খুব বেশি দিন আগে নয়,মাত্র বছর দুয়েক পেছনে গিয়ে কেল্লার প্রধান প্রবেশপথ দক্ষিণ দরওয়াজা পার করে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ত ঘণ্টা ঘর সফেদ মসজিদ সংলগ্ন খোলা চত্ত্বরে অজস্র গাড়ি, বাস গিজগিজ করছে।তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে ওয়াসিফ মঞ্জিল পার করতেই দেখা যেত সারি দিয়ে রাস্তার দুই পাশে টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে,কানে ভেসে আসতো টাঙ্গা ওয়ালাদের গলা ' ও দাদারা দিদিরা চলুন সব সাইট সিন ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবো অল্প দামে ' ৷ এর মধ্যেই চোখে পড়ত বেশ কিছু টাঙ্গা যাত্রী বোঝাই করে টম,টম শব্দ করে পর্যটকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে গন্তব্যে।এবার আরো কিছুটা এগিয়ে মতিমহল ঘাট থেকে একটি রাস্তা সোজা বালাখানার দিকে যায়, সেই রাস্তা দিয়ে গেলে চোখে পড়ত বেশ কিছু হোটেল, যাত্রী আবাস, সেখানে অসংখ্য মানুষের কোলাহলে কেল্লার সেই পরিবেশ মুখর হয়ে উঠত। নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার পাহাড় বাগানের পেছনে চোখে পড়ত বহু টাঙ্গা সাথে রাখা সাথে বহু ঘোড়া দাড়িয়ে থাকত। এরপর সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে রাস্তার দুই পাশে ভিড়ে ভরা ভাতের হোটেল যাত্রী আবাস চোখে পড়ত। অন্যদিকে ওয়াসিফ মঞ্জিল থেকে মতিমহল ঘাটের সামনে দিয়ে সোজা হাজারদুয়ারি যেতে গেলে রাস্তার দুই পাশে পড়ে অজস্র দোকান, দোকানের পিছনের দিকে দুটি নৌকা ঘাট,নৌকা গুলি পর্যটকদের নিয়ে কেল্লা থেকে মতিঝিলে যেত। রাস্তার দুই পাশের দোকান গুলির মধ্যে নানান সৌখিন দ্রব্যের দোকানই বেশি,সেই সঙ্গে রয়েছে চায়ের দোকান,ভাতের হোটেল, পানের দোকান,আইস্ক্রিম কোল্ড ড্রিঙ্কসের দোকান,ফুচকার,ঝালমুড়ির দোকান,গাড়ি,বাইক পার্কিং
চাঁদনী চক দিয়েও কেল্লায় ভেতর প্রবেশ করা যেত । কিম্বা ত্রিপোলিয়া গেট পার করে আরো কিছুটা এগিয়ে সরাসরি কেল্লার ভেতরে হাজারদুয়ারিতে প্রবেশ করা যেত। ত্রিপোলিয়া গেট পার করে এই রাস্তা দিয়ে কেল্লায় এলে রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়ত ভিড়ে ভরা ভাতের হোটেল, গাড়ি পার্কিং এর জায়গা গুলিতেও বহু গাড়ির লম্বা সারি,এসব পার করে এসে হাজারদুয়ারি চত্ত্বরে প্রবেশ করতেই দেখা যেত লোকারণ্য চারিদিক।বহু মানুষ প্রাসাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, বসে ছবি তুলতে ব্যস্ত।অন্যদিকে বহু মানুষ মাঠের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। কেও মাঠের ভেতরে রাখা বেঞ্চে বসে গল্প করছে। ভেতরে অসংখ্য গাইড পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে, গাইডরা পর্যটকদের আশ্বস্ত করতেন যে, সব কিছু সুন্দর ভাবে তাঁরা বুঝিয়ে দেবেন, গাইডদের আসে পাশেই ঘুরতে দেখা যেত সাদা ইউনিফর্মে বহু ফটোগ্রাফার তাঁরা বলতেন ' মুহূর্তেই ছবি তুলে প্রিন্ট করে দেবে অল্প দামে '।এর মধ্যেই কেল্লার ভেতরে মানুষের ভিড়ে কিছু ইরানি চশমাওয়ালি চশমা ফেরি করে বেড়াত।
সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো আসা কোভিড দু বছর আগের সমস্ত ছবিই সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।দুটি লকডাউনের ধাক্কায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল সমগ্র কেল্লা নিজামত এলাকা।কেল্লা জীবন্ত হয় পর্যটকদের আগমনে, পর্যটকরা শুধু কেল্লার জৌলুশই বৃদ্ধি করে না সেই সাথে কেল্লার ভেতরের অজস্র সাধারণ মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যমও হয় তাঁরা।কিন্তু লকডাউনে সব কিছু বন্ধ থাকায় কেল্লা পর্যটক শূণ্য হয়ে পড়ায় কেল্লার টাঙ্গাওয়ালা,নৌকার মাঝি, টোটোওয়ালা, হোটেলওয়ালা, রেস্টুরেন্টওয়ালা, আইস্ক্রিমওয়ালা, ফুচকাওয়ালা,ছোট হকার, সৌখিন দ্রব্যের দোকানদার, চাওয়ালা,পার্কিং ব্যাবসায়ী, সবাই হঠাৎ করেই জীবিকা হারায় ৷ সবাইকেই চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। সব থেকে দূর্বিসহ অবস্থা হয় কেল্লার ভেতরের গাইড, টাঙ্গাওয়ালা, সৌখিন দ্রব্য বিক্রেতা,পার্কিং ব্যাবসায়ী,হোটেল- রেস্টুরেন্টওয়ালা ও নৌকা চালকদের।কারণ তাদের জীবিকা ছিল সম্পূর্ণ পর্যটক নির্ভর।
সব থেকে করুণ অবস্থা হয়েছিল টাঙ্গাওয়ালাদের।টাঙ্গা সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদ(লালবাগ) শহরেই বর্তমানে চালু আছে। ইংরেজদের হাতধরে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুর্শিদাবাদ শহরে টাঙ্গা গাড়ির প্রচলন হয়।প্রথম দিকে শুধুমাত্র ইংরেজ ও নিজামত পরিবার সহ শহরের রাজা জমিদারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ঘোড়ায় টানা এই বাহন , পরবর্তী সময়ে মোটর গাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে , শহরের উচ্চবিত্তরাও মোটর গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হলে , ঘোড়ায় টানা গাড়ি জনপ্রিয়তা হারায় ৷কিন্তু তখন থেকে জনসাধারণের যানবাহন হিসেবে টাঙ্গা গাড়ি পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে আজ একদা রাজধানী শহরে শুধুমাত্র পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য টাঙ্গা গাড়ি পুরনো ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে রয়েগেছে। বহু টাঙ্গা চালক নতুন হলেও কিছু টাঙ্গা চালক দুই তিন পুরুষ ধরেই টাঙ্গার সাথে যুক্ত। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় টাঙ্গা চালকদের আয় নির্ভর করে সম্পূর্ণ পর্যটকদের উপর, পর্যকট মরশুমে কারো কারো দিনে হাজার টাকাও আয় হয়।কিন্তু বর্তমানে ব্যাটারি চালিত রিক্সায় শহর ভরে যাওয়ার ফলে তাদের আয় অনেকটাই কমে গিয়েছে। শুধুমাত্র যেসব পর্যটকরা ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে আগ্রহী , তাদের ওপর ভরসা করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় মুর্শিদাবাদের টাঙ্গা চালকদের।কিন্তু দুটো লকডাউনে টাঙ্গাওয়ালাদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে।তাদের দৈনিক আয় একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ে।অন্যদিকে টাকার অভাবে ঘোড়ার খাবারও কেনার মতো অবস্থাও থাকে না।ফলে কেল্লার মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসে ঘোড়াদের।কিন্তু এভাবে শুধু ঘাস খাওয়ার ফলে অপুষ্টিতে ভুগে বহু ঘোড়ার মৃত্যুও হয়েছে।
লকডাউনের সময়ে এই সমস্ত ব্যাবসায়ীদের সারাজীবনের জমানো সম্পদ শেষ হয়ে যায়,অন্যদিকে যাদের কোনো জমানো অর্থই ছিলনা তাঁরা ধার-বাকি করে কোনো রকমে সংসার চালিয়েছেন, অনেকে আবার পেশা পরিবর্তন করতেও বাধ্য হয়েছেন ৷ আপদকালীন সময়ে অনেকেই রাস্তায় রাস্তায় চা বিক্রি করেছে, কেও আবার মাছ বিক্রি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কেল্লার ব্যাবসায়ীরা শুধুমাত্র নয়। লকডাউনের প্রভাবে সমগ্র কেল্লা আগাছার জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছিলো। যে মাঠ এক সময় নানান ফুল ও পাতা বাহারে ভরা থাকত সেই মাঠ লকডাউনের সময় জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।রাতের বেলা তো দূরের কথা, দিন দুপুরেই হাজারদুয়ারি চত্বরে বিষাক্ত সাপ বিচরণ করত।
অবস্থা পরিবর্তন হতে শুরু করে ২০২১ এর আগস্টের প্রায় মাঝামাঝি থেকে।এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে কেল্লার ভেতরে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হলেও এবারের শারদ উৎসবের মরশুমে সেই পরিমাণটা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে সমগ্র মুর্শিদাবাদ শহর তো বটেই কেল্লাও যেন সেজে উঠছে।কেল্লার ভেতরের জমে ওঠা জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে, পর্যটকদের কোলাহলে আবার হাজারদুয়ারি ইমামবাড়া চত্বর মুখর হয়ে উঠেছে। পর্যটকদের আগমনে কেল্লার সেই হারানো জৌলুশ যেন আবার ফিরেছে।কেল্লার অগণিত কর্মজীবীরা তাদের জীবিকায় পুনরায় ফিরছে,আবার টাঙার টম টম আওয়াজে ভরে উঠছে কেল্লা, কেল্লার ভেতরের মতিমহল ঘাট ও চক ঘাটে পুনরায় নৌকা চলাচল চালু হয়েছে। কেল্লার ভেতরের হোটেলগুলোতে আবার পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ছে, হাজারদুয়ারি চত্ত্বরে শুরু হয়েছে আবার গাইড, ফটোগ্রাফারদের রমরমা,সেই সাথে যুক্ত হয়েছে টিকিটওয়ালারাও ৷ এতদিন হাজারদুয়ারির টিকিট শুধুমাত্র কাউন্টারেই পাওয়ায় যেত কিন্তু কোভিড কালে সেই টিকিট অনলাইনে হওয়াতে কিছু মানুষ এটাকেও জীবিকা হিসেবে নিয়েছে, তারা টিকিট কেটে দিয়ে কিছু আয় করছে পর্যটকদের কাছ থেকে।এতে অবশ্য পর্যটকদেরও বেশ সুবিধে হয়েছে, হাজারদুয়ারির সামনে আবার ফুচকাওয়ালা আইস্ক্রিমওয়ালা পার্কিং ব্যাবসায়ী সহ ছোট বড় সমস্ত ব্যাবসায়ী হকারদের মনে আশার আলো জেগে উঠেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে কেল্লার সামনে এবং চক মসজিদের সামনে প্রতিবছর দুর্গা পূজা পালিত হয়, নজাফি বংশীয় নবাবদের আমল থেকে নবাবদের উৎসাহে নবাবদের দেওয়া জায়গাতেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসে ৷ সমগ্র অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধান করেন নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্য সৈয়দ রেজা আলি মির্জা। দুর্গা পূজার সময় কেল্লায় বসবাসকারী সমস্ত মানুষ মেতে ওঠে উৎসবে।এর ফলে কেল্লা নিজামত এলকা সহ সমগ্র মুর্শিদাবাদ শহরেই যেন সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের বাণী ছড়িয়ে পড়ে।