এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমাদের উত্তর ভারত ভ্রমণ ২৮/০২/২৪

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪১৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | |
    তৃতীয় পর্ব

    শিমলার দিকে

    এবার আসি শিমলা-ভ্রমণের কথায়। অমৃতসর থেকে আবার মোহালি ফিরে একদিন রেস্ট। পরের দিন সকালে  উঠে আইজারের পুরো কাম্পাসটি প্রদক্ষিণ, মর্নিং ওয়াকের ছলে। এত বড় ক‍্যাম্পাস, এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং-এ যেতে পায়ে ব‍্যথা হয়ে যাবে। আমরা ছিলাম ভিজিটরস হোস্টেলে। আমরা যাকে গেস্ট হাউস বলি তাই এখানে এই নামে পরিচিত। এই গেস্ট হাউসের ব‍্যবস্থাপনা দারুণ। কি নেই! দুটি বড় বড় রুম, একটি বেশ বড় ব‍্যালকনি, গোটা তিনেক আলমারি, ক‍্যাবার্ড। সঙ্গে অত‍্যাধুনিক ব‍্যবস্থাসহ বড় মাপের টয়লেট। শুধু একটু কিচেনের ব‍্যবস্থা নেই এই যা। থাকলে ওখানেই দুটো ফুটিয়ে খেতাম! এখান থেকে ৭ নং মেসে খেতে আসতে আপনাকে প্রায় দু'কিলোমিটার হাঁটতে হবে! 'আফটার সাপার ওয়াক এ মাইল'-র পক্ষে খারাপ নয়। ছেলের মায়ের মতে, এখানে যা মর্নিং ওয়াক/ ইভিনিং ওয়াক হলো তাতে কয়েক মাস চলে যাবে! 

    আগে থেকে বুক করা ক‍্যাব  সাড়ে নয়টায় ভিজিটরস হোস্টেলের সামনে এসে হাজির। দে ছুট সোজা কালকা স্টেশন! চল্লিশ কিলোমিটারের কাছাকাছি রাস্তা। ঘন্টা দেড়েক লাগল। ভাড়া নিল দেড় হাজার। স্টেশনে ঢুকতেই দেখি গুড়িগুড়ি পায়ে হিমালয়ান কুইন প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসছে আমাদের ওয়েলকাম করতে!

    টয়ট্রেনের 'ছোট লাইন'

    একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি। এই হিমালয়ান কুইনদের আমরা 'টয়ট্রেন' বলি। শুনতে ভালো লাগে, একটা শিশুসুলভ মাধুর্য ফুটে উঠে। কিন্তু ছিয়ানব্বই কিলোমিটার ঐ পাহাড়ি সর্পিল রাস্তায় সাড়ে চার ঘন্টায় পৌঁছে দেওয়া কোনো টয়-এর কর্ম নয়। এটা আপনি বলতে পারেন ছোট লাইনের ট্রেন। যেমন অর্ধ-দশক আগেই আমরা ছেড়ে এসেছি বর্ধমান-কাটোয়া ছোট লাইন।
    যাই হোক, আমরা কয়েক মিনিট স্টেশনে এদিক-ওদিক বুঝে নিয়ে কম্পার্টমেন্টের ভিতরে নির্দিষ্ট হাতল-দেওয়া চেয়ারেই বসে পড়লাম। একদম প্রথম রো-তেই পর পর তিনটি চেয়ার আমাদের তিন মূর্তির জন‍্য। আমাদের পিছন দিকটা পরের কম্পার্টমেন্টের দেওয়াল। ফলত কোন ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার (সর্বোচ্চ ঘন্টায় গতিবেগ ২৫ কিমি) ঠাণ্ডা হাওয়া সহ‍্য না করেই কাঁচের জানলা দিয়ে খেয়ালি অথচ সুন্দর প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাওয়া। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঠিক সময় ১১.৫৫-য় ট্রেন ছেড়েছিলো। সঙ্গে থাকা ছোলা-বাদাম দেওয়া মুড়ি চিবোতে চিবোতে অপলক দৃষ্টিতে বাইরের প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমরা সকলেই। এই পাহাড়ি প্রকৃতি কখনো সবুজ, কখনো ফ‍্যাকাশে শুষ্ক, কখনো ভয়ংকর, কখনো শান্ত-স্নিগ্ধ, পাখির কুজন মুখরিত। পাহাড়ের নাড়িভুঁড়ি চিরে চলা এই পর্যটন নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির উপর মানুষের আগ্রাসন মনে হতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে প্রকৃতির কোলে একটু 'আদর' খেলে প্রকৃতি-মায়ের খারাপ লাগার কথা নয়। প্রসঙ্গত বলি, আমাদের প্রজাতি-নির্ভর নীতিবোধ ও 'নিজের-কোলে-ঝোল-টানা'র জীব-মাহাত্ম্য প্রকৃতির উপর প্রভুত্বকামী হওয়ার ইন্ধন যুগিয়েছে। আর তাই প্রকৃতির আজ এই দূরবস্থার জন‍্য আমরা দায়ী। তবে জড় প্রকৃতিরও প্রাণের প্রয়োজন হয়েছে তার বিবর্তনে। তাই আমরা প্রকৃতি-মায়ের আদরেরই। তবে বিকৃত ভোগবাদ ও আহাম্মকি কৃতঘ্নতা আজ আমাদের ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

    কারোর জিজ্ঞাসা হতে পারে তাই জানাই এই ট্রেনে টয়লেটের ব‍্যবস্থা আছে। আর নির্দিষ্ট যে কয়েকটি (আমাদের ট্রেনে গোটা পাঁচেক করে স্টপেজ ছিল।) স্টেশন দাঁড়ায় সেখান আপনি হালকা খাবার পেয়ে যাবেন। আমারা অবশ্য লাঞ্চটা কালকা স্টেশন প্লাটফর্মেই পেয়ে গিয়েছিলাম। যথেষ্ট ভালো ও হাইজেনিক।

    দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনকে মডেল ধরে ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে এই  টয়ট্রেন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। যাত্রী-পরিবহন চালু হয় ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জনের সময়কালে। দক্ষিণ ভারতের ওটি, আর উত্তর ভারতের পাঠানকোট সহ চারটি রুটে এখন টয়ট্রেন (ছোট লাইনের ট্রেন!) চালু আছে। এদের মধ্যে উচ্চতা ও ভয়ংকর পাহাড়ি অবস্থানের জন্যে একদিকে যেমন গিনেস বুকে এর নাম উঠেছে, তেমনি  ২০০৮ সালে শিমলা স্টেশন  ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।  এই রেল লাইনে ১০৩ টি ট‍্যানেল, ৮০০ ব্রীজের সঙ্গে কত যে বাঁক আছে তা হিসাব করা বেশ কষ্টসাধ‍্য। ৯৬ কিলোমিটার দূরত্ব পৌনে পাঁচ ঘন্টার মধ্যে অতিক্রম করা এই ঝুঁকিপূর্ণ ট্রাকে কম কথা নয়। কেউ হয়তো মনে করতে পারেন, ও বিরাট খরচ, আমরা পারবো না! না, উত্তর রেলওয়ের আম্বালা ডিভিশনের এই কালকা-শিমলা রুটে ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। আমারা ফার্স্ট ক্লাস এ সি চেয়ারকার বুকিং করেছিলাম ৫০০ টাকা মাথা পিছু। এর অবশ্য নানা মানের কোচ আছে: ইকোনমি, ডিলাক্স ও প্রিমিয়াম। সঙ্গে রাজকীয় নামও। যাবার সময় আমাদের ট্রেনের নাম ছিল 'দ‍্য হিমালয়ান কুইন'। ফেরারটা ছিল 'শিমলা-কালকা মেল'। যেতে আসতে অনেক অনেক ছবি তুলেছি। দেখেছিও প্রাণভরে দু'চোখের আশ মিটিয়ে। অর্ধাঙ্গিনীর ইচ্ছা পুরণ করতে পেরে পুত্রের সঙ্গে আমিও খুশি।

    অবসন্ন সূর্যের আলোয় আমাদের ডিজেল-চালিত ট্রেন শিমলা স্টেশনে এসে পৌঁছলো বিকেল পাঁচটা নাগাদ। কি সুন্দর স্টেশনটি! পাহাড়ের কিছুটা অংশকে কেটে সমতল করে ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিয়েই কাজ সারতে হচ্ছে। কারশেডের তিনটি ট্রাক, আর ট্রেন ঢোকা-বেরুনোর জন্য দুটি প্লাটফর্ম।

    হোম-স্টে 

    আমরা আগে থেকে তিন দিনের হোম-স্টে ব‍্যবস্থা বুকিং করে রেখেছিলাম। মূল শহর (কমবেশি ৭,২৩৮ ফুট উচ্চতা) বা ম‍ল রোড থেকে একটু দূরে হয় স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এগুলি খুব নিরিবিলি, এবং এখানে হোমলি অ্যাটমোস্ফিয়ার পাবেন। আর সামান্য একশো টাকার বিনিময়ে ওরা স্টেশন থেকেই আমাদের পিক-আপ করে। বাড়ির খাবার আপনি যেমন চাইবেন সেরকমই সার্ভ করা হয়। এমনকি অনেক হোমস্টে-তে নিজেদের মতো রান্না করে নেওয়ারও ব‍্যবস্থা আছে। রবিজীর হোমস্টে-তে আমরা ছিলাম, নাম B & B। একটি কিচেন, ড্রয়িং স্পেস, দুটি টয়লেট সহ দুই কামরার ফ্ল্যাট বলতে পারেন। ভাড়া খুব বেশি বলা যাবে না: দিবারাত্র দুই হাজার টাকা। চা/কফি, প্রাতরাশ, লাঞ্চ, ডিনার --সবই ঘরেই পাবেন। নীচের তলার গৃহস্থালিতেই সব হচ্ছে। বাড়ির মালিকই সবকিছু সার্ভ করছিলেন। আমারা হাতে-বেলা তাওয়ায়-সেঁকা রুটি, সবজি, ডিমের ভাজি আর চাওমিনের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। চাইলে আপনি ভাত-ডিম পেতে পারেন। যদিও মাছ-মাংসের চল এখানে কম, তথাপি একান্ত নিরামিষ মুখে না রুচলে ব‍্যবস্থা হয় বলেই মনে হলো।

    কুফরি চলো

    পরের দিন প্রাতরাশ সেরে দশটা নাগাদ ফোর-হুইলার করে প্রথমে কুফরি যাওয়া। রাস্তায় গ্রীন ভ‍্যালিতে ছবিতোলা তো ছিলই, সঙ্গে ড্রাইভারের ধারাবিবরণী। কুফরি-তে বরফ দেখবো ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি। মনে মনে বরফ কখন পড়বে ভাবছি, আর রোমাঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের উসখুশ ভাব দেখে ড্রাইভার ধরমবীরভাই এবার সত‍্যটা প্রকাশ‍্যে আনলেন: "এখনই বরফ-বৃষ্টি শুরু হলে যে/যাঁরা যেখানে আছেন তাঁকে/ তাঁদেরকে সেখানেই 'ন যযৌ' হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে! স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন আপনাকে এগোতে দেবে না। ফেরার মতো অবস্থা থাকলে বা রাস্তার বরফ সরানো হলে তবেই আপনি বাসায় ফিরতে পারবেন। সেটা অনেক সময় সহনীয় বা শেষ পর্যন্ত সবার কাছে আরামদায়ক থাকে না। তবে চিন্তার কারণ নেই, আঠারো দিন আগে ১ লা ফেব্রুয়ারি যে তুষারপাত হয়েছে তা টুরিস্টদের আশা পূরণ করতে যথেষ্ট।" 

    শিমলা মল রোড কুফরি থেকে ২০/২২ কিলো মিটার। 'কুফর' কথাটির অর্থ স্থানীয় ভাষায় লেক, তার থেকেই এই নাম। পাহাড় কেটে রাস্তা, রাস্তার প্রান্ত বরাবর বরফ-গলা জল, যাত্রাপথেই এদিক ওদিকে অল্পস্বল্প বরফের টুকরো রৌদ্রের আলোয় ঝলমল করছে। মূল দর্শন-স্থানে এসে দেখি বেশ অনেকটা বরফই আমাদের জন‍্য রয়ে গেছে। বরফ হাতে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে গাড়িতে চেপেই পারকিং পয়েন্টে পৌঁছে সর্বনিম্ন ২৫০ টাকার টিকিট কেটে ভিতরে যাই। বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট, কফি হাউস, স্নাক্সের দোকান। পাশেই অ্যাডভেঞ্চার পয়েন্ট। এ বয়সে আমাদের ওসব কম্ম নয়। ছেলেও এসব ব‍্যাপারে ছোটবেলা থেকেই ভীতু। ও যখন মাধ্যমিকে পড়ে তখন সামনে বল খেলার মাঠে ও গোল-কিপারের কাজটা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতো! বাকি বন্ধুরা বলের সঙ্গে ছোটাছুটি করে একটু ক‍্যালোরি ক্ষয় করিয়ে নিতো। কিন্তু নীল নির্লিপ্ত থাকতো!

    হেঁটে যতটা উপরে উঠা যায় উঠলাম, ঘুরলাম ফিরলাম। উচ্চ অবস্থান থেকে নীচের পাহাড়ি প্রকৃতি, পাহাড়ে খাঁজে খাঁজে সাজানো ছোট-বড় বাড়ি দেখতে দেখতে ঘন্টা দু'য়েক কেটে গেল। ইন্দিরা টুরিস্ট পার্ক, হিমালয়ান নেচার পার্কে ছবি তোলা হ'ল আশ মিটিয়ে। শেষে এককাপ করে  মসলা দিয়ে তৈরি ভুট্টাসিদ্ধ কফির সঙ্গে খেয়ে, কফি-চীপস সহ সামান্য কিছু কেনাকাটি করে পার্কিং লটে ফিরে আসি। 

    ফাগুতে 

    ড্রাইভার আমাদের আরো উঁচুতে তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে এলেন ফাগুতে উঠার স্টার্টিং পয়েন্ট -এ। স্থানটি বরফ-গলা জলে কর্দমাক্ত। কুফরি থেকে আরো ছয় কিলোমিটার উপরে উঠলে পর ফাগু গ্রাম। এই উপর থেকে চারপাশের উপত্যকা ছবির মতো দেখতে লাগে। এখানে রয়েছে বৈষ্ণোদেবীর মন্দির, ভক্তিমার্গের পর্যটকদের আরো এক পবিত্র পুণ্যভূমি। ওখানে নিজের জুতো জমা রেখে বিশেষ ধরনের স‍্যু পড়ে খচ্চরের পিঠে চড়ে উঠতে হবে। 

    চেইল উপত্যকায়

    আমরা ওখান থেকে চেইলের দিকে যাওয়ার কথা বললে ড্রাইভার আরও হাজার টাকা দাবি করে। (আগের চুক্তি ছিল ১৫০০ টাকা, তবে চেইল সেই হিসেবে ছিল না।) আমরা রাজি হই। উঁচু পাহাড়ি উপত্যকায় পাইন-দেবদারুর মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বর্গীয় দৃশ্য, যেন  সূর্যকে ছোঁয়ার চেষ্টা। শিমলা থেকে চুয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে এই চেইল উপত্যকা। আমরা ফাগু থেকে যাচ্ছি বলে দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে, যদিও শিমলা ফেরার সময় এই পুরো চুয়াল্লিশ কিলোমিটারই অতিক্রম করতে হয়েছে আমাদের।

    প্রথমেই যার কথা আসে তা হ'ল চেইল প‍্যালেসে। পাতিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দার সিং এবং তাঁর পুত্র যাদবেন্দ্র সিং গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ও আবাসস্থল। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে শিমলা থেকে বিতাড়িত হলে পাতিয়ালার মহারাজা এই সুন্দর মনোরম রাজকীয় মহল তৈরি করেন, যা এখন দর্শকদের জন্য আংশিকভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে। হিমাচল ট‍্যুরিজম এটিকে হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়ার ব‍্যবস্থাও করেছে। দিনের বেলায় তো বটেই রাতের বেলায় এর সৌন্দর্য মোহময়ী অবয়ব ধারণ করে।

    এই এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় দু-দু'টি  মন্দির আছে যা হিন্দু পুর্ণার্থীদের বেশি বেশি করে আকর্ষণ করে। ভৈরবনাথ মন্দিরটি একজন ব‍্যক্তি সম্পূর্ণ নিজের খরচে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। ওনার একটিই ফ‍্যামিলি এখানে বাস করেন। ওনাদের একটি নার্শারি রয়েছে পাশে মনে হল। আশে- পাশের সাত-আট কিলোমিটার দ্বিতীয় কোন মনুষ্য-বসতি দেখলাম।

    চেল থেকে শিমলার মল রোডের ফেরার সময় একটু জ‍্যামের মধ্যে পড়েছিলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ হাইকোর্ট বন্ধ হচ্ছে, পাশেই বিধানসভায় অধিবেশন চলছে শুনলাম। শেষমেষ ছয়টা নাগাদ  মল রোডের একটু আগে ধরমবীরভাই আমাদের ছেড়ে দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং-এ চলে গেলেন।

    মল রোড 

    আমরা ঘন্টা দুয়েক মলরোড ছিলাম।  দু'একটি শীত বস্ত্র আর কিছু স‍্যূভেনির কিনে ছেলের ইচ্ছে মতো সেই বিখ্যাত শিমলা মল রোডে ইণ্ডিয়ান কফি হাউসে কফিতে চুমুক দিতে ঢুকে পড়লাম।  ১৯৫৭ সালে তৈরি এই কফি হাউসে ভারতীয় উপমহাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব, সংস্কৃতি জগতের মানুষ এখানে এসেছেন। অনেক নূতন নূতন ভাবনার জন্ম হয়েছে এই কফি হাউসের আড্ডা থেকেই, ঠিক যেমন আমাদের কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস।

    এই মল রোড ও রীজ রোডের সংযোগস্থলটি 'স্ক‍্যাণ্ডাল পয়েন্ট' নামে পরিচিত। ১৮৯২ সালে  তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয়ের কন‍্যা ফ্লোরেন্স ব্রায়ান  এখান থেকেই পাতিয়ালার মহারাজার সঙ্গে গোপনে পলায়ন করে। সেই থেকেই এমন নাম! ধরমবীরকে ফোন করলে আমাদের আবার লিফ্ট পয়েন্ট থেকে তুলে নেয় ও সাড়ে সাতটার মধ্যে হোম-স্টেতে ফিরিয়ে দেয়।

    রাতভোর বৃষ্টি

    রাতে সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার সেরে শীতের উপযোগী নরম বিছানায় ঘুম। হঠাৎ রাতের দ্বিতীয়ার্ধে ব‍্যালকনির দিকে কাঁচের জানলায় শিলাবৃষ্টির আঘাতের মতো শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। সহধর্মিণী তো বেশ ভয় পেয়ে যায়। আমি উঠে পর্দা সরিয়ে দেখি বাইরে বেশ জোর বৃষ্টির শব্দ! সেও এক অভিনব অভিজ্ঞতা। হালকা হালকা বিদ্যুৎ-চমক অন্ধকার আকাশে, তাও আবার সাত হাজার ফুট উপরে জাক্কো পাহাড়ের মাথায়। তবে আমার এক দুশ্চিন্তা মনের আকাশ ঢেকে ফেলল: সকালের মধ্যে বিদ্যুৎ না এলে হাত-মুখ ধোয়া সহ প্রাত‍্যহিকীর কি হবে! যেটুকু ঠাণ্ডা জল ট‍্যাঙ্কে মজুদ ছিল তাও ভোর হতে না হতেই শেষ! তখন মনে হ'ল, শহরের প্রধান স্থানে বড় হোটেলে উঠলে অন্তত জলের বিকল্প ব‍্যবস্থা থাকতো। অবশ্য আমরা এর মধ্যে জেনে নিতে আগ্রহী হইনি বিদ্যুৎহীন অবস্থায় এই হোমে কি ব‍্যবস্থা আছে!

    এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এলো। হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহের একটি টেস্ট-ঝলক দেখে মনে একটু আশা জাগলো। তবে আমাদের প্রয়োজন মেটানোর মতো বিরতিহীন বিদ্যুৎ আসতে আরো এক ঘন্টা দেরি হয়। তারপর আমাদের হাতে যে ঘন্টা তিনেক সময় ছিল তার মধ্যে প্রাত্যহিকী ও প্রাতরাশ শেষ হয়। শুরু হয় ফিরতি-পথের ব‍্যাক-অ্যাপ। সব ব‍্যাগ-ট‍্যাগ গোছানো হলে হোমের মালিককে ডেকে হিসেব-নিকেশ করে প্রাপ্য মিটিয়ে দিও। উনিও কথা মতো আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিলেন ফোর-হুইলার করে। প্রথা মাফিক 'আলবিদা' জানিয়ে রবিজী ফিরে গেলেন!

    যদিও ট্রেন-টাইম সকাল ১১.৫৫, তথাপি আমরা ঘন্টা দেড়েক আগেই শিমলা স্টেশনে উঠে নিশ্চিন্ত হলাম। রাতে বেশ ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, ভয় ছিল রাস্তায় ধ্বস বা তজ্জাতীয় কিছু হয়! স্টেশনে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। তবে রৌদ্রের অপ্রতুলতা না থাকায় আমি ঘন্টাখানেক প্লাটফর্মের এপ্রান্ত -ওপ্রান্ত মর্নিং ওয়াক সেরে নিই। মা-ছেলে অবশ্য রিটায়ারিং রুমে বসেই কাটিয়ে দিলো। আপের ট্রেন কিছুটা লেট করায় আমাদের ডাউন ট্রেন ছাড়তে আধঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। অবশ্য রাস্তায় এইটুকু পশ্চাৎপদতা মেক-আপ করে পৌঁছে যায় কালকায়।

    ফিরতি পথের দৃশ্যপট ছিল আরো নির্মল। রাতে ঝেড়ে বৃষ্টি হওয়ার কারণে উপর থেকে আরো রৌদ্রোজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তবে একদম পাদদেশের বেশ কিছুটা ধূম্রজাল অন্য এক মোহময়ী আবহ তৈরি করেছিল। আমরা এক একটি পাহাড় দেখতে কত কত দূরে যাই। এখানে ছিয়ানব্বই কিলোমিটারই পাহাড়, একটার পর একটা!

    কথাশেষ

    এবারের ভারত-দর্শন খুবই সিলেক্টিভ ছিল। তাই আগে থেকে ঠিক করেই বুড়ো-বুড়িকে ছেলে এই কয়েকটি পর্যটন-স্থলে নিয়ে গেছে। তবে হাঁ, শ্রবণ কুমারের মতো কষ্ট করতে হয়নি!

    (তাজমহল ও ফতেহপুর সিক্রির অনেকটা অংশই পুত্র ইতিহাসের গবেষক নীলকণ্ঠ লিখে দিয়েছে।)

    ছবি/ভিডিও দেখার জন্ম এই লিঙ্কে ক্লিক করুন:

    https://photos.app.goo.gl/vMgkT75p7TCuTT6L8
    ..............
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন