নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
সে রাস্তায় যে কত কিসিমের মানুষ – আমিনা এমনধারা দেখেনি কোনোকালে। চেনা লোকের বাইরে দেখেছেই বা কতজনা! তার দুনিয়া বলতে দাদপুর। সেই চৌহদ্দির বাইরে যাওয়া কেবল আব্বুর সঙ্গে, হাটে। সেও অবরে-সবরে। সেখানের সব লোক ইমানুলের সঙ্গে তার বেটিকে দেখে সুলুক নিয়েছে। তাদের আমিনা ডেকেছে চাচা, নানা, খালা, কি নানি বলে। ছোটবেলায় দলছুট হয়ে হাটে হারিয়ে গেলেও কেউ না কেউ হাত ধরে আব্বুর কাছে এনে দিয়েছে। এখানে তো কাউকে চেনে না। রাস্তাঘাট, বাজার-ইমারত দেখে আমিনার বুক ভয়ে ঢিবঢিব। মনিরুদ্দি বারবার মানা করেছিল, কদমবুশি করাটা শুধু বাকি রেখেছে। ওখেনে যেও না আমিনা, বুন আমার, সে বড় আতান্তরের জায়গা।
কেন, তুমি গেচো সেখেনে? তোমার সনঝে কোনো সাজিশ হইচিল?
আমিনার উল্টো কথায় মনিরুদ্দির জবানে আর কথা যোগায়নি। সে তো নিজে যায়নি কখনো। কলিঙ্গা বাজারে যাবে শুনলেই শরীর কেমন বিড়ায়। কতবার যাবে ভেবেও হিম্মতে কুলায়নি শেষ অবধি। শুধু বিড়বিড় করে বলেছে, পরে আমায় যেন দুষো না। তোমার ভাই-বেরাদর যদি আমার উপর এসে চড়াও হয়, আমি বলব কিচ্ছু জানিনে। বলছিল আর এই একরত্তি মেয়ের সাহস দেখে তাজ্জব হচ্ছিল।
তারা কেউ জানবেই না। আব্বু জানলে কেটে ফেলবে না দু’খান করে? বাড়ি থেকে একটা পোঁটলা-বগলে ভোর ভোর বেরিয়ে গেছিল আমিনা। তারপর মনিরুদ্দির সঙ্গে চুঁচড়োর ঘাটে। গোমড়ামুখো ওয়াহিদ বক্সের চেহারাটা দেখার মত হয়েছিল বটে। এ কারে সঙ্গে এনেচো মনিরুদ্দি? বিবি তুমার?
আমিনা তখনি বুঝেছে মনিরুদ্দি আগে থেকে কিছুই জানায়নি ওয়াহিদকে। এখন যখন খোলসা করে বলল, ওয়াহিদ চটে লাল। এ কি পরবের মেলা, দেকতে যাবে? কলিঙ্গা বাজার কি ঘরের বেটিবিবিকে নিয়ে যাওয়ার মতন ইস্থান? সেখেনে যায় বেবুশ্যে মাগীরা।
কি বলবে মনিরুদ্দি? সে তার মাথার পেটির সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে আমিনাকে নিয়ে হাজির যখন হয়েই পড়েছে। এ মেয়ে নাছোড়বান্দা ওয়াহিদ ভাই। সে যাবেই।
কেমন জোয়ান মদ্দ তুমি? এট্টুস মেয়ের কথায় নাচতে লেগেচো! মনিরুদ্দিকে এক কথায় নাকচ করে আমিনাকে নিয়ে পড়ল ওয়াহিদ। ও মেয়ে, ওখানে কি কোনো ভাল মানুষের বেটি যায়? কী করবে যেয়ে?
আমি জায়াজে করে নিউ অরলিন যাবো।
শুনেই তো ওয়াহিদের মাথায় হাত। কলিঙ্গা বাজার নয়, এ যাবে জায়াজে? কে নে’ যাবে তোমায়? কার সনে কতা কয়েচো?
নিউ অরলিনে আলেফ আলির কাচে যাবো। বড় বড় চোখের পাতা মেয়ের, ভয়ডর নেই যেন। সে বলে, আমি ঠিক চেপে যাবো জায়াজে।
ও মনিরুদ্দি, এ কী হ্যাপা জুটিয়ে এনেচো? আমি যাবো বেপারিদের সঙ্গে বিকিকিনিতে, সঙ্গে আমি কারোরে নে যেতে পারবোনি।
মনিরুদ্দির মাথায় তখনো পেটি, ওদিকে মেয়ে উঠে জাঁকিয়ে বসেছে নৌকাতে, হাতে একটা বোঁচকা। তাকে নামায় কার সাধ্যি।
সঙ্গে নে যাও ওয়াহিদ ভাই, বড় আতান্তরে আচে, তুমি যার সনে বিকিকিনি করো, বলো না তাকে জায়াজে উটিয়ে নে যাক।
সে কি সোজা কতা নাকি? সে অনেক টাকার ব্যাপার। মিনি মাগনা কেন নেবে একে? ও মেয়ে, ট্যাঁকে রেজগি না থাকলে জায়াজে ওটা যায় না। কে নেবে তোমায়?
কেন নেবে নে? তোমরা এই অ্যাত্তোখানি চিকনের কাজ বয়ে নে যাও, আমি সেকেনে গেলে ওমনি সব বান্যে দেবো’খন। জায়াজে করে সামগ্রী নেবার খরচ থাকবে নে। হল না তার উবগার? সে সব বড় বেপারি মানুষ, তাদের দিলদিমাগ তোমাদের চেয়ে ভাল ছোটে। নিজেদের লাভ ঠিক বুজবে।
নৌকা থেকে টেনে নামাতে পারা যায় এই মেয়েকে? সঙ্গে নিয়েই চলতে হল। তবে ওয়াহিদ বেপারি মানুষ। আমিনার নৌকার ভাড়া আদায় তো করলই, তাকে এমন বিপদে ফেলার জন্য মনিরুদ্দির পেটির দাম কম ধরল। তাতেও বিরান নেই তার। সেই থেকে মুখখানি বেজার করে বসে আছে। খনে খনে দাড়ি চুমড়ে মাথা নাড়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বেচারার। ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসছিল। নৌকা থেকে ঘাটে নামতে আমিনা টলোমলো, ওয়াহিদের চোখ শুধু তার পেটিতে। আমিনা ডুবল কি নামল – তার পরোয়া নেই। আমিনা নিজেই হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করে নেমেছে। আমিনাও সোজা মেয়ে নাকি? ঘাড় তুলে শাসিয়েছে ওয়াহিদকে, নদী পার করার পয়সা নিয়েচো মনিরভাইয়ের ঠেঙে। তারপরেও মোছলমানের মেয়েরে হেলাছেদ্দা কচ্চো, দোজখেও থান মিলবে না চাচা।
এতে ওয়াহিদের চলনবলন বদলায়নি কিছু। ঘাড় গোঁজ করে সব মাল তুলিয়েছে এক ঠেলাগাড়িতে, নিজে চলেছে তার পিছে। আমিনা একলা মেয়েমানুষ, কোনো গতিকে হেঁটে-দৌড়ে তাল রেখেছে। কখনো ঘোড়ায় টানা ফিটন দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে ছুটে গেছে রাস্তার কিনারে। ওয়াহিদ গা করে একবারের তরেও ফিরে চায়নি।
হাওড়ার ঘাট থেকে খিদিরপুর জাহাজঘাটায় আসার পথ যা ছিল, ছিল। ঠেলা নিয়ে একবার কলিঙ্গা বাজারে ঢুকতেই আমিনার পা পেটে সিঁধিয়ে গেল একেবারে।
এ যেন এক অন্য দুনিয়া! রকমারি লোকের ভিড় সেখানে। মানুষ যে এতরকমের দেখতে হয় – তা-ই জানত না আমিনা। যেমন রকমারি চেহারা, তেমনি হরেক কিসিমের পোশাক। কারো মাথায় ফেট্টি বাঁধা, চ্যাপ্টামত মুখ, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার। পরনে পাতলুন আর জোব্বার মত পোশাক। মুখটাই কেমন রুক্ষ্ম, কারো বা মুখে কাটা দাগ। দেখলেই কেমন গা ছমছম করছিল আমিনার। কিছু লোক আরও চ্যাপ্টা নাকের, তেমনি সরু গোঁফ, হলদেটে তেলতেলে মুখ। তাদের পোশাকটাও যেন কেমনধারা। চ্যাপ্টা নেকো যেমন আছে, তেমনি আছে টিয়াপাখির ঠোঁটের মত লম্বা নাকের লোকেরাও। তাদের দেখে আরও ভয় লাগে, ওয়াহিদ বক্স বলেছে তারা নাকি নেপোলি থেকে আসা নাবিক। কথায় কথায় মারপিট করে, ছোরাছুরি চালায়। কেন চালায়? আমিনার এই কথায় ওয়াহিদ মুখ ব্যাঁকাল। বাপের সুপুত্তুর হলে কি জায়াজে চড়ে সব মুল্লুকে টহল মারে? ক’টা টাকার জন্য বুকে ছুরি ঠুসে দেবে। আর ওই বেবুশ্যে মাগীগুলো – বলেই থমকে দাঁড়িয়ে আবার হনহন করে হাঁটা মারল ওয়াহিদ।
আমিনা তড়বড় করে হেঁটে ওর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল। যদিও পথে সামলে চলতে হয় খুব। এখন যদিও সকাল, তবু পথেঘাটে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা লোকের কমতি নেই। কেউ ভিরকুটি মেরে পড়ে আছে। আছে ওলন্দাজ, ধুমসো কালো সিংহলি মাল্লা, আইরিশ নাবিক, চোর ছ্যাঁচোড়েরও তো কমতি নেই। তারা একে অপরের সঙ্গে কী সব ভাষায় কথা বলছে যে। আমিনা জানতই না মানুষের এতরকম জবান হয়। তবে যে ভাষাতেই বলুক, মুখ কারুর ভাল না। যেমন হেঁড়ে গলায় কথা বলছে, তামাক চিবোতে চিবোতে থুতু ফেলছে আর মধ্যে মধ্যে হো হো করে হেসে উঠছে। হাত পা চালাতেও কসুর করবে না – এমনটাই হাবভাব।
গাঁয়ে থাকতে হাপিত্যেশ করেও দূর দূর পথে একটা লোক দেখা যেত না। যে যার ঘরে মাকু টানছে, নয় ক্ষেতে উবু হয়ে বসে নিড়োচ্ছে। আর এই শহরে মনে হয় সবাই ঘর ছেড়ে পথে নেমে পড়েছে, না হলে এত লোক আসে কোত্থেকে? আমিনার অবশ্য ভয় ছাড়িয়েও উত্তেজনা হচ্ছিল বেশি। এই রাস্তায় একদিন আলেফও গেছে, আজ সে চলেছে। আমিনার গায়ে কাঁটা দিয়ে রোঁয়া উঠছিল।
শুধু এদের বিষয়ে আর একটু যদি জানা যেত! এদের বেত্তান্ত ওয়াহিদও জানে না। জানলেও মুখ থেকে কথা তো এর সরে না, বরঞ্চ ঘনঘন মুখ খেঁচায়। বড় রাগী লোকটা, আমিনা সঙ্গে এসেছে বলে এমনিতেই বিরক্ত। কিছু জিজ্ঞেস করলে কটমট করে তাকায়, বলে, চুপ যাও দিকি, মেয়ে লোকের এখেনে বেশি কতা বলার পেয়োজন নেই।
পথেঘাটে মেয়ে মোটে নেই। গঙ্গার ঘাটে দেখেছিল হিন্দুঘরের মেয়েরা জলে ডুব দিয়ে নাইতে নেমেছে। এদিকটায় এসে দুই একটা মেয়ে দেখেছে, তাদের চলনবলন একেবারেই আলাদা। কী টকটকে গায়ের রং, তেমনি অদ্ভুত চুলের রং। চুল কার এমন লাল হয়! আমিনা তাজ্জব বনে যাচ্ছিল! এদের সবারই সাজগোজের ভারি বাহার, ছোট ছোট ফ্রক, বুকের আঁচলটুকু অবধি নেই। পায়ে চামড়ার জুতো, তাতেই বা কত কায়দা। আমিনা জুতো পরা কোনো মেয়ে কোনোদিন দেখেনি। এমন দুই-একজনকে কোনো ফিরিঙ্গির হাতে হাত গলিয়ে হিহি হাহা করতে করতে যেতে দেখল আজ। ওরা মেয়ে, কিন্তু যেন মেয়ে নয় – অন্য জগতের। এদেরই কি ওয়াহিদ বেবুশ্যে বলেছিল? তাদের গ্রামেও বদনাম হওয়া মেয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাজ পোশাকে না আছে রং, চলা ফেরায় না এই ঢং।
কিন্তু এমনি কোনো মেয়ে – সে বাদে রাস্তায় আর কেউ নেই। বরং পথচলতি দুই-এক বেহেড মাতাল আমিনার হাত ধরে টানাটানি করার উপক্রম। তখন সত্যি ভয় পেয়েছে আমিনা। দৌড়ে গিয়ে ওয়াহিদের সঙ্গ ধরেছে। আর খেয়েছে মুখ খিঁচুনি। তকনই কয়েছিলাম, এসোনি। এসব ভদ্দরলোকের জাগা নয়কো। মোছলমানের মেয়ে – পর্দা না মান, একটু হায়া-লজ্জা তো থাকবে! এখানে এসে জান নিয়ে ফেরার পেত্যাশা কোরো না।
আসলে ওয়াহিদ বক্স অনেক এসেছে কলিঙ্গা বাজারে, তবু নিজেও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। বিশেষ করে যখন ঘোড়ায় করে লালমুখো সাহেব পুলিশ টগবগিয়ে যায়, তার ভাবখানা যেন রাস্তা থেকে উবে যেতে পারলেই ভাল। নেহাত গাঁয়েগঞ্জে বিক্রিবাটা নেই, এখানে এলে তাও দু’পয়সা আসে। সে কাজ করে রফিক খানের সঙ্গে। রফিক মিয়া সেই দশ-বিশ বচ্ছর ধরে ওই দেশে ব্যাবসা ফেঁদেছে। ওয়াহিদ তাকে সামগ্রী দেয় সে আজ তিন বচ্ছর। যখন রফিক আসে না, তখন তার দলেরই আর কেউ জিনিস বুঝে নেয়। এবার রফিক নিজে এসেছে। কাজকর্ম দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, আরও লোক চাই মার্কিন দেশের হরেক শহরে যাওয়ার জন্যে। অনেক ঘাটের পানি পেরনো পোড় খাওয়া মানুষ সে, ভাবখানা ধীরস্থির। নিজের মনের ভাব চেপে জিজ্ঞেস করল, এ কাকে ধরে এনেছো ওয়াহিদ ভাই?
যদিও আমিনা একটু দূরেই দরজার কাছে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর শুনছে সবই, ওরা কেউ তার রেয়াত করছিল না। ঘর বলতে একটা জানালাওয়ালা একরত্তি জায়গা। একপাশে সার দিয়ে রাখা পেটি। আর এক ধারে খানদুই চাদর তাকিয়া, গোটানো। দিনের বেলাতেও কলিন স্ট্রিটের এই ঘরে আলো কম, তামাকের ধোঁয়ায় গুমোট। জাহাজে ওঠাতক সে থাকবে কোথায়? এখানে? ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে, এখন আমিনার বুকটা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিল।
আমি কি সাধ করে এনিচি রফিকভাই, আনবো না বলায় কত জুলুম।
রফিক খান দেশে বিদেশে ঘুরছে অনেক বছর। দেখেছে হরেক কিসিমের লোক, কোনোকিছুতেই সহজে টলে না। কোনো এক জমানায় তাঁত বুনত, সে কাজে মন্দা পড়তে পথে নেমেছে। তারপর অনেক জাহাজঘাটার পানি ঘেঁটেছে, কিসমতের ফেরে কখনো ভেসেছে, ডুবেওছে। ইদানিং আল্লার দোয়ায় সওদাফিরির বেপার বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। এখন সে পুরো দস্তুর বেপারি মানুষ, মাথায় হরেক সুলুক সন্ধান ঘোরে। তার কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। দাড়ি চুমড়ে বলল, ও মেয়ে, তুমি কী কত্তে এয়েচো?
মাটির দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে মেঝে খুঁটছিল আমিনা। মুখ তুলে বলল, আদাব রফিক চাচা, আমারে জায়াজে নে চলো। আমি নিউ অরলিন যাবো।
নিউ অরলিন? জানো তুমি নিউ অরলিন? কোতায় সেটা? এই মেয়ের মুখে নিউ অরলিনের নাম শুনে হো হো করে হেসে উঠল রফিক। সেই হাসিতে হয়তো চাচাসুলভ প্রশ্রয় ছিল – আমিনাকে আশ্বস্ত করল। আমাকে মুনির ভাই বলেছে। সব চিকনের সামগ্গির নিউ অরলিন যায়।
সে তো বুজলাম মেয়ে, কিন্তু তুমি তো আর আর চিকনের সামগ্গির নয়। তুমি কেন যাবে সেখেনে? জানো সেখেনে যেতে কত দিন-মাস যায়? জায়াজঘাটা থেকে ফিরিয়ে দিলে বচ্ছরও ঘুরে যায়। তাও নয় হল, কিন্তু নিজের দেশ-গাঁ ছেড়ে ঘরের মেয়ে তুমি যাবেটা কেন? গিয়ে করবে কী?
আমি চিকনের কাজ করি, আমার করা কাজ নিয়ে আলেফ আলি গেচে সেই দেশে।
কে আলেফ আলি? সে কোতায় গেচে?
নিউ অরলিন।
সে তোমার কে হয়?
মাথা নিচু করে ফাটাফুটা মেঝে দ্যাখে আমিনা।
তোমায় নিকাহ করে চলে গেছিল?
এরকম অনেক জানে রফিক। কাজের ফিকিরে যারা গেছে, তারা অনেকেই আর দেশে ফেরেনি। ও দেশের কালো মেয়েদের বিয়ে করে নতুন ঘর বসিয়েছে। কেউ কেউ দেশে বিবি-বাচ্চার জন্য টাকা পাঠিয়েছে, কেউ আর খবরও নেয়নি। সে নিকাহ করলেই বা কী, আর না করলেই বা কী। আমিনার জন্য কষ্ট হয় রফিকের, কিন্তু এটাই সত্যি। নিশ্চয় ওই দেশে গিয়ে আলেফ আলি আর একটা ঘর পেতেছে।
দেশে ফিরে নিকাহ করবে বলেছিল।
সে নিউ অরলিনে আছে কেমন করে জানলে? খত লিকেচে তুমায়?
আমায় মুনির ভাই বলেছিল। আমি খত লিকেচি সেখেনে।
সে যদি থাকেও একসময়, এখন কোথায় খুঁজবে, পাবে কী করে? ফিরি করতে আমরা হরেক শহরে ঘুরে বেড়াই, খোঁজ থাকে না কোনো।
বলল বটে, তবে রফিক জানে, নিউ অরলিন্সে সেন্ট লুই স্ট্রিটে একটা বড় আস্তানা আছে তাদের। সে নিজে যায়নি সেখানে অনেকদিন। আজকাল রফিক আমেরিকা ছেড়ে ক্যারিবিয়ান ধরেছে, নতুন নতুন শহরে তাদের চিকনের ব্যবসা বসছে।
আমিনা ভয়ে ভয়ে তাকায়। জানে না সে কী করবে। আলেফ যদি না থাকে নিউ অরলিন্সে?
জায়াজে যাবে, আব্বু-আম্মা ছেড়ে দিল তোরে? জানে কোথায় যাচ্ছিস?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে আমিনা। ঘরে কেউ জানে না, আমি চুপটিতে বেইরে পড়েছি।
ওয়াহিদ ভাই এইটা তুমি কী করেচো? ঘরে কোনো কতা কয়নি, তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে। আর তুমিও নে’ এলে?
আমি কি এনেচি রফিক মিয়া? সে কী জোর জবরদস্তি, নায়ে এসে গেড়ে বসেছে।
আবার ফিরিয়ে নে’ যাও।
ওয়াহিদ কিছু বলার আগেই ঘনঘন মাথা নাড়ে আমিনা, দুধ দিতে না চাওয়া গাভিনের মত। আমি ঘরে যাবো নে, নিউ অরলিন নে চলো আমায়। ঘরে ফিরলে আব্বু কেটে ফেলবে নে?
জায়াজের পথ বড় কঠিন গো আমিনা বেটি। কত ঝড় তুফান, হুদ্দোমুদ্দো লোকেরাও ভিমরি যায়। থাকতে দেবে ডেকে, সেখেনে মাথার উপর ছাদ নেইকো, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেঁকুড়ে যাবে নে।
সে আমি পারবো। বলে আর মনে মনে ভাবে আহা, আলেফ না জানি কত কষ্ট করে গেছে সেই দেশে। কবে গেছে, কবে পৌঁছেছে তার কি ঠিক আছে? সে যদি পারে, আমিনা বুঝি পারবে না?
রফিকের মাথায় অনেক কথা চলছিল। এই মেয়েকে কেমন করে নিয়ে যাবে? বেপারি বলে তো নিতে পারবে না। তার নিজের এখন ওদেশে থাকার কাগজ আছে। একমাত্র নিয়ে যেতে পারে বিবি বলে দেখিয়ে। কিন্তু তার জন্য তো নিকাহনামা লাগবে। সেসব পাবে কোথায়? জাল কাগজ বানাতে হবে কোনো একটা। তার উপর যাওয়ার এখনো দিনদশেক আছে। কেমন করে এই মেয়েকে নিজের হেফাজতে রাখে? এই ঘরে মেয়েটাকে রাখতে হলে সে নিজে কোথায় থাকবে? নাহয় সে নিজে ক’দিন অন্য কোনো আস্তানায় ডেরা বাঁধল, কলিন স্ট্রিট জায়গা তো ভাল না মোটে। একা এই মেয়ে এইখানে থাকলে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। সার দেওয়া ঘর, রাতে ঘরের বাইরে মোদো মাতালেরা দাপাদাপি করে। একে একা রাখতেও মন সায় দেয় না রফিকের।
ও মেয়ে, এই চাচার সঙ্গে এক ঘরে ক’টা দিন থাকতে পারবে?
বড় বড় চোখ তুলে চায় আমিনা। রফিকের চোখে বিশ্বাস খুঁজে নিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। পারবে। আলেফের কাছে যাওয়ার জন্য সব পারবে।
জায়াজে যাওয়ার বড় হ্যাপা আমিন মা। ডেকে থাকতে দেয়, ঝড় জল জারা মানে না। আর যদি জায়াজের খোলে থাকতে দেয়, সেখেনে সব হুমদো হুমদো লোক গাদাগাদি করে থাকে। তুমি সেখেনে এতগুলো মাস চলতে পারবে?
পারবে, সব পারবে আমিনা। আলেফের কাছে আবার পৌঁছে যাবে ভেবে দুই চোখে পানি উপচে আসে। সেই উপচানো চোখে এই ছিরিছাঁদহীন ঘরেও কত রং যে ঢেউ খেলে যায়। হঠাৎ এই কলিন স্ট্রিটটা খুব ভাল লাগে আমিনার। ভাল লাগে এই রফিক চাচাকে। ওয়াহিদকে ভুলে রফিকের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে আমিনা।