সিটি ব্যাঙ্কের অন্য শাখাটি ছিল স্লোভাকিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে, কোসিতসে।
ব্রাতিস্লাভা থেকে পাঁচশো কিলো মিটার খাড়া পুব দিকে, ইউক্রেন এবং হাঙ্গেরির সীমান্ত ঘেঁষে (দু বছর আগে ইউক্রেনে লড়াই শুরু হলে বেশ কিছু ছিন্নমূল মানুষ এই পথ দিয়ে হেঁটে স্লোভাকিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন) কোসিতসে। সেখানে যাবো কি ভাবে? আমাদের সিইওর সহকারী ইয়ানা বললে প্লেনে যেতে পারেন, এক ঘণ্টার ফ্লাইট।
আগের বার ব্রাতিস্লাভা এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যাওয়ার ট্যাক্সি পাই নি, শেয়ারে আরও দুজনের সঙ্গে যেতে হয়েছে। কোসিতসে নেমে কি রিকশা ধরব? ইওয়ানা আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, এক বছরে অনেক বদলে গেছে, ভিয়েনা প্রাগ ফ্রাঙ্কফুর্টের ফ্লাইট নামছে সেখানে। ট্যাক্সি লেখা সাইনবোর্ডের দিকে হাঁটবেন, আর এইটে রাখুন, আমাদের ব্যাঙ্কের ঠিকানা।
তাকে বলা গেলো না প্রথমবারে ব্রাতিস্লাভায় নেমে আমি ট্যাক্সির লাইনের সন্ধান করে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ তৎক্ষণাৎ সে একটি চমৎকার প্রস্তাব দিলে।
‘আমি কি আপনার ফেরাটা ট্রেনে বুক করতে পারি ? প্রায় পাঁচ-ঘণ্টা সময় লাগে বটে কিন্তু ট্রেন যায় তাতরার কোল ঘেঁষে। ভারি সুন্দর সে জার্নি! আমাদের ট্রেনের কেদারা খুব আরামের! পরে রিটায়ার করে যদি আমাদের দেশে আসেন, আপনার ট্রেন ফ্রি!'
জানি না বিনে পয়সায় ট্রেনে চড়ার লোভে কি না, রবার্ট সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডন থেকে অবসর নিয়ে ব্রাতিস্লাভার কাছে বাসা বেঁধেছেন! সে দেশে অবশ্য পনেরো বছর বয়েস এবং স্টুডেন্ট পরিচয় প্রমাণ দিতে পারলে ছাব্বিশ বছর অবধি ট্রেন ফ্রি, বাষট্টি বছর বয়েস হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে কোন দেশের নাগরিক সেই একই সুবিধে পেয়ে থাকেন। ব্রেক্সিটের পরে রবার্ট সেই সুবিধে পান কিনা কে জানে।
তাই সাব্যস্ত হলো । আমার যেমনি যাওয়া তেমনি আসা নয়, উড়ে যাওয়া, ট্রেনে আসা ।
ভোরের ফ্লাইট। যখন শহরে ঢুকছি তখন আবছা আলো। ট্যাক্সির জানলা থেকে দেখি আট তলা দশ তলার অ্যাপারটমেনট, ধূসর বর্ণ, বহুকাল দেয়ালে কোন রঙের পোঁচ পড়ে নি। বাতাসে টু স্ট্রোক এঞ্জিনের ফেলে যাওয়া আধ পোড়া পেট্রোলের গন্ধ। আমার হাতের চিরকুটে লেখা ঠিকানা দেখে ট্যাক্সি আমাকে যেখানে নামিয়ে দিলো সেটা একটা টিপিকাল কমিউনিস্ট আমলের পাঁচ তলা অ্যাপারটমেনট ব্লক। কাচের জানলা হয়তো পঞ্চাশ বছরের পুরনো। দু পাশে ফ্ল্যাট, মধ্যিখানে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি। নিচের তলায় একটি দরোজার সামনে লাইন দিয়ে মোটামুটি নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছু মানুষ। কেউ কেউ ধূমপানে রত। এতো বছর সিটি ব্যাঙ্কে কাজ করছি ততদিনে অন্তত পঞ্চাশটা দেশে সিটি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ দেখেছি তার সঙ্গে এ একেবারে মেলে না। ঠিক জায়গায় এসেছি কিনা সন্দেহ হলো।
দোতলায় যেতে হবে জানা ছিল (প্রিভে প্রশদিয়ে)। মাঝের সিঁড়ির দরোজায় বেল নেই, পরিচিতি জানানোর ওঠে না। সে সিঁড়ির চেহারা বড়ো বাজারের কোন পুরনো বাড়ির মতো , দেওয়ালে পানের পিকটাই যা নেই। দোতলায় উঠে চমকাতে হলো। হলদে রঙের একটা ঝাঁ চকচকে দরোজার ওপরে সিটি ব্যাঙ্ক লেখা দেখে। এমনকি এন্ট্রি ফোন! বেল টিপলে এক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেলো। তিনি ঘণ্টি বাজিয়ে আমাকে দরোজা ঠেলতে বললেন -একেবারে স্টেট অফ দি আর্ট ! যিনি দেখা দিলেন তাঁর নাম ইওয়ানা, এতক্ষণ তিনি আমার পথ দেখছিলেন বলে জানালেন। এক নজরেই বোঝা গেলো এটি একটি স্ট্যান্ডার্ড তিন কামরার কমিউনিস্ট কালের ফ্ল্যাট যার তুল্য দেখেছি সারা পূর্ব ইউরোপে। ঢুকতেই বাঁ হাতে টয়লেট, ডাইনে রান্নাঘর, হলের তিন দিকে তিনটি ঘর । উত্তরে টালিন বা সেন্ট পিটারসবুরগ ( পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি প্রথম পর্ব পশ্য, ছবি সহ) থেকে দক্ষিণে স্কোপয়ে অবধি সমস্ত অ্যাপারটমেনট একই বিশ্বকর্মার প্ল্যান বা মর্জি মাফিক তৈরি। তফাৎ শুধু ঘরের সংখ্যায়, দুই বা তিন । তবে এ ফ্ল্যাটের অন্দরের চাকচিক্য আছে- সিটি ব্যাঙ্ক বলে কথা ! যদি লন্ডন থেকে আমাদের ডেপুটি সিইও ডেভিড গিবসন হঠাৎ এসে হাজির হন , তাঁর কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। বাইরেটা দেখেই অবশ্য তিনি মূর্ছা যেতে পারেন।
দেওয়াল যেন কেউ সদ্য চুনকাম করে গেছে, মেঝের কার্পেটে পা ডুবে যায়। ফার্নিচার লন্ডন ওয়েস্ট এন্ডের বাড়িতে বেমানান হবে না। টেবিলে টেবিলে আই বি এম পি সি। কোসিতসে অফিসের প্রধান আরিফ আমাকে উদ্বাহু হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনিও এ দেশে হালে এসেছেন, খুব কৌতূহলী চোখে নতুন দুনিয়া দেখেছেন। হিন্দি উর্দু মিশিয়ে আমাদের কলকাতা ও করাচীর স্টাইলে আড্ডা জমে যেতে দেরি হলো না। জানতে চাইলাম বাড়ির সামনে কিসের লাইন। আরিফ বললেন একতলায় সরকারের অর্থ দপ্তরের অফিস, সেখানে মাসিক পেনশন তুলতে লাইন দেন মানুষজন। এবার তিনি প্রশ্ন করলেন, দেখলে (দেশি কায়দায়, সিনিয়র লোক আমাকে অনায়াসে তুমি বলেন) কেমন চুপচাপ সবাই দাঁড়িয়ে আছে? তোমার আমার দেশে একেবারে গুলতানি, হট্টগোল চলতো! স্বীকার করলাম এমন নিঃশব্দে শত খানেক লোককে কখনো লাইনে দাঁড়াতে দেখি নি।
জীবন যাত্রা কেমন চলছে জানতে চাইলাম । তাঁর স্ত্রীর রক্তচাপ বৃদ্ধি জনিত অসুস্থতার ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখার মত ডাক্তার খুঁজছিলেন , ইওয়ানা বলেছে আপনি ফারমাসিতে গিয়ে বলুন ওরাই ওষুধ দিয়ে দেবে- ওভার দি কাউনটার । পশ্চিম ইউরোপে প্যারাসিটামল, ভিক্স , খুকখুক কাশির মতো নিতান্ত ছোটো খাটো বিড়ম্বনার আরাম দেওয়া ছাড়া অন্য কোন ওষুধ দোকানে গিয়ে চাইলেই পাওয়া যায় না, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লাগে। স্লোভাকিয়াতে আমাদের দেশের মতো ব্যবস্থা; যেমন পাইকপাড়ার সুমতি ফারমাসিতে যে কোন ব্যথা বেদনার অস্বস্তির কাহিনি জানালেই ওষুধ পাওয়া যেতো। এই প্রথা অবশ্য পরে বদলেছে পূর্ব ইউরোপের সর্বত্র, কিন্তু হালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রী সুনাক (এখন প্রাক্তন) জানিয়েছেন আটটা নির্ধারিত রোগের লক্ষণের ওষুধ অতঃপর ইংল্যান্ডের ফারমাসিতে পাওয়া যাবে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লাগবে না – সেই সুমতি ফারমাসির স্টাইল।
আমার কোসিতসে আসার মুখ্য কারণ পূর্ব স্লোভাক ইস্পাত প্রতিষ্ঠানে (ভিতসোদোস্লভেন্সকে জেলেজিয়ারনে বা ভি এস জেড) আমাদের কিছু ধ্যান ধারণা বেচা! কোসিতসের ধমনিতে বইছে ধাতু বিদ্যা বা মেটালারজি। ইউক্রেন সীমান্ত ষাট মাইল দূরে, সে দেশ থেকে আসে আয়রন ওর। এই একটি বাণিজ্য সংস্থান শহরের হাজার বিশেক লোকের অন্ন সংস্থান করে - প্রতি দ্বিতীয় পরিবারের অন্তত একজন মানুষ সেখানে কর্মরত –আমাদের প্রধান টার্গেট খদ্দের । কিন্তু সুবিধে করতে পারছি না। ডাচ ব্যাঙ্ক আই এন জি পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের মতো এখানেও তাদের আসর জমিয়ে ফেলেছে। ব্যাঙ্কিং-এর সঙ্গে তারা ইন্সিউরেন্সের ব্যবসা করে, তাতে জোটে প্রিমিয়াম, পাওয়া যায় স্থানীয় মুদ্রায়। আই এন জি ব্যাঙ্কের এই সাঁড়াশি আক্রমণের নেতা মাইকেল ক্লার্ক যাকে আমি চিনি : প্রফেশনাল শত্রু, ব্যক্তিগত ভাবে বিশেষ বন্ধু, আমাদের পাশের জিলা হ্যাম্পশায়ারের বেসিংস্টোকের বাসিন্দা, ট্রেনে যেতে আসতে দেখা হয়, আমারই বয়েসি, মাইকের জন্মদিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন’স ডে ! কিন্তু ওই যে একজন বলেছেন, ভাই চারাসে ধন্দা নহি বনতা! আরিফকে পেয়ে সেই আখ্যান শেষ করলাম এই বলে, ওই ভি এস জেড কোম্পানিতে আই এন জি লন্ডনের মাইকেল ক্লার্ক একেবারে দাবিয়ে বসে আছে, সি ই ওর সঙ্গে নিত্য ওঠা বসা করে । আমাদের প্রোপোজাল তাঁকে ধরানোর সুযোগ অবধি পাচ্ছি না। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কি যে করি !
