তাসের ঘর
পলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা যাই ঋণদাতা তথা লগ্নিকারক খুঁজতে। তাঁদের ধরে বেঁধে একত্র করার পরে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়—টেবিলের একদিকে মনে করুন দশ জন দেনেওয়ালা আর উলটো দিকে আমাদের খদ্দের—এক মাত্র লেনেওয়ালা। আপনি আমি আকছার ব্যাঙ্কে বসে এমন ধারা চুক্তিতে সই করে থাকি—গাড়ি বা বাড়ি কিনতে। তফাৎ এই, যে এক্ষেত্রে ঋণদাতা কেবল আপনার আমার চেনা ব্যাঙ্কটি নয়—তারা একা ধার দিচ্ছে না। সঙ্গে আরও পাঁচ বা দশ জন ব্যাঙ্কার, লিভারপুল ফুটবল দলের জাতীয় সঙ্গীতের মতন—উই নেভার ওয়াক অ্যালোন।
এই টেবিলের চারপাশে গোছা গোছা কাগজের বান্ডিল নিয়ে যারা ঘোরাঘুরি করেন তাঁরা উকিল গুষ্ঠি—ঋণ সংবিধান রচনা করে (যদিও সেটা একেবারেই কাঁচি কাটা কাজ), খদ্দেরকে সাত আইনের প্যাঁচে আটকে রাখা তাঁদের কাজ—সময়ে ঋণ শোধ না হলে ঋণ গ্রহীতার কান ধরে ইংলিশ আদালতে হাজির করাতে হবে তো। আমাদের সবার পেয়ারের উকিল থাকে। সিটি ব্যাঙ্কে ছিল ক্লিফোরড চান্স, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে আমার কাজ মূলত ডেনটন ওয়াইল্ড সাপটের সঙ্গে (এখন নাম বদলে এস এন আর ডেনটন)।
সম্ভাব্য সমস্যাকে সীমিত করার জন্য লন্ডনের কিছু ওকালতি সংস্থা উন্নয়নশীল দেশের আইনজীবীদের সঙ্গে নানান সমঝোতা করে থাকেন—লগ্নি কারকের আর ঋণ গ্রহীতার উকিল এক হলে স্বার্থের সংঘাত হতে পারে। কিন্তু ঋণ যে নিচ্ছে তাঁর উকিলের সঙ্গে একটু ভাল সম্পর্ক রাখলে ক্ষতি কি? বাকিটা আপনাদের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিই।
এবার আলমাতি আসছি জেনে ডেনটনের জেফ্রি উইন বললে আলমাতি যাচ্ছ যখন আমাদের অফিসে একবার ঢু মেরে যেও। পলের সঙ্গে দু চার কথা বললে জ্ঞান বাড়বে (হি কুড এনলাইটেন ইউ)। প্রস্তাবটা সাগ্রহে মেনে নিয়েছি।
আমরা ব্যাঙ্কাররা যেভাবে একটা দেশকে দেখি, উকিলেরা সেভাবে দেখেন না। দ্রষ্টব্য এক। দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ধার দেওয়া অর্থের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন আমাদের অভীষ্ট। উকিলেরা আইন বাঁচিয়ে সেই কাজে সহায়তা করেন (আমাদের টাকা ফেরত না এলে তাঁরা যে খুব চিন্তিত হন তা নয় – অনাদায়ী ঋণের জন্য আরেক প্রস্থ দুর্মূল্য কেতাবি কসরত চলে)।
আমরা কেউ অবশ্য পুরোপুরি সফল হই না! তাহলে পৃথিবীর চেহারাটা বদলে যেত। তবে একই জিনিসকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে জানার ও শোনার বিশেষ মূল্য আছে। আন্তর্জাতিক ঋণ প্রায় ৯৫% ইংরেজি আইনের আওতায় (ইংলিশ ল) পড়ে – (আমেরিকান ল বলে কিছু নেই)। তবু ঋণ গ্রহীতার দেশের আইনকানুনের খবর রাখতে হয়েছে। তার পূর্ণ দায়িত্ব আমার নয়। আমাদের উকিলের। সে উকিল কখনো লন্ডনের ফার্মের শাখা, কখনো লন্ডনের কোন কোম্পানির সহযোগী স্থানীয় ফার্ম। জেফ্রির কথা মতন তাঁদের সঙ্গে পাঁচ কথা বলে কিছু শেখা যায়। মাঝে সাঝে বিচিত্র অনুরোধও পেয়েছি। নিক কোটস নামে এক সিটি ব্যাঙ্কের খদ্দের একবার প্যারিস থেকে ফোন করেছে।
-তোমরা লিমা, পেরুতে কোন স্থানীয় আইন সংস্থার সঙ্গে কাজ করো?
হঠাৎ আমাকে এই প্রশ্ন কেন? নিকের উত্তর খুব সহজ। তোমাদের ব্রাঞ্চ আছে লিমাতে। নিশ্চয় নিয়মিত ব্যাবসা আছে! তাই উকিলও লাগে! একটা উটকো ঝামেলায় পড়েছি সেখানে। কাউকে সুপারিশ করতে বলছি না।তবে সিটি ব্যাঙ্ক লিমা যাদের সঙ্গে কারবার করে, তেমন কোন ফার্মের কাছে আমরা নিঃসন্দেহে যেতে পারি। তাই এই প্রশ্ন!
প্রথম দু বছর আলমাতি এলে খাবার টেবিলে, পাবে, পথে ঘাটে একটাই গল্প শুনেছি: বাড়ি ঘরের দাম। কেবলই বাড়ছে। একে অপরকে বলছে আজ কেনো, কাল বেচো। দম থাকলে পরশু বেচ। লাভ একেবারে বাঁধা। কাজাখি ব্যাংকাররা বলতেন বিদেশি ব্যাঙ্কের দৌরাত্ম্যে খনিজ পদার্থের ব্যাবসায় আমরা ঢুকতে পারছিনা বটে তবে এই জমি জমার ব্যাবসার মুনাফা সেটা পুষিয়ে দিচ্ছে।
এবার আলমাতি এসে একটা নতুন কথা শুনলাম। জমি জমার দাম স্থিতিশীল হয়েছে। সম্পত্তি বাড়ি জমির দামের সম্বন্ধে এই বিশেষণ আগে শুনিনি। দাম হয় বাড়ে, নয় কমে। নিদেন পক্ষে অপরিবর্তিত থাকে। এই প্রসঙ্গে স্থিতিশীল শব্দের ব্যবহার আমার অচেনা।
পলের বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। সৌম্য চেহারা। মুখে কম কাঁচা, বেশির ভাগ পাকা দাড়ি। প্রায় সব উকিলের মত সরু ফ্রেমের চশমা। ইংল্যান্ডের উত্তরে ডারহামে বাড়ি, লন্ডন থেকে আইন মেনে চালালে ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। এদেশে এসেছেন দু বছর হল। ফিরে যাবার জন্য অধীর। প্রভাতের প্রচলিত সম্ভাষণের পরে তাঁকেই জিগ্যেস করলাম—সম্পত্তির দাম স্থিতিশীল কথাটার মানে কি? পল হেসে বললেন আমিও এটা আগে শুনিনি। তদন্ত করে জেনেছি এর মানে হল বাড়ি ঘরের দাম কমেছে। বস্তুটা যাই হোক না কেন তার দামের ওঠা নামার হিসেব করতে গেলে একটা মানদণ্ড নিতে হয়। কিসের চেয়ে কমেছে বা বেড়েছে। ইংল্যান্ডে আমরা বলি গত বছর বা গত মাসের চেয়ে কমেছে বা বেড়েছে। কাজাখদের হিসেবটা একেবারেই আলাদা। ধরুন একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট বাজারে এসেছিল তিন বছর আগে। তার প্রাথমিক দাম ছিল পঞ্চাশ হাজার ডলার। ২০০৬ সালে সেটা বেড়ে হল দু লক্ষ ডলার। এক বছর বাদে সেই ভাও নেমে এসেছে পঞ্চাশ হাজারে। মানে সেই পয়লা দিনের দামে। আপনি আমি বলব দাম কমেছে। এরা বলবে দাম স্থিতিশীল হয়েছে।
এই আইনী ভাষণ শুনে প্রায় মাথা ঝিম ঝিম করছিল। পল সকৌতুকে আমাকে অবলোকন করে বললেন, “শুধু কফি খেয়ে এটা বোঝা যাবে না। একটু শক্ত ড্রিঙ্ক লাগবে! সোজা কথায় গত তিন বছরে সম্পত্তির দাম আকাশে উঠে যায়। এখন কমছে ধাপে ধাপে। ধরুন আজকে এরা বলছেন দর দাম স্থিতিশীল হয়ে ২০০৫ সালের দামে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে নিচে গেলে কি বলবেন? তেলের দাম একশ চল্লিশ ডলার থেকে নেমে ষাট ডলারের কাছা কাছি। তামা সিসের দাম কমেছে। সম্পত্তি কেনে কে? ফ্ল্যাটের মালিক যে দামে গত বছর কিনেছিল, আজ বেচলে তার অর্ধেক পাবে। কাজাখি ব্যাঙ্কের সম্পত্তি বন্ধক বিভাগ জলের নিচে। যদি ঋণ গ্রহীতা ই এম আই না দিতে পারে বা ফ্ল্যাটের চাবি ব্যাঙ্কের চিঠির বাকসোয় ফেলে দিয়ে হাওয়া হয়ে যায় সে সম্পত্তি বেচলে ব্যাঙ্কের পয়সা উশুল হবার নয়! আমেরিকায় আবাসন অর্থায়নে সাব প্রাইম সমস্যা আপনারাই তো শুরু করেছেন।”
সবিনয়ে বললাম, আমার আগের অন্নদাতা সিটি ব্যাঙ্ককে সে অপরাধের ভাগি করতে পারেন। বর্তমানের প্রভু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড নিষ্কলুষ। পল বললেন, “আরে ওই হল। আপনারা সব এক ডালের পাখি! আরেকটি পাখির গল্প শুনুন তাহলে। মাস তিনেক আগে এক ব্রিটিশ ব্যাঙ্কার শহরে এলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান কাজাখি ব্যাঙ্কদের সরাসরি ঋণ দিতে ইচ্ছুক, এই আপনারা যার খোঁজে সর্বদা ঘোরাঘুরি করেন। লন্ডন অফিস থেকে ফোন করে জেফ বলল সেই ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিকে কিছু কাজাখি ব্যাঙ্কের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমি তো মোটামুটি বড়ো মাছেদের চিনি। তাঁদের নাম নম্বর দিলাম। সেই ব্যাঙ্কার এলেন, আলাপ আলোচনা করলেন। তাঁর বাণিজ্য হলে আমরা কাজ পাবো, ঋণের দলিল দস্তাবেজ বানানোর জন্য। দেখুন আমি ব্যাঙ্কার নই।তবু কাজাখি ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য আমার চোখেও তেমন সুবিধের মনে হয় নি। তবে এই ব্যাঙ্ক কাকে কত ধার দেবে, কেন দেবে বা কি হিসেবে দেবে সে তারা বুঝবে। ইনি এলেন। দেখা সাক্ষাত করে গেলেন। আমরা কোন কাজ পেলাম না। তবে আমাদের হেড অফিস কিছু কাজ পেল। কেন না এই ব্রিটিশ ব্যাঙ্কটি নিজেরাই একটু সমস্যায় পড়ে যায়।”
পলের মুখে সেই এক রকম রহস্যময় স্মিত হাসি। আমার কৌতূহল চাগিয়ে উঠল। বলেন কি? এসেছিলেন ধার দিতে। তা ধার দেবার আগে কোন সমস্যায় পড়লেন? আমি জানি আপনাদের ফার্মের সঙ্গে সব ব্যাঙ্কের একটা গোপনীয়তার চুক্তি থেকে থাকে। সেটি আপনি ভঙ্গ করতে পারেন না। সে অনুরোধ করাটাও সমীচীন হবে না। তবে অন্য প্রশ্ন করি। আমরা কাজাখে অনেক বিদেশী ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলে অনেক গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণ বা সিন্ডিকেটেড লোনের আয়োজন করেছি। এমনকি গত বছরের ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারের লোন অবধি, যেখানে আপনারাই ঋণ পত্র বানিয়েছিলেন। যে ব্যাঙ্কের কথা আপনি নাম না বলে উল্লেখ করছেন সেই ব্যাঙ্কটি কি আমাদের এই বৃহৎ ঋণদাতার গোষ্ঠীতে ছিল?
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ মার্কা প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে কফিতে মন দিলাম। জবাব দেয়া না দেয়া পলের মরজি। আরেক প্রস্থ কফির অর্ডার দিয়ে পল বললেন
-নর্দার্ন রক।
এবার আমার চমকাবার পালা।
এই উত্তুরে প্রস্তর খণ্ডের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন।*
ইংল্যান্ডের নিউ কাসল শহরের দুটি সমবায় ব্যাঙ্ক, দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত নর্দার্ন কাউনটিস এবং রক একত্র হয়ে নর্দার্ন রক নামে একটি ব্যাঙ্কে পরিণত হয় ১৯৯৭ সালে। বিগত শতকে শ্রীমতী থ্যাচারের সরকার (এবং আটলান্টিকের অন্য পাড়ে এক কালের হলিউডি অভিনেতা শ্রী রেগান) বাণিজ্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণকে বাহুল্য বলে ঘোষণা করেন। ব্যাবসা তার নিজের পথ নিজে খুঁজে নিক। সরকারের কাজ রাস্তায় পুলিশের বন্দোবস্ত করা, ব্যাঙ্কে নয়। যখন ইংল্যান্ডে আসি, সমবায় ব্যাঙ্ক গুলি সম্পত্তি জমি বন্ধক রেখে ধার টাকা দিতো। ব্যাঙ্ক ক্রেডিট কার্ড বা বাণিজ্যিক ধার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এবারে আর কোন ফারাক রইল না। ব্যাঙ্ক নেমে পড়ল বন্ধকি ঋণের কারবারে। দীর্ঘদিনের পুরনো সমবায়ী ব্যাঙ্ক ক্রেডিট কার্ড সরবরাহ শুরু করে।
বাণিজ্যে লক্ষ্মী বাস করেন। তবে তাঁকে আপন গৃহে প্রতিষ্ঠা করার খরচ আছে। খদ্দেরকে বাড়তি ঋণ দিয়ে লাভ করতে গেলে অর্থ চাই। সমবায়ী ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে থাকত আপন সদস্যদের জমানো টাকা। বাড়ি জমি বন্ধক নিয়ে সেই টাকা তারা ধার দিত অন্য সদস্যদের, একটু বেশি সুদে। যারা জমা দেবেন আর ধার নেবেন, দু-পক্ষই ঘরের লোক। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে পরিণত হলে ব্যাবসা বাড়ানোর সুযোগ যেমন আসে, তেমনি অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন দেখা দেয়। অতএব এই নব গঠিত ব্যাঙ্ক, নর্দার্ন রক, বাজারে নামলো হাটে মাঠে টাকা যোগাড়ের সন্ধানে।
লক্ষ্মী দেবী এবার আসনে বসলেন। নিউ কাসলের ব্যাঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। ২০০০ সাল নাগাদ দেশে দেশে ডট কম বোমায় বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ইউরোপ আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়েছেন। বাজারে অর্থের অকুলান নেই। ধার নেবার লোক কম। নর্দার্ন রকের বিজনেস মডেল খুব সহজ। স্বল্প মেয়াদে ও সুদে বাজার থেকে ধার নিয়ে বেশি সুদে দীর্ঘ মেয়াদে সেই টাকা বাড়ি জমি কেনার ব্যাবসায়ে লাগানো। ঠিক সেই সময়ে নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কাররা অধিক লাভের নতুন পথ আবিষ্কার করলেন। ব্যাঙ্ক যে টাকা দিলো বাড়ি কিনতে সেটাকে আরেক ঋণ পত্রে মুড়ে নিয়ে বিক্রি করা হল দুনিয়ার নানান ব্যাঙ্ককে বন্ধক নিয়ে যে ব্যাঙ্ক ধার দিয়েছে তাঁর পোয়া বারো কেন না ওই ঋণপত্রের নৌকোয় চড়ে তার টাকাটা ফেরত এলো—এবার ধরা যাবে নতুন বকরা ই এম আই না যদি দিতে পারে কোন মানুষ, ব্যনাক তার সম্পত্তি বেচে টাকা আদায় করুক সম্পত্তির দাম সর্বদা বারে—সুদ আসল দুই শোধ। লাভ শুভ।
২০০৩ সালে রবার্ট পেসটন নামে এক সাংবাদিক নর্দার্ন রকের বিজনেস মডেল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ছ মাস এক বছরের জন্যে টাকা ধার নিয়ে বিশ বছরের মেয়াদে সে টাকা বন্ধকি ব্যাবসায়ে লাগানো কি সদবুদ্ধির পরিচয়? নর্দার্ন রকের টাকার যোগান আসে বাজার থেকে—যদি সে কল বন্ধ হয়ে যায়? বাড়ির মালিক ঋণ শোধ করবেন বিশ বছর বাদে—অর্থের স্রোত বা ফানডিঙ আসবে কোথা হতে?
২০০৭ সালের প্রারম্ভে লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের ব্যাংকিং বেত্তারা একটি আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করলেন। বাড়ি ঘরের দাম কমছে – তবু বন্ধকের সুদ মেটাতে অনেকেই অক্ষম। এমন তো কথা ছিল না! এ যে দেখি বানরে সঙ্গীত গায়, জলে ভাসে শিলা? বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের মহরতের দিনটি অনেকে ৯ই আগস্ট ২০০৭ তারিখ বলে নির্দেশ করেন। সেদিন ফরাসি ব্যাঙ্ক বি এন পি তাঁদের তিনটি হেজ ফাণ্ড বন্ধ করেন। নিউ ইয়র্কে তখন খুব কানাঘুষো—সাব প্রাইম নামের একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটা কী? বা কারা?
পলের হিসেবমত তার এক মাস আগে নর্দার্ন রকের এক লোন ফিরিওলা পোঁটলা ভর্তি ডলার নিয়ে আলমাতিতে আসেন কাজাখি ব্যাঙ্ক গুলিকে সরাসরি ঋণ দেবার শুভ বাসনা নিয়ে। খদ্দেরের নাম পাতা ব্যাল্যান্স শিট সহ আপন দেশে ফেরার আগেই নর্দার্ন রক নিমজ্জিত হল গভীর সঙ্কটে – বাজারে তাঁদের নাম সঙ্কীর্তন শুনেও কেউ হাত উপুড় করছেন না। নর্দার্ন রকের ব্রাঞ্চের সামনে আমানতকারিদের লাইন—তাঁরা গুজব শুনেছেন ব্যাঙ্কের টাকায় টান পড়েছে। লন্ডনে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের অফিসের কাছেই মুরগেটে নর্দার্ন রকের শাখার সামনে লম্বা লাইন দেখেছি। ক্রাচে ভর দিয়ে বৃদ্ধ, প্র্যাম ঠেলে মায়েরা। আর সেই ব্যাঙ্ক চাইছিল কাজাখি ব্যাঙ্কদের সরাসরি টাকা ধার দিতে? নিউ কাসলে সংগঠিত ইংল্যান্ডে ব্যাবসারত এই ব্যাঙ্কের কি কাজ কাজাখের সাথে? কী কথা উহার সাথে? পথভ্রান্ত পথিক? ব্যাবসার ভোল বদল?
ফিনিশ ব্যাঙ্কের দুর্গতি আলোচনা প্রসঙ্গে হেলসিঙ্কির কফি হাউসে নাইজেল একবার বলেছিল, হাতে কোন সমস্যা না থাকলে অনেক ব্যাঙ্ক বেরিয়ে পড়ে সেটা কিনতে!
পল বললে, “জানি কি ভাবছেন। ঐ যে বললাম আপনারা সবাই একই ডালের পাখি! আর প্রসঙ্গটা তুললাম আপনার প্রশ্নের জবাবে – কাজাখ ব্যাঙ্কেরা কেন বলছে জমি জমার দাম স্থিতিশীল হয়ে এসেছে? এদের ডলার আসে তেল বেচে নয়, আপনাদের মতো বিদেশি ব্যাঙ্কের দেওয়া গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণ থেকে। এই কল যতদিন খোলা”—এই বলে পল প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলিয়ে দিলেন।
সাত তলার জানলা দিয়ে হাজার মিটার উঁচু কক টোবের পাহাড় একটু আবছা দেখা যাচ্ছে—এশিয়ার উচ্চতম স্কি জাম্প। একটা খটকা মাথার মধ্যে ঢুকে রইল। ঋণ পাবার অনুপযুক্ত মানুষদের সস্তায় বাসস্থান সরবরাহ পদ্ধতি দ্বারা নিউ ইয়র্কের মহাজ্ঞানী ইনভেসটমেনট ব্যাঙ্কাররা খাল কেটে কুমির আনা শুরু করেছেন – তবে সে বিদ্যে কাজাখি ব্যাঙ্কার আয়ত্ত করে উঠতে পারেন নি বলে জানি। এখানে সমস্যা অন্যবিধ—কাজাখি ব্যাঙ্কগুলির অর্থায়ন যাদের দায়িত্বে, যেমন আমাদের মত ইউরোপ আমেরিকার পঁচিশ তিরিশটি ব্যাঙ্ক, তারা কতদিন টাকার সাপ্লাই লাইন খুলে রাখবে?
এটা কি নর্দার্ন রকের কাজাখি সংস্করণ?
পল বললেন আমি পড়েছি আরেক সমস্যায়। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড যেতে হবে। অবাক হলাম। কেন, সোভিয়েত আমলে তো শুনেছি জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান অতি উন্নত ছিল। পল বললেন হ্যাঁ সে গল্প আমিও শুনেছি। ১৬ বছর বাদে এখনো হাসপাতাল এবং যন্ত্রপাতি দেখলে সম্ভ্রম হয়। ডাক্তারদের দেখলে নয়। এটি নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। এ নিয়ে কোথাও আলোচনা করা ঠিক সঙ্গত নয় :গ্লাসনস্ত তেমন চালু হয়নি নুর সুলতান নজরবায়েভের দেশে।
এটা বোঝা গেল দেশে ফেরার জন্য মন উড়ু উড়ু।
জেফ জানিয়েছিলেন পলও আরসেনাল ফুটবল দলের ফ্যান। আমাদের ক্লাবের সাম্প্রতিক শোচনীয় ফলাফলের জন্য কোচ আরসেন ভেঙ্গারের প্রতি সমস্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করে সভা ভঙ্গ হল।
দি হরর
বাড়ি ঘরের মূল্য যদি নিম্নগামী, তাহলে বাণিজ্যিক সম্পত্তির হাল হকিকত কেমন? বিকেল বেলা কোনো অনুষ্ঠান ছিল না দেখে সরজমিন তদন্তে বেরিয়ে পড়া মনস্থ করলাম।
ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে দুনিয়ার সব রকমের মেক আর মডেলের ট্যাক্সির হাট। তারই একটায় উঠে পড়েছি। রাশিয়ার যে কোন বড়ো শহরের তুলনায় আলমাতির ট্যাক্সি চালক ইংরেজিটা ভালোই বলেন। তাঁকে বললাম আলমাতি শহরের বিস্তার হচ্ছে—নতুন বাড়ি ঘর উঠছে। সেখানে নিয়ে যাবেন?
-অফিস দোকান মিলিয়ে কিছু মাইক্রো ডিসট্রিক্ট তৈরি হচ্ছে জানি। ঠিকানা কি?
-ঠিকানা কিছু নেই। এমনি একটু ঘুরিয়ে দেখান।
ট্যাক্সি চালক সন্দিহান হলেন।
-আপনার গন্তব্য স্থল না জানলে আমি যাব কোথায়?
বুঝলাম তিনি তাঁর প্রাপ্য ভাড়াটি নিয়ে সন্দিহান। কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। ভাড়া না দিয়ে পথে হঠাৎ যদি নেমে পড়ি?
তাঁকে আশ্বস্ত করলাম।
-আমাকে আপনি আবার এই হোটেলেই ফিরিয়ে আনবেন। সামনের কদিন আমি এখানে আছি। ঘরের নম্বর নিতে পারেন। এই ধরুন একঘণ্টা আমাকে ঘোরাবেন। ভাড়া দেব মিটারে অথবা ঘণ্টার কড়ারে।
তিনি ঘণ্টা হিসেবে রাজি হলে স্থানীয় মুদ্রা টেঙেতে দাম সাব্যস্ত হল। ভেবেছিলাম এ নাম হয়তো চেঙ্গিজ বা তেঙ্গিজ খানের সঙ্গে সম্পর্কিত! তা নয়। টেঙে মানে তুলাদণ্ড বা সমতা, তুর্কী ভাষাতেও প্রায় একই শব্দ, দেঙ্গে।
আমাদের হোটেলটি আলমালী মহল্লায়। সেখান থেকে যাব খানিকটা উত্তর পশ্চিমে। আকাশে অস্তায়মান সূর্য। বিকেলের আলোয় স্নিগ্ধ জনপদ। আলমাতিকে সবুজ রাজধানী বলা হয়। এ আখ্যা সম্পূর্ণ সঙ্গত! হোটেলের সামনেই তোলে বি স্ট্রিট। সে পথ সোজা চলে যায় সাইরান জলাধার ছাড়িয়ে নিরুদ্দেশের নিশানায়, দূরে কোথাও চিন দেশ।
অস্ত সূর্যের আলোয় হঠাৎ চোখে পড়ে সারি সারি অসম্পূর্ণ অগুনতি বহুতল বাড়ি। প্রশস্ত অ্যাভেন্যু। কেহ নাই কোন দিকে। ভবিষ্যতের অফিস, সুপার মার্কেট।। কারো বা বাসস্থান হবে, কোনো দিন। শপিং মল। শিশুরা খেলবে সবুজ পার্কে। যুবক যুবতীরা একদিন হাত ধরে হেঁটে বেড়াবে। লাঞ্চের ফাঁকে ভরে উঠবে কফি হাউস। ব্যাবসা-বাণিজ্য-প্রেম-প্রীতি-প্রণয়-দুঃখ-সুখের কথা হবে এই খানে, কোনো খানে। আজ সব নিস্তব্ধ। প্রাণের সাড়া কেবল গাছের পাতায়। বাতাস বইছে মৃদু মন্দ।
-কোথাও থামবেন কি?
ড্রাইভারের প্রশ্ন।তিনি ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছেন। আমি কি কারণে এই কংক্রিটের বনস্থলীতে এসেছি?
জন মনিষ্যি নেই কোন দিকে। একটা গাড়িও আসতে বা যেতে দেখলাম না। চার রাস্তার মোড়ে একটা গোল চক্কর পড়ল। সেখানে সুরম্য সিমেন্টের বিশাল ফোয়ারা—একদিন জলের ধারা আকাশের পানে উঠে যাবে, নেমে আসবে ঝর্নার ছন্দে। তার চার পাশে মানুষ বসবে অফিসের বিরতির সময়, এক হাতে স্যানডউইচ অন্য হাতে মোবাইল ফোন।
থামলাম। আমরা সিনেমায় এমন সব দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত। অজানা নির্জন কোন গ্রহে হাঁটছে একা মানুষ। অন্তহীন আকাশ আর নিরবচ্ছিন্ন নৈঃশব্দ।
অসমাপ্ত ফোয়ারার পাশে বসি। দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ পথ আর কঙ্কালের মতো গগন চুম্বী বাড়ি ছাড়া আর কি দেখার আছে? এই পথে প্রান্তরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হল আমি ঠিক একা নই। অনেক শীর্ণ দেহ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী যেন সারিবদ্ধ হয়ে মাথাটি একটু নামিয়ে এই জনশূন্য ধরণীকে অবলোকন করছে। বিলীয়মান আলোয় আকাশের পটভূমিতে তাদের স্তব্ধ ছবি সিলুয়েটের মতন বাঁধানো।
ক্রেন! সারি সারি ক্রেন। স্তব্ধ নির্বাক ক্রেন। বহুদিন কাজ বন্ধ। মানুষের সাড়া শব্দ নেই। ক্রেনেরা নিশ্চুপ। কার অপেক্ষায়?
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কঙ্গোয় বেলজিয়ানদের ক্রুর নিষ্ঠুর গণহত্যা ও নির্মম বিভীষিকার অনবদ্য প্রতিফলন জোসেফ কনরাডের হৃদয়ের অন্ধকার (হার্ট অফ ডার্কনেস)। পরিচালক ফ্রান্সিস ফোরড কপোলা তাঁর আপোকালিপস নাও ছবিতে কঙ্গোর সেই নৃশংসতার ছায়ায় চিত্রায়িত করেছেন ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত আমেরিকান বর্বরতা। মিস্টার কুরতস (মারলন ব্রানডো) জীবন ও মৃত্যুর মাঝে এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে বলেন, “দি হরর, দি হরর”।
এই হরর তাঁর সময়ের, জীবনের প্রলম্বিত তিমির (কঙ্গো/ভিয়েতনাম)।
আসফালট বাঁধানো অন্তহীন জনশূন্য পথ, সিমেন্ট ও পাথরে কারুকাজ করা ফোয়ারা, অসমাপ্ত কংক্রিটের অজস্র অট্টালিকার মাঝে একাকি দাঁড়িয়ে মনে হল মিস্টার কুরতসের মতো আমিও কিছু দেখছি
দি ক্রেন! দি ক্রেন!
* গুরুচণ্ডা৯তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সিরিজ অর্থনীতি ও নোবেল পুরস্কার ২০২২, ৮ম পর্বে নর্দার্ন রকের সামান্য উল্লেখ করেছি। এই পুনরাবৃত্তি সম্পূর্ণ কাকতালীয়। পনেরো বছর আগে ভাবিনি এ প্রসঙ্গ নিয়ে কখনো লিখব।