এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (২৪)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০১ জানুয়ারি ২০২২ | ৯১৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়


    ১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।


    বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।

    ২৪


    কালীপ্রসাদ বেদান্ত সোসাইটি নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, যে নেহাত পাঁচকড়ি মণ্ডল খবর হয়ে না উঠলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি তাঁর আসা হত না। খবরটা তাঁর নজরে আনিয়েছিল জেমস, হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারারের একটা পাতা।
    সেখানে লিখেছে –


    Audacious Burglary at Ashbury Park – Residence of Panchkari Mundal Robbed

    Panchkari Mundal, a Hindoo merchant, lives in a cluster of households halfway between Atlantic City’s train station and its boardwalk. The burglar had put a ladder against Mundal’s house and climbed in a second-story window. Mundal was sound asleep as the burglar made off with a rich haul of fine fabrics valued at $500 and $113 in cash. However, no harm was made to Mundal, who got himself hurt while chasing the burglar.


    খবরটা দেখেই কালীপ্রসাদের বুকটা ধক করে উঠল। এই চোর তাঁর বইভর্তি তোরঙ্গটা নিয়ে যায়নি তো? এদেশের ডলারের হিসাবে তার কি দাম হবে বলা মুশকিল, কিন্তু তাঁর কাছে এইসব গ্রন্থ অমূল্য।
    আরেকটা ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত হলেন। কারণ তোরঙ্গ খুলে এমনিধারা জিনিসই তো পাওয়া গেছে। ফাইন ফেব্রিক্সই তো দেখেছেন ফয়জল আলির বাক্সে। তার মানে এটা যার জিনিস, সে এই পাঁচকড়ি মণ্ডলের ব্যবসার অঙ্গ। অন্তত পরিচিত ব্যাপারী। ফয়জল আলির খবর এর কাছে পাওয়া যাবেই। ডলারের যা হিসাব দেখিয়েছে, জিনিস এবং নগদে, সেটা কিছু কম নয়। এদের ব্যবসা বেশ বড়, অনেক লোক থাকবে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে।

    কালীপ্রসাদ একা এখনো কোথাও যাননি। যখনই কোথাও গেছেন, কারো না কারোর সঙ্গে। কিন্তু তাঁর মনে হল, কোনো সাহেবসুবো সঙ্গে নিয়ে গেলে বেচারা আরও ভয় পেয়ে যায় যদি! কে জানে, এই চুরির শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কিনা। তাঁকে একাই যেতে হবে। এছাড়া লোকটা আগে একবার ফয়জল আলিকে চেনে না বলেছে। হঠাৎ করে সেই কথা আর কারো সামনে পাল্টাতে চাইবে না। অভেদানন্দ শত হলেও হিন্দু, গৈরিক বস্ত্র পরিহিত কাউকে দেখলে চট করে মিথ্যা বলবে না।
    শুনে জো ‘না, না’ করে উঠল। আশবারি পার্ক কি এখানে? দুটো ট্রেন বদলে যেতে হবে। নতুন জায়গা, হারিয়ে যাবে না?
    টান্টিন, আমি পদব্রজে সারা ভারত ঘুরে বেরিয়েছি, তখন কে আমাকে পথ চিনিয়েছে।

    খুব একচোট হাসল জো। তখন তোমার কোনো পার্থিব গন্তব্য ছিল না কালিকা। ঠিকানা খুঁজে যাওয়ার ব্যাপারও ছিল না কোনো। এখানে এভাবে একা, তারপর আবার বলছ গেরুয়া পরে যাবে! শুনেছ তো তোমার গুরুভাইয়ের কাছে, পথে গেরুয়া পরে কেমন নাকাল হতে হয়েছে?
    আর এই বাক্স? সেটা বয়ে নিয়ে যাওয়া কি সোজা কথা? জেমসের বাস্তব বুদ্ধি বেশি। বাক্সটা যথেষ্ট ভারি। আবার স্বামী যদি নিজের বাক্স ফেরত পান, সেই বইভর্তি বাক্স বয়ে আনা একার পক্ষে আরও মুশকিল হবে।

    তাহলে উপায়?
    অবশেষে ঠিক হল কালীপ্রসাদের সঙ্গে ওঁরা দু’জনেই যাবেন, কিন্তু পাঁচকড়ি মণ্ডলের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও লাঞ্চ সেরে নেবেন ততক্ষণে।
    সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। কালীপ্রসাদ রাজি হলেন। যোগশিক্ষার অধিবেশন নেই – এমন একটা দিন দেখে ওঁরা বেরোলেন। কিন্তু সকালে নয়, একটু বেলায়। পাঁচকড়ি ব্যবসায়ী লোক, তাকে দিনের বেলা বাড়িতে পাওয়া যাবে – এমন নিশ্চয়তা নেই।

    আশবারি পার্কে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়াল। এখন সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে, তাই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। যদিও কালীপ্রসাদ তাঁর গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করেছিলেন, সঙ্গে জেমস আর জো থাকায় পথে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়নি। তারা কালীপ্রসাদকে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে ব্রিকওয়াল ট্যাভার্নে ডিনারে চলে গেল।

    বেশ কয়েকবার দরজায় আওয়াজ তোলার পরে কপাট খুলল। এক গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসীকে দেখে পাঁচকড়ি প্রথমে হতবাক, তারপরে ঝুপ করে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বসল।
    পাঁচকড়ির বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। ঈষৎ তামাটে বর্ণ, চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। বেশ স্বাস্থ্যবান বলা চলে। বাড়িতে থাকলে সে এখনো ধুতি পরে, যদিও পরনে আজানুলম্বিত কালো কোট, ঠান্ডা তো পড়ে গেছে। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে সে ঠান্ডা কাঠের মেঝেতে সটান শুয়ে পড়ল কালীপ্রসাদের পায়ে। প্রভু!

    পাঁচকড়ির কে প্রভু, কোন দেবতায় তার ভক্তি – সেটা কালীপ্রসাদের জানা নেই। কিন্তু তার এই প্রণামে স্বামী অভেদানন্দ বড় বিব্রত বোধ করলেন। আরে, আরে করছ কি? ওঠ, উঠে দাঁড়াও।
    পাঁচকড়ি যখন উঠল, তার দু’চোখ জলে ভাসছে। আমার এমন বেপদ, দিনরাত হরিনাম নিচ্চি। ঠাকুর এই ভিনদেশেও সাক্কাত গোঁসাইজিকে পাট্যে দেচেন। আর ভয় নেইকো, জয় গুরু, জয় রাধে।
    এতদিন বাদে কানে দুটো বাংলা কথা শুনে অভেদানন্দ প্রফুল্ল বোধ করলেন। স্নেহভরে জানতে চাইলেন, কিসের ভয় তোমার পাঁচকড়ি?

    কি অনেয্য যে করিচি ঠাকুর, একের পর এক বেপদ আসচে। দেশে থাকলে মটে জেইয়ে হরির লুট দেতাম, ছিচরনে লুটোতাম। এই ম্লেচ্ছদের দেশে কিচুটি কত্তে পারিনিকো।
    অভেদানন্দ ঘরের মধ্যে চোখ বুলিয়ে দেখেছেন। ছিরিছাঁদহীন ছোট ঘর, তেমন কিছু আসবাব নেই ঘরে। শুধু বড় বড় কয়েকটা তোরঙ্গ। সেগুলোর সঙ্গে তার বয়ে আনা বাক্সের বেশ মিল আছে। সেটা এখনো দরজার বাইরে রেখে দেওয়া আছে। এই লোকটা এত আপ্লুত হয়ে পড়েছে, সেটা দেখতেও পায়নি। অভেদানন্দ পাঁচকড়ির গলার কন্ঠিটিও দেখেছেন। এ বোষ্টম। কৈবর্তদের মধ্যে অনেকেই বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়ে থাকে। তাঁকে দেখেও গৌড়মঠের গোস্বামী ভ্রম করেছে। কিন্তু কিছু না বলে পাঁচকড়ির দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসলেন শুধু।

    এতক্ষণে পাঁচকড়ির খেয়াল হয়েছে, সে গোঁসাইকে ঢুকতে না দিয়ে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে, কানে আঙুল দিয়ে তাড়াতাড়ি একখানা জাইমাজ পেতে বসার জায়গা করে দিল। এই কাঁথা তার ফিরি করার জিনিস, কিন্তু গোঁসাইমহারাজকে তো মাটিতে বসতে দেওয়া যায় না।

    যদি এখনো কোনো সন্দেহ থাকে অভেদানন্দের মনে, জায়মাজটা দেখে তাও চলে গেল। ঠিক এমনধারা জিনিস তার বয়ে আনা বাক্সেও আছে।
    তোমার তো চুরি হয়েছে শুনলাম, তাহলে এই বাক্সগুলো কি করে রয়ে গেল?
    এতক্ষণে প্রথমার চাঁদের মত পাঁচকড়ির মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল। অত বাক্সো একা নে যাবে, অত তাকত হয়নিকো। আর ও গেচল দোতলায়, এইখেনে আসেনি। একলা চোর এয়েচিল তো, আমার যেই চটকা ভেঙেছে, দেকি দুটো বাক্সো মাতায় করে জানালা দিয়ে বেইরে যাচ্চে। যেই ধরতে গেনু, আমার মাতায় মেরে পেলিয়ে যেচে।
    তাহলে সব কিচু নিতে পারেনি।
    মহারাজ আপনি সবই জানেন, আপনাকে কি বলব। দু’টি বাক্সো নিয়েচে, সেও কি কম। আমরা গরীব লোক, বড় ক্ষেতি হয়ে গেল।
    বাড়িতে একাই ছিলে, আর কেউ ছিল না? পরিবার নেই?
    এখন তো ক’দিন একাই আচি। পরিবার সব দেশে রইচে। এমনিতে আরও অনেকে একাট্টা থাকি এখেনে। কিন্তু এমন মারকাট্টা তুফান হল, তারপর, আজ্ঞে, বোর্ডওয়াক তো এই শীতের কালে জমজমাট থাকে না। সবাই এখন দক্ষিণের দেশে। ভাগ্যি ভাল, বেশি দ্রব্য ওদের সনেই চলে গেচে।

    অভেদানন্দ বুঝলেন, এদের ব্যবসা বেশ বড়ই। যা চুরি গেছে, সেটা ভগ্নাংশ মাত্র। মুখে বললেন, তুফানের সময় এখানেই ছিলে? শুনেছি খুব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মনে পড়ল অভেদানন্দের। তার আগমনের পরের দিনের ঘটনা এটা।
    আপুনি তো সবই পেত্যক্ষ করেন মহারাজ। এবারটা আমাদের ক্ষেতির সন। এবার চুরি হল, তুফানে কত পসরা যে ভেইসে গেল – বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল আবার পাঁচকড়ি। আমাদের একজনা ওই তুফানে কোতায় যে গেল – এই অবধি বলে পাঁচকড়ি গলা তুলে – ওরে ফয়জল রে! বলে কান্না শুরু করল।
    ফয়জল? কি হয়েছে ফয়জলের?
    সদ্য এসেচিল গো, সে জোয়ান মদ্দ এক ব্যাটাছেলে। ফয়জল আলি নাম। যে দিনকা এল, ব্যস ফিরে দিন এইয়া তুফান। আমরা সবাই বোর্ডওয়াকে দ্রব্য ফিরি করচি। ফয়জল আর ফেরল নাকো।

    অভেদানন্দ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। যার খোঁজে এসেছেন, সে মারা গেছে। তার চোখের সামনে শুধু ওই দুটো হাতের ছাপ ভেসে উঠল। আহা রে, যাদের ওই ছাপ, তারা এখনো জানেও না, যে প্রিয়জন আর নেই। সংসারী মানুষ নন অভেদানন্দ, তবু সংসারের অন্নদাতা মারা গেলে কি হতে চলেছে ওদের জীবনে, ভেবে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হল। খবর দেওয়া হয়েছে ওর পরিবারে?
    সে যকন যাব, তকন জানবে। এখেন থেকে কেউ তো যাবে।
    আমাকে দাও ওর গ্রামধাম, নাম সব কিছু। আমি দেশে চিঠি লিখে দিচ্ছি। খবর দিয়ে দেবে।
    অভেদানন্দ সব লিখে নিলেন কাগজে। লিখে না জানানো অবধি ওই হাতের ছাপ তাঁকে উতলা রাখবে। পাঁচকড়ি তখনো খুনখুন করে কাঁদছিল। অভেদানন্দ বললেন, দেখো পাঁচকড়ি, আমি যে কারণে এসেছি, সেটা বলি। তোমাদের ফয়জল যেদিন এদেশে জাহাজে করে নেমেছে, আমিও সেই জাহাজে এসেছি। আমার বাক্সের সঙ্গে ওর বাক্স বদল হয়ে যায়। তুমি কি সব বাক্সে কী আছে খুলে দেখেছ? কোনো বইপত্রের তোরঙ্গ পেয়েছ কি?
    ওটা আপনার আজ্ঞে? এক তোরঙ্গ-ভর্তি পুঁথি।

    অভেদানন্দের মুখ আলোকিত হয়ে উঠল। তার মানে এই লোকটা জানে, দেখেছে। এখানেই আছে। হ্যাঁ, আমার। তোমার ফয়জলের বাক্স আমি নিয়ে এসেছি। ঠিক বাইরে দরজার পাশে রাখা আছে।
    একটু আগের কান্না ভুলে পাঁচকড়ি দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বাইরে গেল। যখন ঢুকল, তখন মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। এই মালগুলো তো হাইরে গ্যাচে ধইরে নেচিলাম প্রভু। আপনার কি কৃপা, এই অধমের ক্ষতি লাঘব করলেন।
    আমার বাক্সটা আছে কি? চোরে নিয়ে যায়নি তো?
    রাখা আছে। আমি দেকে ভাবনু, কি করি। কোন পণ্ডিতের বাক্স এটা, তার দেকা কোতা পাই।

    বাক্স পেয়ে সব নেড়ে ঘেঁটে দেখে বড় সুখানুভূতি হল অভেদানন্দের। কিচ্ছু হারায়নি, যেমন ছিল, তেমনি আছে। মনের থেকে একটা ভার নেমে গেল তার।
    অভেদানন্দ এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন পাঁচকড়িদের কথা। একদম জানা ছিল না তার। কারা কেনে ওদের জিনিস? প্রাচ্যের জিনিসের এত বাজার এখানে?
    স্যোৎসাহে বলছিল পাঁচকড়ি। খুব কেনে মহারাজ। দিন দিন বেড়েই চলেচে। যেমন যেমন এই বোর্ডওয়াকে লোকের আসা বেড়ে যাচ্চে, তেমনি এইসব দ্রব্য কেনার ধুম। হিন্দু চিকনের কাজ বড় আদর পায় এদের ঘরে।

    ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিজের বিস্ময় গোপন করতে পারলেন না অভেদানন্দ। জিনিস তো অনেক, এত বিক্রি হয়, গ্রাহক আছে?
    শুরুতে এত ছেল না। এই যে আইনুদ্দিন মণ্ডল আর ইকবাল ভাই এসল এই দেশে পঁচাশি সনে, তখন ব্যবসা সবে ধরেছে। নিউ অরলিনে খুব বেচাকেনা চলল। দু’টি মাত্তর পেরাণী, কত বেচবে। আর দেকুন গে পদে পদে বাধা বেপত্তি। নিত্যি নতুন নিয়ম লাগু করচে। এই ঢুকতে দেল, তো আবার দেল না।
    ঢুকতে না দিলে কি করত?
    খুব একচোট খুশির হাসি হাসল পাঁচকড়ি। এত বড় মহারাজ তার ঘরে বসে তাদের খবর জানতে চাইছেন, আনন্দে ডগমগ লাগছিল তার। ঝকমারি আজ্ঞে। আমরা হলুম গরীবগুরবো নোক, লাতিঝ্যাটা খেইলে দমি যাই নাকো। এক বন্দর থেইকে ফেরত পাটালে, তো আর এক জাহাজঘাটায় সুযোগ দেকি। সে এক কানামাচি খেলা মহারাজ। সেই থেইকে শুরু। তাপরে আমারে নে এল। বাবনানের কালিমুদ্দিন ভাই এল। শুরুতে শুধু নিউ অরলিন, তারপরে আমরা ধরলাম এখেনে। তাপরে ধরুন গে চারলেস্তান, সাভানা, আটলান্টা সবখানে আমাদের ভাই বেরাদর চিকনদারি কাজ নে গিয়ে উটেচে। বিকিকিনি ক্রেমে ক্রেমে বাড়তির দিকে চলেছে। বলতে বলতে আনন্দে মাড়ি দেখিয়ে হাসল পাঁচকড়ি।

    যত শুনছিলেন, অবাক হচ্ছিলেন অভেদানন্দ। কথা শুনে বোঝা যায়, শিক্ষাদীক্ষা বিশেষ নেই এদের। চিকনদারি কারিগর। ইংরাজি কথা বলতেও হয়তো পারত না শুরুতে। অথচ এত বড় এক ছড়ানো ব্যবসা ফেঁদে বসেছে এই দূরদেশে। সব শহরে নিজেদের আস্তানা গড়েছে। নিজের দেশের লোকেদের জন্য গর্বিত বোধ করলেন অভেদানন্দ। তাঁর মনে হল, এরা যদি এমন সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে পারে, বেদান্ত সোসাইটিও এমনি ছড়িয়ে যাবে একদিন – আমেরিকার প্রতিটা শহরে, প্রতিটা প্রান্তে।
    দেশে যাওয়া হয়?
    এতদিন যেতে পারিনি মহারাজ, এবার যেতে পারব। তৃপ্তির সঙ্গে বলল পাঁচকড়ি। এই শীতের পরেই আরও মাল আনতে যাব আমি।
    কত বছর যাওনি নিজের ঘর?
    এই যে দেকুন না, আটাশিতে এলাম – হাতের কড় গোনে পাঁচকড়ি – দ্যাক-না-দ্যাক দশটা বচ্ছর পার করে দিইচি। ছিলাম কারিগর মানুষ, দেকুন দিকি, এই ফিরি করতে করতে চুলে পাক ধইরি গেল। ফিরিঙ্গি গুলো ঘরে রইতে দিলে নাকো।
    এতদিন যাওনি কেন?
    যদি ফিরে ঢুকতে না দেয়? মকবুল ভাই গেছে দু’বার, একবার ফিরিয়েও দিয়েচে জাহাজঘাটা থেকে। তবে এবার গেলে আমার আর কোন ভয় নেইকো। আমি তো একন এদেশের নোক।
    সেটা কীরকম?
    আমাকে এই দেশের পাসপোট দিয়েচে কিনা। এইতো সেদিন, সেও দেকুন কত কেরামতি করে। তার কি কম হ্যাপা মহারাজ? এই কথা বলে পাঁচকড়ি খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখে অভেদানন্দকে। আপুনিও পেইয়ে যাবেন আজ্ঞে। গাঁয়ের রংটি বাপু দরকার এখেনে। বাপ মায়ের দৌলতে জম্মো থকে আমি একটু ধলার দিকে। এদেশটা তো ধলা মানষের দেশ। আমি জকন পাসপোট চাইলাম, আমার উকিল বলল, এই লোকটা সাদা, একে পাসপোট দাও। কিচুতেই দেবে নাকো। বলে, এশিয়ান নোক কোন প্রেকারে সাদা হবে? এজলাশে এই নিয়ে কি বিতণ্ডা, কি বিবাদ!
    বিবাদ কি নিয়ে? তোমার গায়ের রং?
    এক প্রেকার সেটাই। কত কতা হল, আমি কি তার কিচু বুঝি? উকিল ভাল পেইচিলাম, একশো ডলার নেছিল, সেও তোড়ে কতা কইল। ওদের ছাড়েনিকো। শেষে কী হল মহারাজ, সেই যে জজ, নিজের আসন ছেইড়ে আমার কাচে এলেন আজ্ঞে। বলেন কি, জামা তোলো। আমি ভয়ে মরি। কি না কি করে সেই এই লম্বা লালমুখো লোকটা। তাপরে উনি আমার চামড়া পরীক্ষা কইরে রায় দিলেন, হ্যাঁ এ সাদাই বটে, শিরার রঙ নীল দেখা যাচ্চে। রোদে পুড়ে মুখটা তামাটে হইচে বটে, কিন্তু আদতে সাদা। তবে গিয়ে পেলাম আমার পাসপোট।

    পাঁচকড়ির কথা যত শুনছেন, এক নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছিল অভেদানন্দের কাছে। এই যে তিনি সারা দিন সাদা মানুষজনের সঙ্গে ঘুরছিলেন, কোথায় কখনো তো বোঝেননি, তারা চামড়ার রঙ এমন করে যাচাই করছে। সে কি তিনি, নরেন – ফর্সা বলে? যদি কোনো গুরুভাই আসে, যার গায়ের রঙ কালো, তখন কী হবে?
    নাকি এই দেশটার মধ্যে দুটো দেশ লুকিয়ে আছে? দুই ধরনের মানুষ, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী? একটা দেশকে শুধু ক’টা লোক দেখে চেনা মুশকিল।
    এই অশিক্ষিত গেঁয়ো ব্যাপারির কাছ থেকে এই দেশটা সম্বন্ধে এক সন্ধ্যায় অনেক কিছু জেনে ফেললেন অভেদানন্দ। নতুন চোখে দেখতে শিখলেন আমেরিকাকে।



    ক্রমশঃ


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০১ জানুয়ারি ২০২২ | ৯১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন