এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কম্যান্ডার ও বেগম

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৪৮০ বার পঠিত

  • কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল

    পরিচ্ছেদ  (এক)

    রক্তরেখা

    সরু তলোয়ার হাতে হ্যামলেট তার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেই দেখে :
    হ্যামলেটের মা --- তুই তুই কীইইই করবি কী? মারবি? মেরে ফেললে গো!
    লর্ড পোলোনিয়াস --- কী সব্বনাশ! কে কোথায় আছ গো! (পর্দার আড়াল থেকে)
    হ্যামলেট --- এইবার! ব্যাটা ছুঁচো! মর, তোর কপালে ছিল, মর! (সরু তলোয়ার বার করে চালিয়ে দিল, ফিরেও দেখল না)
    লর্ড পোলোনিয়াস --- ও মা গো, মরে গেলুম রে। (ধপ করে পড়ে মরে গেল, যেমন থিয়েটারে হয়)
    --- হ্যামলেট ভুল করে মেরে ফেলেছিল?
    --- কাকে?

    একটা হত্যাকাণ্ড যা ভুল করে নয়

    স্যার টমাস মেটকাফ ছিলেন মোঘল দরবারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট, কিন্তু তিনি কোন মোঘল শাহাজাদাকে মারেন না। উইলিয়াম হাডসন বলে একজন ব্রিটিশ অফিসার শেষ মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর দুইয়ের দুজন জওয়ান ছেলে আর এক নাতিকে ছুঁচো বা ইঁদুরের মতো গুলি করে মারেন।

    মেজর উইলিয়াম হাডসন ‘হাডসনের তেজি ঘোড়ারা‘ বলে একটা ঘোড়সওয়ার দল তৈরি করেছিলেন আঠেরোশো সাতান্নর গদর-বিপ্লবের সময় যা আদতে ছিল এক নৃশংস মাফিয়া বাহিনী। দিল্লী পুনর্দখলের সময় তিনি হুমায়ুনের কবরে লুকিয়ে থাকা বাহাদুর শাহকে আর তাঁর দুই ছেলে আর এক নাতিকে গ্রেফতার করেন। জনতা এসে আক্রমণ করে শাহাজাদাদের ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই অজুহাতে তিন শাহাজাদাকেই গুলি করে মারেন হাডসন এক প্রাচীন দরজার কাছে। শাহাজাদাদের ল্যাংটো বা আধ ল্যাংটো শরীর সেখানেই পড়ে রইল, হিরে জহরত গয়নাগাটি যা ছিল গায়ে ও জামায়, সব হাডসনের পকেটস্থ হলো, যেমনটা যুদ্ধে হয় আরকি। তিন শাহাজাদার দেহ গরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদনী চকের পুলিশ চৌকিতে, সেখানে সবাইকে দেখানোর জন্য ফেলে রাখা হয়, লাশ পচে তার থেকে গন্ধ ছড়াতে থাকে। ফিরিঙ্গীরা চাইছিল বেয়াড়ারা সেই গন্ধে আকুলিবিকুলি করে মরুগ্গে যাক, তাতে তাদের গদর করার শিরদাঁড়া দুর্বল হবে। তারপর থেকে একসময় হুমায়ুনের তৈরি দিনপানহা শহর, যা শের শাহের হাত ঘুরে আবার সেই হুমায়ুনের হাতেই ফিরবে, যাকে পুরানা কেল্লা বলে জানে সবাই, সেখানের ওই দরজার নাম হতে থাকে খুনি দরওয়াজা। শের শাহের তৈরি করা কাবুলি বা লাল দরজার এইরূপ বদনামের কথাই লোকে মনে রেখেছে যা ফিরিঙ্গীদের খেলাপ প্রতিবাদের এক দস্তুর, আরকিই বা করতে পারে তারা?
    তিন দেহ আনার সময় পথে বা পুলিশ চৌকিতে গাদা করে রাখার পর ধুলোমাখা, তোপের গোলায় বিধ্বস্ত দিল্লীর রাস্তায় রক্তরেখা হয়েছিল কিনা সে জানার সুযোগ নেই। হলেও পিঁপড়ে আর মশা মাছিদের ইতিহাসে তা লেখা থাকবে।
    --- পিঁপড়ে আর মশা মাছিদের ইতিহাস হয়?
    --- হয় না?
    --- কী জানি।
    --- তবে?
    --- কী?
    --- প্রশ্ন করলে?
    --- করব না?
    --- করবে?
    --- পিঁপড়ে আর মশা মাছিদের ইতিহাস হয়।
    --- তবে তাই হোক আর ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা .....
    --- কী?
    --- রক্ত যা রাস্তায় পড়েছিল।
    --- রক্ত আসছে কোত্থেকে?
    --- ওই যে বললে না, গুলির ফুটো থেকে।
    --- কটা ফুটো?
    --- এটা কিন্তু পিঁ পড়ে আর মশা মাছিদের ইতিহাসে নেই!
    --- তুমি নিশ্চিত যে নেই?
    --- না,মনে হয় আরকি।
    --- থাকতেও তো পারে।
    --- পারে? কিছুই তো থাকে না। এই যেমন রক্তরেখার কথা? থাকে কি?

    দ্বিধাগ্রস্থ বাদশাহ

    জানা যাচ্ছে আঠেরোশো সাতান্নর গদরের সময়,শেষবেলার দিকে বাহাদুর শাহ জাফরের স্বপ্নে একটা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ঘুরেফিরে আসতে থাকে। হিন্দুস্থানের বড় বড় গমগমে শহরের আওতার বাইরে তখন মাঠেদেরই প্রাবল্য। সেসব মাঠ সবসময় যে হুকুমতের তাঁবেতে থাকবে এমনটা নয়, হয় সে মাঠ ক্রমে এগিয়ে, পেছিয়ে গভীর হতে থাকা জঙ্গলে মিশবে নয়ত সেখানে চারণভূমি যেখানে গরু, ঘোড়া, হাতি, উট, খচ্চর, ভেড়া, বকরি চরে চরে বেড়ায়। কেউ প্রশ্ন করার নেই কার জানোয়ার, সবার সমান হকদারী কারণ ওসব জমিন সম্প্রদায়গত। যাই হোক, শহরের বাইরের মাঠেরা কেন শেষ মোঘল বাদশাহের স্বপ্নে হরবখত দেখা দেবে এটাই প্রশ্ন। মালিক কি বুঝতে পারছেন শহরের সবকটা দরওয়াজা ঘিরে যেসব মাঠেরা সেখানে অনেক হিসেবে কষে ফিরিঙ্গি জেনারেলরা তাদের লস্কর নিয়ে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলার মতলব করে ফেলেছে? শাহেনশাহের দরবারে এখন গদরের জাহাঁবাজ সেপাইসলারদের দবদবা। তারা নানা খবর আনে ও আনায় আর সেসব শাহেনশাহকে শুনতে হবেই কারণ নিয়ম মতে তিনিই গদরের প্রধান নিয়ন্ত্ৰা যে গদর আজ শেষবেলায় বলে অলিখিত ধূসর ছায়ারা দেওয়ানি আমের জাফরি দিয়ে ঢোকা রোদের সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে থাকে। বাহাদুর শাহ বোঝেন ধূসর রঙেদের, কখন তারা আসে আর যায় দেখেন সেসব।শেষ প্রহরে এসে এতো জড়ালেন কেন? গদরের কোন কিছু কি তাঁর নিয়ন্ত্রণে কখনো ছিল? কী লাভ হলো এতো খুন খারাবায়? সেই যদি আবার ফিরিঙ্গীই ফিরে আসে তো সে আসবে শতগুণে? খুনের দরিয়া বেয়ে কোথায় যাবেন তিনি? কবির মতো, সাচ্চা শায়েরের মতো অনবরত দ্বিধার সাম্পানে দুলছেন শাহেনশাহ।

    তুম নে কিয়া না ইয়াদ কভি ভুল কর হামনে
    হাম নে তুমহারি ইয়াদ মে সব কুছ ভুলা দিয়া।

    দ্বিধা জর জর এক বাদশাহকে দেখে লাল কেল্লার বেলে পাথরদের হৃদকম্প হবার কথা।পাথর শুধু পায়ের কম্পনের জন্য অপেক্ষা করে - জয়ী ফিরিঙ্গী জেনারেলের পায়ের কম্পনের অপেক্ষায় থাকে। সে বেশ বুঝতে পারছে হিন্দুস্থানের বাগী সেপাইদের কম্যান্ড টলোমলো তাই তারা লঘুপদে হাঁটছে।হঠাৎ এক দৃপ্ত পদচারণায় লাল কেল্লার পাথরেরা কেঁপে উঠলো। কিন্তু তাদের আশংকা অমূলক প্রমাণ হয়েছিল সে দিন। দেখা গেল বাহাদুর শাহ জাফরের প্রিয়তমা বেগম জিনাত মহলের খাস অপর লিঙ্গের প্রধান মেহবুব আলি খান আসছেন। জিনাত মহল বিশেষ বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। এই গদরের ঝড় ঝাপ্টা থেকে নিজের পেটের ছেলে শাহাজাদা জওয়ান বখতকে কায়দা করে দূরে রাখতে লাল কুয়াতে নিজের মহলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বেগম। উদ্ধত মেহবুব আলি খানকে দরবারে ঢোকার মুখে আটকাতে গিয়েছিল মহলের আদবকায়দায় নতুন এক সেপাই কিন্তু তাকে প্রায় এক ধাক্কা খেয়ে সরে যেতে হয়। তলোয়ারে হাত যাব যাব করছে আর ঠিক তখনই তীক্ষ্ণনাসা বাদশাহকে বনেদী তিমুরিদ মহিমায় এক ঝলকের জন্য হলেও দেখা গেল। শাহেনশাহ শুধু বাঁ হাতটা ওপরে তুলে এক অনির্দিষ্ট ইঙ্গিতে সব থামিয়ে দিলেন। তখন হিন্দুস্থানের যাবতীয় শোর থেমে দরবারের ভেতরেও একটা তটস্থ ভাব জেগে ওঠে। মেহবুব আলি খান এই ইঙ্গিত বিলকুল চিনতেন তিনিও যাবতীয় বেতমিজি থামিয়ে কুর্নিশে আনত হলেন, শাহী খুশবু মম করছিল, অদৃশ্য সেহনাইয়ের সুর ভেসে আসছিল আর সবাই চুপ মেরে যায়। মেহবুব আলি খান বললেন, "হুজুর, বেগম সাহেব আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী, হুজুর যদি একবার মেহেরবানি করেন তো লাল কুয়ার মহল ধন্নি হয়।" জাফরের অনুমান আংরেজদের তরফে কিছু বার্তা হয়ত এসেছে বেগমের কাছে। সবাই জানে গদরের সময়টায় ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাই বেগমের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহেনশাহ জানেন অন্য অনেক কিছুর মতোই এ ব্যাপারটাতেও তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।অগত্যা জাফর জানালেন তিনি যাবেন, তবে কবে ভালো দিন আছে সে জ্যোতিষীর সঙ্গে পরামর্শ করে জানিয়ে দেওয়া হবে। শুনে মেহবুব আলি খান যেমন এসেছিলেন তেমনই গটমট করতে করতে চলে গেলেন আর যাবার সময় আবার বেতমিজির অভ্যাস হয়ত তাঁর ফিরে আসে, তিনি কোনো এক সেপাইয়ের পা ইচ্ছে করে কিনা কে জানে মাড়িয়ে চলে গেলেন। সে সেপাই উফ বলে চিৎকার করতে গিয়েও পারে না বেয়াদবির ভয়ে। আর যাতে চিনতে ভুল না করে তাই সবাই খান সাহেবের ঝলমলে পোশাক দেখে রাখে, পেছন থেকেও ভালো করে চিনে রাখা দরকার আরকি।

    লাল কেল্লা ছেড়ে

    যতই দ্বিধা থাক বাহাদুর শাহ জাফরের আসন্ন রক্তরেখা দেখতে ভুল হয়নি।ফিরিঙ্গীরা ক্রমশ লাল কেল্লার দিকে এগিয়ে আসছে মুহুর্মুহু গুলি গোলার আওয়াজ শোনা যায়। নিজের আওলাদের রক্তরেখা দেখার হাত থেকে বাঁচতে হবে।তাদের যতজনকে সম্ভব সরিয়ে দিতে হবে, নিজে সরে যেতে হবে লাল কেল্লা থেকে। প্রথমে নিজের প্রিয়তম মেয়ে কুলসুম জামানি বেগমকে গয়নাগাটি উপহার দিয়ে তাঁর স্বামী মির্জা জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে মিরাট রওনা করিয়ে দিলেন বাহাদুর শাহ।পথে অবশ্য গুজর ডাকাতের দল তাঁদের সর্বস্ব লুটে নেবে যা শাহেনশাহ জানবেন কী করে? তিনি নিজে পরের দিনই আঠেরোশো সাতান্নর সতেরোই সেপ্টেম্বর, উজিরে আজম -প্রধানমন্ত্রী আর হাকিম আহসানুল্লাহ খান আর বেগম জিনাত মহলকেও কিছু না জানিয়ে মধ্যরাতের পরে দিনের আলো ফোটার আগে লাল কেল্লার লাগোয়া ঘাটের দিকে হাঁটা দিলেন। জাফর কি মগরিবের নামাজ আদায় করতেন? শাহেনশাহ আলমগীর কে হাজারো ফাসাদে কক্ষনো গভীর রাতের ওই নামাজ কামাই দিতে কেউ দেখেনি। সে নামাজ নাকি তাঁকে জঙ্গ ফতে করার অভাবনীয় কৌশল চিনিয়ে দিত দৈব উদ্ভাসে। কিন্তু জাফর মরতে দমতক লড়ার কৌশলী নন আলমগীরের পারা আর হবেনই বা কী করে? কোথায় তাঁর টাকার জোর! কোথায় তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাখো সেপাই! জোর না থাকলে জোশ আসবে কী করে? তাই মগরিবের নামাজ তিনি আদায় করেছিলেন কিনা বা সে করে তাঁর দৈব উদ্ভাস হয়েছিল কিনা তা অবান্তর। জাফরের সঙ্গে ছিলেন গদরের অন্যতম কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল সহ কিছু আত্মীয় পরিজন আর বাছাই করা শাহী ধনরত্ন ছিল, সেই ধনরত্নের তালিকাও। কোনটা নেওয়া হলো আর হলো না তা পরিস্কার বোঝা আর বোঝানোর জন্য দরবারের কায়দা মেনে ওই তালিকা তৈরি করা হয়। দেখা গেল শাহেনশাহের সঙ্গে একটা মণিরত্ন খচিত পাল্কিও যাচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার সময় শাহী বহরকে, যাতে একসময় লাখো লোক লস্কর আর জানোয়ার থাকত, একলা নিঃসঙ্গ হয়ে পরাজয় স্বীকার করে মাত্র কয়েকটা নৌকো নিয়ে পুরানা কেল্লার জেটির দিকে আস্তে আস্তে পাড়ি জমাতে দেখা যাবে। তারপর বিষণ্ণ জাফর চললেন হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহতে। দেখা যাবে সেই দরগাহতে জাফর তৈমুর বংশীয় বাদশাহদের আচরণের বিপরীত কম্মটি করছেন।
    - বিপরীত কম্ম?
    - হ্যাঁ।
    - কিরকম?
    - শাহেনশাহ তখতে বসার সময় উত্তরাধিকারসূত্রে এক মহান দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
    - কী সে দায়িত্ব?
    - উত্তরাধিকারসূত্রে হিন্দুস্থানের মালিক তৈমুর বংশজ আর চেঙ্গিস খানের জামাই সম্পর্কে গুরকানিরা .....
    - গুরকানিরা?
    - ফিরিঙ্গীরা মোঘল বলে ডাকতে চিনিয়েছে আর তৈমুরের বংশজরা নিজেদের গুরকানি বলতেন।
    - আসল কথায় এসো, বাহাদুর শাহের কথায়।
    - হ্যাঁ, জাফর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এক পবিত্র সম্পদ রাখার বাক্স যা একমাত্র তখতে বসার পর গুরকানি বাদশাহরা পেতেন তা অর্পণ করলেন দরগাহের প্রধান সুফি সন্তের হাতে। সে সম্পদ হয়েছিল জাহানের সবার।জাফর বাদশাহের উত্তরাধিকার বিলিয়ে দিলেন।
    - কী ছিল তাতে?
    - ছিল হজরত মুহম্মদের নিজের তিনটে দাড়ি। নবীজির ওই পবিত্র দেহাবশেষ সুফির হাতে সমর্পন করে বাদশাহ নৈতিক দায়মুক্ত হতে চাইলেন। আর তা হয়ে গেল জনতার সম্পদ।
    - জনতার সম্পদ?
    - হ্যাঁ। সাধে কী নেতাজি জাফর সম্পর্কে বলবেন, “উনি ছিলেন মানুষের বাদশাহ আর বাদশাহদের দলে সাচ্চা ইনসান।“
    - কিন্তু তাড়া করে আসা ফিরিঙ্গীরা এতোসব বুঝেছিল?
    - তারা বোঝাবুঝির বাইরে।
    - তবে?
    এরপর জাফর ও তাঁর পরিজনরা হজরতের দরগাহতে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। পীরজাদারা ওনাদের দিলেন প্রাতঃরাশ। দরগাহতে রাজা আর প্রজায় ভেদ নেই সবাই সেখানে সমান খাবার পেল। সামান্য আহারে দেহের ও মনের তুষ্টির পর যে দায়িত্ব থাকে তা জাহানের সকলের জন্য আর তা কথায় প্রকাশ করতে শুরু করেন হিন্দুস্থানের শেষ স্বাধীন শাসক যিনি গদরের আগুনে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করেও ঝাঁপ দেন অনেকটা কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলের প্রেরণায়। এখন তিনি যা বলে উঠবেন তা শোনার জন্য মুখিয়েছিল আম আদমি আর দরগাহের যত সুফির দল। জঙ্গে হেরেও হিন্দুস্থানের বাদশাহের নৈতিক জোর বিন্দুমাত্র কমেছে কি? বললেন তিনি :

    আমি জানতাম কপালে দুঃখ আছে বাগী সেপাইদের জন্যই। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ ছিল আর যা সত্যি তা হতে চলেছে। আংরেজদের সামনে ওরা পালিয়ে গেল। ভাই সকল! যদিও মন পড়ে থাকে ফকিরী আর অতিন্দ্রীয় ক্ষমতায়, তবু শিরায় আমার বইছে যে মহান রক্তধারা তা শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত লড়াইয়ের কথা বলে। আমার পূর্বজরা এর থেকে খারাপ অবস্থায় পড়েও কখনো ডরাননি। কিন্তু আমি দেওয়ালের লিখন দেখতে পেয়েছি। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি বিয়োগান্ত তমসা ছেয়ে ফেলছে আমার খানদানের যাবতীয় গৌরব ঔজ্বল্য। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে তৈমুর খানদানের আমিই শেষ মালিক এ হিন্দ। গুরকানি গৌরবদীপ দ্রুত নিভে আসে ওই ; আর কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা। তাই জেনেবুঝে কেনই বা রক্তপাতের ভাগী হবো? ওই জন্য কেল্লা ছেড়েছি। এই মুলুক খোদার সৃষ্টি -খালক এ খুদা। তিনি যাকে ইচ্ছে এর শাসনভার দেবেন।
    (Primary source Mehdi Hasan, ”Bahadur Shah, his relation with the the British and the Mutiny : an objective study,’’ Islamic Culture, Hyderabad, vol 33 no 2 1959, page 95-III, as per page 370 note 61 of The Last Mughal, The fall of dynasty, Delhi 1857 by William Dalrymple )

    ফিরিঙ্গীর চাল

    শাহেনশাহকে নিয়ে পালকি এগিয়ে চলল বাদশাহের গ্রীষ্মকালীন আবাস মেহরুলির হাভেলির দিকে সেখানে গদরের প্রবীণ সেপাইসলার বখত খান হুজুরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে অপেক্ষা করছেন। দিল্লীতে যাঁর উপস্থিতির জন্য শাহাজাদা মির্জা মোঘলের গুরুত্ব কমে সেই ওয়াহাবিদের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ খান সাহেবকে মোটেই পছন্দ করেন না জাফর। তবুও এই বিপদের দিনে খানিকটা নিমরাজি হয়ে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন ওনাকে। বখত খানই সেই লোক যিনি বাদশাহকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাবেন ফিরিঙ্গীদের বেষ্টনী ভেদ করে। শাহেনশাহ আর তাঁর মহলের জান মাল রক্ষা না করতে পারলে কিসের সে অভিজ্ঞ সেপাইসালার।

    সেপটেম্বরের মাঝামাঝি দিল্লীর আশপাশে বর্ষা তখনো যায়নি। গুমগুম তোপ আর বন্দুকের ধোঁয়া সেই বর্ষায় ধুয়ে মাটিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। মাটির ভেতর ধোঁয়া ঢুকে পড়লে মাটি শিউরে ওঠে, হিন্দুস্থানের মাটি শেষ স্বাধীন বাদশাহকে বিদায় জানাতে গুমরে উঠছিল। শাহী বহর আস্তে আস্তে খাজা কুতুবের দরগাহের একান্ত সান্নিধ্যে, হাতার মধ্যেকার শাহী মহলের দিকে এগোয় তাই তাকে ধরে ফেলতে জাফরের বেয়াই শাহাজাদা মির্জা ফাকরুর শ্বশুর মির্জা ইলাহে বক্সের অসুবিধে হয়না। দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠ থেকে তিনি নামলেন। বাদশাহকে কুর্নিশ করে জানালেন বাগী সেপাইরা তখনো তাকত ধরে রেখেছে যে মিরাট লখনৌয়ের দিকের রাস্তায়, যেখানে বখত খান নিয়ে যাবেন শাহেনশাহকে, তার সবকটা রাস্তা গুজর ডাকু টুকরার দখলে আর তাদের হাত থেকে হতমান শাহী বহর কী খাজনা সামলে রাখতে পারবে? বাগী সেপাই আর তাদের সর্দার বখত খানের ওপর কতটা ভরসা রাখা যায়? যখন আলোচনা হচ্ছিল সেখানে কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলও উপস্থিত ছিলেন অন্যদের সঙ্গে, তিনি বখত খানের হাতে আগেই অপদস্থ হয়েছিলেন তাই তাঁকেও কথা বাড়াতে দেখা গেলো না। শাহেনশাহ আর শাহাজাদা দুজনেই এখানে একটা চরম ভুল করে বসলেন। এই ফ্যাসাদের মধ্যে নিঃশব্দে না চলে আর ফিরিঙ্গীদের বন্দুকের চাঁদমারী না হয়ে, নির্ভয়ে আওয়াজ তুলে ঘোড়া চালিয়ে দ্রুতবেগে আসতে পারে যে ইনসান, শুধু তাই নয় একদম ঠিকঠাক গোপনে চলা শাহী বহরের হদিস করতে পারে যে সে কর্নেল হাডসনের খাস লোক না হয়ে যায় না, এটা বুঝতে তারা ভুল করে ফেললেন। সেপাইসালার বখত খান বা তাঁর ওয়াহাবী সলাহকার মৌলভী সরফরাজ আলি যতই আজগুবি দৈব ভেল্কির চিন্তায় যুদ্ধের নিয়মকে, ফিরিঙ্গীর কৌশলকে অস্বীকার করে গদরের নিশ্চিত জয়কে গুবলেট করুননা কেন তাঁরা আর যাই হোক বেইমান ছিলেন না, যে গদরের সর্বাধিনায়ককে হাডসনের হাতে ধরিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করবেন। তাই শাহী মহলের আশপাশে জাফরের অপেক্ষা করে করে দুজনে যখন বুঝলেন ডার মে কুছ কালা হায়, আর সময় না নষ্ট করে কিষেণগঞ্জ থেকে আগুয়ান সেপাইদের কালামকে সরিয়ে নিলেন সেপাইসালার, ফলত ফিরিঙ্গী জেনারেল উইলসনের ফৌজ আটক অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে আর দিল্লীর দখল একরকম ছেড়ে আওধের পথে রওনা দিলো বাগী ফৌজ। এখনো অনেক লড়াই বাকি, এই ছিল তাদের মনের কথা। আগুয়ান সেপাইদের দেখে যত লুটেরার দল ভয়ে কাছে ঘেঁষলো না। জাহাঁবাজ বখত খান যে আসছেন সে খবর চাপা থাকে কী করে?

    দিল্লী ছেড়ে পালাও

    আসলে জাফর লাল কেল্লা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাগী সেপাইদের মন ভেঙ্গে যায় অতি দ্রুত, ফলে ক্লান্ত আর কড়া প্রতিরোধের মুখে বিভ্রান্ত ফিরিঙ্গী ফৌজ বেমক্কা জয়ের সুযোগ পায়।সুযোগ পেলে কেইবা ছাড়ে। দিল্লীর আম আদমির মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো খবর। তারা যেই শুনলো শেষমেশ লাল কেল্লা ছেড়ে খাজা কুতুবের দরগাহের দিকে রওনা দিয়েছেন বাদশাহ তারাও দুপুরের মধ্যে বেরিয়ে পড়লো বাক্স পেঁটরা নিয়ে। এরপর কী হবে তার যে কোন ঠিকঠিকানা থাকবে না না, কতো মানুষ যে মারা পড়বে লুটমারে তার অভিজ্ঞতা দিল্লীর লোকের ভালোই আছে। তারা দলে দলে গেলো আজমেরী গেটের দিকে। কিছু মানুষ অতি চালাক, তার ভাবে গুজর ডাকু লুটেরার থেকে ফিরিঙ্গীরা তবু ভালো। নিজের আহাম্মকির জবাব তারা হাতে নাতে পেয়েছিল যখন ফিরিঙ্গী দখলে থাকা কাশ্মীরী গেটের দিক দিয়ে পালাতে গেল। তাজা জওয়ান আর মরদদের বেছে বেছে গুলি করে মারে ফিরিঙ্গী ফৌজ, আওরাত আর বাচ্চাদের বেইজ্জত করে সর্বস্ব লুটে প্রায় ল্যাংটো করে তবে ছাড়ে তারা। কিছু লোক পালালো কার্নাল আর মীরাটের পথে। জাহির দেহ্লভি লিখলেন :
    হাজার হাজার সব পর্দানশীন মেয়েরা, বাচ্চারা, জওয়ান–বৃদ্ধেরা চলেছিল। মেয়েরা পর্দা টানতে ভুলেছে। সম্মানীয়া মহিলারা খালি পায়ে চলেছে, গায়ে তাঁদের চড়ানো শুধু এক চাদর।
    কোমল শরীরে তাদের দুর্ভাগা সময়ের তাপ
    চাঁদ মুখ শুখিয়েছে অসুখের ভারে
    অসহন দুখের তাপে বেআবরু ঘোমটা
    বড় আগে এসে গেলো শেষের সে দিন
    কেমনে বর্ণীব এই দুর্ভাগ্যের লিপি?
    আহা! সে তপ্ত বালু, বিছায়ে রয়েছে ওই কোমল সে নগ্ন পদতলে
    Wretchedness had spread on delicate ladies
    A pallor was seen on moon-like faces
    Woe the impropriety of the veiled women
    Doomsday had come before its time
    How do I describe the turn of its time
    Oh! That burning sand and barefoot helplessness

    (Dastan–e–Ghadar, The Tale of The Mutiny, Zahir Dehlvi, translated by Rana Safvi, page 132-33, edition 2024 )

    মির্জা ইলাহে বক্স কায়দা করে বাদশাহকে শহর ছেড়ে দূরে যেতে দিলেন না। হাডসন চাইছিলেন জাফরকে বন্দী করে নাম কিনতে।বাদশাহের গ্রেফতারের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে গেলে তিনি কি অমর হবেন না? অবশ্যই অমর হবেন হাডসন আর সেজন্য তিনি শুধু ইলাহে বক্সকে কাজে লাগিয়েছিলেন তা নয় লাল কুয়ার হাভেলিতে স্বয়ং বেগম জিনাত মহল আর তাঁর বাবা মির্জা কুলি খানকেও ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন। বেগম আর তাঁর আব্বুজান একান্তে অনেক সলা করে, অনেক দ্বিধার সাগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে জাফরের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে রাজি হলেন। হাডসন সব ডিল করছিলেন আলাদা আলাদা ভাবে। ইলাহে বক্স জানতেন না বেগমের সঙ্গে ডিলের কথা, বেগম জানতেন না ইলাহে বক্সের সঙ্গে ডিলের কথা। দুপক্ষ আলাদা আলাদা ভাবে হাডসনকে বিশ্বাস করেছিলেন। দুপক্ষের শর্তও ছিল তাঁদের নিজের লোকেদের প্রাণভিক্ষা।

    জাফর এসব কিছু না জেনেই ইলাহে বক্সের কথা শুনে পালকি হজরত নিজামুদ্দিনের দরগাহের দিকে ঘোরাতে নির্দেশ দিলেন। সেখানে তিনি জিনাত মহলের আসার অপেক্ষায় ছিলেন। লাল কুয়া থেকে বেগম এলে তাঁরা সবাই মিলে হুয়ামুনের কবরে গিয়ে মোঘল দরবারে ফিরিঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত উজিরে আজম হেকিম আহসানুল্লাহ খানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই উজিরে আজম লোকটার সঙ্গেও ফিরিঙ্গীদের দহরম মহরম ছিল। তিনি কি সবার ওপরে গিয়ে হাডসনের সঙ্গে সব পক্ষের আলাদা আলাদা ডিলের ব্যাপারে আগে থেকেই সব জানতেন? সেটা পরিস্কার হচ্ছে না কোনোদিন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে জাফর বখত খানের ওপর ভরসা না করে পুরোপরি ফিরিঙ্গীদের মাকড়শার জালের মতো ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে আটকে অথচ তিনি বা কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল কিছুই বুঝতে পারছেন না। এখন জাফরকে শাহাজাদাদের ও অন্য ঘনিষ্ঠদের নিয়ে হুমায়ূনের কবরের প্রার্থনাকক্ষে নামাজ আদায় করতে দেখা যাচ্ছে।

    পরের দিন সেপ্টেম্বরের আঠেরো তারিখ তাঁরা ফজরের নামাজে রত।একটু পরেই মধ্যদিনে পাঁচ মিনিটের জন্য পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল।বাগী সেপাই আর ফিরিঙ্গীদের আমনে সামনে লড়াইয়ের ফলে লাশের কমতি ছিল না। সেই লাশের আশপাশে রাতের বেলা শেয়াল আর দিনে কুকুর শকুনের দল এসে খানাপিনা করে।মাঝদুপুরে সেদিন রাত হয়ে গেছে ভেবে শেয়ালেরা আবার পালে পালে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে, বিভ্রান্ত কুকুরের দলের সঙ্গে তাদের মারামারি ঝটাপটি লেগে যায় শকুনেরাও চিৎকার করতে থাকে।দুপক্ষের ফৌজ আর আম আদমি গ্রহণের হঠাৎ অন্ধকারে ভয়ে আশংকায় কাঁপতে থাকে। আসন্ন রক্তরেখা দেখে বাহাদুর শাহ হুমায়ুনের কবরের মধ্যে আতংকগ্রস্থ পরিজনের মধ্যে আরো বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। সাময়িক ঘোর কাটিয়ে ফিরিঙ্গী আর তাদের ভাড়াটে শিখ, পাঠান আর গোর্খা ফৌজ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল আর বাগী সেপাই আর দিল্লীওলারা আবার পালাতে শুরু করলো।

    লাল কেল্লার পতন

    এডওয়ার্ড ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ফিরিঙ্গীরা লাল কেল্লার দখল নিলো সেপ্টেম্বরের কুড়ি তারিখ। প্রধান দরজা বিস্ফোরণে উড়ে যেতে কিছু কাঠ গোঁয়ার শাহী বন্দুকবাজ পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করতে না করতে মারা পড়ে। ফিরিঙ্গীরা তাদের দেশী ফৌজ নিয়ে প্রথমে দেওয়ান ই আম আর তারপরে জীবনে ঢোকা যায়নি সেই দেওয়ান ই খাসে লুটপাট ভাঙচুর চালায়, যে যা ইচ্ছে করতে থাকে। তাদের সবার লক্ষ্য বাদশাহ আর তাঁর পরিজনদের ধরা। কেল্লায় নেহাতই অক্ষম আর অসুস্থ যারা পালাতে না পেরে বা গোবেচারা কিছু লোক পালানোর গুরুত্ব না বুঝেই পড়েছিল, সেইসব জীবিতদের কোতল করা হয়। কিন্তু কেউই জানতে পারে না হাডসনের গোপন ডিলের কথা। জানতে পারে না কোথায় বাদশাহ আর তাঁর পরিবার। তাতে কী আর বিজয়ী ফিরিঙ্গী ফৌজের আনন্দ ফূর্তি আটকায়? সন্ধেবেলায় দেওয়ান ই খাসে জেনারেল উইলসন তাঁর ব্রিটিশ হেডকোয়ার্টারের স্টাফদের নিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে জয়োধ্বনি দিতে দিতে মদের পেয়ালা ঠোকাঠুকি করলেন। লাহোরে জয়ের বার্তা গেলো তাতে লেখা - পলাশীর প্রান্তরে ক্লাইভের বা জেনারেল জেরার্ড লেকের মারাঠা বিজয়ের মতো গৌরবের দিন আবার ফিরে এসেছে।

    বাইরে, কেল্লার বাইরে তখন মানুষের শরীরে গুলি মেরে মেরে এলাকা ফাঁকা করা চলছিল। যাকে পাবে তাকে গুলি করবে এই ছিল আদেশ কারণ এলাকা ফাঁকা করতে হবে। মানুষ রাখা যাবে না কারণ মানুষ থাকলেই তার ফাঁকে ফাঁকে গাদা বন্দুক, তলোয়ার, বর্শা থাকতে পারে। অস্ত্র তা সে যতই পুরোনো হোক তার ঘাতক ক্ষমতা ছিল আছে থাকবে। সে ক্ষমতা কম হলো কিনা কিছু এসে গেল কি? তাতে গোরা সৈন্য, ফিরিঙ্গীদের দেশী ভাড়াটে ফৌজি অজাট মাজহাবি শিখ –মাজ্বি, পাঠান বা গোর্খারা সবাই মারা যেতে পারে। পুরোনো অস্ত্রের ভেদ ক্ষমতা অনেক বেশি হয় বিশেষ করে যখন ঘর ঘর তল্লাশি, লুট, ধর্ষণ, আগুন লাগানো চলে। যখন মরিয়া একেবারে আমনে সামনে অসম দেয়ালে পিঠ ঠেকা লড়াই চলে আর সে লড়াই দিতে দিল্লীওলারা পেছপা নয় সেটা ফিরিঙ্গী ফৌজ ভালোই জানে। তাই মরদদের বেছে বেছে মারা চলতে দেওয়াই জেনারেলের কাজ, কর্নেলের কাজ, ব্রিগেডিয়ার, মেজর, কাপ্তানের কাজ তাদের কাজ হলো বন্ধ কপাট ভেঙে ভেগে সব কেড়ে কুড়ে নিয়ে সম্ভাব্য পুরোনো অস্ত্রের ধারকদের … আর যুদ্ধের নিয়ম বলছে তারা হচ্ছে যত দিল্লীওলা কিশোর থেকে বৃদ্ধ সব ধরণের মরদ তাদের মেরে ফেলা। তখন সব ধরণের জেনানাদের তীব্র কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে, যেতে থাকবে আরকি। অসহ্য সে আওয়াজ শুনে ব্রিটিশ অফিসার এডওয়ার্ড ভিবার্ট মনে করতে থাকবেন এই হতচ্ছাড়া কালা আদমিরা তো, গদরের সূচনায় আমার ব্রিটিশ বাপকে খুন করেছে টেনে নিয়ে গিয়ে আর মাকেও -বোনকে টেনে নিয়ে গেছে কুমীরের কামড়ে, পায়ের তলায় ফেলে ছটফট করতে থাকা ভাই মরেছে। ওদের সবার আর্ত স্বর বলছে মারো, বলছে সন্তানকে, আহ্বান করছে বদলা নিতে। সে সন্তান কী রক্তস্নান না করে থাকতে পারে, রক্তপান সে করবেই তবু, তবু, তবু, তবু ……
    - কিসের তবু!
    - তবু পক্ককেশ ওই বৃদ্ধকে
    - কাকে?
    - পক্ককেশ অই বৃদ্ধকে যখন টানতে টানতে এনে গুলি করা হচ্ছিল আমার সামনে!
    - তাতে তুমি পেছিয়ে আসবে?
    - যেখানেই যাবে অসহায় লোককে আর তাদের সঙ্গী সাথীদের টেনে এনে মারা চলতে থাকে। ঈশ্বর জানেন আমার অনুতাপ হচ্ছে না তবু ……

    জাহির দেহ্লভি ছিলেন জাফরের দরবারের কর্মী, কবিও বটে। থাকেন আজমেরি দরজার কাছে, রূপো লাগানো খাটে শুতেন। পালানোর সময় সে খাট থেকে কিলো দেড়েকের মতো রূপো খুলে তবে পালিয়েছিলেন তিনি। দেহ্লভি দূর থেকে যুদ্ধের আওয়াজ শোনেন। এক দুই তিন চার করে নানান যুদ্ধের আওয়াজের কথা লিখেছেন। বাগীদের কাছ থেকে সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে নানান গল্প শোনেন।সব জঙ্গের গল্প, সেপাই সব জঙ্গ ফতে করেছে এমনটা ভাব দেখায়।সে সব তিনি মিলিয়ে নেন। সেপাই যখন বললো, ‘’ এই ঘোড়াটা গোরাদের কাছ থেকে কেড়ে এনেছি।‘’ ওমনি দেহ্লভি ঘোড়ার নাল পরীক্ষা করতে বসে গেলেন। দেখে নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ, এটা ফিরিঙ্গীদের ঘোড়াই বটে, নালে আংরেজি মার্কা করা আছে। এইভাবে আংরেজি মার্কা করা ঘোড়ার সংখ্যা শহরে বেড়ে গেলো আর বলিয়ে কইয়ে সবাইকে শহীদ হতে হচ্ছে শহর দিল্লীতে। সে শহর আর্তনাদ করে উঠলো তখন -
    শহীদ হয়েছে সব জওয়ান বুজুর্গ
    সব জাতে, পরিবারে শহীদ অগণন
    বলিয়ে কইয়ে যত হতেছে শহীদ
    সারকথা তবে হলো দুনিয়ায় সবাই শহীদ
    All the young and old of the city are were martyred
    Every tribe, every family was martyred
    Every eloquent, sweet-tongued was martyred
    In short, an entire world was martyred
    ( Dastan–e–Ghadar, The Tale of The Mutiny, Zahir Dehlvi, translated by Rana Safvi, page 142, edition 2024)

    যত লুচ্চা লাফাঙ্গা, যারা এই কদিন আগে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল বাগীদের হয়ে, মাঝে মাঝে তাদের লুটের বখরাও নিয়েছে, সব ব্রিটিশের খোচড় হয়ে লোক আর লুকোনো ধনদৌলতের সন্ধান দিতে শুরু করে দিয়েছে। বেয়াড়া লোক ধরিয়ে দিয়ে মাথা পিছু দু টাকা ইনাম পাচ্ছে তারা।

    কুচা চেলানের গণহত্যা

    ব্রিটিশদের চরম ঘৃণার পাত্র মোঘল সমন্বয় সূচক সংস্কৃতির কেন্দ্র সমৃদ্ধশালী মহল্লাগুলো এই গণহত্যার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছিল ডালরিম্পল এরকম এক মহল্লার কথা বলতে গিয়ে দেহ্লভির কথা টেনেছেন।উত্তর পূর্ব দিল্লীর চাঁদনী চক ওয়ার্ডের পুরোনো দরিয়াগঞ্জের কুচা চেলান মহল্লা ছিল এরকমই এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।এখানের এক হাজার চারশো জনকে কোতল করা হয়।দেহ্লভি লিখলেন এর মধ্যে ছিলেন জগৎশ্রেষ্ঠ ক্যালিগ্রাফার মিয়াঁ মুহম্মদ আমির পাঞ্জাকাস্থি আর শায়ের মৌলভী ইমাম বক্স সেহবাই আর তার ছেলে দাস্তানগই -গল্প বলিয়ে মির নিয়াজ আলি। হয়েছিল কী, এ মহল্লায় লুটপাট চালাতে এসে তিনজন ব্রিটিশ ফৌজি মারা পড়ে নবাব মুহম্মদ আলি খানের সেপাইদের গুলিতে।ব্যাস, গোটা রেজিমেন্ট কামান বন্দুক নিয়ে চড়াও হয়ে নবাবের হাভেলি গুঁড়িয়ে মাঠ করে দিলো। গোটা এলাকায় গণহত্যা চালানো হয় তাতে কেউ ছাড় পায়নি। গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে মেরে ক্লান্ত ব্রিটিশ আর তাদের ভাড়াটে দেশীরা জনা চল্লিশ লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল যমুনার ধারে লাল কেল্লার পাঁচিলের তলায় তাদের সার করে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে মারল। বাড়ির মেয়েরা স্বামী হত্যা, সন্তান হত্যায়, বাবা আর ভাইয়ের হত্যায় পাগল হয়ে একের পর এক গভীর সব ইঁদারায়, কুয়োতে ঝাঁপ মেরে মেরে মরে পচে পড়ে রইল।সেখান থেকে তারপর আর গন্ধ গিয়েছিলো কি? সেসব কুয়ো কি পানযোগ্য জল আর দিতে পারে কোনো দিন, কো নো দিন পারলো কি দিতে? আনন্দমঠে - বিশাল অট্টালিকা মাঝে সুন্দর রমণী দেহ পড়িয়া পড়িয়া পচার কথা বলেছিলেন বঙ্কিম, সে মন্বন্তরের কথা দুর্ভিক্ষের, সতেরোশো সত্তরের মন্বন্তর।
    - তিনি কি গদরের সময় গণহত্যার কথা জানতেন না?
    - বঙ্কিম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লোক ছিলেন। তাঁর মানসিকতা আলাদা।
    - বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লোক কি গদরের গণহত্যার কথা জানত না?
    - বঙ্কিম সেপাই বিদ্রোহের সময়কার লোক ছিলেন। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লোক।
    - কিন্তু বঙ্কিম গদরের সমকার কথা লিখলেননা কেন?
    - বঙ্কিম গদরকে সেপাই বিদ্রোহ মনে করতেন, সেপাইদের বিদ্রোহ। তাঁর কি সেপাইদের পছন্দ করার কথা, তাঁর আইডিয়ায় গদর থাকবে কী করে। তাছাড়া সেপাইরাও কম অত্যাচার করেনি, তা বঙ্কিম পছন্দ করবেন কী করে?
    - বাগী সেপাইরা অত্যাচার করেছিল মেরেছিল ফিরিঙ্গীদের, কিন্তু পরিকল্পিত গণহত্যা করে কি? বঙ্কিম কী বলেন?
    - জানি না। বঙ্কিম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লোক ছিলেন। তাঁর মানসিকতা আলাদা। তিনি জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন।বাগীরা মোঘল বাদশাহকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা জাতীয়তাবাদী নয়।
    -তবে তারা কী?

    তৈমুর খানদান শেষ

    আঠেরোশো সাতান্নর বিশে সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সেপাইসালার বখত খানের ঘোড়া থামলো হুমায়ূনের কবরের কাছে। ঘোড়া থাকে নেমে তিনি চললেন বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে। কী কথা হয় দুজনে? নাকি সেখানে অন্যরাও ছিল? ছিলেন কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল? ব্রিটিশ ওরিয়েন্টাল এণ্ড ইন্ডিয়া অফিস কলেকশন্স আর ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়াম সূত্র ব্যবহার করে ডালরিম্পল একটা বয়ান খাড়া করলেন। সেটা ধরে এগোনো ছাড়া গতি নেই। দেখা যাচ্ছে বখত খান শেষ বারের জন্য বাদশাহকে অনুরোধ করছেন তার সঙ্গে লখনৌ যেতে। তখন উজিরে আজম হাকিম আহসানুল্লাহ খান বাদশাহকে যুক্তি দিচ্ছেন, "জাহাঁপনা, ব্রিটিশ ফৌজ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তাতে মালিক এ হিন্দের কী এলো গেলো হুজুর?"
    - গেলো না?
    - না হুজুর, বাগী ফৌজের সঙ্গে আপনার যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না হুজুর।
    - তবে যে বলছে ফিরিঙ্গীরা কয়েদ করবে?
    - কাকে কয়েদ করবে হুজুর?
    - আমাকে। সবাইকে।
    - জি গুস্তাখি মাফ, করবে না।
    - কেন?
    - কারণ আপনিই এই মুলুকের বাদশাহ আর ফিরিঙ্গীরা আপনার দেওয়া ফরমানে হুকুম চালায়।
    - তা তারা মানবে কী?
    - আলবাত মানবে হুজুর।

    বাদশাহ উজিরের কথায় বখত খানকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তবে ফিরিঙ্গীরা শাহী ফরমানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল। কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলের সঙ্গে বখত খানের যতই রেষারেষি থাক, তাঁর পছন্দ হয় সেপাইসালারের কথা। জঙ্গের নিয়ম বলছে এখন বখত খানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফিরিঙ্গীদের খেলাপ লড়তে লাগে। লখনৌ যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তাঁকে নানাভাবে কান ভারী করে আটকে দিচ্ছেন মির্জা ইলাহে বক্স। তবে কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল জঙ্গের নিয়মেই ভোলেন না বখত খানের আহ্বান। সে আহ্বান তাঁর কানে লেগেছিল এটা পরে বোঝা যাবে।

    সেদিন রাতেই মির্জা ইলাহে বক্স দিল্লীতে এসে হাডসনকে বাদশাহ আর কম্যান্ডার শাহাজাদা কোথায় আছেন, তাঁদের সঙ্গে শাহী ধনরত্ন এসবের তত্ত্ব তালাশ দিলেন। ফিরিঙ্গীদের মধ্যে হুটোপুটি লেগে গেলো। হাডসন জেনারেল উইলিয়ামসনকে ধরে পড়লেন, "স্যার, ধরে নিয়ে আসি?"
    - কাকে?
    - স্যার বাদশাহ জাফরকে, নইলে ভিক্টরি পূর্ণ হয়না যে স্যার।
    - মাথা খারাপ! ওই জাফর লোকটা মিনমিন করে কিন্তু ডেঞ্জেরাস। কত সেপাই, বাগী, জেহাদী, লুকিয়ে আছে জানো! কত কামান, কত বন্দুক!
    - স্যার, আমার স্পাইরা বলছে ওসব কিচ্ছু নয় স্যার। সব পালিয়ে গেছে নয় মরেছে, মরছে।
    - তোমার স্পাইরা কারা?
    - খাস জাফরের সব বড় বড় অফিসার স্যার! বিপদ বুঝে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। আয়েশি কুত্তার দল। টাকা পেলে সব বিক্রি করবে?
    - তারা কী রেগুলার পে রোলে আছে?
    - হ্যাঁ, তারা রেগুলার টাকা পয়সা পাচ্ছে আর তাছাড়া আমার ঘোড়সওয়ারদের আপনি চেনেন তো।
    - তোমার গুন্ডাদের দল। আমি একা এতো বড় ডিসিশন নিতে পারবো না।

    পরে এডজুটেন্ট জেনারেল অফ দ্য ইন্ডিয়ান আর্মি নেভিল চেম্বারলেনের, যাঁর কাজ ছিল সরাসরি ব্রিটিশ চিফ অফ আর্মি স্টাফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা,হস্তক্ষেপে হাডসনকে নিজের দায়িত্বে জাফরকে ধরার অপারেশন সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনারেল উইলসন বোকা লোক নন, তাঁর আশংকা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। হাডসনের দুই স্পাই মৌলভী রজব আলি আর মির্জা ইলাহে বক্স যখন জাফরের আশ্রয়য়স্থলের দিকে এগোচ্ছিলেন তখন জেহাদীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হলো তাঁদের। জনা চারেক সওয়ার মারাত্মক জখম হলো। এতে ভয় পেয়ে ওনারা হাডসনের কাছে ফিরে আসেন। তাঁর মাফিয়া গুন্ডা বাহিনীর জনা পনেরোকে এক শিখের নেতৃত্বে স্পাইদের সাহায্যে পাঠিয়ে চুপচাপ লুকিয়ে বসে রইলেন হাডসন ওই পুরানা কেল্লার ভগ্নাবশেষের কোনো এক জায়গায়। বাদশাহের সঙ্গে পালিয়ে আসা প্রচুর দিল্লীওলা ছিল তাদের মধ্যে বাগী সেপাই আর জেহাদীরা থাকতেই পারে। হাডসনের শর্ত ওদের ছেড়ে বাদশাহ আর তার পরিবারকে চলে আসতে হবে তবে তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত, নইলে আদেশ আছে হুমায়ূনের সমাধিতে ঢুকে গুলি চালিয়ে সাফা করার আর তখন কে বাঁচে আর মরে তার ঠিক নেই। ঘন্টা দুই চলে গেলে সব আশা যখন ছেড়ে দেওয়ার মতো হয়েছে তখনই বাদশাহ আর সঙ্গে বেগম জিনাত মহল, তাঁর ছেলে শাহাজাদা মির্জা জওয়ান বখত আর বাবা মির্জা কুলি খানকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। দিল্লীর নাগরিক প্রশাসনের প্রধান চার্লস স্যান্ডার্সের হেপাজতে বাদশাহকে তুলে দিলেন হাডসন। প্রথমে লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয় জাফরকে আর বিকেলের দিকে বেগম জিনাত মহলের লাল কুয়ার হাভেলিতে চালান হলেন তিনি।

    জেনারেল উইলসনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হা ড সন খুব একটা পাত্তা পেলেন না আগের মতোই। কলকাতা থেকে ক্যানিং বলে পাঠিয়েছেন মোঘলদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা আর এই হতচ্ছাড়া হা ডসন তাঁর নাম করে বাদশাহকে কিছু করবে না এই শর্তে পটিয়ে নিয়ে এসেছে।মেরে আনতে পারলো না! অথবা নিজেও তো গুলি খেয়ে মরতে পারত! এসব জটিল প্যাঁচালো চিন্তা বৃদ্ধ জেনারেলকে কুরে কুরে খেয়ে রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল, লড়াই এখনো চলছে যে, বাদশাহকে পাকড়ে তা কমবে কতটুকু?

    কামান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘল,খিজির সুলতান আর মির্জা ইলাহে বক্সের নাতি আবু বকর তখনো হুমায়ুনের সমাধিতে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সেখানে হাজার তিনেক সশস্ত্র জেহাদী ছিল মনে করে ব্রিটিশ সূত্র। তারা এক্ষুনি তক্ষুনি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরি। তাই ওনাদের হেফাজতে নিতে মাত্র শখানেক সওয়ার নিয়ে দুরু দুরু বক্ষে চললেন হাডসন। এবারও কো নো ঝমেলায় না জড়িয়ে শাহাজাদারা ধরা দিলেন এইভরসায় যে বাদশাহকে যেহেতু কিছু করা হয়নি, তাই তাঁরাও ছাড় পাবেন। পরের ঘটনাটা আগেই জানা হয়ে গেছে আর সেটা ঘটেছিল কাবুলি দরওয়াজার ঠিক সামনে পরে যার নাম হবে খুনি দরওয়াজা। যেখানে হাডসন নিজের হাতে তাঁর কোল্ট রিভলভার দিয়ে তিন শাহাজাদাকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারবেন। মরার সময় অন্য দেহ যা করে, যা যা করতে পারে শাহাজাদা খিজির সুলতান আর আবু বকরের দেহও তাই করে স্থির হয়ে গেলো। মির্জা ইলাহে বক্সের ট্র্যাজেডি হলো ব্রিটিশের স্পাইগিরি, খোচড়গিরি করেও তিনি নিজের নাতি শাহাজাদা আবু বকরকে গুলি খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। দেখা যাচ্ছে বেগম জিনাত মহল হাডসনের সঙ্গে গোপন ডিল করে বাজি মাত করে দিলেন, হুমায়ুনের সমাধি থেকে আগে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিজের পেটের ছেলে শাহাজাদা মির্জা জওয়ান বখত আর বাবা মির্জা কুলি খানকে। শাহাজাদা আবু বকর হয়ত বাগী বড়া ভাইদের নেওটা ছিলেন তাই আগেভাগে দাদাজানের  সঙ্গে কেটে পড়ছেন না।বাগীদের সঙ্গ করলে তো মরতেই হবে, তাই না কি? কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলের ব্যাপারটা আলাদা যেহেতু তিনি ছিলেন বাগীদের কম্যান্ডার তাই ফিরিঙ্গীর সামান্য কোল্ট রিভলভারের গুলিতে মরার সময় তাঁর রুহ গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে এসে হাডসনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাতে সাহেবের কোনো ভাবলেশ হবার কথা নয়, রুহকে- আত্মাকে কেইবা দেখতে পেয়েছে। ফেরেস্তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে জঙ্গের বাকি কর্তব্য সারতে লখনৌ চললেন কম্যান্ডার। পথে সেপাইসালার বখত খানের সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়ে গেল ফেরেস্তাদের কৃপায়। সব মন কষাকষি ভুলে তাঁরা দুজনে আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন। কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলের একটাই সমস্যা হাডসনের কোল্টের গুলি থেকে তার বুকের দু পাশে দুই ফুটো হয়ে গেছে আর তার থেকে রক্তক্ষরণ আর থামছেই না। সেটা অবশ্য জীবিত সেপাইসালার বখত খানের কাছে সমস্যাই ছিল না কারণ তিনি ওই রক্তরেখা দেখতেই পাননি।একমাত্র বাগী রুহর পক্ষেই এই আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ দেখা, বোঝা সম্ভব। কম্যান্ডার শাহাজাদা মির্জা মোঘলের রুহ জ্যান্ত সেপাইদের সঙ্গে আরো বড় এক জঙ্গে চলেছে রক্ত রেখা বেয়ে বেয়ে দিল্লী থেকে লখনৌয়ের পথে।

    সূত্র :

    ১) Dastan–e–Ghadar, The Tale of The Mutiny, Zahir Dehlvi, translated by Rana Safvi
    ২) The Last Mughal, The fall of dynasty, Delhi 1857 by William Dalrymple
    ৩) The Felt Community: Commonality and Mentality Before the Emergence of Indian Nationalism, Rajat Kanta Ray
    ৪) A Begum & A Rani: Hazrat Mahal and Lakshmibai in 1857 Rudrangshu Mukherjee
    ৫) The Broken Script Delhi Under The East India Company And The Fall Of The Mughal Dynasty, Swapna Liddle
    ৬) The Great Rebellion of 1857 in India,Exploring transgressions, contests and diversities edited by Biswamoy Pati
    ৭ ) ঝান ​​​সির রানী - প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,, রচনাবলী ১৭ খণ্ড
    ৮) আনন্দমঠ -বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    ৯) Delhi Through the Ages: Essays in Urban History, Culture and Society edited by R E Frykenberg
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৪৮০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বাবর - upal mukhopadhyay
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন