মন্দিরের পিছনে ও।ছোট একটা ঘরে থাকে। তখন ওর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পড়াশোনা করেনি। অন্য কোনো কাজও জানে না। তাই এই বয়সে আর নতুন কিছু করা বা অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবে না করণ। মন্দির কমিটি থেকে মাসমাইনে পায় দু হাজার টাকা। এছাড়া আছে দর্শনার্থীদের কিছু দান। তাতেই চলে যায় ওর। মনে হোলো এই জীবনযাত্রায় করণের কোনো আক্ষেপ নেই। থাকলে অকারণে প্রায়শই ওর মুখে এমন অমলিন হাসি দেখা যেতো না।
জায়গাটি অতি মনোরম। শান্ত পরিবেশ। পাহাড়ের গায়ে কিছুটা ওপরে হওয়ায় অবাধ দৃষ্টি চলে যায় বহুদূর। সারাদিনে অনেক হাঁটাহাঁটি করে একটু ক্লান্ত লাগছিল। ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর, মন জুড়িয়ে গেল। এবার ধর্মশালায় ফেরা ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই। তাই উঁচু চাতালে করণ আর একটা সতরঞ্চি পেতে দিতে জমিয়ে বসে জানতে চাইলাম, এখানে নানান দেব দেবীর মধ্যে ফুহারীজী কে? আগে তো কখোনো শুনিনি।
আমার প্রশ্ন শুনে করণ করুন ভাবে আমতা আমতা করে। করণের মতো মানুষের জীবনে বিশেষ কিছু না জেনেও দিব্যি চলে যায় তাই যেখানে এতদিন আছে সেই স্থানের নামটির তাৎপর্য জানার কৌতূহলও হয়নি ওর। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কোট - যা রোমিও জুলিয়েট না পড়েও কোথাও উদ্ধৃতি পড়েই জেনেছি - “What's in a name? That which we call a rose by any other name would smell just as sweet.” মনে হয় এমন খামচা মারা জানার আগ্ৰহ ওর নেই।
কিন্তু স্থানীয় মহিলাটি সপ্রতিভ। আগেই সে জানতে চেয়েছে, বাবুজী, আপ কাঁহাসে আয়ে হো? এবারেও সেই জবাব দিল। বাবুজী, ঐ যে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা হনুমানজীর মূর্তি দেখছেন, ওটা খুব প্রাচীন। সেই গড়ের আমলের। বাকি সব মন্দির হালে হয়েছে। একবার এখানেই কারুর কাছে শুনেছিলাম, হনুমানজী তো ফলাহারী, তাই হয়তো ওনাকে ফলাহারীজী দেবও বলা হোতো। ক্রমশ তা লোকমুখে ফুহারীজী হয়ে গেছে। তবে পূজারীজী থাকলে হয়তো আরো সঠিক বলতে পারতেন। মহিলাটির ব্যাখ্যা আমার গ্ৰহণযোগ্য মনে হোলো।
একটু পরে মহিলাটি ও বাকি কয়েকজন দর্শনার্থীরা চলে গেলেন। একদম নির্জন হয়ে গেল এমনিতেই শান্ত জায়গাটি। দুরে পশ্চিম দিগন্তে পাহাড়ের মাথায় গোধূলির লালচে আভাও ক্রমশ মিলিয়ে গেল।
ব্যাগ থেকে কিছু কড়াইশুঁটি, গাঁঠিয়া, প্যাঁড়া বার করে করণকে দিলাম। দু হাত পেতে মন ভালো করা হাসিমুখে নিল। ঠান্ডা হাওয়ার দাপট বাড়ছে দেখে করণ একটা চ্যাপ্টা কড়াইয়ে কাঠের আগুন জ্বালালো। ততক্ষণে আর একটি বছর আঠারোর ছেলে এসে হাজির হয়েছে। রকমসকম দেখে মনে হোলো কথা বলতে পারে না। করণ জানালো ও এখানে নিয়মিত আসে। আমায় প্রথম দেখেও উৎসাহ নিয়ে নানা ইশারা করে কত কি বোঝাতে চাইলো। আমি মাথা নেড়ে ওর অঙ্গভঙ্গিতে সায় দিই বটে তবে কিছুই বুঝতে পারি না। অসহায় লাগে। প্রকাশের অক্ষমতায় নয়। ভাষার খাঁচায় আবদ্ধ আমার ওর অব্যক্ত অনুভব উপলব্ধি করার দৈন্যতায়। করণ কিছুটা ধরিয়ে দেয়।
এক ফাঁকে করণ ঠোঙায় করে কিছু খোলাসমেত কাঁচা চিনেবাদাম এনে দেয় আমায়। সরল প্রতিদান। খারাপ লাগলেও বলি, কাঁচা বাদাম খেলে অসুবিধা হয় আমার। খুব উৎসাহ নিয়ে ও একটা টিনের খোলায় বাদামগুলো আগুনে সেঁকে দেয়। গরম গরম সেঁকা বাদামভাজা খেতে ভালোই লাগে।
ততক্ষণে সেখানে আর একটি স্থানীয় লোক এসে বসছে। বয়স ত্রিশের কোঠায়। নাম প্রদীপ। সেও করণের চেনা। রোজ আসে সন্ধ্যা আরতির আগে। দেখলেই বোঝা যায় নিম্নবিত্ত। কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র। কথাবার্তা খুব মার্জিত। চলতে থাকে টুকটাক আলাপচারিতা। মূলত আমিই জানতে চাই চান্দেরী সম্পর্কে কিছু কথা। ওরা সাধ্য মতো জানায়।
হঠাৎ সেই মূক ছেলেটি একটা ছোট্ট বাটিতে একটু নুন এনে আমার পাশে রাখে। ইশারায় বোঝায় বাদামগুলো নুন দিয়ে খেতে। ভালো লাগবে। যারা মূক হয় তারা সচরাচর বধিরও হয়। এও তাই, কানে শুনতে পায় না। কথা বলতে পারে না। লেখাপড়া শেখেনি বলে লিখেও মনের কথা বোঝাতে পারে না। কিন্তু না চাইতে জলের মতো নুনটা তো এনে বেশ রাখলো! আমাদের কথা বলতে দেখে সেও মাঝে মাঝে অবোধ্য কিছু আওয়াজ করে মনের ভাব প্রকাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কথা বলতে পারে না বলেই ওর হয়তো অতো প্রকাশের তাগিদ। যারা বলতে পারে তারা জানে কথা সাজিয়ে মনোভাব গোপনের মন্ত্র। অক্ষমতা সত্ত্বেও ওর প্রকাশের আকুলতা, মমত্ববোধ নাড়া দেয়।
করণকে বলি, ওর নাম কী? করণ বলে, ওর কোনো নাম নেই তো। মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, তাহলে ওকে ডাকো কী করে? করণ বলে, ডাকি না তো। ডেকেও তো লাভ নেই। ও তো শুনতেই পায় না। হয় কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাকি বা চোখাচোখি হলে হাতের ইশারা করি।
করণের কথায় ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যাই।
লেখাপড়া, ঘোরাঘুরি, অভিজ্ঞতার এই ফল! একটু আগে ওর প্রতি আমার সামান্য অনুকম্পা হয়েছিল - এতোদিন এখানে থেকেও জায়গাটির স্থানমাহাত্ম্য না জানার অনাগ্ৰহে। কিন্তু ওর থেকে অনেক বেশী জেনেও এই সরল সত্যটা তো আমার মাথাতেই এলো না! নাম তো তাদের প্রয়োজন যাদের কাছে নামহীন অস্তিত্ব অর্থহীন। যারা বোঝে নিছক আত্মপরিচয় ছাড়াও নামের কী অপার মহিমা, তাই নামার্জনের মোহে জীবনভর চলে অক্লান্ত নামকীর্তনের তাড়না। জন্মাবধি নিস্তব্ধতায় নিমগ্ন ওর অস্তিত্বটাই তো প্রায় অকিঞ্চিৎকর। কোথাও কোনো কাগজে ওর একটা নাম থাকলেও তার সাথে তো ওর কোনো একাত্মতাই তৈরি হয় নি। তাই নিজের নাম কারুর মুখে না শুনেও ওর কেটে গেছে এতগুলো বছর। বাকি জীবনটাও হয়তো ওর এভাবেই কেটে যাবে।
সরল সহজ মনের করণ আমার ভাবান্তর, হঠাৎ চুপ করে যাওয়া এসব টের পায় না। কাঠের আগুনের কড়াইটা পাশে বসিয়ে দেয়, বাবুজীর যাতে ঠাণ্ডা না লাগে। নীচে তখন প্রাচীন চান্দেরী শহরের আলো জ্বলে উঠছে।