এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (১৪)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ১০৪৩ বার পঠিত

  • ১৪

    গোবিন্দ পরের দশদিন টোনিয়ার বোর্ডিংহাউজে ঘাপটি মেরেই রইল। নিঃশব্দ বন্ধ ঘর, একটা দুটো ইঁদুর কি ছুঁচো ঘুরলে তাও খুটখাট কিছু শব্দের আশা ছিল। টেন্ডারলয়েনে রাতের দিকে বাইরে অনেক আওয়াজ ওঠে। ঘর ফেরা মাতালের চিৎকার, রাতফেরত সওয়ারি নিয়ে ছুটে যাওয়া ক্যারেজ আর মাথার উপর দিয়ে পাটাতন ঝমঝমিয়ে ছুটে যাওয়া রেলগাড়ি ঘরের ফাঁকফোকর খুঁজে ঢুকে পড়ে ঘরটায়। ব্যস এইটুকুই, সে শব্দ শোনা গেলেও তার সঙ্গে আলাপচারিতা চলে না। নাগালের মধ্যে আসার মত একমাত্র বাইরের বাতাস আফ্রিকা। টোনিয়া তার বপু নিয়ে অত ওঠানামা করতে পারে না, শুধু একবারই যা এসেছিল। আফ্রিকাও টোনিয়ার কথা মান্যি করে শুধু খাবার রেখেই চলে যাচ্ছিল। সময়মত খাবার এনে, কোণার টেবিলে খাবার রেখে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ। হয়তো গোবিন্দ ঘুমিয়ে আছে, কি আধঘুমে। বাতাসের ওঠাপড়া বা আর একটি মানুষের উষ্ণতার জানান পেয়ে শরীরের ঘোর ভাঙতে ভাঙতেই ঘরে আবার শূন্যতা।

    গোবিন্দর শরীরে যে এত ঘুম জমে ছিল, সে নিজেও জানত না। দিনভর ঘুমাতে কসুর করেনি শুরুর ক’টা দিন। জাহাজের স্টকহোল্ডে কাজ করে শরীরখানা এমন দুমড়ে মুচড়ে যায়, সবসময় ঘুমের জন্য মুখিয়ে থাকে। দু’দিন এমনি গেল। তারপর বদনখান এমন ঝরঝরে হয়ে গেল, মোটে ঘুমই আসে না চোখে। শুয়ে থাকলে বরং গায়ে বেদনা। ওইটুকু তো ঘর, হাত-পা খেলানোর ঠাঁই নেই। পায়চারি করার পরিসর দূরস্থান। সে বেচারা কি করে? বিছানার উপরেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইল রাতভোর। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ফুটল, ঘরের হলুদ আলোর সঙ্গে ছায়া ভুবন তৈরি করল। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। জাহাজের জন্য মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল গোবিন্দের। অথবা ঠিক জাহাজের জন্য নয়, শুধু একটু বাইরে যাওয়ার জন্য। একটু বাইরের আলো বাতাস, মানুষের মুখ, কারো সঙ্গে দু’টি কথা কইবার তরে পাগলপারা ছটফটানি। ঠিক যেমন একেকবার ফার্নেসে কয়লা ঢেলে গোটা শরীরখান শুকিয়ে যেত, আর ইচ্ছা হত দেয় এক ঝাঁপ মাঝদরিয়ায়, নিশ্চিত মরণ জেনেও, এখন তেমনি ধরা পড়ুক চাই যা খুশি হোক – বাইরে একদম যাওয়া চাই – এমন একটা বেপরোয়া ভাব তাকে গ্রাস করছিল।

    এই কথা শুনে আফ্রিকার নাওয়ের মত বাঁকান ভুরু উথাল-পাথাল হল, নদীর জলের মত গভীর চোখে ছলাত ছলাত ঢেউ উঠল। হাত পা নেড়ে সে মেয়ের কি ধমক! তুমি কি পাগল হচ্চো? বাইরে গেলে তোমাকে ওমনি পাকড়াও করে আবার জাহাজে নে যাবে – সেই বুঝি ভাল কতা হবে?
    ছিলাম তো সেখেনে এতগুলো বচ্ছর। বেঁচে বর্তে আছি এখনো। আবার নয় কাজ করবো ফার্নেসে।
    আর তোমার সেই লোকটার খপর চাইলে কি কইবে? যা ঘুম দিচ্চিলে তার কথা বিস্মরণ গেচো বুঝি?

    শুনেই দমে গেল গোবিন্দ। কথাটা ঠিক, তার যে হাত পা বাঁধা। কোন মুখে ফিরবে জাহাজে, কি জবাবদিহি দেবে? নাচ দেখতে দেখতে আক্রাম গায়েব হয়ে গেছে? কেউ বিশ্বাস যাবে না। আর জাহাজে যা হবে, সে না হয় হল – গাঁয়ে ফিরে আক্রামের আব্বাকে কি ব্যাখ্যানটা দেবে?

    আফ্রিকা আজ সকালের খাবার দিয়ে চলে গেল না। চেয়ার টেনে বসল সে মেয়ে। ঘরে বন্ধ থেকে হাঁপিয়ে উঠেচো? আর ক;টা দিন সবুর যাও, তারপর যাও না যেদিকে খুশি।
    খুশি মতন কি পারবে কোথাও যেতে? কোথাও যাওয়ার হাল হদিশ আছে তার কাছে?
    শুনেচি জাহাজের কাজ, সে বড় খাটনির। সত্যি গোবিন?

    সম্মতিতে মাথা দোলায় গোবিন্দ। সব জায়গায় অত খাটনি নয়। যেমন ধরো, যারা কেবিনের দেখভাল করে, খাবারের যোগানদারি করে। ওসব যেন মেয়েদের কাজ। কাজ থাকে চুল্লিতে। কি তাত সেখেনে। ফার্নেসের দরজা খোলার আগে আমরা কি কত্তাম জানো? দরিয়ার পানি নিয়ে ঝপঝপ করে মাথায় ঢালতাম। তারপর সোজা ওই চুল্লিতে।
    ও বাপরে। চুল্লিতে সেঁধিয়ে যেতে? কি করতে ওখেনে? আফ্রিকার চোখ দুটো দেখার মত হল বটে। তার চোখের ফাঁদ বেশ বড়, আশ্চর্যে এতটাই গোলগোল হল, যেন নদীর মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠা চোরা-ঘূর্ণি।

    ওর চোখ-মুখের চেহারা দেখে হেসে ফেলল গোবিন্দ। নারে বাবা, চুল্লির ভিতরে ঢুকবো, পাগল নাকি? কিন্তু ওই যে দরজাটা খুলে কয়লা ঢালতাম কি নেড়ে ঘেঁটে দিতাম, ওতেই গায়ের জামা শুকিয়ে আংরা। এক নিমেষে চুল্লির আগুনখেকো দানোটা বদন থেকে সব রস নিংড়ে নিত। ওতেই কত লস্কর ভিরমি খেয়েছে, কেউ বা দিবানা হয়ে যেতো। একবার কি হল বলছি – গল্প করার সুযোগ পেয়ে গোবিন্দর পালাই পালাই ভাবটা ঝপ করে কমে এসেছিল। ইব্রাহিম বলে এক ছোকরা, চুল্লির কাজে তখনো নতুন। কি যে তার মাথায় হল, ডেকে দৌড়ে গিয়ে গোলগোল পাক মারতে থাকল।
    সে আবার কি? গায়ে আগুন লেগে গেছিল নাকি?
    কে বলবে ওর মনের কথা। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার, সে এক ফিরিঙ্গি লোক, ওকে থামাতে এল, তো ইব্রাহিম তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ডেকের উপর দু’জনের হুস্তুম-মুস্তুম চলল বেশ খানিক। সে যাত্রায় বেচারা ইব্রাহিমকে জাহাজের খোলে আটকে রাখা হয়েছিল বাকি ।
    কেন এমন করলো? আগুন দেখে মাথা খারাপ?
    দেখে নয় চেখে। বদন জ্বলিয়ে দেয় যে বড়। মাথার ঠিক থাকে না কোনো। অবশ্য অনেকে বলে, সেই আগুনের মধ্যে থেকে নাকি কাউকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। যে দেখে ফেলে তার আর মাথার ঠিক থাকে না। এই কারণে আমরা কয়লা ঠেলার সময় যতটা পারি চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতাম।
    তুমি যে এতদিন কাজ করেচো, তোমার মাতা খারাপ হয়নি? এমন সব অজানা কথা শুনতে বেশ লাগে আফ্রিকার, আর পিঁপড়ের পেট টিপে টিপে কথা বের করে আনতেও জানে।

    নিজের কাণ্ড স্মরণ করে খুব লজ্জা পেয়ে হাসল গোবিন্দ। হয়েছিল সে একবার। রোজ করি ওই কাজ, কম বচ্ছর তো করলাম না। তখন আমরা রেড সিতে। একদিন হল কি, মাথায় কেমন ঘোর চেপে গেল। মনে হল আমার সারা গায়ে যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি পুড়ে যাচ্ছি। দৌড়ে চলে যাচ্ছিলাম দরিয়ায় ঝাঁপ দেবো মনস্ত করে।
    ও বাবা, তুমি কাউকে আগুনের থেকে বেরোতে দেখে ফেললে সেদিন?
    আমি জানি না আসলে কি দেখেছিলাম আর কি ভেবেছিলাম। মাথার ঠিক ছিল না। যা জানি সব অন্য লস্করদের কাছ থেকে শোনা কথা। আমি দরিয়ায় ঝাঁপ দেওয়ার আগেই পিছন থেকে জাপ্টে ধরে শোভান মিয়া। সে বলল আমার বদন খান যেন এক আগুনের গোলার মত তাপ দিচ্ছিল। সে না থাকলে ওখানেই লীলে সাঙ্গ হত সেদিন।

    এমনি নানা গল্প জমতে থাকে আফ্রিকার সঙ্গে। খাবার দিতে এসেই আর চলে যেত না মেয়েটা, বসছিল খানিক।
    টোনিয়া জানলে রেগে যাবে না?
    ওর চোখ দুষ্টুমিতে ঝিকমিক করে উঠেছিল। ও বুড়ি কালেভদ্রে উপরে আসে। সেদিন এয়েচিল সেই ভাগ্যি, ওই চেয়ারা নিয়ে সিঁড়ি ঠেলে বারবার ওঠা তার কম্মো নয়।
    আফ্রিকা বসে বসে গোবিন্দর খুঁটিনাটি জানতে চায়। বুঝতে চায় তার গ্রামের হাল-হদিশ। শুনতে চায় বইরালি গ্রামের রমনাবির কথা। গোবিন্দর সামান্য জীবন নিয়ে কেউ কক্ষনো এমন উৎসুক হয়নি। সে তার শাড়ি পরা বিবির রূপ বর্ণনা করে, কথায় কথায় তার দুই ছেলে আর মেয়ে জড়িয়ে যায়। জাল ফেলে সুরমা নদীর গহীন পানিতে মাছ ধরার কথাও বাদ থাকে না। বলতে বলতে নদীর ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারে গোবিন্দের চোখে মুখে।

    আমাদেরও নদী আচে। নদীর কথা শুনে যেন বাচ্চা মেয়ে হয়ে যায় আফ্রিকা।
    হাডসন? সুরমা অত বড় নয় অবিশ্যি।
    না, না। আমার গাঁয়ের নদী। সেন্ট জনস। জ্যাকসনভিলে আমার ঘর, সে তো ওই নদীর পাড়েই।
    তুমিও নদীর দেশের মানুষ? আমার দেশে আগে পিছে যেদিকে চাও সব নদী। তোমার এই নদীটা কোথায়?
    ফ্লোরিডা। সে জায়গাটা এখান থেকে অনেক দূর, দক্ষিণ সমুদ্রের কাচে।
    তাহলে তুমি কেন বাড়ি ছেড়ে এখেনে এসেছ? ওখেনে কাজ নেই বুঝি?
    আমি পড়তে এয়েচি। ওখেনে যে কালোদের ইস্কুলটায় পত্তাম তাদের হাই স্কুল ছিল না তো। ওইসব দিকে অনেক বাধা-নিষেধ, সাদাদের গা ঘেঁষতে পারি না মোটেই, পড়ার কথা দূরস্থান। তাই চলে এসেছি নিউ ইয়র্কে।

    গোবিন্দ সারেং নিজে কতটুকুই বা পড়াশনা করেছে? এইটুকু মেয়ে পড়বে বলে এত দূর থেকে এসেছে এখানে? কত জানে বোঝে! আশ্চর্য শ্রদ্ধা বোধ করছিল। নিউ ইয়র্কে বুঝি কালোদের পড়ায় কোন বাধা নেই?
    এখানে তো সেগ্রিগেশান নেই, তাই আমরাও একই ইস্কুলে পড়তে পারি।
    তাই বলে এত দূরে? ভয় করে নি মায়ের? মেয়েটার জন্য এবার চিন্তা হচ্ছিল। বাড়িটাও তো টেন্ডারলয়েনের উপরে, জায়গাটা বিশেষ ভাল নয়। খারাপ কাজে লেগে পড়তে কতক্ষণ?

    আফ্রিকা যেন তার মনের কথা কপালের ভাঁজ থেকে পড়ে নিল। ভয় কি? টোনিয়া আছে না? টোনিয়ার বাড়ি ছিল জ্যাক্সনভিলে। আমার মা আর টোনিয়া ওয়েট্রেস ছিল একত্রে। মা আর টোনিয়া সেই থেকে সিস্টা’স। ফিক করে হাসল আফ্রিকা। দেখেছ তো টোনিয়া আমাকে কেমন শাসনে রাকে। সোজা ইস্কুলে যাই আর একটা দোকানে কাজ করি। তার বাইরে পা বাড়ালে টোনিয়া দেবে আমার ঠ্যাং ভেঙে।

    কাজের কথায় গোবিন্দ খুব উৎসাহ পেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল কি কাজ করে, কত টাকা পায়, কত ঘণ্টার কাজ – সবকিছু।
    তোমরা জাহাজে অনেক টাকা পাও, দোকানে আর কি পাই, ঘণ্টায় পঞ্চাশ সেন্ট। তাও সবদিন কাজ জোটে না।
    সে তো অনেক টাকা। বারো ঘণ্টা আগুনে কাজ করে জাহাজে বুঝি খুব আমদানি? যা টাকা পাই তার দু’মাসের টাকা দিয়ে দিতে হয় বন্দরের সারেংকে।
    এমন কেন? খুব তেতে উঠল আফ্রিকা। গায়ে গতরে খাটবে তুমি, অন্য লোকে কেন ভাগ পাবে?
    সে লোকটা কাজের খবরি। বন্দরের জাহাজের সঙ্গে কাজের বন্দোবস্ত করে। এ বাদে একমাসের টাকা দিতে হয় লস্করদের সর্দারকে। ওইরকমই বন্দোবস্ত। তারপর ধরো, এই যে এতদিন জাহাজে থাকবো, আগুন আর কয়লা নিয়ে কাজ করবো, ভেবেছো কি জাহাজ থেকে কাপড় দেয়? খোরাকি দেয়, এই কত! কাজের জামা কাপড় কিনতে হয় নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে। এইসব দিয়ে থুয়ে ক’টা টাকা থাকে আমার? সাকুল্যে সত্তর-আশি টাকা সারা বচ্ছরে, তোমাদের হিসেবে বিশ ডলার।
    ও মা! এতো কম? শুনে আফ্রিকা তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল। লাথি মারি এমন কাজের মুকে। বেশ করেচো জাহাজ থেকে পালিয়েচো। তোমায় বলচি শোন, টোনিয়ার সঙ্গে কতা কও। ওর এক ভাই আছে বেথেলহেম পেনসেলভেনিয়ায়, ইস্টিলের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সেও তোমার মত আগুনের চুল্লিতে কাজ করে। তোমাকে কাজ জুটিয়ে দেবে ঠিক।

    সেটা শুনে নড়াচড়া করে বসেছিল গোবিন্দ। আমি পারবো সেই কাজ। টাকা কেমন দেবে?
    আর না হলেও মাস গেলে পঞ্চাশ ডলার পাবে, সে আমি জানি।
    চোখ বড় বড় হয়ে গেল গোবিন্দর। এতোগুলো টাকা? সেই টাকা থেকে আর কাউকে কিছু দিত হবে না?
    তোমার টাকা, আনশান কাউকে দেবে কেন?
    ওই যে কোন সর্দার লোক থাকলে, টোনিয়ার ভাইকে?
    না, সব তোমার।

    খুব খুশি খুশি উঠে বসেছিল গোবিন্দ। তারপর মনে পড়ে গেল, কাজে লাগবে যে তার জন্য কাগজ চাই। আমাকে ওখানে চাকরি দেবে? আমার তো কাজ করার কাগজ নেই কোনো।
    এত সবের খবর আফ্রিকা জানে না। তবু এই খবরটাও একটা আশার আলো। অন্ধকার ঘরে বসে স্বপ্ন দেখার হাতিয়ার।

    বাকি ক’টা দিন দিনভোর দিল-দিমাগে এইসব কথাই ঘুরতে থাকল। চোখ বুজলে খোয়াবে তার না দেখা শহর বেথেলহেমে আটচালা বাড়ি হল, সেখানে রমনাবি হেঁশেলে গোশত বানাচ্ছে আর সারা ঘর খাবারের বাসে ভুরভুর করছে। বাপ ছেলের টিফিন বাঁধা হলে দামোদরের সঙ্গে কাজে বেরোচ্ছে একত্রে। সুদি ইস্কুলে যাচ্ছে। ময়নাও, আফ্রিকার মতন। এইসব স্বপ্ন তাকে মনে জোশ দিল, আবার কমজোরও করে দিল। কাজের জন্য কাগজ চাইলে তখন কি হবে ভেবে বুকটা পাক মারে। এইসব একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে সে কথাটা পাড়ল টোনিয়ার কাছে।
    সে তুমি বেথেলহেম যেতে চাও, আমি এডির ঠিকানা লিকে দেবো তোমায়। কিন্তু ওই যে কাগজ না কি বলচো, সে তো আমি কিছু জানিনে। তার হদিশ তোমাকেই লাগাতে হবে।

    কি করবে প্রথমে মাথায় এল না কিছু। তারপর মনে পড়ল ডক্টরের কথা। দশদিন আগেই তো দেখা হল, মনে হচ্ছে যেন এক যুগ। ভুলেই গেছিল। জাহাজ বন্দর ছাড়ার খবর জানিয়ে টোনিয়া বলল, এবার তোমাকে অন্য আস্তানা দেখতে হবে বাপু। আমার এখেনে সব মেয়েরা থাকে, আর ক’দিন তোমায় লুকিয়ে রাকি?
    টোনিয়াকে দোষ দেওয়া যায় না। সে অনেক করেছে, বিদেশ বিভুঁয়ে কে এমন যত্ন-আত্তি করে? তার কাছ থেকে একদিনের সময় চেয়ে নিয়ে গোবিন্দ হাঁটা দিল বন্দরের পথে, ডক্টরের দোকানে। যদিও জানে সেন্ট লুই সাদাম্পটনের পথে রওয়ানা হয়ে গেছে, মনের ধুকপুকানি যায় নাকি! সবসময় মনে হয় তাকে পাকড়াও করার জন্য পিছনে বুঝি এল কেউ। এই সময়টায় আক্রাম সঙ্গে থাকলেও মনে বলভরসা বেশি পেত। সে বান্দা যে কোথায় হাপিস হয়ে গেল, আল্লা জানে।

    ডক্টরের দোকানে আর কেউ ছিল না ভাগ্যিস। গোবিন্দকে দেখে সে মুখ জুড়ে হাসল। জাহাজ থেকে পালিয়েছ তাহলে। তোমার স্যাঙ্গাত কোথায় গেল?
    আক্রামের কথাটা পাশ কাটিয়ে গেল গোবিন্দ। তোমার কথায় সাহস করে পালিয়েছি, এবার বলো যাবো কোথায়? আমায় কাজ দেবে কে সেটা তো বুঝতেই পারছি না, কাজ করবার সনদ কেমন করে পাওয়া যায়?
    ডক্টর খুব একচোট হাসল। আরে, এক পা এক পা করে এগুতে হয়, তুমি তো একেবারে রেলগাড়ির মত দৌড়াচ্ছ। জাহাজ পালানো লোকেদের সঙ্গেই ডক্টরের কারবার, সব আঁটঘাট ফন্দি ফিকির জানা তার। দাড়ি চুমরে বলল, পাঠিয়ে দেব তোমাকে ঠিক লোকটার কাছে, কিন্তু তার আগে রেজগির ব্যবস্থা করেছো কি?

    সেদিনের বিশ ডলারের কিছু গেছে নাচ দেখতে গিয়ে, এখুনি কিছু দরকার নেই। কিন্তু পাউন্ডের মায়া রেখে লাভ কি, যখন এই দেশেই ঠাঁই গাড়তে মনস্ত করেছে? বাকি ক’টা পাউন্ডের নোট জেব থেকে বের করে বাড়িয়ে দিল ডক্টরের দিকে। আগের থেকে লোকটার উপর বিশ্বাসটা বেড়েছে কিছু।
    তোমার জাহাজ তো ছেড়ে গেছে, এবার দেখো যদি কোন আমেরিকান জাহাজে চড়তে পারো। ওখানে আমদানি ভাল হবে। থাকছো কোথায়?

    টেন্ডারলয়েনের কথা শুনে বুড়ো মাথা নাড়ল। জাহাজে যদি কাজ চাও তোমাকে কিনারায় থাকতে হবে। আর কিছুটা এগোলেই পাবে সিমেন’স ইন্সটিটিউট, ওটা বোর্ডিং হাঊজ। ওখানে একটা থাকবার জোগাড় করো। তোমার জাতভাইও পেয়ে যাবে। হেঁ হেঁ করে হাসল ডক্টর। তুমিই তো আর প্রথম নয় যে জাহাজ থেকে ভেগেছে, এমন হরদম হচ্ছে। দেখবে তোমার দেশের লোকরাই আছে ওখানে, তারাই তোমাকে কাজ জোটানোর হদিশ বাতলে দেবে।

    এমন কপাল, দেশের লোক না – ওখানে উপায় জোটালো হিথক্লিফ বলে আর এক ব্রিটিশ। সেও এক ব্রিটিশ স্টিমশিপ থেকে পালিয়েছিল। ঘাঁতঘোঁত সব জানে। বলল থাকছো তো এখানে, আগে টাকা দিয়ে এখানে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলো।
    তারপর, তারপর কি হবে?
    হিথক্লিফ পোড় খাওয়া লোক। পাকানো চেহারা, জাহাজ থেকে পালানোর আগেও অনেক দেশ ঘুরেছে। সে নিজে কাজ করত কেবিনে। পালানোর পরে বছর-দুই ঘুরেছে আমেরিকার মার্চেন্ট শিপে। তারপর খুলে বসেছে এই বোর্ডিং হাউজ। সব দেশের নাবিকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। তার মোট মোটা আঙুলের বিশাল পাঞ্জা রাখল গোবিন্দের কাঁধে, যেন কতদিনের আত্মীয়। জাহাজের মুখ-খিঁচানো ক্যাপ্টেন বা মেটদের মত নয়। ওরাও ব্রিটিশ, লস্করদের জন্তু জানোয়ারের মত খেদিয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই লোকটার আঙুলের চাপে বেরাদরির আশ্বাস।

    ঘাবড়াবার কিছু নেই, গোবিন। উপায় তোমার অনেক। আমার দেশের জাহাজ থেকে অনেকেই পালায়, তারা যায় আমেরিকার মার্চেন্ট শিপে। এদের নিজেদের জাহাজে অনেক লস্কর লাগে কিনা, তাই বিদেশি নাবিকদের জন্য ইমিগ্রেশানের নিয়মকানুন খানিক আলগা। অর্থপূর্ণ হাসি হাসল হিথক্লিফ। ন্যাচারালাইজ করার জন্য একটা পিটিশান বানিয়ে দেবো, তারপর জুতে পড়ো ওদের জাহাজে। আমেরিকার মেরিটাইম ইউনিয়ানে ঢুকে গেলে তিন বছরের মধ্যে এই দেশের নাগরিক। ব্যস, আর কি চাই?
    এত সোজা? গোবিন্দ ভাবতেই পারছিল না তার এমন সৌভাগ্য হবে। যদিও জাহাজে ঘোরার অত সাধ নেই আর, দরকার হলে তাও করবে। বেথেলহেমের আটচালা বাড়ির স্বপ্নটা ঘাই মারছিল বুকে। সে না হয় দেখা যাবে, কিন্তু পথ আছে এই আশ্বাসটা এক বিশাল পাওনা। টোনিয়ার ঘর ছাড়তে হত, তার একটা উপায় হয়েছে। মাথার উপর ছাদের জোগাড় হয়েছে এই খবরটা টোনিয়া আর আফ্রিকাকে দিয়ে এখানে আগে থিতু হোক দু’দিন, তারপর সব কিছু আগাপাশতলা ভেবে নেবে’খন।

    দেশ বিদেশে অনেক জাতের লোকের সঙ্গই করেছে গত বিশ বছরে। কিন্তু এই দশদিনে এক ইহুদি দোকানি, দুই নিগ্রো মেয়ে আর শেষে এই ব্রিটিশ নাবিক – সবাই মিলে কি আলোটাই জ্বালল তার জীবনে। আল্লার দোয়া না থাকলে এমন হয় না। আমেরিকা দেশটারও একটা রূপ উজিয়ে উঠছিল বইরালি গ্রামের অশিক্ষিত লস্কর গোবিন্দ সারেং-এর সামনে। বহু দেশ থেকে আসা অমনি অনেক জাতের অভিবাসীদের মত তার সামনেও এই দেশটার দরজা খুলে যাচ্ছিল। যারা সেটা খুলে দিচ্ছে জাত বেরাদরির কেউ নয় তারা, তবুও বড় আপনজন।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ১০৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন