এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমাদের উত্তর ভারত দর্শন ২০২৪ - সন্তোষ কুমার পাল /২৬.০২.২৪

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৮৬৪ বার পঠিত
  • | |
    (এ মাসেই আগ্রা, অমৃতসর ও শিমলা ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। সেই ভ্রমণ-কাহিনি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।)

    (প্রথম পর্ব)

    মুখবন্ধ

    সেবার ছিল ২০১৮। ইউরোপ-পর্যটনে গিয়েছিলাম টমাস কুকের ব‍্যবস্থাপনায়। সময়টা ছিল জুনের শেষ ও জুলাই-এর প্রথম, আরো স্পষ্ট করে বললে,  জুনের ২৯ থেকে জুলাই-এর ৯ তারিখ। ভারতের বিভিন্ন রাজ‍্যের জনা পঁচিশ সহযাত্রীর সঙ্গে বর্ধমান থেকে আমার এক সহকর্মীর পরিবারের চারজনের সঙ্গে আমরা সপুত্র তিন-- সব মিলে ৩২ জন-- আন্তর্জাতিক পর্যটনে। লণ্ডন, প‍্যারিস, রোম, ভ‍্যাটিক‍্যান ও সুইৎজারল‍্যাণ্ড ছিল গন্তব্য। বেশ ভালো করে ঘুরেছি। আল্পসের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ ইয়ুঙ ফ্রাও জোখের অত উঁচুতে বরফ হাতে নিয়ে ছবি তুলেছি। প‍্যারিসের ল‍্যূভে মিউজিয়ামও গেছি, মোনালিসার কথিত অরিজিনাল ছবি দেখেছি। গেছি ইতালির মিলানে, দর্শন করেছি পিসার লিনিং টাওয়ার। শেক্সপিয়ারের  ভেনিসও বাদ যায়নি। অনেক আনন্দ, হুল্লোড় করেছি। ছবি তুলতেও কার্পণ্য করিনি। কিন্তু গুছিয়ে কিছু লিখে রাখিনি বলে আফশোস হয়। কাউকে বিস্তারিত বলতে পারি না। ক্ষণ-তিথি ধরে বলতে পারি না 'আমাদের কাজল' কীভাবে তিতলিস পর্বত শৃঙ্গে উঠে, শাহরুখ খানের কাট-আউটের সামনে দাঁড়িয়ে ওই বরফ-বৃষ্টিতে ভিজে কনকনে ঠাণ্ডায় শাড়ি পড়ে পোজ দিয়েছিল! তাই ঠিক করলাম, এবার থেকে কোথাও গেলে দু'কলম লিখে রাখবো। আর সেকথা পড়ে কেউ যদি একটুকু  মানস-ভ্রমণের তৃপ্তি পায় তাতে ক্ষতি কী!

    প্রস্তুতি

    গত অগাস্ট থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে তিন বার অ্যাকাডেমিক ইনভিটিশনে বিদেশে গেছি। তাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম আবার ছুটি পাবো তো! সঙ্গে ছিল এই দোলাচল যে ২০/০২/২৪ থেকে তৃতীয় সেমেস্টারে পরীক্ষা শুরু হলে আমার মানবীবিদ‍্যা বিভাগের পরীক্ষা পরিচালনার কি হবে! অবশ্য পরে পরীক্ষার ডেট এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাওয়ায় কিছুটা নিরুদ্বিগ্ন হই। আমাকে অনিশ্চিত ভেবে (কিন্তু গণনায় রেখেই) পুত্র-পরিবার মাস তিনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি চালিয়ে গেছে। এখানে মূলত দু'জনের ইচ্ছা পূরণের তাগিদ ছিল: ছেলের তাজমহল দর্শন, আর ছেলের মায়ের কালকা থেকে টয় ট্রেনে শিমলা দর্শন! প্রসঙ্গত, আমরা দু'জনে অনেক আগেই তাজ-দর্শনে গিয়েছিলাম, তখন ছেলের এই 'নিষ্করুণ অথচ সুন্দর' পৃথিবীর মুখ দেখেনি! আমার অবশ্য পূর্ব নির্দিষ্ট তেমন কোন বিশেষ ইচ্ছে-অনিচ্ছে ছিল না। তবুও, জালিয়ানওয়ালাবাগের ক্ষত-বিক্ষত ইতিহাস, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির কিম্বা ওয়াঘা সীমান্ত-দর্শনের প্রসঙ্গ উঠলে আমি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি। আমার ভারতীয় সত্তা তীব্রভাবে আলোড়িত হয়। সব মিলে তাই একদিকে তাজমহল-আগ্রা ফোর্ট-ফতেপুর-সিক্রি, অন‍্যদিকে ছেলের বর্তমান অধ‍্যয়ন-ইনস্টিটিউট IISER Mohali-কে ছুঁয়ে কালকা-টয়ট্রেন -শিমলা-কুফরি -ফাগু-চেইল। আর আমার অমৃতসর- জালিয়ানওয়ালাবাগ-স্বর্ণমন্দির-আত্তারি/ওয়াঘা বর্ডার!

    আগ্রার উদ্দেশে

    আমরা ১০ তারিখ মধ্যরাতে বর্ধমান থেকেই আজমীর শরিফ সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসে চেপে বসি। ট্রেন টুণ্ডলা পর্যন্ত ঠিকঠাক গেলেও যমুনার কাছাকাছি এসে থমকে যায়, 'ন যযৌ ন তস্থৌ'। যেন আমাদের কেষ্টঠাকুর জেদ ধরেছে "সব সখিকে পার করিতে...।" দু'ঘন্টা ব্রিজ-ঘাটে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বান্টি ভাই অটো নিয়ে আগ্রা ফোর্ট স্টেশনে অপেক্ষমান! দশ মিনিট অন্তর ফোনাফুনি! একূল ওকূল দুকূলই অধৈর্য হয়ে পড়ছে। (পরে জেনেছি, ওর প‍্যেয়ারি এক বন্ধু ঐ দিন সন্ধ্যায় একটা বড়সড় পার্টি দিচ্ছে। ওকে সময়মতো পৌঁছাতে হবে, তাই এত অধীর ছিল।) সাড়ে ছয়টায় পৌঁছনোর কথা, পৌঁছলাম ঠিক সাড়ে আটটায়। বান্টিভাই যথেষ্ট ভদ্রলোক, পেশার প্রতি সমান দায়িত্বশীল। তাই নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে দিয়েই ছোটে বন্ধুর পার্টিতে।
    মধ‍্যম মানের 'শ্রীকৃষ্ণ হোটেল', মানসিং প‍্যালেসের সন্নিকটে। (ওরা লোকেশন বোঝাতে অবশ্য "উদুপি" নামটি ব‍্যবহার করছিল।) তাজমহলেরও খুব কাছে। এর থেকে  দু'চারশো মিটার কাছাকাছি দু-একটা হোটেল আছে। তবে তারা 'তারা'য় বেশি, যার প্রতিফলন ঘটে প্রাইসিং-এ: আমাদের হোটেলে অবস্থান-মাশুল যেখানে ১৫ শো প্রতি দিবারাত্র, ঐ 'তারা'-ওয়ালাদের সেখানে ১৫ হাজার!

    রাতে হালকা নৈশভোজ হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে। হাঁ, আমরা বাইরে গিয়ে আহারে একটু সংযম অনুশীলন করি। খাবার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। আর প‍্যাকেজড ড্রিঙ্কিং ওয়াটার ছাড়া অন্য কোন পানীয় ব‍্যবহার করি না। খাবারের ব‍্যাপারে ছেলে মাঝেমধ্যে বেগরবাই করে। তবে শেষমেশ মায়ের কথা একবারে ফেলতে পারে না! ফলত, পেটের সম্ভাব‍্য সমস্যার জন্য নিয়ে যাওয়া ট‍্যাবলেটাদি অধিকাংশটাই ফিরে আসে। তবে ব‍্যতিক্রম আছে। অনেক সময় এমন সহযাত্রী পাই,  যারা খাওয়া-দাওয়াটাকে সমধিক গুরুত্ব দেয়। সেবার ইউরোপ-ভ্রমণে লণ্ডনে দু'দিন ছিলাম। অনেকেই জানেন ওখানে বড় বড় হোটেলে ব্রেকফাস্টটা অ্যাকোমোডেশন চার্জের সাথেই ধরা থাকে। আমাদের যে হোটেলে রাখা হয়েছিল তার প্রাতরাশ-ব‍্যবস্থাটি ছিল কমবেশি আমাদের দুটি বিয়ে-বাড়ির সমান। কি নেই সেখানে! মাছ-মাংস থেকে শুরু করে ফল, ব্রেডের রকমারি প্রিপারেশন। নূতন নূতন আইটেম, তেমনি টেস্টিও। একটি পরিবার কোথায় শেষ করবো ভাবতে না পেরে দ্বিতীয় দিন থেকে আমার হজমের ওষুধের শরণাপন্ন হয়। নিজেদের যা ছিল প্রথম ছত্রিশ ঘন্টায় শেষ! সেবারই আমি কোন ফ‍্যামট‍্যাক র‍্যানট‍্যাক ফেরত আনতে পারিনি!

    বান্টিভায়ের অটো

    প্রসঙ্গে ফিরি। বান্টিভাই কথামতো সকাল আটটায় হোটেলের সামনে অটো নিয়ে হাজির। আমরাই সেদিনের তাজ-দর্শনের প্রথম পরিবার বলতে পারেন। টিকিট ছেলে আগে থেকেই অনলাইনে কেটে রেখেছিল। শুধু এটাই নয় যেখানে সম্ভব ছিল সব টিকিট ও হোটেল বুকিং অনলাইনে আগে থেকেই করে রেখেছিল। সব হিসেব করে, তাৎকালিক গতিতে। এই ধরুন, কালকা-শিমলা ট্রেনের টিকিট ঠিক ত্রিশ দিন আগে থেকে দেয়। সকাল আটটায় সাইট খোলে, তিন মিনিট গড়িমসি করলে হয়তো বুকিং শেষ হয়ে যাবে! 

    শাহজাহান-মুমতাজের প্রেমকথা

    ফিরে আসি তাজে। দু'রকমের ব‍্যবস্থা। আপনি মূল তাজ-কাঠামোয় না ঢুকে বাইরে থেকে সকাল আট/নয়টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দর্শন করতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, যদিও টিকেটে তিন ঘন্টার একটা সময়ের কথা বলা আছে। এই টিকেটের মূল্য মাথা পিছু ৫০ টাকা। আর যদি উপরে উঠে মূল কাঠামো, অর্থাৎ মুমতাজের সমাধির উপরি কাঠামোর মধ্যে ঢোকেন তাহলে টিকিটের মূল্য বেশি তো বটেই (২৫০ টাকা), আপনার পাদুকাদুটিকেও বায়োডিগ্রেডেবল কপড়ের কভারে ঢেকে লাইনে দাঁড়াতে হবে। আর তাজে ঢোকার আগে একাধিক সিকিউরিটি চেকিং-এর ব‍্যাপার তো আছেই। আমরা প্রথম দিন সাড়ে তিন ঘন্টার মতো ছিলাম তাজ-এলাকায়। ঐ দিন বিকেলে আবার যমুনার অপর তীর থেকে ঘন্টা দু'য়েক তাজ-দর্শন করি। পরের দিন আবার বিকেল চারটে থেকে ছয়টা সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে এই কাঠামোর উপর আজকের 'কারেকটিং হিস্ট্রি'র জাতীয়তাবাদীদের হাত পড়বে না। সম্রাট শাহজাহানের থেকে বয়সে ছোট হলেও মার্কস অনেক আগে বলে গেছেন না অর্থনীতিই সবকিছুর মূল!

    তাজ কমপ্লেক্সে সব মিলিয়ে চার-পাঁচটি স্থাপত্য। প্রথমেই লালপাথরে তৈরি প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারটির নির্মাণশৈলী লক্ষণীয়। বিশালাকার এই দ্বার দিয়ে যত আপনি ভিতরে প্রবেশ করবেন, তাজ মহল সমাধিটি আরো যেন দূরে চলে যাবে। দ্বারটি পেরোলেই বাগান। বাবরের হাত ধরে যে "চারবাগ"-এর প্রকল্প মুঘল ভারতে এসেছিল, তারই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাজ কমপ্লেক্সের এই বাগানটি। মাঝখানের জলধারা, আর দুপাশে সারিবদ্ধ বৃক্ষরাজি, কোরআন-কথিত স্বর্গীয় বাগানের রূপকধারী। বাগানের শেষ প্রান্তে, ঠিক মাঝখানে শ্বেতপাথর-নির্মিত, পিয়েত্রাদুরা-খচিত, জগৎবিখ্যাত তাজমহল সমাধি, দু'ধারে লালপাথরের মসজিদ আর মেহমানখানা। চারিদিকে লাল-স্থাপত্য আর সবুজের বাগানের মাঝে ঝকঝকে শ্বেতপাথরের সমাধিটি সত্যি মানব-ইতিহাসের সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বাইশ বছর লেগেছিল এটি নির্মাণে। "শুভ্র-সমুজ্জ্বল" শ্বেত পাথর, এর বিশাল আকার, নির্মাণশৈলীর সামঞ্জস্য, চারিদিকে চারটি মিনার-- সবই যেন সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর সমাধিটিকে, এক স্বর্গীয় প্রাসাদের রূপ দিয়েছে।

    তাজের শ্বেতশুভ্র বর্ণচ্ছটা মোটামুটি আগের মতোই আছে, আমার সাদা চোখে অন্তত তাই মনে হয়েছে, যদিও অনেকে বলেন দূষণের মলিনতা তাজকেও স্পর্শ করছে। সম্রাট শাজাহানের প্রেম, তাকে "কালের কপোল তলে" অমর করে রাখা-এসব নিয়ে আমার মতো অ-প্রেমিকের তেমন কিছু বলার নেই। অবশ্য আমার একটা মুদ্রা-দোষ হচ্ছে, সব কিছুকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করে বোঝা! আমার কেমন যেন মনে হয়, আমাকে-আপনাকে তো বর্তমানেই বাঁচতে হয়! আচ্ছা, আমাদের যেসব ছাত্রছাত্রী গান্ধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থানে নিরন্তর বসে থেকে বয়স বাড়িয়ে নিচ্ছে শুধু অতীত-চর্চা বা অন্ধ ভক্তিরস দিয়ে তাদের কি সান্ত্বনা আপনি দিতে পারেন! অথচ ঠিক এই কাজই বর্তমান রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ করে চলেছেন!

    যে কথা বলছিলাম, উপরের যে কাঠামো আমরা দেখি মূল সমাধি দুটির মধ্যে একটি মুমতাজের, একটি শাহজাহানের। শাহজাহানের সমাধিটি একটু উঁচু। আমার অর্ধাঙ্গিনীর বক্তব্য: এত প্রেমও দু'জনকে মৃত্যুর পরেও সমান করতে পারল না! আমি বুঝিয়ে বলি, শাহজাহান সম্রাট, পুরুষ। আর একাধিক স্ত্রীর অন‍্যতম মুমতাজ--এসব ভুলে যাও কেন! আর আজকের ফেমিনিস্ট চেতনায় অতীত মুঘল যুগের বিচার হয়? আজকের শাহজাহান হয়তো এটা করতে দিতেন না! আর শাহজাহান তো চেয়েছিলেন যমূনার ঠিক অপর তীরে তাঁর সমাধি হোক! "এই কূলে আমি/ আর ঐ কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়..."এরকমই শাহেনশাহ-র মনোবাসনা ছিল। কিন্তু পুত্র ঔরঙ্গজেব যদি পিত্রিচ্ছা পালন না করেন তাহলে আমরা কি করতে পারি! স্থান-কাল-পাত্র তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

    প্রসঙ্গক্রমে বাংলা সাহিত্যের অন‍্যতম সাধক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক, প্রয়াত হাসান আজিজুল হকের একটি আত্মজীবনীমূলক লেখার কথা মনে এলো। আমার গ্রাম থেকে (আবার বর্ধমান থেকেও) ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি গ্রামে ওনার শৈশব,  কৈশোর ও যৌবনের কিছুটা অংশ কাটিয়েছেন। পরে দেশভাগের সময় এপার বাংলা থেকে যারা ওপার বাংলায় থিতু হয়েছে তাদের অন‍্যতম এক পরিবারের সন্তান। ঐ গ্রামে মাত্র দুইটি মুসলিম পরিবার বাস করত। যদিও হাসান সাহেবের বাবার সঙ্গে সকলেরই সদ্ভাব ছিল‌। ওখানের স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের সকল শিক্ষক ছাত্র হাসানকে দারুণ স্নেহ করতেন।  স্কুলের পণ্ডিত মশায় হাসানের সংস্কৃত-জ্ঞানে এতটাই মোহিত ছিলেন যে অন্য ছাত্র কিছু না পারলে ওকে সেই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিতেন। সেই স‍্যার খাতা সংশোধনের জন্য অন‍্য যে কোন ছাত্রের পেন্সিল নিতে তৈরি থাকলেও, হাসানেরটা কখনো হাতে ধরতেন না। মধ্য বয়সে এসে এই বিষয় নিয়ে তিনি যখন পুনরাবলোকন করছেন, তখন তিনি একে "অসচেতন সাম্প্রদায়িকতা'' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই প্রশ্ন রেখে গেছেন: অসচেতন সাম্প্রদায়িকতার সেঁকো বিষ দাঙ্গার মতো পরিস্থিতিতে স‍্যারকে আমার সামনে কীভাবে দাঁড় করাতো?

    আগ্রা ফোর্ট

    যাই হোক, প্রথম দিনের তাজ-দর্শন সেরে অনেক অনেক ছবি তুলে বান্টিভাই আমাদের আগ্রা ফোর্ট-এ নিয়ে গেলেন। আকবরের আমলে নির্মাণ শুরু এই আগ্রা ফোর্টের, চলে তাঁর পৌত্র শাহজাহানের সময়কাল পর্যন্ত। তাই বিভিন্ন সম্রাটের আমলের নানান স্থাপত্য বহন করে চলেছে যমুনার তীরের এই বিশাল কেল্লা। তবে বহু স্থাপত্যের মধ্যে সবচেয়ে দাগ কাটে জাহানারা বেগমের মহল। কথিত আছে, ঔরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণের পর পিতা শাহজাহানের স্থান হয়েছিল এখানেই। অবন ঠাকুরের সেই ছবির মতনই বৃদ্ধ শাহজাহান এই মহল থেকেই প্রয়াত পত্নী মমতাজের সমাধি দর্শন করতেন।

    ফোর্ট থেকে বেরিয়ে দ্রুত হোটেলে প্রত্যাবর্তন। দ্বিপ্রাহরিক স্নানাহার সেরে এবার পালা আরো কিছু মুঘল স্থাপত্য দর্শন। ইতিমাদৌল্লাহর সমাধি, রামবাগ, চিনি কা রওজা ঘুরে, পড়ন্ত বিকেলে এসে পৌছালাম যমুনার অপর প্রান্তে মেহতাববাগে গোধূলির আলোয় আরেকবার তাজ-দর্শনের লোভে।

    ফতেহপুর সিক্রি

    তৃতীয় দিন আগ্রা থেকে পাড়ি দিই ফতেহপুর সিক্রি। ফতেহপুর সিক্রি বলা যায় আকবরের মূল কর্মস্থান, ধর্মস্থানও বটে। সিক্রি এলাকার চিশতি সাধক শেখ সেলিমের আশীর্বাদে পুত্র (যে কিনা পরে হয়ে উঠে 'জাহাঙ্গীর')-লাভের পর আকবর দিল্লি ছেড়ে নতুন রাজধানী গড়ে তোলেন সেলিম চিশতির দরগার পাশেই, নাম হয় ফতেহপুর সিক্রি। দক্ষিণের দিকটি বাদ দিলে ১১ কিমি প্রাচীরে ঘেরা এই রাজধানী এলাকাটি যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শহর। সম্রাটের রাজকীয় বাসস্থান, রানীদের মহল, স্নানাগার, রাজকার্য্য পরিচালনার দফতর ছাড়াও ছিল বাজার, কারখানা ও কারিগরদের বাসস্থান। পাশেই ধর্মীয়স্থান সেলিম চিশতির সমাধির সাথে সাথে সেখানে আছে জামা মসজিদ, আর আকবরের গুজরাত-জয়ের স্মারক বুলন্দ দরওয়াজা। রাজপ্রাসাদ আর সুফিসাধকের সমাধির এই নৈকট্য আসলে মুঘল আমলে রাজকীয় সার্বভৌমত্বের ধারণার এক নতুন দিককেই তুলে ধরে, যেখানে সম্রাট আকবর সচেতনভাবেই নিজেকে একইসঙ্গে ইহজগতের শাসক ও পরজগতের মসিহারূপে নিজেকে তুলে ধরতে চান। ফতেহপুর সিক্রির স্থানে স্থানে স্থাপত্য যেন তারই প্রমাণ বহন করছে। সর্বসাধারণের গম্য দেওয়ান-ই-আমে সম্রাটের বসার স্থান তাই "কীবলা"-র দিকে, পশ্চিমে। আবার ধর্মীয় এলাকাটির মধ্যে থাকা এই জামা মসজিদ থেকেই এক সময় আকবর মাহজারনামা ঘোষণা করে ধর্মীয় বিষয়ে চূড়ান্ত বিচারের ক্ষমতা তুলে নেন নিজের হাতে। সেলিম চিশতির পরিবারের সদস্যদের  কেবল পারলৌকিক কাজে না রেখে যুক্ত করে নেন সাম্রাজ্য পরিচালনার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে।

    (চলবে...)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিত সেনগুপ্ত | 122.17.***.*** | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:১৯528908
  • ক্ষমা করবেন,"মানবীবিদ্যা" মানে কী? কেউ জানালে নতুন কিছু জানবো ও তাঁকে অগ্রিম ধন্যবাদ। 
  • | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৪১528909
  • মানবীবিদ্য হল উইমেন স্টাডিজের বাংলা।   যতদূর জানি যাদবপুরে প্রথম বিষয়টি চালু হওয়ার সময় এই বঙ্গীকরণ  হয়েছিল। 
  • Santosh Kumar Pal | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৩০528912
  • একদম ঠিক! 
  • lcm | ০১ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৩528953
  • "... আল্পসের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ ইয়ুঙ ফ্রাও..."

    আল্পসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মন্ট ব্লাঁক (Mont Blanc), এটা ফ্রান্স এবং ইতালির বর্ডারে শামোনি (Chamonix) বলে একটা জায়গার কাছে। 
  • Santosh Kumar Pal | ১০ মার্চ ২০২৪ ২০:২৯529213
  • ঠিক। আমি ভুল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন