জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেন অ্যাফেয়ারস নিয়ে পাস করার পরে হয়তো বিদেশকে চেনার অভিলাষে ইতালিয়ান আমেরিকান যুবক উইলিয়াম রোকা একদিন সুদূর প্রাগে আবির্ভূত হয়ে নতুন জীবনের সন্ধান শুরু করেছিল। ভাষা শিক্ষা করে চেক ফার্মে কাজ পেলো, একদিন সাক্ষাৎ হলো কারোলিনা নাম্নী এক মহিলার সঙ্গে। এবার তার প্রয়াস হলো আধা চেক নাগরিক বনে যাবার। একদিন কেন সে প্রাগে হাজির হয়েছিল, বুদাপেস্ত বা বার্লিন কেন নয় এর কোন সদুত্তর সে কোনদিন দেয় নি। তবে একদিন তার দুর্মতি হলো, দেশে ফেরা না হোক, অন্তত তার দেশের কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে সে মজদুরি করবে। ফল হল বিবিধ - প্রাগে বাস, সম্ভাব্য চেক পত্নী, আমেরিকান প্রভু, ঘরে চেক, অফিসে ইংরেজি। শ্যাম, কুল, ডলার, কোরুনা – সর্বরক্ষে!
উইল (সে কখনো উইলিয়ামদের প্রচলিত ডাক নাম বিল বলে পরিচিত হতে চায় নি) আরেকটা শিক্ষা পেলে- যদিও সিটি নিউ ইয়র্কের ব্যাঙ্ক, ইউরোপীয় ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই ইউরোপিয়ান অথবা ভারতীয় উপ মহাদেশের মানুষ। যেমন সিটিব্যাঙ্ক প্রাগের সি ই ও কার্ল স্বভোদা ; জন্মসূত্রে সুদেতেন জার্মান কিন্তু, উইল ঠাট্টা করে বলতো, দি ওনলি থিং চেক অ্যাবাউট হিম ইজ হিজ লাস্ট নেম – স্বভোদা! (চেক অর্থ স্বাধীনতা, তা থেকে স্লবোদান, যেমন স্লবোদান মিলোসেভিচ)। আমেরিকান উইল তাকে লজ্জা দিতে পারে কারণ কার্ল সুপ্রভাত, ধন্যবাদ ধরণের সম্ভাষণ ছাড়া আর কোন চেক শব্দ জানেন না বলে দুর্নাম রটেছে অফিসে।
উইলকে একদিন বলা হলো - যদিও সে প্রাগ অফিসের কর্মী, প্রোডাক্ট লাইন অনুযায়ী তাকে লন্ডন অফিসের সঙ্গেও কাজ করতে হবে। এই বিচিত্র রিপোর্ট পদ্ধতির নাম মেট্রিক্স ম্যানেজমেন্ট। উইলের স্থানীয় প্রভু কার্ল যিনি তার দৈনন্দিন উপস্থিতির পর্যবেক্ষণ করবেন, ছুটি ছাটা, কর্ম বণ্টন, বেতন, কাজে প্রোমোশন অথবা অধঃপতনের জিম্মেদার। উইলের কাজের তালিকার মধ্যে পড়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং অরিজিনেশন – অর্থাৎ চেক বা স্লোভাকিয়াতে ঋণ, বন্ড ফিরি করা, যদি কোন খদ্দেরের সন্ধান মেলে তৎক্ষণাৎ সে লন্ডনে ৩৩৬ নম্বর স্ট্র্যানড অফিসের ছ তলায় আমাদের এত্তেলা করবে, আমরা এই ডিলের পুরো দায়িত্ব নেবো। ক্ষেত্র প্রস্তুত করা তার কাজ, আমরা গিয়ে হাল চালাবো। ডিল পাকলে আমার সুযোগ্য সাগরেদরা ‘লোন কিনবে গো’ বলে মাঠে নেমে পড়বে, বনগাঁ লোকালে দন্ত মঞ্জন ফেরিওলার করার সঙ্গে তার পার্থক্য সামান্য।
একদিন সে এলো আমার অফিসে। দাড়িওলা ভারতীয় অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলা মানুষটির সম্বন্ধে তার প্রাথমিক ধারণা কি হয়েছিল জানি না। প্রথম দিন থেকে উইলকে আমি দেখেছি সম্ভ্রমের সঙ্গে। অসম্ভব পরিশীলিত, মিতবাক, নিষ্ঠাবান শ্রোতা, শান্ত - কখনো তাকে উত্তেজিত হতে বা চার অক্ষরের ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে শুনি নি। দু কথার পরেই মাতব্বরি দেখানোর জন্য মধ্য ইউরোপে আগত তরুণ আমেরিকানের সামনে কাফকা প্রসঙ্গ তুললাম; প্রাগে থাকে, বাণিজ্যের বাইরে সে শহরের কতটা কি খবর রাখে জানবার জন্যে। খানিকটা আলতো বল ছুঁড়ে দেওয়ার মতন। লুফে নেয় কিনা দেখি। অত্যন্ত বিনীত ভাবে উইল জানালো প্রাগে এসেই সে কাফকার বাড়ির খোঁজে গেছে, তাঁর কাফকার পদ চিহ্ন চেনার চেষ্টা করেছে এবং সাকুল্যে তিনটে বই সে পড়েছে, অবশ্যই ইংরেজি অনুবাদে।
শুনে চমকাতে হলো।
জানি ব্যাংকিং নামক পেশায় সাহিত্য চর্চার পরিসর সীমিত এবং নিরর্থক। কিন্তু বরানগর স্কটিশ চার্চ কলেজ কলকাতার কাঁটাকলের যে আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছি সেখানে প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে শুধু রবীন্দ্রনাথ জুড়ে থাকেন না, থাকেন সকল কবি, শেক্সপিয়ার, বারনারড শ, অরওয়েল, কাফকা, কামু। ষ্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াতে একটি গোলমেলে ঋণদানের প্রস্তাব পাঠ করে ক্রেডিট গুরু বলেছেন, ইন টু হোয়াট ডেঞ্জার উইল ইউ লিড মি, হীরেন!
ইউরোপে এসে অবধি তাঁদের স্মরণ করেছি সেটি একান্ত নির্জনে অথবা পুত্র কন্যার সমক্ষে (তাদের না শুনে উপায় নেই) – ডেনমার্কে হেলসিংগর থেকে সুইডেনের ফেরিতে ওঠার সময় ছেলেকে শুনিয়েছি, এই বন্দরে কেউ তাঁর পুত্রকে বিদায় দেবার সময় বলেন, নাইদার এ বরোয়ার নর এ লেনডার বি। ফোরো রোমানায় মনে করেছি মার্ক অ্যানটনিকে – আই কাম টু বেরি সিজার নট টু প্রেজ হিম। নিতান্ত ভাগ্যবলে এমনি কতবার আমার শোনা জানা কত না বাক্য সলিলকি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বানারড শ কেন, শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে দুটো মোক্ষম কোটেশন ছাড়তে পারে এমন ইংরেজ আমেরিকান ক্বচিৎ চোখে পড়েছে। একবার আমাদের কমোডিটি বিভাগের বিগ বস টম শরটেল খদ্দেরের সঙ্গে মিটিং সেরে অফিসে এসে ধপাস করে বসে বলেছিলেন, ও হোয়াট এ ট্যাংগলড ওয়েব উই উইভ! সেটাও ব্যতিক্রমের পর্যায়ে পড়ে। টিম মিটিঙে যখন বলেছি একবার হারলে ক্ষতি কি? উই লিভ টু ফাইট অ্যানাদার ডে -এটা কি প্রসঙ্গে বল তো? শূন্যদৃষ্টি পেয়েছি। সিটি ব্যাঙ্ক হামবুর্গে এক তরুণী অফিস সেক্রেটারিকে পেয়েছিলাম যে অবলীলাক্রমে টোমাস মানের কনুল্প গল্পটা শুনিয়েছে, হাউপটমান ফন কপেনিক পড়তে অনুরোধ করেছে। নিনা হয়তো ভুল করে ব্যাঙ্কে এসেছিল। এসব ব্যাঙ্কিঙ্গের কারিকুলামে পড়ে না, আমার প্রচেষ্টা মাঠেই মারা যায়। শ্রোতা মনে করেন শো অফ করছি, জার্মানে যাদের নাম আনগেবার, প্রিটেন্ডার।
বাণিজ্য সূত্রে আমার প্রথম প্রাগ অভিযানের সকালবেলা উইল আমাকে নিতে এসেছে, সঙ্গে তার সহকর্মী স্বর্ণকেশিনী ইভানা। ব্রেকফাস্টে উইল সেদিনের মিটিং তালিকা দেখালো। লক্ষ্য করলাম প্রথম কাস্টমার মিটিং সাড়ে বারোটায়, লাঞ্চে। তাহলে সকালবেলা কোথায় যাবো? উইল তার স্বভাবসিদ্ধ বিনীত হাসি হেসে বলল, পারিস্কা! কাফকার বাড়ি! আমরা এখুনি ব্যাঙ্কে বা কোন মিটিঙে যাচ্ছি না।
মেয়েটির চোখ মুখ আলোকিত হলো। ব্যাঙ্কের কাজে এটা তার কাছেও নতুন অভিজ্ঞতা।
উইল আমাকে নিয়ে গেলো পুরনো প্রাগের মাঝখানে। যে ইহুদি পরিবারের বাড়িতে তেসরা জুলাই ১৮৭৫ সালে শিশু কাফকার জন্ম গ্রহণ করেন, সেটি একদা তৈরি হয়েছিল প্রাগের সেন্ট নিকোলাস গিরজের ক্যাথলিক পুরুতদের বসবাসের জন্যে! ১৮৯৭ সালে ইহুদি ঘেটোর অবসানের সময় সে বাড়ি ভাঙা পড়ে, আজ কেবল মাত্র তার পুরনো দুয়োরটা দেখা যায়। অতএব কাফকার আদি বাড়ি আপনি দেখতে পাবেন না। তাতে কি, প্রাগের সবচেয়ে প্রখ্যাত সন্তানের স্মরণে এই বছর বিশেক আগে পৌরসভা সেখানে বানিয়েছেন কাফকা স্কোয়ার (নেমেসতে ফ্রান্তসে কাফকি)। একদা সেন্ট পিটারসবুরগে আনার সঙ্গে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে দস্তয়েভস্কির কল্পিত রাসকোলনিকভের বাড়ি, উপাসনার গিরজে খুঁজেছিলাম। উইলের সঙ্গে হাঁটলাম কাফকার স্কুলের পথে - প্রথম বিদ্যাপীঠ ডয়েচে কনাবেনশুলে বা কিন্ডারগার্টেন, আজকের মাসনা নামক পথে। মাইসলোভার বাড়ি থেকে কিন্সকি পালাস চত্বরের মধ্যে আলটষ্টেডার ডয়েচে গিমনাসিউম মিনিট কয়েকের পথ। আট বছর বাদে কাফকা গেলেন কার্ল ফারদিনান্দস ডয়েচে ইউনিভেরসিতেতে। সে সময়ে বোহেমিয়ান কার্ল বিশ্ববিদ্যালয় দু ভাগে বিভক্ত - কার্ল ফারদিনান্দে পড়ানোর মাধ্যম জার্মান, অন্যটিতে চেক মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। সেটিও হাঁটা পথ মাত্র। ধর্ম চর্চা প্রাগের সিনাগগে – তার নামটি বিচিত্র। নতুন-পুরনো সিনাগগ! সারা ইউরোপের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেখানে সবচেয়ে দীর্ঘদিন প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিতা হ্যারমানের কঠোরতম শাসন উপেক্ষা করে যুবক কাফকা প্রতি শনিবার সিনাগগে হাজরে দিতে অস্বীকার করেন। পিতার সঙ্গে কাফকার নিরন্তর মতভেদ তাঁর ব্রিফে আন ডেন ফাটার (বাবাকে চিঠি) পুস্তকে স্পষ্ট।
পারিবারিক শান্তি বজায় রাখার জন্য চারটি প্রধান ধর্মীয় দিবসে কাফকা গেছেন – পেসাখ (পাসওভার), সুকোথ (চল্লিশ বছরের মরুভূমি পরিক্রমার স্মৃতি ,তাঁবুতে বাস), রশ হাসানা (নববর্ষ) এবং ইওম কিপ্পুর (অনুশোচনার দিন -ইহুদি ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে পবিত্র)। সবচেয়ে বেশি দিন কাজ করেছেন বোহেমিয়ার শ্রমিক দুর্ঘটনা বিমা প্রতিষ্ঠানে (আরবাইটার ঊনফালফেরজিখেরুং) -তার ঠিকানা ৯ নম্বর না পরিসিসি যেটি আজকের হোটেল সেঞ্চুরি ওল্ড টাউন। বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল দূরে, নিশ্চয় হেঁটেছেন! আড্ডা দিয়েছেন প্রাগের নিচা নগরে (মালা স্ত্রানা), নদীর অপর পারে সেটাও ওই মাইল খানেকের দূরত্বে।
আধুনিক সভ্যতার প্রচণ্ড প্রভাব উপেক্ষা করেও কাফকার প্রাগকে একটি ছোট্ট বৃত্তের মধ্যে যেন ধরা ছোঁয়া যায় গেলো।
এই দিনের বেলাতেও প্রাগের প্রাচীন বাড়ি ঘর গলি ঘুপচির ভেতরে যেন রহস্যময় আলো আঁধারির খেলা দেখতে পাই। এ শহরের সঙ্গে পরিচয় যতো বেড়েছে, ততোই সেটি অনুভব করেছি। কাফকার ডাস শ্লস (কাসল) অথবা ডের প্রোৎসেসের (ট্রায়াল) ছায়ান্ধকার জগতটি – যেখানে নাম না জানা লোকেরা আদালতে হাজিরার এত্তেলা পাঠায়, আদালত বসে ধোপানীর বাড়িতে, অপরাধের কোন কারণ জানা যায় না, গ্রামের লোকেরা দুর্গের পরিচালকদের প্রতি আস্থা রাখেন, দেখতে পান না কাউকে, ভেতরে অসংখ্য মুখহীন মানুষ সতত সঞ্চরমান।
কাফকার পথ পর্যটন করে একটি কাফেতে বসা গেল – আমরা কাফকাকে ছাড়ি নি। তিনি এবার উদিত হলেন আরেক রূপে। লন্ডনে উইলের সঙ্গে প্রথম গল্পগাছার সময়ে জেনেছিলাম কারোলিনার কাহিনি। সিয়াটলের এই সুবোধ আমেরিকান যুবককে পথভ্রষ্ট করার বাসনা জেগে উঠেছিল নিতান্ত পরিহাসের ছলে উইলকে একটি জার্মান আপ্ত বাক্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই –
ফেরলিবে দিখ অফট, ভেরলোবে দিখ জেলটেন, হাইরাতে দিখ নি
প্রেমে পড়ো অজস্রবার, প্রতিশ্রুতি দাও কদাচ, বিয়েটি নৈব নৈব চ।
বয়স্ক লোকেরা সুযোগ পেলেই নানান আজে বাজে গপ্প ছাড়ে; তরুণদের কাজ সোনামুখ করে বিনা প্রতিবাদে সে সব শুনে যাওয়া। সেদিন উইল তাই করেছিল।
আজ কফি হাউসে বসে উইল বললে, আমার বেশ মনে আছে তোমার ওই বাণী ; আমার ক্ষেত্রে খাটবে না। সামনের মাসেই আমার বিয়ে, তোমার আসা চাইই! কিন্তু প্রাগে এসে ইস্তক কাফকা সম্বন্ধে যতো জেনেছি ততো মনে হয়েছে সম্ভবত তাঁকে দেখেই কেউ এই জার্মান আপ্তবাক্যের রচনা করেছিলেন। কাফকা প্রেমে পড়েছেন বহুবার, বিয়ের শপথ নিয়েছেন কয়েকবার কিন্তু বিয়েটি করেন নি।
ইভানা এতক্ষণ অলস আগ্রহ নিয়ে আমাদের গল্প গুজব শুনছিল। এবার নড়ে চড়ে বসল।
প্রথম প্রেমের নাম বার্লিন বাসিনী ফেলিচে বাউয়ার, কাফকার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু মাক্স ব্রোডের পিসতুত বোন (কাফকা মাক্স ব্রোডকে নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর সকল অপ্রকাশিত রচনা পুড়িয়ে ফেলার, মাক্স সেই প্রতিজ্ঞা পালন না করে আমাদের সকলের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা কুড়িয়েছেন)। এই প্রেম চলাকালীন কাফকা ফেলিচে বাউয়ারের এক বন্ধুর (মারগারেথে) প্রেম পাশে আবদ্ধ হন। গুজব অনুযায়ী এই সম্পর্কের পরিণাম একটি শিশু, যে স্বল্পকালের মধ্যেই মারা যায়। ইতিমধ্যে ডাক্তাররা সহমত কাফকা সে আমলে দুরারোগ্য টিউবারকিলোসিসে ভুগছেন। এই সময়ে তিনি মিলেনা নামের এক বিবাহিতা চেক সাংবাদিকের প্রেমে পড়লেন -লুকোনোর কোন চেষ্টাই করেন নি। তাঁর লেখা পত্রাবলী ডি ব্রিফে আন মিলেনা (মিলেনাকে চিঠি) এক প্রাঞ্জল স্বীকারোক্তি। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে যাকে ভালবাসলেন তিনি কাফকার প্রথম ইহুদি প্রেমিকা, ডোরা ডিয়ামনট (হীরে, ডায়ামনড) তাঁকে তিনি বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেন, একত্র থাকবেন বলে বার্লিন গেলেন। কিন্তু বিয়ে করলেন না। অনুপ কুমারের মতন পলাতক কাফকা চিরতরে চলে গেলেন দু বছর বাদে।
চল্লিশ বছরে বয়েসে কাফকা বিদায় নিলেন , সাতচল্লিশ বছরে কামু।আমাদের ঘোর আজও কাটল না।
প্রাগে গিয়ে অভিভূত হন নি এমন মানুষ বিরল কিন্তু প্রাগ কি শুধু পথঘাট, ক্লাসিক অট্টালিকা, গ্রিডের ছকে সাজানো ছবি? ও’হেনরির ভয়েস অফ দি সিটি গল্পে (শহরের বাণী নামে বাংলা অনুবাদে পড়েছি) অরেলিয়া বলেন, প্রত্যেক শহরের একটি বাণী আছে, মেসেজ – সেটা কোথাও লেখা থাকে না গানেও শোনা যায় না।
প্রথম দিনের সন্ধ্যেয় দেখা প্রাগের এক ছায়া ঘেরা রহস্যময়ী রূপ থেকে গেছে আমার মনের ভেতরে। ইউরোপে পুরনো শহর অনেক দেখেছি – ভিয়েনা বুদাপেস্ত ভিলনিউস। কিন্তু প্রাগের অলিতে গলিতে, দুটি বিশাল বাড়ির মাঝের উঠোনে, অন্ধকার উঁচু জানলায়, উদ্ধত গৃহ শিখরে নিত্যিদিন যেন চলেছে জল্পনা, ফিস ফিস করে কি কথা, কার কথা? কাফকার চরিত্র ইওসেফ কে হাঁটেন এখান থেকে সেখানে, সেই অন্ধকারে। অন্ধকারের এই আলপনাকে কিছুতেই কয়েকটি শব্দের বাঁধুনিতে টেনে আনতে পারি না।
বরং স্মরণ করি আমাদেউস ছবিটি। ভলফগাঙ্গ আমাদেউস মোতসারতের জীবন নিয়ে সাজানো শেফারের অনবদ্য চলচিত্র (মূল -আমাদেউস স্টেজ প্রোডাকশন) এখানে ভিয়েনার অনেক দৃশ্য প্রাগে চিত্রায়িত হয়েছে ; যেমন অন্ধকার গলির মধ্যে, এ বাড়ি ও বাড়ি পার হয়ে যান অস্ট্রিয়ান রাজসভার তানসেন সালিয়েরি ইতালিয়ান অপেরা রচনার যার একছত্র অধিকার, যিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না সালতসবুরগের এক উদ্ধত যুবককে। গিরজেয় দাঁড়িয়ে প্রভুর সামনে কাঁদেন- এতো প্রতিভা তুমি কেন একটা মানুষকে দিয়েছো? সেই সঙ্গে যেন ষড়যন্ত্রের ছায়া তার সঙ্গে চলে। মোতসারতের ডন জিওভান্নি অপেরার প্রিমিয়ার হয়েছিল প্রাগের নোস্তিজ থিয়েটারে ২৯শে অক্টোবর ১৭৮৭ এবং চেক ভাষায়! আমাদেউস ছবিতে টম হালস বর্তমানের নোস্তিজ থিয়েটারে ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে কনডাকট করেছেন যেখানে দু শো বছর আগে আসল মোতসারত ডন জিওভান্নির প্রিমিয়ারে সেটি করেন। পরিচালক শেফার দেখাতে চেয়েছেন এই ডন জিওভান্নি যেন মোতসারতের পিতার আত্মা যা তাঁকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে, উদ্ভ্রান্ত মোতসারত লিখতে শুরু করেন নিজের রিকুয়েম, মানুষের মৃত্যুর পরে যা লেখা হয়ে থাকে। মাত্র চার বছর বাদে মোতসারত মারা যাবেন পঁইত্রিশ বছর বয়েসে। সালিয়েরি বাঁচবেন আরও অনেক দিন। তাঁকে কে আজ মনে রাখে?
গদ্যময় পাদটীকা
ব্রিটেনের প্লাগ তিন পায়ার, ইউরোপে দু পায়ার। তাই সর্বদা সঙ্গে থাকে তিন থেকে দুই করার ম্যাজিক অ্যাডাপটার। সেদিন কাফকার বাড়ির উলটো দিকের কাফেতে ফোন চার্জ করার পরে সেটি খুলে নিতে ভুলে যাই! কেন জানিনা তিরিশ বছর যাবত সেটা ভুলি নি – কাফকা, প্রাগ, উইল রোকা এবং অ্যাডাপটার একই সুতোয় বাঁধা! মায়ার দশম বর্ষ পূর্তির উৎসবে প্রাগে গিয়েছিলাম, তাকে দেখাতে ভুলি নি কোন কাফেতে সেই অ্যাডাপটারটা ফেলে আসি।