খিচুড়ি মহারহস্যের আগের কিস্তি আমরা শেষ করেছিলাম এ খানার ইতিহাসে এক মহাসন্ধিক্ষণে। এতাবৎ ব্যবহৃত প্রাচ্যের মশলা গোলমরিচকে পুরোদস্তুর সঙ্গে রেখে ও লঙ্কার হাত আলতো করে ধরা এ রেসিপি পশ্চিমের অলিন্দে খিচুড়ির প্রথম সাবধানী ‘পরিমিত’ পদক্ষেপ করালেন বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, ১৮৯৭ সালে। যে ছোট্টো ছোট্টো পায়ে চলতে চলতে খিচড়ি একদিন পৌঁছে গেল লন্ডনে টেম্স নদীর তীরে বাকিংহ্যাম প্যালেসে। কেন, কীভাবে সেসব কিস্সাও আমরা শুনব, ক্রমে ক্রমে।
ঠাকুরবাড়ির আহার। বসে বাঁদিক থেকে তৃতীয়জন রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু মজার কথা এই যে, ১৮৯৭ সালে বিপ্রদাস মহাশয়ের পাক করা ‘জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন’ ‘বাঙ্গালী’-র পাতে পড়ার পর কোথায় যে বেপাত্তা হয়ে গেল সেরহস্যের সমাধান আজও করতে পারিনি। এর ঠিক পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হল বাঙলা ভাষায় রচিত এক মহাকেতাব—আমিষ ও নিরামিষ আহার। ১৯০২ সালে। রসনা-বিলাসের ক্ষেত্রে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ ফসল। আর তা যে ঠাকুরবাড়ি থেকেই ফলবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পূর্ণিমা দেবীর কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী এ মহাকুকবুকের লেখক/সংকলক।
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী (১৮৮৪-১৯৫০)
যদি শুধু খিচুড়ির কথাই ধরা যায়, দুনিয়ায় দ্বিতীয় কোনো পাকবিধির পুস্তকে খিচুড়ির এমন মেলা আর আছে বলে আমার জানা নেই—৩৮৫ পৃষ্ঠার এই কুকবুকে রয়েছে উনিশ কিসিমের খিচুড়ে! কিন্তু কোত্থাও নেই জাহাঙ্গিরি খিচুড়ি বলে কোনোখানা।
এর একশো বছর পর প্রকাশিত হল মুক্তাগাছার জমিদার বংশে বউ-হয়ে-আসা রেণুকাদেবী চৌধুরানীর দুই খণ্ডের কুকবুকের দ্বিতীয় খণ্ড—রকমারি আমিষ রান্না। আর তাতেই ঘটল ‘জাহাঙ্গির খিচুড়ির’ প্রত্যাবর্তন। সঙ্গে আজিজুল হক খিচুড়ি নামের এক দোসরকে নিয়ে! আজিজুল সাহেবের খিচড়ির কথা অন্য আর-একদিন শুনব নিশ্চয়ই। কিন্তু খিচুড়ির দুনিয়ায় জাহাঙ্গিরের এই প্রত্যাবর্তন কী স্বাদে ঘটল? বিপ্রদাসের জাহাঙ্গিরী খেচরান্নকে তো সেবন করেছেন খানিক আগে, অতঃপর তার সঙ্গে এটিকে মিলিয়ে দেখুন নিজেই। সোজা বাংলায় লেখা—
উপকরণ: মাংস ১ কিলো, ভালো আতপচাল ৫০০ গ্রাম, সোনামুগের ডাল ৫০০ গ্রাম, ঘি ১ কিলো, পেঁয়াজের রস ২৫০ গ্রাম, দারচিনির গুঁড়ো ৫ গ্রাম, ছোটো এলাচ ৬ গ্রাম, লবঙ্গগুঁড়ো ৫ গ্রাম সমরিচগুঁড়ো ৬ গ্রাম, আদার রস ৩৬ মিলিলিটার, পরিমাণ মতো নুন, লঙ্কাবাটা ঝালের রুচিরমতো, ধনেবাটা ৬ গ্রাম।
প্রণালী: মাংসের কিমা তৈরি করে পেঁয়াজের রস, ধনেবাটা ও নুন মেখে ১ ঘণ্টা মতো ঢেকে রাখো। চাল ও ডাল ঘিয়ে ভেজে নিয়ে এতে মশলামাখা কিমা দিয়ে ও সমস্ত গুঁড়োমশলা ও এলাচ থেঁতো করে একসঙ্গে মিশিয়ে খুব অল্প আঁচে উনুনে বসিয়ে দাও। একটু ঘন ঘন নেড়ে নিতে হবে। মাংস থেকে যে জল বের হবে সেটা শুকিয়ে এলে তাতে বাকি ঘিটা গরম করে ঢেলে দাও। এইবার হাঁড়ির মুখ মোটা ভিজে কাপড় দিয়ে বেঁধে তার ওপরে একটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ঢাকনার ওপরে কিছু কাঠকয়লার আগুন বা টিকের আগুন দিতে হবে। এইভাবে ওপরে ও নীচে কাঠকয়লার আগুন দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। তারপর ঢাকনা খুলে দেখো মাংস ও চাল ডাল সিদ্ধ হয়েছে কি না। সিদ্ধ না হলে আরও একটু সময় ওইভাবে আগুনের ওপর রাখতে হবে।
দ্রষ্টব্য: এই খিচুড়ির জন্য ভালো আতপচাল অথবা পোলাওয়ের চালকে ঝেড়ে বেছে নিতে হবে।
কিন্তু যখন নজর করি যে তিনি আদার রস দিতে বলছেন ৩৬ মিলিলিটার বা ধনেবাটা ৬ গ্রাম, প্রায় নিশ্চিত হই এই পরিমাপ তিনি ওজনের অন্য কোনো মান—যেমন ‘মাশা’, ‘তোলা’ ইত্যাদি—থেকে মেট্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে লিখছিলেন।
রেণুকাদেবী চৌধুরানী (১৯০৯ – ১৯৮৫)
তিনি তাঁর লেখা ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ বইটির ‘আমার কথা’ অংশে লিখেছেন যে, তিনি ‘অনেক সাধারণ রান্না ও মোগলাই রান্না’ শিখেছিলেন তাঁর ‘কর্তাদাদা অর্থাৎ আমার স্বামীর মাতামহ রাজা জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরী’১-র কাছে। এবার এই রাজা জগৎকিশোর যেহেতু রান্নায় খুবই আগ্রহী ছিলেন, তিনি শ্রীবিপ্রদাস শর্ম্মার পাকপ্রণালী থেকেই কি এ রান্না সংগ্রহ করেছিলেন? পাকপ্রণালী কেতাব হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৭ সালে, পত্রিকা হিসেবে কিছু বছর বেরনোর পর। জগৎকিশোরের জন্মকাল আমার জানা নেই। কিন্তু রেণুকাদেবীর জন্ম ১৯০৯ সালে। কাজেই তাঁর থেকে যদি তাঁর স্বামীর মাতামহ জগৎকিশোর ৩০ বছর আগেও জন্মে থাকেন তবে তাঁর জন্ম হয়ে থাকবে ১৮৭৯ সাল নাগাদ। ১৮৯৭ সালে তাঁর বয়স ১৮ বছর। কে জানে? অন্যথায় বলতে হবে জাহাঙ্গিরি খিচুড়ির এই পাকপ্রণালীটি ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়াংশে বাংলার হেঁশেল সংস্কৃতিতে ঘোরাফেরা করছিল পরম্পরাগত ভাবে ছড়িয়ে, মুক্তাগাছার জমিদারি হেঁশেল ও বিপ্রদাসের আম আদমির হেঁশেল উভয়ই সেখান থেকে এ রান্না ধার করছিলেন।
এবার কথা হল, মুঘল বাদশা থেকে বর্ধমানাধীশ্বরের ডাকসাইটে হেঁশেল সেখান থেকে বিপ্রদাসের কলকাত্তাই হেঁশেল, মুক্তাগাছার জমিদারি হেঁশেলে এত ঘুরে বেড়িয়েও তো আমাদের মূল রহস্যের সমাধান হল না। অধরাই রয়ে গেল জাহাঙ্গিরের দিলশাদ বাজরা খিচড়ি বা লাদরা। বিশিষ্ট খাদ্য-ইতিহাসকার কেটি আচায় দাবি করেছেন, জাহাঙ্গির গুজরাটের খিচড়ি খেয়ে এতই পুলকিত হয়েছিলেন যে তার নাম রেখেছিলেন লাজ়িজ়ন, পরমোপাদেয় খানা, এবং সে খিচুড়ি নাকি তৈয়ার হত ঘি, পেস্তা, কিশমিশ আর বিবিধ মশলা দিয়ে।২ আচায়র এই উক্তিতে জাহাঙ্গিরি খিচড়ির রহস্যের সমাধান মনে করে উৎফুল্ল হলে, মহা ভুল হয়ে যাবে। কারণ এই তথ্য কোথায় পেয়েছেন তার কোনো উল্লেখ তিনি করেননি। এ ক্লু মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। আমি জাহাঙ্গিরনামার সব থেকে নির্ভরযোগ্য ইংরেজি তরজমা, হুইলার এম থ্যাকস্টোনের The Jahangirnama: Memoirs of Jahangir, Emperor of India, খুঁটিয়ে দেখেছি তাতে ‘লাজ়িজ়ন’ বলে কোনো খানার উল্লেখই নেই, বর্ণনা তো দুরস্ত্। আর এই লাদরা অ্যাডভেঞ্চারকে আরও বিপথে চালিত করেছে রুক্মিনী ভায়ানেয়ার ও পিটার রোনাল্ড ডিসুজা-র সম্পাদিত Keywords for India: A Conceptual Lexicon for the 21st Century নামক এক বিচিত্র বই। এতে জাহাঙ্গিরের এই লাজ়িজ়ন-আশিকানার গপ্পো আবার চাপানো হয়েছে রুশ পর্যটক এথেনেসিয়াস নিকিতিনের ঘাড়ে। কী মুশকিল! ভারত, পারস্য ও ‘এশিয়া মাইনর’ দেখে সে ভদ্রলোকের লেখা রঙিন সফরনামার ইংরেজি তরজমা পড়লেই যে দেখা যাবে তিনি এ যাত্রা করেছিলেন ১৪৬৬ থেকে ১৪৭২ কিংবা মতভেদে ১৪৬৮ থেকে ১৪৭৪—এর মধ্যে৩। তখন জাহাঙ্গিরের দাদুর বাবা জ়াহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর-ও যে জম্মাননি! ইন্টারনেটকেই বিনাপ্রশ্নে সর্বজ্ঞ ধরে নেওয়ার ভয়ংকর পরিণতিতে এইসব আবোলতাবোল গালগপ্পো দেখছি ছড়িয়ে পড়ছে বাঙালিখানা-কলমচিদের মধ্যেও। ওয়েবসাইট, কেতাব ও পত্রিকার সম্পাদকরা তা ছেপে দিচ্ছেন অম্লানবদনে।
নিকিতিন অবিশ্যি খিচুড়ির কথা কয়েছেন একজায়গায়, আর তা বেশ মজার, আর তা আমরা শুনবও, তবে বেশ কয়েক পর্ব পরে, এখন নয়। স্বাভাবিক ভাবেই এমন কোনো কাহানি নেই মুঘল খানাদুনিয়া নিয়ে দিব্যানারায়ণের একাধিক তন্নিষ্ঠ গবেষণাতেও। মুশকিল হল ইন্টারনেটের দৌরাত্ম্যে শেয়ার হতে হতে এই ‘লাজ়িজ়ন’ গালগপ্পো ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে, মায় বাংলাতেও! কিন্তু এর কোনো প্রামাণ্য রেসিপি বা বর্ণনা কোথাও নেই। ধন্য গুজরাটবাসী, খিচুড়ি একখানা খাইয়েছিলে বটে সেলিম বাদশাকে!
তাহলে? তাহলে গুগ্ল। গুগ্ল-এ ‘বাজরা খিচড়ি’ খুঁজতেই মিলে গেল ১ লক্ষ ৫৬ হাজার পৃষ্ঠা! চোখ বোলাতে মনে হল সিংহভাগই রাজস্থানি রেসিপি, কিছু হরিয়ানারও। চোখে পড়ল না কোনো গুজরাটি বাজরা খিচুড়ি, তবে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কোথাও, সব তো আর খুঁজে দেখিনি। এসব রেসিপি ঐতিহাসিক ভাবে কোন্ যুগের কোন্ অঞ্চলের কেউ জানে না। তবে ঐতিহাসিক কোনো কেতাবে নাই থাকুক, প্রমাণিত নাই হোক, খাস বাজরা খিচড়ি রহস্যের একটা সমাধান এ দেশের আমজনতা নিজেরাই কবে যেন করে ফেলে তাকে ভারতীয় খাদ্যপরম্পরার অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির বিপুল ভাণ্ডারে গুঁজে দিয়ে সম্মিলিত স্মৃতিতে রেখে দিয়েছে হইহই করে। সঞ্জীব কাপুর এজমানার ডাকসাইটে পাচক। একবারে নিজের সই করা সাইটে লিখে দিয়েছেন এ নাকি তাঁর এক্সক্লুসিভ রেসিপি৪ —
বাজরা খিচড়ি (সঞ্জীব কাপুর এক্সক্লুসিভ)
‘উপকরণ
জলে ভেজানো বাজরা — ১/৩ কাপ
কাঁচামুগ — ৩ টেবিল-চামচ
নুন — স্বাদমতোন
বিশুদ্ধ ঘি — ২ টেবিল-চামচ
গোটা জিরে — ১ চা-চামচ
হিং — ১/২ চা-চামচ
পদ্ধতি
প্রথম দফা — মিক্সারে বাজরা ও মুগডাল মোটা করে বেটে নিন। বাজরা-মুগডালের মিশ্রণে নুন মিশিয়ে আড়াই কাপ জল দিয়ে প্রেশার কুকারে তিন কী চারটি সিটি দিয়ে সিদ্ধ করে নিন।
দ্বিতীয় দফা — প্যানে ঘি গরম করুন। জিরে ও হিং দিন। জিরের রং বদলালেই গোটাটা সিদ্ধ বাজরা খিচড়ির ওপর ঢেলে ভালো করে মিশিয়ে নিন।
তৃতীয় দফা — কড়হি বা দইয়ের সঙ্গে গরমাগরম পরিবেশন করুন।’
শাবাশ! এতক্ষণে পেলাম এমন এক আধুনিক খিচুড়ি যাতে বাজরা আর মুগ আছে কিন্তু চাল নেই। ইতিহাসের দলিল যার হদিশ রাখেনি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে—হয়তো বা মা থেকে মেয়েতে, বাওর্চি থেকে শাগির্দে—তা বয়ে বয়ে এসে গিয়েছে একবিংশ শতকে! এও কী কম রহস্য! ঘি আর জিরে দেওয়া খিচুড়ি তো আমরা এর আগেও পেয়েছি। কিন্তু সঞ্জীব তাঁর ‘এক্সক্লুসিভ’ খিচুড়িতে দিয়েছেন এমন আর-একটি গন্ধদ্রব্য যা মধ্যযুগীয় ইসলামি ঘরানার কোনো খিচড়ির রেসিপিতে নেই। হিং। তবে আমরা শিগগিরি দেখব, খিচড়িতে হিং ব্যবহারের কৌশলটা অন্তত সঞ্জীবজি-র ‘এক্সক্লুসিভ’ নয়—বেশ প্রাচীন।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার।)