নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
দরজা খুলে আলেফকে দেখে অ্যাবিয়েলের চোখে হাজার জোনাকি। আলেফের মুখচোখের অবস্থা দেখে দপ করে নিভেও গেল। বিস্ফারিত চোখ, দরদর করে ঘামছে। জালে মাছ পড়া চাহনি।
আ-লেফ! কী হয়েচে?
খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছিল, বুক তখনো হাপর টানছে। বুক থেকে মুখে কথা সেঁধোচ্ছে না। অ্যাবিয়েল তার আঙুল দিয়ে আলেফের মুখের ঘাম মুছিয়ে দিল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েচে? কিছু কি হয়েচে?
আগুন! ওরা আসচে। এক্ষুনি পালাও। ছররাগুলির মত ছিটকে এল কথাগুলো।
কারা আসচে? কোতায় আগুন লেগেচে? অ্যাবিয়েল তখনো কিছুই জানত না।
স্যারাটোগো স্ট্রিটে। ওরা ধরে ধরে মারচে, ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্চে।
ওরা মানে কারা, সেটা বুঝতে অ্যাবিয়েলের আর সময় লাগল না। কিন্তু কেন? কেউ কিচু করতে পারচে না?
হ্যাঁ, এখন দুই দলে মারকাট কচ্চে। এখুনি এসে পড়বে এখেনে। তোমাকে পালাতে হবে।
অ্যাবিয়েলের কপাল চিন্তায় কুঁচকে গেল। মলি এখন ইনোসেন্টের কাছে, মাউন্ট বাউ। তবু বাড়িটা তো আছে। সেটা ফেলে কী করে যাবে?
অধৈর্য্য ঘোড়ার মত পা ঠোকে আলেফ। ওরা এসে পড়লে কি আর আটকাতে পারবে? ওই শোনো, আওয়াজ পাচ্চো না আবিল? ওই দ্যাখো, ওই যে, ওই খেনে ধোঁয়া উঠেচে, জ্বলচে কারো বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে তুমিও পুড়তে চাও? আলেফের গলা চড়ছিল। সে চোখের সামনে দেখেছে একটা মেয়েকে ওরা – আবেগে অ্যাবিয়েলকে জড়িয়ে ধরল। আলেফের কন্ঠনালীতে উথালপাথাল করা কথাগুলো এবার বেরোনোর পথ পেল। ওরা একটা মেয়েকে কীভাবে মারচে আবিল, সব জামাকাপড় খুলে নিয়েচে, একেবারে সদর রাস্তায়। তকনি তোমার কথা ভেবে আমার বুক কেঁপে উটেচে। থরথর করে কাঁপছিল আলেফের গলা। ওদের হাতে বন্দুক, লাটি কত কিছু, আমার কাছে তো কিচুটি নেই। ওরা এসে পড়লে আমি তো বাঁচাতেও পারব না।
এতক্ষণে দূর আকাশে পাক খেয়ে ওঠা কালো ধোঁয়া দেখতে পেয়েছে অ্যাবিয়েল। অনেক দূরে, আবার এত দূরেও নয় যে এখানে এসে পড়ার ভয় নেই। ওরা যদি সত্যি এখানে আসে, ঘর জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে কিছু তো অন্তত বাঁচাতে হবে। দ্রুত বাড়ির ভেতরে ছুটে গেল অ্যাবিয়েল। যতক্ষণ না ফিরল, উদ্বিগ্ন আলেফ লাগাম টানা ঘোড়ার মত ছটফট করছিল দু’পায়ের উপর। হাতে বাদামী চামড়ায় শিরা উপশিরা ছড়ানো এক বাক্স নিয়ে ফিরল অ্যাবিয়েল। যা পেরেছে। বেশি বড় নয়। আর আছে আলেফের চিকনের পেটি। অ্যাবিয়েল বাক্স আর পেটি দু’দিকে রেখে আলেফের পিছনে, সাইকেল টলমল করতে করতে রাস্তা ধরল।
কোতায় যাব?
আমাদের ঘরে? এটা নিয়ে আলেফও ভাবছিল। সেখানেও কি হামলা হতে পারে না? কে জানে কতদূর এই আগুন ছড়াবে।
না, অ্যাবসিন্থ হাউসে চল গে।
ওখেনে অত লোকের মাজকানে?
এখন কেউ থাকবে না, সোজা উপরের কামরায় সেঁদিয়ে যাব।
যখন আসবে? সব তো -
উপরে কেউ আসবে না, জানবেই না কেউ আছে বলে। ওর থেকে নিশ্চিন্তির জায়গা আর নেই কো।
সেখানে পৌঁছাতেও অনেকটা রাস্তা। পথে কিছু কম বাধাবিঘ্ন? গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়েছে মিসিসিপির তুফানের মত। কোনো পথে ঢুকতে গিয়েই আবার উল্টোমুখো হতে হচ্ছে। রাস্তা দেখাচ্ছে অ্যাবিয়েলই, কোন রাস্তা কোন পট্টি দিয়ে গেছে, কোথায় নিগ্রোরা ঢুকলে ধোলাই জুটবে না - সে সব জানা খুব জরুরি। আলেফ হিন্দু বলে অনেক জায়গায় পার পেয়ে যায়, অ্যাবিয়েলের জন্য সেটা নাও হতে পারে।
অ্যাবিয়েলকে সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে, আলেফের চিন্তা কেমন করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে ফেলবে। দ্বিধান্বিত গলায় বলল, আবিল! আমি তো কিচ্ছুটি জানি নে কোতায় বেপদ, কোন পথে গেলে সুবিদে। আমরা ঠিক পথ ধরেচি তো? কোনো বেপদ নেই তো?
আচ্ছা, আ-লেফ, এত মারকাট আগুন দেখে না পালিয়ে আমাকে কেন নিতে এলে?
জানে না কি অ্যাবিয়েল, জানে। কিন্তু আলেফ মুখে ফুটে না বললে মনে ধরে না। অ্যাবিয়েলকে কতজনা ভালবাসার কথা বলেছে, কত রকম ভাষায় গুণগান করেছে। কিন্তু তার এই হিন্দু মানুষটার মুখে যেন কথা সরে না। অ্যাবিয়েলের মন ভরে না, কানে শোনার জন্য ছটফট করে। তোমার ভয় লাগে নি আলেফ? নিজে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করেনি কো?
আলেফ খুব কিছু সাহসী বীরপুরুষ নয়। পালিয়ে যেতে হবে জানে, কিন্তু একা পালাবার কথা মনে হয়নি একবারের জন্যেও। একা পালানো যায় নাকি?
অ্যাবিয়েলকে নে পালাতে চাও? কোথায় নে যাবে? কদ্দূরে?
এই তো বললে অ্যাবসিন্থ হাউসে!
উদ্বিগ্ন আলেফ অ্যাবিয়েলের প্রশ্নের হদিশ পায় না, তার চোখ রাস্তাকে ফালাফালা করে। বিপদ যে কোনো পথ ধরে হামলা করতে পারে, নিমেষে চুরচুর করে দিতে পারে সব। হলও তাই।
চায়না টাউনের গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। লা সালে ধরে হিংস্র চিৎকার তুলে এসে পড়ল গ্রিন টার্টল বাহিনীর উন্মত্ত হামলাদারেরা। নেহাত দলটা এত আওয়াজ করে আসছিল, তাই আলেফ স্যাঁত করে চায়নাটাউনের গলিতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারল। অ্যাবিয়েল, চিকনের পেটি, বাদামী বাক্স আর সাইকেল নিয়ে রাস্তার ধারে খাবারের উচ্ছিষ্ট আর যত নোংরা আবর্জনার মধ্যে গড়িয়ে পড়ল আলেফ, একেবারে মোক্ষম সময়ে।
কতজন মানুষ ছিল ওই দলে? তাদের কতজনের হাতে ছিল বন্দুক, লাঠি কিংবা অন্য কোনো অস্ত্র? তারা কে কী বলছিল? মানুষ যখন দল বাঁধে, তখন তাদের আর আলাদা করে চেনা যায় না। তারা তখন একটা দল, সমষ্টি। সেই সমষ্টিতে রাগ, বিদ্বেষ আর ঘৃণা লাভার মত পাক খায়। পার্থক্য শুধু এই লাভা, আগ্নেয়গিরির মত অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করে না। এই সন্ত্রাসের লক্ষ্য স্থির। নিগ্রোদের মাথা তুলে দাঁড়ানোটা বেমানান, তাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু কোনো আয়োজনে একসঙ্গে সামিল হবার যোগ্যতা নেই। যদি কেউ সেই আশা রাখে - ধরো, মারো, কাটো। নিকেশ করো।
এই নিকেশ করাটা কত ক্রূরভাবে হবে, ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা নির্বিশেষে হবে কিনা – সেটা ভাববার কিংবা তর্ক বিতর্কের সময় নেই এই দলবদ্ধ হামলায়। কেউ চেঁচাল, আগুন লাগাও। সেটাই চকমকি পাথর। কেউ যদি বলে ধর ওই মেয়েটাকে, তাহলে সেই মেয়েকে বে-আব্রু করায় কোনো ধর্মসঙ্কট নেই। আলেফ সেটা জেনেছে এই ক’বছরে। পড়ে গিয়েই যেমন ভাবে পেরেছে আড়াল করছিল অ্যাবিয়েলকে। কিন্তু ওরা কাছে এসে যেতেই তার হাড় হিম হয়ে গেল। একটা লোক আগে আগে ছুটছে, তার হাতে একটা লম্বা দড়ি, সেই দড়ির আন্য প্রান্ত লটকে আছে এক নিগ্রোর গলায়। হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া শরীরটা কখনো ধুলোয় চিত হচ্ছে, কখনো উপুড়। অ্যাবিয়েল ফিসফিস করে বলল, এ যে ডিওয়েন! একটু আগেই দেখা হয়েছে আলেফের সঙ্গে, মেরে ফেলেছে ওকে? নাকি এখনো বেঁচে আছে? থাকলেও আর কি বাঁচবে আজ দাভে দ্য রাজা? কিন্তু আলেফের সাহস হল না বেরিয়ে গিয়ে কিছু করে। কিই বা করতে পারে সে। যতক্ষণ ওদের উন্মত্ত ঢেউ পার হয়ে যায়নি, আলেফ আর অ্যাবিয়েল ওইভাবেই পড়ে থাকল একরাশ বর্জ্য আর নোংরার মধ্যে।
ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে নিবিড় হতে সময় নেয়। রাস্তা বহুক্ষণ থরথর করে দোলে, কাঠের বাড়িরা ঠকঠক করে কেঁপে আতঙ্ক বজায় রাখে অনেক সময় ধরে। রাস্তার ধুলোর ঝড় ধীরে ধীরে থিতু হয়। এমন কি পথের পশুপাখিও গা ঝাড়া দেয় না ততক্ষণ। ওরা এই অবস্থায় পড়ে রইল – সেও কত মুহূর্ত, কত পল। হামলার শেষ প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতেই আলেফ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে এমনই আরেকটা দল এসে যাবে, এরপর পালাবার উপায় নাও হতে পারে।
এলোমেলো শরীরে আবার অ্যাবিয়েল চেপে বসল আলেফের পিছনে। দু’হাতে আবার দুই বোঝা। পথের আবর্জনা মাখা দু’টি মানুষ বিধ্বস্ত শহরের অশান্ত রাস্তা বাঁচিয়ে টলমল করতে করতে পৌঁছাল অ্যাবসিন্থ হাউজে।
অ্যাবিয়েলকে নিরাপদ গন্তব্যে এনে দিয়ে আলেফের মুখে নিশ্চিন্তি। সেও ক্ষণকালের জন্য। কাছে-দূরে বুক-কাঁপানো আওয়াজ আসছে। শিগগির নিজের ঘরের খোঁজ নিতে হবে, কে জানে সেটা আছে না গেছে!
পা বাড়িয়েছিল, অ্যাবিয়েল পথ আটকাল।
শহরে এমনতর অবস্থা, আমি তোমাকে ছেড়ে কোতাও একা থাকব না আ-লেফ।
এই যে বললে, অ্যাবসিন্থ হাইজে থাকবে? খুব চিন্তায় পড়ে গেল আলেফ। আমাদের ওখেনে কী অবস্থা হচ্ছে আমি তো জানি নে ।
আমি ওখেনে যাবো না। আ-লেফ থাকবে অ্যাবসিন্থ হাউজে আমার সঙ্গে, যতক্ষণ শহর শান্ত না হয়।
তা কী করে হয়? ওখেনে আমাদের যাবত সামগ্রী পড়ে আচে।
আগুন দিতে এলে, পারবে বাঁচাতে?
এখেনে আমায় ঢুকতে দেবে কেন? আমার তো খরচ করার মত টাকা নেই কো।
সেসব ভাবা হয়ে গেছে অ্যাবিয়েলের। এখন কেউ নেই এখানে, শুধু ইসাবেল। আমি তোমাকে নিয়ে উপরের ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকব। কেউ জানতেও পারবে না।। সব নিঝুম হলে তখন অ্যাবিয়েলকে ছেড়ে যেও তোমার সঙ্গীসাথীদের খোঁজে।
অ্যাবিয়েলের দু’চোখ জলে টসটস করছিল। চোখে যদি থাকে মিনতি, হাতে ছিল জোর। আলেফের ডান হাতের কবজি শক্ত করে ধরে রেখেছিল নিজের বাঁহাতে। যাক তো দেখি, কেমন যাবে এখন?
কেউ কিচ্ছুটি বলবে না? আমতা আমতা করে আলেফ। এই চিকনের পেটির কী হবে?
অ্যাবিয়েলের চোখের জল এবার ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেল। হে ভগবান! তোমার চিকনের পেটি নিয়েই শুধু ভাবনা? নে চল ওটা মাথায় করে। ছটফট করছিল অ্যাবিয়েল, ঘোড়ায় জিন দিয়েছে এমন ভাব। কোনো কথার উত্তর শোনার আর ধৈর্য নেই, দু’হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল অ্যাবসিন্থ হাউজের ভিতরে।
ইসাবেল বসেছিল কাউন্টারে, দু’ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। এই সময়ে অ্যাবিয়েলকে ঢুকতে দেখে অবাক হল খুব।
অ্যাবি! এখন? বলতে বলতেই আলেফকে দেখে তার হলদে চোখে প্রশ্নের জট। অ্যাবিয়েলকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে দেখে, সিগারেট ঠোঁটের এক কোন থেকে আরেক কোনে ঠেলে দিয়ে দাঁতের ফাঁকে হাসল ইসাবেল। আজ শহরে এত ধুন্ধুমার –
সেইজন্যেই তো। লুকাতে এসেছি।
যাও, যাও। কোনো চিন্তা নেই। আমি হেনরিকে কিছু জানতে দেব না। এমন কি মারিয়াকেও উপরে যেতে দেব না। গলায় ঘড়ঘড়ে হাসি তুলে চোখ টিপল ইসাবেল।
উপরের এই ঘরটি তেমন বড় কিছু নয়। কাঠের দেওয়াল ফুলকাটা কাগজে মোড়া। এই একটা দরজা ছাড়া আর কোনো ফাঁকফোঁকর নেই। ঘরে থাকার মধ্যে একটা পালঙ্ক। খুব বড় নয়, কিন্তু তাতেই সারা ঘর জোড়া। খাটের দুই পাশের দেওয়ালে কিছু ছবি, নগ্ন নরনারী মিথুন ক্রিয়ায় মগ্ন। দেখেই চোখ ফেরায় আলেফ। খাটের পায়ের দিকের দেওয়ালে এক বিশাল তৈলচিত্র, পুরোনো হয়ে যাওয়া সোনালি ফ্রেমে।
আলেফ জানে না, যে এটা জেনারেল জনসনের ছবি, জানে না – এই ছবি ঘিরে গড়ে ওঠা গল্পকথা।
এতসব আলাদা করে আলেফ দেখছিল তা নয়। এতটা সময় প্রাণ হাতে ছোটার পর একটা অবসাদে আচ্ছন্ন হচ্ছিল বরং। অ্যাবিয়েলের হাত ধরে বিছানায় ধুপ করে বসল আলেফ, শরীরটা ছেড়ে দিতে মন চায়।
অ্যাবিয়েল কাপড়ের প্রান্তে তার মুখের ঘাম মুছিয়ে দিল। তার দুই হাত আলেফের গলা জড়িয়ে নিল। ধীরে ধীরে তার স্পর্শ, গন্ধ, উষ্ণতা আলেফকে আকুল করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল সে জোয়ারের জলে উচ্ছলিত গঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্রোত তাকে দু’হাত ধরে টানছে, কিন্তু এর মধ্যে গেলে সাঁতরে ফেরার কোনো উপায় থাকবে কিনা জানা নেই। এই ভাবনা তাকে উদ্বিগ্ন করছিল।
আ-লেফ! অ্যাবিয়েলের ঘন কালো চোখ আলেফের চোখকে বন্দী করল। তুমি কি আমার কাছে আসতে ভয় পাও?
ভয় পায় অ্যাবিয়েলকে? না তো। বরং নিজেকে ভয় পায়। উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়া আলেফের কাছ থেকে কোন সাড়া এল না।
আ-লেফ বুঝি নিজেকে ভয় পায়? অ্যাবিয়েলের ঠোঁট আলেফের ডান কানে কথাগুলো প্রবেশ করাল। এই শব্দেরা আলেফের ভিতরে ঢুকে অনেক গলিপথে ঘুরপাক খেল। নিজেকে অ্যাবিয়েলের কাছে নিঃশেষ করতে কি ভয় লাগে তার? ভয় না দ্বিধা? দ্বিধা না দ্বন্দ্ব? আলেফ যে আলেফ আলিকে চেনে গত বাইশ বছর ধরে, অ্যাবিয়েলের আ-লেফ কি আর সেরকমটা থাকবে? অ্যাবিয়েলের আ-লেফ যদি তার ভিতরে ঢুকে আসে আর আলেফ এরপর কোনোদিন নিজের ভেতর থেকে বেরোতে না পারে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়ে আলেফ আরও জোরে অ্যাবিয়েলকে জড়িয়ে ধরল। তাদের পোশাকেরা ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জিজ্ঞাসার মোড়কের মত খসে পড়ল এক এক করে। সাত ভাগ কালো আর এক ভাগ সাদা মেয়ে তার সমস্ত কোমলতা, উষ্ণতা আর প্রশান্তির আশ্বাস নিয়ে এই হিন্দু পুরুষটিকে নিজের মধ্যে টেনে নিল।
বাইরে জ্বলতে থাকা শহরকে দ্রুত ভুলে গেল ওরা। আলেফ তার ফেলে আসা গ্রাম শহরকে মন থেকে মুছে নিল, অ্যাবিয়েল দেওয়ার কিছু বাকি না রেখে আলেফকে গ্রহণ করল। অবস্থান, সময়, কার্যকারণ বিস্মৃত হল। বর্তমান থেকে বিচ্যুত হল।
এমনটা বেশিক্ষণ সম্ভব হল না। জেনারেল জনসন ফ্রেমের মধ্যে থেকে ছটফট করছিলেন। এর আগেও ছবি থেকে তার নেবে আসার কাহিনী শোনা গেছে, কিন্তু আজ তাঁর উত্তেজনার কারণ আলাদা। অ্যাবিয়েলের অস্ফূট শীৎকারে জেনারেল জনসন শুনেছেন হিন্দু শব্দটি বারবার আর গা কুটকুটিয়ে উঠেছে। আজকের এই লোকটাকেও তাঁর পরিচিত মানুষদের মত লাগছে না মোটেই। এ বিদেশী, অন্য এক প্রজাতির। এই দেশে ঢুকে আসছে। হানাদারদের থেকে এই দেশকে বাঁচানোর জন্যই না যুদ্ধে গেছিলেন জেনারেল জনসন? জেনারেলের মাথায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। তিনি এক লাফে ঘরের মধ্যে এসে গেলেন।
এই ঘর তাঁর চেনা। কোনো এক সুদূর সময়ে এই ঘরে বসেই যুদ্ধের শলাপরামর্শ চলেছে। যবে থেকে এই ফ্রেমে আটকা পড়েছেন, আর অ্যাবসিন্থ হাউজের মেয়েরা এই পালঙ্কে কোনো পুরুষকে নিয়ে এসেছে, ইচ্ছা হলেই পাতলুন খুলে জেনারেল ঘরে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আজ তিনি এলেন তলোয়ার খুলে। তার মুখ থেকে যুদ্ধের হুঙ্কার উঠল। তাঁর তরবারি মাথার উপরে উঠল আর নেবে সোজা ঢুকে গেল আলেফের বুক চিরে।
অ্যাবসিন্থ হাউজে আসা খদ্দেররা যখন জেনারেল জনসনের কাছে ধাক্কা খেয়ে বিছানা থেকে ছিটকে পড়েছে, তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি, পয়সাও ফেরত পায়নি। যে মেয়েরা সেই ঘটনার শারীরিক প্রমাণ বহন করে, তারা হ্যাঁ-ও বলেনি, না-ও করেনি কোনোদিন। তরবারির আঘাতে আলেফের মৃত্যুর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি কখনো। আলেফকে হেঁটে চলে বেড়াতে দেখা গেছে, কিন্তু সে যে ভূত নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আলেফ কি দুটো ছিল, যার একটা জেনারেল জনসন মেরে ফেলেছিলেন? নাকি আলেফ একজন ছিল আর তাকে দ্বিখণ্ডিত করলেন? যে আলেফ ওই ঘরে ওই খাটে অ্যাবিয়েলকে নিয়ে জ্বলন্ত শহর থেকে পালিয়ে বেঁচে রইল, সে, আর যে আলেফ উত্তপ্ত শহরের রাস্তা ধরে কাঁচা কয়লার আগুনের উপর দিয়ে ছুটে যাওয়ার মত নিজের ক্যানাল স্ট্রিটের বাড়িতে পৌঁছে গেল, তার বাক্সপ্যাঁটরা খুঁজে অনেকদিন না দেখা সেই চিত্রবিচিত্র মাটির হাঁড়ি বের করে তার মধ্যে আর সেই পুরোনো সজীব চিংড়ি মাছটিকে একেবারেই খুঁজে না পেয়ে অবসন্ন হাহাকারে লুটিয়ে পড়ল, তারা কী? এক থেকে দুই, না দুইয়ে মিলে এক?
সবাই বলত আলেফের ভূত। কারণ এই আলেফ একটু ঝুঁকে, চোখে কুয়াশা মেখে হাতে এক চিত্রবিচিত্র হাঁড়ি নিয়ে মিসিসিপির বাঁকে বাঁকে ঘুরে বেড়াত হারিয়ে যাওয়া চিংড়ি মাছটার খোঁজে, যে মিষ্টি জলের চিংড়ি এই হাঁড়ির মধ্যে ঢুকলে আমিনা হয়ে বেরিয়ে আসবে। কোনোদিন। কোনো একদিন।