আমার এই অভিযোগ অনুযোগ, দুখ ভরি কাহানি শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময়ে আরিফ বললেন, আমি তোমার এই মাইকেল ক্লার্ককে চিনি না, জানি না। কিন্তু আচ্ছা বল তো , তাঁরও তো দুটো হাত দুটো পা আছে তোমার মতো, তাই না ? তাঁর পেছনে না হয় হল্যান্ডের আই এন জি ব্যাঙ্ক আছে, তোমার পেছনে আছে তার চেয়েও বড়ো এক ব্যাঙ্ক। লড়াইতে নামো।
কঠিন বাণিজ্যিক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সকলেই চিনি সেই সব নির্জন মুহূর্ত- একদিকে বাজেটের নম্বরের চাপ, অন্যদিকে কঠোর ক্রুর প্রতিদ্বন্দ্বী, উদাসীন খরিদ্দার। কিভাবে জুটবে আমার পরের ডিল? সেদিনের কোসিতসেয় ছিল তেমনি একটা সময়। মনে হচ্ছিল এ আমার একার লড়াই, রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। সেদিন আরিফ আমাকে সান্ত্বনা দেন নি, আমার হাত ধরে তুললেন – তুম ভি কিসিসে কম নহি !
পরবর্তী দু বছরের মধ্যে আমেরিকান কোম্পানি ইউ এস স্টিল কিনে নেয় ভি এস জেড , সেখানে আমাদের কিঞ্চিৎ ভূমিকা ছিল। পুরো খেলাটাই যায় বদলে।
কলকাতা কর্পোরেশনের লোগো পুরশ্রী বিবর্ধন (দুষ্ট লোকে বলেছে পুরশ্রী বিসর্জন), তার তলায় নন্দলাল বসুর আঁকা একটি হাতের ওপরে ধরা মশাল। তেমনি ইউরোপের বিভিন্ন শহরের আছে কোট অফ আর্মস যেমন ব্রেমেনের চাবি, ভেনিসের সন্ত মার্কের সিংহ, অক্সফোরডের ষাঁড়, বার্লিনের ভালুক। ইউরোপের নাগরিক ইতিহাসে কোসিতসে প্রথম শহর যে আপন এম্বলেম সম্বলিত পতাকা ওড়ানোর অধিকার অর্জন করে। আর এর মধ্যেই নিহিত আছে এই শহরের ইতিকথা। পূবের হাঙ্গেরি থেকে পোল্যান্ডের দিকে সচল বাণিজ্য বহরের পথে এই শহরের নাম হলো কাশাউ। অনেক ভাষায় ঘুরে ফিরে আজকের কোসিতসে। হাজার বছরের পুরনো শহরের মালিকানা বদল হয়েছে বহুবার, হাঙ্গেরিয়ান, অটোমান, অটোমান সমর্থিত হাঙ্গেরিয়ান, হাবসবুরগ, হাঙ্গেরিয়ান । কোসিতসে শহরের কোট অফ আর্মসে চারটি শাদা চারটি লাল রঙ্গের সমান্তরাল লাইন, লিলি ফুলের সমাহার সকলই সেই বিভিন্ন রাজার প্রতীক । কোসিতসের স্থাপত্যও ঠিক সেই রকম। পোল্যান্ডের ট্রেড রুটে কোসিতসের তখন বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, রাজধানী বুদার পরেই হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বের দ্বিতীয় শহর। একদিন হাঙ্গেরিয়ান রাজা বেলা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হানোভার অঞ্চলের জার্মানদের এই শহর গড়তে। ট্যাঙ্ক বা কামান নয়, সেই জার্মানরা এসেছিলেন বিদ্যে বুদ্ধি, ছেনি হাতুড়ি নিয়ে -এক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে আরও পুবে, হাঙ্গেরি ছাড়িয়ে রোমানিয়া, ইউক্রনে। তাই স্লোভাকিয়ার কোসিতসে, হাঙ্গেরির দেবরেচেন, রোমানিয়ার ব্রাসভ, ইউক্রেনের তেরনোভিতসে পথের মোড় ঘুরলে মনে হয় যেন ব্রেমেন হানোভারের পুরনো শহরে আছি ! কালে কালে জার্মান স্থপতির পাশে দাঁড়িয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান, হাবসবুরগের মিস্তিরি। ফলে এ শহরে আজ পাস্ট মিটস প্রেজেন্ট। হয়তো সঙ্গত কারণেই স্লোভাকরা বলতে পারেন, আরে এ সবই তো ইনভেডারদের কীর্তি, ও সব মোটেই স্লোভাক ইতিহাস নয়! বলেন না। পথের পাশের অজস্র কাফে রেস্তোরাঁয় বসে তাঁরা উপভোগ করেন এক অনন্য ইতিহাস যা জীবন্ত হয়ে থাকে চোখের সামনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোসিতসে শহরে দেখা দিয়েছে সোভিয়েত কংক্রিট স্থাপত্য, যাকে ব্রুটালিজমের আরেক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে । পুরনো শহর ছাড়িয়ে উত্তরে গেলে চোখে পড়ে সারি সারি দৈত্যের আকারে অজস্র দশ তলা বাড়ি। সবুজের কোন খোঁজ মেলে না সেখানে- দৈনন্দিন জীবন যে নিতান্ত প্র্যাকটিকাল। তাকে মনে রাখি নি ।
সেই সরকারি পেনশন অফিস ছেড়ে সিটি ব্যাঙ্ক কসিতসের অফিস উঠে এসেছে ওয়েরফেরোভার ঝাঁ চকচকে নতুন বাড়িতে । ভি এস জেড আজ ইউ এস স্টিল, তবে শিগগির জাপানি নিপ্পন স্টিল তাকে কিনে নেবে বলে গুজব চালু। এককালের প্রতিপক্ষ মাইকেল ক্লার্ক অবসর নিয়ে তাঁর প্রিয় হবি, মোটর বাইকে চড়ে গ্রাম শহর চষে বেড়াচ্ছেন, ইগর থাম পরবর্তী কালে প্রথম স্লোভাক সি ই ও পদে সম্মানিত হয়, ইভেতা কিছুদিন ডাবলিনে কাজ করার পর এখন ফার্স্ট ব্যাঙ্ক অফ আবু ধাবিতে, মারেক পোল্যান্ড চেক রাশিয়া ঘুরে সিটি ব্যাঙ্ক দুবাইতে কর্মরত, রবার্ট অবসর নেওয়ার পরে থেকে গেলেন স্লোভাকিয়াতেই , আরিফ নানা দেশে সিটি ব্যাঙ্কের পদ অলঙ্কৃত করে এখন আপন দেশে সময় কাটাচ্ছেন, ইওয়ানা সিটি ব্যাঙ্ক স্লোভাকিয়াতে। কোসিতসেয় আই এন জির কোন শাখা নেই, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে আমার এককালীন সহকর্মী অ্যানড্রু বেসটার বর্তমানে আমস্টারডামে আই এন জি ব্যাঙ্কের পরিচালক মণ্ডলী বা মেন বোর্ডে বসেন।
আমার ফেরার পথটিও ছিল স্মরণীয়।
আজ অবধি মনে আছে এক দিকে উঁচু তাতরার ছায়ায় ছায়ায় সেই ট্রেন জার্নি। এ দেশের মাত্র চল্লিশ শতাংশ বাসযোগ্য – কিন্তু ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে দেখা বসবাসের অযোগ্য সেই পর্বতমালা, ঢালু উপত্যকা, এখানে ওখানে দুর্গের চুড়ো, দেওয়াল, হ্রদ, অপরূপ সবুজ বনানীর দৃশ্য ভোলা যায় না - পাঁচ ঘণ্টার যাত্রায় সে ট্রেন থামে দীর্ঘ ব্যবধানে। সেখানে তখন তুমুল কর্মব্যস্ততা - আমাদের দেশের জংশন স্টেশনে গাড়ি থামলে যেমন হয়। চায় গরম নেই কিন্তু আছে সসেজ রুটির ফেরিওলা ! সহযাত্রীদের ওঠা নামার বার্তালাপে শিখলাম একটি জরুরি স্লোভাক কথা – আহয় ( হ্যালো )! এই শব্দটিকে আমরা চিনি অন্য প্রেক্ষিতে - এক জাহাজ বা নৌকো থেকে অন্য জলবাহী যানের উদ্দেশ্যে বলা হয় আহয় ! টিনটিনে প্রথম এটা পেয়েছিলাম।
কোসিতসে-ব্রাতিস্লাভা ট্রেনে আমি প্রথম ফোন বা কম্পিউটার চার্জ করার প্লাগ পয়েন্ট দেখেছি (১৯৯৬)। ব্রিটেন বা জার্মানিতে কেন , এমনকি ইউরোস্টার ট্রেনেও সে সুবিধা ছিল না ।
কোসিতসে শহর কোনদিন আপনার ভ্রমণ তালিকায় স্থান পাবে না জানি কিন্তু যদি পথ ভুলে আসেন, হাঁটবেন প্রশস্ত, আদিগন্ত চলে যাওয়া হ্লাভনা উলিতসায়। বার্সেলোনার লাস রামবলাস দেখে কবি লরকা বলেছিলেন, এ পথ যেন কোথাও শেষ না হয়। এই উলিতসা (পথ) যেন তেমনই - এলিজাবেথ ক্যাথেড্রালের সামনে সংগীতময় ফোয়ারা -সন্ধ্যায় সেটি গানের সুরে নৃত্যরত; অজস্রে রঙে রাঙানো দু পাশের ঘর বাড়ি, ব্ল্যাক ডেথের স্মারক ইমাকুলাতা, পথের পাশের কাফেতে বসে দেখা ইতস্তত মানুষের ধারা।
পিকচার পোস্ট কার্ডে নয়, আমার কোসিতসে থেকে গেছে কোসিতসেতেই -বুকের ভেতরে বয়ে এনেছি কিছু মুহূর্তের, কিছু মানুষের স্মৃতি ।
আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।
আমার বন্ধুজন অভিযোগ করেছেন আপনি এত ঘুরেছেন, কখনো খাই খাই মনে হয় নি? এস বোসো আহারে? তার গল্প করেন না কেন?
তাঁদের মান্য করেই আমি মাসিদোনিয়া পর্বে বলকান ভোজন কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বুঝেছি যে কোন রেসিপির কপি রাইট নিয়ে সব সময় দেশে দেশে লড়াই লেগে থাকে। হাইফার ইজরায়েলি রেস্তোরাঁ হুমুসকে আদি ইহুদি সৃষ্টি বলে দাবি করেছিল। ভিয়েনার ধারনা প্রকৃত সসেজ একমাত্র তাদের রান্নাঘরে প্রস্তুত হয়ে থাকে। আপনি আমি নিতান্ত অজ্ঞ টুরিস্ট কিন্তু মিউনিক বার্লিনে এ কথা সর্ব সমক্ষে বললে প্রহারিত হবার সম্ভাবনা আছে। রোমানিয়া থেকে আলবানিয়া অবধি বিস্তৃত বলকান ভূখণ্ডে কোন খাবার কাদের অরিজিনাল এ নিয়ে বাদ বিসম্বাদ লেগেই থাকে।
মারটিনার মা হেনরিয়েটাকে সেদিন বললাম ‘তোমার দেশ নিয়ে লিখছি, বল দিকি তোমার দেশে এক আগন্তুকের প্লেটে তুমি কোন আদি ও অকৃত্রিম স্লোভাক খাবার পরিবেশন করবে ?'
হেনরিয়েটা বললে, গুলাশ !
কি সর্বনাশ, হাঙ্গেরিয়ানরা যে নিজেদের গুলাশের প্রপিতামহ বলে দাবি করে থাকেন! সেই কবে আলি সায়েব বলে গেছেন গুলাশ মশলা দেওয়া মাংসের ঝোল মাত্র! বহুবার স্বাদ আহরণ করে আমি ঠিক তাই মনে করেছি। স্লোভাকরা দীর্ঘকাল হাঙ্গেরিয়ানদের প্রজা, তাদের রান্নাঘরে বা ভোজসভায় পরিচিত হয়েছে গুলাশের সঙ্গে। যেমন ওয়াজেদ আলি শাহ কলকেতা শহরকে দিয়ে গেছেন বিরিয়ানি।
যদিও রোমানিয়ান রোদিকার কাছে হাঙ্গেরি চির শত্রু তবু গুলাশের অরিজিনালিটি নিয়ে তার মনে প্রশ্ন নেই। আমাদের যৌথ প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে হেনরিয়েটা অনেক ভেবে বললে, হালুশকি !
বাঁধা কপি, প্রভূত পরিমাণে মাখন ও বেকন সহযোগে ডিমের নুডলের এই মহান সমন্বয়ের নাম হালুশকি । প্রত্যক্ষ ভোজনকারি হিসেবে বলতে পারি সেটি অতীব সুস্বাদু। সেই স্বর্গীয় অনুভূতিকে সম্যক উপভোগ করতে গেলে কোলেস্টেরল, ফ্যাট, সুগার কনটেন্ট ইত্যাদি পীড়াদায়ক চিন্তাকে সাময়িকভাবে নির্বাসনে পাঠানো বাঞ্ছনীয়। স্লোভাক রান্নায় চিজ মাখন আলুর অনাবিল ব্যবহার হয় আপনার রসনার পুলক সঞ্চারের বাসনায়, হেলদি লিভিং পত্রিকার নির্দেশ অনুযায়ী নয়।
জাবজ্জিবেৎ সুখং জিবেৎ ।
জার্মান বিয়ারের বর্ণ এগেন ভক্ত হয়েও বলি স্লোভাক বিয়ার পান করে ও করিয়ে সমান তৃপ্তি। আমার জার্মান বন্ধুরা অবশ্যই বলেন , টেকনিকটা আমরাই ওদের শিখিয়েছি! বুধভার ( যাকে আপনারা বাদওয়াইজার নামে চেনেন ) এদের বিয়ারের পূর্বসূরি! পেটেন্টের মালিকানা যারই হোক না কেন, সোনার রঙের যে পানীয় আপনার গ্লাসের ভেতরে দেখা দেয় সেটি স্বাদে ও গুনে অসামান্য। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের যুগে বিয়ার বানানোর সময়ে যে শুদ্ধতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল (রাইনহাইটসগেবোট , ১৫১৬) স্লোভাক বিয়ার সেটিকে সম্ভবত মেনে চলে।
পানীয়ের জগতে স্লোভাকদের শ্রেষ্ঠ অবদান বিভিন্ন প্রকারের বেরি (যেমন জুনিপার, রাস্পবেরি), পিচ বা প্লাম থেকে তৈরি শ্নাপস- বোরোভিতসকা, যার অ্যালকোহলিক কনটেন্ট অন্তত চল্লিশ পারসেন্ট। ভোজনের পরে পরিমিত পরিমাণে সেবনীয় এবং পরীক্ষা প্রার্থনীয় !
অধিকন্তু দোষায় !
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায় ! *