এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  ঘুমক্কড়

  • মায়াবী নির্জন নাচনা-২

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | ঘুমক্কড় | ২৬ মার্চ ২০২৪ | ৯২৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • লাগলো লটারি


       
    একটু বাদে শৈলেশ একটা চার কেজি‌র ছোট সিলিন্ডার দিয়ে যায়। ওপরে বার্ণার লাগানো। এবার ঘরেই দিব‍্যি গরমাগরম ম‍্যাগী মটর বানিয়ে খা‌ওয়া যাবে। ঠান্ডায় আর রাতে বাইরে যেতে হবে না। গেলেও অবশ‍্য কিছু পাওয়া যাবে না। শৈলেশ, সুরেশ দুজনেই বলছে, অটোস্ট‍্যান্ডের কাছে একটা দোকানে চা, বিস্কুট, পকোড়া ছাড়া আর কিছু পাওয়া‌ যায় না। একানে ছোট জায়গা। শ্রাবণ মাসে চৌমুখনাথ মহাদেব মন্দিরে অনেক ভক্তসমাগম হয়। তখন কদিনের মেলা কিছু সাময়িক খাবারের দোকান বসে। ভান্ডারাও লাগে। জৈন তীর্থ‌যাত্রীরা সচরাচর বড় দলে বাস বুক করে আসেন। সাথে থাকে রান্না‌র ঠাকুর, যোগাড়। কেউ গাড়িতে এসে দিনে দিনে ঘুরে চলে যায়। একা কেউ এখানে এসে রাতে থাকে না। তাই সারা বছর প্রায় ফাঁকা‌ই থাকে এ জায়গা। কে খাবে হোটেলে? তাই খাওয়া‌র হোটেল‌‌ও নেই। 
     

    সুরেশ হাফ লিটার মতো দুধ নিয়ে আসে। কত লাগবে বলতে, পঁচিশ টাকা চায়। যে তিন দিন ছিলাম, রোজ সুরেশ দুধ দিয়ে গেছে। রান্নার ব‍্যবস্থা হতে একটা আইডিয়া এলো মাথায়। সেই অটো‌ওয়ালা জয়রাম তো সালেহা - নাচনা ট্রিপ মারে। সালেহা‌তে অটোস্ট‍্যান্ডের কাছেই বাজার  দোকান আছে দেখেছি। ওকে ফোন করে বলি, ভাই জয়রাম, আমি সেই কলকাতার আঙ্কল বলছি, পরেরবার নাচনা আসার সময় আমার জন‍্য সালেহা থেকে খান ছয়েক ম‍্যাগীর প‍্যাকেট, এক কিলো হরা মটর আর একটু গাজর নিয়ে আসবে? তাহলে খুব উপকার হয়। জয়রাম বলে, আচ্ছা আনবো। সাতটা নাগাদ ফোন করে জয়রাম বলে, আমি স্ট‍্যান্ডে‌র সামনে চায়ের দোকানে রেখে গেলাম। আপনি ওকেই পয়সা দিয়ে দেবেন, আমি পরে এসে নিয়ে নেবো। একাকী ভ্রমণে বহুবার এভাবে নানা অচেনা মানুষের এমন সহৃদয়‌তায় মুগ্ধ, উপকৃত হয়েছি। 
     

    শৈলেশের দেওয়া গ‍্যাসস্টোভে রাতে ম‍্যাগী মটর বানিয়ে খেলাম। পরদিন জলখাবারে‌ও তাই খেলাম  - গরমাগরম। ২০২১এ করোনা‌র কারণে শীতে দীর্ঘ একাকী ভ্রমণে যাওয়া হয়নি। তার পরের বার ১৩.১২.২২এ দু মাসের একাকী ভ্রমণে বেরিয়ে নিয়ে গেছি‌লাম একটা দেড় লিটারের ওপেন টপ সিলিন্ড্রিক‍্যাল ইলেকট্রিক কেটল। ফলে সেবার আর গ‍্যাস বার্ণারের ভরসায় থাকতে হয়নি। ওতেই সেবার মটরশুঁটি, গাজর, ক‍্যাপসিকাম, টমেটো, বীনস দিয়ে বহুবার খেয়েছি বানিয়ে খেয়েছি ভেজ ম‍্যাগী। অনেকেই এতে বোর হয়ে যাবে - তবে আমি এ ব‍্যাপারে গিনেসে নাম তুলতে পারি। মুখ বদলাতে মাঝে মধ‍্যে ওতে ডিম সেদ্ধ, দুধ ওটস, দুধ পাঁউরুটি, দুধ কর্নফ্লেক্স এসব‌ও করে খেয়েছি। একবার কাজু, কিসমিস দিয়ে পায়েস‌ও করেছিলাম। হেব্বি হয়েছিল। হোটেলে খেয়েছি খুব কম।

    সুন্দর সকাল

    ২২.১.২০ - গতকাল রাতে কখন যে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে টের পাই নি। সকালে ছাদে উঠে দেখি আকাশে‌র মুখ ভার। ভিজে জমি থেকে আসছে সোঁদা সৌরভ। চারপাশে হিমেল কুয়াশার মধ‍্যে আড়মোড়া ভাঙছে আর একটি নতুন সকাল। একটি স্থানীয় মানুষ গুটি‌কয় গরু নিয়ে চলেছে দুর পাহাড়ের দিকে। হয়তো ওখানে এখনও রয়েছে বড় বড় ঘাস। কাছাকাছি জমিতে বেঁচে আছে ন‍্যাড়া মাথায় সদ‍্য গজানো চুলের মতো কিছু ঘাস। তা হয়তো ছাগলের পক্ষেই মুড়িয়ে খাওয়া সম্ভব।
     

    মানুষ‌টি ফুট বিশেক পিছনে চলতে চলতে থেকে থেকে আওয়াজ ছাড়ছে - হ‍্যেইট-টে-টে। হয়তো নিছক অভ‍্যাসে। কারণ গরুগুলো উপর নীচে মাথা দুলিয়ে শান্ত ছন্দে, ধীর লয়ে হেঁটে চলেছে মেঠো পথ ধরে। দেখেই বোঝা যায় এ পথ ওদের চেনা। কোথায় যাবে তাও জানা। ওদের গলায় বাঁধা ঘন্টায় মৃদু ডিং-ডং, ডিং-ডং মিষ্টি আওয়াজে শৈশবের কিছু সুখস্বপ্নের মতো দৃশ‍্য মনে পড়ে। ২০১৯এ দেবগড়ে চায়ের দোকানের পাশে মোষটা চোখবুঁজে জাবর কাটতে কাটতে কান মাথা নাড়িয়ে মাছি তাড়াতে গিয়ে ওর গলার ঘন্টা থেকেও অমন মিষ্টি আওয়াজ আসছিল। মগ্ন হয়ে দেখছি‌লাম ছাদের আলসে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। ক্রমশ ওরা মিলিয়ে গেল দুরে। মেঘ পর্দা সরিয়ে উঁকি মারা শীতালী সকালের নরম রোদের বালাপোষ জড়িয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে এমন সব দৃশ‍্য দেখতে থাকলে হয়তো সেই আবেশে সারারাত ঘুমিয়ে উঠেও আবার চোখ জুড়িয়ে আসতে পারে আরামে।
     

    গরুগুলো চলে যেতে চরাচর আবার ডুবে যায় নিস্তব্ধতা‌য়। জমিতে খাবারের খোঁজে চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ল‍্যাপ‌উইগ ও শালিখ। এ ছাড়া জীবনের আর কোনো অস্তিত্ব‌ সাদা চোখে ধরা পড়ে না। এমন জায়গায় ঘড়ি নিতান্তই বাহুল্য। মনে হয় অনেক তো হোলো ছোটাছুটি, ইচ্ছে করে এমন শান্ত জায়গায় শুয়ে বসে ঘুমিয়ে, ইতস্ততঃ অনির্দিষ্ট ঘুরে বেড়িয়ে, ব‌ই পড়ে, স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপ করে বা নিজের মধ‍্যে ডুব দিয়ে‌ই কদিন কাটিয়ে দি‌ই।

    চৌমুখনাথ মহাদেব মন্দির


     
    প্রাতরাশ করে চললুম লেকের পশ্চিম ধার দিয়ে উত্তর দিশায় এখানকার মুখ‍্য দর্শনীয় পূরাতাত্বিক স্থান চৌমুখনাথ মন্দির। এই মন্দির পরিসরে আছে দুটি মন্দির। একটি চৌমুখনাথ মহাদেব। শিখর সমেত উচ্চ মন্দির‌টি আকারে বড়। আমার মতো ভ্রামণিক‌দের কাছে সেটি‌ই এখানকার মুখ‍্য  আকর্ষণ। স্থানীয় এবং দূরাগত ভক্তদের কাছে মান‍্যতাপ্রাপ্ত। অন‍্যটি আকারে ছোট - পার্বতী মন্দির। চৌমুখনাথ মহাদেব মন্দির সম্পর্কে ভারতীয় পূরাতত্ব বিভাগের ফলকে বলা হয়েছে পরিচিতি নির্দেশক শিলালেখের অনুপস্থিতিতে শিল্প ও স্থাপত্যের শৈলীগত বিবেচনায় এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরবর্তী যুগে আনুমানিক সপ্তম খ্রিস্টাব্দের বলে মনে হয়।
     
       গর্ভগৃহে চারটি মুখ বিশিষ্ট একটি শিবলিঙ্গ আছে। তাই এর নাম চৌমুখনাথ মন্দির। এটি একটি বর্গাকার মন্দির। এর সামনে একটি বারান্দা রয়েছে। পুরাতাত্ত্বিক‌দের মতে পরিসরে পাওয়া মূর্তি, দ্বার ও গাত্রের স্থাপত্যের ভাস্কর্যে জটিল, নিপুণ খোদাই অনুসারে এগুলি আবার চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের গুপ্ত যুগের বৈশিষ্ট্য নির্দেশক বলেও মনে হয়। অর্থাৎ তারা এই মন্দিরে‌র বয়স সম্পর্কে নিঃসন্দেহ নন। এই মন্দিরে আচ্ছাদিত পরিক্রমা পথের উপস্থিতি মন্দিরের নির্মাণ স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বিবর্তনসূচক। এখানে পাওয়া কৃষ্ণ-লীলার দৃশ্য ছাড়াও শেষাশায়ী বিষ্ণু, বরাহ, নরসিংহ, বামন এবং ত্রিবিক্রম মূর্তি‌গুলি বৈষ্ণব ঘরাণার বিকশিত ভাস্কর্যশিল্পের নির্দেশক। 

    চৌমুখনাথ মন্দিরের গর্ভ‌গৃহের দ্বার পূব দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকেই চতূর্মুখী শিবলিঙ্গ‌র পূব দিশায় রয়েছে পার্বতীর সাথে বিয়ের আগে প্রস্তুতি‌র সাজে শিবের মুখ। জটায় চাঁদ, গঙ্গা, তৃতীয় নেত্র খোলা, মৃদু হাস‍্যময় মুখভাবে আগামী রোমান্সের খোয়াব। দক্ষিণে হলাহল পান করে গলা জ্বলে যাওয়া বিকট করাল রূপ। পশ্চিমে যোগ বা ধ‍্যানমূদ্রায় সমাহিত ভাব। উত্তরে অর্ধনারীশ্বর রূপ। দর্শকের দৃষ্টি অনুসারে নয় -  মূর্তির মুখের ডানদিকে বা পুবদিকে শিবের ভাব ও বাঁদিকে বা পশ্চিমদিকে পার্বতী‌র। চৌমুখনাথ শিবলিঙ্গ‌র চারটি মুখের ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছিলেন ওখানে উপস্থিত পুরোহিত। তবে পরে মোবাইলে তোলা অর্ধনারীশ্বর ছবিটি অনেক‌ক্ষণ দেখে‌‌ও দুটি ভাবের তফাৎ পরিস্কার বুঝতে পারি নি। ছবিটি নীচে র‌ইলো।


     
    মন্দিরের মধ‍্যে আলো কম ছিল বলে আমার মোবাইলে তোলা ছবি ভালো আসেনি। তাই নেটে পাওয়া জনৈক The Banjara Man (মন!) এর তোলা দুটি সুন্দর ছবি রাখলাম। একটি‌ই পাথর কেটে বানানো প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু লিঙ্গটির বর্গাকার বেসটির বাহু এক মিটার। ASI এর তত্ত্বাবধানে থাকলেও এটি বর্তমানে‌ও রোজ পূজিত হয়। সন্ধ্যায় পূজার পর পূজারী চলে গেলে মন্দিরে তালা দেয় ASI গার্ড। ASI এর অধীনে এমন অনেক লাইভ টেম্পল আছে যেখানে নিত‍্য পূজা হয় - হ‍্যালেবিড, বেলুর, খাজুরাহো, পাট্টাডাকাল, আইহোলে, গোপেশ্বরে গোপীনাথ মন্দির ইত‍্যাদি। কিছু মন্দির কেবল পূরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত - সেখানে নিত‍্য পূজা হয় না। যেমন দেবগড়ে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের গুপ্তকালীন দশাবতার মন্দির। ঐ মন্দির‌টি পূরাতাত্বিক প্রেক্ষাপটে অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 




    পার্বতী মন্দিরের ক্ষেত্রে‌ও পরিচিতি নির্দেশক শিলালেখের অনুপস্থিতিতে শিল্প ও স্থাপত্যের শৈলীগত বিবেচনায় এটি গুপ্তকালীন পঞ্চম শতাব্দী‌র বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরটিতে একটি বর্গাকার গর্ভগৃহ রয়েছে।  এই মন্দিরে গর্ভগৃহের উপরে একটি ছোট বর্গাকার কক্ষ রয়েছে, যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটি উত্তর ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যে পূর্ববর্তী সমতল ছাদযুক্ত মন্দির থেকে বিবর্তন সূচক। মন্দিরটির দরজা, জানালার ফ্রেম এবং ফুলদানি এবং পাতার মোটিফের সূক্ষ্ম খোদাই এবং পিলাস্টারগুলিতে অর্ধেক পদ্মের পদক দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।  লিন্টেলের অলঙ্কৃত ফুলের নকশা গুপ্তকালীন শিল্পশৈলীর অনন্য বৈশিষ্ট্য।  লিন্টেলের মাঝে রয়েছে পার্বতীর সাথে উপবিষ্ট বীণাধর শিব।  


    পার্বতী মন্দির - গর্ভগৃহের ওপরে কক্ষের অবশেষ


    পার্বতী মন্দিরের দ্বারে ভাস্কর্য - ললাটবিম্বের (Lintel) মাঝে পার্বতী‌র পাশে বীণাধর শিব

    মন্দির চত্বরে ভাঙা বিয়ের হিসেব নিকেশ

    মন্দির চত্বরে প্রত‍্যক্ষ‍্য করা একটি অভিজ্ঞতা বেশ চমকপ্রদ লাগলো। মধ‍্যপ্রদেশে কিছু ছোটোখাটো জায়গায় একটা ব‍্যাপার দেখে বেশ অবাক লেগেছে। বাড়িতে কারুর বিয়ে হলে বাইরের দেওয়ালে 'X marriage with Y’ মানে এ বাড়িতে অমুকের সাথে তমুকের বিয়ে হয়েছে এতো তারিখে - এ জাতীয় একটি ঘোষণা লেখা হয়। কখনো অশ্বপৃষ্ঠে পাত্র, পালকি‌তে পাত্রী‌, সানাই, ফুল ইত‍্যাদি সহযোগে দেয়ালে রঙিন চিত্র অঙ্কিত হয়। বাড়িতে পরবর্তীতে অন‍্য কারুর বিয়ে না হলে বা রঙ করার দরকার না পড়লে সেই চিত্রিত ঘোষণা ওভাবেই থেকে যায় অনেকদিন। 

    একবার সাতনা থেকে রেওয়া যাওয়ার পথে - মাঝে এক জায়গায় নেমে - অপ্রত্যাশিত‌ভাবে জায়গা‌টা ভালো লেগে যাওয়ায় একদিনের জন‍্য পরিকল্পনা বহির্ভূত‌ভাবে থেকে গেছিলাম। নির্দিষ্ট শিডিউল না ধরে বেড়ানোর এ‌ও এক বিশেষ আনন্দ। সেখানে স্থানীয় একজনকে অমন একটা বছর দুয়েক আগে আঁকা, একটু ফিকে হয়ে যাওয়া দেওয়াল-চিত্র দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - কোন কারণে বিয়ে ভেঙে গিয়ে মেয়েটি পিতৃগৃহে ফিরে এলে তখন কী ওগুলো মুছে দেওয়া হয়? নাহলে তো নিত‍্যদিন ওটা দেখে তার খারাপ লাগতে পারে। লোকটি‌ জানালো না তেমন কোনো প্রথা নেই। তার হাবভাব দেখে মনে হোলো, ব‍্যাপার‌টা নিয়ে কখনো সে ভেবে দেখেছে কিনা কে জানে।

    চৌমুখনাথ মন্দির চত্বরে দেখলাম ভাঙা বিয়ের বৈষয়িক হিসেব নিকেশ হচ্ছে। মানে বিয়েতে কন‍্যাপক্ষ পণ, যৌতুক হিসেবে যা দিয়েছিল - বিয়ে যখন টেকেনি - পাত্রপক্ষ সেসব ফেরৎ দেবে। দুই পক্ষের কর্তাব‍্যক্তি, কিছু নিকটাত্মীয় এসে মন্দির চত্বরে বসেছেন। চৌমুখনাথকে সাক্ষী মেনে কন‍্যাপক্ষ কাগজে তালিকা করছে বিয়েতে কী দেওয়া হয়েছিল। পাত্রপক্ষ দেখছে। বাকিরা‌ হয়তো সাক্ষী হিসেবে রয়েছে। হৈচৈ, রাগারাগি নেই। শান্তভাবে সবকিছু হচ্ছে। দুপক্ষে আলোচনা করে যা ঠিক হবে পাত্রপক্ষ একদিন কন‍্যাপক্ষের বাড়ি গিয়ে সেসব দিয়ে আসবে। পণ, অলঙ্কার এসব ফেরৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিয়ে কেন বা কার জন‍্য ভেঙেছে সেসব নিয়ে কূটকচালি হয় কিনা বোঝা গেল না। ঈশ্বর সাক্ষী করে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে বা কেবল নিজেদের মধ‍্যে আস্থা নির্ভর গন্ধর্ব‌বিবাহর কথা জানা ছিল। ঈশ্বর সাক্ষী করে ভাঙা বিয়ের বৈষয়িক হিসেবনিকেশ সেই প্রথম দেখলাম।
     

    বাঁধ ধরে ফিরলুম পণ্ডিত‌জীর সাথে


     
    রয়ে সয়ে চৌমুখনাথ মন্দির দেখে লেকের পূব দিকের বাঁধের মেঠো পথ ধরে ফিরছিলুম ধর্মশালার দিকে। সে পথে দেখা হোলো টাঙি কাঁধে পণ্ডিত রামসহায় শর্মার সাথে। রোদে পোড়া তামাটে মুখ। কিন্তু বোঝা যায় যৌবনে খুব সুপুরুষ ছিলেন। বলিও সেকথা। শুনে সে কী লাজুক হাসি পণ্ডিত‌জীর। আশকথা পাশকথা গল্প করতে করতে যাই ওনার সাথে। একাকী ভ্রমণে এমন সব স্থানীয় মানুষের সাথে সাধারণ গল্প করে‌ও সমাজ মাধ‍্যমে‌ নানা চালক চালাক চাপান‌উতোর দেখে দেখে ক্লান্ত মনে শান্তির মলম লাগে। ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, হলুদ ফুল ফোটা ক্ষেতিগুলো অড়হড় ডালের‍। এদিকে ভালো হয় ঐ চাষ। 



     
    বাঁধের পাশে বুনো ঝোপে দুটি বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে দেখলাম। একটি  অসম্পূর্ণ। অন‍্যটি মনে হোলো তৈরী হয়ে গেছে। ছবি তুলতে একটু কাছে যেতে একটি বাবুই পাখি বাসা থেকে বেরিয়ে ফুরুৎ করে উড়ে গেল। পাখির বাসা দেখে শহুরে মানুষের আহ্লাদ দেখে পণ্ডিত‌জী আমোদ পান। দাঁড়িয়ে পড়েন। বলি, আচ্ছা, পণ্ডিত‌জী, অমন একটা বাসা বানাতে আন্দাজ কতোদিন লাগে? উনি বলেন হপ্তা তিনেকের মধ‍্যে বানিয়ে ফেলে ওরা। অবাক লাগে। কেবল ঠোঁট দিয়ে, ঝুলে ঝুলে, এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে বানায় ওরা এমন সুন্দর আকারের ঘর?
     

    আহা ঐ আঁকা বাঁকা যে পথ যায় সুদূরে


       
    যেদিকে সকালে গরুগুলো যাচ্ছিল, বিকেলে জৈনতীর্থ পরিসর থেকে সেই পূবদিকে উঁচুনিচু মেঠো পথে একটু পায়চারি করতে গেলাম। দুরে হালকা টিলার ওপরে ছোট্ট সাদা মতো কিছু (লাল তীর) একটা দেখা যাচ্ছে। টানছে ওটাই। তবু পথটা‌ও বেশ সুন্দর। ওটা দেখে সলিদার সুরে, শ‍্যামলদার কণ্ঠে একটা প্রিয় গান মনে পড়ে গেল। 


     
    টিলার ওপরে সেই সাদাটে বস্তু‌টি ছোট ইটের গাঁথুনি‌র  পিরামিডের মতো কিছু একটা। হয়তো কোনো থান হবে। সামনে জমি ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তার পর বিস্তৃত এলাকায় অড়হড় ডালের চাষ হয়েছে। হলুদ ফুল ফুটে আছে। বৈশাখের শুরুতে দানা পাকলে কাটা হবে। জমিতে প্লাস্টিকের ছোট ছোট ছাউনি। পাশের জঙ্গল থেকে নীলগাই এসে ফসল খেয়ে নেয়। ওগুলো তাই রাত পাহারার সাময়িক আস্তানা। আসন্ন সন্ধ‍্যার প্রাক্কালে কেউ কাঠের আগুন জ্বেলেছে। আকাশে পাকিয়ে উঠছে সাদা ধোঁয়া। কুয়াশা‌য় দুরের পাহাড়ের রেখা অস্পষ্ট। মেঠো পথ ধরে জঙ্গল থেকে কেটে আনা কাঠকুটোর বোঁচকা মাথায় আসছে তিনজন। দুটো বালক সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে চড়াই ধরে উঠে গড়গড়িয়ে উৎরাই বেয়ে হাফ প‍্যাডেলে নামছে। কলকল করে হাসতে হাসতে ক্রমশ দুরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা সুন্দর, শান্ত ছবি। একটা পাথরে বসে অনেকক্ষণ তাই তাকিয়ে ছিলাম পূব দিশায় এইসব মনোরম দৃশ‍্যাবলীর দিকে।

    মনে পড়লো কেভিনের ছবি

    মনে হোলো সূর্যাস্তের সময় হয়ে এলো। তাই তাকালাম পশ্চিম দিকে। আর তখনই চোখে পড়লো কিছুটা দুরে মাটিতে শুয়ে আছে একটি গরু। একটি কুকুর পিছনে এসে জমি শুঁকছে। 



    বুকটা ছ‍্যাঁৎ করে ওঠে। আহা রে - মরে গেছে নাকি! তার শুয়ে থাকার ভঙ্গি - পিছনে ঘুরঘুর করা কুকুর‌ দেখে আচমকা মনে পড়ে যায় সুদানের দুর্ভিক্ষের ওপর তোলা, দক্ষিণ আফ্রিকার ফটো-জার্নালিস্ট কেভিনের ছবিটির কথা - The Struggling Girl. ছবিটি ১৯৯৪ সালের মার্চে পুলিৎজার পুরস্কার‌ পেয়েছি‌ল।  কেভিনের জন্ম আমার দশদিন আগে কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে সে স্বেচ্ছায় চলে গেছে এই ধরাধাম ছেড়ে। পুরস্কৃত হ‌ওয়া‌র চারমাস পরে‌ই সে আত্মহত্যা করে। ব‍্যক্তিগত দারিদ্র্য‌র সাথে সুদানের মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ প্রত‍্যক্ষ‍্য করার মর্মপীড়া হয়তো তাকে ঠেলে দিয়েছিল জীবনের কিনারায়। ছবিটি দেখলে‌ আমার একটা‌ই ক‍্যাপশন মাথায় আসে - The waiting vulture. তবে কেভিনের ছবিটি‌র মতো ধৈর্য্য‌সহকারে অপেক্ষা‌রত মরা মাসখেকো হুডেড ভালচার নয় -  সমাজে চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে নানা পোষাক পরা শকুন, তাদের তীক্ষ্ম নির্মম ঠোঁটে বহুকিছু ছিঁড়ে খেতে - জীবিকা - জীবন - সম্মান। তাদের কেউ কেউ দৃশ‍্য - অনেকে‌ই অদৃশ্য …


     
    দুরে থাকায় এতক্ষণ চোখে পড়েনি। টিলা থেকে নেমে কাছে গেলাম। গরু নয়, শীর্ণকায় এক বলদ। ট্র্যাক্টর দিয়ে জমি চষায় অভ‍্যস্থ হয়ে এখন অনেকেই আর বলদ দিয়ে জমিতে হাল দেয় না। তাছাড়া এটি এক তরুণ, কৃশকায় বলদ। হাল টানার মতো শক্তপোক্ত‌ নয়। অর্থাৎ এ কোনো কাজের‌ই নয়। তাই হয়তো এর মালিক জন্মের পরেই ওকে খেদিয়ে দিয়েছে। গৃহস্থের গোয়ালে এখন ওর জায়গা নেই। সেখানে এখন আছে দুধেল গরু। ইঞ্জেকশন দেওয়া সত্ত্বেও যেদিন সে পাকাপাকি দুধ দেওয়া বন্ধ করবে, সেদিন সেও গোয়ালচ‍্যূত হবে। ভাগ‍্য ভালো হলে বৃন্দাবনের বিধবার মতো হয়তো তার জায়গা হতে পারে কোনো গোশালায়। নচেৎ সে‌ও এর মতো অপ্রয়োজনীয় বেওয়ারিশ হয়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াবে।


     
    কাছে গিয়ে দেখি তার আকাশমুখো চোখটা মরা মাছের মতো মৃত্যুশীতল - কালচে নীল - অপলক। মুখের অন‍্যপাশটা মাটিতে লেপটে আছে। মুখটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। নীচের পাটির দাঁতের সারির হালকা আভাস চোখে পড়ে। মুখে লেগে আছে রক্ত - মাটিতে‌ও কয়েক জায়গায় রক্তের ছোপ। হয়তো সে একটু আগে মারা গেছে। কারণ তখনো তার মুখে চোখে এসে বসেনি অবহেলিত মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ - ভনভনে মাছি।
    মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল তার করুণ ভাবে মাটিতে পড়ে থাকার ভঙ্গি‌মা দেখে। হঠাৎ তার খোলা চোখে একবার পলক পড়লো। চোখের মণিটা উল্টে গেল। চোখের কালো অংশটা নীচের দিকে নেমে গিয়ে উপরের সাদা অংশটা রক্তাভ শিরাগুলো সমেত প্রকট হয়ে গেল।
       
    আকাশে মেঘলা মরা বিকেলের ঘোলাটে আলো - সামনে পাহাড় - আর তার পাদদেশে অসহায় ভাবে মরে পড়ে আছে একটি শীর্ণকায় বেওয়ারিশ বলদ - এমনটাই ভেবেছিলাম আমি। হঠাৎ তার চোখের পলক পড়তে মনে হোলো তাহলে কী সে এখনও বেঁচে আছে? শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চোখের পাতা ফেলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে? ঝুঁকে পড়ি তার মুখের কাছে। প্রাণের রেশ অবশিষ্ট আছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করি। 
      
    হঠাৎ সে ধরফর করে চার পা নাড়িয়ে আপ্রাণ চেষ্টায় মাটি থেকে মাথাটা তুলে উঠে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু পারে না। মাথাটা আবার ঘুরে গিয়ে ধপাস করে ঠুকে যায় শক্ত মাটি‌তে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। একটি অবলা প্রাণী - যাকে দেখে মনে হয়েছিল শান্ত‌ নীরবতায় মেনে নিয়েছে অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু‌‌ - হঠাৎ তার প্রবল জিজীবিষার প্রকাশে বেশ চমকে উঠি। রাস্তা ঘাটে মরে পড়ে থাকা কুকুর, বেড়াল অনেক দেখেছি। যে জীবনের প্রকাশ যত ক্ষুদ্র, তার মৃত্যুর অভিঘাত তত অকিঞ্চিৎকর। তাই জুতোর তলায় কেন্নো চাপা পড়লে এতোটা খারাপ লাগে না। কিন্তু চোখের সামনে বড় একটা প্রাণী এভাবে ছটফট করে মারা যাচ্ছে দেখে খুব বিহ্বল, অসহায় লাগে নিজেকে।  
     

    আমায় বলদটার কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখতে স্থানীয় কয়েকটি কিশোর এগিয়ে আসে। শহুরে চোখে গ্ৰাম‍্য জীবনের সাধারণ দৃশ‍্য বা ঘটনা‌‌ও রোমান্টিক সুন্দর বা মর্মস্পর্শী করুণ মনে হয়। ওরা নিত‍্য এসব দেখে অভ‍্যস্থ। দলে সকালে চায়ের দোকানে‌ আলাপ হ‌ওয়া অশোক‌ও ছিল। ওর কাছেই গত সন্ধ্যায় অটোচালক জয়রাম আমার জন‍্য কেনা ম‍্যাগী, মটর, গাজর রেখে গেছি‌ল।  মনে হোলো সেই ঐ দলের পান্ডা। অশোক নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে, হয়তো গেছিল কোনো ক্ষেতে ফসল খেতে, চাষী ঠেঙিয়েছে খুবসে। বা টাঙি দিয়ে মেরেছে। দেখছেন না পিঠের ওদিকে ক্ষতচিহ্ন। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছে মানে এ আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। 
     
    তাহলে আর কী আর করা যাবে। ওর মুখের আশপাশে জমি থেকে পাথরের টুকরোগুলো তুলে সরিয়ে দি‌ই। মরার আগে আরো কতবার যে মুখ তুলে উঠতে গিয়ে ওর মাথা ওভাবে ঠকাস ঠকাস করে মাটিতে পড়বে তার ঠিক নেই। তাই ওর চলে যাওয়ার সময় যন্ত্রণা কিছুটা অন্তত কম করে দিই।   ন‍্যাপস‍্যাক থেকে জলের বোতল নিয়ে ওর মুখের কাছে এগিয়ে যাই। অশোক বলে, ও কী ওভাবে জল খেতে পারবে? তবু দিই। হলেই বা প্রাণী, মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে একটু জল দেওয়া আমাদের বহুদিনের সংস্কারের শিকড়ে রয়ে গেছে। 
     

    কতক্ষণ ওভাবে ওখানে পড়ে আছে কে জানে। হয়তো গলা শুকিয়ে গেছিল। বোতল থেকে মুখে সাবধানে জল দিতে সে জিভ বার করে চাটলো। ঢোঁক গেলার আভাস পাওয়া গেল গলায়। চোখ পিটপিট করলো কয়েকবার। বার দুয়েক হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো। তবে প্রতি‌বার‌ই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আসন্ন রাতের কঠিন ঠান্ডায় খোলা মাঠে বেহাল শরীরে এভাবে পড়ে থাকলে হয়তো আজ রাতেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আর দেখতে পারলাম না। আকাশে‌র দিকে তাকিয়ে জোড়হাত করে কাকে প্রণাম করলাম জানি না। তারপর ওকে ওর ভবিতব‍্যের হাতে সঁপে দিয়ে ভারী মনে হাঁটা দিলাম লেকের দিকে। মেঘলা পশ্চিমাকাশে সূর্য তখন অস্তাচলে।
     

     

    হয়তো সে বেঁচে গেল এযাত্রা

    এক বয়স্ক মানুষের এহেন কাতর ভাবালুতা দেখে অশোক আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। আধঘন্টা বাদে ধর্মশালার ঘরে এসে বসেছি। মনশ্চক্ষে তখনও ভাসছে বলদটার সেই মৃত্যুশীতল নীলচে চোখ, বারংবার উঠে দাঁড়ানোর করুণ প্রচেষ্টা। এমন সময় বাইরে কিছু সম্মিলিত গলার আওয়াজ পেলাম। কারা যেন মেন গেটের বাইরে থেকে বাবুজী, বাবুজী করে ডাকছে। এই গুরুকৃপা ধর্মশালায় বা দূরে পশ্চিমের ঘরগুলোতে‌ও কেউ নেই। শৈলেশের ঘর প্রায় দুশো মিটার দুরে। রাতে চৌকিদার সুরেশ‌ও থাকে না‌। তার ডিউটি কেবল দিনে। গুরুকৃপা ধর্মশালার পরেই দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, চাষজমি। এতো ফাঁকা, নির্জন জায়গায় রাতের বেলায় একা থাকতে একটু গা ছমছম করে। তাই লোহার ভারী সদর দরজায় ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে রেখেছি‌লাম।
     

    কথাবার্তা‌র আওয়াজ পেয়ে বাইরের আলো জ্বালিয়ে উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলি। একটু আগে মাঠে দেখা ছেলেগুলি। সবার আগে অশোক। ওর মুখচোখ জ্বলজ্বল করছে। কী হয়েছে অশোক? জিজ্ঞাসা করি আমি। ওরা একসঙ্গে হড়বড় করে বলে, বাবুজী আপনি চলে যাওয়ার পর আমরা সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে তুলে খাড়া করে দিয়েছি। তারপর? প্রায় রুদ্ধশ্বাসে বলে ফেলি। অশোক বলে, খানিক লড়খড়িয়ে ও আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেছে গ্ৰামের দিকে। 
     

    ওদের কথা শুনে আমার আনন্দে চোখে জল এসে যায়।  হয়তো এযাত্রা বেচারা বেঁচে যাবে। ভ্রমণপথে রাস্তাঘাটে আলাপ হ‌লে শিশুদের দেওয়ার জন‍্য আমার কাছে সর্বদা কিছু চকলেট থাকে। গতকাল পান্না থেকে কেনা এক প‍্যাকেট টফি ছিল। ওদের আটজনের হাতে দুটো করে দিই। সবার মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বলি, তোমরা আজ খুব পূণ‍্যের কাজ করলে। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। এবারেও ওরা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। বিশেষ করে অশোক। হয়তো পূর্বপরিচিত বলে। সকালে‌ও ওর সাথে চায়ের দোকানে আলাপকালে মনে হয়েছিল শান্ত, মিতবাক অশোকের দৃষ্টি বেশ মর্মভেদী। যেন ভেতর অবধি পড়ে নিচ্ছে। আমায় সংবাদ দিয়ে ওরা নিজেদের মধ‍্যে কথা বলতে বলতে চলে যায় গ্ৰামের দিকে। চরাচরে তখন সূর্যাস্তের পর ঘন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তবে দিনান্তে‌র সেই ভার নেমে গিয়ে  মনটা তখন ভোরের মতো হালকা লাগছে। 


    চায়ের দোকানী তরুণ অশোক - হয়তো সে এযাত্রা বেঁচে যাবে ওদের কৃপায়

    (চলবে)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৬ মার্চ ২০২৪ | ৯২৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    লোকটা - Kunal Basu
    আরও পড়ুন
    কবিতা  - S Azad
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ২৬ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৬529813
  • গরুটা বেঁচে ফেরার কথা লেখায় পড়ে আমি যতটা স্বস্তি পেলাম, আমি ভাবছি আপনার ওই দিন রাতে কতটা আনন্দ হয়েছিল বাচ্চাদের কাছে ওই খবর শুনে। দারুন পর্ব। পরে আরেকবার আরো খুঁটিয়ে পড়ব।
  • প্রতিভা | 202.88.***.*** | ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৩:১৮529818
  • আপনার বেড়াবার এবং বলার ধরন খুব পছন্দ হল।
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b102:14fa:47bd:48a3:5485:***:*** | ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৫:৩৬529825
  • চৌমুখনাথের মুখগুলির নাম এখানে পাবেন। আমার জ্ঞানবুদ্ধিমতে ঠিকঠাক লেখা।
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৭:০১529827
  • @পলিটিশিয়ান 

    আপনি যে WiKi লিংকটি রেখেছেন, মনে হয় ওটা একটা Generalised article. তবে আমার মনে হয়েছে চতুর্মুখী বা পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ একটি GENERALISED  ASPECT নয়। কিছু কমন ফ‍্যাক্টর থাকলেও বিভিন্ন এলাকায় প্রাচীন শিল্পী‌রা তাঁদের মনের মাধূরী থেকে নানাভাবে এটি ভেবেছেন। 

    যেমন ধরুন ঐ WiKi entry তে বলছে যেখানে গর্ভগৃহের একটি‌ই দ্বার থাকবে সেখানে মুখলিঙ্গতে একটি‌ই মুখ/রুপ থাকবে। নাচনায় গর্ভগৃহে‌ও একটি দ্বার আছে কিন্তু সেখানে রয়েছে চতুর্মুখী মুখলিঙ্গ।

    আবার বিহারের বৈশালীতে যে চতুর্মুখী শিবলিঙ্গ আছে তাতে চারটি রূপ হচ্ছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং সূর্য।

    নাচনায় চারটি মুখ‌ই কিন্তু শিবের বিভিন্ন অবস্থার - যেমন আমি পূজারী‌র থেকে জেনে লিখেছি। তাতে কোনো ভুল নেই। আমি কেবল বলতে চেয়েছি ওখানে অর্ধনারীশ্বর মুখভাবটি খুঁটিয়ে দেখেও নর ও নারী ভাবের তফাৎ করতে পারিনি। তবে কেবল মুখ নয়, কানের দুল, শিরে কেশবিন‍্যাস এসবের মধ‍্যে‌ও শিব ও পার্বতী ভাবের সূত্র লুকিয়ে আছে যা আমার স্থুলদৃষ্টি‌তে ধরা পড়েনি। 
     
    পূর্ণাঙ্গ অর্ধনারীশ্বর মূর্তি‌ও কয়েক জায়গায় দেখেছি - সেখানে কিন্তু এমন ধন্দ হয়নি কারণ সেখানে মূর্তির যেদিকটি নারী রূপ সেদিকে পরিপূর্ণ স্তন ছিল। আমার গোদা নজরে নর ও নারীর তফাৎ বোঝার জন‍্য ঐটি‌ই মোক্ষম সূত্র। 

    এ প্রসঙ্গে তিনটি তথ‍্যসূত্র রাখছি। 







    এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তির ছবিটি তুলেছি মধ‍্যপ্রদেশের ধার কেল্লার মধ‍্যে স্থিত সংগ্ৰহশালায়। এখানে মূর্তির দক্ষিণ অংশে  পূর্ণবিল্বসদৃশ পয়োধর দেখলে ধন্দের কোনো অবকাশ থাকেনা।
  • kk | 2607:fb91:87a:43fe:884d:6a78:c8db:***:*** | ২৬ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৬529837
  • গরুর গল্পটা খুবই করুণ। পড়তে পড়তে খুবই মনখারাপ লাগছিলো।সম্ভাব্য শেষটা ভাগ্যিস এই রকম। বাকি কাহিনী যথারীতি উপভোগ করলাম। পার্বতী মন্দিরের দরজার ভাস্কর্য অতি সুন্দর লাগলো। অর্ধনারীশ্বর ছবিতে খুব স্পষ্ট করে না বুঝলেও দেখুন আপনি যেমন বলেছেন শিরে কেশবিন্যাসে তফাৎ আছে সেটা তো আমি বুঝতে পারছি। শিবের চুলের বাঁ দিকে ঐ তরঙ্গ, এটা কি জটা আর গঙ্গা বোঝাচ্ছেনা? অন্যদিকে পার্বতীর চুল থাক থাক হয়ে রয়েছে। ছোট ছোট স্ট্রোক। তাপসী নারীদের চুড়ো করে বাঁধা চুল। নয় কি? বাঞ্জারা ম্যানের তোলা ছবি দেখে মূর্তির এক্সপ্রেশন আমার ভালো লাগলো। বেশির ভাগ মূর্তিতে যেমন একটা আধবোজা চোখ, অস্পষ্ট হাসি, এসব দিয়ে বোঝানো দৈবী ভাব থাকে এখানে তা নয়। এখানে এক্সপ্রেশনগুলো অনেক বেশি মানুষী লাগলো।
  • Arindam Basu | ২৬ মার্চ ২০২৪ ২৩:২৬529847
  • আপনার লেখা গরুর কাহিনি দারুণ মর্মস্পরশী! 
  • রঞ্জন | 171.6.***.*** | ২৭ মার্চ ২০২৪ ০৫:৪১529853
  • আপনার সোনার কলম হোক!
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৭ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩১529861
  • @ রমিত চট্টোপাধ্যায়/ পলিটিশিয়ান/ প্রতিভা/ কেকে/ অরিন্দম বসু/ রঞ্জন রায় :
     
    আমার লেখ‍্যভঙ্গি সোজাসাপ্টা - তাতে আঙ্গিক, শৈলী‌র নৈপুণ্য প্রদর্শনের তাগিদে‌র থেকেও প্রাধান‍্য পায় নানা অভিজ্ঞতার অভিঘাত, অনুভূতি আন্তরিক‌ভাবে বিশদে প্রকাশের তাগিদ। তাই আমার অধিকাংশ লেখা‌র বা কিছু মন্তব্যের আকার‌ও বড় হয়ে যায়। যেমন এটা।

    ইংগিতময়তা, রূপক, চর্চিত অস্পষ্টতা‌র মাধ‍্যমে কাব‍্যের মতো গদ‍্য লেখা - বিন্দুতে সিন্ধু প্রকাশের কলা - অথবা উবের স্মার্ট উপস্থাপনা - এসব আমার আসেনা। আমার প্রকাশভঙ্গি সাদা-মেঠো। তাই হয়তো মুষ্টিমেয় কারুর তা ভালো লাগলেও অনেকে‌র পাতি লাগতে পারে। আবেগের আতিশয‍্য বলে‌ও মনে হতে পারে। তাতে আমার কিছু করার নেই। 

    ওর মুখে একটু জল দেওয়া ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারিনি। তবে সেদিন আসন্ন সন্ধ্যায় ঐ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, একটি মৃতপ্রায় অবলা প্রাণী‌কে বাঁচাতে না পারার অসহায়‌তায় বুকের কাছে হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে প্রার্থনা করেছি‌লাম। কে বলে প্রার্থনা‌য় কাজ হয় না? সেদিন তো হাতেনাতে হয়েছিল। পরোক্ষভাবে হলেও। আমার ভাবাবেগে প্রভাবিত হয়েই তো ঐ ছেলেগুলি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঐ ভারী পশুটি‌কে সবাই মিলে ঠেলেঠুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আমার একার পক্ষে তো সম্ভব ছিল না। তাই সে সেযাত্রা বেঁচে গেছে। না হলে ওরা তো ওসব দেখে অভ‍্যস্থ, ওদিকে নাও আসতে পারতো।

    একটা কথা এ প্রসঙ্গে লিখতে ভুলেছি। অশোক বলেছিল, হয়তো ওকে কেউ হালকা বিষ খাইয়েও দিতে পারে, তাই মুখে রক্ত উঠে এসেছি‌ল। শুধুমাত্র ক্ষেতে ফসল খেতে গিয়ে চাষী‌র লাঠি‌র বা টাঙির ঘা খেয়ে মরে যাওয়ার মতো ক্ষীণ প্রাণ ওর নয়। 

    এ লেখা‌র প্রথম পর্বে যেমন শৈলেশের পত্নীর  অস্বাভাবিক‌তা, এই পর্বে তেমনি চৌমুখনাথ‌কে সাক্ষী রেখে ভাঙা বিয়ের হিসেব-নিকেশ এবং ঐ মৃতপ্রায় প্রাণীটির ভাগ‍্যক্রমে বেঁচে যাওয়া - এ দুটি‌‌ই ছিল আমার কাছে মুখ‍্য মানবিক অনুষঙ্গ। তাই ঐ গরুপর্ব বিশদে এসেছে। তাই হয়তো তা কয়েকজন‌কে নাড়া দিয়েছে।
     
    আমাকেও গভীর‌ভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই ওরা এসে বলায় আনন্দে চোখে জল এসে গেছি‌ল। বুড়ো বয়সেও কখনো আবেগে বাকরূদ্ধ হয়ে যাওয়া বা চোখে জল এসে যাওয়া‌য় আমার কোনো লজ্জা নেই। A man never cry ধরনের মাচো ইমেজ‌ ক‍্যারি করার কোনো দায়‌ আমার নেই। বরং মনে হয় এখনো কিছু সংবেদনশীল‌তা বেঁচে আছে বলে, এখনো আমার জ্ঞান, বুদ্ধি, তার্কিক প্রবণতা আমার মানবিক বোধকে দাবিয়ে ছাপিয়ে যায়নি বলে - নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়। 

    তাই তেমন কিছু বিশেষ অনুভব লিখতে এবং শেয়ার করতে সংকোচ হয় না। লেখা তো কেবল পাঠককে আনন্দদানের জন‍্য নয়। তাই তো বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হীরেন সিংহরায়ের “দুরে কোথায়” বা রঞ্জন রায়ের “হারানো কলকাতার গল্প” লেখার কিছু অংশ পড়ে মন ভারী হয়ে গেছিল। সেটাও পাওনা। 
     
     Life is not an episode of eternal spring. না, এটা বিখ্যাত কারুর বাণী কোট করলাম না, আমার নিজস্ব অনুভব।  

    আবেগতাড়িত হয়ে অনেককিছু লিখে ফেললাম। সবাই‌কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
        

     
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৯:১৪529936
  • @kk

    আপনার “ব্ল‍্যাক‌আউট ডাইনিং” লেখা বা অন‍্যের লেখার, ছবির, কার্টুনের ওপর মন্তব্য থেকে মনে হয়েছে আপনার মধ‍্যে প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিতে খুঁটিয়ে দেখার, অনুভব করার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে যেটা হয়তো চেষ্টা‌কৃত নয়। এই লেখা‌র প্রেক্ষিতে‌ চৌমুখনাথ লিঙ্গের মুখভাব প্রসঙ্গে মন্তব্যে‌ও তা মনে হয়েছে।
     
    চৌমুখনাথের চারটি ভাবের মধ‍্যে বিয়ের আগে আনন্দ‌ময় ভাব ও হলাহল পান করে করাল, রুদ্ররূপ নিয়ে কোনো ধন্দ নেই। তবে অর্ধনারীশ্বর মুখ ও ধ‍্যানমগ্ন মুখের ভাবের মধ‍্যে বিশেষ তফাৎ নেই। অর্ধনারীশ্বর মুখে‌ শিব ও পার্বতীকে আলাদা করার সূত্র রয়েছে শিরোভাগের আইকোনোগ্ৰাফিতে - সে‌টা আমার‌ও মনে হয়েছিল - তবে আপনি যেমন খুঁটিয়ে উল্লেখ করেছেন - আমি তা পারিনি। ধন‍্যবাদ।

    নেটে চোল রাজত্ব‌কালের একটি অর্ধনারীশ্বর মূর্তি পেলাম যেটি চেন্নাই মিউজিয়ামে আছে। এখানে তফাৎ সুস্পষ্ট এবং তা কেবল পীন পয়োধরে‌ই সীমিত নয়। এখানে শিল্পী আরো অনেক স্পষ্ট সূত্র রেখেছেন, যেমন:

    ১. শিবের পদ কটিবন্ধের পর নগ্ন, পার্বতী‌র অনেকটা আচ্ছাদিত
    ২. শিবের উরুতে কোনো আইকোনোগ্ৰাফিক চিহ্ন রয়েছে, সেটা আমি জানি না।
    ৩. কটিদেশে নীবিবন্ধের প্রান্তটি পার্বতী‌র দিকে অনেকটা ঝুলে আছে।
    ৪. নাভির ওপরে বিছেহারের মতো যেটা রয়েছে তাতে পার্বতী‌র দিকে বেশী অলঙ্কৃত।
    ৫. কবজিতে শিবের একটি‌মাত্র বালা, পার্বতী‌র কয়েক থাক চুড়ি।
    ৬. বাজুবন্ধের অলঙ্করণেও তফাৎ রয়েছে। পার্বতী‌র বাজুতে শঙ্খের ডিজাইন মনে হচ্ছে, শিবের বাজুতে তা অন‍্যরকম।
    ৭.গলায় হার দুদিকে এক‌ই রকম মনে হলে‌ও একটি হার পার্বতী‌র স্তনের পর নীচের অংশে উপবীতের মতো শিবের কোমর অবধি নেমে এসেছে।
    ৮. পার্বতী‌র কানে একটি গোল দুল কিন্তু শিবের কোনো কর্ণালঙ্কার নেই।
    ৯. শিরোধানের শীর্ষে পার্বতী‌র ক্ষেত্রে খোঁপার মতো চুড়ো কিন্তু শিবের দিকে গঙ্গা‌ধরের আভাস।

    হয়তো আপনার নজরে আরো কিছু ধরা পড়তে পারে। 
    এখানে আমার যেটা ধন্দ রয়ে গেল:

    ১. শিবের দুটো হাত কিন্তু পার্বতী‌র একটা‌ই মনে হচ্ছে।
    ২. শিবের দ্বিতীয় হাতে একতারা‌র মতো কিছু রয়েছে, 
     
    সাধারণত শিবের হাতে ত্রিশূল ও ডমরু দেখেছি।
     
    এছাড়া এই মূর্তি‌টি দেখে আর একটা বিষয়‌ও তারিফ করতে হয় -  শিল্পী‌র সামঞ্জস্য‌বোধ ও পরিমিতি বোধ। তাই পার্বতী‌র স্তন‌ বাস্তবানুগ। খাজুরাহো বা আরো অনেক জায়গায় দেখেছি শিল্পী মনের মাধূরী মিশিয়ে  সুরসন্দরী, অপ্সরা থেকে উমা বা পার্বতী‌র স্তন‌ও রেখেছেন অস্বাভাবিক আকারের। 
     
    তেমন একটি নমুনা - একাদশ শতাব্দীর উমা - মহেশ্বর মূর্তির ছবিও রাখলাম। এটা দেখেছি উজ্জয়িনীতে নবনির্মিত মহাকাল করিডরে ত্রিবেণী মিউজিয়ামে। ওখানে অর্ধদিবস কাটিয়েছি‌লাম। প্রসঙ্গত বলি উজ্জয়িনীর মহাকাল করিডর আমার বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ করিডরের থেকে অনেক বেশী ভালো লেগেছে। ওখানে আমি প্রায় দুটো দিন কাটিয়ে‌ছিলাম



     
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৯:২৬529937
  • পুনশ্চঃ - উমা-মহেশ্বরের ভাস্কর্যে‌ও পার্বতী‌র দুটি হাত কিন্তু শিবের চারটি হাত দেখা যাচ্ছে। শিবের বাঁদিকে‌র একটি হাত উমার স্তন ধারণ করে আছে, অন‍্য হাতে সর্প। ডানদিকে‌র একটি হাতে ত্রিশূল অন‍্যটি হাঁটুর কাছে মনে হয় রয়েছে বরাভয় মূদ্রায়।

    প্রাচীন মন্দির স্থাপত‍্যে, মূর্তি‌তে নানা আইকোনোগ্ৰাফিক চিহ্ন সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে পুরাতাত্বিক জায়গা‌য় গেলে সেসবের অর্থ উদ্ধারের ঘোরে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে যেতে পারে। তবে সেসব উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষক‌দের পক্ষেই সম্ভব
  • kk | 2607:fb91:89c:cac0:f81e:3179:9020:***:*** | ২৯ মার্চ ২০২৪ ২০:৫১529957
  • সমরেশবাবু,
    চোল বংশের এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তির ক্ষেত্রে আপনি যেভাবে পয়েন্ট করে লিখেছেন তা পড়ে বুঝতে পারছি আপনিও খুবই খুঁটিয়ে, ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন। সেটা পড়ার পরে আর ছবিটা দেখার পরে আমার দু একটা কথা মনে হলো, তা লিখি। দু নম্বর পয়েন্টে, আপনি লিখেছেন শিবের উরুতে কিছু চিহ্ন আছে। আমার ধারণা এই দাগগুলো ওঁর পরণে বাঘছাল বোঝাচ্ছে। দেখুন দাগগুলো সরাসরি উরুতে নয়, পরিধেয়র ওপরে আঁকা, নয় কি? পরের যে দুটো জিনিষ নিয়ে আপনার একটু ধন্ধ থেকে গেছে লিখেছেন সেই নিয়ে আমার দুটো কথা মনে হয়েছে। ১) পুরাণে তো শিবের চারটে হাতের কথা আছে। কাজেই তাঁর অর্ধেক অংশে দুটো হাত দেখানো হয়েছে। পার্বতীর ক্ষেত্রে আমি আগে কোনো কোনো ছবি বা মূর্তিতে চারটে হাত দেখেছি, কোথাও কোথাও আবার দুটো হাতও দেখেছি। সম্ভবত এই শিল্পী পার্বতীর দুই হাত ধরে নিয়েই কাজ করেছেন। ফলে ওঁর অর্ধাংশে একটাই হাত দেখিয়েছেন। ২) শিবের হাতে যে জিনিষটা আপনার একতারার মত কিছু মনে হয়েছে সেটা আমার ধারণা কোনো অস্ত্র। খুব সম্ভব ওঁর সেই কুঠার (পরশু)। চোল বংশেরই একটা অর্ধনারীশ্বর মূর্তির ভার্শন আগে অন্য কোথাও দেখেছিলাম। তাতে কুঠার দেখেছিলাম বলেই মনে হচ্ছে।
    শিব পার্বতীর অন্য যে মূর্তির কথা আপনি লিখেছেন তা আমি দেখিনি। তবে এই দুজনের একটা বিখ্যাত মূর্তি আমার খুবই পছন্দের। সেটা হলো ইলোরায় শিব আর পার্বতীর বিয়ের দৃশ্য। ঐ মূর্তিতে দুজনের এক্সপ্রেশন এত সুক্ষ্ম ডিটেইলস দিয়ে দেখানো আছে বলে খুব ভালো লাগে দেখতে।

    আপনার লেখার কল্যাণে এই বিষয় নিয়ে খানিক আলোচনা হলো, সেটা খুব উপভোগ করলাম। তবে,আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় মূর্তি দেখতে গেলে সামনে থেকে নিজের চোখে না দেখলে ঠিক 'দেখা' হয়না। ভাস্কর্য্য একটা থ্রী-ডাইমেনশনাল আর্ট। চারপাশ ঘুরে বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে না দেখলে পুরোটা বুঝে ওঠা যায়না বলে আমার মনে হয়। ছবির (পেইন্টিং বা স্কেচ) ক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা ব্যাপার। টু-ডাইমেনশন্যাল বলেই নেট থেকে দেখলেও খুব অসুবিধা হয়না।
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b102:14fa:d6e9:1281:6144:***:*** | ৩১ মার্চ ২০২৪ ০৭:০৪530034
  • পরের কিস্তি আসুক।
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৭530204
  • @kk - ২৯.৩/২০.৫১

    আর একবার টের পেলাম আপনার পর্যবেক্ষণের ধার। ঠিক বলেছেন, শিবুদার পা কটিদেশ থেকে নগ্ন নয়, হাঁটুর ওপর আন্ডারপ‍্যান্টের মতো লুজ ফিটিং কিছু একটা পরে আছেন তিনি। সেটা বাঘছাল হ‌ওয়াই সম্ভব।
    অর্ধনারীশ্বর হলে শিব এবং পার্বতীর শরীরের অংশ ৫০:৫০ অনুপাতে থাকার যুক্তিতে চতুর্ভূজ শিবের দুটি হাত ভালো যুক্তি। তবে পাবুদির দুহাত ওয়ালা মূর্তি এযাবৎ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। মিনিমাম চার হাত আর মহিষাসুর বধ মোডে থাকলে চার অথবা অষ্টাদশ হাত দেখেছি‌। তবে আপনি বলেছে‌ন, এক্ষেত্রে হয়তো শিল্পী ফুল পার্বতী‌র দুটি হাত ভেবেই ডিভাইডেড বাই টু করেছেন। 

    পৌরাণিক ব‍্যাপার বিশেষ জানা নেই তবে কোথাও পড়েছি‌লাম (এখন বিজেপি যেভাবে বিরোধীমুক্ত ভারত করতে উঠেপড়ে লেগেছে) একদা পরশুরাম‌ও নাকি ধরাকে ক্ষত্রিয়‌শুন‍্য করতে তাঁর নির্মম পরশু নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সেই‌টে যে শিবুদা‌র হাতেও থাকে সেটা জানতাম না। আমার ধারণা ছিল (এখন বিজেপি যেমন CBI-ED-IT ত্রিমুখী অস্তর নিয়ে বিরোধীদের পিছনে লেগেছে‌ন)  শিবুদা‌র‌ প্রিয় অস্ত্র ত্রিশূল। 

    ভাস্কর্য যে সামনাসামনি দেখলে ভালো লাগে সে ব‍্যাপারে সহমত‌।
     
  • অরিন | 119.224.***.*** | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৪৬530206
  • "বিরোধীমুক্ত ভারত করতে উঠেপড়ে লেগেছে) একদা পরশুরাম‌ও নাকি ধরাকে ক্ষত্রিয়‌শুন‍্য করতে তাঁর নির্মম পরশু নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সেই‌টে যে শিবুদা‌র হাতেও থাকে সেটা জানতাম না। আমার ধারণা ছিল (এখন বিজেপি যেমন CBI-ED-IT ত্রিমুখী অস্তর নিয়ে বিরোধীদের পিছনে লেগেছে‌ন) শিবুদা‌র‌ প্রিয় অস্ত্র ত্রিশূল।"
     
    ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ ( https://www.wisdomlib.org/hinduism/book/the-brahmanda-purana ) অনুযায়ী 
     
    পরশুরাম শিবের কাছ থেকে কুঠার পেয়েছিলেন। 
     
    শিব কুঠার পেয়েছিলেন বিষ্ণুর কাছ থেকে দক্ষ যজ্ঞের পর তাণ্ডব থামাতে ভগবান বিষ্ণু শিবের দিকে কুঠার নিক্ষেপ করেন, শূলপাণি তদবধি কুঠার ধারণ করেন। 
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৫530214
  • তাহলে ঐ মূর্তি‌তে শিবুদা‌র হাতে - কেকে যেমন বলেছেন - ওটা পরশু‌ই হবে - হয়তো পরশু‌রামকে ওটা গিফট করার আগের অবস্থা শিল্পী ভেবেছেন। 
     
    আচ্ছা পরশুদাকে গিফট করার পরে‌ও কি শিবুদা‌র হাতে পরশু থাকতে পারে?   
     
    আমার এই সব কথা পড়লে আমার বৌ রেগে কাঁ‌ই হয়ে যায় - বলে শিবুদা, পরশু‌দা, পাবুবৌদি ... ঠাকুর দেবতা নিয়ে ইয়ার্কি? আমি বলি‌, আরে বাবা আপন ভাবি বলেই তো এভাবে বলি - মানবে না।
  • Arindam Basu | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:০০530216
  • "আচ্ছা পরশুদাকে গিফট করার পরে‌ও কি শিবুদা‌র হাতে পরশু থাকতে পারে? "
    না থাকার তো কিছু নেই | 
    কুঠার হয় মহাদেবের হাতে থাকবে নয় পরশুরামের হাতে থাকবে এমন কোন কথা নেই | তার ওপর পরশুরাম সে কুঠার পরে অরুণাচল প্রদেশের পরশুরাম কুণ্ডে ফেলেও দিয়েছিলেন, :-)
     
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৭530218
  • অরিনবাবু , 
     
    গুচতে ভাট, খেখা, টপ, হপা, বুবুভা বিভিন্ন জায়গায় নানা বিষয়ে আপনার নির্দিষ্ট তথ‍্যসূত্র উল্লেখ করে মন্তব্য দেখে মনে হয়েছে আপনি এক দারুণ রিসোর্স পার্সন। এভাবে দ্রুত এতো ডাইভার্স বিষয়ে রেফারেন্স দেওয়া মোটেও সোজা কথা নয়। এই প্রবণতা গুরুর আরো কয়েকজনের মধ‍্যে দেখেছি - যেযন lcm, কিন্তু আমার কাছে আপনি অনন্য।
     
    ভালো থাকুন।

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন