১৫ নভেম্বর ১৯৯২
গভীর সন্ধ্যায় প্রাসাদ তোরণে একজন বিদেশি আগন্তুকের আকস্মিক আগমনে দ্বাররক্ষীরা সন্ত্রস্ত হলেন। আপনি কে, এখানে কেন, কী উদ্দেশ্যে – এইসব প্রশ্ন ভাঙাচোরা ইংরেজিতে আমার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত হল।
জানালাম আমি সিটি ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিস থেকে আসছি।
দুয়ারে বাক্যালাপ শুনে সদর থেকে এক মহিলা এগিয়ে এলেন। পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “সিটি ব্যাঙ্ক থেকে আসছেন বললেন? এখানে যাঁদের যোগ দেবার কথা, তাঁরা সকলেই ওয়ারশ থেকে পৌঁছেছেন সন্ধ্যে নাগাদ। আপনি এই রাতে কোথা থেকে কীভাবে এলেন?”
নাম জানিয়ে বললাম, “বার্লিন থেকে। গাড়িতে।”
বিগত পঞ্চাশ বছরে জার্মান সীমান্ত অতিক্রম করা যে দেশে যুদ্ধ জয় বলে বিবেচিত হত, সেই পোল্যান্ডের ৫৫০ জনসমষ্টির একটি প্রত্যন্ত গ্রামে অন্ধকার শীতের রাতে হঠাৎ এক কালো মানুষ এসে বলে, ‘এই তো বার্লিন থেকে এলাম!’
মহিলা কিঞ্চিৎ দ্বিধা সহকারে বললেন, “আচ্ছা আসুন আমার সঙ্গে।”
আলোকিত প্রাসাদের প্রশস্ত দ্বার, উঁচু সিলিং, ছোট আর্চ, সব যেন গতকাল রং করা হয়েছে। কয়েক ধাপ উঠে গিয়ে যেখানে দাঁড়ালাম, সেটা একটা মাঝারি গোছের নাট্যশালার মত। গোলাকৃতি। চারদিকের দেয়ালে নানান স্ট্যাচু। আমি ব্যাগ নিয়ে হাঁটছি, এমন সময় আমার পেছন থেকে লন্ডন ইস্ট এন্ডের উচ্চারণে উঁচু আওয়াজে কেউ বললেন
-বেয়াতা, কী ব্যাপার? এরকম সন্দেহজনক লোককে এই রাতের বেলা এখানে ঢুকতে দিচ্ছ কেন?
তাকিয়ে দেখি সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে বিয়ারের পাত্র হাতে ইয়ান ফিঞ্চ। আমি কিছু বলার আগেই বেয়াতা কোনো ঘোর অন্যায় করেছে ভেবে কুণ্ঠিতস্বরে বলল, “ইনি বলছেন সিটি ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিস থেকে এসেছেন। তাই নামটা মিলিয়ে নেবার জন্য মিস্টার হার্স্টের অফিসে যাচ্ছিলাম।”
ইয়ান তাকে অভয় দিয়ে বলল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এই মর্কটকে উত্তমরূপে চিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এর সঙ্গে কাজও করি। এই দলছুট হীরেন নিজের থেকে হাজিরা না দিলে, সিটি ব্যাঙ্কের আস্তাবলে তোমার সান্ধ্য গণনায় একটি প্রাণী কম পড়ত।”
বিলিতি রসিকতা ও শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে বেচারি বেয়াতার পরিচয় ক্ষীণ। এবারে সে একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, “আসুন, তাহলে আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিই।” ইয়ানের আদেশ হল মালপত্তর রেখে এসে আমি যেন সত্বর তার সঙ্গে প্রাসাদের পানশালায় যোগদান করি। জানা গেল, শুধু আমাদের লন্ডনের দলবল নয়, নিউ ইয়র্ক থেকেও কয়েকজন এসেছেন ব্যাঙ্কিং-এর বিভিন্ন বিষয়ে তালিম দিতে। মানে নিখরচায় দেশভ্রমণ। সকলেই আজকের বিভিন্ন সময়ে ওয়ারশ-ভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছেন। সেখান থেকে বাসে সাড়ে চার ঘণ্টার মত লেগেছে এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুর পৌঁছতে।
আমার শয্যাকক্ষ নিতান্ত সাদামাটা। বোঝা যায়, দীর্ঘ অবহেলার পরে এক বুর্জোয়া অট্টালিকার সংস্কার সাধনের কাজ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে। প্রাসাদের তুলনায় পানশালাটি বেমামান রকমের ক্ষুদ্রাকৃতি, একটা ঘোরানো সিঁড়ির তলায় ইতস্তত চেয়ার ছড়ানো আছে। দুটো টেবিলকে জুড়ে বেশ কয়েকজন বসেছি। সিটি নিউ ইয়র্কের কয়েকজন এসেছেন, মূলত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বিভাগ থেকে। সিটি ব্যাঙ্ক ওয়ারশ-তে হালে যোগ দেওয়া ভিটেক, নোভাক, ডরোটার সঙ্গে পরিচয় হল – পানীয় হাতে সাম্যবাদী ইউরোপের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক পশ্চিমের সরাসরি মোলাকাত।
বৈদ্যুতিক মুহূর্ত!
ইয়ানের কাছে জানা গেল, সিটি ব্যাঙ্ক টিমের সঙ্গে অ্যালান সাক্ষাৎ করবেন সকালে। একদা লিটল রক, আরকানসাসের রাজ্যপালের দফতরে পৌঁছনোর দিনে যার পাশে ছিলেন, সেই উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন এখন সে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন দু’সপ্তাহ আগে। ওয়ারশ থেকে ওয়াশিংটনে নিয়মিত টেলিফোনে কানাকানি চালু।
আগামী পাঠন প্রকল্পে দিনে দেড় ঘণ্টা নির্ধারিত হয়েছে আমার জন্যে।
ইয়ান বললে, আমি তোমার প্ল্যানের কথা কাউকে জানাইনি! অ্যালান সাসপেন্সে আছে। তবে আমি একটু ভাবনায় ছিলাম। দেশে রাস্তার বাঁদিকে গাড়ি চালাও। এখানে তো উলটো দিকে চলে। বেঁচে এসেছ – এই রক্ষে।
এক জন বললেন, “ইউ কান্ট বি সিরিয়াস।” ওটা নিতান্ত হঠকারিতার কাজ – সবে দরোজা খুলেছে এ দেশের, রাস্তাঘাট, ভাষা – কিছুই জানো না। নিউ ইয়র্কের মাইক ক্লেটনের মতে এটি বার্লিন দেওয়াল ভাঙার মত দুঃসাহসী ব্যাপার নিশ্চয়। তবে মনে রাখা ভাল, পথে কোথাও ফেঁসে গেলে সিটি ব্যাঙ্ক তার কর্মচারী উদ্ধার প্রকল্পে পাঁচজনের সার্চ কমিটি পাঠাত না!
পোল্যান্ড তথা পূর্ব ইউরোপে আমার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল, সেই সন্ধ্যায়।
১৯শ শতকে প্যারিস থেকে ফিরে ওজিয়েরস্কি নামক এক ধনী পোলিশ জমিদার ফরাসি কায়দায় একটি প্রাসাদ নির্মাণ করালেন। তখনও প্রাশিয়ানরা এ অঞ্চল দখল করেনি। পরবর্তী শতকে নানান মালিকের হাত ঘুরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সেটি পোলিশ সরকারের দখলে আসে। প্রথমে তাঁরা এখানে চাষবাসের আকাদেমি ও পরে শিশুদের ছুটির ক্যাম্প বানান। কম্যুনিস্ট শাসনের অবসান হলে এটি এখন আবার ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে গেছে। নতুন মালিকরা এই প্রাসাদটিকে হোটেল তথা কনফারেন্স সেন্টার হিসেবে ভাড়া দিতেন, যেমন আমাদের দিয়েছিলেন। সিটি ব্যাঙ্কের পদচিহ্ন অনুসরণ ধরে তিরিশ বছর বাদে এখন এটি আরেক আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কের স্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার। নাম উল্লেখ করে মুফতে তাঁদের বিজ্ঞাপন করতে চাই না।
প্রাসাদটি অসামান্য। অন্তত ৬০টি শোবার ঘর। বিশাল কনফারেন্স রুম। বাগান নেমে গেছে ধাপে ধাপে প্রায় ৪০ একর জমিতে।
সকালবেলা চা পানের পরে অ্যালান আলাদা ডেকে পাঠালেন। বড় সায়েবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ।
“কাল বিকেলে তোমার অনুপস্থিতি দেখে চিন্তিত ছিলাম। পরে জানলাম তুমি একটি বিচিত্র পথে এখানে আবির্ভূত হয়েছ। এই পথ তুমি কেন বেছে নিয়েছিলে, তার সঙ্গত বা অসঙ্গত কোনো কারণ নিশ্চয় আছে। অখণ্ড অবস্থায় (ইন ওয়ান পিস) যে পৌঁছেছ, তাতেই আশ্বস্ত হলাম। এখন মনোযোগ সহকারে আমন্ত্রিত পোলিশ ব্যাঙ্কারদের তালিকাটি অধ্যয়ন কর। কে কোন ব্যাঙ্ক থেকে এসেছে, সেসব ব্যাঙ্কের কর্মধারা কী – সে সব ইয়ানের কাছে জেনে নেবে। এরা বুনিয়াদি (বেসিক) ব্যাঙ্কিং করে। দুনিয়া সেখান থেকে অনেক কদম এগিয়ে গেছে। তার মানে এই নয়, যে এখানে পাঁচ বছরের শিশুদের পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো হবে। ওয়াল স্ট্রিট সুলভ কাউবয় বিদ্যে এদের নেই। সেটা খানিক শেখানো দরকার। কারণ তোমাদের মত লোকেরা একদিন এদের পক্ষে দুর্বোধ্য এবং সিটি ব্যাঙ্কের পক্ষে লাভজনক বাণিজ্য প্রস্তাব এনে, লোভ দেখিয়ে দু’পয়সা বানাবে। তাই তার পরিচয়টা করিয়ে রাখ আগেভাগে। সবটা আবার বুঝিয়ে দিও না। কাউকে সম্পূর্ণ নির্বোধ মনে করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আর শোনো, প্রথম বিদেশি ব্যাঙ্ক হিসেবে আমরা যে পোল্যান্ডে শুধু অফিস খুলিনি, বিনা খরচায় বিদ্যাদানের আসর বসিয়েছি, এটি ওয়ারশ বাজারে চাউর হয়ে গেছে। গুড ভ্যালু!”
সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে লেনদেন ছিল নগদে। চেক অজ্ঞাত। জনসাধারণ অর্থের ব্যবহার করতেন সমবায়িকা থেকে দৈনন্দিন কেনাকাটা করার জন্য।
আমরা জানি, বাজারি অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাজ টাকা সরবরাহের; সুদের হ্রাস-বৃদ্ধি, ব্যাঙ্কিং-এর খবরদারি, মূল্যবৃদ্ধিকে বশে রাখা, বিদেশি মুদ্রার সঙ্গে দেশের মুদ্রার সঙ্গতি সংরক্ষণ করা। এর কোনোটাই পূর্ব ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাজের আওতায় পড়ত না। তাঁরা ছিলেন অর্থ দফতরের অধীনে। দেশের একটিমাত্র তথাকথিত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের তদারকি করতেন। সে ব্যাঙ্কের শাখা গোটা দেশে ছড়ানো। জনগণ সেভিংস ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের খাতা খুলতেন। বাবার কাছে পোস্ট অফিসের সঞ্চয় খাতা দেখি – ঝরিয়া শহরে, পাঁচের দশকে। সেই প্রকার পাসবুক প্রচলিত ছিল পূর্ব ইউরোপের সব দেশে। ইংল্যান্ডে, জার্মানিতে পাসবুক দেখেছি নয়ের দশক অবধি। তবে তার পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডও ছিল।
বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের জন্য প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট দেশে ছিল একটি বিশেষ ব্যাঙ্ক, যেমন – পোল্যান্ডে হানডলোভে, রোমানিয়াতে বানকোরেক্স, হাঙ্গেরিতে ফরেন ট্রেড ব্যাঙ্ক।
কম্যুনিস্ট আমলে পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক টাকা ছাপাত, সঞ্চয় ব্যাঙ্ককে সেটি যোগাত। একশ’ বছর আগে ক্রোনেনবের্গ নামের এক ইহুদি ব্যাঙ্কার যে ব্যাঙ্কটি স্থাপনা করেছিলেন, কালক্রমে সেই ব্যাঙ্ক হানডলোভে সরকারের অধীনে বিদেশি ব্যবসার দায়িত্বগ্রহণ করে। পেকাও একটি স্বতন্ত্র সেভিংস ব্যাঙ্ক। কোনো এক অনির্দিষ্ট কারণে পোলিশ সরকার এই দুটি ব্যাঙ্কের সম্পূর্ণ মালিকানা আত্মসাৎ করেননি। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দশটি শাখা সেভিংস ব্যাঙ্ক রূপে ব্যবসা শুরু করে ১৯৯০ সাল থেকে। তাদের অভিজ্ঞতা সীমিত, কিন্তু তারা সক্রিয় ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নামতে বদ্ধ পরিকর।
সমতল মাঠে (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) খেলা কথাটা আজকাল খুব শোনা যায়। সেটা কোন কোদালের কাজ?
আটের দশকে যখন সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দিয়েছি, ইউরোপে আমাদের দু’টি ট্রেনিং সেন্টার: একটি বেইরুতে (পরে আথেন্স) এবং অন্যটি দক্ষিণ লন্ডনের উপকণ্ঠে, লুইসহ্যামে। চক এবং ডাস্টার হাতে নিয়ে বাইরের কোনো অধ্যাপক এসে কঠিন অঙ্ক শেখাতেন না। ব্যাঙ্কের বিভিন্ন দফতরের মানুষ এসেছেন, তাঁদেরই চেনাজানা বিষয়গুলি নবীনদের বোঝাতে। সিটি ব্যাঙ্কের কর্তাদের ইচ্ছে – কেবল আপন বিভাগ নয়, আমরা যেন ব্যাঙ্কের যাবতীয় বিদ্যা সম্বন্ধে অবহিত হই। তাই নবীনদের পাশাপাশি বয়স্ক সিটি ব্যাঙ্কার বসতেন নতুন কিছু শেখার জন্য। অফিসার পর্যায়ে তিন বছর অন্তর দফতর বা দেশ বদলানোর অলিখিত নিয়ম ছিল – যাতে সকলে হরফান মউলা হয়ে উঠতে পারেন। এক চেয়ারে বসে চুল পাকানো গর্হিত কর্ম বিবেচিত হত।
আরেকটি গুপ্ত উদ্দেশ্য ছিল – এই অবসরে ভাল ছেলে বা মেয়ে চোখে পড়লে, তাদের ফুসলিয়ে নিজের অফিসে নিযুক্ত করা!
জন ফিটজেরাল্ড তখন সেখানকার হেড মাস্টার বা প্রিন্সিপাল। সারাদিন ফরেন এক্সচেঞ্জ পড়িয়ে এক সন্ধ্যেয় হাই স্ট্রিটের পাবে নিয়ে গেলেন। জন নির্ভেজাল আইরিশ কায়দায় গিনেসের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে আমাকে যা বলেছিলেন, সেটা অন্য মানুষের কাজে একদিন লাগতে পারে ভেবে সাধ্যমত লিপিবদ্ধ করেছিলাম
-একদিন তুমিও কোনো ট্রেনিং সেন্টারের বোর্ডের সামনে দাঁড়াবে। বিষয় যাই হোক না কেন। সামনে বিশ জন লোক বসে আছে, নানান বয়েসের। বিভিন্ন বিভাগে, নানান দেশে কাজ করে। সকলে সিটি ব্যাঙ্কার, তোমার শিক্ষার্থী – সেটা তাদের প্রাথমিক পরিচয়। কিন্তু বাগাড়ম্বর শুরু করার আগে তাঁদের একটু চিনে নাও। কার লেখাপড়া কতদূর, সেটা জানতে চাইতে পার না। কিন্তু নামের সঙ্গে সঙ্গে কে কোন বিভাগে, কোন দেশে, কতদিন যাবত কাজ করে – তা জিজ্ঞেস করার অধিকার তোমার আছে। মিনিট দুয়েক ব্যয় কর। একজনের সম্বন্ধে কিছুটা জানবে, এমনকি তার ইংরেজির দৌড় অবধি। সেই মূল্যবান তথ্যটুকু দ্রুত হজম কর। তা না হলে তোমার ভাষণ কারো কাছে বালখিল্য গোছের মনে হবে। আর বাকিদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পণ্ডশ্রম। তাক কর মাঝামাঝি জায়গায়। এক তরফা বক্তৃতা নয় – আলোচনার আসরে সবাইকে টেনে আনো (আজকে যাকে বলে ইন্টারঅ্যাকটিভ!)। তবু যদি অনিশ্চয়তা থেকে যায় মনে, একটা ভূমিকা দিতে পার – আপনাদের মধ্যে কার জ্ঞানগম্যি কতদূর সেটা সঠিক জানি না বলে আমি একবারে অ-আ-ক-খ থেকে আরম্ভ করছি। যারা এ চৌকাঠ পার হয়ে গেছেন, তাঁদের কাছে আগাম ক্ষমা ও ধৈর্যের দাক্ষিণ্য চেয়ে নিই।
সামনের দেওয়ালে নয়, চেষ্টা কোরো শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলার। প্রত্যেকে যেন মনে করে, তুমি তার সঙ্গেই কথা বলছ। সুন্দরী শ্রোতার দিকে দীর্ঘকাল দৃষ্টিনিবদ্ধ করাটা অবশ্য সমীচীন নয়।
ঝাকশেভো গ্রামে আমার প্রথম ক্লাস নেওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ব্যাঙ্কের বক্তিয়ার খিলজি সেজে নানান দেশে শিক্ষকরূপে আবির্ভূত হবার সময়ে জনের কথা মনে রেখেছি।
ওয়ারশ, পজনান, ক্রাকভ, ভ্রতস্লাভ, লুবলিন – ইত্যাদি দশটি শহরে পোলিশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঞ্চয় ব্যাঙ্কগুলিকে কার্যকরী লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এসেছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। এছাড়া ব্যাঙ্ক হানডলোভে ও পোলিশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মিলিয়ে চারজন।
১৬ নভেম্বর ১৯৯২
অনুষ্ঠানসূচির প্রারম্ভে প্রধান অতিথির ভাষণ। উদ্বোধন সঙ্গীতটাই যা নেই।
সকলকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে অ্যালান বললেন, “লেট আস লুক অ্যাট হিস্ট্রি!” ১৮১২ সালে যখন নাপোলেওঁ মস্কোর দরোজায় কড়া নাড়ছেন, সেই সময় সিটি ব্যাঙ্ক তার দোকান খুলেছে নিউ ইয়র্ক শহরে (প্রথম ভারতীয় ব্যাঙ্ক আরও আগে দেখা দিয়েছে – ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা, ১৮০৬)। বার্লিন ওয়াল স্থাপনা, কেনেডির ‘আই অ্যাম এ বারলিনার’ স্পিচ থেকে নভেম্বর ১৯৮৯ সালে দেওয়ালের পতনে পৌঁছে গেলেন। সেই অকুস্থল মাত্র তিনশ’ কিলোমিটার পশ্চিমে, যেখান থেকে এক সহকর্মী গাড়ি চালিয়ে এসেছে কাল সন্ধ্যেয়। আমার নামটা বাদ দিলেন।
এবার ভূগোল। পোল্যান্ডের সুখোভালা গ্রামটিকে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যবিন্দু (সেন্টার পয়েন্ট) বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে তিনি জানেন। নব উন্মোচিত পূর্ব ইউরোপে আবির্ভূত প্রথম বিদেশি ব্যাঙ্ক হিসেবে আমাদের তাবৎ বাণিজ্যিক প্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দু হবে ওয়ারশ। এখান থেকে আরও পূর্বে, যেমন বালটিক দেশগুলিতেও ব্যবসা সঞ্চালনের ও প্রসারণের ভার নেবে ওয়ারশ শাখা। পোল্যান্ড তথা ওয়ারশ হবে আমাদের পূর্ব ইউরোপের পথপ্রদর্শক। এই ক’দিনের সেমিনারে সমাগত পোলিশ ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে আলাপের এবং পারস্পরিক অভিজ্ঞতার আদানপ্রদানের সুযোগ হবে আমাদের। পুনর্বার সকলকে স্বাগত এবং এই নিরালা গ্রামে উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তুমুল করতালির মধ্যে বিদায় নিলেন।
পরে জানতে চেয়েছিলাম, পোল্যান্ড যে ইউরোপের ঠিক মাঝখানে – এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন। অ্যালান বলেন দেখ, এটা বিবাদিত বিষয়। লিথুয়ানিয়া, চেক, স্লোভাক, পোল্যান্ড – সবাই এই খ্যাতি দাবি করে থাকে, এমনকি ইউক্রেন অবধি। কম্পাস দিয়ে কে আর মেপেছে! এই চার-পাঁচটা দেশের যখন যেখানে বাকতাল্লা মারছ, সেটাকেই ইউরোপের মধ্যবিন্দু বলে দেওয়াতে কোনো ক্ষতি নেই।
রাজনৈতিক বক্তৃতা লিখে হাত পাকিয়েছেন, ফ্যাক্ট চেকিং করে নয়!
কৌতূহলী পাঠককে জানাই, মাপজোক করে স্থির হয়েছে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিউসের নিকটবর্তী গিরিজা গ্রাম ইউরোপের ভৌগোলিক মধ্যমণি।
পটভূমিকাটা একবার দেখে নেওয়া যাক।
পোলিশ নাগরিক ব্যাঙ্কে টাকা জমা করেছেন বা তুলেছেন। সমবায়িকায় জামা-জুতো-রুটি-আলু-কপি কিনেছেন। সেখানে দাম বাঁধা। মূল্য বৃদ্ধি বা ইনফ্লেশন নামক দানবের অস্তিত্ব অজানা ছিল।
স্কুল-কলেজ ফ্রি। ওষুধ-ডাক্তার-হাসপাতাল দাতব্য। ছুটির খরচা সীমিত। সমুদ্র বলতে উত্তর সাগর অথবা বড়জোর বুলগারিয়ার কৃষ্ণসাগর তট। স্লোভাক সীমান্তে জাকোপানেতে স্কি। কোথাও বা ছিল সরকারি হলিডে হোম। বেতন স্বল্প, খরচাও সীমিত। শেয়ার বাজার, ক্রিপ্টো কারেন্সি, সঞ্চয়িতা ইত্যাদি জুয়া খেলার অবকাশ নেই। ব্যাঙ্ক থেকে ব্যক্তিগত ঋণ পাওয়া কঠিন।
টাকা জমা হয়েছে সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতায়। অনেকদিনের সঞ্চয় একত্র করে হয়তো গাড়ি কিনেছেন – সে গাড়ি আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি লাদা গাড়ি। টাকা থাকলেই বিএমডব্লিউ কেনা যেত না।
মনে রাখা ভাল, পঞ্চাশ বছর আগে, নাৎসি আমলে একটা ফোলকসভাগেন কেফার (বিটল) গাড়ির দাম ছিল ৯৯৯ রাইখসমার্ক – ব্যাঙ্কের খাতায় সেই পরিমাণ জমা মার্ক না দেখাতে পারলে গাড়ি মিলত না। দেখাও টাকা, পাবে গাড়ি। আজ নগদ। কালও নগদ। উধার ভুলে যান। নাৎসি অর্থনীতি ছিল নগদভিত্তিক।
নতুন পোল্যান্ডে ব্যাপারটা বদলাচ্ছে। এঁরা যা শিখেছেন, সেটার অংশবিশেষকে নতুন করে ঘষে মেজে নেওয়া। এঁরা কি এ-অবধি ভুল শিখেছেন? না। আমরা শেখাতে চাইছি জানা বিদ্যের নতুন প্রয়োগ। ফজলি আম ফুরোলে বলব না – আনো ফজলিতর আম – বলব, নতুন বাজার থেকে দেখেশুনে আতা নিয়ে এস তো হে!
দুটোই ফল।
এবার রঙ্গমঞ্চে অবতরণের পালা।
প্রভাতি সম্ভাষণ, আত্মপরিচয় প্রদান।
কিঞ্চিৎ অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে কাঁটাকলে অর্থনীতি পড়ার সময় বাড়িতে দু’জনকে পণ্ডিতি টোলের ধরনে পঠনপাঠন করিয়েছি। এখন পঁচিশজন প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে কোন কায়দায় বিদ্যা বিতরণ করব? টেবিলে গাদাখানেক প্লাস্টিক অ্যাসিটেট। প্রজেক্টরে এক নম্বর স্লাইড গুঁজে বেয়াতা আলোক সম্পাতের জন্য প্রস্তুত। কেবল আমার ইঙ্গিতের অপেক্ষা।
গুরুবাক্যি স্মরণ করে জেনে নিলাম, কে কোন ব্যাঙ্কের কোন বিভাগে কতদিন কাজ করেছেন। প্রশ্নোত্তরের সুযোগে তাদের কথিত ইংরেজি বিদ্যার পরিচয় পাওয়া গেল। সিঁথি বরানগরে লালিত আমার ইংরেজি উচ্চারণ তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে কিনা, সে হদিশ নেওয়াটাও জরুরি ছিল। নিজের ব্যবসার তরিকা অন্যকে বোঝাতে হয়নি। কাঁটাকলের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্টেট ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে কাজ শিখেছি কাজ করে, ক্লাসরুমে বক্তৃতা শুনে নয়। পাতাটি ছিল সাদা। টাবুলা রাজা। কাগজে লেখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে!
আজকের বিষয় – আন্তর্জাতিক বা বৈদেশিক বাণিজ্য: ট্রেড ফাইনান্স
সে কথাগুলো বোর্ডে ইংরেজি ও পোলিশ ভাষায় নিখুঁত অক্ষরে লিখে রেখেছে বেয়াতা।
তাহলে এবার আরম্ভ করি?
স্লাইড নম্বর ১? ডেফিনিশন অফ এ লেটার অফ ক্রেডিট?
পরে অনেকবার স্মৃতির আলমারি খুলেছি। মনে করতে পারিনি সেদিন কেন, কোন খেয়ালে যাবতীয় স্লাইড দেখানোর বদলে বেয়াতেকে বিভ্রান্ত করে অন্যদিকে চলে গেলাম।
আপনারা বাজার-দোকানে কেনাকাটার দাম কীভাবে মেটান?
কেন, নগদ টাকায়! ক্যাশ!
আপনাদের ট্যাঁক বা সুদৃশ্য ব্যাগ থেকে কেউ একটি নোট বের করুন তো! পড়ে দেখুন, তাতে আপনাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর নোটের ধারককে লিখিত পরিমাণ জ্লোটি (Zloty, পোলিশ মুদ্রা) দেবার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। আপনাদের মুঠোয় ধরা নোট একটি অঙ্গীকারপত্র। আমার ব্রিটিশ পাউন্ড ও জার্মান মার্ক দেখুন। সেখানেও সেই সুসমাচার লিখিত আছে দু’টি ভাষায়।
আপনি-আমি সকলেই নিজের দেশের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করি। তাই একে অপরকে বা দোকানদারকে সে নোট দিয়ে ঋণ অথবা ক্রয়মূল্য চুকিয়ে দিতে পারি। আমরা সবাই জানি ও মানি সেই পাউন্ড, মার্ক বা জ্লোটির বিনিময়ে কিছু কেনা যায় – সবাই এটি গ্রহণ করে। লিগাল টেন্ডার। একাধারে একটি গ্যারান্টি অথবা অঙ্গীকারপত্র।
অন্যথায়, এটি একটি সামান্য রঙচঙে কাগজ।
ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত আছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পরে, যথাক্রমে ১৯১৮ ও ১৯৪৫ সালে, জার্মানিতে বিলিয়ন মার্কের নোট দেখা গেছে। সেটা নিতেও মানুষের আপত্তি – জার্মান গভর্নরের অঙ্গীকারের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ছিল না।
সভ্যতার সকালে চারটে ছাগলের পরিবর্তে হয়তো একটা গোরু পাওয়া যেত। ফিনিশিয়ানরা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চালু করলেন ধাতব মুদ্রা, তার নিজস্ব মূল্য ছিল। ছাগল গোরুর অঙ্ক শেষ। সে এই মাত্তর তিন হাজার বছর আগের কথা।
এখন কাগজের যুগ! তাই দাম ঠিক হয়, কার অঙ্গীকার সেখানে লেখা আছে তাই দিয়ে।
হাতে যদি ক্যাশ না থাকে বা তা ব্যবহারে অনিচ্ছুক হলে, দাম মেটানোর জন্য আমরা দোকানদারের কাউন্টারে ভিসা বা মাস্টারকার্ড রাখি। পোল্যান্ডে এখনো চালু হয়নি বটে, তবে অচিরেই হবে। আপনি যা কিনলেন, তার সমমূল্য দেবার দায়িত্ব আপনার নয়, সেই ভিসা/মাষ্টারকার্ড কোম্পানির ওপর বর্তাল। সে কোম্পানি যথেষ্ট সমর্থ। টাকা মার যাবে না, এ বিশ্বাস দোকানদারের আছে। সে এটাও জানে, আপনার কাছে নগদ-নারায়ণ নেবার পরিবর্তে ভিসা কোম্পানির ল্যাজ ধরার জন্য একটা বাড়তি খরচ লাগে। আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রাপ্য টাকা উশুল করে নেবার ফি বা পারিশ্রমিক। তাও তখুনি নয়, দোকানির খাতায় জমা হবে দু’সপ্তাহ বাদে। জিনিসের দাম থেকে ফি কাটা গেলে নগদের চেয়ে কম জোটে। লাভের গুড় ভাগ করে নিয়ে দোকানদার সে ব্যয় সানন্দে বহন করে তার বাণিজ্যবৃদ্ধির বাসনায়।
দামটা চেকেও দিতে পারেন। সেটা পোল্যান্ডে তেমন প্রচলিত নয়, তবে দেখা দিতে দেরি নেই!
দোকানদার আপনার চেকটি ব্যাঙ্কে জমা দিলে তার প্রাপ্য টাকা হাতে পাবে কয়েকদিন বাদে, কোনো পারিশ্রমিক বা ফি ব্যতিরেকে। কিন্তু সে চেক জমা হবার আগেই আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ভাঁড়ে যদি মা ভবানী বাসা বাঁধেন? তাহলে তো সে চেক একটা বাজে কাগজ মাত্র। তাই দোকানদার চাইবে আপনার ব্যাঙ্কের চেক গ্যারান্টি কার্ড। এতদ্বারা দোকানি আপনার ব্যাঙ্কের ওপর ঝুঁকি নেবে। এটি পশ্চিম ইউরোপে তখন খুব চালু ছিল।
হরিদাস পালকে কেউ বিশ্বাস করে না, করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নরকে, ভিসা/মাস্টারকার্ড, আপনার ব্যাঙ্ককে।
মোদ্দা কথা, দোকান-বাজার করতে গেলে দাম মেটানোর এই তিনটে রাস্তা আছে।
এ তো গেল তাৎক্ষণিক কেনাবেচা।
ক্রেতা যদি বলে আজ মাল নেব, দাম দেব তিন মাস বাদে? শুধুই মুখের কথায় বিক্রেতা বিশ্বাস করবে না। তাহলে সে কথা একটা কাগজে লিখে সই করে দিন! তাকে বলে প্রমিসরি নোট বা হ্যান্ড নোট (ভারতে হুন্ডি, জার্মানে ওয়েকসেল)। অঙ্গীকারের আরেক প্রকাশ মাত্র। তার মূল্য নির্ভর করে, যিনি সেই অঙ্গীকার দিচ্ছেন – তাঁর আর্থিক সঙ্গতির ওপরে। ক্রেতার অর্থবলে বিশ্বাস না থাকলে, বিক্রেতা সেই নোটের ওপরে আরেকজনের গ্যারান্টি চাইতে পারে। কথার খেলাপ হলে বিক্রেতা যাবে উকিলের, আদালতের দরোজায়। উকিলকেও তো করে খেতে হবে!
প্রসঙ্গত, জনসংখ্যার মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি উকিল আমেরিকাতে দেখা যায়।
অবক্ষয়ী পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার প্রতীকরূপে নিন্দিত হলিউডি ফিল্মের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল পোল্যান্ডসহ সব কমিউনিস্ট দেশে। কিন্তু মাঝেসাঝে কিছু নিরামিষ নিরীহ ছবিকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হত। যেমন সাতের দশকে দুর্ধর্ষ বলশালী, কখনও বা উড়ন্ত এক মানুষের কর্মকাণ্ডের ছবি – সুপারম্যান। জানলাম, অনেকেই সে ছবি দেখেছেন। আমি বললাম, অঙ্গীকারের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা সেখানেই পেয়েছি।
সমবেত হাস্যরোল।
আচ্ছা, মনে করুন তো সেই দৃশ্য – দৈনিক গ্রহ পত্রিকার সংবাদদাতা লোয়েস লেন অফিসের বেয়াল্লিশ তলার জানলা থেকে পড়ে গেলেন। পতন ও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এমন সময় কোথা হতে উড়ে এসে সুপারম্যান তাঁকে বগলদাবা করলেন।
-চিন্তা করবেন না ভদ্রে। আমি আপনাকে ধরে আছি (ডোন্ট ওয়ারি লেডি। আই গট ইউ)।
শূন্যে দোদুল্যমান লোয়েস একবার পায়ের অনেক নিচে নিউ ইয়র্কের পথঘাট আর একবার সুপারম্যানের সবল বাহুবন্ধনের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস ভরে বললেন:
-আপনি না হয় আমাকে ধরে আছেন। আপনাকে ধরে আছে কে? (ইউ গট মি, বাট হু গট ইউ?)
গ্যারান্টির দৃঢ়তা নির্ভর করে, সেটা যে দিচ্ছে – তার মুরোদ বা সাধ্যের ওপরে!
বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যপারটাও তাই। তফাৎ এই – ক্রেতাকে দামটা দিতে হবে কোনো শক্তসমর্থ বিদেশি মুদ্রায়, যেমন ডলার। সেটা বিক্রেতার ব্যাঙ্কে জমা হলে তার বদলে পাওয়া যাবে পোলিশ Zloty। এখানে আরেকটা সমস্যা আছে – যদি বিদেশি ক্রেতা ডলার কেন এমনকি আপন মুদ্রাতেও টাকা শোধ না করে? তার ব্যবসা যদি পরমগতি প্রাপ্ত হয়? বিক্রেতা কি সে দেশে মামলা দায়ের করতে যাবে?
সে তখন ধরে তার স্থানীয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে – “আমি মাল বেচেছি বটে, তবে ঐ বিদেশি ক্রেতাকে তো জানি কেবল কাগজেই। যদি পয়সা না দেয়, আমি যাব কোথায়? আপনারা দুনিয়ার ব্যাঙ্কের খবর রাখেন! আপনি একটু মধ্যস্ততা করুন, সার!” ম্যানেজার তখন ক্রেতার নামঠিকানা জেনে এবং তাঁর আপন ডিরেক্টরির পাতা উলটে সেই বিদেশি ক্রেতার ব্যাঙ্কারকে খুঁজে বের করেন। এবার সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। যে ব্যবসা ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে হচ্ছিল, সেখানে দু’টি ব্যাঙ্ক ঢুকে পড়ে, অবশ্যই কিছু পারিশ্রমিকের সন্ধানে! ক্রেতার ব্যাঙ্ক পাঠায় একটি অঙ্গীকারপত্র, যার সরকারি নাম – লেটার অফ ক্রেডিট। বিক্রেতার ব্যাঙ্ক তাতে হস্তাক্ষর করে। ক্রেতার প্রতি বিক্রেতার আস্থা নেই বলেই, সে চায় তৃতীয়পক্ষের অঙ্গীকার! তার নাম – লেটার অফ ক্রেডিট!
ক্যাশ নোটে সরকারি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, ক্রেডিট কার্ডে একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, চেকে একটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, বিদেশি বাণিজ্যে আরও দু’টি ব্যাঙ্ক – সেই সুতোয় বাঁধা অঙ্গীকারের মালাটিকে সকলেই মান্য করি।
মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা অটুট থাকলে ব্যাঙ্কার ও উকিলের কোনো প্রয়োজন হত না।
এমনই ইটের ওপরে ইট সাজিয়ে বাড়ি বানানো।
যেমন আমার পোলিশ জ্ঞান অর্জন – বার্লিনে যখন নেমেছি একটাও পোলিশ শব্দ জানতাম না। তারপর অন্ধকার রাস্তায় পথের নিশানা খুঁজতে খুঁজতে তিনটে শব্দ শিখলাম – প্রাভো, লেভো, প্রসতো। বাঁয়ে, ডাইনে, সোজা! সবশেষে জলতভ গ্রামে এসে শিখলাম – তাম! ওই তো!
জ্ঞানগর্ভ স্লাইডের উত্থাপনা না করেই প্রথম দিনের ক্লাস কেটে গেল। মূল বিষয়টি আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে জানা। নিজেদের দর বাড়ানোর জন্য আমরা ব্যাঙ্কাররা নানান গেরেম্ভারি টেকনিকাল মারপ্যাঁচ দিই।
সবাই খুশি মনে যোগ দিলেন গল্পগুজবে। নগদ টাকা নিয়েও যে কত ঝামেলা। ব্যাঙ্কে ক্যাশের টানাটানি, সমবায়িকার দোকানে খুচরো পাওয়ার ঝক্কি, ছেঁড়া নোট নিতে আপত্তি! শুনে মনে হল, শ্যামবাজার বা আশুবাবুর বাজার ছেড়ে বেশি দূর আসিনি!
অ্যাসিটেটগুলো আরেকদিন কাজে লাগবে! আজ নয়।
আজ খেলাঘরে খেলনা সাজানোর দিন।
যদি কারো প্রয়োজন হয়, এই ভেবে একজন অনুবাদককে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ষাটের কাছাকাছি বয়েস, সৌম্যদর্শন। একই কোট পরে আসতেন রোজ। সুচর্চিত কেতাবি ইংরেজি উচ্চারণ। একটি সমাজব্যবস্থা তাঁর চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে। বিকল্পটি কী? তিনি, তাঁর প্রজন্ম এক ভ্রান্ত বিশ্বাসকে অবলম্বন করে প্রায় সারাজীবন কাটালেন? সংশয় জাগে কী মনে? পশ্চিমের লোক কি সবই জানে? না হাওয়ায় ভাসে? একান্তে গল্প করার সময় একটুআধটু পরীক্ষা নিয়েছেন, আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির দৌড় মেপেছেন। একদিন হঠাৎ বললেন, ইউরোপে একবার হাতি চরেছিল, জানেন? অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, হানিবাল নামক একজন সেনাপতি টিউনিসিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন।
স্থানীয় ব্যাঙ্কারদের পোষাকে বস্ত্র সমবায়িকার পরিষ্কার ছাপ। লন্ডন থেকে এসে সেটা চোখে পড়ে। খুব কম মানুষ সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমে গেছেন। বুলগারিয়া-ক্রোয়েশিয়া সবচেয়ে লম্বা দৌড়। শ্রোতাদের প্রশ্ন কম। আমাদের দলেরই কাউকে পেছনের সারিতে দর্শক সাজিয়ে নিজের বানানো প্রশ্ন পেয়েছি। প্রশ্ন রোপণ করো – প্লান্ট এ কোশ্চেন। একান্তে কেউ বলেছেন, ইংরেজি বলার একটা অস্বস্তি আছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও মুখ খোলেননি। বিষয়ে দখল থাকলেও সর্বসমক্ষে অপরের ভাষায় কথা বলার সঙ্কোচ।
আমি নিজেই এক কৌতূহলের বস্তু। তিরিশ বছর আগে বাদামী রঙের মানুষ সে দেশে বিরল। ব্রিটিশ বা আমেরিকানদের না হয় বোঝা গেল। এই ভারতীয় এ দলে কীরূপে ভিড়িল?
সমবেত জনতার ব্যাঙ্কিং অভিজ্ঞতা বিবিধ প্রকারের।
কয়েকজন এসেছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের একমাত্র কাণ্ডারি ব্যাঙ্ক হানডলোভে থেকে – তার নব্বুই শতাংশ ব্যবসা সোভিয়েত ইউনিয়নের ও কমিউনিস্ট ব্লক বা কমিকনের সঙ্গে। মুদ্রার দর, সুদের হার বাঁধা। জাতীয় ব্যাঙ্ক এবং তার দেশজোড়া শাখাগুলি থেকে এসেছেন বেশিরভাগ, সেগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে সঞ্চয় ব্যাঙ্ক। বিগত দু’বছরের মধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানায় কিছু ব্যাঙ্ক গজিয়ে উঠেছে সকলপ্রকার ব্যাঙ্কিং পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সেবাটি মেলে কিনা, সে বিষয়ে বহু মানুষ নিশ্চিত নন।
জানতে সময় লাগেনি, এঁরা সকলেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ চৌকাঠ সসম্মানে পার হয়ে এসেছেন, তা সে ওয়ারশ, ক্রাকভ (১৩৪৮, অক্সফোরডের চেয়ে তিনশ’ বছরের ছোট), লুবলিন (কমিউনিস্ট পোল্যান্ডে একমাত্র বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) বা পজনানের অ্যাডাম মিকিয়েভিতস হোক। আমাদের লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, নিউ ইয়র্ক অথবা প্যারিস অফিসে টর্চ বাতি জ্বালিয়ে ঘুরলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দরোজাটা অন্তত বাইরে থেকে দেখেছেন – এমন পুরুষ বা নারী খুঁজে পাওয়া শক্ত। শুধু পোল্যান্ড নয়, আমাদের ব্যাঙ্কে প্রাগ থেকে মস্কো, ব্রাতিস্লাভা থেকে বুখারেস্ট শাখায়, এমনকি টেলিফোন অপারেটর অবধি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।
নতুন কিছু শেখার, জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে সমবেত শিক্ষার্থীদের মনে। খানিকটা দ্বিধা, সতর্কতা। চেনা পৃথিবী ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে।
সিটি ব্যাঙ্ক ওয়ারশ-র কতিপয় কর্মীসহ ক্লাসে পঁচিশ জন। তার মধ্যে পাঁচজন পজনানের। তাঁরা রোজ হাজিরা দেন। অন্যেরা এই প্রাসাদে আমাদের সঙ্গে থাকেন। সন্ধ্যেয় আমাদের লন্ডন আর নিউ ইয়র্কের লোকেদের আড্ডা। ক্রমে কয়েকজন পোলিশ অতিথি সেই পানশালায় যোগ দিলেন।
স্থানীয় বিয়ারের নাম লেখ যা আমাদের সকলের হাতে শোভা দিচ্ছিল। তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের লেগুতকো আমাদের মত অর্বাচীনকে পোলিশ ইতিহাস অবগত করানোর চেষ্টা করলেন।
পোল্যান্ড নামক দেশটির প্রতিষ্ঠাস্থল পার্শ্ববর্তী গ্নিজনো শহর (যেখান দিয়ে আমার আসার কথা ছিল)। তার সম্মানে এই অঞ্চলের নাম উইলকোপোলস্কা বা বৃহৎ পোল্যান্ড, জার্মানে গ্রোসপোলেন।
কিংবদন্তি অনুযায়ী ৫০০ খ্রিস্টাব্দে তিন স্লাভিক ভাই, লেখ, চেখ এবং রুস একসঙ্গে পশুপাখি মেরে বাস করতেন মধ্য ইউরোপে। পশুপাখির সংখ্যা কমে এল। বাঁচতে গেলে নতুন বনানী, নতুন নদী খুঁজতে হয়। রুস একদিন এই দল থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন পুবদিকের উন্মুক্ত দিগন্ত বা স্টেপ ভূমিতে। চেখ গেলেন খানিকটা দক্ষিণে – সেখানে সুন্দর পর্বতমালা, অফুরন্ত পশুপাখি, সবুজ উপত্যকা। লেখ তাঁর দল নিয়ে হাঁটলেন উত্তরে। এসে পৌঁছুলেন এক সুন্দর উপত্যকায় – সেখানে অজস্র – নদী, হ্রদ, সবুজে সবুজ বনাঞ্চল।
দলের সাথীরা বললেন, দ্যাখো তোমার এক ভাই রুস ঝাণ্ডা গেড়েছে পুবে। তার দেশের নাম হয়েছে রুসিয়া। পরের ভাই তার দলবল নিয়ে সুখে-স্বছন্দে আছে যেখানে, সে দেশের নাম চেখ। আমরা নাহয় এখানেই বাসা বাঁধি? লেখ বললেন, যদি একটা ঐশ্বরিক লক্ষণ দেখি – তাহলেই। এমন সময় একটি শ্বেত ঈগল এসে নামল বট বৃক্ষের শীর্ষে। লেখ বললেন, মনে হয় পাখি সে বার্তা নিয়ে এসেছে। তবে এই হোক আমাদের দেশ।
সেই শ্বেত ঈগল আজও পোল্যান্ডের পতাকায় আসীন।
গ্নিজনোর কাছে একটি পাহাড়ে দুর্গ গড়লেন লেখ। সেখানে পোল্যান্ডের প্রাচীনতম ক্যাথিড্রাল। সেটি আমরা পরে দেখতে যাই। দেশের সরকারি নাম পোলস্কা, আক্ষরিক অর্থে খোলা মাঠের দেশ। তবে শুধু বিয়ার নয়, লেখ শব্দটির ছায়া আছে অন্যত্র। লিথুয়ানিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় পোল্যান্ডের নাম যথাক্রমে লেঙ্কিয়া ও লেনিয়েল। এমনকি আমার এক হাঙ্গেরিয়ান বাণিজ্যিক সহযোগীর নাম ছিল পিটার লেনিয়েল, বুদাপেস্ট ব্যাঙ্কের এককালীন কোষাধ্যক্ষ।
লৌহ না হোক, ছিল কোনো এক অদৃশ্য যবনিকা। ইউরোপ প্রবাসের প্রথম পনেরো বছর পুবের প্রতিবেশীদের চিনবার জানবার কোনো চেষ্টা করিনি। মুখোমুখি দেখে মনে তো হল না – তাঁরা কেউ অন্য গ্রহের মানুষ! এ যেন বরানগরে পুরোনো চার নম্বর বাসস্ট্যান্ডের উলটোদিকে নিতাইদার দোকানের আড্ডা। কেবল চায়ের বদলে লেখ অথবা জিভিঞ্চ বিয়ার, ভাঁড়ের বদলে কাঁচের গেলাস।
ও নিতাইদা, আর চারটে দেবেন এদিকে।
ইহুদি রসিকতা আমার চেনা। নিজেদের নিয়ে তাঁরা মশকরা করেন অতি স্বচ্ছন্দে। ঝাকশেভোর আড্ডায় পরিচিত হয়েছি পোলিশ রসিকতার সঙ্গে। হাস্যমুখে দৃষ্ট এবং অদৃষ্টকে পরিহাস করার এলেম আছে পোলিশদের। একেই হয়তো ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন আত্মনিগ্রহের আকাঙ্ক্ষা।
পাঁচের দশক। অন্নের অনটন। পজনানে রুটির দাবিতে মিছিল বেরিয়েছে। কসাইয়ের দোকানে একজন বয়স্ক ক্রেতা ঢুকলেন।
-সসেজ আছে?
-না, নেই।
-শ্নিতসেল, কাটলেট?
- না।
-আচ্ছা রামপসটেক?
-না, তাও নেই।
-তাহলে আর কী করা, চলি।
-আসুন।
খদ্দের বিদায় নিলে কসাই তার তরুণ সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, “বুড়োর কি স্মৃতিশক্তি দেখেছিস? কোনকালে খেয়েছিল, মনে রেখে দিয়েছে!”
**
১৯৬০
নির্বাচনে ৯৯% ভোট পেয়ে ভ্লাদিস্লাভ গোমুলকা কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান নির্বাচিত হলেন।
মন্তব্য: নন্দনকাননে আদমকে ঈশ্বর বললেন, যাও, তোমার পত্নী বেছে নাও।
**
১৯৭৫
লাদা গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। দোকানে অর্ডার দেওয়ার পরে ক্রেতা জানলেন, ১৯৮০ সালে ১৪ই মে গাড়ির ডেলিভারি পাওয়া যাবে।
ক্রেতা: সকালে না বিকেলে?
বিক্রেতা: সেটা পাঁচ বছর বাদের কথা। গাড়ি সকালে না বিকেলে পাবেন সেটা আজকে জানতে চাইছেন কেন?
ক্রেতা: না, মানে সবে একটা ওয়াশিং মেশিন অর্ডার করে এসেছি তো। বলেছে ওই ১৪ই মে, বেস্পতিবার ১৯৮০ সালের সকালবেলা সেটা ডেলিভারি দেবে।
***
১৯৮৮
গদান্সক শিপ ইয়ার্ডে লেখ ওয়ালেনসার নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন তুঙ্গে। কাগজের ভাষায় দেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। মহান পোলিশ-সোভিয়েত মৈত্রী টলোমলো। পোলিশ প্রেসিডেন্ট ইয়ারুজেলস্কি নিয়মিত বাক্যালাপ করছেন সোভিয়েত ভাগ্যবিধাতা গরবাচেভের সঙ্গে।
রাস্তায় দু’জন পোলিশ।
-কি হবে এখন? রাশিয়ানরা কি ট্যাঙ্ক পাঠাবে? হাঙ্গেরি আর চেকে যেমন পাঠিয়েছিল?
-মোটেও না। এই ক্রিসমাসে রাশিয়ানরা তিরিশ হাজার শ্যাম্পেন বোতল পাঠাবে।
-তাদের মাথা খারাপ নাকি?
-না। তিরিশ হাজার রাশিয়ান সৈন্য হাতে হাতে আনবে।
গাড়ি নিয়ে কয়েকজন মিলে পজনান গেলাম। আপনাদের ভ্রমণ-তালিকায় তার স্থান পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পশ্চিম প্রাশিয়ার রাজধানী পজনানের ইদিশ নাম পজনা – এককালে ফ্রাঙ্কফুর্ট-বার্লিনের চেয়ে বেশিসংখ্যক ইহুদির বাস ছিল সেখানে। ইতিহাস সাতশ’ বছরের। অনেকবার হাতবদল হয়ে সে শহর আজ পোলিশ, কিন্তু বিভিন্ন সময়ের প্রতিফলন থেকে গেছে তার ক্যাথিড্রালে, নগর স্থাপত্যে। প্রাশিয়ার প্রভাব সেখানে প্রকট। মস্কো বা বুখারেস্টের কায়দায় বুলডোজার না চালালে কালের চরণ চিহ্ন হারিয়ে যায় না। পজনানে হেঁটে বেড়ানো এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রতিটি বাড়ির দরোজার রঙ আলাদা – ডাবলিনের মত!
ঝাকশেভো থেকে বার্লিন ফিরছি। চেনা পথ, অচেনা অনুভূতি।
এক মাস আগেও যে দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, সেখান থেকে নিয়ে গেলাম এক স্মৃতির সম্ভার। পূর্ব ইউরোপের পথে পথে ফিরিওলার ঝুলি নিয়ে আমার পদযাত্রা যে ঝাকশেভোতে শুরু হবে – এমন কথা কেউ ললাটে লিখে রেখেছিলেন। সেদিন বুঝিনি।
মানুষের সঙ্গে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। তার রেশ রয়ে যায়। ডানিয়েল কাজেকর্মে বিশাল উন্নতি করেছে। আজো এ দেশে এলে আমাদের সঙ্গে থাকে। সে আমাকে নিয়ে যায় পোলিশ লেক অঞ্চলে। কাটোভিতসের বাঙ্কা স্লন্সকির গ্রাতসিনা – তার সঙ্গে একদিন আবিষ্কার করব সাইলেশিয়া, পোলিশে স্লন। ভিটেক জিলিনিস্কি একদিন ইউক্রেনে এবং পরে আমার শ্বশুরবাড়ির দেশ রোমানিয়াতে সিটি ব্যাঙ্কের সিইও হবে। পোলিশে সুপ্রভাতের প্রতিশব্দ এবং তার উচ্চারণটি শেখায় সে – জেন দোবরে: জেনের উচ্চারণ হবে কোনো মেয়ের নামের মত, যেমন জেন অস্টেন। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের লেগুতকোর কাছে প্রথম বিদেশি মুদ্রা ট্রেডিং-এর রোমহর্ষক গল্প শুনি – যে ডলার ছুঁতে পাওয়া ভাগ্য বলে বিবেচিত হত, সেই মুদ্রার কেনাবেচা চলেছে! পেকাও ব্যাঙ্কের ইয়ানুশ কজলোস্কি সেই রুস, চেক, লেখের কাহিনির প্রেক্ষাপটে স্লাভিক ভাষা-ঐক্যের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে বললেন, “পোলিশ শেখা কঠিন। তবু শুভ দিন, শুভ সন্ধ্যা, শুভ রাত্রি, দিন ভালো যাক, কেমন আছেন, ধন্যবাদ ইত্যাদি কিছু সম্ভাষণ আয়ত্ত করুন। তারপরে কাজে যখন চেক, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া বা ক্রোয়েশিয়া ঘুরবেন – সেগুলির ব্যবহার করে মানুষজনকে চমৎকৃত করতে পারবেন!” বলা বাহুল্য, এ উপদেশ আমি শিরোধার্য করেছি! পরে কাজেকর্মে দেখা হলে জানতে চাইতেন আমার অগ্রগতি কতদূর!
উইলকোপলস্কা ব্যাঙ্কের মালগোরজাতা অষ্টিনোভিতস (সব মালগোরজাতা বা মারগারেটের ডাকনাম গসিয়া, যেমন সব কাতারজিনা বা কাথারিনার ডাকনাম কাসিয়া) বলেছিল, সঠিক উচ্চারণে হ্যালো বলতে পারলে জানবে পোলিশ শেখার প্রথম পরীক্ষা পাশ করেছ। হ্যালোর প্রতিশব্দ বাঙালির কানে চেশ শোনায়। আমার অক্ষম উচ্চারণে পোলিশের কানে যে কী শোনায় কে জানে! ইতালিয়ানে চাও বা হিব্রুতে শালোমের মত পোলিশ ভাষায় স্বাগত এবং বিদায় জানানোর সহজ শব্দ চেশ!
গদান্সক (ডানজিগ) বন্দরে সে একদিন আমাকে এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় করাবে: একশ’ বছর আগে কোন অচিন মায়ার সন্ধানে জাহাজে উঠেছিলেন পোলিশ নাবিক য়োসেফ তেওডোর কনরাড করজেনিউসকি। ইউক্রেনে তাঁর জন্ম, ইংল্যান্ডের ক্যানটারবেরিতে তিনি সমাহিত।
বালটিক সাগরকূলে পাথরের নোঙরে তাঁর স্মারকে লিখিত আছে একটি সতর্কতার বাণী:
“সমুদ্রের নাবিকের জীবনের চেয়ে লোভনীয় ও নিরাশাজনক দাসত্ব আর কিছু নেই।”
তিনি জোসেফ কনরাড। গসিয়ার উৎসাহে পড়ি – হৃদয়ের অন্ধকার (হার্ট অফ ডার্কনেস) যা তাঁকে ইংরেজি সাহিত্যে অমরত্বের আসনে বসিয়েছে। এই কাহিনির ভিত্তিতে সৃষ্ট আপোকালিপ্স নাও ছবিতে কঙ্গোর দুঃস্বপ্ন আর ভিয়েতনামের বিভীষিকাকে মিলেমিশে একাকার হতে দেখেছি।
পূর্ব ইউরোপের পালা শেষ হলে জোসেফ কনরাডের পদরেখা ধরে আমিও একদিন দাঁড়াব কঙ্গো নদীর তীরে, মাতাদিতে, কিনশাসায়।
সে আরেক উপাখ্যান।