বার্ষিকীর সংক্ষিপ্ত বিনিময়
২৩.১.২০ - সেদিনটা ছিল আমাদের বিয়ের ত্রিশতম বার্ষিকী। বৌ ছেলে রয়েছে মনিপাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে ভাড়া বাড়িতে। আমি মনিপাল থেকে বেরিয়েছি জানুয়ারির ৮ তারিখে। বেড়ানোর প্ল্যান ছিল ৭৫ দিনের - কিন্তু করোনার দাপটে বাড়ি ফিরলাম ১৩ই মার্চ - ৬৪ রাত বাদে। এযাবৎ সেটাই ছিল আমার দীর্ঘতম সোলো ট্রিপ।
একাকী ভ্রমণকালে একটা অন্য ঘোরের মধ্যে থাকি। তখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আত্মীয়, বন্ধু কাউকে ফোন করিনা। ওকেও না। ফোনে দেশবিদেশের খবর দেখি না। তবে বৌমণির সাথে লোকেশন শেয়ারিং অন থাকে। চলার পথের কিছু ছবি, ইনফো শেয়ার করি। কোন বাসে কবে কোথায় যাচ্ছি বাসের ছবি সহ নিঁখুত ইনফো যায়। যাতে পথে কোনো অঘটন ঘটলে ওর কাছে আমার লেটেস্ট ইনফো থাকবে। পুলিশে খবর দিলে ট্রেস করতে সুবিধা হবে।
এসব আমার পুলিশ পিতার দৌলতে তৈরী অভ্যাস। পিঠের ও বুকের স্যাকে, ওয়েস্ট পাউচে, মোবাইল লক স্ক্রিনে - চার জায়গায় ICE Crad থাকে। যাতে এমারজেন্সিতে ওকে কেউ যোগাযোগ করতে পারে। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে সরকারি হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকতে না হয়। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। কারণ তখন আমি এসে-যাওয়ার অতীত। অন্তিম সৎকার নিয়েও আমার কোনো সংস্কার নেই। এই নশ্বর দেহ মৃত্যুর পর কীভাবে পঞ্চভূতে বিলীন হবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পার্সিদের ক্রমশ লুপ্ত হয়ে আসা প্রথা - টাওয়ার অফ সাইলেন্সে অন্তিম ক্রিয়া - আমার তো বেশ লজিক্যাল লাগে। তবে মৃত্যুর নির্দিষ্ট খবর, মৃতদেহ নিকটাত্মীয়র কাছে না গেলে যারা রয়ে গেল তাদের কিছু বাস্তব সমস্যা হতে পারে। তাই রাখি কয়েকটি ICE Card.
কর্মজীবনে ইতি টেনে শীতকালে একাকী ভ্রমণে যাই বলে এযাবৎ কয়েকবার বিবাহ বার্ষিকীর দিন বাড়ি থেকে দুরে কোথাও ছিলাম। সেদিন সকালে বৌমণির উইশ মেসেজ পেলাম হোয়াতে। আমিও মেসেজে জবাব দিলাম। তারপর এলো কল, কী রে, বুড়ো, কেমন আছিস? ঘুরছিস কেমন?
বলি, দারুণ। এখন যেখানে আছি - একদম চমচম! তোরা সব ভালো তো? ছোটু কেমন আছে? গত দুদিন একটু মেঘলা ছিল। আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। তাই আজ পাহাড়ের ওপর মন্দির, সাধন গুহাগুলো দেখতে যাবো। ওপর থেকে নীচের লেকটা মনে হয় দারুণ লাগবে। ছবি পাঠাবো তোকে পরে।
আমাদের একমাত্র ছেলের তখন তেইশে পা দিতে চার মাস বাকি, ছয় দুই হাইট - কোনোভাবেই সে আর ছোটু নেই। তবে ঐ, ছেলেটা মায়ের খোদন টাইপের। তাছাড়া বাবামায়ের কাছে থাকলে ছেলেমেয়েরা একটা সময় অবধি বাবামায়ের মনে ছোটই থেকে যায়, শরীরে বাড়লেও। বিয়ে থা করে তার নিজস্ব পরিবার, পরিমণ্ডল তৈরী হলে, ভাবগতিক বদলে গেলে তখন হয়তো তাকে আর ছোটু ভাবা যায় না।
বৌমণি বলে, সাবধানে থাকবি বুড়ো, বয়স হয়েছে মনে রাখবি, আর ছোঁড়া নেই তুই। একা একা ঘুরিস, আমার চিন্তা হয়।
বলি, আচ্ছা বাবা হয়েছে, অতো ভাবিস না, সাবধানেই থাকি, এখনো কতো বেড়ানো বাকি। বাই।
এভাবেই সমাপ্ত হয় আমাদের বিবাহবার্ষিকীর সংক্ষিপ্ত কথোপকথন। বাড়িতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় হাটুরেদের মতো তুই তোকারিতে বেশ মজা পাই আমরা। ফোনালাপও তো তাই - একান্ত আলাপচারিতা।
চললুম পাহাড়েপাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হচ্ছে একটি বড় মন্দির। তিনটি মূর্তিও বেদীর ওপর বসানো হয়েছে। তবে মন্দিরের ছাদ তখনও হয়নি বলে সেগুলি প্লাস্টিক শীট দিয়ে ঢাকা। মাঝে ষোড়শ তীর্থঙ্কর শ্রী শান্তিনাথ - পূবে সপ্তদশ তীর্থঙ্কর শ্রী কুন্থুনাথ ও পশ্চিমে অষ্টাদশ তীর্থঙ্কর শ্রী অর্হননাথ। তবে এ ছবিটি ২৩.১.২০ তোলা বলে তখনও মন্দির অসম্পূর্ণ। লেখার শুরুতে টোপোম্যাপটা আর একবার এখানে রাখছি। তাহলে ভিসুয়ালাইজ করতে সুবিধা হবে।
4 নম্বরে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই ঐ ২০২০তে দেখা নির্মিয়মান মন্দির - তবে ম্যাপে তা হালের - অর্থাৎ চার বছরে মন্দিরের ছাদ হয়ে গেছে।
পাহাড়ে আর একটু উঠতে এলো ম্যাপে দেখানো (5) গণাচার্য শ্রী বিরাগসাগর সন্ত আবাস। পাহাড়ের মাঝে শান্ত সুন্দর পরিবেশে এই দ্বিতল আবাসটি কেবল জৈন সাধকদের অবস্থান ও তপস্যার জন্য। এখানে যাত্রী সমাগম, কথাবার্তা নিষিদ্ধ।
হিন্দুশাস্ত্রে চারটি যুগের ধারণা আছে - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। এই চতুর্যুগ চক্রাকারে চলতে থাকে। এভাবে চতুর্যুগের এক হাজার চক্র (cycle) সম্পন্ন হলে তাকে এক কল্প ভাবা হয়। তেমনি আছে তিনটি লোকের বা ত্রিলোকের ধারণা - স্বর্গ - মর্ত্য - পাতাল। জৈন ধর্মেও তেমনি তিনটি কালের ধারণা আছে - অতীত - বর্তমান - ভবিষ্যত। এই তিন কালকে ত্রিকাল বলা হয় এবং চতুর্যুগের মতো এই ত্রিকালও চক্রাকারে চলতে থাকে। “ত্রিকাল চৌবিশি” বলতে তিনটি কালের চব্বিশজন তীর্থঙ্কর বোঝায়। তারা হলেন অতীতকালে প্রথম তীর্থঙ্কর শ্রী নির্বাণনাথ ও ২৪তম শ্রী শান্তনাথ। বর্তমান কালের - প্রথম শ্রী ঋষভদেব / আদিনাথজী এবং ২৪তম শ্রী মহাবীরস্বামী / বর্ধমানজী। ভবিষ্যতকালের প্রথম শ্রী মহাপদ্মনাথজী এবং ২৪তম শ্রী অনন্তবীর্যনাথজী।
ঝাড়খণ্ডের পরেশনাথ পাহাড়ে (সম্মেদ শিখরজী), পালিতানার শত্রুঞ্জয় পাহাড়ে, নর্মদা তীরে নেমাওয়ারের মতো বড় জৈন তীর্থে “ত্রিকাল চৌবিশি মন্দির” থাকে। অর্থাৎ তিনটি কালের চব্বিশজন হিসেবে সেখানে ৭২ টি তীর্থঙ্করের মূর্তি বা মন্দির থাকে। শ্রেয়াংসগিরি পাহাড়ে গোলাকার মন্দির সমূহে আছে কেবল বর্তমান কালের চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মূর্তি। তাই ঐ গোলাকার মন্দির সমূহ “চৌবিশি মন্দির”।
আরো কিছুটা উঠতে এলো সেই গোলাকার চৌবিশি মন্দিরসমূহ।
টুকুন পার্শ্বচারণা
চব্বিশতম তীর্থঙ্কর শ্রী বর্ধমানস্বামী বা মহাবীরস্বামী। তিনি বিহারের (অধূনা ঝাড়খণ্ড) পরেশনাথ পাহাড়ে মোক্ষলাভ ও রাজগীরের কাছে পাওয়াপুরীতে নির্বাণলাভ করেন। তবে তেইশতম তীর্থঙ্কর শ্রী পার্শ্বনাথস্বামী পরেশনাথেই মোক্ষ ও নির্বাণলাভ করেন। তাঁর নামেই হয় পরেশনাথ পাহাড়। বর্তমান কালের চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে কুড়িজনই পরেশনাথ পাহাড়ে মোক্ষলাভ করেন তাই এটি জৈন সম্প্রদায়ের কাছে অতি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সম্মেদ অর্থ গভীর অভিনিবেশ আর শিখরজী অর্থ পবিত্র শিখর। তাই সম্মেদ শিখরজী অর্থ যে পর্বত শিখরে জৈন সাধকরা গভীর মনোযোগ সহকারে ধ্যান করে মোক্ষ লাভ করেছেন অর্থাৎ Peak of concentration and salvation.
বিয়ের দেড়বছর পরে বৌ, শ্যালিকা ও দুই বন্ধু মিলে হাজারীবাগ ঘুরে গেছিলাম পরেশনাথ। যাওয়া আসা ও পাহাড়ের ওপর ছড়ানো নানা মন্দির, উচ্চতম পয়েন্ট পার্শ্বনাথ মন্দির দেখা নিয়ে প্রায় চব্বিশ কিমি হাঁটতে হয়। স্থানীয়রা বলেছিল রাত থাকতে না গেলে ফিরতে রাত হয়ে যেতে পারে। তাই মধুবন ধর্মশালা থেকে রাত তিনটেয় বেরিয়ে টর্চের আলোয় জঙ্গুলে পায়েচলা পথে ধরে উঠতে শুরু করেছিলাম পাহাড়ে। আমরা তো তীর্থযাত্রী নই, তাই স্পোর্টস শ্যূ পরে যাচ্ছিলাম। তাও নামার সময় এক জায়গায় পা হড়কালো উৎপলের। কিছু জৈন তীর্থযাত্রী ঐ পথে খালি পায়ে যাচ্ছিলেন। বাপরে! দু’বোন ওপরে গিয়ে বসে রইলো এক জায়গায়। আর এদিক ওদিক গেল না। আমরা তিন বন্ধু ঘুরে এলাম সব। ফিরেছি বিকেল চারটেয়। অবিষ্মরণীয় সেই অভিজ্ঞতা।
হালে গিয়ে দেখলাম অনেক বদলে গেছে মধুবন - পায়ে চলা পথ কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো, অনেক দোকানপাট হয়ে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। That old world charm has gone. আড়াই তিন হাজার বছর আগে জৈন সাধকরা যখন ওখানে যেতেন তখন কেমন ছিল শ্বাপদসঙ্কুল সেই অরণ্যময় অঞ্চল! আজ তার ধারণা দুরতম কল্পনাতেও অসম্ভব।
কোথাও পড়েছিলাম পশ্চিমে আরাবল্লীর মাউন্ট আবুর উচ্চতম পয়েন্ট (গুরু শিখর ৫৬৪৮’) থেকে পূর্ব হিমালয়ে অরুণাচল প্রদেশের উচ্চতম পয়েন্ট কাঙ্গটো শিখর (২৩,২৬১’) অবধি একটি জ্যা (Arc) আঁকলে পরেশনাথ শিখর (৪৪৮০’) হবে তার মাঝে উচ্চতম পয়েন্ট। মেঘহীন দিনে পরেশনাথ শিখর থেকে নাকি দূরবীনে ৪৫০ কিমি পাখিওড়া দূরত্বে এভারেস্ট শৃঙ্গ দেখতে পাওয়াও সম্ভব - কারণ দৃষ্টিপথ অবাধ।
গুজরাটে সোমনাথ মন্দিরে একটি স্তম্ভে লেখা দেখেছিলাম - ওখান থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি একটি সরলরেখা টানলে মাঝে কোথাও জমি পড়বে না। পাথরে খোদাই ঐ লিপিটি আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর। জানুয়ারি ১৯৭৭এ দানিকেনের বইতে পিরী রেইসের (Piri Reis) আঁকা পৃথিবীর ম্যাপের প্রসঙ্গ পড়ে অবাক লেগেছিল। দানিকেনের বক্তব্য ছিল, এরোপ্লেন আবিস্কার এবং তার ফলে এরিয়াল সার্ভে সম্ভব হওয়ার বহু আগে তিনি ঐ ম্যাপ আঁকলেন কী করে?
তা নিয়ে আমেরিকান বিমানবাহিনীর এক কম্যান্ডারও যে আশ্চর্য হয়েছিলেন তেমন একটি নোটও দানিকেন তাঁর বইতে দিয়েছিলেন। অটোমান সাম্রাজ্যের নৌসেনাধ্যক্ষ পিরি রেইসের ১৫১৩ সালে আঁকা সেই ম্যাপ সংরক্ষিত আছে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদে। তারও নয়শো বছর আগে ভারতীয়রা কীভাবে জানতে পেরেছিল সোমনাথ ও দক্ষিণ মেরুর মাঝে কোনো স্থলভাগ নেই? এসব প্রাচীন বিষ্ময়। পাহাড় পছন্দের বিষয় বলে পার্শ্বচারণায় চলে গেছি প্রসঙ্গ থেকে বহুদূরে।
ফিরে আসি শ্রেয়াংসগিরি
চৌবিশি মন্দির, তার ওপরে শ্রী আদিনাথস্বামী মন্দির (A) ছাড়িয়ে পাহাড়ে আরো ওপরে উঠে এসেছি সন্ত শ্রী বিরাগসাগর মহারাজের তপোগুহার কাছে। এখানে তিনি বহুবছর একান্তে সাধনা করেছিলেন। এখান থেকে পাখির চোখে উত্তর দিশায় শ্রেয়াংসগিরি ক্ষেত্র পরিসর, সরোবর, ডানদিকে গুরুকৃপা ধর্মশালা (B), দুরে চৌমুখনাথ মন্দির পরিসর ( C ), অটোস্ট্যান্ড (D) সব কিছু পরিস্কার আলোয় ছবির মতো লাগছে।
আচার্য বিরাগসাগর মহারাজ তপস্যা স্থল ওখানে আলাপ হোলো স্থানীয় ঠিকাদার রামচরণের সাথে। ও জানালো শ্রেয়াংসগিরি পাহাড়ে দুটো লেভেলে পাথরের খাঁজে আশ্রয় নেওয়ার যোগ্য মোট ১৪টি জায়গায় জৈন মুনীরা বিভিন্ন সময়ে তপস্যা করেছেন। ১ থেকে ৪ নম্বর গুহা আছে লোয়ার লেভেলে। ৫ থেকে ১৪ আপার লেভেলে। তখন ও লোয়ার লেভেলে আচার্য্য বিরাগসাগর সাধনা স্থলের সামনে পাহাড়ি ঢালে রিটেনিং ওয়ালের কাজ করছিল। ওর তরুণ ছেলে কাজ দেখাশোনা করছিল। ও বলে, চলুন আপনাকে গুহাগুলো দেখিয়ে আনি।
রামচরণের সাথে গুহাগুলি দেখে ফিরে আসার সময় পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে একটি প্রাচীন ভগ্নপ্রায় মন্দির (সবুজ বৃত্ত) ও দুরে দক্ষিণ-পশ্চিমে জলাশয়ের কোনে সাদা রঙের একটি মন্দির চোখে পড়লো (লাল বৃত্ত)। রামচরণ বলে দুটোই শিব মন্দির। কাছে ভগ্নপ্রায়টি মাতঙ্গেশ্বর শিব, ওটা তিলিয়া মঠ নামেও পরিচিত। দুরেরটা রূপনেশ্বর মহাদেব মন্দির।
বিকেলে গেলাম সেদিকে
বিকেলে পাহাড়ের পশ্চিম দিশায় যাওয়ার সময় পিছন ফিরে দেখি। পরিসরের সামনে বাহুবলী মন্দির থেকে শেষে গুরুকৃপা ধর্মশালা (লাল তীর) অবধি কংক্রিটের বাঁধানো পথ - তারপর মেঠো। দুরে পাহাড়। যথারীতি জনহীন নির্জন।
লেকের পাড় ধরে গিয়ে বাঁদিকে মোড় ঘুড়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে পাহাড়ের ঢাল ধরে পায়ে পায়ে বনতুলসীর শুকনো ঝাড়ের মাঝে সরু পাকদণ্ডী ধরে এগোই। ক্রমশ স্পষ্ট হয় তার রূপ - উপেক্ষায় ও বয়সের ভারে জরাজীর্ণ - তবু লাগে অন্য রকমের আকর্ষণীয়। সকালে পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা পুঁচকে মন্দির কাছ থেকে বিকেলের সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সর্বাঙ্গে প্রাচীনতা ও অযত্নের ছাপ। মন্দিরের গায়ে, শিখরে বটগাছ গজিয়েছে। ওরাই ক্রমশ ফাটিয়ে দেবে। গর্ভগৃহে গিয়ে দেখি শিবমন্দিরই হবে।
কিন্তু মাখনে ছুরি চালানোর মতো এমন লম্বালম্বিভাবে দ্বিখণ্ডিত শিবলিঙ্গ এর আগে কোথাও দেখিনি। এটা প্রাকৃতিক কারণে হয়েছে না মনুষ্যকৃত বোঝা গেলনা। তবে অবহেলার বহর দেখে এটা পরিস্কার বোঝা গেল কোনো কারণে মাতঙ্গেশ্বর শিব মন্দিরটি পরিত্যক্ত।
মন্দিরটা চক্কর মারতে গিয়ে দেখা হয় ডাকাতসর্দারের মতো রাফটাফ রাজেন্দ্র সিং ওরফে মুন্নিবাবার সাথে। কালো জ্যাকেট, হলুদ উড়নি, গলায় নানা মালা, শ্রীরাম লেখা রূপোর লকেট। আলাপ করে জানা গেল ওনার তিনকুলে কেউ নেই। অদুরে সরোবরের পাড়ে রূপনেশ্বর মন্দিরে বিগত পনেরো বছর ধরে পড়ে আছেন। তখন ঐ মন্দিরের অবস্থাও দেখরেখের অভাবে প্রায় এরকম দশাই ছিল। শুরুতে উনি একা হাতে মন্দিরের আশপাশে ঝোপঝাড়, গা থেকে বটগাছ, ভেতর থেকে ধূলো ময়লা, ইঁট পাটকেল সাফাই শুরু করেন। ক্রমশ গ্ৰামের লোক পয়সাকড়ি নিয়ে, শ্রম দিয়ে এগিয়ে আসে। উনি হয়ে যান ঐ পরিত্যক্ত মন্দিরের স্বনিযুক্ত পূজারী।
নিত্য পূজা শুরু হওয়ার ফলে লোকজন আসা শুরু হয়। প্রণামী পড়ে। মুন্নিবাবার লোভ নেই। নিজের প্রয়োজন সামান্য। যেখান থেকে যা আসে তাই দিয়ে মন্দিরের মেরামত শুরু হয়। এই গ্ৰামের এক প্রাক্তন অধিবাসী সাতনায় PWD ইঞ্জিনিয়ার। মুন্নিবাবার লগন দেখে সেও অনেক সাহায্য করে। জানতে চাই, কোনো সরকারি সহযোগ পাওয়া যায়নি? মুন্নিবাবা হেসে বলেন - যেখানে ভোট কম, নেতাদের আনাগোনাও কম, সেখানে সরকারি সাহায্য দুরাশা। এখন রূপনেশ্বর মন্দিরের হাল অনেকটাই ভালো হয়েছে। তাই মুন্নিবাবা এবার মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরের হাল ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে। আরণ্যকের রাজু পাঁড়ের মতো চরিত্র এঁনারা। মার্জিত, শান্ত ভঙ্গিতে ব্যারিটোন ভয়েসে মানুষটি যখন ঐসব ইতিবৃত্ত শোনাচ্ছিলেন - মনে মনে তাঁকে সমীহ করেছি। মুন্নি বাবা ঝোপঝাড় কেটে জড়ো করে আগুন লাগাতে উদ্যোগী হন, আমি এগিয়ে যায় আগে।
পড়ন্ত বিকেলের আলোয় জনবিরল এলাকায় জলাশয়ের এপার থেকে রূপনেশ্বর মন্দিরটির অবস্থান খাসা লাগলো। কাছে গিয়ে দেখি, মুন্নিবাবার উদ্যম ও সম্মিলিত প্রয়াসে সরকারি সাহায্য ছাড়াই মোটামুটি মেরামতি হয়ে মন্দিরটি বেঁচে গেছে। অচিরেই ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা নেই। মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরটির হাল বড়ই খাস্তা, তবু হয়তো ওটাও বেঁচে যাবে এভাবে, অনেকের সদিচ্ছায়।
মেঘের ফাঁক দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফোকাসের মতো আসা সূর্যের আলো ফটোগ্ৰাফিক লিঙ্গোতে Jacob's Ladder নামে পরিচিত। এটি একটি বিবলিক্যাল টার্ম। নমুনা হিসেবে নেট থেকে তেমন একটি সাদাকালো ছবি রাখলাম। সেদিন নাচনায় রূপনেশ্বর মহাদেব মন্দিরের কাছে জলাশয়ের পাড়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে দেখছিলাম। বহুদূর বিস্তৃত উঁচুনিচু জমি। দিগন্তে দূর অবধি চলে গেছে পাহাড়। হেলে পড়া সূর্যের মায়াবী সোনালী আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর লেগেছিল সেই দৃশ্য। মোবাইল ক্যামেরা বিশেষ এ্যাঙ্গেলে ধরে Lens flare তৈরী করে কৃত্রিমভাবে তুললাম একটি Slanting Jacob's ladder. তৃতীয় দিনটি মেঘহীন ঝকঝকে আলোয় বেশ কাটলো নাচনায়।
বন্ধুভরা বসুন্ধরা
পরদিন সকালে শৈলেশকে পয়সাকড়ি মিটিয়ে দিয়ে বলি, ইচ্ছে তো করছে এখানেই থেকে যাই আরো দিন দুয়েক। এমন নির্জনতা বহুদিন পাইনি কোথাও। কিন্তু আরো কিছু জায়গা দেখার বাসনা নিয়ে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে, তাই আজ চানটান করে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়বো। শৈলেশ বলে, তিনদিন থাকলেন এখানে, একদিনও খেলেন না আমাদের কাছে। আমার বৌয়ের মাথার গণ্ডগোল হলেও রান্নাটা কিন্তু খারাপ করে না। আপনি বুজুর্গ ব্রাহ্মণ, একটু অতিথি সেবার সুযোগ অন্ততঃ দিন। এতে গৃহস্থের মঙ্গল হয়।
খুব খারাপ লাগে ওর কথা শুনে। বলি, ছি ছি, এসব কি বলছেন! এমন দীর্ঘ একাকী ভ্রমণে আমার সাথে সব যোগাড়যন্ত্র থাকে। কোথায় কী পাবো ঠিক নেই। তাই যতটা সম্ভব স্বাবলম্বী হয়ে বেরোই। আপনি গ্যাস বার্ণারটা দিতে খুব উপকার হোলো। তাই আর আপনাদের খাওয়ার কথা বলি নি। ঠিক আছে আজ খেয়ে যাবো।
সেই ঝনাৎ করে চাবি ছুঁড়ে ফেলা ঢাকা বারান্দায় চেয়ার পেতে দেয় শৈলেশ। পরিস্কার থালায় তিনটে ঘি মাখানো পাতলা রুটি, বাটিতে ঝোলঝোল আলু, মটরের সবজি, একটু আচার আর মুলির স্যালাড নিয়ে আসে ভেতর থেকে। পাশে বসে থাকে যতক্ষণ খেলাম। জিজ্ঞাসা করে, রুটি, সবজি দিই? রাস্তায় যেতে হলে বেশী খাওয়ার অভ্যাস নেই। তবু কী মনে করবে ভেবে একটা রুটি, আর একটু সবজি নিই। স্বাদু রান্নার প্রশংসা করি। বলি, আচ্ছা একটা কথা বলছি, কিছু মনে করবেন না, জৈনরা তো মাটির তলার সবজি খায় না শুনেছি, তাহলে আলুর সবজি, স্যালাডে মুলো দিলেন যে। লাজুক হেসে শৈলেশ বলে, আজকাল অতো আর কেউ মানে না। যারা সাধক তারাই খুব নিষ্ঠা সহকারে সব নির্দেশ পালন করে।
হঠাৎ চোখ পড়ে দরজায়। পর্দার পাশ দিয়ে মুখ বার করে আমার খাওয়া দেখছেন শৈলেশের স্ত্রী। নিজের হাতে রান্না করা খাবার অতিথি কীভাবে খাচ্ছেন দেখতে চাওয়াও তো স্বাভাবিক মহিলাদের মতো প্রতিক্রিয়া। প্রথমবার দেখা সেই কর্কশ মুখভাব নেই। দৃষ্টি নরম। হেসে বলি, রান্না খুব ভালো হয়েছে। কোনো উত্তর না দিয়ে চকিতে ঢুকে যান তিনি ভিতরে।
তখন মনে হয়, ওহো, উনি তো ঠিক স্বাভাবিক নন, তাই অতিথির প্রশংসা কীভাবে স্বীকার করতে হয় জানেন না। অবশ্য অনেক স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও এটা দেখেছি - those who take others's appreciation for granted as entitlement so don't feel obliged to acknowledge.
খাওয়ার মাঝে বাইক নিয়ে শৈলেশের কাছে কাজের কোনো খবর দিতে আসেন ঠিকাদার রামচরণ। পিলারে হেলান দিয়ে রাখা দুটো স্যাক দেখে বলে - চললেন নাকি বাবুজী? বলি, হ্যাঁ, ভাই, এই শ্রেয়াংসগিরি জৈনতীর্থ আর চৌমুখনাথ মন্দির ছাড়া আর তো বিশেষ কিছু দেখার নেই এখানে, তবু জায়গাটাই এতো সুন্দর, দুদিন ভেবে এসে তিনদিন দিব্যি থেকে গেলাম। বেশ লাগলো। এবার যাই।
রামচরণ বলে, চলুন আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি। চলে আসার আগে শৈলেশ বলে, আর একবার আসুন কখনো ভাবীকে নিয়ে। গেছিলাম ওখানে নিছক ভ্রামণিক হিসেবে, কিন্তু ওদের সহৃদয়তায় ফিরে যাই মনে আত্মীয়তার মাধুর্য মেখে।
সেদিন ছিল চৌমুখনাথ মন্দিরে একদিনের একাদশীর মেলা। বেশ কিছু ভক্ত সমাগম হয়েছে। রাস্তার ধারে মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে ফেরিওয়ালারা বসেছে কিছু বিক্রিবাটার আশায়। অন্যদিনের তুলনায় সেদিন সালেহা নাচনা ঘনঘন শেয়ার অটো চলছে।
রামচরণকে বলি, অটোস্ট্যান্ডেই ছেড়ে দিন। আপনার দৌলতে দুটো স্যাক নিয়ে এক কিমি হাঁটা বেঁচে গেল। রামচরণ বলে, তেমন কোনো কাজ নেই আমার, চলুন গঞ্জ তিরাহাতে ছেড়ে দিই। সালেহা বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার আগেই হাইওয়ে থেকেই সাতনার রানিং বাস পেয়ে যাবেন। এক অচেনা পরেদেশীকে রামচরণ আপ ডাউন দশ কিমি তেল পুড়িয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। বহুবার এসব দেখে, ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কবি অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর শব্দবন্ধটি বারবার মনে পড়ে - “বন্ধুভরা বসুন্ধরা”।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।