এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (১২)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০২ অক্টোবর ২০২১ | ২০১৪ বার পঠিত

  • ১২

    নিউ ইয়র্ক থেকে রেলের কামরা ছুটেছে নিউ অরলিন্স, দু’দিনের যাত্রা। পথে আসবে কত অজানা শহর। পার হবে পাহাড়, নদী, জনপদ। জানালার বাইরে অচেনা প্রকৃতি রূপরঙ বদলাতে বদলাতে চলবে। ফায়জল থাকলে উচ্ছাস আর প্রশ্নে কান ঝালাপালা করে দিত। কিন্তু ফায়জল নেই, তাকে নিয়ে গেছে আসবারি পার্কের টর্নেডো।

    দুর্নিবার তুফানে নিউ জার্সির সমুদ্রতীর উজাড় হয়ে গেছে। বহু দূর থেকে আসা এই মানুষগুলো জীবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা দেখেছে। তাদের জীবনের দুঃখের ভাণ্ডার কানায় কানায় পূর্ণ বলেই দেশ ছেড়ে ভাগ্যের সন্ধানে এসেছিল। এসেই এমন দুর্যোগের মোকাবিলা করার কথা ভাবেনি। এই ঘটনা মোকসাদ আলিকে মুহ্যমান করে দিয়েছিল। যদি আর একদিন অপেক্ষা করত তাহলেও তো ওদের উপর এমন বিপর্যয় নাবত না। ফায়জল বলেছিল কতবার। একদিন বাদে যাই চাচা? এই ভাবনা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। এদেরকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, সমস্ত সিদ্ধান্তের দায়িত্ব তাতেই বর্তায়।

    তার হাতে কিছু ছিল না। তবু মন যে মানে না। কত মানুষ মারা গেছে এই আবর্তে। আনন্দে উচ্ছল সমুদ্রতীর, এক তুফানে মৃত্যুপুরী। মোকসাদ আলি সমস্ত মৃতদেহের মধ্যে তালাশ করেছে। জনে জনে জিজ্ঞেস করেছে, ঝড়ের পরের সাতটা দিন ওই এলাকার সর্বত্র হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু ফায়জলের কোন হদিশ নেই। গরীবের জীবনে মহিমা কম, কিন্তু মৃত্যুর গরিমাও রইল না। এই আফসোস মোকসাদ আলি মেনে নিতে পারছিল না।
    বসিরউদ্দিন বলেছিল, হাসনুবির ছেলেটা জানতেই পারবে না তার আব্বার ইন্তেকাম হয়ে গেল।
    আফসোস, বড় আফসোস হয় বসির মিয়া। মোকসাদ আলির আক্ষেপ বাতাস ভারী করছিল।

    দুঃখের ভারা বেঁধে বসে থাকার উপায় রাখেনি আল্লা। পেটের টান বড় টান। এই বছরের মত নিউ জার্সির বোর্ডওয়াকে আর কোন ব্যবসার আশা নেই। আটলান্টিক সিটিতেও একই দুরবস্থা। ওরা চলেছে নিউ অরলিন্স। এমনিতেও যেত, আরও কদিন পর। জলে শীতের কামড় পড়লে। আগেই সই। বেচাকেনা যেখানে হবে, সেখানেই যাবে বেপারি।
    পাঁচকড়িও সঙ্গে। এমনিতে যেত না, নেহাত মোকসাদ এমন মুষড়ে পড়েছে! বোর্ডওয়াকেও এখন বেচাকেনা বন্ধ থাকবে। চলেছে নিউ অরলিন্স। থিতু করিয়ে আবার ফিরে আসবে। মোকসাদের কাঁধে হাত রাখল। কি করবে মোকসাদ, মারে হরি, রাখে কে। সব তেনার হাতে। এমনি আরও কত বেপদ আসবে। একবার ঘর ছেইড়ে যকন বেরিয়েচি, পিছনপানে তাকানো নেইকো।
    সামনেই তাকানো শুধু। রুজি রোজগার বজায় রাখতে ওটাই করতে পারে দেশ ছেড়ে ভাগ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা।

    কামরায় এক বুড়ো নিগ্রো হাতে গিটার নিয়ে সুর তুলেছিল। তার ফ্যাকাশে বাদামি চামড়া টানটান হলেও, একমুখ সাদা দাড়ি। মাথায় লম্বা বারান্দাওলা টুপি আর হাঁটু অবধি চামড়ার বুট। গান গাইছিল –
    “Call the number of the train I ride:
    Number one, Number Two, Three, Fo’,
    And Five...”
    আলেফ বসিরের কানে ফিসফিস করে, এখেনে কি ভিখ মাঙ্গতে লেগেচে? হঠাৎ এমন গান গাইচে কেন?

