, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন।
রাতের বেলা ড্রেসডেন ছেড়ে সকালে ভ্রতস্লাভ সদর স্টেশন। এটি দেড়শ’ বছর আগে প্রাশিয়ানদের স্থাপন করা। নানা যুদ্ধের চোট খাওয়ার পরে মার্জিত হয়ে পুরোনো প্রাশিয়ান চেহারা ফিরে পেয়েছে। ড্রেসডেনে সরকারি কাজের শেষে আমার একদিনের ছুটি কাটাব – এই শহরে। এটি আমার ব্যক্তিগত ভ্রমণ। লন্ডনের অফিসের কাজ কিছু আটকে থাকবে না।
আনিয়া মাগদালেনা রেল স্টেশনে ছিল। সে তখন ভ্রতস্লাভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিভাগের রিসার্চ ছাত্রী। আগের বছরে রাদোম শহর থেকে লন্ডনে এসেছিল ইংরেজি চর্চা করতে। সিটি ব্যাঙ্কের একটি বিনিময় প্রকল্প (এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম) মাফিক আমাদের ব্যাঙ্কে সাময়িকভাবে কাজ করেছে ইন্টার্ন হিসেবে। সেখানে পরিচয়। যদিও সে ইংরেজি ভাষায় সড়গড় হওয়ার জন্য এসেছিল, দ্রুত জানা গেল আনিয়ার মাতৃভাষা জার্মান এবং আনে বলে ডাকলেও সে সাড়া দেয়! সহজেই নানান রকমের আলোচনার সূত্র পাওয়া গেল। তার পুরো নাম আনিয়া মাগদালেনা হর্ন।
আমি সুযোগ পেয়ে জার্মান বলি। আর সে বলে, কী মুশকিল, আমি যে ইংরেজি শিখতে এয়েছি!
শর্ত হল, আমি যদি কখনও ভ্রতস্লাভ যাই, সে আমাকে শহরটা দেখাবে।
আনিয়ার পরিবার জার্মান। বহু পুরুষে শ্লেজিয়েন বা সাইলেশিয়ার বাসিন্দা। ১৯৪৫ সালে সেটি পোল্যান্ডে পরিণত হল। তাদের পরিবার জার্মানি যায়নি। কেবলমাত্র ভাষা আর ধর্মের সূত্রে একটা দেশের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন কী হয়? জুরিখ থেকে বার্ন অবধি যে সব মানুষ এক অশ্রাব্য উচ্চারণে জার্মান বলেন, তাঁরা সুইস। জার্মানিকে আপন দেশ মনে করেন না। জেনিভা অথবা ব্রাসেলসের ফরাসি-ভাষী সুইস বা বেলজিয়ানের কাছে ফ্রান্স আপন দেশ নয়। অন্য দেশ। তবে এখানে প্রসঙ্গটি আরও জটিল। সাইলেশিয়া ছিল জার্মান সাম্রাজ্যের অংশ।
নতুন পোলিশ সরকার জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধী। আনিয়ার বাবা মা বাড়িতে সন্তর্পণে জার্মান বলেছেন। একমাত্র সন্তানের জার্মান অক্ষর পরিচয় করিয়েছেন বাড়িতে। সেখানে তাকে আনে বলে ডাকেন। বাড়ির বাইরে সে আনিয়া, পোলিশ। ক্রমশ জটিলতা দেখা দিল নানান দিক দিয়ে। যে স্বল্পসংখ্যক জার্মান পোল্যান্ডে রয়ে গেলেন, পোলিশ সরকার তাদের জানাল – এ দেশে থাকতে গেলে পোলিশ নাগরিকতা নেওয়া বাধ্যতামূলক। না নিলে জার্মানি যাও। অনেক পরে ইদি আমিন সেইরকম হুকুম জারি করেন উগান্ডাতে। সংখ্যালঘু বলে কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব মানতে পোল্যান্ড রাজি নয়। যুদ্ধের পরে চেক রিপাবলিকেও ঠিক তাই হয়েছে।
১৯৪৯ সালে দুটো আলাদা দেশ জন্ম নিল – গণতান্ত্রিক পূর্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পশ্চিম জার্মানি। পোল্যান্ড থেকে কিছু জার্মান গেলেন পূর্ব জার্মানিতে। বেশির ভাগ গেলেন পশ্চিমে। নতুন পোল্যান্ডের সীমারেখা মেনে নিয়েছে পূর্ব জার্মানি কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা ঠেলে দেওয়া ওডার/নাইসে নদী-দ্বারা বিভাজিত যুদ্ধোত্তর সীমান্তকে মানতে পশ্চিম জার্মানি রাজি নয়। আনিয়ার পিতামাতা ত্রিশঙ্কুর মত ঘরে জার্মান, বাইরে পোলিশ হয়ে রয়ে গেলেন পোল্যান্ডে।
ধীরে ধীরে পোল্যান্ডের জার্মান বিদ্বেষ কমতে থাকে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি উষ্মা এবং তার প্রকাশ বৃদ্ধি পায়। সাতের দশকে উইলি ব্রান্ডের পশ্চিম জার্মান সরকার ওডার/নাইসে নদীকে পোল্যান্ডের সীমানা বলে মেনে নিলেন। রিয়াল পলিটিক শুরু। তারপর একদিন চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড এলেন ওয়ারশ ঘেটোর স্মারক বেদি দর্শনে। ১৯৪৪ সালে, ৬৩ দিন ধরে এই ঘেটোর ইহুদিরা লড়েছিলেন মহা পরাক্রান্ত জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে এক নিতান্ত অসম লড়াই। সেই সময় রাশিয়ান লাল ফৌজ সহজেই ওয়ারশ ঢুকে শহরের দখল নিতে পারতেন। করেননি। ভিসতুলা নদীর অপর পারে সমবেত হয়ে ভদকা সহযোগে এই হত্যাকাণ্ড উপভোগ করছিলেন; শুনেছিলেন আহতের আর্ত চিৎকার। আজকের ওয়ারশ-র পুরোনো শহরের দেওয়ালে দাঁড়িয়ে নদীর পানে তাকালে সেটা সহজেই কল্পনা করে নেওয়া যায়। সাত হাজার ইহুদি প্রাণ হারালেন। জার্মানরা সেই প্রতিরোধ শেষ করে দিলে, নদী পার হয়ে লাল ফৌজ বিজয়ীর বেশে নিরঙ্কুশভাবে ওয়ারশ প্রবেশ করে জার্মানদের পিটিয়ে মারলেন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই।
স্টালিন প্রণম্য!
শক্তিমানের বিরুদ্ধে নিতান্ত দুর্বলের লড়াইয়ের অসামান্য প্রতীক ওয়ারশ ঘেটো।
সাত ডিসেম্বর, ১৯৭০। সেই ঘেটোর স্মারক বেদিতে অজস্র ফুলের স্তবক নামিয়ে প্রোটোকল ভেঙে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন নির্বাক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড। সেটা কোনো পরিকল্পিত ডিপ্লোম্যাটিক চাল ছিল না। জার্মান নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চাইলেন। ঈশ্বরের কাছে? ইতিহাস লেখে বিজয়ীরা। বিজিতদের কথা বলে কে? নাইজেরিয়ান লেখক আচেবে বলেছেন, ‘যতদিন না সিংহ তার আপন লেখক পাচ্ছে, শিকারের ইতিহাস লিখবে শিকারিরা’।
পোল্যান্ড আর জার্মানির ইতিহাস সমান রক্তাক্ত। তাই ব্রান্ডের ক্ষমা চাওয়ার স্মৃতি পোলিশ মনকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। জার্মানিতে অর্ধেকের বেশি মানুষ অবশ্য এটিকে নিতান্ত বাড়াবাড়ি মনে করেছিলেন। ঘেটো স্মারকে তামার প্লেটে সেই ছবিটি সুরক্ষিত আছে – ওয়ারশতে হাঁটুগাড়া ১৯৭০। ওদিকে রাশিয়ান প্রভুদের মন বোঝা ভার। এই সময়ে কাটে আনিয়ার বাল্যকাল।
একদা ব্রেসলাউ ছিল জার্মান সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর। সে শহরের স্থাপত্য একান্তভাবেই প্রাশিয়ান – মতান্তরে জার্মান!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায়ভাগী বলে জার্মানিকে ১৯২৪ ও ১৯২৮ অলিম্পিকে যোগদানের অধিকার দেওয়া হয়নি। যেমন ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে এবং ১৯৫০ সালের রিও বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানির আসন মেলেনি। বিশ্বকাপ ফুটবলে এই একটিবার মাত্র জার্মানি বিশ্বকাপ খেলেনি। ব্রাজিল সব কাপে খেলেছে ।
আজকের রাশিয়ার মত দেশের পতাকা ব্যবহার না করে রাশিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের নামে প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত হওয়ার আধুনিক তরিকাটি তখনও চালু হয়নি ।
মন ভোলাতে জার্মানরা ১৯২৪ সালে নানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সাঁতারের চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় ব্রেসলাউতে। ওডার নদী বয়ে গেছে শহরের মাঝখান দিয়ে। যুদ্ধের ছাপ বিলুপ্ত। পুরোনো সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছে এ শহর। একের পর একটা স্কোয়ার। একটা থেকে বেরোলে আরেকটা শুরু। যেন বইয়ের পাতা উলটে যাচ্ছে। প্রতিটি স্কোয়ারকে ঘিরে নানা বর্ণের গথিক বাড়ি। লাল টালির ছাউনি। বিশাল বাঁধানো চত্বর। বর্ণে-গন্ধে জার্মান, শব্দে পোলিশ!
শহরের একটি অংশ ছিল ইহুদি পাড়া। নাৎসিদের পাঁচশ’ বছর আগেই ব্রেসলাউতে ইহুদি প্রবেশ মানা হয়েছে অনেকবার। প্রাশিয়ান আমলে সেই বিধি খানিকটা শিথিল করা হয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ জনের বেশি ইহুদি ছাত্র-ছাত্রী নেওয়া বারণ ছিল। নাৎসিরা যখন ক্ষমতায় এল, তখন তিরিশ হাজার ইহুদির বাস (বার্লিন আর ফ্রাঙ্কফুর্টের পরেই বড় আবাস)। তাদের স্মৃতি এই শহরে ছড়িয়ে আছে। বিশাল সিনাগগটি যথারীতি ৯ নভেম্বর ১৯৩৮ সালে ধ্বংস হয়।
কত ইতিহাস এই শহরের অলিতে গলিতে। ওডার নদীর একটি শাখার (তার নাম পুরোনো ওডার) পাশ দিয়ে আনিয়া নিয়ে গেল একটি লাল ইটের বাড়ির সামনে। এই ভিলাতে একদা বাস করেছেন এক জার্মান চিকিৎসক। ব্যাভেরিয়াতে ডাক্তারি পাশ করে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। সেখানে ১৯০১ সালে আউগুস্তে ডেটার নামে বছর পঞ্চাশের মানসিক ভারসাম্য হারানো এক রোগীকে দেখেন। আউগুস্তের সমস্যা ছিল সাম্প্রতিক স্মৃতি হারানো। তাঁর স্বামী চিকিৎসার খরচা বেশি বলে নার্সিং হোম থেকে সরাতে চেয়েছিলেন। এই রোগীর মধ্যে ডাক্তার একটা কিছু লক্ষ্য করেছিলেন – তাঁকে অল্প পয়সায় হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করলেন। পাঁচ বছর ধরে সেই রোগীর খবর রাখেন। ১৯০৬-তে আউগুস্তে মারা যান। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যে ব্যাধিটি নির্ণয় করেন, সেটি আজ তাঁর নাম বহন করছে।
আলয়েস আলৎসহাইমার।
তাঁর শেষ কর্মস্থল ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ তাঁর নাম বিশ্ববিদিত। আনিয়া গল্প বলে ভণিতা ব্যতিরেকে। কোন দিগগজি বর্ণনা দেয় না। মাঝেমধ্যে থেমে বলে, এটা একটু দেখো! ওটা শুনেছ কী? আনিয়ার সঙ্গে হেঁটে বেড়ালে এই ম্যাজিকের কোনো শেষ পাওয়া যায় না।
এক সময় এসে পৌঁছুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। জার্মান আমলে ফ্রিডরিখ ভিলহেলম এবং বর্তমানে ভ্রতস্লাভ বিশ্ববিদ্যালয়। তার অবস্থিতি ওডার নদীর তীরে। একাধিক ক্ষুদ্র দ্বীপ – প্যারিসের ইল দে লা সিতের মত, যেখানে নোৎরদামের অবস্থিতি। জার্মান আমলে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিরিশ বছরে ভ্রতস্লাভ বিশ্ববিদ্যালয়ের আট জন নোবেল পুরস্কার পান! পদার্থবিদ্যা, রসায়নে এবং সাহিত্যে। তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রবাদপ্রতিম মানুষ মাক্স বর্ন। ব্রেসলাউতে জন্ম। কাইজারের আমলে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় অন্য কোথাও একাধিক সেমেস্টার পড়াশোনা করার অনুমতি ছিল। মাক্স বর্ন গেছেন হাইডেলবের্গ, জুরিখ, গোয়েটিংগেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স আনিয়ার অন্যতম বিষয়। তার কাছে মাক্স বর্ন পূজনীয় এক ব্যক্তিত্ব। আমি নিজে এ বিষয়ে বিশেষরূপে অজ্ঞ। অর্থনীতির মতন ধোঁয়াটে বিষয় পড়েছি, যেটা নিজেই ভাল বুঝিনি। আনিয়ার কাছে আইনস্টাইনের একটা গল্প জানা গেল।
আইনস্টাইন নিজে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে বিশ্বাসী ছিলেন না, কারণ এর নির্ণয় হাইসেনবের্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের (আনসারটেনটি প্রিন্সিপল) ওপর আধারিত, যেখানে কোনো বস্তুর গতি ও অবস্থান জানা অসম্ভব। হয়তো এই অনিশ্চয়তার কারণে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “কোয়ান্টাম থিওরি আমাদের সেই বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে নিয়ে যায় না। ঈশ্বর নিজে পাশা খেলেন না”।
তদাপি ১৯২৮ সালে স্বয়ং আইনস্টাইন নোবেল কমিটির কাছে আবেদন পাঠিয়েছিলেন – ভ্রতস্লাভের মাক্স বর্নকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক। তখন বর্নের বয়েস ৪৬; আইনস্টাইন নোবেল পেয়েছেন সাত বছর আগে। নাৎসি অভ্যুদয়ের পরে বর্ন নানান দেশে চাকরি খোঁজেন, এমনকি বাঙ্গালোরে। ভাবতে অবাক লাগে, সেখানেও পাকা কাজ জোটেনি। শেষ অবধি এডিনবরা। ৭০ বছর বয়েসে যে কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেলেন, সে কাজটি তিনি তিরিশ বছর আগেই সেরে ফেলেছেন।
আনিয়ার মতে, যারাই পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের মূল্যবান কর্মটি তিরিশ চল্লিশ বছর বয়েসের ভেতরেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।
ভ্রতস্লাভ বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজেতাদের মধ্যে কয়েকজন ইহুদি (পল এরলিখ, অটো স্টেরন, ফ্রিতস হাবের, মাক্স বর্ন)। ইহুদিদের বাৎসরিক প্রবেশসংখ্যা বাঁধা ছিল কাইজারের আমলে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত আড়াইশ’ ইহুদি পরীক্ষা পাশ করলেও সরকারি ডিগ্রির কাগজ দেওয়া হয়নি। এই হালে, প্রায় ৭০ বছর বাদে ভ্রতস্লাভ বিশ্ববিদ্যালয় সেই বকেয়া ডিগ্রিগুলি প্রাপকের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্গত, তবে কার্যকরী নয়। নাৎসি আমলে পাশ করা সেই কৃতী ছাত্রছাত্রীরা কেউ বেঁচে নেই।
তিরিশ বছর আগে ভ্রতস্লাভের পথে পথে হেঁটে বেড়ানোর দিনটি কখনও ভোলার নয়।
আরও একদিন সে আমাকে ওয়ারশ চিনিয়েছে। সে গল্প পরে হবে।
আনিয়া আজ দীর্ঘদিন ওয়ারশ বাসিনী। সেখানে স্কুলের উঁচু ক্লাসে পদার্থবিদ্যা পড়ায়। একজন পোলিশকে বিয়ে করে আনিয়া মাগদালেনা ভোদারচিক নামে পরিচিতা। বাবা-মা মারা গেছেন অনেকদিন। রাদোমের পাট শেষ। সেইসঙ্গে জার্মান ভাষাও বিলুপ্ত। আমরা ইংরেজিতে কথা বলি। পুরোনো অভ্যাসবসে তাকে আনে বলে ফেলি।
আনিয়া আজ দ্বিভাষিণী।
শুধু শুধু জামার রঙ আর জুতোর নম্বর বদলিয়ে গেল।