আমাদের বন্ধু বিমলের ছোট ভাই অমল।
স্কুল কলেজে থাকতে আমি বিমলের বাড়িতে অনেক গেলেও অমলকে সেভাবে চিনতাম না। তার একটা কারণ ওদের বয়সের পার্থক্য। বিমল ওর ভাইয়ের থেকে পাঁচ কি ছয় বছরের বড় ছিল। তাই, আমরা যদি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে, অমল তখনো স্কুলের নিচু ক্লাসে। ওর বাড়িতে যখন গেছি, অমলকে কখনো সখনো দেখেছি – জানালার শিক দিয়ে দুই পা গলিয়ে, বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। অথবা, পেয়ারা গাছের ডালে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ডাঁসা পেয়ারা চিবোচ্ছে। দেখে হয়তো হাঁক দিতাম, কী রে! ব্যস, এইটুকুই। অত ছোট বাচ্চার সঙ্গে আর কী-ই বা কথা বলবো। তাই অমলকে আমি জানতামও না সেভাবে।
কলেজের পরে, আমি একটা স্কুলে পড়াই তখন, বিমল বাবার ব্যবসায় লেগে পড়েছে। বড়বাজারে মশলার দোকান ছিল ওর বাবার। পাইকারি। বিমলের সঙ্গে দেখা হত খুব কম, ন’মাসে ছ’মাসে। তবুও বন্ধুত্ব টিকে গেছিল। হঠাৎ একদিন বিমলের ফোন। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, অমলকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমলের কাতর অবস্থা দেখে গলায় যতটা সম্ভব সমবেদনা ফুটিয়ে বললাম, বলিস কী? পুলিসে খবর করেছিস?
না রে, দিইনি এখনো। বাবা থানা পুলিশ করতে চায় না।
না মানে, কোন অ্যাক্সিডেন্ট-টেন্ট হল কি না, সেটা –
অমল চিঠি লিখে গেছে। নিজের থেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ও।
সেই সময় অমলের কলেজে পড়বার বয়েস। জানতাম না কলেজে পড়ত কি না, কিংবা পড়লেও পরীক্ষা দেওয়ার বয়েস হয়েছিল কি না। কিন্তু সেইটাই প্রথম মাথায় এল। পরীক্ষার রেজাল্ট?
না, না, এই তো সবে ভর্তি হল।
প্রেম করত নাকি কারো সঙ্গে? মনে পড়ল, কলেজে থাকতে বিমল আমাদের ব্যাচের চন্দ্রাণী বলে একটা মেয়েকে দেখে লাট্টু হয়ে গিয়েছিল। সামনে এগিয়ে কোনো কথাও বলবে না। আমি ওকে ঠেলতাম। লজ্জার কি আছে, যা না, একবার কথা বলে দ্যাখ। বিমল এমনভাবে শ্বাস ছাড়ত, যে ওর কচি গোঁফ তিরতির করে কাঁপত। লজ্জা না রে, আমি এগিয়ে গেলাম আর মেয়েটাও পটে গেল। তারপর কী হবে?
সেটা তো আরো সোজা, ধাঁ করে বিয়ে করে নিবি। আমাদের নয় চাকরি জোটাতে হবে, তোর তো বাপের গদিতে চাকরি বাঁধা।
ধুর, ছাড় ওসব। আমার বাপটাকে তো চিনিস না, রাজিই হবে না। ডান হাত মুঠো করে, হনুটা সেই গর্তে রেখে, একেবারে নিশ্চিত গলায় বলেছিল বিমল। কিসের আপত্তি সেটা আর জানতে চাইনি।
ওর ভাই হয়তো অন্যরকম। তাই জিজ্ঞেস করলাম, কোনো মেয়ের চক্কর ছিল?
মনে হয় না। তাহলে লিখত চিঠিতে।
কী লিখেছে?
কিছুই না। শুধু এই, যে আমি চল্লাম, চিন্তা কোরো না। সাদা সাপটা লেখা।
ব্যস, এইটুকুই? এখন কী করবি?
বাবা তো কিছু করতে বারণ করল। আসলে রেগে ব্যোম। বলল, যখন টাকার দরকার পড়বে, বাছাধন ঠিক সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসবে, এখন চেপে বসে থাক।
মা কিছু বলেনি?
বাবার উপর দিয়ে যেতে পারেনি কখনো। আজ কি করে যাবে? সব ঠাকুরের দোরে মানত করছে।
তাহলে? আমাকে কি বলতে চায় বিমল? ফোন কানে দিয়ে এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিল।
ফ্রি আছিস? তাহলে আসতাম।
ডিসেম্বরের গোড়ার দিক। সবে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আমার মাথার উপর রাজ্যের খাতা, সব চেক করে নাবাতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে। তবু না করতে পারলাম না। শত হলেও ছোটবেলার বন্ধু। বললাম, চলে আয়।
বিমল এল, হাতে একটা ম্যাকডাওয়েলের পাঁইট। অনেকদিন বাদে দেখা বিমলের সঙ্গে, দেখলাম বেশ একটা ভুঁড়ি বাগিয়েছে। ওর বাবার মত। সেদিকে তাকিয়ে বললাম, এ কী রে, পেটটা বাড়ছে কেন? খুব মালটাল টানছিস নাকি?
মা কালীর দিব্যি, তিনমাস বাদে আজ। আসলে সারাদিন অমনি একঠায় গদিতে বসে থাকা, হাঁটুর জন্য বাবা তো আজকাল পারে না।
দ্যাখ, তোকে বসতে হয় বলে তুই কমপ্লেন করছিস, এদিকে আমায় সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলে চরাতে হয়, এখনই গাঁটে গাঁটে ব্যাথা।
হা হা করে হাসল বিমল। কারো জীবনে সুখ নেই রে। ততক্ষণে গ্লাসে গ্লাসে মাল ঢালা হয়ে গেছে, কোক মিশিয়ে প্রথম চুমুক দিয়ে বিমল গেয়ে উঠল -
সবাই তো সুখী হতে চায়
কেউ সুখী হয়, কেউ হয়না।
ভাগ্যিস বেশি দূর গায়নি, গলায় মোটে সুর নেই বিমলের।
গান থামতে জিজ্ঞেস করলাম, অমল কেন গেল কিছু জানলি?
ওই, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। বলল, কিন্তু কেমন উদাস হয়ে গেল বিমলের চোখের দৃষ্টি।
অত ছোট ভাইয়ের জন্যে বিমলের মনে কিরকম ভাব ভালবাসা ছিল, আমার জানার কথা না। দেখে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল। থম মেরে বসে আছে, মনে হয় পেটে দু’চার পেগ না যাওয়া অবধি মুখ খুলবে না বেশি। আমিই খোঁচালাম, কী লিখে গেছে বললি না।
খোলসা করে লিখলে তো কথাই ছিল না।
ভূতটা কিসের? পলিটিক্স?
ধার দিয়েও মাড়ায়নি কোনোদিন।
বৈরাগ্য?
অমলের মধ্যে ওসব সন্ন্যাস-টন্ন্যাস ছিল না রে! কিন্তু একটা আলুক-শালুক ভাব জড়িয়ে রাখত ওকে। চোখ দেখলেই মনে হত, উড়বে যেন এখুনি।
তাহলে? আগে থেকে কিছু বুঝিসনি?
কিছু না। ও তো আমার মত ছিল না। অনেক বন্ধু বান্ধব, এদিক সেদিক যাচ্ছে। আমার তো মনে হত আনন্দেই আছে।
ও কি তোর সঙ্গে দোকানে বসত? জিজ্ঞেস করলাম, কারণ আমার মনে আছে কলেজে পড়ার সময়, লাস্ট ক্লাসের পরেই, নিয়ম করে সপ্তাহে তিনদিন বিমল বড়বাজারে বাবার দোকানে চলে যেত। একেবারে উর্ধশ্বাসে দৌড়ানো যাকে বলে। ওই সোম, বুধ, শুক্রবারের চক্কর থেকে ওকে কোনোদিন ফেরানো যায়নি। এমন নয়, যে ওদের দোকানে কর্মচারীর অভাব আছে, কিন্তু ওর বাবা নাকি ওকে ট্রেনিং দিচ্ছে।
আমি বিমলের দিকে চেয়েছিলাম। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। প্রায় কদমছাঁট। একটু ভিতরে বসা চোখ। গোঁফজোড়া এতদিনে বেশ জম্পেশ, মিলিটারি কায়দায় পাকানো। ভুঁড়িটা না থাকলে বেশ মিলিটারি মিলিটারি লাগত। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল বিমল। স্কুলের রেসে ভাল দৌড়াত। ব্যায়ামমন্দিরে গিয়ে হাত-পা বেশ তাগড়া করেছিল। কে জানে, বাবার দোকান না থাকলে হয়তো আর্মিতেই নাম লেখাত ছেলেটা। বাবার দোকান না থাকলে, এরকম অনেক কিছুই হয়তো করতে চাইত, মাঝে মাঝে প্রেসার কুকারের সিটি মারার মত মুখ ফুটে সেকথা বেরিয়ে আসত। কিন্তু জোরের সঙ্গে অন্যকিছু করতেও দেখিনি বিমলকে।
মাঝমধ্যে বসত। সুরুত করে এক একটা চুমুক দিচ্ছিল বিমল। ওর টিকি দেখা গেলে তবে না।
তাহলে তুই কেন গেঁড়ের মত রোজ গিয়ে বসে থাকতিস?
আমায় মানতে হত রে। আমার জন্য অতটা রোদ্দুর ছেড়ে রাখা ছিল না কোনোদিন, মেঘ চাপা আলো নিয়েই কেটে গেল এই জীবনটা। ফড়াত করে একটা শ্বাস টেনে গ্লাসটা গলায় উপুড় করে হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁটের কষ মুছল বিমল।
শালা, কিসব সেন্টু ঝাড়ছিস রে! বাপ মায়ের ন্যাওটা ছিলি, সেটা কবুল কর।
হয়তো তাই। মা বলত, বিমলে সন্ধ্যে হলে ঘরে ফিরে আসবি। দিনের শেষ আলো তখনো ঘাসে লেগে আছে, খেলার মাঠ থেকে ছুট্টে বাড়ি এসে ঢুকতাম। কলেজে পড়ি, বাবা বলল, এত পড়ে আর কি হবে, দোকান সামলাও। ব্যস, হালে জুতে গেলাম।
তাহলে তোর ভাই কেন বাবাকে মানত না?
বাবা তো আজকাল সব দিন আর দোকানে যেতে পারে না। বাবা না থাকলে একবার বুড়ি ছুঁয়েই হাওয়া।
তুই কিছু বলতিস না?
আমি তো আর বাবা না। ফিকে হাসল বিমল।
আমি হো হো করে হাসলাম। কিছুটা হাওয়া হালকা করতেই। কেন রে, বড় দাদাকে পাত্তা দিত না?
পাত্তা দিত, ন্যাওটা ছিল আমারও এক সময়। একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে হেসেছিল বিমল। কিন্তু এটাও জানত, আমার কাছে সহজেই পার পাওয়া যাবে, বাবাকে লাগাবো ভাঙ্গাবো না। বলতে বলতে এবার বিমল হু হু করে কেঁদে ফেলল।
তখনো মোটে এক পেগই খেয়েছে, নেশা হওয়ার কথা নয়। মনে হল ভাইকে খুব ভালবাসত বিমল। আমি উঠে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আরে ছাড় না বিমল, বাচ্চা ছেলে তো না। ঠিক নিজের ব্যবস্থা করে নেবে।
বিমল খপ করে আমার দুটো হাত পাকড়ে ধরল। আমি তো একেবারে ফেঁসে গেলাম, না রে মনা!
কেন তোর আবার কি হল? ওর কথায় খুব অবাক হয়েছিলাম আমি।
ভাবছিলাম অমলটা বড় হয়ে দোকানের ভারটা নেবে একসময়, আমি তাহলে ঝাড়া হাত-পা হয়ে নিজের মত কিছু করতে পারি। ঠিক ওই মুহূর্তে আমি বুঝলাম, বিমলের কষ্টের অনেকটা বোধহয় ওর নিজের জন্য। নিজের জন্য একটা অন্য ভবিষ্যৎ খুঁজছিল। অন্তত খেয়ালি পোলাও রাঁধতে কোন বাধা ছিল না। অমল চলে গিয়ে সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
বাকি সময়টা বিমল কেমন থম মেরে বসে রইল। চোখদু’টো পেরেকের মত সরু করে কী যে ভাবছিল! আরও কয়েক পেগ চালিয়েও সন্ধ্যাটা জলবৎ তরলং হয়ে গড়িয়ে গেল না। রাত বারোটা বাজার আগেই বিমল বাড়ির পথ ধরেছিল সেদিন। বেরোনোর আগে দরজায় থমকে দাঁড়াল একবার। একদিন ফিরে আসা পাবেই, পাবেই তুই দেখে নিস।
তারপর সত্যি বলতে ওর সঙ্গে কথাও খুব কম হয়েছে। আমি ছাত্র পিটিয়ে আর ও মশলা বেচে দিন গুজরান করছিলাম নিজের নিজের মত। হয়তো আমার একবার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল, কেমন আছে, ভাই ফিরল কি না – এইসব। আমার স্কুল কলকাতার বাইরে, ট্রেন বদলে যেতে ঘণ্টাদুই লাগে। ফেরার সময় আবার সেই। তবে উল্টোপথ বলে জায়গা পাওয়া যায়। আর সিটে পাছা ঠেকাতেই আমার নাক ফুরুত ফুরুত। সে জস্টি মাসের ঝাঁ ঝাঁ দুপুর হোক, কি পোষমাঘের জানালার কাঁচ নাবানো বিকেল। তবু আসা যাওয়ার ধকলটা রয়েই যায়। তারপর আর ফোন করবো কিংবা ওর বাড়িতে গিয়ে হাজির হবো – সেসব করা হয় না। এমনকি, ওর বিয়ে হল – ওদের বাড়িতে ছেলেদের বিয়ে তাড়াতাড়িই হয় – সেটাতেও যাওয়া হয়নি। আমার অশৌচ চলছিল।
দেখতে দেখতে মাস গড়িয়ে বছর, অন্তত বছর চারেক তো হবেই। একদিন দেখা হয়েছিল বড়বাজারে। ওদের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ঢুঁ মেরেছিলাম। কলেজে থাকতেও বার দুয়েক গেছি। কিন্তু সে অন্যরকম। এখন গদিতে থেবড়ে বসা বিমল, আমাকে দেখে কেমন একটা বিব্রত হাসি হেসেছিল। বিব্রত হবার কিছু নেই, এত বড় দোকান, ছ’টা লোক খাটছে, ও গদিতে বসে একে ওকে হাঁক পাড়ছে, এই বলা, সাহা বাবুর লিস্টটা মিলিয়ে দিয়েছিস? আবার আরেকটা লোককে বলছে, কী মিত্তির মশাই, আজকাল দোকানের কাটতি কম কেন? লোকে খাচ্ছে কম? হা হা হা, আপনার মশলার লিস্ট প্যাংলা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
এ অন্য বিমল, গলার স্বরটাই যেন আলাদা। আমার সঙ্গে যে ভাবে কথা বলত, সেটা অন্য। হয়তো ওই গদিতে বসে সেই গলাটা বের করে আনতে অসুবিধা হচ্ছিল ওর। কিংবা ওইভাবে ছেদড়ে বসে থাকাটা। এটা ঠিক, ওর সেই অস্বস্তিটা বুঝে আমি বেশি সময় থাকিনি। দু’টো বাচ্চা হয়েছে, দু’টোই ছেলে, সেটা জানতাম। আমার বিয়েও হয়নি এখনো, স্কুল মাস্টারের বিয়ে অত তাড়াতাড়ি হওয়া মুশকিল, তার উপর মাথার উপর বাবা নেই। ওদিকে বিমল দুই বাচ্চার বাপ। যখন জিজ্ঞেস করলাম, কত বড় রে? হাত উল্টে গলা নাবিয়ে বলল, বড় হয়েও লাভ নেই। বৌ বলেছে ছেলেরা মশলার দোকানে বসবে না।
আমি অবাক, তোর ছেলেদের বয়েস কত?
দেড় আর চার।
বোঝো কাণ্ড! বিমল তার বাপের উপর দিয়ে গেছে, চার বছরের বাচ্চা কবে গদিতে বসবে, সেই নিয়ে বউয়ের সঙ্গে আলোচনা!
কিন্তু বিমলকে দেখে জেঠুর আদলটা পুরো যেন দেখতে পেলাম, হয়তো সেই জন্যেই কথা তেমন জমেনি সেদিন, তাড়াতাড়ি বিমলের ধরিয়ে দেওয়া এক নম্বর কাশ্মিরী লঙ্কাগুঁড়োর একটা ফ্রি প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে গেছিলাম। তারপর মাঝে আর দেখা হয়নি, কথাও না।
দীর্ঘ বিরতির পর ক’দিন আগে আবার বিমলের ফোন। অবাক হয়েছিলাম।
মনা রে, অমলের খোঁজ পাওয়া গেছে! এমন গলায় বলল, যেন সেই বিমল। বন্ধু তো ছিলই, কেমন একটু দম চাপা। কিন্তু আমার কাছে নিজেকে খুলে দিত সব সময়, আজ আবার সেই ভাব।
কোথায়?
কালিম্পং।
কেমন করে জানলি?
বাড়ির ঠিকানায় একটা চিঠি এল যে, অমলের। শরীর ভাল নয়। ডাক্তার দেখানোর দরকার। যাবি আমার সঙ্গে?
শরীর খারাপ তো চিঠি কেন? সোজা বাড়িতে ফিরলেই তো পারত।
বুঝিস না, একটু কিন্তু কিন্তু করছে হয়তো। শত হলেও বুড়ো বাপ-মাকে ফেলে হাওয়া হয়েছেন বাবু, কোন তোপ তো দাগেনি। এখন চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার।
কী অসুখ?
অত কিছু লিখলে তো। না লিখেছিল যাওয়ার সময়, না লিখেছে এখন। নামেই চিঠি, টেলিগ্রামও এর থেকে লম্বা হত।
তুই চলেছিস ভাইকে আনতে?
আসবে না সে, সাহায্য চায় শুধু। বাবা-মা এই বয়সে ওইসব পাহাড়ি জায়গায় কি যেতে পারে, আমাকেই যেতে হবে।
যা তাহলে বউ বাচ্চা নিয়ে। হানিমুন গেছিলি কি? কালিম্পং ভাল জায়গা, সেকেন্ড হানিমুন হয়ে যাবে। হ্যা হ্যা করে হাসলাম।
সে গুড়ে বালি। বউয়ের বাপের বাড়ি মৌলালি। নাগের বাজার থেকে মৌলালি, মৌলালি থেকে নাগের বাজার। এর বাইরে ওকে নড়ানো মুশকিল। তুই চল।
আমি? কালিম্পং, সে তো অনেক দূর রে। স্কুলে এখন ছুটি নেওয়া মুশকিল।
কোনদিন পাহাড়ের কাছে যাইনি, চল না মনা।
আমি অবাক হয়ে বিমলের কথা ভাবলাম। ওকে পাহাড়ে ডাকছে, না অমল? বললামও সেটা।
আহা, আমি তো না হয় অমলের টানে যাবো, তোর জন্যে বলছি। থাকবি দু’দিন, পাহাড়-টাহাড় দেখবি।
দেখবো, না অমলকে খুঁজবো?
খোঁজার কিছু নেই, দুরপিন মনাস্টেরি না কি আছে, সেখানে।
মনাস্টেরি? তোর ভাই কি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে গেছে নাকি?
সেসব লেখেনি কিছু, শুধু বলেছে শনিবার বিকেল পাঁচটায় থাকবে গেটের সামনে।
একেবারে দিনক্ষণ লিখে দিয়েছে? যেন জানে তুই আসবিই? যদি না যেতিস?
বলছিস কী মনা, আমার ভাইটা এমন গৃহহীন নিরুদ্দেশ ভেসে চলবে যাবজ্জীবন, আমি খোঁজ পেয়েও যাবো না?
সে না হয় তুই ভাই-অন্ত প্রাণ। ও যদি না আসে?
আসবে, ঠিক আসবে। না হলে এমন করে লিখবে কেন? কাজ মিটে গেলে ঘুরবো কালিম্পং শহর। ওখানে দেওলো হইল যাবো, একটা হনুমান মন্দির আছে। সেখানেও। তুই চাইলে দার্জিলিং। পারলে অমলকেও আমাদের সঙ্গে জুটিয়ে নেবো।
ব্যাটা বাপের মত ব্যবসায়ী হয়েছে ঠিক। বেচতে শিখে গেছে একদম। টুরিস্ট গাইডের মত সব জায়গার নাম মুখস্ত করে তবে ফোন করেছে। মনে মনে এই কথাটা আওড়ালেও রাজি হয়ে গেছিলাম। টিকিট ও কাটবে, থাকার জায়গার খরচ ওর বাপের। স্কুলে পড়িয়ে হেজে গেছি, আমার তো আর বউ-বাচ্চা নেই। ছুটি বাগাতে পারলেই হল।
অমল শনিবার আসবে, কিন্তু আমরা বেরোলাম বেষ্পতি। সেদিন সকালবেলা নিজের ঝোলাকম্বল নিয়েই গেছিলাম স্কুলে। যদিও মে-মাস, সঙ্গে খান দুই সোয়েটার নিয়েছি। স্কুল থেকে সোজা শিয়ালদা স্টেশান এনজেপি এক্সপ্রেস ধরতে। ট্রেন সন্ধ্যা সাতটা পঞ্চাশে। আমি পৌঁছে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দর দর করে ঘামছি। টিকিট ওর কাছে। ট্রেন ঢুকে গিয়ে, বিমলকে বার তিনেক ফোনে না পেয়ে যখন মেজাজ চড়তে শুরু করেছে, তখন ঠিক সাতটা পঁয়ত্রিশে হাঁফাতে হাঁফাতে বিমলচন্দর হাজির। ওর হাতে বড় খাবারের ডাব্বা, আর এক হাতে জলের বোতল। পিছনে এক কুলির মাথায় ঢাউস দু’টো স্যুটকেস।
এত কী নিয়ে চলেছিস সঙ্গে করে? যাচ্ছিস তো পাঁচ দিনের জন্য।
সব গুছিয়ে বসতে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল, তারপরে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
মা দিয়ে দিল। অমলের জন্য গরম জামা, হাতে বানানো আচার, নারকেলের নাড়ু – এইসব ঠাসতে ঠাসতে সুটকেস বোঝাই। তারপর চোখ টিপে বলল, আমাদের সব দরকারী জিনিসও আছে। হাতের আঙুল দিয়ে বাতাসে বোতল আঁকল।
বিমলকে চিনি সেই কোন ছোটবেলা থেকে। মানে চিনতাম। কিন্তু এই দোকানে বসা বিমল, যেন অন্য লোক। তবে ওর বাবাকে দেখেছি, তাই অতটা চমক ছিল না। ট্রেনে চেপেও যে দোকানের কাজ করবে বুঝতে পারিনি। একটা বড় জাবদা খাতা বের করে পাছা চিবানো লাল পেন নিয়ে জায়গায় জায়গায় যোগ বিয়োগ করতে লাগল। একটু লাজুক হেসে বলল, দৌড়ে চলে আসতে হল, স্টক দেখার সময় পাইনি। বুঝলি না, যদি কোন মাল শর্ট পড়ে যায়, কত লোক এসে ফিরে যাবে।
এরকম চললেই হয়েছে ভেবে আমার চোখ জানালার বাইরে। হঠাৎ ‘এইরে খেয়েছে’ শুনে চোখ ফিরিয়ে দেখি, ভুরু কুঁচকে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে ফোন লাগিয়েছে। কিন্তু লাইন লাগছিল না। দেখেছিস কাণ্ডটা? বলে ও দরজার দিকে দৌড় লাগাল। আমাদের সিট নাম্বার বারো আর চোদ্দ, ওখান থেকে দরজার রড ধরে সিগন্যাল পাওয়ার আশায় বিমলকে ঝুলতে দেখা যাচ্ছিল, একটু বাদে ওর হেঁড়ে গলার চিৎকারও।
এই যে দাশবাবু, আমাদের এলাচ আর দারচিনির অর্ডারটা দেওয়া হয়েছিল? স্টক দেখলাম ঢনঢন।
চোখটা ছুঁচলো করে, হাওয়ার তোড় সামলে, প্রাণপণে শোনার চেষ্টা করা বিমলকে দেখে মজাই লাগছিল। যেন ওই এলাচ আর দারচিনির উপর ওর জীবন আটকে আছে।
অ্যাঁ? করা হয়নি? করটা কী বল দেখি তোমরা? গলা থেকে ঘোঁত করে একটা আওয়াজ বের করল। ওর গলার আওয়াজটা চড়ছে। এখন ঠিক আমাদের স্কুলের গভর্নেন্স কমিটির সেক্রেটারি অধীরবাবুর গলা যেন। আমাদের ট্রেনের পাশ দিয়ে উল্টোদিকে আর একটা ট্রেন ঝমঝমিয়ে চলে গেল। বিমল আঁতকে উঠে বডি ভিতরে করল, মোবাইল কান থেকে সরায়নি।
শিগগির কোঝিকোডে রবিন্দ্রনকে ফোন লাগাও। হ্যাঁ, আজই। একদম! সাতদিনেরও মাল নেই গুদামে। দেখলাম খাতায়। ঢুকল ঘটে?
ফোনপর্ব সেরে খাতা বন্ধ করে বসল বিমল। খচে গেছিস মনা? এই কালীর দিব্যি, আর যদি একবারও এই খাতা খুলেছি।
না গুরু, তুমি ব্যাবসাদার মানুষ। যখন যেখানে যাবে, মাথায় কাজ তো থাকবেই।
আরে ধুস! বললাম না, এই শেষ। দরজার কাছটায় কী ফ্যান্টা হাওয়া রে মাইরি! একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বলেই ফিক করে হাসল, একটা ট্রেন গেল দেখলি, ওটা ত্রিবান্দ্রম থেকে আসছিল। আমরা খুব মশলা কিনি ওধার থেকে।
দ্যাখ তোর এলাচ আর দারচিনি আসছিল হয়তো।
আরে, মিত্তিরটা এত লেদুস, এখনো অর্ডার করেনি মোটে। এই দ্যাখ, আবার দোকানের কথা! আর না এসব, এখন ট্রেনের হাওয়া খেতে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, গোপীস্যার পড়াতেন মনে আছে?
এটা দক্ষিণ-পূর্বী হাওয়া ছিল, ত্রিবান্দ্রম-শিয়ালদা ট্রেন কিনা।
হা হা হা, বেড়ে বলেছিস। পুরো মুখ হাঁ করে হাসল বিমল, দাঁতের খাঁজে খাঁজে পানের দাগ দেখিয়ে। মনা, কফি খাবি? আমার হ্যাঁ বলার অপেক্ষা না করেই এখুনি আমাদের এলাকা পার হওয়া একটা হকারকে হাঁক পাড়ল, এ! এই কফি এদিকে।
এর পরে বিমলের খাওয়ার দৌরা পড়ল। যত হকার আসছে, এটা ওটা খাচ্ছে। আমি বললাম, এত খাবার এনেছিস সঙ্গে, এসব হাবিজাবি খেয়ে পেট ভরাবো কেন?
ধুস, ওই খাবার তো পেট থেকে পড়ে খাচ্ছি, এই ট্রেনের রকমারি খাওয়ার মজাই আলাদা। কেমন একটা বেড়াতে যাচ্ছি যাচ্ছি ভাব হয়। বলে সুরুত করে তিন নম্বর কফি কাপটা শেষ করে জানালার বাইরে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল।
শুধু খাওয়া? আমাকে বগলদাবা করে এক বগি থেকে আরেক বগি করে পুরো ট্রেনটা চক্কর মেরে এল। আমি যত বলি, সারাদিন এত ধকল গেছে, একটু বস না চুপ করে, সে ছেলে আবেগতাড়িত গলায় বলল, তোর মনে আছে মনা? তোরা পুরী গেলি সেই একবার, আমার বাপটা ব্যাগড়া দিল। তোরা সবাই সারা ট্রেন ঘুরে মেয়ে দেখছিলি।
আরে, সে এক অন্য বয়েস। এখন কি আর সেই বয়েস আমাদের?
আরে আমি না হয় ডাবল ডেকার, তোর তো এখনো বিয়ে-শাদী হয়নি। অত লজ্জা কিসের?
রাতের ট্রেনের হলদে আলো ছড়ানো কামরায় উচ্ছসিত বিমলকে দেখে কে বলবে, ব্যাটা মশলা বেচু।
শুধু তাই? সুস্থির হয়ে একবারটি বসল না। রাত হতে যতক্ষণ চেকার এসে দরজা টেনে দিল না, খানিক বাদে বাদে দরজার সামনে গিয়ে হাতল ধরে দাঁড়াবে। ও নাকি মৌসুমি বায়ু ফিল করছে। ছেলেমানুষি ব্যাপার, কিন্তু আমার আবার কেমন মায়া হল। বেচারা বাপের খপ্পর থেকে গিয়ে বউয়ের কব্জায় পড়েছে। এমন ভাবে হাওয়া-বাতাস বয়নি ওর জীবনে।
আমিও কোনোদিন এদিকটায় আসিনি। সংসার টানা আর স্কুলের চাপে বেড়ানো আর কোথায় হয়! বিমলের সঙ্গে এতদিন বাদে কেমন জমবে, সেটা নিয়েও ধন্দ ছিল মনে। কিন্ত মশলার দোকানের গদিতে বসা বিমলের চেয়ে এই ছেলেমানুষি করা বিমল বরং ভাল। আমারও বেশ ভাল লাগতে শুরু করেছিল।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে একটা জিপ ধরে কালিম্পং। এখানে গরম মোটেই নেই। কালিম্পং পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেছিল, তখনই হাওয়ায় কেমন একটা শিরশিরানি। ভাগ্যিস সোয়েটার এনেছিলাম সঙ্গে। তিস্তা ব্রিজের উপর জিপ দাঁড় করিয়ে বিমল ফটো নিয়েছিল। আমি তখন ব্যাগের ভিতর থেকে একটা তুষের চাদর নিয়ে জড়িয়ে নিয়েছিলাম, সন্ধ্যাবেলা হয়তো সোয়েটার ছাড়া চলবে না।
বিমল কোনো কিছু গায়ে নিল না, ওর কথা – একটা ঠান্ডার জায়গায় এসেছি, বুঝবি কী করে, যদি একটু শীতের কাঁপুনি গায়ে না লাগে? বোঝো!
কালিম্পং পৌঁছাতে সাড়ে তিন ঘণ্টা। ড্রাইভার গজগজ করছিল, এটা নাকি আড়াই ঘণ্টার পথ। বিমল এতবার দাঁড় করিয়েছে, দেরি হয়ে গেছে। পাহাড় দেখে কেমন অবাক চোখে তাকাল, ভুগোলের বইতে ম্যাপের মধ্যে কেমন খাঁজকাটা লাইন টেনে পাহাড় আঁকা থাকত, মনে আছে তোর?
এমন করছিস যেন কোনদিন পাহাড়ের ছবিও দেখিসনি।
ছবি দেখা আর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া এক কথা? এ ভাই, সামনের ওটা কী পাহাড় বল তো?
বিমল আবার দাঁড়াবে ভেবে সন্ত্রস্ত ড্রাইভার ছোকরা বলল, সবই হিমালয় দাদা, আর ওই পাহাড়েই তো যাচ্ছেন। কালিম্পং গিয়ে দেখবেন সাধ মিটিয়ে। বিমল তাও ছেলেটাকে একটা সিগারেট হাতে ধরিয়ে তিরতির করে নেবে আসা একটা জলের ধারার পাশে জিপ দাঁড় করিয়েছিল। একটা সেলফি নইলে নাকি চলবে না।
আমরা উঠেছিলাম ইস্ট মেন রোডের উপরে একটা লজে। দু’টো সরু সরু খাট, দু’টো হেলানো চেয়ার, জানালা দিয়ে সুন্দর পাহাড় দেখা যায়। আর কী চাই আমাদের? রাস্তার ধকলে খিদে পেয়ে গেছিল। গরম জলে স্নান করে উল্টো দিকের ধাবা টাইপের একটা দোকানে গিয়ে লাল ভাত আর স্কোয়াশ দিয়ে চিকেনের ঝোল মেখে বেশ খেলাম। ট্রেনে আমার অত ভাল ঘুম হয়নি, ঘরে এসে গড়িয়ে নেওয়ার তোড়জোড় করছিলাম, বিমল কিছুতেই শুতে দেবে না। রিসেপশানের ছেলেটা কী বলল মনে নেই? বিকেল পাঁচটার পর অন্ধকার নেবে যাবে, তখন আর কিছু দেখা যাবে না। এইবেলা বেরিয়ে পড়ি চল।
এখুনি কোথায় যাবি আবার?
যাই ওই দূরপিন মনাস্টেরিতে। দেখা কে দেখাও হল, আবার কাল অমল কোথায় আসবে তার একটা ছক থাকল মাথায়।
আমি নিমরাজি ছিলাম, কিন্তু পথে নেবে খারাপ লাগল না। কালিম্পং শহরটার দু’দিকে দু’টো পাহাড় – দেওলো আর দূরপিন। যে মনাস্টেরিতে অমল আসবে, সেটা ওই দূরপিন হিলের মাথায়। ছোট শহর, যেখানেই দাঁড়াই, দু’দিকে এই দুই পাহাড়। হোটেল থেকে হাঁটা শুরু করে দূরপিন দারার উপকণ্ঠে পৌঁছলাম। আমি না হয় স্কুলে পড়াই, সারাদিন দাঁড়িয়ে বোর্ডে চক ঘষি। বিমল তো সারা দিন থেবড়ে বসে থাকে, অত হাঁটার অভ্যাস নেই। হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিল। কিন্তু উৎসাহের অন্ত নেই। পাহাড়ের গোড়ায় একটু জিরিয়ে নিয়ে, এবার পাহাড়ি ছাগলের মত তিড়িং তিড়িং করে উঠতে থাকল উপরে। ভুঁড়ি-টুড়ির তোয়াক্কা না করে। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে, কী একটা জায়গা না? বলে আবার উপর দিকে। তবে অত অভ্যাস তো নেই, একটু এগিয়ে দেখি একটা পাথরে বসে হাঁফাচ্ছে।
কি রে আর যাবি? নাকি আজ ফিরে যাবি, কালকে তো আসতেই হবে আবার।
তাতে কী? উপরে উঠে আকাশ ছুঁতে হবে না? তবে এবার একটু আস্তে আস্তে উঠব।
উপরে উঠে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। নিচে পুরো শহরটা, পাহাড়ের থাকে থাকে কাঠের বাড়ি। দূরে বরফে ঢাকা হিমালয়ের সিকিম রেঞ্জ। তিস্তা নদীও দেখা যাচ্ছে। একটা বড় পাথরের উপর চড়ে কোমরে দু’হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস টানছিল বিমল। কিন্তু গোঁফের পাঁচিল পেরোনো হাসি মুখে ছড়িয়ে বলল, শিরায় শিরায় রক্ত চলাচলটা কেমন বোঝা যাচ্ছে দ্যাখ, জানান দিতে দিতে চলেছে। তাই না রে? আমি বিমলের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম।
জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর। বিমলের কল্যাণে আমারও আসা হয়ে গেল। এরকম ঠান্ডা বাতাস, চিরহরিৎ গাছেরা সার দিয়ে দিয়ে উঠে গেছে। কত রকমের পাখি ওড়াউড়ি করছে। মনাস্টেরির চারদিকে ফুলের বাগান। এর মধ্যে একটা হলদে-কালো প্রজাপতি দেখে বিমল কেমন বাচ্চার মত ছোটাছুটি জুড়ে দিল। এটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ছেলেমানুষি লাগল আমার কাছে। প্রজাপতি দেখিসনি নাকি কোনোদিন?
ওকে দমানো গেল না। হা হা করে হেসে উঠে বলল, সেই বিয়ের কার্ডে দেখেছি লাস্ট!
মনাস্টেরিটাও খুব সুন্দর। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এদিক ওদিক ধ্যানে বসেছে, কি পদচারণা করছে। তাদের সৌম্য শান্ত চেহারা।
ধীর পায়ে হেঁটে বেড়ানো এই সন্ন্যাসীদের আমার খুব ভাল লেগেছিল। দেখেছিস মনা? বিমল ফিশফিশ করে বলল, অমলটা যদি সন্ন্যাসী হয়ে থাকে, ও কি এমনটাই হবে?
মনাস্টেরি থেকে বেরিয়ে, আবার একটা পাথরে চড়ে বিমল এবার দুই হাত ডানার মত করে মেলে দিল।
কি রে বিমল, এবার কি তোর পাখি হওয়াটাই শুধু বাকি আছে?
সবই বাকি রয়ে গেল রে মনা, তবু যদি এই পাহাড়ে খেলে বেড়ানো বাতাসকে ছুঁয়ে দেখতে পারি, তার চেষ্টা করছি।
ব্যাটা মশলার দোকানদার, পাহাড়ে এসে একেবারে কবি হয়ে গেছে!
লজে ফিরে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে মাল খাচ্ছিলাম, লজ্জা লজ্জা মুখে ফিশফিশ করে বলেছিল বিমল, বাতাস যখন সারা শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, সারা শরীরে কেমন একটা শিরশিরানি হচ্ছিল, না রে মনা?
সে তো হবেই, সোয়েটার পরে যাসনি। বিকেলে বেশ ঠান্ডা এখানে।
না না, সে ঠান্ডা নয় রে। কেমন একটা বেঁচে আছি, বেঁচে আছি ভাব। আমাদের দোকানটায় এসি বসিয়েছি একটা, কিন্তু সে তো বানানো বাতাস! বলেই ফোঁত করে একটা নিশ্বাস ফেলে স্তব্ধ হয়ে গেল বিমল।
আকাশের অন্ধকার ফুঁড়ে তারারা উঁকি মারতে শুরু করেছিল। শীতল বাতাসে রামের গ্লাস হাতে নিয়ে বেশ মৌজ এসেছিল আমার।
বিমলের গলা অন্ধকার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। অমলকে যদি চিনতে না পারি কাল? কী হবে?
নিজের ভাইকে চিনতে পারবি না কেন?
এই রোদ আলো বাতাসে সে কি আর অমনি আছে? ওই যে সন্ন্যাসীগুলোকে দেখলি, সেই রকম জ্যোতি থাকবে ওর, ঠিক দেখিস!
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ।
আমি চিনলেও, ও যদি চিনতে না পারে? বিমলের গলাটা খুব করুণ শোনাল।
আমাদের গায়ে ছ্যাতলা পড়ে গেছে না রে মনা? এমনিধারা আলো বাতাস ছুঁয়েই দেখিনি কোনোকালে।