    পাঁচকড়ি শুনতে পেয়ে বলল, দুঃখের পরানে গান আসে গো। এখেনে নিগ্রোদের ওমনি ধারা, মুখে মুখে গান বেঁদে চলেচে দিনমান। দেকোনি, রেল রোডে কাজে জুটেচিল যতেক-ক’টা, ওখেনেও পাথর পিটাইয়ের তালে তালে গান জুড়েচিল কেমন।
    আমাদের ধান মাড়াইয়ের সময় যেমন বেটিমেয়ারা গান বাঁদে, দেকো নি-
    সে বুড়ো গান থামিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়ল, হিন্দু?
    মোকসাদ মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল হ্যাঁ।
    বুড়ো এক মুখ হেসে এবার ওদের কাছে এসে বসল। Lawd bless you, suh! আমার নাম এরুবা। তেনারা যাচ্চো কোতায়?
    এই রেল যদ্দূর যায়।

    পাঁচকড়ির কথায় লোকটার হাসিতে পায়রার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। নিউ অরলিন? বড় কঠিন ঠাঁই বেরাদর! তোমরা হিন্দু, বেঁচে যাবে। নিগারদের জন্য টেকা বড় মুশকিল সেখেনে।
    পাঁচকড়ি একবার ভাবে, জিজ্ঞেস করে কেন খারাপ, কিসের মুশকিল। থেমে গেল। কি লাভ? তাদের জিনিস বেচার কাজ। নিউ অরলিনে তাদের কম লোক আছে? জিনিস বেচে লাভ হচ্ছে বলেই না। তাছাড়া মন্দ হোক, ভাল হোক, পথে যখন বেরিয়েছে, মানতে হবে বৈকি। কিছু কম খারাপ দিন তো দেখেনি নিজেরা। সে পালটা প্রশ্ন করল, তুমি কোতায় যাচ্চো?
    ওই নিউ অরলিন। কিন্তু রইবো না আর ওখেনে। পরিবারকে আনতে যাচ্চি। বড় অনেয্য হচ্চে সে শহরে। ম্যানহাটানে মাথা তুলে ঘুত্তে পারি বরং। তুমি নিজের দেশ ছেড়ে এখেনে এলে কেন বেরাদর?
    ঘরে বসে থাকলে কি দানাপানি জুটবে?
    ঠিক। দেকো না , আমি হলেম মিসিসিপির লোক। কাজের খোঁজে এইচিলাম নিউ অরলিন, সেখেন থেকে আবার নিউ ইয়র্ক। চরকি কাটচি।

    কামরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোক। সাদা কালো সব রকমই আছে। কিন্তু ট্রেন শারলটভিল আসবে কি আসবে না, অনেকেই নাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। কামরায় যত নিগ্রো ছিল, সব।
    ইরুবা জিজ্ঞেস করল, তোমরা নাব্বে না?
    আমরা তো নিউ অরলিন যাবো। এখেনে কেন?
    এরপর শারলটভিল। নিগ্রোদের কামরা আলাদা হবে যে।
    এমন নয় যে পাঁচকড়ির গায়ের রং খুব ধোপদুরস্ত। কিন্তু তার পরনে গেরুয়া, কপালে তিলক। সেই ভরসায় বলল, আমরা হিঁদু হলাম গো, আমাদের এই কামরায় যেতে মানা নেই।
    ইরুবাও নাবার তোরজোড় করছিল। এটা শুনে একবার থমকে দাঁড়াল। বেরাদর, তোমার কাচে আর একখান অমন মাথার টুপি আছে?
    কেন?
    দেকি, আমিও হিন্দু হয়ে বসে থাকব। একমুখ দাঁত দেখিয়ে হাসল ইরুবা।
    দেখেছ মিয়া, কেন বলেছিলাম মাথায় ফেজ, শেরওয়ানির উপরে ফ্রককোট চড়িয়ে আসতে? শারলটভিল আসছে, সব নিগ্রোরা নেবে তাদের কামরায় চলে যাবে। একবার ভার্জিনিয়া ঢুকে গেলে ওদের আর সাদাদের সঙ্গে এক কামরায় যাওয়া নেই।

    পাঁচকড়ি বেরোনোর আগে সবাইকে পই পই করে বলে সাজগোজ করিয়েছে। মাথায় ফেজ টুপি, পরনে আচকান আর কোট। পায়ে শুঁড়তোলা জুতো। নিজের পরনে গেরুয়া আলখাল্লা আর মাথায় গেরুয়া পাগড়ি। গলায় আর হাতে এমনিতেই তার রুদ্রাক্ষের মালা থাকে, কপালে তিলক।
    টেরেনে যাবো, তার আবার এতো তরিবৎ কিসের পাঁচকড়িদাদা? আগে তো এমন ধারা করিনি।
    দিনকাল পালটে গেচে না মোকসাদ। ওয়াশিংটন ছাড়ালেই সাদা আর কালোর জন্য সব ভেন্ন করে দিয়েচে। এক কামরায় যাওয়া বারণ। যত দিন যাচ্চে ওধারে নিগ্রোদের এমনি নিড়েন দিচ্চে – দেকো গে নিউ অরলিনে। ওখেনে চাইলে কালো মাগির ঠেঙ্গে শুতে পারবে, কিন্তু এক কোষ জল খেতেও মানা।

    মাথায় ফেজ পড়লেই আমরা সাদা হয়ে যাবো পাঁচকড়ি জ্যাটা? আলেফ বুঝতে পারছিল না, এই সবে লাভটা কোথায়।
    আমাকে আইনুদ্দিন পইপই করে বলেচে, দখিন দেশে পাড়ি দিলে ওমনি সেজে আসো দাদা। যাতে হিন্দু বলে বুইতে পারে। আমরা হলাম কিনা না সাদা, না কালো। এরা ধন্দে পইরে যায়। যেকন ইবাদর ভাইয়ের নিকট থেইকে সামগগির তুলতে এনু, এমনটাই তো করেচিলাম।
    তার চে’ কালোদের কামরায় গেলেই তো হয় জ্যাটা। গরমে কোট পড়ে এখন গা কুটকুট!

    বসিরের বিরক্তিতে কোন ফিকির নেই পাঁচকড়ির। দেকো গে যেয়ে ওদের কামরাখান। এতো মাল, সব কোলেকাঁখে নিতে হত, এমন মাথার উপর রাখার বন্দোবস্ত পেতে না কো। যাবে ওমনি করে দু’রাত্তির?
    কিন্তু আমাদের টেরেন থেইকে নাম্মে দিলে?
    দেকবে কি হয়। বচসা হলে নেবে যাবো তকন। পাঁচকড়ি নিজেও জানে না কিসে কি হয়, এমনি ধারা গেছে একবার। কেউ টুঁ শব্দটি করেনি।

    মোকসাদ মাথা দুলিয়ে সায় দিয়েছিল। বিদেশ বিভুঁয়ে এয়েচি, ওদের নিয়ম মাফিক চলতে ফিরতে হবে অবিশ্যি। আর একটা বাক্যি উজিয়ে রাকবে, এখেনকার মানুষজনা আমাদেরকে দেকে অবাক মানে। কেমনভাবে হাঁটি, কেমন পোশাক পরি, চোখে সুর্মা টানি, কি খাই – সব ওদের তাজুব করে। আমাদের চিকনের কাজ দাম দিয়ে কি এমনি কেনে মিয়া? আমরা যে পরদেশি, ওটাবসা সব ভেন্ন রকমের, সেটা দেকেই না পেত্যয় যায়, যে পূব দেশ থেকে সত্যিকারের দামী সামগ্রী এনেচি। বেচাকেনা করতে হলি এমনই কত ভেক ধরতে হয় আমাদের।

    আলেফ আর বসির সদ্য এসেছে। এখনো ঘোর কাটেনি। যা দ্যাখে অবাক মানে, যা শোনে মাথায় ঢোকায়। এই দেশে করে খেতে হলে এদের ধারায় চলতে হবে বৈকি।
    ইরুবার মাথাতেও সেই ফিকির এসেছে।
    মোকসাদের গাঁটরি থেকে বেরোল আর একখানা ফেজ টুপি, আর রঙ-বেরঙের কাজ করা হাত কাটা কুর্তা। মোকসাদের চেহারা বড়সড়, তবু তার কুর্তা ইরুবার কাঁধ থেকে ঝুলছিল শুধু। মাথায় ফেজ, গায়ে কাজ করা কুর্তা নিয়ে ইরুবা হিন্দু সেজে তাদের মাঝে বসে রইল।
    যত নিগ্রো ওর সঙ্গে নাবছিল, তারা ইরুবার দিকে জিম ক্রো, জিম ক্রো বলে বাঁকা হাসি হাসতে হাসতে মাল নিয়ে নেবে গেল।

    সত্যি তাদেরকে সাদাদের কামরা থেকে নাবিয়ে দিল না কেউ। টিকেট দেখতে এসে লালমুখো গুঁফো লোকটা অনেকক্ষণ চোখ সরু করে সবার চেহারা জরিপ করল। এরা নিজেদের জান পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে বসে ছিল। ভাবটা যেন কিছুই হয়নি, কিন্তু বুক গুড়গুড় করছে। শেষ অবধি লোকটা জিগেস করল, হিন্দু? চেকার আসার আগেই পাঁচকড়ি চোখ বুজে হরিনামে ডুবে গেছিল। মোকসাদ মাথা নেড়ে সায় দিল। ফ্রম ক্যালকাট্টা।
    আর তুমি? লালমুখোর নজর ইরুবার দিকে।
    ইরুবা দাড়িতে হাত বুলিয়ে দাঁত বের করে বলল, হিন্দু ফ্রম কালকাত্তা।
    সে লোক ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। কি নাম তোমার?
    ইরুবা এত কিছু ভেবে রাখেনি। বলল, ইরুবা।
    কোথায় যাচ্ছো?
    নিউ অরলিন।

    সে লোক এবার ইরুবার কাঁধে এক থাবা মেরেছে। কথা বলছো যেন মিসিসিপির নিগার, আর ভেক ধরেছো হিন্দুর?
    মুহূর্তে ইরুবা দিল এক লাফ, যেন জলজ্যান্ত হনুমান। উপরের বাঙ্কে এক হাত ভর করে সে শরীর তুলে দিল শূন্যে কামরার ছাদ বরাবর। সেখানে এক পা ঠেকিয়ে পাক মেরে চলে গেল কামরার অন্য প্রান্তে বাঙ্কের মাথায়।

    আলেফ বুড়োর এই এলেম দেখে হাঁ। ফিসফিস করল, বসির মিয়া! যাত্রা পালায় হনুমানকে এমনি ধারা কসরত করতে দেকেচি, এতো তার আব্বা লাগে!
    লাল্মুখো সাহেব যত তাকে নাগালে ধরার ফিকির করে, সে ওই ছাদের এই আংটা, ওই ফোঁকর ধরে ঝুলছে। শুধু ঝুলছে না , ওইখান থেকে গান ধরেছে
    “White man rides in a Pullman coach,
    Nigger man rides Jim Crow...”
    এবার শুধু চেকার নয়, কামরার আরও দুই সাদা মানুষ ওকে ধরার জন্য এটা-ওটা দিয়ে খোঁচা মারতে শুরু করল। সে ব্যাটাও পাঁকাল মাছের মত ছিটকে বেরিয়ে গেল। কামরা জুড়ে সে এক কাণ্ড। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। চুঁচুড়ার ব্যাপারিরা হ্যাঁ করে তাকিয়ে। ইরুবার উদ্দেশ্যটাই যেন এদেরকে ভড়কি দিয়ে মস্করা করা। তিন লাফে ভেস্টিবিউলের দরজায় পৌঁছে একবার মাথা ফিরিয়ে বলল, ইরুবাকে ধরবে, আচে এমন হিম্মত?
    ওরে সাদা, ওরে হাঁদা ভাবিস তোরাই দেশের রাজা?
    আমি একজনাকে জানি
    বলে সব মিছে রে, আদতে তুই খাজা!
    লাল গুফো হেঁকে উঠল, কে বলে রে? কে সেটা?
    এক লাফ দিল ইরুবার দাড়ি ধরে টান মারার জন্য। সে লোক যেন মাকড়সার মত কামরার ছাদ আঁকড়ে চরে বেড়াচ্ছে। পাচকড়ির মনে হল এ নির্ঘাত টেন্ডারলয়েনে কোনো দড়ির খেলা দেখায়, শরীরে সেইরকম ক্ষিপ্রতা।

    ইরুবা ঝুলতে ঝুলতে দাঁত বের করল,
    জানতে চাও কে সেটা?
    সে বড় কেউকেটা!
    তোদের মায়ের কাণ্ডখানা তাও বলেছে সে
    আর যে তোদের দিম্মা, কাপড় তারো খুলেছে রে –
    তবে রে! ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়তে এদিক দিয়ে তিনজনা রে রে করে হামলে পড়ল। ইরুবা হাসতে হাসতে চলন্ত ট্রেনের দরজা গলে তেমনি ঝুলতে ঝুলতে সটকে গেল কালোদের কামরায়।

    চেকারটা, ফিলদি নিগার! বলে গালি দিয়ে হাত ছুঁড়ে মিথ্যা আস্ফালন করল শুধু। যে দু’জন জায়গা ছেড়ে উঠে বসেছিল, উত্তম মধ্যম দেওয়ার এমন সুযোগ হারিয়ে আফসোস করতে করতে বসে পড়ল নিজের নিজের জায়গায়। কামরায় একটা আলোড়ন উঠেছিল, থিতোতে সময় লাগল খানিক। খলুইতে খই ভাজার মত ফুটফাট কথা চলল সাদা মানুষদের মধ্যে। ঝমঝমিয়ে চলতে থাকা পুলম্যানের গতির সঙ্গে ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে গেল সে সব।
    মোকসাদ আর পাঁচকড়ি এতক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল, এবার ওদের উপর না আগুন বর্ষায়। কিন্তু সে চেকারের তাদের হিন্দুত্বে কোনো সন্দেহ ছিল না, আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মোকসাদ। ইরুবা তার থেকে নিয়ে ফেজ মাথায় দিয়েছিল। ফেরত দেয়নি। ওর মাথার টুপি আর বাদ্যযন্তরখানি ফেলে গেছে পায়ের তলায়। নিউ অরলিন্সে নিশ্চয় নিতে আসবে।

    আলেফ গোটা কান্ডটা হাঁ করে দেখেছে। ইরুবার কারসাজি যেমন চমকদার, সাহস তেমনি জবরদস্ত। ওরা সদ্য এসেছে, চারদিকে এত সাদা মানুষ দেখে ভয় পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে। মোকসাদের আঙুল না পাকড়ে এক পা এগোতে দুই পা পেছোয়। ইরুবা ওদের সেই জড়তায় ধাক্কা দিয়ে গেল। নতুন দেশে এটাও বেঁচে থাকার রসদ।

    এক ঠায় বসে বসে মাজা ব্যাথা হয়ে গেছিল। মোকসাদ মাথার ফেজ মুখে চাপিয়ে ঘুমাচ্ছে। পাঁচকড়ি মুখ হাঁ করে চক্ষু মুদেছে। বসির আর আলেফ এমন থম ধরে বসে থাকতে পারছিল না আর। দু’জনে উঠে গিয়ে ভেস্টিবিউলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। খোলা দরজা দিয়ে গরম বাতাস আর বাদামি ধুলো আসছে। তবু সেও যেন বসে থাকার চেয়ে ঢের ভাল। চোখে বালি পড়ে জ্বালা করলেও, পিছনে ছুটে যাওয়া হলুদ প্রান্তর আর থেকে থেকে কাপাস তুলোর সাদা হয়ে যাওয়া ক্ষেত দেখতে ভাল লাগছে।

    আমাদের ওখেনে কেমন সবুজ ধানের ক্ষেত থাকে মিয়া, চক্ষুখান জুইড়ে যায়।
    এখেনেও থাকবে, তুলো খায় না তো লোকে। বসির বলতে বলতেই হাত নাড়ে দরজার বাইরে। তুলোর ক্ষেত থেকে কাঁধে বস্তা নিয়ে তুলোর বীজ তুলে তুলে রাখছিল কামিনরা। তারাও চোখের উপর এক হাতে সূর্য আড়াল করে বসিরকে দেখে হাত নাড়ল। বসির আলেফের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল এবার। বাবনানে ধানের ক্ষেত পার করে যাওয়ার ঠেঙ্গে এমনই হাত নাড়তাম, কিষান মাগেরা ওধার থেকে হাত নেড়ে দিত মিয়া।
    নিজের দেশের সঙ্গে কোনো একটা মিল খুঁজে পেলেও প্রাণে কেমন শান্তি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবধি এত ঘটনা! সব সময়ে ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা। তাদের দিকে তাকিয়ে সব লোকের চোখে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। এর মাঝখানে কেউ ক্ষেতের মাঝখান থেকে একবার হাত নেড়ে দিলেও নিজেকে কেমন যুগ্যি মনে হয়। বসির আর আলেফ কথা বলছিল না কোন, দমকা হাওয়ায় চোখ কুঁচকে দাঁড়িয়েছিল। ওই অজানা মানুষের একটু হাত নাড়ার কথা অনেকক্ষণ মাথায় গুনগুন করল। নতুন দেশে তাদের জন্য এই প্রথম কেউ সওগাত করেছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০২ অক্টোবর ২০২১ | ২০১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ০৩ অক্টোবর ২০২১ ০৯:১৫499000
  • কত পরিশ্রম, কত পড়াশোনা থাকে একটা লেখার পিছনে।
    পড়ছি-
  • বিশ্বদীপ | 103.217.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০২১ ০৭:৫৩499163
  • ধন্যবাদ ইন্দ্রানী। সব লেখকই  কথাশ্রমিক।কেউ কেউ শিল্পী। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন