১
আটপৌরে একটি রেস্টুরেন্টের কাপল টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে সাইদা। সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে বন্ধু নীল এসেছে। খুব বেশি বিশেষ বন্ধু। অনেক অনেকদিনের আলোচনা শেষে আজ হয়ত একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে ওদের সম্পর্কের নামকরণে।
নীল জানিয়েছিল, ঢাকা শহরের কুখ্যাত জ্যাম যেন কিছুতেই আমাদের সময় খেয়ে না ফেলে। কাছাকাছি সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় এরকম কোন কফি শপ হলে ভাল হয়। সাইদারও গোপন ইচ্ছে বন্ধুকে আরেকটু বেশি সময় কাছে পাওয়ার। অনেকটা সময় নিয়ে গল্প করার। কিছুটা হলেও নিজেদের আরও একবার ভাল করে জেনে নেবে। শরীর পারমিট করলে বাধা দেবে না। ওরা তো টিনএজার বা তরুণ নয়। মতে না মিললেও ভবিষ্যতে যেন ভাল পড়শি হয়ে থাকতে পারে। মন-পড়শি। মসজিদ মন্দিরের সামনে দিয়ে নিত্য হেঁটে যাওয়া সেইসব দিলখুশ মানুষদের মত যারা ইদের নামাজ বা দুর্গাপুজোর উৎসবকে সানন্দে উপভোগ করে। বছরে একবার দুবার দেখা হবে। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের কয়েকটি দিন না হয় উড়ে যাবে ওদের বেহিসেবি আনন্দে।
সাইদা জানিয়ে দেয়, লেকের ধারে খুব ঝকঝকে নয়, কিছুটা ঘরোয়া কিন্তু আপন গন্ধমাখা এ রেস্টুরেন্টের কথা। দূরত্বের মাপে এখানে আসতে ওদের সময় ক্ষেপণ হবে না। আর, সময় বাঁচলে গল্প যে কেবল লম্বা হবে শুধু তা নয়, ডালপালা ছড়িয়ে ঝোপালো হয়ে উঠতে পারে!
নাম বলতেই চিনতে পারে নীল। চেনা জানা লোকেশন। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে, তোমার চয়েসকে সেলাম সু। আমি চিনি। চিনি গো। খানিকটা হেরিটেজ টাচ আছে। নাইস প্লেস। থ্যাংকু থ্যাংকু…
পূর্বপুরুষের দেশে এলে সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে এখানে কফি পান করে গেছে নীল। এদেশে ওর প্রচুর বন্ধু। টলটলে, তরুণ, ব্রিলিয়ান্ট এবং ভাল মনের অনেক কবি গল্পকার নাট্য কর্মী মেয়ে বন্ধুরাও আছে। তবু নীল সাইদাতেই নীলাভ হতে চাইছে। জীবনের বাকি সময়ের জন্যে গিট্টু বাঁধতে দু’বছর ধরে ওরা চেষ্টা করে যাচ্ছে! এবার পুজোর ছুটিতে সাইদা ডেকেছে। হাসতে হাসতে বলেছে, জানো তো দূরবর্তী কাশবন ঘনঘোর গাঢ় লাগে!
নো স্মোক জোনের কর্ণার টেবিলে বসে ভূমেন্দ্র গুহ এর ‘আলেখ্য: জীবনানন্দ’ বইটির পাতা উল্টেপাল্টে দেখছিল সাইদা। মন লাগিয়ে কষে পড়তে হবে বইটি। ওর বহু বহুদিনের ইচ্ছে, ইচ্ছে না বলে অভিলাষ বলাটাই ঠিক হবে, কবি জীবনানন্দ দাশের অসুখী জীবনের জন্যে কেবলমাত্র লাবণ্য দাশকে দায়ী করে তার কপালে দেগে দেওয়া একমেবাদ্বিতীয়ম কলঙ্ক তিলক মুছে দেওয়ার।
কী জন্যে শুনি? যে স্ত্রী হাসপাতালে পড়ে থাকা মরণাপন্ন স্বামীর সেবা তো দূরের কথা, দেখতে পর্যন্ত অনিচ্ছা দেখিয়েছে তার জন্যে এত টান কেন তোর? নিজেকে সাইদার প্রেমিক ভাবা মুস্তাক রেগে মেগে জানতে চেয়েছিল।
শান্ত মেজাজে ওর কাছে জানতে চেয়েছিল সাইদা, তোর বউ কোন সাবান ব্যবহার করতে ভালোবাসে তুই কি জানিস?
চরজাগার মত মুস্তাকের সদ্য উত্থিত ভুঁড়ি টুকি দিচ্ছে। টাক ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াসে প্রাণান্তকর। তবু আত্মবিশ্বাসের লাটিম হাসি দিয়ে জানায়, ওই ডাভ ছাড়া আর কী! বডির জন্যে হার্ড ডাভ আর হাতে পায়ে মুখে লিকুইড বাটার ডাভ।
এক্সেলেন্ট! টেন আউট অফ টেন। এবার বল ফিজিক্যালি তোর…
কফির উপর ক্রিম দিয়ে আঁকা মিউ বিড়ালের ছবিটা স্পুন দিয়ে সরিয়ে ফেলে এবার পাক্কা প্রোগ্রোমারের মত মুখ করে মুস্তাক, এই তুই কি আমারে দিয়ে জীবনানন্দকে ম্যাপ করছিস নাকি! তাইলে জেনে রাখ দু-পিস ছেলেমেয়েও হয়েছিল ওদের। যদি ফিজিক্যালি হ্যাপি না…
থাম। বাচ্চা পয়দা করতে জানলেই যদি হ্যাপি কাপল হয় তাহলে তুই তোরা অসুখী কেন? এত সুখে থেকেও তোদের বউরা কেন বয়ফ্রেন্ড পোষে আর তুই গার্লফ্রেন্ড খুঁজিস টাকলা গাধা!
মুস্তাক পরাজিত সৈন্যর মত হাত উঁচু করে হেসেছিল, ওরে থাম থাম! আসলে কি জানিস, জীবনানন্দ দাশ বিয়েটা না করলেই ভাল করত। সংসার তো রাজ্য পত্তনের সমান। তাতে অর্থ যেমন লাগে তেমনি মনের জোরও লাগে। খালি উত্থিত লিঙ্গতে ওসব কুলায় না। ওই যে মহামতি আলেকজান্ডার বলে গেছেন না, প্রেমিক বা স্বামীর অর্থকড়ি ধনসম্পদ না থাকলে বিয়ের পর জানালা…
কে বলে গেছেন? মুস্তাকের কাছ থেকেই উপহার পাওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর লেখা বই দিয়ে ওর মাথাটা আচ্ছা করে ঠুকে দিয়েছিল সাইদা। এখানে এই টেবিলে। গত সপ্তাহে ওদের আড্ডা জমেছিল।
২
নির্ধারিত সময়ের কুড়ি মিনিট উতরে গেছে। নীল এসে পৌঁছাতে পারেনি বলে বিরক্ত লাগছে না। এ শহরে এটাই স্বাভাবিক। হয়ত কোথাও থির হয়ে জমাট বেঁধে আছে বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, রিক্সা। একচক্ষু রাক্ষসের মত অনন্তকাল চেয়ে আছে লাল সিগন্যাল বাতি। ওই জ্যামের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে কোন মোটর সাইকেল বা স্কুটি। ফুটপাত সচকিত করে চালক খানিকটা পথ এগুতে পারলেও বেদম গালিগালাজ খাচ্ছে হকার আর পথচলতি মানুষদের কাছ থেকে। ব্রিলিয়ান্ট বুদ্ধি হল, এরকম সময় বুদ্ধ বুদ্ধ মুখ করে নির্বিকার আর মৌন থাকতে হয়! সোনার চেয়ে দামি সময় বাঁচাতে আম পাবলিকদের ওরকম দু-চারটা কাঁচা গালাগালিকে পাত্তালে খ্যাচ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাতে আরও দেরি হয়ে যায়। জ্যাম যন্ত্রণায় সাইদা নিজেই গাড়ি ছেড়ে স্কুটি নিয়েছে। ধারে কাছের কাজগুলো আগের চেয়ে এখন কম সময়ে করে ফেলতে পারে বলে ফালতু টেনশনে পড়তে হয় না।
সরি সাইদা, আটকে গেছি। তুমি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছ! নীলের বিপন্ন ভদ্র কণ্ঠস্বর। জানিয়ে দেয়, হচ্ছি না। একটা বই পড়ছি। তুমি এসো। মনে মনে বলে সাইদা, আজ তোমার দিন নীল।
আলেখ্য: জীবনানন্দ বইয়ের পঁচাত্তর পৃষ্ঠায় কথঞ্চিৎ অবজ্ঞার সুরে ভূমেন্দ্র গুহকে কবি জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ বলেছিলেন তোমার দাদার চেহারা এমন কিছু রাজপুত্তুরের মত ছিল না যে ছবি টবি তোলানো টোলানো ব্যাপারে বিশেষ মাথাব্যথা রাখতে হবে।
সময়টা ছিল শোকের। কবির মৃত্যুর মাত্র কয়েকটি দিন গত হয়েছে। কবি অনুরাগীরা শোকসভা করবে। সে কারণে কবির একটি একক ছবি পেলে ভাল হয়। অথচ কোথাও ছবি পাওয়া যাচ্ছে না কবির। স্ত্রী-ভাই-বোন কারও কাছে, এমনকি ছবি তোলায় অপারদর্শী হলেও নিজের রঙ চটা পুরোনো বক্স ক্যামেরায় যত্রতত্র যার তার ছবি তুলতে ভালবাসতেন কবির যে ছোট বোন সুচরিতা দাশ, তাঁর কাছেও তাঁর কবি দাদার কোনো একক ছবি নেই। তাতে অবশ্য সুচরিতার কোনো দোষ হতে নেই। কিন্তু বাড়ি ভর্তি শোকার্ত আত্মীয়-পরিজন, ভক্ত-অনুরাগী বন্ধু গুণগ্রাহী। কবির আত্মা অদৃশ্য আলয়ে থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাড়ির সিঁড়ি-ঘর, ছাদ, রুম আর তালা বদ্ধ কালো ট্রাঙ্কের জাদু বাস্তবতার গর্ভে। সেই শোকাকুল পরিবেশে কবির একান্ত অনুরাগী, দুঃখ-তাপে বিক্ষিপ্ত সদ্য কবি স্নেহ থেকে চির বঞ্চিত বিষাদাচ্ছন্ন ভূমেন্দ্রকে ঠাস করে কথাগুলো বলে দিলেন কবি জায়া দুষ্ট লাবণ্য দাশগুপ্ত। তুচ্ছতার তবক লাগানো গ্লানি কলঙ্কিত ওই মুহূর্তে ঠোঁট টিপে কি অস্বস্তি চেপেছিলেন ট্রাঙ্ক বন্দি মাল্যবান? তিনি তো জানতেন, পৃথিবীর শেষ ঘুঘুটিও যদি গেয়ে যায় মরণ গান, কিছুতেই বদলাবে না লাবণ্য দাশ!
সাইদার বিশ্বাস স্বামীর কর্মহীনতা নিত্য অভাব অনটন আর যাপিত জীবনের চাওয়া পাওয়ার বৈষম্যে মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিলেন লাবণ্য গুপ্ত। বাবা-মা হীন এতিম লাবণ্যের পাশে কেউ ছিল না। তিনি স্বামীকে চেয়েছিলেন সুহৃদ সবল কর্মে উদ্দাম পুরুষ হিসেবে। খুব কি অপরাধ ছিল এ চাওয়ায়?
অথচ নিরন্তর আত্মমগ্নতায় বিভোর থেকে আত্মীয়পরিজন লেখালিখির আশীর্বাদ ছাড়াও স্থায়ী কর্মহীন কবি পেয়েছিলেন শোভনাকে!
একানব্বই সালের এক রাত। সাইদাদের বাড়িতে অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা ছোটখালার কাছে প্রচুর বিরক্তি নিয়ে ও জানতে চেয়েছিল, খালামনি এমন বাজে একটা লোককে তুমি কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে বল তো দেখি!
সোনার কঙ্গন ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছোটখালা বলেছিল, এতিম ছিলাম যে। তোদের বাসায় পরগাছার মত থাকতাম। দেখেছিস তো রান্নাঘরের ফ্লোরে ঘুমতাম। মাঝে মাঝে তোর ঘরে। ব্রেন ভাল ছিল। তাতে কী! খর্চার ভয়ে কেউ পড়াশুনার ভার নেয়নি। তোর ছোটখালু চেহারা স্বভাবে দেখতে রাজপুত্রের মত না হলেও আমি তো খেয়ে পরে নিশ্চিন্তে আছি। ভাল আছি।
খেয়ে পরে? শুধু খাওয়া আর পরার জন্যে? সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সাইদার মন।
ছোটখালু কেবল দেখতে অসুন্দর ছিল তা নয়। অসহ্য বিরক্তিকর স্বভাবের একজন লোক ছিল। খাওয়ার সময় বিশ্রী ছপছপ শব্দ করে চিবত। বোন প্লেট ইউজ না করে টেবিলেই এঁটোকাঁটা ফেলে রাখত। খাওয়া শেষে প্লেটে হাত ধুয়ে পেট টান করে ঘেউঘেউ করে ঢেঁকুর তুলত। খকখক করে ডাইনিং-এর বেসিনে সর্দিকাশি ঝেড়ে ভাল করে ক্লিন করত না। মাঝে মধ্যে বাথরুম নোংরা রেখে চলে আসত। সবচেয়ে বেশি রাগ লাগত যখন টিভি দেখতে দেখতে সশব্দে বাতকর্ম করে ছোটখালাকে ডেকে বলত, এট্টা ইন্টাছিট আনি দেও তো মুনিরা। গ্যাস জমি পাইখানাডা আটকি গেছে প্যাটে।
খালুকে দেখলে বাসার সবাই আতঙ্কে থাকত। যদিও মাত্র একদিনের জন্যে বেড়াতে আসত। অই একদিনেই বাসা শুদ্ধ আমাদের ওয়াক থু অবস্থা হয়ে যেত। অবশ্য যাওয়ার সময় খালুর মানিব্যাগ খুলে মুঠো ভরে টাকা নিয়ে ছোটখালা সাইদাকে বলত, তোর ইচ্ছে মত বই কিনে নিস বুনো। আপা দুলাভাইয়ের অবস্থা তো দেখছিস। ঝগড়া করিস না মা।
স্বামী গর্বে উদ্ভাসিত হয়ে লাবণ্য কি এমন দান কখনও কাউকে দিতে পেরেছে! পারেনি।
বরং বারবার আওয়াজ খেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের নাভিমূল থেকে দুয়ো উঠেছে সহায় সম্বলহীন বিধবার হাহাকার নিয়ে। কবির মৃত্যুর পর… হয়ত বাংলা সাহিত্যের জন্যে অনেক কিছু রেখে গেলেন কিন্তু আমাদের জন্যে কী রেখে গেলেন? লাবণ্য দাশের এ হাহাকারটিকে স্বার্থপরতার মোড়কে মুড়ে কুবাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজও ভাসছে। অথচ দুটি সন্তানসহ বিধবার অবস্থানটি কেউ বুঝতে চায়নি। তখনও না। এখনও না! লাবণ্য তাই বন্য নিষ্ঠুর দুর্মুখ রুগি। কোন চিকিৎসা হয়েছিল লাবণ্যের?
তুই কি পাগল? কে করবে ? ড্রাই ফ্রুটের অর্ডার দিয়ে বলেছিল মুস্তাক, কপালও ছিল লাবণ্য দাশের! ছেলেটা তো জানিসই। মেয়ে মঞ্জুশ্রীও…
পঁয়তিরিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। চেনা ওয়েটার এক বোতল পানি আর মেনু বই নিয়ে জানতে চাইল, চা খাবে কিনা! খুব বেশি চা খায় না সাইদা। নইলে এতক্ষণে এক কাপ রঙ চা খেয়ে নিত। অদ্ভুত ভাল রঙ চা বানায় এরা। পিওর হানি কালার। তাতে দুলে দুলে ভাসে ইটালিয়ান বেসিলপাতা। সোনার কাঠির মত কয়েকটি লবঙ্গ থাকে। দারুণ টেস্ট। নীল এলেই খাবো না হয়। তারচেয়ে বইটা পড়ি ভেবে মগ্ন হয়ে যায় সাইদা।
৩
হাই সাইদা। অ্যা য়াম নীল উইলসন হাওয়ার্ড।
হঠাৎ আলো হয়ে উঠল নো স্মোক জোন। দেড় ফুট টেবিলের ওপাশ থেকে দুখানি হাত প্রসারিত করে হাসছে যে, সে পঁয়তাল্লিশের এক প্রৌঢ় যুবক। বহুবার দেখা চেহারা। অবশ্য ভার্চুয়াল। এবার একেবারে সামনে। কেমন যেন থ্রিল জাগে ওর। পঁয়তাল্লিশের একলা শরীরে তীব্র গোপন অনুনাদ জেগে ওঠে। গলে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে বেকুবের মত হেসে ফেলে, এদেশে ওসব হাগফাগ চলে না নীল। আরাম করে বসে পড় প্লিজ।
অহো এক্সট্রিমলি সরি। ভুলে গেছিলাম নব্বই পার্সেন্ট মুসলিমদের দেশে তুমি বসে আছ। আমি হয়ত শুধু হাগ করে থেমে থাকতে চাইতাম না সু! উষ্ণ হচ্ছি তোমাকে দেখে।
স্বল্প চুল। লম্বা জুলফি। সেখানে দু-একটা মুক্তো রঙ সাদা চুল জ্বলজ্বল করছে। গলার বয়েস রেখার ভাঁজে ঘাম জমেছে। জামার কোথাও কোথাও ঘামে ভেজা। তার মানে পাবলিক বাসে করে এসেছে। তারপর আসাদগেট নেমে হেঁটে এসেছে এখানে। বেচারা। নীলকে ওর চেয়ারটা ছেড়ে দেয় সাইদা। ওর পেছনেই এসি। ঠান্ডা বাতাস সরাসরি এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল।
ওহ্ নো ইট উইল বি…
ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে সাইদা। নীলের চোখে বিমোহন। এবার আরাম পাচ্ছে। জামার কলারটা খানিক টেনে ঢিলেঢালা করে দেয়। পানির বোতলের মুখ খুলে গ্লাস টেনে মৃদু হাসে, জানো বার বার কেন বাঙালি বিশেষ করে বাংলাদেশি নারীদের কাছে আমি ফিরে আসি? এই কেয়ারটুকু পাওয়ার জন্যে।
মন রাখা প্রশংসা বা যাই হোক হাসি মুখে গ্রহণ করে সাইদা, এবার কী নিয়ে লিখছ? গেল সপ্তাহে তোমার নিবন্ধটা পড়েছি।
কেমন লাগল? লাইন ঠিক আছে তো?
ফ্রুট আইসক্রিমের অর্ডার দেয় সাইদা, অতিরকমের অতিরিক্ত লাগল। তোমার লেখা বদলাচ্ছে।
মানে?
রাজনৈতিক সমালোচনা নেই। ব্যক্তিগত আক্রমণে শাণিত। অবশ্য তোমার পার্টি যদি কবুল বলে তো তুমি তাদের জামাইরাজা।
নীল হো হো করে হেসে ফেলে। বাঁধানো দুটি দাঁতের রুপোরঙ ঝলসে ওঠে দারুণ আনন্দে। কমরেড না বলে সাইদা যে ওকে জামাইরাজা বলেছে সেটি খেয়াল করে না বা ইচ্ছে করে এড়িয়ে যায়।
ওদের আলোচনা বিশ্ব মানচিত্র ঘুরে এমন একটি বিষয়ে এসে ঠেক নেয় যার জন্যে কিছুটা প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম ভূতল উতল থেকে সাইদা নীলকে দেখে। দেখে বললে ভুল হবে। অনেকটা যেন যাচাই করে। বিবাহ বিচ্ছিন্ন। এক পুত্রসন্তানের বাবা। নারী-সঙ্গ বঞ্চিত নয়। নীলের পোস্টে কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। কেউ কেউ ইনবক্স পর্যন্ত কামনার আশ্লেষ ছড়িয়ে ভাসিয়ে দিতে চায়। সাইদাও নীলের লেখা দেখে। দ্বিমতে কড়া কমেন্ট দেয়। তাতে নীলের কোন অনুযোগ থাকে না। প্রতিদিন একবার দু’বার মন চাইলেই ওদের কথা হয়। কথার রাজা নীল। কিভাবে যেন অন্য একটি সম্পর্ক ওদের মধ্যে চারিয়ে গেছে।
হিরে বসানো আংটি সাইদার আঙুলে পরাতে গিয়ে অনুনয় করে নীল, হ্যাঁ বল সাইদা। আমি তোমার কোনকিছুতেই অধিকার ফলাবো না। শুধু বছরে একবার দু’বার দু-পাঁচ বা সাত দিনের জন্যে তোমার সাথে সংসার করতে আসব। তুমি লিস্ট করে দিবে আমি বাজার করে আনব। বেসিনের কল, এসি ফ্যানের রেগুলেটর ঠিক করে ঘরটাকে আমাদের গন্ধে ভরিয়ে রাখব। আমার স্পাউজের ঘরে লেখা থাকবে, সাইদাতুলন্নেসা নীল।
হাসতে হাসতে আংটিটা পরে নেয় সাইদা। দ্বিতীয় বারের মত হিরে উঠল ওর আঙুলে। একটি কন্যা সন্তান আছে ওর। ক্যাথারিন। ইংল্যান্ডে বাবা আর স্টেপ মা মেলিন্ডা এবং সৎভাই কায়সারের সাথে থাকে। ভাল আছে। ব্রিটিশ বাঙালি পরিবার হলেও মেলিন্ডা এশিয়া অনুরক্ত। সাইদার প্রথম স্বামী আনিস কায়সার এখন খুব সুখী।
আংটিটা দেখতে দেখতে সাইদা হাসে, দ্যাট এটারন্যাল ড্রিম। এরপর বলবে না ত, ঘর কেমন খালি খালি লাগে, একটা বাচ্চা হলে… আমি কিন্তু পঁয়তাল্লিশ এবং ন্যাচারাল নিয়মে বন্ধ্যা।
নীল ওর বুকের ভেতর সাইদার হাত জড়িয়ে রাখে। উষ্ণ বিবশ কিছু মুহূর্ত। গলে যাচ্ছে। গলে যাচ্ছে সাইদা। যতখানি আশ্লেষ জমে ছিল কামের ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে ওদের শরীর জুড়ে। ঘন দুটি চুমু খাওয়ার ঘনিষ্ঠ আবেগের মুহূর্তে করুণ সুরে বেজে ওঠে নীলের মোবাইল। স্ক্রিনে হৃষ্টপুষ্ট একজন লোকের ছবি। হয়ত অবাঙালি। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নীল রিসিভ করে এবং এরপরেই উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, সরি সু জাস্ট ওয়ান…
নারকেল গাছ বেয়ে উঠে গেছে জায়ান্ট মানি-প্ল্যান্ট। বিশাল হলদেটে পাতা ছুঁয়ে পাটের শিকায় ঝুলিয়ে রাখা লাল-নীল নকশা আঁকা মাটির হাঁড়ি পর্যন্ত হেঁটে এসে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে নীল। কিছুটা উত্তেজিত। আগের কথাগুলো কী ছিল বোঝা যায়নি কিন্তু, ফাকিং রিলিজিয়ন, কাট দেম… ‘অল দে আর বাস্টার্ড’ বলে নীল যখন টেবিলে ফিরে এল তখন ওর চোখ মুখ জুড়ে ঘৃণার লাল ছিটে দপদপ করে জ্বলছে।
ট্রিং শব্দে ইনবক্স দেখে সাইদা। মুস্তাক লিখেছে, শুয়োরের বাচ্চারা হিন্দু বসতিতে আগুন দিয়েছে। এখুনি প্রতিবাদ চাই। লেখা দে দোস্ত।
৪
আংটিটা নীলের হাতে দিয়ে ওর হাত ধরে রাখে সাইদা। চুমু খায় উষ্ণ কম্পময় হাতে, মুখে ঘাড়ে, আমরা বন্ধু থাকব নীল।
ঝুঁকে আসে নীল। অনেকখানি ঝুঁকে গলাভাঙা সারসের মত ঘস-ঘস করে জানায়, ঘৃণাটা পেরুতে পারলাম না সু। আমার ধর্ম বদলেছে দু’পুরুষ আগে। আমি এখন এশিয়ানও নই। তবু রক্তের ভেতর গেঁড়ে থাকা সংস্কারকে মুছে ফেলতে পারলাম না। এই যে তোমার রিলিজিয়ন! কী যে ঘৃণা করি। অথচ তোমাকে ভালবাসি। ভীষণ। ভীষণভাবে…
বিচ্ছিন্নতার বাতাস ধেয়ে আসছে। দূরত্ব বাড়িয়ে জিতে যাচ্ছে ঘৃণা। সাইদার কান্না পায়। নীলের বুকের ভেতর জড়িয়ে থেকে কান্না চাপে, জানো এই লেক পাড়ে বেত ঝোপ, হিজলের সাথে শুনেছি একটি রক্তপলাশ গাছও আছে। যাব? যদি খুঁজে পাই!
দুমড়ে মুচড়ে ধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে তোলে নীল, এই সন্ধ্যায়?
রেস্টুরেন্টের বাইরে লম্বা ঠোঁটের মত একটি রাস্তা চলে গেছে মেন রোড পর্যন্ত। ওপারে বাসস্ট্যান্ড। বায়ে পাখনার মত ছড়িয়ে আছে লেকউন্মুখ একটি শর্ট রাস্তা। ঘৃণা আর ভালোবাসায় দোলায়মান নীল সময় নেয়। ইচ্ছে করলে বাস ধরে চলে যেতে পারে। কিন্তু সাইদা…