চারদিক দেখেশুনে সের্গেই বললে, “আমার মতে ইংরেজ অতি বুদ্ধিমান প্রাণী”।
সের্গেই উরাল সিব নামক একটি ব্যাঙ্কের বৈদেশিক বিভাগের প্রধান। বয়েস ষাটের কাছাকাছি। গত বিশ বছর এই নব সংগঠিত ব্যাঙ্কে নানান বিভাগের দায়িত্ব সে নিয়েছে। মাঝারি উচ্চতা। মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি লেগে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে সরকারি কাজে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন। ভাল ইংরেজি বলেন। যেটি এই নতুন রাশিয়াতে তেমন দেখি না।
পনেরো নম্বর অ্যাবচার্চ লেনে লন্ডন ক্যাপিটাল ক্লাবের একতলার বারে বসে আছি। একটু পরে দোতলায় ভোজনাগারে যাব। আমি ইংরেজ নই। তাই এই দেশবাসীদের অপ্রত্যাশিত প্রশস্তিতে আমার পুলকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবু তার এই বিদগ্ধ মন্তব্যের উৎসটি জানতে চাইলাম। সের্গেই তার মোক্ষম কেতাবি ইংরেজিতে বললে, “তুমি যে ইংল্যান্ডের ক্লাব সভ্যতার সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছো, তার প্রমাণ আগেও পেয়েছি (কলোনিয়াল যুগের জিতা জাগতা সবুত ইস্ট ইন্ডিয়া ক্লাবের সঙ্গেও তার পরিচয় করিয়েছি!)। সেখানে তোমার আসা-যাওয়া মধ্যাহ্ন বা সান্ধ্য ভোজনে। কদাপি চা পানে। কিন্তু এই ক্লাব সভ্যতার পিছনে কোন চিন্তা প্রছন্ন আছে সেটি কি অনুধাবন করার চেষ্টা করেছো? আমি লক্ষ করেছি এই সব ক্লাবে দিনের বেলায় বেশিরভাগ বয়স্ক পুরুষের সমাবেশ হয়। মাথা এখুনি ঘুরিও না। কিন্তু বারের ঠিক সামনের টেবিলে যিনি একা বসে ফাইনান্সিয়াল টাইমসের পাতা উলটোচ্ছেন তাঁর আজ কোথাও কোনো কাজ আছে বলে তো আমার মনে হয় না। আমি ধরে নিচ্ছি তিনি এবং তাঁর মত যাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন, তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনটা এখানে কাটান কারণ তাঁদের কোনো নিয়মিত কাজ নেই। ফোন বাজে না। এমনিতেই তোমাদের ক্লাবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ, তবে কারো ফোন এসেছে চোখে পড়লে মানুষ বাইরের করিডোরে গিয়ে কথা বলে দেখেছি। এঁরা সবাই ক্লাবে অন্ন গ্রহণ করেন, তার সঙ্গে প্রভূত পানীয়। স্যুট ও টাই পরে আসেন। আমার মতে এঁরা শুধু যে অবসরপ্রাপ্ত তাই নয়, এঁরা দিনের বেলার গৃহত্যাগী। সন্ধ্যেয় নীড়ে ফিরে যান। ক্লাব গুলি তাঁদের দিবা যাপনের পান্থশালা।”
যাযাবরের ‘ দৃষ্টিপাত ‘ মনে পড়ল! তিনি নতুন দিল্লির কালীবাড়ির কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘দু’জন ইংরেজ একত্র হলে একটা ক্লাব খোলে। দু’জন বাঙালি একত্র হলে খোলে কি? কালীবাড়ি?!’
ব্যাঙ্কের খদ্দের নিয়ে লর্ডসের প্যাভিলিয়নে বসে দেখেছি, বয়স্ক মানুষেরা স্কোর লেখার শিট আর পেন্সিল নিয়ে মাঠের পানে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। প্রতি বলের পরে রান হল কিনা বা কত হল – সেটি লিপিবদ্ধ করেন। আমি টেস্ট ম্যাচ, টি-টোয়েনটি বা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার কথা বলছি না। এই ধরুন মিডলসেক্স বনাম কেন্টের তিন দিনের কাউন্টি ম্যাচের মত সম্পূর্ণ অর্থহীন ক্রিকেট। মাঠের ভেতরে ১৩ জন খেলোয়াড় দু’জন আম্পায়ার। মাঠের বাইরে ঘাস পরিচর্যার মালি, টিকিট পরীক্ষক – সব মিলিয়ে হয়তো জনা চল্লিশ মানুষ। আমি এসেছি খদ্দেরের সঙ্গে বসে গুলতানি করতে, তাকে লর্ডস প্যাভিলিয়ন ঘোরাতে। তার সঙ্গে চলে খুঁটিনাটি অপ্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ, যেমন এদের টয়লেটে দু’টি দ্বার। একটিতে লেখা আউট, অন্যটিতে নট আউট। বারে কর্মরতা বাদে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ (কয়েক বছর আগে অবধি)। প্লেয়ারস বারের ঘণ্টাটি – যার ধ্বনি দ্বারা খেলার সূচনা নির্দেশ করা হয়। কমিটি রুম – যেখানে টেস্ট ম্যাচের দল নির্বাচন হয় ম্যাচের আগের রবিবার, লং রুম (যার তলায় কোন থাম নেই – ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় পিলারবিহীন ছাত, ফ্রি স্ট্যান্ডিং রুফ), ব্র্যাডম্যানের ব্যাট, অ্যাশেস, হ্যাম্পটন কোর্ট প্রাসাদের বাইরে সবচেয়ে বড় রিয়াল টেনিস কোর্ট। তারপরে দীর্ঘ তরল লাঞ্চ। ক্রিকেট খেলা দেখাটা একটা আংশিক উদ্দেশ্য মাত্র। অথচ সেই সব সাদা চুলের মানুষজন সারাদিন খেলা দেখছেন, স্কোর লিখে যাচ্ছেন। এ কি অলস মায়া? শুধু ছলনা? বাড়ি গিয়ে কি এগুলি ফাইল করবেন? কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে গা ঢাকা দিয়েছেন?
বলশয় থিয়েটারের কাছাকাছি মেট্রোপোল হোটেলে এবারের আস্তানা গেড়েছিলাম। আজ দশটা নাগাদ আমাদের দেখা হবে লুবিইয়াঙ্কার কফি হাউসে। কোনো নির্ধারিত সময়সীমা ছাড়াই, আজ আমার কর্মহীন দিন।
সেই ক্লাব প্রসঙ্গ আবার উঠল। সের্গেইয়ের কথার সঙ্গে একমত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। লন্ডনের ক্লাবগুলি আদতে অবসরপ্রাপ্ত পুরুষদের দিবাশ্রম! সের্গেই বললে, “এজন্যেই বললাম, ইংরেজ খুব চতুর। এটা আমরা রাশিয়ানরা শিখে উঠতে পারিনি। এত বছর ধরে আমাদের কানে গুঁজে দেয়া হয়েছে কমরেড, এগিয়ে চল। কাজ করে যাও। আরে বাবা, কাজের পরে কী হবে? এই যে আমার ষাট বছর হতে চলল। কাজ শেষ হলে আমি কোথায় কীভাবে সময় কাটাব? বাড়িতে? তবে হ্যাঁ, আমরাও কিছু বুদ্ধি রাখি। তোমার হাতে কতটা সময় আছে?”
আগের দিনে ব্যস্ত ছিলাম ব্যাঙ্কের কাজে। উরাল সিব ব্যাঙ্কের ঋণ পত্রে ঋণদাতা অন্যান্য ব্যাঙ্কের সই সাবুদ যোগাড় করা। সে কর্তব্য সুসম্পন্ন। এবার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড নিউ ইয়র্ক শাখা দশটি ব্যাঙ্কের দেওয়া ডলার উরাল সিব ব্যাঙ্কের নিউ ইয়র্ক ডলার আকাউন্টে পৌঁছে দেবে। দু’বছর বাদে তাদের টাকাটা ফেরত দেবার কথা। আমার সরকারি কর্তব্য শেষ, আজকের দিনটা আমার অধিকারে। আরেকবার রেড স্কোয়ারে চক্কর কাটার বাসনা আছে মনে। সেটা জানাতে সের্গেই বললে, “সেটা অনেক শক্ত পাথরে তৈরি। একশ’ বছরেও মিলিয়ে যাবে না। চলো, আজ তোমাকে একটা রাশিয়ান আবিষ্কার দেখাই। যেতে হবে পেত্রভকা। হেঁটে যাওয়া যায় স্বছন্দে”।
একটু ঠান্ডার ভাব অক্টোবরের ভর দুপুরে। যথাকালে কীরকম ঠান্ডা পড়ে সেটা পরখ করে দু’শ’ বছর আগে ফরাসি আর সত্তর বছর আগে জার্মানরা নিজ বাসভূমের উদ্দেশ্যে পলায়ন করেছে। অনেক পুরনো এই মস্কো শহরের পথঘাট সুপ্রশস্ত। লন্ডন-প্যারিস-ভিয়েনা-রোমের মত সেখানে কোনো সরু বা কানা গলি নেই। তার কারণ জানতে বেশিদূর যেতে হয় না। স্তালিন (আক্ষরিক অর্থে স্টিল বা লৌহমানব) যানবাহন ও জনসাধারণের সুবিধার্থে সেই হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের সঙ্গে কোনো আপোষ করতে চাননি। যেখানে বাধা, সেখানেই বুলডোজার চালিয়ে আপন পথ পরিষ্কার করেছেন, আপন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অর্থে দ্বিবিধ। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি রুমানিয়ার চাউসেস্কু সেপথেই চলে বুখারেস্টকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। নির্মম হাতে প্রাচীন শহরকে নির্মূল করে কংক্রিট নগরী গড়ে তোলার পথে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। অকালে তাঁর নিধন না হলে বুখারেস্ট শহরের ইতিহাসকে সমূলে উৎপাটন করে সারিবদ্ধ দশতলা ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব হত না।
লুবিয়াঙ্কা স্কোয়ার থেকে দক্ষিণ মুখে হাঁটলে রেড স্কোয়ার ঢোকার গেট – সেখানে জন সমাবেশ দেখা যায়। ডান হাতে চিরনিদ্রায় শায়িত ভ্লাদিমির ইলিইচ উলিয়ানভ লেনিন। পঞ্চাশ বছর তাঁর পাশে শায়ীন হয়ে তাঁর সঙ্গ যিনি দিয়েছিলেন, সেই ইওসেব বেসারিওনিস জুগাসভিলি, স্টালিনকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে।
এবার যাব উলটো মুখে। কফিহাউস থেকে বেরিয়ে বাঁ-হাতে হাঁটা। সের্গেই লন্ডন ভালো চেনে। সে বললে, “তোমাদের শহরে ক্যানন স্ট্রিট আছে না? এই রাস্তার নামও তাই। পুশেখনায়া স্ট্রিট। পুশেখ মানে তোপ, ক্যানন। সেই অর্থে এটা ক্যানন স্ট্রিট!” পেত্রভকা যাচ্ছি জানি, কিন্তু ঠিক কী কারণে সেটা জানি না। মিনিট পনেরো ধীর গতিতে হেঁটে, একাধিক রাস্তা সাবধানে পার হয়ে একটি চারতলা বাড়ির সামনে এসে সের্গেই থামল। সোভিয়েত আমলের বাড়ি। দরজার ডানপাশে অনেক নাম সারিবদ্ধভাবে লিখিত। প্রতি নামের গায়ে একটি বোতাম। তারই মধ্যে সে একটা বোতাম টিপল। একটা যান্ত্রিক আওয়াজ হতে বোঝা গেল সেটি চিচিং ফাঁকের ইঙ্গিত। সের্গেই সেই যন্ত্রের সামনে আত্মপ্রকাশ করে জানিয়ে দিল আমরা এসেছি। তিনতলা কিন্তু কোনো লিফট নেই। এইটুকু হেঁটে ওঠার সময় সের্গেই রহস্য খানিকটা উদঘাটন করল। আমরা যাচ্ছি যেখানে, সেটা আপাতদৃষ্টিতে অফিস বলে মনে হবে। কিন্তু সেটি তার পূর্ণ পরিচয় নয়। আরও চিন্তায় পড়লাম। এ শহরের অনেক প্রকারের অখ্যাতি আমার অজানা নয়। পাসপোর্ট আছে পকেটে। সেটা ছেনতাই হয় যদি?
করাঘাত অপ্রয়োজনীয়। দুয়োর ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেল। একটি অন্তত ৬ মিটার বাই ৬ মিটার অফিস ঘর। আইম্যাক শোভিত দু’টি মুখোমুখি ডেস্ক, একপাশে একটি গোল টেবিল। ছ’টি চেয়ার সাজানো। এক কোনার ডেস্কে এক ব্লন্ড রাশিয়ান তরুণী। তাঁর ঠিক পিছনে একটা মাইক্রোওয়েভ। পাশে বেসিন। ছোট কাঁচের আলমারিতে কিছু কাপ প্লেট সাজানো। একটি ডেস্ক খালি। তিন জন শুভ্রকেশ বয়স্ক লোক তাঁদের ডেস্ক আলো করে বসে আছেন। দোবরি উৎরো (সুপ্রভাত) কাক দেলা (কেমন আছ) জাতীয় সম্ভাষণ আদান প্রদানের পরে সের্গেই ইংরেজিতে ঘোষণা করলেন তিনি লন্ডনের একজন ব্যাঙ্কারকে এনেছেন আলাপ করাতে। তরুণীর নাম দিনারা। তার প্রতি আদেশ হল পাঁচটা কফি বানানোর। আলাপ হল তিনজনের সঙ্গে। নাম জানলাম। পাভেল ছিলেন গাজপ্রম ব্যাঙ্কে, দিমিত্রি কোনো টেলিকম কোম্পানিতে আর ইভান রসনিয়েফট তেল কোম্পানিতে। অনুপস্থিত ইয়ুরি ছিলেন উরাল সিব ব্যাঙ্কে। বোঝা গেল সকলেই “ছিলেন” কোথাও না কোথাও। কিন্তু এটা কীসের অফিস? দরজাতে লেখা আছে একটি নম্বর “চার”। সেটি ফ্ল্যাট নম্বরও হতে পারে। কফি এল। তরুণী ইংরেজি বোঝেন, বলতে পারেন কষ্টে সৃষ্টে। বাকি সবাই বিদেশিদের সঙ্গে কাজকর্ম করেছেন। রাশিয়ান টান আছে (আই হ্যাভ তাঁরা কখনও বলতে পারেন না – আই হেভ) তবে ইংরেজিতে স্বছন্দ।
সের্গেই শুরু করল আমাদের সকালবেলার বাক্যবিনিময় দিয়ে। আমি আমার লর্ডসের গল্প যোগ করে সের্গেইয়ের মতের পুষ্টি সাধন করলাম। এবার পাভেল হেসে ফেললেন। বললেন, “আমরা কয়েকজন ইংলিশ ক্লাবের বিকল্প তৈরি করেছি। আমাদের এই যে আড্ডা দেখছেন, এটা দেখতে মনে হয় বটে কিন্তু কোনো অর্থেই অফিস নয়। আমরা চারজন অবসরপ্রাপ্ত লোক মিলে এই ঘরটা ভাড়া নিয়েছি। তার সঙ্গে দিনারার বেতন। আমরা খরচা ভাগ করে নিই। সের্গেই আসবে বছর খানেকের ভেতরে। তার জায়গা করা হবে! আজকে ইয়ুরি আসেনি। মস্কোর বাইরে গেছে। সকালবেলা আগে যেমন কাজে যেতাম, তেমনি এখানে আসি। এত দিন কাজ করেছি, আমরা সবাই টেকনিকাল ব্যাপারগুলো বুঝি। দেখছেন সবার টেবিলে আইম্যাক আছে। পাশে ম্যাকবুক। আমরা গল্পগুজব করি। দুনিয়ার হালচাল বোঝার চেষ্টা করি। যার যেমন ইচ্ছে শেয়ার অথবা মুদ্রার বাজারে পয়সা লাগায় আপন ঝুঁকি নিয়ে। আগের অফিসের লোকজন মাঝেমধ্যে আসে জ্ঞানগম্মি নিতে। আমরা সবাই উদাত্ত হয়ে সেটা বিতরণ করি বিনামূল্যে। এটাও যোগ করে দিই – আমাদের পরামর্শ ওই সিগারেটের লেবেলের মত। ইহা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হইতে পারে। আপনার মত দু’চারজন আসেন। এখানেই আড্ডা দিই। দিনারা খাবার নিয়ে আসে। আর আসুন আমাদের ফ্রিজটা দেখাই”। সেটা কোনো কারণে আমার চোখে পড়েনি। একটু নিচু লেভেলে, দিনারার ঠিক পেছনে। দেখলে মনে হবে ফাইল রাখার ড্রয়ার। পাশাপাশি তিনটি। সেগুলি উন্মুক্ত হলে দেখা গেল তার একটি আসলে ফ্রিজ। সেখানে কোক, ভদকা ইত্যাদি। অন্য দুটো ড্রয়ার আরও বহুবিধ মাদকদ্রব্যে সুসজ্জিত। মধুর তোমার শেষ যে না পাই। এবারে লক্ষ্য করলাম, কাঁচের আলমারিতে কাপ-প্লেটের পাশাপাশি তিন রকমের গ্লাস সাজানো – ভদকার ছোটো, হুইস্কির মেজো আর ওয়াইনের ঢেউ খেলানো। ধূমপানের কোনো বাধা নেই। তবে জানলাম চুরুটটা চলে না।
বেলা বারোটা বাজে। ইভান জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী প্ল্যান? বললাম, “চেক আউট করে মেট্রোপোল হোটেলের কনসিয়ারজের কাছে ব্যাগ জমা দিয়ে এসেছি। ভাবছিলাম আরেকবার ক্রেমলিনের দিকটায় চক্কর মেরে যাব”। ইভান বললেন, “মস্কো তো প্রায়ই আসা-যাওয়া করেন। আরেক দিন দেখবেন। লেনিন তাঁর কাঁচের বাক্স থেকে উঠে যাবেন না। ক্রেমলিনে গেলে কি পুতিন আপনাকে হিরোর মেডেল দেবেন? শুনুন, আমি দিনারাকে বলছি। এখানেই একটু বসে যান। আপনারা ভদকার নামে জালি তরল পদার্থ পান করেন। খাঁটি রাশিয়ান ভদকা খাওয়াব”।
এর পরের ঘটনাবলীর গতিবেগ অত্যন্ত দ্রুত। পাশের কোনো দোকান থেকে দিনারা নিয়ে এলো শ্নিতসেল (কাটলেট) আর বরশ (রাশিয়ান স্যুপ, যার কোনো তুলনা নেই)। রাশিয়ান প্রথা মতন (সেন্ট পিটারসবুর্গ পর্বে তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে)) খাওয়ার পরে ভদকার বোতল খোলা হল। তার সঙ্গে টমেটো, শসা। গল্প গুজব এগোল। পাভেল সেন্ট পিটারসবুর্গের লোক। যত রাশিয়ান কালচার সেখানেই। মস্কোকে অর্বাচীন সাব্যস্ত করেন। গাজপ্রম ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক ঋণের ব্যাপারে একদা জড়িত ছিলাম বলে কিছু কৃতিত্ব দাবি করবার সুযোগ ছাড়লাম না। যদিও আমার বৃহত্তর গল্প গাজপ্রম নামক বিশাল শক্তি উৎপাদক সংস্থাকে নিয়ে। ইভান ভ্লাদিভস্তকে লেখা পড়া করেছেন। ইংরেজি ও জার্মান দুটোই খুব ভাল বলেন। আমি একটু জ্ঞান ফলিয়ে বললাম, মানে রাশিয়ার যে ১২টা সময়সীমা আছে তার শেষেরটা? ইভান বললেন, “না, আমরা ১০ নম্বরে। এরও পরে দুটো সময়সীমা আছে। শেষেরটা কামচাতকা। জানি না এ দেশটা কেমন করে চলে। সময়ের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কোথায় কখন আছি আর সেখানে ক’টা বাজে তার হদিশ পাওয়া শক্ত। তবে এটা জেনে রাখবেন, ভ্লাদিভস্তক শহরের সময় আর ভ্লাদিভস্তক ট্রেন স্টেশনের সময় এক নয়। মানে? তার মানে এই, যে, ভ্লাদিভস্তক শহর থেকে যে ট্রেনটা ছ’দিন গড়াতে গড়াতে মস্কো যায়, সে ট্রেনটা চলে মস্কোর সময় অনুযায়ী। যে সব স্টেশনে ট্রেন থামে, সেখানকার ঘড়িতে মস্কোর সময় দেখায়, সেই শহরের আপন সময় যাই হোক না কেন। তার ফল এই – ধরুন একটা ট্রেন মস্কো সময় সকাল ন’টার সময় যাত্রা শুরু করল ভ্লাদিভস্তক স্টেশন থেকে। সেই ট্রেনের হিসেবে মস্কোর সকাল ন’টা কিন্তু ভ্লাদিভস্তকে তখন বিকেল চারটে – সাত ঘণ্টার ফারাক! সবিনয়ে মনে করালাম, ব্রিটেনের ব্যাপারটা উলটো। ট্রেন যোগাযোগের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন শহরের সময় আলাদা ছিল। ম্যানচেস্টারে যখন সকাল সাতটা, লন্ডনে আটটা। ট্রেন ধরতে গেলে তারা যদি আপন আপন ঘড়ির সময় দেখে তাহলে ট্রেন ধরা আর হয় না! এই কারণে নাকি ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড টাইম তৈরি হয়! ট্রেন সেই সময় অনুযায়ী চলে।
সের্গেই আরেকবার মাথা নেড়ে বললেন, “বলিনি ইংরেজ বুদ্ধিমান প্রাণী?”
কেজিবি-র কথা এলো একসময়। ইভান বললেন, “শুনুন তবে। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি। লিওনিদ ব্রেঝনেভের আমল। ঠান্ডা লড়াইয়ের খেলা তখন তুঙ্গে। রেজাল্ট ভদ্র-গোছের (ওটা রাশিয়ান বিনয়। সের্গেই বললেন, ইভান অঙ্কে তুখোড় পণ্ডিত। ফলিত অঙ্কবিদ্যায় তাঁর অবদান আছে)। কোথায় চাকরি খুঁজব ভাবছি। এমন সময় একদিন আমার ডর্মিটরির দরজায় দু’জন মাঝবয়সী লোকের আবির্ভাব। পোশাক-আশাকে পুলিশ মনে হয় না। কম্যুনিস্ট আমলে অযাচিতভাবে আপনার সঙ্গে কেউ কথা বললে ভীতির সঞ্চার হত। তাঁরা বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। বাইরে যাওয়ার মত জামাকাপড় পরে নাও। বেশ ঠান্ডা তখন। আমি গরম বেশভূষা চাপালাম। সঙ্গে একটা ব্যাগ নেব কিনা, সে ভাবনা মনে এল। এরা আমাকে নিয়ে কোন গারদে পুরবে, ভলনিতে বাবা-মাকে কী করে খবর দেব – সেইসব ভাবতে ভাবতে এঁদের সঙ্গে বেরুলাম। কেউ কোনো কথা বলছেন না। আমি তাঁদের পেছনে পেছনে হাঁটছি। হঠাৎ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দফতরে এমনভাবে ঢুকে পড়লেন যেন সেখানে তাঁদের সেখানে নিত্যি আসা-যাওয়া। একটা ছোট কনফারেন্স রুমে প্রবেশ। একটি টেবিল, চারটে চেয়ার আর একটা মিটমিটে আলো জ্বলছে”।
সবাই ভীষণ মন দিয়ে শুনে যাচ্ছেন, দিনারা অবদি। বোঝা গেল এটি বহু-চর্চিত গল্প নয়।
“এবার প্রথম কথা শুনলাম’।
“বোসো। তোমার নাম ইভান পাভলোভিচ। তুমি অঙ্কে খুব ভাল। ইংরেজি আর জার্মান এই দুটো বিদেশী ভাষা জান। তোমার বাবা-মা ভলনিতে থাকেন। দু’জনেই স্কুলে পড়াতেন। বাবা অঙ্ক, মা পদার্থবিদ্যা। এখন পেনশন পান। তুমি তাঁদের একমাত্র সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ। আমরা মনে করি, তুমি আমাদের কাজের উপযুক্ত লোক”।
এঁরা কারা?
আমি সাহস করে বললাম, “আমি তো আপনাদের কাছে কাজের দরখাস্ত করিনি”। সেই বক্তা ভাবলেশহীন মুখে বললেন, “আমাদের কাছে কাজের জন্য কেউ দরখাস্ত করে না। আমরা ঠিক করে নিই কাকে চাই”।
আমি রুদ্ধশ্বাসে বললাম, “তারপর?”
ইভান বললেন, “আমি সাহস করে বললাম, ‘সবে তো পরীক্ষা শেষ হল। এখন কিছু দিন জিরিয়ে নেব ভাবছি, বাবা মার কাছে। পরে কি যোগাযোগ করতে পারি?’ তিনি ঠিক সেই রকম সুরে বললেন, “ইভান পাভলোভিচ, আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করে না। কোথায় কার সঙ্গে কখন দেখা করতে হবে, সেটা আমরা সাব্যস্ত করি। আপাতত ভলনি যাও।” যেমন আকস্মিক তাঁরা এসেছিলেন তেমনিভাবেই চলে গেলেন। বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে পরের দিন ভলনির ট্রেন ধরেছি। বাবাকে ঘটনাটা জানালাম। বাবার জানা কেউ ছিলেন মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। অঙ্ক বিভাগে কাজ পেতে অসুবিধে হয়নি। যদিও আর কেউ কোনোদিন যোগাযোগ করেননি, তবে বাবা বলেছিলেন মনে রেখো তুমি ওদের নজরদারিতে রইলে সারা জীবন। দুঃখের বিষয়, বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ এবং কেজিবি-র নতুন অবতার দেখে যেতে পারেননি”।
দিমিত্রি বললেন, “এবার তাহলে আমাকে সেই কেজিবি কাহিনিটা বলতেই হয়”। ইভান, পাভেল তুমুল প্রতিবাদ জানালেন। ওটা তাঁরা হাজারবার শুনেছেন। দিমিত্রি দমবার পাত্র নন, “আহা ইনি তো এতা (বাংলা ‘এটা’ – রাশিয়ানে একইরকম শোনায় আর তার অর্থ একই) আগে শোনেননি”।
ইভান ওলেগকে ফোন করেছে তার হালহকিকত জানবার জন্য।
ইভান: কেমন আছ? কী খবর?
ওলেগ: ইভান, ভীষণ ভাল আছি। আমাদের সমবায় সমিতির দোকানে মাখন থেকে আরম্ভ করে বেদানা অবধি পাওয়া যাচ্ছে। আর কি বলব, আমাদের রাষ্ট্রীয় ইস্পাত সংস্থা এই গ্রীষ্মে আমাকে সোচি পাঠাবে ছুটি কাটাতে’।
ইভান: ঠিক আছে ওলেগ। কেজিবির লোকেরা তোমার ফ্ল্যাট থেকে চলে গেলে আমাকে ফোন কোরো।
জনগণের তুমুল আপত্তির কারণ সহজেই অনুমেয়! ইসরায়েলি সংস্করণটি অবধি আমার চেনা!
গল্পের কোনো শেষ নেই। বেশিরভাগ তাঁরা বলেন, আমি শুনি। এঁদের সকলের বয়েস ষাটের ওপরে। ১৯৯৮ সালের মহান রাশিয়ান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাক্ষী। হঠাৎ নবাবরা হঠাৎ গরিব হলেন। আর তাঁদেরই মধ্যে কিছু লোক নবাব নয়, অর্থের হিসেবে বাদশা হলেন। তথাকথিত অলিগার্করা প্রভূত ধনের মালিক। সাইবেরিয়ার গা-ঘেঁষে সারাটোভ শহরের অনাথ ইহুদি যুবক রোমান আব্রামোভিচ (চেলসি), আলিশার উসমানভ (আর্সেনাল) পেত্র আভেন (আলফা ব্যাঙ্ক), আরকাদি রোটেনবের্গ (স্টোরিমনতাঝ) এমনি কত নাম। অলিগার্ক শব্দটা একটা ভাঁওতা। এঁরা সবাই নানারকম ধাপ্পা দিয়ে ঠকিয়ে সস্তায় ভাউচার দিয়ে, ব্যাঙ্ক লোনের বদলে সরকারি শেয়ার কিনে ইয়েলতসিনের সময় নানান সরকারি কোম্পানি দখল করেন জলের দরে। পুতিন প্রসঙ্গটা হয়তো এড়িয়ে গেলেন। সরকারের প্রতি পুরনো ভীতির উচ্ছেদ সহজে হয় না, বিশ বছরে কেটে গেলেও।
ঘণ্টাতিনেক বা চারেক বাদে একান্ত অনিচ্ছায় সভা ভঙ্গ করতে হল। দিনারা আবার কফি বানাল। সেখান থেকে মেট্রোপোল হোটেল আবার পনেরো মিনিটের রাস্তা। হোটেল কন্সিয়ারজের কাছ থেকে প্যাঁটরা ফেরত নিয়ে ট্যাক্সিতে নির্বিঘ্নে দোমোদেদোভো বিমানতট পৌঁছুনো গেল। তারপরের স্মৃতি একটু ধোঁয়াটে। এক ময় তারপর বাড়ি পৌঁছে আপন শয্যায় শয়ন করি। সেই লম্বা আড্ডা আর ভদকার রেশটুকু সহজে কাটেনি। রাতে স্বপ্ন দেখছি দু’কাঁধে রুপোর তারকাখচিত ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছে, “তোমার পড়া শোনা শেষ। এবার কাজে লাগো কাল থেকে। আর আমি আর্তি জানাচ্ছি, আরও একটা পরীক্ষা বাকি আছে সার”।
১১ অক্টোবর, ২০১১