প্রাগ প্রাসাদ শহর থেকে অনেকটা উঁচুতে। বিমান পরিবহন আবিষ্কার হওয়ার আগে অবধি অবস্থানের উচ্চতাকে নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভ মানা হতো। আধুনিক বাণিজ্যিক যুগের প্রভাব অনুযায়ী আনাচে কানাচে সুভেনিরের দোকান–সেদিকে তার মনোযোগ আকৃষ্ট হবার আগেই মায়াকে বললাম চলো, প্রাসাদের ভেতরে ঢুকি।
পুরনো প্রাগ প্রাসাদের লুডভিগ উইং-এর একটি অপ্রশস্ত ঘরে হাজির হয়েছি; সিলিং অনেকটা উঁচুতে, জানলাগুলো মাথায় লম্বা কিন্তু চওড়ায় নয়। দেওয়ালে কোন খোদিত ফুল বা আর্ট চোখে পড়ে না। বাল্যকাল থেকেই ভ্রমণের বিষয়ে পুত্র ইন্দ্রনীল এবং কন্যা মায়া দুজনেই এ বিষয়ে এক মত যে তারা কোন সপ্তম শতাব্দীর রোমান আর্চ বা দ্বিতীয় দশকের গ্রিক পদ্মফুল দেখতে দু মাইল হাঁটতে বা দুশো সিঁড়ি ভাঙতে একান্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু আমার কাছে সত্যি মিথ্যে ট্রিভিয়া শুনতে ভালোবাসে। ইউরোপ ভ্রমণে আরেক মজা, গল্প জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেমন কখনো রোমের ফোরো রোমানায়, একেবারে অকুস্থলে গিয়ে বলেছি, দ্যাখো, ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে মার্ক অ্যান্টনি বলেছিলেন, আই কাম টু বেরি সিজার, নট টু প্রেজ হিম!
মায়া জানতে চাইলে এই একটা সাদা মাটা ঘরে কি দেখার আছে?
- মায়া, চারশ বছর আগে এখানে দুই বিবাদী পক্ষের একটি মিটিং হয়েছিল।
- কি নিয়ে বিবাদ?
- ধর্ম এবং জমি।
- দুটো আলাদা ধর্মের লড়াই?
- না, ধর্মটা একই, ক্রিসটিয়ানিটি। প্রভু এক, সেই যিশুখ্রিস্ট, কিন্তু পক্ষ দুই – ক্যাথলিক, যারা পোপকে মানে আর প্রটেস্টান্ট যারা বড়ো তরফের পুরোহিতকে মানতে রাজি নয়। তাদের ভজনালয় আলাদা হয়ে গেছে, ফলে গিরজের সম্পত্তিও ভাগ হচ্ছে। এখানে সেই নিয়ে বিতণ্ডা হচ্ছিল কিন্তু দু পক্ষ সহমত হলেন না কাজেই এক পক্ষকে বেরিয়ে যেতে হলো।
- সে তো হতেই পারে।
- আচ্ছা ধরো তোমাদের উওকিং হাইস্কুলে কিছু ছেলেমেয়েকে যদি শিক্ষক ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন, তারা কি ভাবে যাবে?
- কেন, দরোজা দিয়ে! শাস্তি হিসেবে বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
- ঠিক। কিন্তু এখানে তা হয় নি। ক্যাথলিক হাবসবুরগ রাজার দুই সম্মানিত প্রতিনিধি রাজকীয় চিঠি এনে বললেন ক্যাথলিক জমিতে প্রটেস্টান্ট গিরজে বানানো যাবে না। শুনে প্রটেস্টান্ট বোহেমিয়ান কাউন্ট’রা ক্ষিপ্ত হয়ে দুই রাজপ্রতিনিধি ও তাঁদের সেক্রেটারিকে ওই জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। এর নাম ডিফেনেসট্রেশন অফ প্রাগ*। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়, জানলা দিয়ে মানুষ ছোঁড়ার অগণতান্ত্রিক কায়দা প্রাগ ও বোহেমিয়া থেকে আগেও ঘটেছে। নিচে নেমে গিয়ে দেখাবো ঠিক কোনখানে তাঁরা ভূপতিত হন।
- পতন ও মৃত্যু?
- না, এই উচ্চতা থেকে পড়েও তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান! ক্যাথলিকদের মতে মাতা মেরি তাদের রক্ষা করেন- ফলে হাওয়ায় ভেসে এই তিন জন সুস্থ দেহে নিচে নেমেই ভিয়েনা মুখে পালান। প্রটেস্টান্ট মত অনুযায়ী তাঁরা এই টাওয়ারের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়েন এক অশ্ববিষ্ঠা স্তূপে যা বহুকাল কেউ পরিষ্কার করে নি – ফল সফট ল্যান্ডিং! যে যেটা মানবে।
বেসরকারি সফর। ব্যবসার দিন শেষ, এখন আবার ইউরোপ ঘুরি ট্যুরিস্টের মতন। চেনা শহরকে নতুন চোখে দেখি। বারো বছরের মেয়েকে গল্পের ছলে ইতিহাস শোনাই।
মায়া নিচে নেমে অত্যন্ত কৌতূহলের সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখছিল ঠিক কোনখানে সেই তিন রাজপ্রতিনিধি অধঃপতিত হয়েও আপন প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন! তাকে বললাম, সেক্রেটারি ফাব্রিসিউস এই মহান কৃতিত্বের জন্য হাবসবুরগ সম্রাটের কাছে একটি খেতাব পান – লর্ড হোহেনফাল (ঊর্ধ্বপতন) যদিও মনে হতে পারে এই খেতাবের পেছনে সম্রাটের কোনো প্রচ্ছন্ন কৌতুক ছিল কিন্তু ফাব্রিসিউস আজীবন এই নামে সই সাবুদ করেছেন।
ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, প্রাগ শহর কর্তৃপক্ষ সযত্নে সেই সব জরুরি তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট দুই পক্ষেরই অসীম কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
নির্মম সত্য এই যে প্রাগ প্রাসাদের জানলা দিয়ে তিনজন রাজ প্রতিনিধি নিক্ষিপ্ত হবার সরাসরি ফল ইউরোপব্যাপী তিরিশ বছরের ধর্ম যুদ্ধ। বারুদ থাকে থাকে সাজানো ছিল, প্রাগে দেশলাই কাঠিটি জ্বালানো হলো।
যুদ্ধক্ষেত্রে, দুর্ভিক্ষ ও প্লেগের কারণে প্রাণ হারালেন অন্তত সত্তর লক্ষ মানুষ, বেশির ভাগ জার্মান ভাষা ভাষী। সুজলা সুফলা ধরিত্রীতে নেমে এলো শ্মশানের শান্তি। জনসংখ্যার অর্ধেক প্রাণ হারান। ব্রেখটের নাটক ‘মুটার কুরাজ উনড ইহরে কিনডার’ (মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন) তার অসামান্য চিত্রণ। পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মের নামে এমন বিপুল হত্যাকাণ্ড আগে বা পরে কখনো সংঘটিত হয় নি। এই মহাদেশে পরবর্তী রক্তের হোলিখেলার সূচনা হবে তিনশ বছর বাদে সারায়েভো নগরীতে, ২৮শে জুন ১৯১৪ সালে - ল্যাটিন ব্রিজের পাশে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপের রিভলভারের দুটি গুলিতে রাজকুমার ফারদিনান্দ ও তাঁর পত্নী সোফির মৃত্যুর কারণে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তার রেশ চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি।
যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য সন্ত পিটারের অনুগামী পোপ, তিনি অভ্রান্ত, তিনি সত্য, তাঁহার উপরে নাই। অতএব সারা দুনিয়ার চার্চ এক এবং অদ্বিতীয়। এই অমোঘ চিন্তার ওপর প্রথম আঘাত আসে খ্রিস্ট জন্মের হাজার বছর বাদে যখন ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের ক্রিস্টিয়ানরা ধর্মাচরণের রীতিনীতি এবং রোমের গুরু পোপকে মানতে অস্বীকার করেন (১০৫৪)। কনস্তানতিনোপলে (আজকের ইস্তানবুল) তাঁরা অর্থোডক্স গিরজে বানিয়ে গড়ে তোলেন দ্বিতীয় রোম – তৎকালীন পোপ তৎক্ষণাৎ তাদের ধর্মচ্যুত বলে ঘোষণা করলেন, পাল্টা দিলেন কনস্তানতিনোপল-তাঁরা পোপকে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে নির্বাসন দিলেন (এক্স কমুনিকেট)। চলতে থাকলো একই ঈশ্বরের ভজনা, নিজের নিজের ভঙ্গিতে। দেখেছি বেথলেহেমে প্রভুর জন্মস্থানে অথবা জেরুসালেমে তাঁর শেষ শয্যায় ক্যাথলিক ও অর্থোডক্সের পূজা পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। এই, মাত্র ১৯৬৫ সালে, দুই পক্ষ সমঝোতা করেছেন, প্রায় এক হাজার বছর বাদে পারস্পরিক ধর্মচ্যুতির সরকারি অবসান হলো।
চারশ বছর বাদে প্রাগের চার্লস ইউনিভার্সটির অধ্যাপক রেকটর ও ডিন, চেক ক্যাথলিক সাধু ইয়ান হুস চার্চের নানান প্রচলিত প্রথার বিরোধিতা করলেন, পোপ হয়তো অভ্রান্ত নন এ কথাও বললেন। রোম সেটি ভালো চোখে দেখে নি। কনসটানসে (আজকের জার্মানি) এক ধর্মসভায় ক্যাথলিক পণ্ডিতদের সঙ্গে মুখোমুখি এক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ পাঠানো হয় হুসকে। তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ইয়ান হুস এলেন, ধর্মসভায় পণ্ডিতরা বললেন হুস যেন ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের প্রতি তাঁর অপমানজনক মন্তব্য প্রত্যাহার করেন (যেমন গালিলেও গালিলিকে আদেশ করা হবে দুশো বছর বাদে)। হুস তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে না নেওয়ায় করুণাময় প্রভুর নামে তাঁকে প্রকাশ্যে স্টেজের ওপরে বাঁশে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হল। বোহেমিয়া তথা চেকের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মবেত্তা ইয়ান হুসের বয়েস ৪৩, দিনটা ৬ জুলাই ১৪১৫।
এবার জার্মান ভূমিতে অবতীর্ণ মারটিন লুথার। ভিটেনবেরগ শহরের প্রধান গিরজের দরোজায় ৯৫টি পত্র ঠুকে দিয়ে তিনি বললেন পোপের বাকসোয় টাকা জমা দিলেই পরকালের পথটি পরিষ্কার হতে পারে না -এটা ব্যবসা মাত্র, মহা অধর্ম। রিফরমেশনের এবং ইউরোপ জুড়ে অশান্তির শুরু কিন্তু এটি ব্যাপক ধর্মযুদ্ধে পরিণত হয় নি। হুসের মতন তাঁকেও ডাকা হয়েছিল ওয়ারমসের ধর্মসভায়, সেখানে মারটিন লুথার বললেন, ইখ কান নিখট আনডারেস -যা বলেছি সেটাই আমার কথা এর কোন অন্যথা করতে পারি না। এই সভায় অবশ্য তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় নি যদিও ওয়ারমস ধর্মসভা ঘোষণা করে, মারটিন লুথার বধের যোগ্য। রোমের সঙ্গে মতে না মিললে কাউকে কোতল করা যেতেই পারে।
১৫৫৫ সালের আউগসবুরগ চুক্তিতে সাব্যস্ত হল – কুইউস রেগিও, এইউস রেলিগিও, রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম। ফ্রান্সে বাস করতে হলে হাইল মেরি বলতে হবে, রবিবারে গিরজেয় পাদরির চাদরে দুটো মুদ্রা দিয়ে পাপ স্খালন করতে হবে। না পোষালে অন্য দেশে চলে যাও! স্পেনের সরকারি পুলিশ ইতিমধ্যে ইহুদি ও মুসলিম নিধন / বিতাড়ন /ধর্ম পরিবর্তনের কর্ম সম্পন্ন করে ফেলেছে। সুইডেন হল্যান্ড প্রটেস্টান্ট পথে হাঁটল। ইংল্যান্ড আরেক কাঠি ওপরে - রাজার বিবাহ বিচ্ছেদের শুভ বাসনায় স্বয়ং পোপ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিলেন বলে অষ্টম হেনরি তাঁকে বললেন, আপনি থাকুন রোমের পুরুত হয়ে, আপনার আইন এ দেশে চলবে না। প্রভু তো আমাদের একই, আমার প্রজা তাঁর ভজনা করবে আমাদের স্টাইলে। আমি নতুন চার্চ খুলব- চার্চ অফ ইংল্যান্ড! তিনি মোট দু বার বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলেন, আরও দুই পত্নীর মুণ্ডুও কাটলেন।
ইংল্যান্ড ফ্রান্স স্পেন স্বতন্ত্র দেশ, সীমানা টানা আছে, তাদের নিজেদের রাজা, এক ভাষা এক ধর্ম। সমস্যাটা রয়ে গেলো পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে- সেটা নামেই সাম্রাজ্য এবং সেখানে কাগুজে সম্রাট। আজকের বেলজিয়াম থেকে ইতালি অবধি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোন একছত্র শাসক সংবিধান পুলিশ পেয়াদা আইন নেই। হাজার খানেক ছোটো বড়ো রাজা, ডিউক, জমিদার ক্রিস্টিয়ানিটির দুই শাখার সহাবস্থানকে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় মেনে নিয়ে আপন লুণ্ঠন শোষণের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বোহেমিয়াতে ক্যাথলিক হাবসবুরগ রাজা এবং প্রটেস্টান্ট জমিদারেরা নিজের ধর্ম আচরণ করলেন। এমনকি ভিয়েনার সদাশয় রাজা মাথিয়াস ক্যাথলিক জমিতে গিরজে বানানোর জন্য প্রটেস্টান্টদের অনুমতি দিলেন। অপুত্রক মাথিয়াসের পরে রাজা হলেন তাঁর ভাইপো ফারদিনান্দ – তিনি কট্টর পোপ পন্থী – ক্যাথলিক সম্পত্তিতে প্রটেস্টান্ট গিরজের অনুমোদন বাতিল হল। এই সুসংবাদ নিয়ে মোট চার জন কাউন্ট ভিয়েনা থেকে তাঁদের সেক্রেটারিসহ প্রাগ প্রাসাদের এই ঘরে হাজির হয়েছিলেন। বিতণ্ডা শুরু - বোহেমিয়ান প্রটেস্টান্ট রাজপুরুষরা মাথিয়াসের কথামত গিরজে বানানোয় বদ্ধ পরিকর; গোলমাল দেখে ভিয়েনা থেকে আগত দু জন রাজ পুরুষ আমতা আমতা করে এও হয় সেও হয় গোছের কথা বলে বোহেমিয়ানদের সহানুভূতি কুড়লেন, কিন্তু অন্য দু জন, কাউন্ট স্লাভাতা ও বরিতা উলটে চেকদের ধমকানি দিলেন - এমনও বললেন যদি বোহেমিয়ানরা এ প্রস্তাব না মানেন অথবা তাঁদের গ্রেপ্তার করেন, দুপুরের আগেই ভিয়েনার সম্রাট তাঁদের মুক্ত করবেন। সঙ্গে তাল দিলেন সেক্রেটারি ফাব্রিসিউস - পারিষদ বলে তার শতগুণ।
এতো বড়ো কথা? আমাদের মুলুকে এসে আমাদেরই চোখ রাঙানো? তবে তোদের দেখাচ্ছি মজা- এই রকম কোন জার্মান গাল দিয়ে বোহেমিয়ান কাউন্টরা হাবসবুরগ রাজার দুই প্রতিনিধি এবং তাঁদের সেক্রেটারিকে তুলে ধরে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেললেন (ততক্ষণে অন্য দুজন হাওয়া খারাপ দেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালিয়েছেন)।
২৩শে মে ১৬১৮
রণবাদ্য বেজে উঠলো – বোহেমিয়ার প্রটেস্টান্টরা ক্যাথলিক সম্রাটের অসম্মান করেছেন! পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে যারা খেলাটা দেখছিলেন, তাঁরাও এবার ফিল্ডে নামলেন, যেমন সুইডেন। প্রাগের আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারা ইউরোপে একই ধর্ম, পৃথক আচরণের কারণে শুরু হল নৃশংস হত্যালীলা।
বাকিটা ইতিহাস।
রুক্ষ শুষ্ক মাদ্রিদ বাদে - সেখানে নদী দূরের কথা একটা খাল বিল অবধি নেই - ইউরোপের প্রখ্যাত শহরগুলি হ্রদ সমুদ্র বা নদীর কূলে গড়ে উঠেছে, প্রয়োজনে তাই দেখা দিয়েছে অজস্র সেতু-তারা দূরকে করেছে নিকট আমার মনে হয় সেতু যেন আরও কিছু-দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে, ওপারেতে সোনার কূলে আঁধার মূলে কোন মায়া!
প্যারিসে সেইন নদীর ওপরে অন্তত তিরিশটা ব্রিজ, আমস্টারডামে, ভেনিসে নিদেন পক্ষে কুড়িটা করে। সুরম্য সবুজ বাতি সাজানো প্যারিসের পঁ আলেক্সান্দ্রর, পঁ নয়েফ (যেটি শহরের প্রাচীনতম তার নাম নতুন সেতু – এই কারণে ফরাসি ভাষার সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠলো না) অতুলনীয়, তেমনি মনে থেকে যায় ভেনিসের রিয়ালটো, দীর্ঘশ্বাসের ব্রিজ, আমস্টারডামে সিটি ব্যাঙ্ক অফিসের কাছে রেগুলিয়েরসঘ্রাখট থেকে দেখা কানালের ওপরে ছটি আলোকিত ব্রিজ, মাগেরে ব্রুঘ (ক্ষীণকায় সেতু), বুদার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দেখা চেন ব্রিজ (কেটেনব্রুইকে),–সকলই শোভন। তবে সকলকে ছাপিয়ে মনের মধ্যে গেঁথে থাকে প্রাগের সেতু। ইউরোপের মধ্যে একমাত্র এখানেই দেখি একটি নয়, সেতুর সারি। কোন কোন জায়গায়, যেমন লেটনা পার্কের একটি বিন্দুতে দাঁড়ালে মলডাউ ( চেক নাম ভ্লাতাভা) নদীর ওপরে চার বা পাঁচটি, দিন পরিষ্কার থাকলে হয়তো পাই সাতটি সেতুর আভাস। নদীর জলের, আকাশের রেখা মিশে যায় দিগন্তে।
শহরের কেন্দ্র ওয়েনসেসলাস স্কোয়ার পেরিয়ে দু পা হেঁটে গেলে পাবেন চতুর্দশ শতাব্দীর পাথুরে চার্লস ব্রিজ বা কার্লস ব্রুইকে। এটি কেবলমাত্র পথচারীদের জন্য নির্মিত হয়েছিল ( শোনা যায় পাথরের সঙ্গে পাথর গাঁথতে রাজ মিস্ত্রীরা দই এবং ডিম ব্যবহার করেছিলেন)। এই ব্রিজে পদচারণা না করলে আপনার প্রাগ সফর বৃথা।
চার্লস ব্রিজ শুধু নদী পারাপারের জন্য তৈরি হয় নি – এটি একটি প্রমেনাদ, একটি রঙ্গমঞ্চ, ক্যাট ওয়াক! যেমন প্যারিসের শঁজেলিজে বা পুরনো বার্লিনের ঊনটার ডেন লিনডেনে, যেখানে সকালে বিকেলে সুশোভিত নারী পুরুষ মন্দ গতিতে হাঁটেন, কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে নয়, শুধুই দেখা দেন; মৃদুস্বরে বাক্যালাপ করেন, মলডাউ নদী বয় ধীরে, শিশুরা ছুটে যায়, দু পাশে সন্তদের স্ট্যাচু আপনার মঙ্গল কামনায় আশীর্বাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, বিজন সন্ধ্যায় নামে ছায়া, পাহাড়ের গায়ে প্রাগ প্রাসাদে আলো জ্বলে ওঠে, নগর চত্বরের গিরজেয় বাজে ঘণ্টা। বেহালায় কেউ বাজান স্মেতানার ডি মলডাউ – মাতৃভূমি বোহেমিয়ার বন্দনা। দু’পাশে স্কেচ আঁকিয়েরা এই মুহূর্তটিকে অমর করে রাখেন।
সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে।