কেমন আছে ওরা? – এ এক জটিল প্রশ্ন এবং আপেক্ষিক। উত্তরের কাছাকাছি আপনাকে পৌঁছতে হলে জানতে হবে আগে তাহলে তারা কেমন ছিল! মুশকিল হচ্ছে, এই আগে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের তেমন কোন মাথাব্যাথা নেই। প্রতিটি দিনই আগের দিন হয়ে যায় পরের দিন ঘুম থেকে উঠলে। মাঝে মাঝে অদেখা, অচেনা, বা আগে না শোনা ব্যাপার চলে এলে, আমরা খবরের কাগজ দেখে নড়েচড়ে উঠি – তারপর নানা তত্ত্বকথা, বহু হ্যাজানো। সবাই যে ভুলভাল লেখেন এমন নয় – কিন্তু বেশির ভাগই অর্ধেক ছবি, ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে যা হয় আর কি।
ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতা কী? এই ধরুন, যদি বলি এই বারে গ্রামের দিকে (অন্তত বর্ধমান এবং হুগলী জেলায়) পুজোর বাজার একদম খারাপ। কারণ মানুষের হাতে একদম পয়সা নেই। এই পর্যন্ত শুনে বেশির ভাগ লোকেই ধারণা করে নেবেন, এর মূলে তাহলে কোভিড! হ্যাঁ, কোভিডের প্রভাব নিশ্চয়ই আছে – কিন্তু পুজোর বাজার খারাপ হওয়ার কারণ আরো একটু জটিল। এর মূল কারণ এবারে আলুর দাম নেই। গতবারে আলুর খুব দাম ছিল – তাই কোভিড থাকলেও পুজোর বাজার কিন্তু গ্রামের দিকে খুব একটা প্রভাবিত হয়নি।
কিন্তু সারা বছর তো আর পুজো চলবে না! গত পুজোয় সব একটু ঠিক হল এবং কিছুদিন পরে কোভিড আবার ফিরে এল প্রবল ভয়ঙ্কর আকারে। তাই সেই সময়টুকুতে গ্রামের দিকে ছোটখাট ব্যবসায়ীরা কেমন ছিল? ভাবলাম, একটু খুঁজে দেখা যাক – কথা বললাম আমার পিসির ছেলের সাথে অরবিন্দ-র সাথে। ওকে আমরা বলি অর-দা।
অর-দা অনেক দিন হল ব্যবসা করছে, একেবারে নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছেলে। ওদের চোদ্দ পুরুষেও কেউ কখনো ব্যবসা করেনি – কলেজ লাইফ থেকে অবসর নিয়ে, গিটার বাজানো শিকেয় তুলে রেখে নেমে পড়ল ওষুধের দোকানের কাজ শিখতে, মাঝে কি একটা ডাক্তারের নার্সিংহোমে কিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করে কিছুদিন। কোনো দিকেই সেটল না হলে, সবশেষে খোলে কাপড়ের দোকান। বলতে নেই, পুরোপুরি নিজের ব্যবসা-বুদ্ধির জোরে, এবং নিজের পরিশ্রমে আজ ব্যবসাটাকে খুব ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। একটা দোকান থেকে আরো একটা দোকান বাড়িয়েছে। আমরা মাঝে মাঝেই ওকে খোঁচা দিই – “যা-তা কামাচ্ছিস তো! কথায় বলে, সুতোর আর জুতোর দামের কোন ঠিক নেই – তা তোর ব্যবসা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। মঙ্গলহাট থেকে ২০ টাকার মাল কিনে ১০০ টাকায় বেচছিস!” তবে সেই সবই ছিল ফ্রেন্ডলি লেগ-পুলিং যাকে বলে।
কোভিডের ব্যাপার স্যাপার অর-দা যেমন একদম ঠেকে শিখেছে, সেই দুর্ভাগ্য অনেকেরই হয়নি (আর যেন না হয়!)। ২০২০ সালের মার্চ মাসের কথা – কোভিড এসেছে ভারতে, কিন্তু কেমন ছড়াবে বা কোভিডের প্রভাব কি তা কেউই জানে না। তার আগের বছর দাদা আমার পুজোর বাজারে বিশাল কামিয়েছে – আমাদের বাড়িতে পুজোর সময় এলে বললাম,
-“কি রে, ফ্যামিলি নিয়ে একটু ঘুরতে-টুরতে যা – শুধু পয়সাই কামিয়ে গেলি! লাইফ আর কবে এনজয় করবি”!
অবশ্য আমার বলার জন্য নয় – কারণ সে আমি বহুদিন আগে থেকেই বলে আসছি ওকে – কিন্তু কি জানি, কি মনে হল, বিশাখাপত্তনম যাওয়ার প্ল্যান করল সেই মার্চ মাসেই। বেড়াতে যাওয়ার আগে ফোন করল একদিন,
-এই, তোর বৌদি বলল বলে ফোন করলাম। এই পরিস্থিতিতে কি বেড়াতে যাওয়া ঠিক হবে?
-সেটা আমি কি করে বলব? তুই কি আমার কথা শুনে চলবি নাকি?
-আরে শোন না, তোর বৌদি বলছে সুকান্ত বললে তবেই নাকি ট্রেনে চড়বে!
-বলিস কি রে! এ তো বিশাল চাপে ফেলে দিলি!
-তুই তো ঘুরছিস, দেখছিস চারিদিকের খবর – কি মনে হয়, যাওয়া ঠিক হবে তো?
-দেখ, আমি বলতে পারব না শিওর কি হবে। তবে কেস সুবিধার নয়। এই দেখ না, আমার তো ১৯শে মার্চ আমেরিকা যাবার টিকিট ছিল, ক্যান্সেল করে দিলাম।
-কিন্তু ভাই, এই অনেক দিন পরে প্ল্যান করেছি। এবারে না গেলে আবার কবে যাওয়া হবে কে জানে! ব্যবসা ছেড়ে যাওয়া কি চাপের বুঝতেই তো পারছিস।
-এবার বাইরে গিয়ে যদি আটকে যাস কোন কারণে?
-প্রচুর টাকা নষ্ট হবে রে! সব বুক করা আছে – কেউ টাকা ফেরত দেবে না বলছে।
-আচ্ছা, সেইটা আগে বলবি তো! টাকার মায়া আর ছাড়তে পারলি না।
-অ্যাই শোন না, তোর বউদি ফোন করলে কিন্তু – তুই যেতে বারণ করছিস – এমন বলিস না ভাইটি আমার।
-আমার কথার যে এত মূল্য তা জানতাম না তো!
-যাই হোক, আমি তোর বউদিকে ম্যানেজ করছি – তুই কিছু আলাদা করে বলবি না
আমিও কিছু আর আলাদা করে বলি নি। দাদা, বৌদি আর ভাইজি বেড়াতে গেল ভাইজ্যাগ। ফেরার দুই দিন আগে থেকে লকডাউন! অনেক চেষ্টা করেও ফেরার টিকিট পেল না। ঋষিকুন্ডা বিচের কাছে এক বাঙালি-পরিচালিত হোটেলে ছিল – সেখানেই আটকা পড়ল। এর পরের গল্প অনেক লম্বা – সেই নিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে। মোট ৫০ দিন ছিল লকডাউনে আটকা পড়ে সেই হোটেলে – বসে বসে সারাদিন সমুদ্র দেখত! জানি না ঠিক কতদিন পরে সমুদ্র পুরানো হতে শুরু করেছিল – বা আদৌ পুরানো হয়েছিল কিনা! মাঝে মাঝে আমার সাথে কথা হত – বলেছিল স্থানীয় প্রশাসন খুব সাহায্য করেছিল। রেট বাড়িয়ে হোটেল যাতে মানুষকে অসুবিধায় ফেলতে না পারে – বা খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা যাতে আর না হয়, সবই দেখেছিল স্থানীয় প্রশাসন।
একসময় রাজ্যের বর্ডার খুলল – কিন্তু ট্রেন চালু হল না। স্পেশাল পাশ নিয়ে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত সম্ভব হল। কিন্তু দাদা আমার ট্রেনের জন্য ওয়েট করছে – ফোনে কথা হলে বললাম, “তুই আর রিস্ক নিস না – টাকা খরচ হবে তো কি হবে, গাড়ি ভাড়া করে চলে আয়”। কিন্তু মনস্থির করতে পারছে না দাদা। কিছু দিন পরে বৌদি সরসরি ফোন করল আমাকে, বলল “তোমার কি মনে হয়? গাড়ি নিয়ে যাব?” আমি এবার সরাসরি বললাম, “দাদাকে আমি বললাম তো যে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসতে।” ব্যস, সেই শুনে হালকা দাম্পত্য রাগারাগি – বৌদি গাড়ি করেই ফিরবে, আর ট্রেনের অপেক্ষা করতে রাজি নয়। অবশেষে দাদা সেই হোটেলেই আটকে পড়া হুগলি জেলার আরো দুটো ফ্যামিলির সাথে কথা বলে শেয়ার করা গাড়িতে বাড়ি ফিরল ভাইজ্যাগ থেকে।
অর-দা আমাকে মাঝে মাঝেই বলে, “সুকান, তুই তো সবাইকে নিয়েই লিখিস – আমার ব্যবসাটা নিয়ে লেখ না একদিন”। মজা করেই বলে – আমি চেষ্টা করলেও কিই বা আর করতে পারব! আমার আর পরিচিতি কতটুকু। কোভিডের জন্য দাদার ব্যবসা বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত – আরো অনেক ক্ষুদ্র এবং ছোট ব্যবসায়ীদের মত। তা গুরুচণ্ডা৯ কর্তৃপক্ষ যখন বলল, পুজো সংখ্যায় ‘ওরা কেমন আছে’ – এইভাবে কোভিডকালের ব্যবসায়ীদের কথা ছাপাতে ইচ্ছুক – তখন মনে এল দাদার ব্যবসার কথা।
এই লেখায় আমি ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতাতেই জোর দিয়েছি – তাই একদিন এক প্রশ্নমালা তৈরি করে দাদার ইন্টারভিউ নিলাম। তবে এ শুধু আমার দাদার একার কাপড়ের ব্যবসার গল্প নয় – ওর কথা, ওই অঞ্চলের বাকি ক্ষুদ্র এবং ছোট কাপড়ের ব্যবসায়ীদের জীবন কথা – এই ভাবেই এখন আছে তারা।
সাক্ষাতকার দিলেন:
অরবিন্দ ঘোষ,
“ঘোষ ছিট মহল এ্যান্ড রেডিমেড সেন্টার”, গুড়াপ বেলতলা, হুগলি,
মোবাইল ফোন: 9932848142
ফেসবুক পেজঃ Ghosh Chhit Mahol