একটি ঋণের বিবরণ
প্রাক কথন
নয়ের দশকের প্রারম্ভ থেকে পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলির শিল্প বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশ্বের বাজারে অর্থ সংগ্রহের অভিযানে সিটি ব্যাঙ্ক ছিল পথিকৃৎ। আমার ডায়েরিতে তাই বারে বারে আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ কেনা বেচার কথা এসেছে । প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঋণ গ্রহীতা উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা আর ঋণ দাতা অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশের লগ্নিকারক; আজকে যাকে নর্থ সাউথ ডিভাইড বলা হয়ে থাকে (পরে আমরা সাউথ সাউথ বা গ্লোবাল সাউথকে একত্রিত করেছি , যেখানে এক উন্নয়নশীল দেশ অন্য দেশে অর্থলগ্নি করেছে )। সে সময়ে আমরা উত্তরের ধন দক্ষিণে বণ্টন করেছি, অবশ্যই উপযুক্ত সুদ এবং মানানসই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। দেশ কাল ও খদ্দেরের ক্রেডিট রেটিং ভেদে এই বাণিজ্যের খানিকটা ইতর বিশেষ হয়; বদলে যায় সুদের হার, পারিশ্রমিকের বহর। মোদ্দা গল্পটা একই থাকে। তাই একটি চাল কি প্রক্রিয়ায় সেদ্ধ হয় তাঁর বৃত্তান্ত দিলেই ভাত রান্নার কলা কৌশল সর্বজনের বোধগম্য হতে পারে। এই সামান্য তথ্যকে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য কোনো গভীর গোপন জ্ঞানের কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতে ভালবাসেন কিছু বিজ্ঞজন , নইলে তাঁদের এলেম প্রমাণিত হয় না, বোনাসে ঘাটতি পড়ে । আমার কখনোই মনে হয় নি এটা একটা ভয়ানক জটিল কোন ব্যাপার । তাই যদি হতো তাহলে আমার মতো স্বল্প শিক্ষিত ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষ দু দশক ইউরোপ আমেরিকার বাজারে করে কম্মে খেতে পারতো না।
এই ঋণের গপ্পটি ফাঁদার আগে একটি কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
তখন সদ্য কাজে যোগ দিয়েছি লন্ডনে। সিটি ব্যাঙ্কের সহকর্মী রডনির সুপারিশে মাইকেল লুইসের লায়ারস পোকার ( সলোমন ব্রাদার্সের গল্প ) কনি ব্রুকের প্রিডেটরস বল ( জাঙ্ক বন্ডের স্রষ্টা মাইকেল মিলকেনের কাহিনি ) পড়তে গিয়ে ইংরেজি ফাইনান্সিয়াল নন ফিকশন বইয়ের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি; সে নেশা আজো কাটে নি। গল্প উপন্যাস পড়েছি কম , ইতিহাস এবং বিশেষ করে ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে গোগ্রাসে গিলেছি দুনিয়ার যাবতীয় ফাইনান্সিয়াল স্ক্যানডালের বৃত্তান্ত । মনে হয়েছে জানা দরকার সেই ভদ্রবেশী ডাকাতদের কথা যারা আরমানি সুট গায়ে দিয়ে , পাটেক ফিলিপ ঘড়ি, সালভাদোরে ফেরাগামো টাই পরে সার্বিক লুণ্ঠন কর্ম চালিয়েছে দিনের পর দিন । জামতাড়ার মোবাইল আর্মি সাইবার ফিল্ডে নামার পরে স্ক্যাম কথাটা মুখে মুখে ফেরে কিন্তু এই বড় বিদ্যাটি অনেক আগেই নানা রূপে নানা বেশভূষায় নানান দেশে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে সাধন করেছেন অনেক মহা পুরুষ। স্কট ম্যাকডোনালডের সেপারেটিং ফুলস ফ্রম দেয়ার মানি তার একটি উৎকৃষ্ট খতিয়ান।
যেমন কার্লো পিয়েত্রো জিওভান্নি পনজি।
পকেটে আড়াই ডলার নিয়ে একুশ বছর বয়েসি এই ইতালিয়ান যুবক বোস্টন বন্দরে নেমেছিলেন । ইতালিতে সস্তার ইন্টারন্যাশনাল রিপ্লাই কুপন কিনে আইন সম্মত ভাবে আমেরিকায় বেশি দামে বিক্রি এবং লগ্নির টাকা ডবল করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তিনি যে স্ক্যামের পথ দেখিয়েছিলেন সেটি যুগে যুগে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। আমেরিকা, আলবানিয়া থেকে আমাদের দেশের সঞ্চয়িতা, সারদা, নারদা অবধি, একই খেলা, শুধু লুণ্ঠিত মানুষের চেহারা ও পাসপোর্টের রঙ বদলে যায়। এই হলো আসল রহস্য রোমাঞ্চ, কোথায় লাগে জেমস হ্যাডলি চেজ, আগাথা ক্রিস্টি, ব্যোমকেশ, স্বপন কুমার, দস্যু মোহন! তাই ঢুকে পড়েছি হোয়াইট ক্রাইম সিরিজের পাঠশালায় - বারবেরিয়ানস অ্যাট দি গেট ( আর জে আর -নাবিসকো) স্মারটেস্ট গাইস ইন দি রুম ( এনরন), হোয়েন জিনিয়াস ফেইলড (লং টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ), এক্সপোজার (অলিম্পাস কেলেঙ্কারি) এ কলোসাল ফেইলিউর অফ কমন সেন্স (লেমান ব্রাদার্সের জুয়ো) উইজার্ড অফ লাইস ( বারনি মেডফের ৬৫ বিলিয়ন লুঠ), ব্যাড ব্লাড (থেরানোস/ এলিজাবেথ হোমস ) বিগ শর্ট ( ২০০৮ এর সেকেন্ড গ্রেট ডিপ্রেশন ) – তালিকা অন্তহীন*।এগুলির প্রায় সবই লেখা হয়েছে তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁরা অন্যের ডিলের তদন্ত এবং তার চোট্টামির কিসসা পরিবেশন করেছেন। হিন্দি ছবির ভাষায় সনসনি খেস কাহানিয়া।
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের বাজারে আত্ম পুরুষে লেখা ব্যবসার কাহিনি , তা তাঁরা মাষ্টার অফ ইউনিভার্স হোন অথবা ফলেন এঞ্জেল হোন , খুব কম পড়েছি । (ব্যতিক্রম অ্যানদ্রু সারদানিসের এ ভেঞ্চার ইন আফ্রিকা) । আমার কপালে কোন বসওয়েল জোটার সম্ভাবনা নেই জানি তাই নিজের একটি কর্মকাণ্ডের কথা নিজেই লিখছি। এলাম দেখলাম জয় করলাম , ভেনি ভিদি ভিচি তথা বাড়িয়ে বলার স্কোপ নেই কারণ সবই রেকর্ডেড হিস্টরি ! ফ্যাক্ট চেক করতে পাঠকের এক মিনিট লাগবে। তবু সত্য বই মিথ্যা বলিব না এই শপথ আগাম নিয়ে রেখেছি ।কারো জ্ঞান বর্ধনের অভিলাষ নয়, পাঠকের কিঞ্চিৎ অবসর বিনোদনের প্রয়াসেই আমার এই কথকতা।
বুদাপেস্ট ব্যাঙ্কের ঋণ কাহিনি
উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য সিটি ব্যাঙ্ক দ্বারা পূর্ব ইউরোপে আয়োজিত অনেক আন্তর্জাতিক ঋণের মধ্যে এটিকে বেছে নেওয়ার বিশেষ কারণ আছে ।তৎকালে পূর্ব ইউরোপের সদ্য উন্মুক্ত বাজারে প্রথম যে ব্যাঙ্কটিকে আমরা ইউরো লোনের দরবারে নিয়ে আসি তার নাম বুদাপেস্ট ব্যাঙ্ক।
আটের দশকের মাঝামাঝি যখন লন্ডনের সিটি ব্যাঙ্কে কাজে যোগ দিয়েছি লাল বনাম নীলের ঠাণ্ডা লড়াই তখন খেলার মাঠ অবধি নেমে এসেছে। আগের বছর সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলি (রোমানিয়া বাদে) লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক (১৯৮৪) বয়কট করেছে , মস্কো অলিম্পিকে পশ্চিমি দেশগুলির বয়কটের পাল্টা জবাবে । আমাদের দৈনন্দিন ব্যাঙ্কিং জগতে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কোন ছায়া পড়ে নি । আঙ্গুর ফল টক এ কথা কেউ বলি নি , কেন না লৌহ যবনিকার ওপারে কোন প্রকারের ফল আছে কিনা তাই আমরা জানতাম না। পূর্ব ইউরোপের কোনো কোনো দেশ সরকারি লেভেলে ধার দেনা করেছে , কোন বাকি বকেয়া রাখে নি জানি কিন্তু সেই লেভেল বেল পাকিলে আমাদের মতন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের কি।
ওরা থাকে ওধারে।
এই শীতল তিমিরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা গেলো , একটা আচমকা বিস্ময়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির নব অধ্যুষিত জেনারাল সেক্রেটারি মিখাইল গরবাচেভ বললেন জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে স্বচ্ছতার (গ্লাসনস্ত) যেমন প্রয়োজন , তেমনি প্রয়োজন সমাজের পুনর্গঠন (পেরেসেত্রয়কা)। ক্রেমলিন দুর্গের গোপন কক্ষে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি এক তরফা দেশে দেশে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবার দিন শেষ।
পথ পরিবর্তনের সাড়া জাগানো নিশানা !
পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত প্রভাবিত দেশগুলির নেতৃত্ব এই ঘোষণায় উল্লসিত হয়ে নৃত্য করলেন না । ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে হাঙ্গেরির ব্যর্থ অভ্যুথান , ১৯৬৮ সালের প্রাগের বসন্তের মলিন স্মৃতি তখনো তাঁদের মনে বেদনার সঞ্চার করে। তবে কোনো কোনো দেশ এই স্বতঃ প্রণোদিত স্বচ্ছতাকে একটি অর্থনৈতিক চেহারা দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলেন রাশিয়ানরা এই পরিবর্তনের রশি কতদূর ছাড়বেন । পশ্চিমের বাণিজ্যিক জগতের বোর্ড রুমে খানিকটা অলস ঔৎসুক্য বা মাইলড কিউরিওসিটি দেখা দিয়েছিল নিশ্চয় কিন্তু সেটা আমাদের মতন পদাতিক সৈন্যের ব্যারাক অবধি নেমে আসে নি।
তবু খবর কাগজ পড়ি , সি এন এন , ইকনমিষ্ট সাপ্তাহিক দেখি , শোনা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের লৌহ আলিঙ্গনে বাঁধা থেকেও সাতের দশকে হাঙ্গেরির কয়েকজন অর্থনীতিক সরকারি সম্মতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। রাজনৈতিক নিয়ম কানুন না ভেঙ্গে এবং তার চেয়ে বড়ো কথা ক্রেমলিনের উষ্মা উৎপত্তি না করেও কিছু নতুন চিন্তা ধারার সূচনা হয়েছিল । তৎকালীন সোভিয়েত কমরেডরা উদ্বাহু হয়ে তার সমর্থন না করলেও বাধা দেবার প্রয়াসে ট্যাংক পাঠান নি ।
১৯৭৪ সালে হাঙ্গেরিয়ান স্থপতিবিদ এরনো রুবিক একটি জাদুর ঘনক্ষেত্র (ম্যাজিক কিউব) আবিষ্কার করে দুনিয়াতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন। সাত আর আটের দশকে দেখেছি আন্ডারগ্রাউন্ড বা ট্রেনে বিশ্ব ভুলে হাতে রুবিক কিউবের ধাঁধা নিয়ে মানুষজন কেবল সেটি ঘুরিয়ে যাচ্ছেন, আজ কাল যেমন লোকে স্মার্ট ফোনে আপন দৃষ্টি নিবিষ্ট করেন। হাঙ্গেরির লাজার সরকার অনুমতি দিলেন একটি নিরীক্ষার – নিউ ইকনমিক মেকানিজম (উই গাযদাসাগি মেকানিজমুস)। কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নয়, বুদাপেস্টের অফিস ঘরে অধিষ্ঠিত আমলাদের কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে দেব্রেচেন আরপাদ বা শেগেদের স্থানীয় বাজারকে খানিকটা স্বাধীনতা দেওয়া হলো, বিশেষ করে মূল্যমান বিষয়ে - প্রাইসিং মেকানিজম (মস্কোকে কলা দেখিয়ে সাতের দশকে ইউগোস্লাভিয়া যেটি সাফল্যের সঙ্গে করতে সক্ষম হয়)। হাঙ্গেরির সবচেয়ে বিখ্যাত খাবারের সঙ্গে মিলিয়ে বাজারে তার চলতি নাম - গুলাশ কমিউনিজম। এসব খবর কানে আসে।
সেই সময়ে নিউ ইয়র্কের ম্যানি হ্যানি , ভালো নাম ম্যানুফ্যাকচারার হানোভার ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক (অনেক হাত ঘুরে এখন সেটি জে পি মরগান ) রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ব্রাঞ্চ খুলে ওয়াল স্ট্রিট ও পার্ক এভিনিউতে সাড়া জাগায় –এঁরা কি কোনো অমূল্য রতনের খোঁজ পেয়েছেন, আমরা তার হদিশ পাই নি অবধি ? পূর্ব ইউরোপের মোয়া সেই ম্যানি হ্যানি একা খাবে কেন ? অতঃপর সিটি ব্যাঙ্ক পাশের দেশ হাঙ্গেরিতে হাজির হবার চেষ্টা চালায় মহা উদ্যমে , বার্লিন দেওয়াল পতনের কয়েক বছর আগেই। সিটি ব্যাঙ্ক কোন নতুন দেশে প্রথমে আপন ব্রাঞ্চ বা শাখা অফিস খোলে, ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ বা লিমিটেড কোম্পানি খোলে না। দেশটার সঙ্গে আলাপ পরিচয় বাড়লে সে সব হবে, এই ছিল কর্পোরেট চিন্তা।
বুদাপেস্টের অর্থ দফতরে আমাদের প্রাথমিক আবেদন পত্রে শাখা খোলার আর্জি পেশ করা হয়েছিল। অর্থ দপ্তর টাল বাহানা করেন। সিটি ব্যাঙ্কের উপস্থিতিকে ব্রাঞ্চের সম্মান দিলে সেটা শ্রমিক কৃষকের স্বর্গ রাজ্যে আমেরিকান পুঁজিবাদের সাক্ষাৎ হানাদারির সামিল হতে পারে ভেবে হয়ত হাঙ্গেরিয়ান কর্তৃপক্ষ ইতস্তত করছিলেন। রবিন উইনচেষ্টার নামের এক অদম্য ইংরেজ সহকর্মী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মতান্তরে ইউনিকুম নামক পানীয়ের বিপুল ব্যবহার করে সরকারের কাছ থেকে একটি সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমোদন আদায় করেন, যেখানে সামান্য হলেও সরকারের কিছু শেয়ার থাকতে পারে। পূর্ব ইউরোপে এটি সিটি ব্যাঙ্কের প্রথম অফিস। রবিনের সম্মানে বুদাপেস্ট অফিসের লবিতে একটি স্মারক ফলক আছে ।
জর্জি লাজারের সরকারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সিটি ব্যাঙ্ক হাঙ্গেরির স্বতন্ত্র অবস্থানকে রবিন কঠোর হাতে রক্ষা করেছিলেন- সে এক টাইট রোপ ওয়াকিং । যখন লন্ডনে তাঁকে নিয়ে অন্যান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, রবিন সর্বদা বলেছেন তিনি একটি হাঙ্গেরিয়ান প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাতে সিটি ব্যাঙ্কের কিছু শেয়ার মালিকানা আছে মাত্র।
সিটি বুদাপেস্টের একেবারে প্রথম দিকের কর্মী টোনি ফেকেতের (ফেকেতে মানে কালো ) সঙ্গে দারুণ আলাপ জমে যায় স্লোভেনিয়ার ব্লেড শহরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে । তুখোড় ইংরেজি বলতো। পূর্ব ইউরোপের ডায়েরিতে স্লোভেনিয়া পর্বে তার ইংরেজি শেখার গল্প আছে। টোনিকে বলেছিলাম নিউ ইকনমিক মেকানিজম নামক এক্সপেরিমেন্ট হাঙ্গেরিতে অনেকদিন আগেই তো ঘটে গেছে, সোভিয়েত বলয়ে সেটি ছিল এক বিশাল ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ । এবার পশ্চিমের জানলা যখন খুলল , আমার মনে হয় সবার আগে হাঙ্গেরিয়ান ফোরিনট একদিন পরিবর্তনযোগ্য (কনভারটিবল) মুদ্রা হবে । টোনি অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলে হাঙ্গেরি কেন , তার জীবৎকালে পূর্ব ইউরোপের কোন মুদ্রা কখনো কনভারটিবল হবে না ! এই বাক্যালাপের সাত বছরের মধ্যে শুধু ফোরিনট নয়, খোলা বাজারে অন্য অনেক পূর্ব ইউরোপীয় মুদ্রার বিনিময় চালু হয়ে যায় ।
গরবাচেভের প্রতিশ্রুত স্বচ্ছতার পরখের পথে পা বাড়ালেন হাঙ্গেরির জাতীয় ব্যাঙ্ক ।তাঁদের সিদ্ধান্তে জাতীয় ব্যাঙ্কের পেস্ট শাখা (ডানিউব নদীর যে দিকে বইছে তার ডান দিকে পেস্ট, বাঁ দিকে বুদা। দুটো মিলে বুদাপেস্ট) , বুদাপেস্ট ক্রেডিট ব্যাঙ্ক এবং সরকারি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের সমন্বয়ে একটি নতুন ব্যাঙ্ক স্থাপিত হল ১ জানুয়ারী ১৯৮৭ সালে । তার নাম বুদাপেস্ট ব্যাঙ্ক।
তিন বছরের মধ্যেই যে বার্লিন দেওয়াল ভেঙ্গে হাঙ্গেরি তথা সারা পূর্ব ইউরোপে পুরো দস্তুর বাজারি অর্থনীতি চালু হবে এমন কোন দেয়াল লিখন তাঁরা দেখেছিলেন কি ? অশনি সঙ্কেত ? অনেকে মনে রাখেন না বার্লিন দেওয়াল ভাঙার তিন মাস আগে ১৯শে আগস্ট ১৯৮৯, হাঙ্গেরির সীমান্তবর্তী গ্রাম সোপরনে একটি প্যান ইউরোপিয়ান পিকনিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল; সেখানে দুই সরকারের বিদেশ মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে হাঙ্গেরি /অস্ট্রিয়ার সীমান্ত বেড়ার কাঁটা তার কাটা হয়, যেখান দিয়ে কিছু পূর্ব জার্মান প্রথম আইনিভাবে পশ্চিমে প্রবেশ করেন। লৌহ যবনিকায় প্রথম ফাটল।
তিনটি ব্যাঙ্কের সমন্বয়ে নতুন ব্যাঙ্কটি তৈরি হল এক বিশাল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণের বোঝা নিয়ে । পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে ইতিমধ্যেই দেখেছি আয় ব্যয় বা দেনা পাওনার হিসেব মেলানোটা কম্যুনিস্ট আমলের অর্থনীতিক বা বাণিজ্যিক দফতরের মূল উদ্দেশ্য হয়ত ছিল না। সেই সব প্রতিষ্ঠানের বড়ো কর্তা জানতেন সরকার নির্দিষ্ট কর্তব্য সাধনেই তাঁর মুক্তি , খাতাপত্রের হিসাব মেলানোয় নয় । নিজের নিজের কাজ করে যাও, তোমার হাতে নাই লাভ লোকসানের হিসেবের ভার। সম্পূর্ণ নগদ ভিত্তিক (ক্যাশ বেসড ) কমিউনিস্ট অ্যাকাউনটিং সিস্টেমে সরকারের বিভিন্ন দফতরের কার কি পাওনা দেনা সেটা কেবল খাতায় ডেবিট ক্রেডিট এন্ট্রি । সরকারের ডান হাত দিচ্ছে, বাঁ হাত নিচ্ছে । কোন বিভাগ কবে কি দেবে বা দেয়নি , ফেরত না পেলে যে একটা অনাদায়ী ঋণের জন্ম হয় বা হতে পারে সে আতঙ্ক ছিল অজানা। তিনটি ব্যাঙ্কের একত্রীকরণ করার সময় হাঙ্গেরি সরকারের অর্থ বিভাগ হিসেব নিকেশ করতে গিয়ে অনাদায়ী ঋণ নামক দানবের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং এই প্রথম আমাদের জানা কোন পূর্ব ইউরোপীয় অর্থনীতিক ব্যবস্থা তাকে সরকারি স্বীকৃতি দিলেন।
ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রথম আমেরিকান ব্যাঙ্কে কাজে যোগ দিয়েই জেনেছিলাম কোনো কোম্পানির ঋণের সুদ যদি নব্বুই দিনের বেশি বাকি পড়ে তাহলে সেটি অনাদায়ী ( নন পারফর্মিং) তালিকায় দাখিল হয়। পশ্চিমে এবং বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় অনাদায়ী ঋণের ( সরকারি ব্যাঙ্কে , বর্তমানে ৬০ বিলিয়ন ডলার বাকির খাতায় ) উপাখ্যান সকলেরই চেনা শোনা জানা, জলভাত ।
গুণী লোকেরা বলেন কোন সমস্যায় পড়লে আগে মেনে নাও সমস্যা আছে , পরে তার চেহারা চরিত্র বোঝবার চেষ্টা করো, সমাধান খোঁজো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে না হোক, গরবাচেভের স্বচ্ছতা অভিযান অর্থনৈতিক স্তরের বিদ্যমান সমস্যাগুলিকে চেনার পথে হয়তো এক সঠিক পদক্ষেপ । সরকারি গদি বদলের শঙ্কা নয়, দেখা দিলো অর্থনৈতিক কণ্টক গুলির মুখোমুখি হবার অস্বস্তিকর সম্ভাবনা । বুদাপেস্ট ব্যাঙ্কের কঠিন পরিস্থিতি অনুধাবন করে হাঙ্গেরির সরকার একটি বিরাট সংখ্যার জামিন দিলেন। তার সঙ্গে কিছু মূলধনের যোগান। এতে করে ব্যাঙ্কের ব্যাল্যান্স শিট কিঞ্চিত ভদ্রস্থ হল।
দ্রুত বদলাতে লাগল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট । বার্লিন দেওয়ালের পতন হলে পশ্চিমী হাওয়া পুবে ধেয়ে এলো । পশ্চিমের কিছু কিছু ব্যাঙ্ক আসা যাওয়া শুরু করলেন, খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে। আপাত দৃষ্টিতে সব ব্যাঙ্ক টাকা জমা নেয় টাকা ধার দেয়। তবে এখানে একটা বিশাল ফারাক – কম্যুনিস্ট দেশে সরকার ছিল মালিক । ছিল না কোন শেয়ার হোল্ডারের দাবি দাওয়া , মুরুব্বিপনা । তাদের তদারকি হত সরকারি কায়দায় । আমাদের পরিচিত জেনারালি অ্যাকসেপ্তেড অ্যাকাউনটিং প্রিনসিপল মোতাবেক নয়।
প্রস্তাবনা
আগনেস (আগি) কুমের তখন সিটি ব্যাঙ্ক হাঙ্গেরিতে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেখা শোনা করে , তার টাইটেল হেড অফ ফাইনান্সিয়াল ইনসটিটিউশন ।আগির সঙ্গে টেলিফোন মারফত যা চেনা। জানুয়ারি মাসের একদিন আমাকে ফোন করে আগি বললে নতুন কাজ তার , ব্যবসার খোঁজে সব ব্যাঙ্কের দরোজায় কড়া নেড়ে বেড়াচ্ছে। জুতসই কিছু যদি জোটে তখন আমাদের ক্রেডিট দফতর বলে না ওটা হবে না , এতোটা ধার দেওয়া যাবে না । লন্ডনে স্ট্র্যানডের চার তলায় আমাদের নবগঠিত ক্রস বর্ডার ফাইনান্স গ্রুপ নামক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং উদ্যোগের কথা শুনে আগি স্থির করেছে দেখাই যাক আমাদের নিজের সাধ্যে যদি না কুলোয় হাঙ্গেরির কোন ব্যাঙ্ককে আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে গিয়ে বাড়তি টাকা তোলা যায় কি না। আমি কি সোমবার বুদাপেস্ত যেতে পারি ?
সেদিন বৃহস্পতিবার ২৭শে জানুয়ারি ।
ভ্রমণের অনুমতি চাইতে গেছি। আমার কর্তা আলমান বললেন বাণিজ্যের সন্ধানে যেখানে যাবে যাও আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসে আমার সময় নষ্ট করো না। আমার কোন এক্সপেন্স রিপোর্টে তিনি কোনদিন একটি আঁচড় কাটেন নি , কোথায় গেছিলেন , কেন এই খরচা এ প্রশ্ন করেন নি। আমার কর্মজীবনে তাঁর অবদান ভোলার নয়, সিটিলাইফ নামে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক বইতে তাঁর স্মৃতি চারণা করেছি।*
হাঙ্গেরি- সেই কতকাল আগে বাংলায় সেতুর ওপারে মুক্তি পড়েছি ( জেমস মিচেনারের ব্রিজেস অ্যাট আন্দাউ), ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান অভ্যুথানের কাহিনি। মহারানি সিসি, ধীরে বহে দানিউব ফেরেন্তস পুশকাশ , গুলাশ সুপ।
আসিতেছি ! হাঙ্গেরি , হিয়ার আই কাম ।
রবিবার ৩০শে জানুয়ারি ১৯৯৪
জার্মানির ডোনাউশিঙ্গেনে ছোট্ট এক ঝর্না দেখেছিলাম , সেটি ক্রমশ যে বিপুল জলধারায় পরিণত হয় তার নাম ডানিউব (জার্মানে ডোনাউ , হাঙ্গেরিয়ানে দুনা )। পাসাউতে তার বিস্তার বিশাল , ভিয়েনায় সে অদৃশ্য ( ইওহান স্ট্রাউসের ব্লু ডানিউবের সঙ্গে ভিয়েনার কোন সংযোগ নিতান্ত কষ্ট কল্পনা মাত্র), ব্রাতিস্লাভায় পুনরায় প্রকট। বুদাপেস্ট যেতে আকাশ থেকে পরিষ্কার দেখি সে নদীর ধারা। প্লেন নামে ফেরিহজ বিমান বন্দরে , যার নাম বদলে এখন ফেরেন্তস লিস্ত এয়ারপোর্ট। এই ফেরেন্তস লিস্ত কে আমরা ফ্রান্তস লিস্ত নামে চিনি, জন্মসূত্রে তিনি হাঙ্গেরিয়ান কিন্তু খ্যাতি অর্জন করেন জার্মানিক ইউরোপে , সেখানে তিনি ফ্রান্তস। ইউরোপে হাজার কন্সার্টে বাজিয়েছেন , তাঁর ফ্যান বেস প্রকাণ্ড , মহিলারা তাঁর ফেলে দেওয়া সিগারের অবশিষ্ট , ছুড়ে ফেলা রুমালের অংশ বিশেষ অধিকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন । সব দেখে শুনে হাইনরিখ হাইনে এর নাম দিয়েছিলেন লিস্তম্যানিয়া যার তুলনা ইউরোপে দেখা গেছে একশো বছর বাদে – বিটলম্যানিয়া ।
প্রসঙ্গত ইউরোপের দুটি মাত্র বিমান বন্দর কোন ক্লাসিকাল সুরকারের নাম বহন করে , ওয়ারশর ফ্রেদেরিক শোপিন ( যদিও আমি ওকোচিম নামে বেশি জানতাম ) এবং বুদাপেস্টের ফেরেন্তস লিস্ত ।
যে কোনো ভ্রমণকারীর কাছে বুদাপেস্ট অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য স্থল , যদিও এয়ারপোর্ট থেকে শহর অবধি যাত্রাটি অসম্ভব বোরিং। তিরিশ বছরেও বদলাতে দেখলাম না । টোনি ফেকেতে বলে দিয়েছিল বুদাপেস্তে দ্রষ্টব্য অনেক তবে তার মধ্যে পয়লা নম্বর হলো ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের ডানিউবের দিকে জানলাওলা ঘর থেকে নদীর শোভা। সেখানে বসলে চোখে পড়বে নদীর বিস্তার , বুদা দুর্গ রাজ প্রাসাদ আর চেন ব্রিজের ভিউ !
হোটেল বুক করেছে লন্ডন অফিসের শ্যারন, তাকে বলা যায় নি এমনি ঘর যেন পাই! সে ভাববে এসব বায়না কেন, আমি কাজে যাচ্ছি মাত্র। অনেক বছর যাবত এই হোটেলের লয়ালটি কার্ড বহন করি , সর্বদা আপগ্রেড পেয়ে থাকি । তাই অনুমান করেছি চেক ইনের সময় এই বিনীত দাবি জানালে হয়তো কাজ হবে।
শীতের বিকেল , আকাশে সূর্য, কিন্তু ঠাণ্ডা রীতিমত জানান দিচ্ছে । রিসেপশনের মহিলা বললেন আপনি আপগ্রেড পাবেন। বললাম নদীর দিকের ঘর পাওয়া যাবে কি ? তিনি মৃদু হাস্য করলেন। আর কিছু বলা গেল না। ওই অ্যামাবাসাডর ক্লাব কার্ডের আরেকটা ফায়দা, কেউ না কেউ অত্যন্ত সৌজন্য সহকারে আমার ব্যাগ বা সুটকেস ঘর অবধি বয়ে নিয়ে যাবে ; চাবি খুলে বাকায়দা দেখিয়ে দেবে ঘরের কোথায় কি আছে, টি ভি, এয়ার কনডিশনারের যন্ত্র কেমনে ব্যবহার করতে হয় , মিনিবার কোন খানে । তার কোন ব্যত্যয় হলো না । কেবল খটকা লাগলো – ঘর অন্ধকার কেন ? বাইরে পড়ন্ত বেলা কিন্তু আলো তো ছিল । আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম , আচ্ছা এটা কি ডানিউবের দিকের ঘর ? বয়স্ক মানুষটি স্মিত হেসে বললেন, ও আপনাকে টি ভি, মিনিবার সব দেখালাম , আরেকটা জিনিস তো দেখানো হয় নি ! এই বলে তিনি কোন একটা যন্ত্র টিপলে বিশাল জানলার পর্দা খুলে গেলো । সোনালি বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে ডানিউব , ওপারে বুদার প্রাসাদ সামনে চেন ব্রিজ, একটি আশ্চর্য দৃশ্যের ফ্রিজ শট । বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো । পরের বিশ বছর কোনের সেই ঘর চেয়েছি , পেয়েছি বিভিন্ন তলায় । সন্ধ্যেয় আলো জ্বলে ওঠে, সৃষ্টি হয় এক আশ্চর্য স্বপ্নলোক । কখনো দেখেছি চেন ব্রিজের ওপরে আতসবাজির খেলা, নদীর ওপরে মন্দ গতির বজরা , বাঁধা বোটে পার্টি , ভেসে আসে গানের সুর, প্রমেনাদে হেঁটে যান সুবেশ নরনারী । এই জানলায় বসেই যদি দিন কেটে যায়, যাক না !
বুদাপেস্টের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।
কাল সকালে আগি নিয়ে যাবে প্রথমে ভাচি উতচায় সিটি ব্যাঙ্কের অফিসে তারপর বুদাপেস্ট ব্যাঙ্ক।
আরেক দেশ আরেক দিন।
পুনশ্চ:
**কৌতূহলী পাঠককে নেশা ধরানোর জন্য কয়েকটি পুরিয়া
*CitiLife: Tales of a London City Banker - Hiren Singharay
Separating Fools from their Money- Scott McDonald
Liar’s Poker (Solomon Bros) - Michael Lewis
Predators Ball ( Junk bond/ Michael Milken) - Connie Bruck
The Barbarians at the Gate (RJR/Nabisco) - Brian Burrough & John Helyar
Smartest Guys in the Room (Enron) - Bethany McLean Peter Elkind
When Genius Failed (LTCM) - Roger Lowenstein
Exposure ( Olympus saga) - Michael Woodford
Colossal Failure of Common Sense (Lehman Brothers bankruptcy) - Larry McDonald
Wizard of Lies (Madoff theft of $65 billion) - Diana Henriques
Bad Blood (Theranos/ Liz Holmes) - John Carrey rou
Big Short (sub- prime & crash of 2008) - Michael Lewis
Andrew Sardanis - A Venture in Africa
ক্রমশ...