বাংলা ছোটোগল্পের আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র এই ভুবনকে আলোকিত করে রেখেছে। এইসব নক্ষত্রের মধ্যে অনেক মৃত নক্ষত্র এখনও পৃথিবীতে আলো পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি। আবার, বিপরীতক্রমে অনেক নক্ষত্র আছে, কিন্তু দূরত্বহেতু তাদের আলো আমাদের কাছে পৌঁছোয়নি। আপাতভাবে সেই নামগুলো, তাদের প্রখর সৃষ্টির পরিচয় আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যবশত অজানা রয়ে গিয়েছিল।
অমর মিত্র একটি অসাধারণ কাজ করেছেন। সেই দূরত্ব দূর করে খুঁজে বের করেছেন সেইসব উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। যেসব মণিমুক্তো ধুলোয় পড়ে ছিল, অমর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগ্রহী পাঠদের জন্য, নবীন প্রজন্মের লেখকদের জন্য, ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য সেগুলো খুঁজে গ্রন্থিত করেছেন। ধন্যবাদ ‘গুরুচণ্ডা৯’কে এই অমূল্য সংগ্রহের প্রকাশনার জন্য। প্রকৃতই উজ্জ্বল উদ্ধার করেছেন অমর। বাংলা ছোটোগল্পে মূলধারার বাইরে যাঁরা লিখে গেছেন বা লিখছেন, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই জনচিত্তজয়ী লেখা লেখেননি। সাধারণ নিয়মের বাইরে তাঁদের বিষয়, তাঁদের লিখনশৈলী। এই সময়ে বাংলাভাষায় যারা ছোটোগল্প লিখছেন, হাতে গোনা দু-একজনকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকছে, সেগুলো পড়ে মনে হতেই পারে চলাচলের নিরাপদ, প্রথাগত পথকেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন। ব্যক্তিবিশেষের গল্প বলার ভঙ্গিতে একটু উনিশবিশ হচ্ছে, কিন্তু ভয়ংকর কোনো বিষ্ফোরণ, যার তীব্রতা কাঁপিয়ে দিতে পারত সনাতন কাঠামো, গল্পবলার প্রথাগত প্রকরণকে আক্রমণ করে খুঁজে আনতে পারত নতুন কৌশল—তেমন বারুদগন্ধী বিপজ্জনক পথে প্রায় কেউ নেই। হাতে গোনা দু-চারজনের লেখায় সেই দুঃসাহসের ইশারাটুকু কখনও ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছোবার জন্য একটা আকুতি বোধহয় লেখার সময় গোপনে কোথাও কাজ করে। লেখক-পাঠক communication—দায়, সেতুবন্ধনের গোপন প্রবৃত্তি পরোক্ষে কাজ করে। সেই দায় শেষ পর্যন্ত পাঠককে একটা গল্প শোনাতে চায়। তখন সমঝোতার প্রশ্ন আসে। কেমন হবে আমার বলার ভঙ্গি, কাদের জন্য আমি গল্প লিখছি, সমাজের কোন্ শ্রেণির মানুষের কাছে আমি আমার বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে চাই, emotional factor, নাকি cerebral factor—কাকে বেশি প্রাধান্য দেব।
পুরূষ ও মহিলা। শিল্পী এম এফ হুসেন।
তখন যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবে উঠে আসে, তা হল, সাহিত্য কি একধরনের বিনোদনের উপকরণ, নাকি আমাদের জীবনযাপনে অবিরত যে সংশয়, যে সংকট আমাদের বেঁচে থাকাকে বিপদগ্রস্ত করে রাখে, তাকে উন্মোচিত করা। আমাদের বেঁচে থাকার গ্রাফ তো কখনোই সরলরেখা নয়। অজস্র উঁচুনীচু রেখা। বিচিত্র, রহস্যময়। প্রেম, অপ্রেম, ঘৃণা, ভালোবাসা, পেটের খিদে এবং যৌনতা, কাম ও ঘাম, অশ্রু এবং রক্ত—এসব কিছুই একজন লেখকের কালির সঙ্গে মিশে থাকে। এর ভেতর কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ সেটা নির্দেশ করার দায় লেখকের নয়। সে দায় সমাজসংস্কারকদের, সমাজসেবীর, গুরুদেবের, আচার্যদের, যুগাবতার মহাপুরুষদের। লেখক শুধু সত্ত্ব এবং তমঃ, আলো এবং আঁধারকে শিল্পসম্মতভাবে চিহ্নিত করেন। যদি বিনোদন হয়, তবে সে লেখায় cerebral factor–এর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে বাণিজ্যমুখীনতাই প্রধান বিচার্য বিষয়। পাঠকের ইচ্ছাপূরণের জন্য গোলগল্প চাই। পাঠকের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়ার কয়েকটা সমীকরণ থাকে। সেসব পড়ার পর একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় শুধু। কিন্তু যে রসায়নে কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদ্রি’ বা বিমল করের ‘আঙুরলতা’ গল্প চিরকালের জন্য পাঠকের মনে আসন পেতে বসে, সে রসায়ন এসব বাণিজ্যমুখী গল্পে থাকে না।
এই সংকলনের প্রথম গল্প শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গল্পটিতেই রয়েছে অসাধারণ চমক। পাঠককে ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেবার মতো ঝাঁকুনি। নীচের তলায় প্রেমিকা এবং হতে-পারে শালিদের নিয়ে ফূর্তি করছে রাজেনবাবু। পাড়া ঘিরে চিরুনিতল্লাশি চালাচ্ছে সিআরপি জওয়ান। বুটের লাথি আর রাইফেলের কুঁদোর গুঁতো খেয়ে চিৎকার করে উঠছে আশপাশের ঘরের মানুষজন। রাজেনের ভেতরে ভিতু মধ্যবিত্ত, যেমন-আছে-থাকুক নীতিতে বিশ্বাসী মন এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। একজনকে মিলিটারি দোতলা থেকে ছুড়ে নীচে ফেলে দিয়েছে। তার মাথা থেকে কিছুটা ঘিলু এসে রাজেনের চায়ের কাপে পড়েছে। রাজেন ভাবছে দরজায় ধাক্কা পড়লে তাকে গিয়েই দরজা খুলতে হবে—এ বাড়ির লোকজন সে ভাবেই পরামর্শ করে তাকে এই সন্ত্রস্ত বাতাবরণের ভেতরে আটকে রেখেছে। শালি, প্রেমিকা, প্রেমিকার বউদি, সবাই মিলে হবু জামাইকে নিয়ে মস্করা করছে। অনুভবী পাঠক বুঝতে পারেন এই তামাশা আপাত তামাশা। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় (পাঠকেরও) এইবার এই দরজায় বুটের লাথি পড়বে। তার মাঝেই প্রেমিকার মুখে রাজভোগ গুঁজে দিচ্ছে রাজেন। অদ্ভুতভাবে গল্পের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছেন লেখক। একদম বিপরীতধর্মী দুটি তল তৈরি করে তাদের ভেতরে ঘর্ষণ এবং তার ফলে উৎপন্ন দ্বন্দ্ব এই গল্পের রহস্য। চারজন নারী ও একজন পুরুষের আমিষ-ঘেঁষা রঙ্গ-রসিকতা চলছে এক ঘরে। উলটো দিকের বাড়িতে চলছে রাষ্ট্রের নিপীড়ন। ‘কোরাস কান্নার শোরগোল’। রাজেনকে আশ্বস্ত করছে তার প্রেমিকা আভা। ‘মন্টু বলে দিয়েছে এ বাড়িতে পুলিশ আসবে না। লিস্টের বাইরে।’ আমরা, যারা সত্তরের দিকে ঝুঁকে পড়েছি, একদিন বিশ্বাস করেছিলাম শ্রীকাকুলাম মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে, সদর দপ্তরে কামান দাগতে হবে, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শুনেছিলাম—তারা জানি এ রকমই হয়েছিল। রাতে পুলিশের জিপের পেছনে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে থাকত কংগ্রেসি দালাল। বাড়ি চিনিয়ে দিত। সেই ইতিহাস খুব সাঁটে কয়েকটি লাইনে বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক। ভেতরের ভয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শেষ পর্যন্ত রাজেন নারীশরীরের কাছে মুক্তি চেয়েছিল। আভা তখন আর তার প্রেমিকা নয়, যে-কোনো নারীশরীর। জোর করে তাকে নিয়ে ফাঁকা ঘরে শুয়েছিল রাজেন। ভয় থেকে পরিত্রাণের আর কোনো পথ ছিল না। অসাধারণ নির্মাণ। একদিকে সময়কে চিহ্নিত করা, অন্য দিকে মানুষের সংশয় ও সংকট। অসাধারণ এর পটভূমি নির্বাচন, নির্মাণশৈলী। এমন গল্পই পাঠকের অস্তিত্বে ঝাঁকুনি দেয়।
আসলে যখন কোনো রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা আমাদের বেঁচে থাকাকে, আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে, তখন শিল্প, প্রধানত সাহিত্য এগিয়ে আসে তার লড়াই নিয়ে। ভাষাকে, অক্ষরকে হাতিয়ার করে সমস্ত মানুষের চেতনাকে, তার বোধের কাছে লড়াই করার বার্তাটুকু পৌঁছে দেয়। এ লড়াই, বুঝতেই পারছেন, বন্দুককামান নিয়ে লড়াই নয়, মনুষ্যত্বহীনতা, লোভ, হিংসা, জাতিদাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা—যা এই সমাজকে, সভ্যতাকে পেছন দিকে টানে, তাকেই চিনিয়ে দেন লেখক।
আসলে সংশয় এবং সংকট। আমাদের বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত এই সংশয় এবং সংকটে আক্রান্ত। আমরা কোনো সময় এর স্বরূপ স্পষ্ট বুঝতে পারি। যেমন ধরুন, আর্থিক দৈন্য, জীবিকার অনিশ্চয়তা, পারিবারিক সংকট, সামাজিক পীড়ন, আমার চেয়ে যে শক্তিশালী, তার কাছ থেকে নিত্য অপমান ও লাঞ্ছনা—এসব দিয়ে তো আমরা প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হচ্ছি। দু-ধরনের খিদে সেই আদিম কাল থেকেই মানুষকে আক্রমণ করে এসেছে। পেটের খিদে আর যৌন চাহিদা। যে সমস্যাগুলোর কথা বললাম, সেগুলো আর আমাদের বেঁচে থাকা—এদুটোকে যদি দুটো তল কল্পনা করি, তবে প্রতি মুহূর্তে এই দুটি তলে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়ে চলেছে। এই ঘর্ষণ থেকেই শিল্প জন্ম নেয়। মসৃণ জীবনযাপনে কোনো শিল্প তৈরি হয় না। ফুটে বেরনোর, ফেটে পড়ার কোনো রসায়ন সেখানে কাজ করে না। দ্বন্দ্ব ছাড়া বিকাশ হয় না, এ তো বৈজ্ঞানিক সত্য।
আর-এক ধরনের সন্ত্রাসও খুব গোপনে মানুষের বেঁচে থাকায় কাজ করে। রাষ্ট্রীয় পীড়ন, রাজনৈতিক চাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা, প্রাণঘাতী অসুখের ভয়, দুর্ঘটনার আশঙ্কা। ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিয়েছি, তারপর যদি কোনো খারাপ খবর আসে? আমাদের বেঁচে থাকায় যে উষ্ণতা রয়েছে, এসব ফ্যাক্টর এক ধরনের হিমশীতল ভয় আমাদের বিপদগ্রস্ত করে রাখে। একজন গল্পকার এসব চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। একটা গল্প-কাঠামোর ওপর এসব উপাদান দিয়ে গল্পপ্রতিমা নির্মাণ করেন। একমেটে হয়, দোমেটে হয়, রং চাপানো হয়, গর্জন তেল মাখানো হয়। ডাকের সাজের শেষে একটি ছোটোগল্প ঝলমল করে।
এই সংকলনের প্রতিটি গল্পে রয়েছে সেই সংকটের কথা। বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসে এই গল্পগুলো অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। এসব লেখা কখনোই প্রতিষ্ঠানের প্রসাদধন্য হয় না। তাদের অসাধারণ সৃষ্টিগুলো অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে সেই দীপ্তি, সেই মহিমাকে উপস্থিত করেছেন অমর মিত্র। এ কাজ ভগীরথের কাজ। অজস্র ধন্যবাদও সেখানে নগণ্য। কী শক্তিশালী এক একটি গল্প কালের ধুলোয় হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য তেমনই সতেরোটি গল্প অমর খুঁজে এনেছেন। প্রতিটি গল্প তার নিজস্ব ভঙ্গিতে অনন্য। হতবাক হয়ে গেছি শৈবাল মিত্রের খয়ের খাঁর ইন্তেকাল, নকুল মৈত্রের মুণ্ডুহীন মানুষের চলাফেরা, সোমক দাসের ঘন শ্যামবাজার, সমীর চট্টোপাধ্যায়ের মলয়ের চারপাশে পড়ে। পড়ার সুযোগ হয়েছে রমেন চক্রবর্তী, ব্রজমাধব ভট্টাচার্য, চণ্ডী মণ্ডল, জ্যোৎস্নাময় ঘোষ, অবনী ধর, প্রিয়তোষ মুখোপাধ্যায়, প্রভাত চৌধুরী, অসীম চক্রবর্তী, কানাই কুন্ডুর লেখা। প্রতিটি গল্প প্রথাগত নির্মাণের বাইরে, অথচ পাঠকের মনোযোগ টানটান ধরে রাখে।
সমীর চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে মলয়ের চারপাশে যা ঘটে গেছে, সেটা বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে কিছু অস্পষ্ট ঘটনাপ্রবাহ মনে হয়। মনে হয় বাস্তবে শিবু নেই, ডুপ্লিকেট বিজন ভট্টাচার্য নেই। যেন একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখে উঠল মলয়। সমীরের কথাতেই বলি—“মলয়ের মনে হয়েছিল, আমাদের প্রত্যেকের পায়ে অসংখ্য দড়ি বাঁধা আছে। শৈশব, স্মৃতি, ভালোবাসা, পরিবার, বন্ধুতা, বিশ্বাস, যৌনতা... ‘পছন্দমত নির্বাচন করো’—এই ক্যাপশনের সামনে নিয়নবাতি জ্বলছে, নিভছে। এ খেলার নীচে কোনো জাল পাতা নেই।”
বেঁচে থাকার কথা, সংকটের কথা এ ভাবেই লিখেছেন সমীর। সপ্তদশ অশ্বারোহীর মতো সতেরোটি গল্প এসে আঘাত করেছে আমাদের এই থোড়-বড়ি-খাড়ার গল্পজগতে। অনেক ধন্যবাদ অমরকে। অনেক ধন্যবাদ গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনাকে।