নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
সেন্ট লুই ১৪ নম্বর পিয়ারে ভিড়তেই লস্কর মাল্লাদের মধ্যে ম্যানহাটানের পথে নামার হিড়িক উঠেছিল। দু পাঁচ ঘণ্টার শোর লিভ নিয়ে পায়ের তলায় খানিক জমি খুঁজে পাওয়া। যারা নতুন আমদানি তাদের দোকান পাট ঘুরে দেখার শখ। ঘাঘু নাবিকেরা ছুটেছে টেন্ডারলয়েনের পথে। তপ্ত তাওয়ায় বাদাম ভাজার মত ফুটফাট চাঞ্চল্যে ভরপুর সেই চত্বর। এই নামের পরিসর ২৪ নম্বর স্ট্রিট থেকে ৪২-এর শেষতক। আবার ওধারে ফিফথ অ্যাভেনিউ থেকে সেভেন্থ। এলাকার অর্ধেকের বেশি বাড়িই আসলে নাচঘর, মদের গুমটি আর বেশ্যাদের আস্তানা। তবে যেইটুকু সময় ওদের নামার জন্য বরাদ্দ, আগে থেকে ঠেক না জানলে শুধু হাঁটাই সার। বড় ঠেক বলতে সিক্সথ অ্যাভেনিউতে কসার আর বেইলির মিউজিক হল যেখানে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় ক্যান ক্যান ডান্স। ওই মেয়েদের সঙ্গে নাচাও যায়, আর খুব পছন্দ হলে কাপড়ের আড়ালে তাঁবুর মত জায়গায় নিয়ে বিছানায় ফেলা যায় সটান। তবে এসব আস্তানায় ঢুকতে অনেক রেস্তো লাগে, ফার্স্ট মেট, সেকেন্ড মেটরা পারে। মাঝিমাল্লারা শুধু পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখে। তাতেও দেখায় কোন ঘাটতি নেই। ঝোলানো বারান্দায় এসে বুকের কাপড় নামিয়ে দুই এক পদ নেচে যায় মেয়েরা, লোক ডাকার ছলে। যাদের পকেট খালি ওই দেখেই সোনামুখ করে হাঁটা দেয় পশ্চিম চত্বরে, ২৯ নম্বর স্ট্রিটের দিকে। সেখানে সস্তার মৌচাক আর মৌতাত দুইই মজুত।
গোবিন্দ আর আক্রামও নেমেছিল। ধান্দা ম্যানহাটানের এদিক ওদিক ঘুরে দেখবে একবার। গোবিন্দ আগে এসেছে, টেন্ডারলয়েন তার দেখা আছে। তবে তার দৌড় ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝুলবারান্দার পানে চেয়ে থাকার। আক্রাম নিউ ইয়র্কে এই প্রথম। ঘুরে দেখার উৎসাহে টগবগ করছিল, বয়সটাও কাঁচা। তাগড়া জোয়ান, তেল দেওয়া বাঁশের মত চেহারাখানা। ফার্নেসে কাজ করে করেও দরকচা মেরে যায়নি। এতদিন জাহাজে থেকে শরীরটা খিদেয় ছটফট করে। একটা মেয়ের নরম শরীরই শুধু এই আগুন নেভাতে পারে।
সময় খুব মাপাজোকা। মাত্র ঘণ্টা চারেকের ছুটিতে ঘাটে নেমেছে। আক্রাম চাইলেও ২৯ নম্বর স্ট্রিট অবধি গিয়ে একবার ঝাঁক মেরে চলে আসার বেশি উপায় নেই। এর মধ্যে গোবিন্দর মুখটা সুলাচ্ছিল একটা আমেরিকান সিগারেটে টান দেওয়ার জন্য। এক টান মারমুনে?
এমনিতে আক্রামের আপত্তি ছিল না। দেরি অইতো নায়? আমরা নু টেণ্ডারলয়েন যাইতাম?
যাইমু তো। যাইবার আগে একটা সুখটান দিয়া যাইতে পারলে মনটা ফুরফুর করতো খুব!
তুমার কিতা মনো ওয় গোবিন দা, সায়েবোর দেশো মানষর নাম ওতো আজব কেনে কও চাই? টেন্ডারলয়েন!
তোর লগে কিতা আমি টেন্ডারলয়েনোর গফ করছি না? এক পুয়া আছিল, হ্যাটকিন্স কইয়া নাম পুয়ার, তার গেছে হুনছিলাম ওউ গফ। কিতা অইছে জানস নি? হালার পট্টিত ক্লাবার উইলিয়ামস নামোর এক দারোগা আছিল। ক্লাবার বেটা নামোর দারোগা আর কামো আমরা দুলু মিয়ার লাখান।
থানার ইতা বা হক্কলটি এক লাখান অইন গোবিন'দা। আমরার জেলাত আছিল দফাদার এগু, মানষোর গেছ থাকি হে কিতা কম পয়সা খাইছে নি?
ক্লাবার বেটায় দুই-আত ভরিয়া লুটছিল, কিজাত বুকুর পাটা রে তার! জনে জনে গাইয়া ফিরতো- অখন পয়সা লুটরাম, টেন্ডারলয়েন ছাড়িয়া আর কুন্তা খাইতাম নায় ই জীবনে।
ইতা তো এক্কেবারে পুকড়িচুরি বা দাদা। আমরার দফাদারেও এমোলাখান মাততো নায়।
কথা বলতে বলতে ওরা মানহাটানের পশ্চিম কিনার ধরে হাঁটছিল। ওইখানেই পেয়ে গেল এক মনোহারি দোকান। দেখেছে কিন্তু আগে কখনো এই দোকানে ঢোকেনি গোবিন্দ, আর আক্রামের তো এই দেশে প্রথমবার। দোকানের তেমন কিছু জলুশ নেই, বাহার নেই। এস ডক্টর প্রভিসনস লেখা বোর্ডটা পর্যন্ত এক দিকে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে, কারবারের মালিকের এতে কোন চ্যাদব্যাদ নেই যেন।
দোকানি লোকটার ছুঁচোল মুখ, নাকটা টিয়া পাখির মত। রং কোনকালে ফটফটে ছিল, এখন চামড়া ঝুলে সেই চিকনাই আর নেই। মাথার চাঁদিতে একটা হাতে বোনা সাদা টুপি। সাদা জামার উপরে একটা হাত কাটা জ্যাকেট, সবজে রঙের। দোকানে থরে থরে সাজানো রোজকার ব্যবহারি জিনিস।
গোবিন্দ শখ করে একটা পালমল সিগারেট নিল আজ। মাটিতে পা দেওয়ার আমেজে নিজেকে একটু অন্যরকম ভাবতে দোষ কি।
সিগারেট হাতে ধরিয়ে লোকটা সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জাহাজি? তার মুখ থেকে কাঁচা রসুনের গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
হ্যাঁ। ঘাটে নেমে গোবিন্দ সংক্ষেপে কথা সারা পছন্দ করে। কার পেটে কী আছে তা কে জানে। তাছাড়া তার ইংরাজির দৌড় অত বেশি নয় তো, কী কথার কী মানে করবে।
কোন জাহাজ?
এস এস সেন্ট লুইস।
দেখেই বুঝেছি। মুচকি হাসিতে লোকটার মুখটা লাগল যেন একটা শেয়াল। যদিও শেয়ালের হাসি না দেখেছে গোবিন্দ সারেং, না জানে আক্রাম আলি। কিন্তু লোকটাকে কেমন ধান্দাবাজ মনে হচ্ছিল। লোকটার কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কতদিন ভাল করে স্নান করনি বুঝি?
সিগারেটে লম্বা টান দিতেই কাশির দমক উঠল গোবিন্দর। বড্ড গায়ে পড়া তো। গলায় বিরক্তি আর শ্লেষ্মা জড়িয়ে বলল, দিনে ষুল্ল ঘণ্টা কাজের পরে শরীরে আর কুনু তেজ থাকে? যেদিন থাকে ভাল করে ছান করি, নাহলে ঝপঝপিয়ে পানি ঢেলে বিছনাত পড়ি যাই।
আক্রামের নাক দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের হল। তার মনের কথাটা বাইরে এলে বোঝা যেতো সেটা দমচাপা দুঃখে। শেষে বলেই ফেলল নিজের ভাষায়, কিতা অইবো অতো নাই ধুয়া করিয়া? আমরা লাগি তো আর রাজার পুড়ি বিছনাত বার চার না!
ডক্টর না বুঝে বোকা চাহনিতে চেয়ে আছে দেখে গোবিন্দ ইংরাজিতে বলে দেয়, বলছে কোন রাজার মেয়ে তো পাবেনা। ছান করে কী লাভ?
হেঁ হেঁ করে খুব একচোট হাসল ডক্টর। সে তো বটেই। কিন্তু আজকে যেখানে চলেছো, সেখানে সবাই যে স্বপ্নকুমারী। সেই বেলা? জাহাজিরা ঘাটে নেমেই কোন পথে ছোটে, তার হালহদিশ সব জানা লোকটার।
ফালাও কড়ি, মাখো তেল, ওরা কি আর গন্ধ হুঙ্গে শুতে আসবে?
টাকার কথায় লোকটার চোখ আরও জিজ্ঞাসু হল। আমদানি কেমন তোমাদের? কত ডলার কামাও দিনে?
পাউন্ডের হিসাবে দেয় ত, তোমাদের এখানকার ডলারে নয়। গোবিন্দ টাকার অঙ্ক বলতে চাইছিল না। বিদেশ বিভুঁই, কে জানে কী মতলব। আক্রামের তো কথাটা শুনেই জেবে হাত চলে গেছে। বেচারা এতদিনের সব রুজি রোজগার নিয়ে জাহাজ থেকে নেমেছে।
জানি জানি। ব্রিটিশ জাহাজগুলো একেবারে চশমখোর, খাটায় ষোল ঘণ্টা, টাকা দেয়ার বেলায় অষ্টরম্ভা।
কেন ইধারের জায়াজে বেশি দেয় বুঝি?
সারা জীবন জাহাজেই ঘুরতে চাও না কি?
না হলে খাইমু কি?
কেন, মাটির উপর চাকরি নেই? এদেশে কত রকমের কাজ। যাও চলে কারখানায়, সেই আগুন ঠেলার কাজ করলেও দুগুণ টাকা পাবে। এমনি আরো অনেক কাজ আছে। কাজের অভাব নেই, লোকের অভাব।
আমাদের কাগজ নেই, কাম কেনে দিবো?
লোকটার চোখ চকচক করে, যেন ফাঁদে পড়েছে কোন খরগোশ, এমন ভাব। আজকাল এদিকে খুব লোকের দরকার। তোমাদের মত তাগড়া জোয়ান পেলে কাজ কেন দেবে না? কত লোকই তো জাহাজ থেকে পালিয়ে এখানে কাজে জুটে গেল।
তুমি ইতা খবর কেমন করে জানলে?
আমার কাছে আসে তো টাকা বদলে ডলার নিতে। কার কাছে কী টাকা দেখলেই সব বুঝি। কান এঁটো করে একচোট হাসল ডক্টর। রেখেও যায় ওদের টাকা, আমি ওদের হয়ে সুদে খাটাই।
এবার লোকটার আসল ব্যবসাটা বোঝা গেল। গোবিন্দর আরো শোনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আক্রাম আলি পেছন থেকে খালি গুঁতাচ্ছিল। অবশ্য কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক।
ওরা বেরোচ্ছিল, লোকটা পিছন থেকে ডাকল। শোন, শোন। যে পথে যাচ্ছো সেখানে পাউন্ডে দিলে ঘাঁটা পড়ে যাবে তোমাদের। তার চাইতে আমার এখানে ডলার বানিয়ে নিয়ে যাও।
কথাটা সত্যি। লোকটার কাছ থেকে পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে দশ দশ ডলার হাতে নিয়ে বেরোল দুজনে। বোঝা গেল এটা লোকটার সাইড ব্যবসা। কিংবা এটাই আসল, দোকান খুলে রেখেছে শুধু লোক টানার জন্য। ডক্টর লোকটা বেরোবার আগে আর একবার মনে করিয়ে দিল জাহাজ থেকে পালালে তাদের জীবনটা কেমন বেবাক ভাল হয়ে যেতে পারে।
আক্রাম দাঁড়িয়ে থেকে দোকানির কথা শুনতে না চাইলেও, রাস্তায় বেরিয়ে সেই কথা তুলল আবার। জুইতোর কথা কইছে গোবিনদা, জায়াজো আর না গেলে কিতা ওয়?
কথা কইবার বেলা খুব সওজ রে, অতো সুজা বিষয় নায় মনো রাখিস; যুদি একবার পুলিশোর আ'তো পড়স, তে কিতা অইবো?
কেনে, তুমরার ক্লাবার সাব কিতার লাগি? তান আ'তো রেজগি ধরাই দিলেই অইবো।
ওয়, তুমরার ওউ ক্লাবার সাব অখনও টিকিয়া আছে নি দেখ, মরিয়া মাটির মিশি গেছে!
বাপ নাই তে কিতা অইছে, পুয়া ভাতিজা তো বেটার আছে; তারার চলাফিরাত কুনু উঁচনিচ দেখছো নি কুনু দিন?
ওউ দেখ, দেখ রে আক্রাম। গোবিন্দ সারেং হই হই করে উঠল। দেখোছ নি? কি উজালা করছে রে বাত্তি জ্বালাইয়া! তুমরার দেশো কুনুদিন ইতা দেখছছ?
ই দেশো কিতা রাইত না অইতেই পরবোর লাখান বাত্তি জ্বলে নি গো দাদা? চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার বয়েস আক্রামের, তার কাছে সবই নতুন, সবই বেজায় বড়।
দেখছস নি কুন দেশো আইছস? গোবিন্দ এমন ভাবে বলছিল যেন এখানেই তার ঘর বাড়ি, সে গ্রাম থেকে আসা পরিজনকে ঘোরাতে নিয়ে বেরিয়েছে।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে এসে গিয়েছিল ২৯ নাম্বার স্ট্রিটে। ব্রথেল, স্যালন, জুয়াখানা, কী নেই এখানে।
ইতা কিতা ওর গোবিনদা? তুমার মুখো হুনলাম- বাকিঙয়াম পেলেস বুলে লন্ডন, হিনো মহারাণি ভিক্টুরিয়া থাকইন। তে, ই পেলেস ইনো আইলো কেমনে?
সত্যিই সামনের দুতলা বাড়িটার নাম বড় বড় করে লেখা, বাকিংহাম প্যালেস। তার সামনে দুটি সোমত্ত মেয়ে বুক আলগা করে দাঁড়িয়ে।
দেখছনা'নি, রানি ভিক্টুরিয়ায় তোর লাগি বুনি খুলিয়া উবাই থাকছে। যা গিয়া ভালা করি বুঝিয়া আয় ঘটনা কিতা।
কিতা যে মাতো রে বা দাদা! ইতার লইজ্জা শরম কুন্তাউ নাই নি? লাজুক লাজুক মুখ করে হাসল আক্রাম।
কেনে রে হালার পুয়া, তুমি ইনো কিতা হেঙ্গা করার হাউস লইয়া আইছো নি? যতো আউগ্যাইবায় অতো মণি পাইবায়। বেটিনতোর আট-বাজার রে, অইলে পকেটো মাল থাকা লাগবো।
সার দিয়ে সব বেশ্যাখানা আর জুয়ার আড্ডা। স্টার অ্যান্ড গার্টার। বোহেমিয়া। তিভোলি। ওল্ড আলহামরা। নামে রকমারি, কেউ দুই তারা কেউ তিন তলা, কিন্তু ব্যবসায় রকমফের বেশি নেই।
গোবিন্দ সারেং হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল, আক্রামের যেন পা আর সরে না। একবার দরদাম করিয়া দেখি ওগুর লগে।
মাইর খাইতায় চাইরায় নি? পকেটো যিতা আছে ইতা দিয়া পুড়ির নউখও ছুইতায় পারতায় মিয়া। ছইতে অইলে হে মার্কেট যাইতায় আইবায়।
আক্রামের চেহারায় এখন খুব উত্তেজনা, শরীর একদম চনমন করছে। তে রুষে আ'টিয়া চলো গোবিনদা। হে মার্কেট। আমরা নু আরবার জায়াজো ফিরত যাওয়া লাগবো।
উঠ পুড়ি তরে বিয়া করলে কেমন অইবো। ওলে ওলে। আর থুরা গেলে দেখবায় নে, টিন প্যান আলে। টাউনোর হক্কল নাচগান অনউ ওয়।
আক্রাম খুব শ্রদ্ধার চোখে তাকাল গোবিন্দ সারেং-এর দিকে। দাদায় বাক্কা আইছো লাগে, নায় নি? থাকি যাইবার লাগি মনে চায় না নি?
দেখছি না যে তা নায়, সুলুগ অইছে না। বলে নিজের কপালে একটা দাঁড়ি টানে। ইনোর লেখারে খণ্ডাইবায় কেমনে।
হে মার্কেট এসে গিয়েছিল। মস্ত তিনতলা বাড়ি। আলোর রোশনাই নেই অত বাইরে থেকে, কিন্তু ভেতর থেকে খুব গানা বাজানা, হাসি হুল্লোড় ভেসে আসছে।
ভিতরে আগে কুনুদিন উঁকি দিয়া দেখছিলায় নি? আক্রামের শরীরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল।
দুই বছর আগে একবার খালি বদ্রু মিয়ার লগে আইছলাম।
পাইছলায় নি? হাত দিয়ে হাওয়ায় মেয়ের শরীর আঁকে আক্রাম আলী।
অতো তরাশ করিও না মিয়া, চুউখ দুইখান খুলিয়া ভালা করি দেখো আগে। ই বাজারো পুড়িনতোর অভাব নাই। ইখান অইলো ববোর বাজার। অইলে হস্তায় গণ্ডায় পুড়িন পাইতায় নায়। ইতা চিন্তা করলে পড়ে পস্তাইবায়।
তে? কেমন বিহ্বল চোখে তাকায় আক্রাম। তে আমরার ইনো আইয়া লাভ কিতা অইলো?
গরম অইবার লাগি খালি পুড়িন লাগে নি? ওনো নাচ ওর, আগে নাচ দেখতায় নায় নি? ই নাচ দেখলে চউখ জুড়াই যাইবো।
আর পরাণ জুড়াইতে অইলে?
আমরার লগে কাম করার লাগি বুড়া মাগির অভাব নাই রে। বাজারো ইলিশাও থাকে, লইটখাও থাকে। বড় মানষে ইলিশা পাভিয়া লইয়া যাইব। আর আমরার লাগি চেং আর লইটখা।
গোবিন্দ সারেং নিজের অবস্থানটা খুব ভাল করেই জানে। কম তো ঘোরেনি জাহাজি হয়ে। আক্রাম তার পিছন পিছন এগোল। রেজগি থেকে গুনে গুনে কাগজের নোট দিয়ে একটা নাচঘরে ঢুকেছিল দুজনে। এক তলায় পাশাপাশি তিনটে নাচঘর, হরেক রকম নাচ হচ্ছে। কখনো মেক্সিকান নাচ ফ্যান্ডাঙ্গো, কোথাও বা বেলি ডান্সিং, আবার কখনো ফরাসি নাচ, ক্যান ক্যান।
ওরা যেখানে ঢুকলো তার মঞ্চে চার নর্তকী। তাদের পরনে লাল আর কালো বড় বড় ঘাঘরার মতো পোশাক। সে ঘাঘরার ঘের কী, বাহারই বা কী! নিচের দিকে পোশাক যত ছড়ানো, উপরে ততই জড়ানো। বুকের সঙ্গে এমনভাবে লেগে রয়েছে, যেন ওই ভারী ভারী বুক নাচের তালে তালে ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মত ছিটকে বেরিয়ে আসবে। প্রচণ্ড দ্রুত তালে বাজনার সঙ্গে চার জন বৃত্তাকারে নেচে চলেছে। যেন বিদ্যুৎ লতা। চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে।
মঞ্চের একধারে দাঁড়িয়ে গাইছে এক মহিলা, তাকে সঙ্গত দিচ্ছে জনা চারেক লোক। তার সুর যেমন সরল, গতি তেমনি চপল।
In the land of Hindustan
There lived a Hin-doo fakir man ……
গানের অনেক পদ, অত ইংরাজি বোঝার ক্ষমতা নেই আক্রামের। কোনমতে হিন্দু কথাটা কানে আটকে গেছে, আক্রাম চোখ বড় বড় করে বলল, বেটির গীতো আমরার দেশোর কথা!
গোবিন্দও খুব অবাক হয়েছিল। মাথা নেড়ে বলল, ওয় ওয়, দেখরাম তো।
ই'ন্দুর কথা কইলো কেনে?
হিন্দুস্তান থাকিয়া আইলেউ ইদেশো ইন্দু।
ততক্ষনে কোরাস শুরু হয়ে গেছে।
My Hindoo man is a prize
And he can hypnotize …
গানের কথা বুঝুক না বুঝুক সম্মোহিত হয়ে গেল আক্রাম। হয়তো ওইখানে সবাই। মেয়েগুলোর নাচের তালে তালে সকলের শরীর দুলছে সাপের ফনার মত।
কোরাসের সময়ে মঞ্চের একেবারে কিনারে এসে এক সঙ্গে চারজনের এক পা উঠে গেল একেবারে আকাশ পানে। তাদের মাখনের মত পায়ের উরু জঙ্ঘা এক পলকের জন্য চোখের সামনে এনেই আবার ওরা পাক খেয়ে ঝুঁকে পড়ছে সামনে। তখন তাদের বুকের ঢল যেন একেবারে গড়িয়ে পড়বে মঞ্চের মধ্যে। তাদের বুকের দোলানির সঙ্গে সঙ্গে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক থরথর করে কাঁপছে। দুটো মুশকো জোয়ান পাহারা দিচ্ছিল, তা না হলে সবাই বুঝি মঞ্চেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। নাচতে নাচতে ওরা মঞ্চের কিনারায় এসে পড়লেই দশটা আগ্রাসী হাত এগিয়ে যাচ্ছে একবার ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য। মেয়েগুলোর চোখের আমন্ত্রণ ওদের নিশির ডাকের মত টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ছুঁতে গেলেই খিলখিল করে হেসে নাচের তালে তালে চলে গেল অনেক পিছনে। মনে হচ্ছে যেন মঞ্চের উপর ভেসে বেরাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। উত্তাল, উদ্দাম, অনিশ্চিত। ওদের লাল আর কালো ঘাঘরা। তাতে অনেক থাক, অনেক ফাঁক। যখন সেই ঘাঘরা ফুলে উঠছে মনে হয় ঘরের তামাম লোক সেই ঘাঘরার তলায় বুঝি ঢুকে যেতে পারবে তবু জায়গার অভাব হবে না।
আক্রাম ঠেলেঠুলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। এখানে গোবিনদা ওর পিছনে। ছেলেটার লম্বা চওড়া চেহারা, যৌবনের শক্তি ঠেলে ঠেলে বেরোচ্ছে। তাকে আটকায় কে।
মেয়েরা এখন আবার পিছনে। গানের কলি এগিয়ে গেছে সামনে। গানের প্রতিটা কথার সঙ্গে ওদের শরীরের বিভঙ্গ, চোখের কটাক্ষ আর ঠোঁটের চুমকুড়ি সমবেত জনতাকে উদ্বেল করে তুলল।
Now this hindoo maiden
Fair, she told the Hindoo fakir man …
হিন্দু শব্দটা ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে নি আক্রাম। দ্রুত তালে গান এগিয়ে যাচ্ছে আর আক্রাম এগোচ্ছে মঞ্চের দিকে। গানের এমনই তাল আর নাচের এমন ভঙ্গিমা মঞ্চের মায়াবী আলোয় চারটে মেয়েকেই লাগছে স্বর্গের হুরী পরীটা। তবে তার মধ্যে একটা মেয়ে যেন সবাইকে ছাপিয়ে যায়। তার চোখ বাংলাদেশের মেয়েদের মত ঘন কাল, সাটিনের মত চামড়ায় তাম্র পাত্রের ঝলকানি। গাল দুটিতে কুচ ফলের মত লাল রং যেন টোকা মারলে রক্ত উছলে পড়বে। ঠোট দুটো টিয়া পাখির মত রক্তাভ। এত রঙের মাঝখানে দাঁতগুলো আরো সাদা, আর ঝকঝকে।
নাচলে নাচতে তার বাজ পাখির নিশানা ওলা চোখের চাহনি আক্রামকে বেঁধে ফেলেছিল। মেয়েটা নাচতে নাচতে মঞ্চের এক কোন থেকে অন্য কোনে চলে যাচ্ছিল, চারজনের মধ্যে জায়গা পরিবর্তন হচ্ছিল অনবরত। কিন্তু ও যেখানেই যাচ্ছিল আক্রামের চোখ অনুসরণ করছিল সেই নিশানায়। সেই মেয়েও যেন আক্রামকে চোখ দিয়ে ছুঁয়ে ফেলছিল। নাচতে নাচতে চারটে মেয়েই মঞ্চের একদম কিনারায় চলে এসে দর্শকদের দিকে পাছা ঘুরিয়ে নাচের ঝটকায় ঘাঘরা তুলে দিল মাথার উপরে। কী সুঠাম, পেলব সেই পা! পদ মূলে চোখ পৌঁছালে তাদের যোনিকেশ আর পায়ুপথের নিশানা দেখে উত্তাল হয়ে উঠল জনতা। আক্রাম এক লাফে মঞ্চের উপর উঠে পৌঁছে গেল একেবারে মেয়েটির পায়ের তলায়। চোখের পলক ফেলার আগেই হল সেসব। নাচের তালে পরমুহূর্তে ঘাঘরা নিচে নেবে এলো, নাচতে নাচতে মেয়েরা মঞ্চের পিছন কিনারে চলে গেল। আর আক্রাম হারিয়ে গেল সেই ঘাঘরার ভাঁজে ভাঁজে।
কোরাস ততক্ষণে আবার উচ্চকিত।
My Hindoo man is a prize
And he can hypnotize
My Hindoo man my Hindoo man
গোবিন্দ বুঝতেও পারল না আক্রাম গেল কোথায়। পাহারা দিতে থাকা জোয়ানগুলো একবার যেন কাউকে মঞ্চে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখল। কিন্তু মেয়েরা নাচতে নাচতে পিছনে চলে যেতে সেখানে কাউকে দেখতেও পেল না।
আক্রাম তখন সেই জাদুকরী মেয়ের দুই পায়ের মাঝে। এমন পেলব সে মেয়ের জঙ্ঘা আক্রাম সেই স্পর্শে বিহ্বল হল, এমন সুগন্ধি সে মেয়ের যোনি তার মধুর মাতাল সুবাসে চেতনা হারাল আক্রাম। তার মনে হল সে অথই সমুদ্রে ভাসছে, সেই সমুদ্রের ঢেউ তাকে পরম আদরে কোলে নিয়ে নাচাচ্ছে।
সাতদিন সাত রাত আক্রাম রইল সেই ঘাঘরার ভিতরে। সে মেয়ে যেখানে যায় অচেতন আক্রাম রয়ে গেল তার ঘাঘরার ভিতরেই। সে আবার বের হয়েছিল তাদের জাহাজ ১৪ নম্বর পিয়ার ছেড়ে রওয়ানা দেওয়ার একদম পরে।
একটা উপন্যাস লেখার পিছনে বিশেষ করে যে আখ্যান একটি পুরোনো সময়কে ধরবে, সেই সময়ের ডিটেইলিং, জাহাজের মানুষজনের এই যে কথ্য ভাষা- একজন লেখকের কত পরিশ্রম থাকে-
আমাদের মত শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ।
লেখককে নমস্কার।
চমৎকার এগোচ্ছে। পরের কিস্তির জন্য মন টানে। কিন্তু সিলেটি ভাষা বোঝা কী কঠিন ! বার বার পড়ি।
ইন্দ্রাণীর সঙ্গে একমত।
ইন্টারেস্টিং লাগছে