বাণগঙ্গা ধাম ও পরমহংস আশ্রম জাতীয় উদ্যানের গেট থেকে সাতশো মিটার দুরে রাস্তার বাঁদিকে বাণগঙ্গা ধাম। জনশ্রুতি বনবাসকালে পান্ডবরা এখানে এসেছিলেন। অর্জুন জমিতে বাণ মারতে বাহান্নটি ছোটবড় কুন্ডের জন্ম হয়। সৃষ্টি হয় জলধারা। তাই নাম বাণগঙ্গা ধাম। অধিকাংশ কুন্ডই চৌকোনা, বাঁধানো। এখনও তাতে পরিস্কার টলটলে জল। ভাদিয়াকুন্ড ঝর্ণার নীচে কুন্ডে নাকি ভীমসেন স্নান করতেন। বাণগঙ্গা ধামে রাস্তার পাশেই প্রাচীন গণেশ মন্দির। পিছনে অনেকটা জায়গা নিয়ে পূর্ণকামনেশ্বর হনুমান মন্দির। বড় প্রাঙ্গণে অনেক প্রাচীন মহীরুহ। বেশ কয়েকটি কুন্ড। বসার জায়গা। শান্ত, নির্জন পরিবেশ। কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটানোর পক্ষে আদর্শ।
গতকাল সন্ধ্যায় আশ্রমে খোশগল্পের সময় ব্রজবিহারীজী বলেছিলেন বছর বিশেক আগের এক ঘটনা। এই বাণগঙ্গা ধামে এক কুন্ডে নিয়মিত স্নান করতে আসতেন এক বৃদ্ধ - ফুলচন্দ সাইকেল ওয়ালে দাদাজী। তাতে গরমকালেও জল থাকতো। একবার তিনি কোথাও গেছিলেন মাসখানেকের জন্য। ফিরে এসে কুন্ডে স্নান করতে গিয়ে দেখেন জল একদম নেমে গেছে। দাদাজী বিমূঢ়! এমন কেন হোলো? তখন গরমকালও নয়। অন্য কুন্ডে জল আছে। দাদাজীর ঐ বিশেষ কুন্ডেই নিয়মিত স্নানের কথা স্থানীয়রা সবাই জানতো। তাদের কেউ বললো, হয়তো কোনো কারণে জল নেবে গেছে, পাশের কুন্ডে করে নিন। কেউ বলে বালতি করে জল তুলে এনে পারে বসে স্নান করুন। কিন্তু দাদাজীর জেদ ঐ কুন্ডেই তিনি অবগাহন স্নান করবেন।
উপস্থিত সবার সামনে দাদাজী শপথ নিলেন "যব তক ইস কুন্ড মে ডুবকি লাগানে লায়ক পানি না আয়ে" উনি অনশন করবেন। বসে গেলেন ঐখানে। দিন পাঁচেক পর কুন্ডে আবার আগের মতো জল এসে যায়। দাদাজী স্নান করে ব্রত ভাঙেন। কেনই বা জল কমে গেছিল, কেনই বা বাড়লো খুঁজলে হয়তো তার কোনো ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত তবে সাধারণ মানুষের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসের স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। তাই তারা এটা কোনো দৈবলীলা ভেবে দাদাজীর ভক্তির জোরের জয়জয়কার করে। আজ দাদাজী নেই তবে দু যুগ আগে দাদাজীর সেই 'অজীব দাস্তা' আজও জীবিত।
পাশে প্রশস্ত এলাকা নিয়ে পরমহংস আশ্রম ও সতী অনসূয়া মন্দির। সতী ও তাঁর পতি অত্রিমূনির শ্বেতপাথরের মূর্তি দুটি খুব সুন্দর। একদম জীবন্ত মনে হয়। পিছনে দেওয়ালে কিছু রঙিন চিত্র। আশ্রমের প্রথম সন্তের প্রাচীন সমাধিও রয়েছে পাশে। ইজিচেয়ারে অর্ধশায়িত এক অশতীপর, অসুস্থ মহারাজ। তিনিই বর্তমানে আশ্রমপ্রধান। তাঁর সেবায় নিয়োজিত প্রৌঢ় ভক্ত শ্যামসুন্দর মহারাজ। সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইশ বছর আগে এখানে এসে তারপর আর কোথাও যান নি। কথাটা শুনে কেমন একটা দমবন্ধ অনুভূতি হয়। তবে ওনার মুখচোখের সমাহিত ভাব, শান্ত কথাবার্তার ভঙ্গিতেও সেই ভূজ-বাবার প্রতিফলন। তবে উনি কোনো প্রতিষ্ঠানে থিতু না হয়ে একাকী অনিশ্চিত পথে ঘুরে বেড়াতেন। আর ইনি সচ্ছল ভক্তদের দানে নির্মিত এক সমৃদ্ধ আশ্রমে আশ্রিত যোগী। আশ্রম দর্শনের সময় সকালে ৮-১২ ও বিকেলে ৪-৯টা। তবে পিছনে হনুমান মন্দির চত্বরে আমায় ঘুরে বেড়াতে দেখে উনি নিজেই আময় ডেকেছেন। তাই বেলা একটাতেও উঠোনে মাদুর পেতে বসে আলাপচারিতা হচ্ছিল। প্রসাদ হিসেবে উনি দুটো গোটা সিঙ্গাপুরী কলা দিলেন। আমি নমস্কার করে চলে গেলাম। এবার হয়তো ওনার বিশ্রামের সময়।
সিন্ধিয়া ছত্রী আশ্রম থেকে আধা কিমি হাঁটা পথে সিন্ধিয়া ছত্রীর গেট। মাধো রাও ও তাঁর মাতা সখ্যারাজের সমাধি মন্দির আছে এখানে। দক্ষিণ-পশ্চিমে মূল তোরণ এখন বন্ধই থাকে। দর্শকদের জন্য প্রবেশপথ উত্তর-পশ্চিমে ছত্রী রোড থেকে। টিকিট ২৫ টাকা। দর্শনের সময় সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা। শিবপুরীর মাধব বিলাস প্যালেসটি শুনলাম সরকার অধিগ্ৰহণ করে নিয়ে তাতে সরকারি অফিস করেছে। সিন্ধিয়া ছত্রী পরিসরও সরকার অধিগ্ৰহণের চেষ্টা করেছে। তবু এখনো অবধি এটি সিন্ধিয়া পরিবারের অধীনে ছত্রী ট্রাস্টের আওতায় আছে।
নতুন দিল্লীর তৎকালীন ভাইসরয় হাউসের (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ভবন) বাগিচা মোগল শৈলীর তাই নাম মোগল গার্ডেন। এডুইন লিটুয়েনস তার প্রেরণা পেয়েছিলেন তাজমহল ও দিল্লীর হুমায়ূনের সমাধির বাগিচাসজ্জা এবং কাশ্মীরের মোগল উদ্যান থেকে। সিন্ধিয়া ছত্রীর উদ্যান সজ্জাও সেই শৈলীর। ছত্রীর উদ্যানের দৈর্ঘ্য মূল তোরণ থেকে উত্তর-পূবে বাণগঙ্গা রোড অবধি প্রায় ছশো মিটার। মাঝে অনেকগুলি পাথর বাঁধানো বাহারি অগভীর জলাশয়, তাতে ফোয়ারা।
মাতা ও পুত্রের স্মৃতি মন্দির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে রাজমাতা সখ্যারাজের স্মৃতিমন্দিরটি আকারে বড়। জানলার অবস্থান বৈশিষ্ট্যে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে মন্দিরটি দ্বিতল। কিন্তু ঢুকলে বোঝা যাবে মাঝে কোনো ছাদ নেই। একটিই সুউচ্চ ছাদ। তাতে সুন্দর অলঙ্করণ। ঝুলছে ঝাড়লন্ঠন। বেশ কিছুটা উঁচুতে তিন দিকে আভ্যন্তরীন অলিন্দ। পাথরের রেলিং দেওয়া। একতলায় মূল প্রবেশদ্বারের দুপাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। অতীতে সন্ধ্যায় অন্দরের বড় ফরাসে শিল্পীরা গোয়ালিয়র ঘরানার ভজন করতেন। মহিলারা ওপরের অলিন্দে বসে দেখতেন। এখন তেমন ভজন হয় কালেভদ্রে, কোনো উৎসব, অনুষ্ঠানে।
মাতাজীর স্মৃতিমন্দিরের আড়াইশো ফুট বিপরীতে পুত্র মাধো রাওয়ের একতলা স্মৃতিমন্দির। রাজপুত ও মোগল শৈলীর শিখর। ভেতরে বাইরে শ্বেতপাথরের দেওয়ালে রঙিন পাথরের মীনাকারির কাজ। ভারী রুপোর দরজা। গর্ভগৃহে মাধো রাওয়ের শ্বেতপাথরের মুর্তির সামনে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। গর্ভগৃহের বাইরে বেদীতে কুচকুচে কালো পাথরের পালিশ করা নন্দী।
দুই স্মৃতিমন্দিরের মাঝে ১২৫x১২৫ ফুট বর্গাকার একটি গভীর বাঁধানো কুন্ড। চার দিকের পারে দুটি করে মোট আটটি ছোট ছত্রী। কুন্ডের ঠিক মাঝে একটি চৌকোনা বসার জায়গা। ওপরে ছাদ। বৃষ্টি উপভোগ করার জন্য অনবদ্য। চার দিকের পার থেকে মাঝের ঐ জায়গায় যাওয়ার জন্য দুপাশে পাথরের রেলিং দেওয়া পদপথ। কুন্ডের চারপাশেও পাথরের সুরক্ষা রেলিং। কুন্ডের দুই পার থেকে ফুট চল্লিশ দুরে মুখোমুখি দুটি দ্বিতল মন্দির - শ্রীরাম ও রাধাকৃষ্ণের।
বাহারি জলাশয়, বড় কুন্ড এসবে একসময় এক কিমি দুরে যাদবসাগর লেক থেকে জল আসতো। শুনলাম বছর দশেক আগেও ফোয়ারাগুলি চলতো। এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কুন্ডের বদ্ধ সবুজ জলে মোটা শ্যাওলা। সর্বত্র বয়সের সাথে যেন অবহেলারও করুণ ছাপ। মূল স্মৃতিমন্দিরদুটি কেবল এখনো ভালো অবস্থায় আছে। এত বড় চত্বরে ঢুকতে হয় খালি পায়ে।
ছত্রী চত্বরে দিবানিদ্রা ছত্রী পরিসরে ঢোকার আগে খেয়েছি চা ও এক প্যাকেট পার্লে-জি। এখন সোয়া দুটো বাজে। ক্ষিধে পাচ্ছে। বাঁধানো চত্বরে চারদিকে অনেকগুলি পাথরের হেলান দিয়ে বসার মতো বড় বেঞ্চ। পাথরে নিপুণ খোদাইকাজ। বড় কুন্ডের দক্ষিণ পারে তেমন একটি পাথরের বেঞ্চিতে বসে সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার ও মহারাজের দেওয়া দুটো কলা দিয়ে সারলুম লাঞ্চ। আকাশে হালকা মেঘ। মরা রোদ। ফুরফুরে বাতাস বইছে। মনোরম আবহাওয়া। এখন চত্বর প্রায় ফাঁকা। আড়ালপিয়াসী কিছু অল্পবয়সী জুটি দুরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিজেদের মধ্যে মগ্ন। খোলা বিস্তৃত চত্বরে ঝিমঝিমে দুপুরে নির্জন শান্তি। বেঞ্চের পাশে প্লাস্টিক পেতে বডি ফেলি। সকাল নটা অবধি ঘুমিয়েও স্যাকে মাথা দিয়ে চোখে রুমাল জড়িয়ে শুতে তন্দ্রা ঘনিয়ে আসে। এটাই তো আজ সকালে চোখ পিটপিট করে মনে মনে ভেবেছিলাম। কী আরাম! ঘুমের কোনো প্রতিযোগিতা হলে তাতে যে কোনো একটা পুরস্কার আমার বাঁধা।
বোম্বে কোঠি চারটে নাগাদ উঠি। বেশ ফ্রেশ লাগে। স্মৃতিমন্দিরের ওপাশে পায়েচলা পথেও কিছু কাঁকড়, ডালপালা পড়ে আছে। আশপাশে জমিতে খালি পায়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে জুতো পড়ে আবার মাধো রাও ছত্রীর বাইরের মাটির রাস্তা ধরে খানিকটা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে ঢুকি বাকি না দেখা অংশে।
পূব দিকে একটু দুরে বিঘা তিনেক জমি প্রাচীন গাছপালা কেটে পরিস্কার করা। সেখানে একটা বড় বাংলো বাড়ি - 'বোম্বে কোঠি'। সাজানো বাগান। বর্তমান রাজবংশের কেউ শিবপুরী এলে ওখানে থাকেন। জায়গাটা প্রাইভেট। দর্শকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মন্দির পরিসরে মসজিদ !!
লম্বা টানা পাথর বাঁধানো পথ, জলাশয়, ফোয়ারা এসবের পশ্চিমে একটু দুরে গাছপালা সমেত জমির মাঝে একটি মাঝারি আকারের মসজিদ। ধপধপে সাদা দেওয়াল ও মিনার। তবে ছোট ছোট অনেকগুলি গম্বুজ উজ্জ্বল সবুজ রঙের। মনে হয় হালে রঙ ফেরানো হয়েছে। এক হিন্দু রাজার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন উদ্যানে মসজিদ!! এই কৌতূহল নিরসন হয় মাধো রাও ছত্রীর একটি ফলকের লেখা থেকে।
মাধো রাও যখন ৫.৬.১৯২৫এ মারা যান তখন তাঁর বয়স ৪৮, তাঁর পুত্র জিভাজী তখন ৯ বছরের বালক। রাজঘরাণার নিয়মে সেই বালককেই বসতে হয় রাজ সিংহাসনে। জীভাজী রাওই ছিলেন সিন্ধিয়া বংশের শেষ মহারাজা কারণ স্বাধীনতার পর ২৮.৫.১৯৪৮এ ভারত প্রজাতন্ত্রে গোয়ালিয়র স্টেটের অন্তর্ভুক্তির পর মহারাজা পদটি বিলুপ্ত হয়। মাধো রাওয়ের বিশ্বস্ত মন্ত্রীসভার সুপারিশে ৬.১.১৯২৬ সালে সাড়ে ন বছরের বালক তার পিতার ও পিতামহীর (সখ্যারাজে) স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এখানে।
এই প্রকল্পের মূল নিয়ামক বা প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর ছিলেন তৎকালীন গোয়ালিয়র সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্ণেল স্যার হাসমাতুল্লা খান, মুখ্য প্রকৌশলী বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন রায় বাহাদুর এস.এন.ভাদুড়ী (C.E, M.I.E) এবং নির্বাহী বাস্তুকার বা এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আসগর আলী খান। মাধো রাওয়ের শেষকৃত্য প্যারিসে হলেও ছ বছরের পরিশ্রমে ১৯৩২ সালে সম্পূর্ণ হয় তাঁর কারুকার্যময় স্মৃতিসৌধ, তাঁর প্রিয় শিবপুরীতে।
সিন্ধিয়া বংশের পূর্বপুরুষ মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও হয়তো মাধো রাও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। সুষ্ঠভাবে রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অমাত্য, কর্মচারী নিয়োগে তাঁর কাছে হয়তো ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসের থেকে অন্যান্য যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হয়তো তাঁর মন্ত্রীসভায় ও শাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন বেশ কিছু অহিন্দু। তাই এক হিন্দু মহারাজার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান দুজন অহিন্দু রাজকর্মচারী। কে দিয়েছিলেন তাঁদের ঐ দায়িত্ব? তৎকালীন মহারাজা জিভাজী তো তখন নিতান্তই বালক। হয়তো রাণী ও মন্ত্রী পরিষদ মাধো রাওয়ের পরম্পরা অনুসারে যে কাজের জন্য যে ব্যক্তি যোগ্য তাকেই নিযুক্ত করেছিলেন। বিরাট ছত্রীপ্রাঙ্গণের একপাশে মসজিদের অস্তিত্বও হয়তো সে কারণেই। এটা আমার অনুমান।
পুরস্কৃত কদম গাছ সকালে যেমন ভেবেছিলাম আজ মেঘলা দিনটা তেমন আলস্যভরে কাটানোর জন্য এই ছত্রী পরিসর বেশ লাগলো। চলে আসার আগে কুন্ডের পূব কোনে দেখলাম একটি হেরিটেজ আইটেম। সেটা প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ছত্রী পরিসরের থেকেও অর্ধ শতাব্দী বয়জ্যেষ্ঠ্য একটি কদম গাছ। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বনদপ্তর ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্ববৃহৎ কদম গাছ হিসেবে তাকে 'মহাবৃক্ষ' পুরস্কার দেয়। গাছ তো আর পুরস্কার নিতে পারে না। পুরস্কার টুরস্কারে তার কিছু এসেও যায় না। মানুষ তাকে কেটে না ফেললেই সে খুশি হয়ে মানুষ ও পশুপাখি, কীটপতঙ্গের জন্য আমৃত্যু জীবন, ছায়া ও সৌরভ বিলিয়ে যায়। মহাবৃক্ষ নিজেই একটি ক্ষুদ্র ইকোসিস্টেম। তার হয়ে সেই পুরস্কার গ্ৰহণ করেন ছত্রী ট্রাষ্টের তরফে অশোক কুমার মোহিতে। তখন সেই গাছের বয়স 'মাত্র ১২৫ বছর'। ২০২৩এ ১৫২ বছর। অর্থাৎ কবিগুরু যখন দশ বছরের বালক তখন এই গাছটি অঙ্কুরিত হয়েছিল। এখনো তার শরীরের কাঠামোয়, পাতার চেকনাইয়ে বার্ধ্যক্যের কোনো লক্ষণই নেই। ১৯৯৬ সালে তার উচ্চতা ছিল ৬৮ফুট ও পরিধি ১৪ফুট। বিগত ২৭ বছরে এই চিরহরিৎ মহীরুহটি বহরে ও উচ্চতায় নিশ্চিত আরো অনেকটা বেড়েছে।
মনুষ্য উপদ্রপহীন সুদুর অরণ্যে হয়তো এমন অনেক গাছ আছে যার বয়সের গাছপাথর নেই। যেমন সুইডেনের ল্যাপল্যান্ড থেকে ডালার্নার পর্বতাঞ্চলে কিছু গাছের বয়স (কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নির্ধারিত) ৮০০০ থেকে ৯৫০০ বছর। চার পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন পাইন গাছ অনেক আছে ক্যালিফোর্ণিয়াতে। তেমন একটি বৃক্ষ জেনারেল শেরম্যানের পাশে দাঁড়িয়ে লোকজন সেলফি নেয়। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিখ্যাত বটবৃক্ষটি নাকি আড়াইশো বছরের প্রাচীন। সে তুলনায় এটি তরুণ।
নানা জায়গায় কিছু গাছ দেখেছি যাদের বেশ প্রাচীন মনে হলেও তাদের বয়স জানার উপায় ছিল না। চোখের সামনে এমন এক সার্টিফিকেটধারী সুঠাম সিনিয়র সিটিজেন দেখে অভিভূত হয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে, তার দীর্ঘজীবন কামনা করে বলি, ভালো থেকো কদমদিদা। মনশ্কর্ণে শুনতে পাই, গাছদিদা বললে, আবার এসো কখনো। বেরিয়ে আসি ছত্রী পরিসর থেকে।
যা দেখা হোলো না ব্রজবিহারীজী কাল বলেছিলেন পারলে ছত্রী দেখে রাজ রাজেশ্বরী মন্দির ও চিন্তাহরণ বিষ্ণু মন্দির দেখে আসবেন। ম্যাপে দেখলাম সেসব প্রায় পাঁচ কিমি দুরে মাধব বিলাস প্যালেসের কাছে। পড়ন্ত বিকেলে আর যেতে ইচ্ছে হোলো না। ছত্রীর বাইরে এসে এক ছোট্ট চায়ের দোকানে জমিয়ে বসলাম। প্রৌঢ় দোকানীর সাথে গল্প করতে করতে চা খেলাম। ছত্রীর সীমানা প্রাচীরের বাইরে রাস্তার ওপাশে চটকল শ্রমিকদের কোয়ার্টারের মতো পাথরের কয়েক সারি মজবুত ঘর। দোকানী বললেন এককালে ওখানে সিন্ধিয়ারাজের সৈন্যরা থাকতো। এখন কিছু ঘরে থাকে ছত্রীর কর্মচারীরা। বাকি খালি পড়ে আছে।
অস্বস্তিকর সূচনা পটল ভাদিয়াকুন্ড ফিরে যাওয়ার পথে বাণগঙ্গা ধামের একটু আগে ডানদিকে দেখলাম প্রাচীন সিদ্ধবাবা যোগাশ্রম। গেট খুলে ভিতরে ঢুকি। অন্ধকার ঝুপসি মতো পরিসর। এক গেরুয়াধারী প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করছেন। একপাশে কয়েকটি ঘর। আশ্রমিকদের জন্য। গেট দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ে একটা বড় চৌকোনা কুন্ড। হয়তো সেই বাহান্ন কুন্ডের একটা। অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির। সবই হালের নির্মাণ। তাতে নানান দেবদেবীর মুর্তি। প্রাঙ্গণের মাঝে চারটি পিলারে ভর করা চারপাশ খোলা ছোট শিখর সমেত একটি মন্দির। তাকে চারদিকে মোটা ঝুরি নামিয়ে ঘিরে রেখেছে এক বৃহৎ প্রাচীন বটবৃক্ষ। ওটাই প্রাচীন সিদ্ধবাবার সমাধি স্থল। জনশ্রুতি অতি জাগ্ৰত। জমি থেকে ফুট চারেক উঁচু প্রশস্ত চবুতরা। ওপরে ওঠার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তার পাশেই একটা সূচনা পটল (Notice Board)। তাতে লিখিত নির্দেশ - ঐ চত্বরের ওপর বালক ও পুরুষ নগ্নপদে উঠতে পারে কিন্তু মহিলাদের যাওয়া নিষিদ্ধ। শবরীমালার আয়াপ্পাস্বামী মন্দিরের মতো নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার মহিলা নয়, এই সমাধি বেদীতে নাবালিকা বা বৃদ্ধাদেরও যাওয়া মানা।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঐ সিদ্ধবাবা নিশ্চয় মাটি ফুঁড়ে ওঠা শিবলিঙ্গের মতো স্বয়ংম্ভূ নন। কোনো এক মহিলাই তাঁকে দশমাস গর্ভে ধারণ ও লালন করে এই ধরাতলে এনেছিলেন। তবু তাঁর সমাধিস্থলে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ? এতই অপবিত্র তারা? ব্রহ্মচারী আশ্রমে মহিলাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার একটা অর্থ বোঝা যায় - ব্রহ্মচর্য পালনে অভ্যাসরত তরুণ আশ্রমিকের সম্ভাব্য চিত্তচাঞ্চল্য এড়াতে। কিন্তু অনেক হনুমান মন্দিরেও মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ কারণ হনুমানজী ব্রহ্মচারী। মহিলাদের জৈন দিগম্বর মূর্তি বা শিবলিঙ্গ স্পর্শ করায় যে নিষেধাজ্ঞা তা পাথরের প্রাণহীন মুর্তি, প্রতীকের চিত্তচাঞ্চল্য এড়াতে? নাকি মহিলা ভক্তের? জানি না।
একটি ইংরেজি নিবন্ধে পড়া স্বামী বিবেকানন্দর একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে যায়
"There is a danger of our religion getting into the kitchen … Our God is the cooking pot, and our religion is, 'Don't touch me, I am Holy' … If this goes on for another century, every one of us will be in a lunatic asylum." স্বামীজীর মতো যুগাবতারেরও হয়তো ভবিষ্যতদর্শনে খামতি ছিল। একশো বছর কবে পার হয়ে গেছে। তবে খুব কম লোকই পাগল বা বীতশ্রদ্ধ হয়েছে। বেশিরভাগই আছে ধর্মের আফিমে মজে। তাদের মাথায় ধর্মাচরণের কাঁঠাল ভেঙে বহুলোক নানাভাবে করেও খাচ্ছে।
দিনের শেষে গতকালের মতোই সন্ধ্যার আগেই চলে এলাম আশ্রমে। মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে যোগ দিলাম স্থানীয় কজনার সাথে সন্ধ্যা আরতিতে। ব্রজবিহারীজী জানতে চাইলেন আজ কেমন ঘুরলাম। কাল মাগরোনীর দিকে যাবো শুনে বললেন, যাওয়ার পথে সম্ভব হলে অটল সাগর ড্যাম ও পাহাড়ের মাথায় টপকেশ্বর মহাদেব মন্দির দেখে নেবেন। ভালো লাগবে। এই তথ্যটা জানা ছিল না। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন অনেক জায়গার কথা জানা যায় যেখানে নিজস্ব বাহন থাকলেই যাওয়াই উচিত। আর কখোনো এদিকে আসা হবে কিনা জানা নেই। চলার পথে আশেপাশে দেখে গেলে ভালোই লাগে। তবে আমার চলা তো পাবলিক বাসে। সম্ভব হবে কিনা কে জানে। বাবা যথারীতি আটটায় খাবার দিয়ে গেলেন। খেয়েদেয়ে দশটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম। শেষ দিনটা সুন্দর কাটলো এখানে।
চিত্রাবলী:২০১২তে ভূজে দেখা সেই বিনদাস রমতা যোগীপূর্ণকামনেশ্বর হনুমান মন্দির পরিসর - বাণগঙ্গা ধামের নানা কুণ্ডের একটি (সবুজ তীর) পরমহংস আশ্রমে সতী অনসূয়া দেবী মন্দির - চাদর পাট করছেন শ্যামসুন্দর মহারাজ - ২২ বছর ধরে এখানেই থিতু হয়ে আছেন! সিন্ধিয়া ছত্রী পরিসরে রাজমাতা সখ্যারাজে সিন্ধিয়ার স্মৃতি মন্দির। ডানদিকে ‘মহাবৃক্ষ’ পুরস্কারে ভূষিত কদমদিদা (লাল তীর) সখ্যারাজে সিন্ধিয়ার স্মৃতি মন্দিরের অভ্যন্তরে সামনে মহারাজা মাধো রাও স্মৃতি মন্দির - পিছনে তাঁর মায়ের মহারাজা মাধো রাও স্মৃতি মন্দিরের অভ্যন্তরে ছত্রী চত্বরে সুন্দর কারুকাজ করা পাথরের বেঞ্চের পাশে তীর চিহ্নিত স্থানে প্লাস্টিক বিছিয়ে দিয়েছিলুম টুকুন দিবানিদ্রা ছত্রী পরিসরে মসজিদছত্রী পরিসরে পিছনের গেট - সচরাচর বন্ধ থাকেপিছন থেকে সখ্যারাজে ছত্রী (লাল তীর) অবধি সুন্দর পথ - ডানদিকে আছে (সবুজ তীর) বম্বে কোঠি বম্বে কোঠি - দর্শকদের জন্য নিষিদ্ধ অনেক ফোয়ারা বানিয়ে ছত্রী পরিসরে সৌন্দর্য্যায়ন করা হয়েছিল - রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেসব এখন শুষ্ক পড়ন্ত বিকেল শেষবারের মতো দেখে নিলাম শান্ত সুন্দর সিন্ধিয়া ছত্রী পরিসররাধেশ্বর পুরী মহারাজ - যাঁর বদান্যতায় দুটি রাত সুন্দর কেটেছিল ভাদিয়াকুন্ডের আশ্রমে