নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
Sisters and brothers of America!
শুধু এই দু’টি কথা – হাজার হাজার লোক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করল, থামেই না।
আজ সকাল থেকেই ডিওয়েনের কাজ পড়েছিল মেমোরিয়াল আর্ট প্যালেসে। সে একা নয়, তার মত আরও বিশ-পঁচিশজন সকাল থেকে মোতায়েন, সমস্ত জায়গাটা সাফ-সুতরো রাখার জন্য। কম লোক তো নয়, হাজার সাতেক লোক জমায়েত। বেশিরভাগ লোকই সাদা আমেরিকান, উচ্চবিত্ত। তবে অন্যান্য দেশের লোকও আছে, এমনকি কালোরাও। তারা সংখ্যায় নগণ্য। মঞ্চেও অনেক দেশের লোক, তাঁদের কত রকমের আচকান। সকাল থেকেই এক একজন করে বক্তৃতা দিয়ে চলেছে। এমন নয় যে ডিওয়েন কাজ ছেড়ে তাদের কারোর কথা শুনেছে। আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজে কি কাজ? সে মন দিয়ে নিজের কাজ সারছিল। কিন্তু ওই ক’টি শব্দে সব লোক যেমন দাঁড়িয়ে গেল, ডিওয়েন ওইখানেই নিজের ঝাড়ন রেখে বসে গেল।
কি অন্যরকম দেখতে এই সাধুকে। সবার পরনে হয় সাদা, নয় কালো পোশাক। এ পরেছে হলুদ আর কমলা রঙের পোশাক, অনেকটা গাউনের হাঁটুর নিচের অংশটা বাদ দিলে যেমন হবে, তার নিচে পা-চাপা পাতলুন। মাথায় কাপড় জড়িয়ে বাঁধা, সেও কমলা রঙের। ঠিক যেন, অপরাহ্নে সূর্য উঠে, শিকাগোর ম্রিয়মাণ, ভারী আকাশকে আলোকিত করে ফেলেছে। ডিওয়েন ব্যাপ্টিস্ট চার্চে যায়, তবে ধর্মপ্রাণ বলতে যা বোঝায় – সে রকম কখনোই নয়। কিন্তু এই মানুষটার মধ্যে কি পেল, হাঁ করে চেয়ে রইল মঞ্চের দিকে। চার্চের ফাদারদের মত মোটেই নয় এই সাধু। তাঁর মাথাটি একটু বাঁকিয়ে উপর দিকে তোলা, যেন ঈশ্বরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছেন, আর সত্যিই কি সে চোখের চাহনি! মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল ডিওয়েন। খুবই সংক্ষিপ্ত ভাষণ, তবু তার রেশ বাতাসে ভেসে রইল। শেষ হতেই সবাই তার কাছে একবার যেতে চায়। যে মানুষগুলো সকাল থেকে শান্ত হয়ে এত লোকের কথা শুনে গেল, এই এক সন্ন্যাসী মুহূর্তে তাদের সযত্ন-লালিত শান্ত, ধৈর্যশীল ভাবের খুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিল। আর সবার মত ডিওয়েনেরও ইচ্ছা হল – একবার কাছে যায়, পারলে ছুঁয়ে দেয় ওই সূর্য-শিখাকে।
কিন্তু সেটা সম্ভব নয়, তাছাড়া একে তো কাজ ফেলে শুনতে লেগেছিল। এখন যদি তাদের কাজের সর্দার মশাই দেখে, যে সে ঝাড়ু ফেলে সন্ন্যাসীর কাছে পৌঁছাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে, তাহলে কাজটাই যাবে। সেটা না করে ডিওয়েন আগে বোঝার চেষ্টা করছিল – কে এই সন্ন্যাসী? উনি কথা বলতে শুরু করার আগে, মঞ্চে কে কি বলছে তার দিকে ডিওয়েনের মোটেই কান ছিল না। কেনই বা থাকবে? কি সব ভারী ভারী কথা বলছে, সে সব বোঝার এলেম তার নেই। এই লোকটা অন্যরকম। আমেরিকায় কাউকে ভাই আর বোন বলে কোন অপরিচিত লোককে ডাকতে শোনেনি কাউকে। নিগ্রোরা ছাড়া। ডিওয়েনের মাঝে মাঝে মনেও হয়েছে, তারা নিগ্রোরা কেন অন্য কালো মানুষদের ব্রাদা’স আর সিস্টাস বলে ডাকে? জীবনে প্রথমবার দেখা হলেও! একবার ফাদার সুলিভানকে জিজ্ঞেস করেছিল ডিওয়েন। তখন তার বয়েস আরও কম। ফাদার সুলিভান তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, সন, আমাদের নিগ্রোদের দুর্ভাগ্য, যে জন্মের আগে বা পরে তাদের ভাই-বোন – কে যে কোথায় বিক্রি হয়ে গেছে, আমরা জানতেও পারিনি। তাই হঠাৎ কোনো কালো মানুষের সঙ্গে যদি দেখা হয়, ভাবো দেখি – সে তো হতেই পারে তোমার ভাই কিংবা বোন। তাই না? এভাবেই ভাবো আর বড় হলে সব কালো মানুষদের জন্য কাজ করো এমন, যেন সবাই তোমার পরিবার।
ফাদার সুলিভানের কথাটা তার মনে ছিল, হয়তো এইভাবেই কালোরা শুরু করেছিল অপরিচিতদের ভাই বা বোন বলা। এই বলার মধ্যে দিয়ে একটা অন্তরের সংযোগ তৈরি হয়, সেটা ডিওয়েন অনুভব করে। আজ এই সন্ন্যাসীর সঙ্গেও সেইরকম সেতু তৈরি হয়ে গেল যেন। নাহ্, এঁর নাম জানতে হবে। জানতেই হবে তাকে।
একজন গণ্যমান্য-দেখতে লোক পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি এই সন্ন্যাসীর নাম জানেন? নিউ অরলিন্সে হলে, এমন কোনো লোকের সামনে এগিয়ে কথা বলতে তার সাহসে কুলাতো না, কিন্তু গত তিন বছর এই শহরে থেকে সাহসটা তো বেড়েইছে। ভদ্রলোকের ভ্রূ ধনুকের মত বেঁকে গেল, ভাবটা কে এই আকাট! ডিওয়েন কালো বলে নয়। যে সন্ন্যাসীকে নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে – এই নির্বোধ তাঁর নামটাও জানে না, এটা হয়তো তাঁর অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। যদিও মিনিট পনেরো আগে মঞ্চে এত ধর্মের হরেক প্রতিনিধির মধ্যে আলাদা করে কেউই এর নাম জানত না। তবু তাঁর উত্তরের মধ্যে তাচ্ছিল্য চাপা ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ – হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি উনি।
ডিওয়েন নিজের মনেই নামটা দু’বার আউড়ে নিয়েছিল। লোকটার বলার মধ্যে যদি কোনো উন্নাসিকতা থেকে থাকেও, সেটা ডিওয়েনকে ছুঁতে পারেনি সেদিন। সে বরং জিজ্ঞেস করেছিল, উনি আবার কি কিছু বলবেন?
অবশ্যই, আজকে তো সবে শুরু। রোজই বলবেন হয়তো, অন্তত আরও দুই-একবার তো বটেই।
বোঝা গেল, এও নির্দিষ্ট করে সেটা জানে না। কিন্তু একটা কথা ডিওয়েন ঠিক করেছিল, তাকে আগামী ক’দিন এখানেই কাজ বাগাতে হবে। রোজ সকালে ঠিক হয়, কে কোনদিকে কাজে যাবে। যে করেই হোক, তাকে এই চত্বরেই থাকতে হবে।
সে ব্যবস্থা করে ফেলেছিল ডিওয়েন। কিন্তু একদিন গেল, দু’দিন – এমনকি তিনদিনও, স্বামী আর মঞ্চে কথা বলতে ওঠেন না। যদিও তাঁকে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে – তাঁকে দেখতে পেলেই সমবেত জনতা তাঁর কথা শোনার জন্য উদ্বেল হয়ে উঠছে। তাঁর হাটাচলা সবার থেকে ভিন্ন। কি দৃপ্ত সে ভঙ্গি! দ্রুত পদক্ষেপে যখন হেঁটে যান, ডিওয়েনের হৃতপিন্ড যেন লাফিয়ে মুখে চলে আসে। এরকম অন্য কাউকে দেখে মোটেই হয়না। এমন একজন মানুষ তাঁর ওই সূর্যের রঙের পোশাক না থাকলেও সকলের মাঝে ওমনি আলো নিয়ে জ্বলতেন, এমনি মনে হচ্ছিল ডিওয়েনের। কালো মানুষ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে থেকে বড় হয়েছে ডিওয়েন, শুধু সে কেন এই দেশের সব নিগ্রোই তাই। শুধু ক্রীতদাসের বংশধর নয়, মনের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল সেই দাসত্বের শেকল। অথচ এই সন্ন্যাসী, সেও তো এসেছে অন্য এক দেশের থেকে। কোথার থেকে পায় এই সাহস, এমন বুক চিতিয়ে হাঁটার ক্ষমতা! কথা না বললেও এই যে মাঝে মাঝে হেঁটে চলে যেতে দেখছে, এইটাই যেন যথেষ্ট লাগছিল ডিওয়েনের। আসলে রোজ নিজের ঘরে ফিরে একা একা ওমনি হাঁটা অভ্যাস করে সে, ঠিক ওই রকম বুক চিতিয়ে। চোখ না ঝুঁকিয়ে সোজা চাইতে শেখার স্পর্ধা কিছুতেই যেন আসে না। রোজ ঝাড়ু হাতে যখন চত্বরে ঢোকে আবার যে কে সেই। হোক না সে ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, হাঁটে সেই ঘাড় ঝুঁকিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ইচ্ছা বুকে নিয়ে।
অবশেষে পনেরো তারিখে আবার মঞ্চে কথা বলতে এলেন বিবেকানন্দ। ঝাড়ু ফেলে, যেখানে ছিল সেখানেই থেবড়ে বসে পড়ে, মঞ্চের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। স্বামীজি, নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে সবার গর্বের সঙ্গে তুলনা করলেন কুয়োর ব্যাঙের। সত্যিই তো, কত কঠিন কথা কেমন সহজ করে বললেন! সব কথা হাঁ করে গিলল ডিওয়েন।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল ডিওয়েন। সবাই যখন সব ধর্মের নির্যাস পাচ্ছিল, সে নিচ্ছিল মানুষের মত মাথা তুলে নেওয়ার পাঠ। কথা বলার জাদুতে যে মানুষকে জয় করা যায়, সব সময় গায়ের জোর লাগে না, সেটাও মনে হল। চেহারা ভালই সন্ন্যাসীর। কিন্তু তাই বলে এমন কিছু লম্বা-চওড়াও তো নয়। এমনকি ওঁকে ঘিরে থাকা অনেক আমেরিকান মহিলাও তাঁকে মাথায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু তাঁর মাথা যেন উঁচুতে, সবার উপরে।
এর পরেও বেশ ক’বার এলেন স্বামীজি। ধর্মের কথা বললেন, বেদান্তের ব্যাখ্যা করলেন। সব যে খুব বুঝল ডিওয়েন – এমনটা নয়। শুনল। যতটুকু নিতে পারল, নিল। যেটুকু মনে গেঁথে রইল, নিজের ঘরে গিয়ে সেটাই আওড়াল বার কয়েক। দাঁড়াল ঠিক ওইভাবে, ওই দৃপ্ত ভঙ্গিতে, বুক চিতিয়ে। যেদিন পথে বেরিয়েও এমনি বুক চিতিয়ে যেতে পারবে, লোকে হয়তো তার কথাও শুনবে – এমনি একটা বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছিল তার মনে।
শেষের দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সবাই মিলেজুলে থাকার কথা। লড়াই নয়, সবার মধ্যে ভাব-ভালবাসা – এইটাই হোক মন্ত্র। কিন্তু কি অদ্ভুত, ডিওয়েনের নিজের মধ্যে যে একটা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। গুটি কেটে প্রজাপতি বের হওয়ার একটা ষড়যন্ত্র চলেছে। প্রথমদিন ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়নি, কিন্তু আজ গেল। যতটুকু পারে, যত কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
সবার শেষে সবাই মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছে, হঠাৎ কেমন একটা সুযোগ এসে গেল ডিওয়েনের। সে চারপাশে ঘুরঘুর করছিল, যেই একসময় দেখল স্বামীজীর চারপাশে ভিড় করা শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের ভিড় নেই, এক-পা এক-পা করে সামনে এগিয়ে গেল সে। আর কি আশ্চর্য, সন্ন্যাসী তার দিকে চেয়ে হেসে উঠলেন – সে হাসি কোন উপহাসের নয়, যেন পরিচিতের হাসি। সে কথা মুখ ফস্কে বলেই ফেলল ডিওয়েন।
শিশুর মত হাসল সে নবীন সন্ন্যাসী। আমি তোমাকে রোজ দেখেছি যে। আমার কথা তোমার ভাল লেগেছে?
কি বলবে ডিওয়েন? মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না। শুধু ঘাড় হেলিয়ে জানাল হ্যাঁ।
সন্ন্যাসী এক পা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। যেন কি অপরিসীম শক্তি তার শরীরে প্রবেশ করল। নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। তোমার গায়ের যে কালো রঙের চামড়াটা, সেটা ঠিক আমার পরনের কমলা রঙের পোশাকের মত। আবরণ মাত্র। আসল লোকটা ভিতরে আছে – সেখানে আমাদের সবার যিনি ঈশ্বর, তিনি কোন ফারাক রাখেননি ব্রাদার। সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল আমি মানুষ। পড়ে থাকা ঝাড়ুটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিলেন। তুমি যে কাজই কর না কেন, সব কাজের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। অন্য সব কোট-প্যান্ট পরা লোকের মতই, তোমারও আমার সামনে এসে কথা বলার সমান অধিকার।
ডিওয়েনের সেদিন মনে হয়েছিল, যেন শুধু তার জন্যে একটা মন্ত্র উচ্চারণ করলেন সন্ন্যাসী। উনি চলে যাচ্ছিলেন, কি মনে করে আবার ফেরত এলেন। স্মিত হেসে নিজের মাথার কমলা রঙের কাপড়টা খুলে তার হাতে দিলেন, এটা তোমার কাছে রাখো ভাই।
এ কি উপহার, না কোন পথনির্দেশ? সেদিন সারা রাত ওই কমলা রঙের কাপড়টা হাতে ধরে বসে রইল ডিওয়েন। তার চোখের ঘুম উড়ে গেছে। আয়নায় দেখে দেখে মাথায় জড়াল সেই কমলা কাপড়, ঠিক তাঁর মত করে। বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, যেমন স্বামী বিবেকানন্দকে দেখেছে। তারপর নিজের সঙ্গে শুরু হল কথা।
ডিওয়েনের হাব ভাব কথাবার্তায় পরিবর্তন আসছিল – সেটা মাঝে মাঝে কাজের মধ্যে তার কথা শুনে আর সবাই যখন তাকে ঘিরে মন দিয়ে শুনতে শুরু করল, বুঝতে পারল সে। এমনকি, একদিন সে দুপুরে খাওয়ার সময় কুয়োর ব্যাঙের গল্পটা শোনাচ্ছিল। এলমহার্ট, তাদের সুপারভাইসার, তাড়া দিতে এসে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও শুনল। তারপর রোজকার মত খ্যাঁকানি না দিয়ে, বেশ নরম গলায় সবাইকে তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে বলে গেল।
ডিওয়েন রোজকার কাজের শেষে শিকাগোর রাস্তা ধরে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে বেড়াত। নিজের সঙ্গে চলত কথাবার্তা। সবচেয়ে ভাল লাগত বেভারলি হিলস চড়তে। হাঁটা শুরু করত লঙউড ড্রাইভ ধরে, শিকাগো লেকের ধার ঘেঁষে। খাড়াই রাস্তা ধরে, বড় বড় গাছের আড়াল ছাড়িয়ে যতক্ষণে লেভিট স্ট্রিটে পৌঁছাত, তখন চারদিক ফাঁকা, নির্জন, নিস্তরঙ্গ। জায়গাটা লেক-শোর থেকে অনেকটা উঁচুতে। তার পিছনে পড়ে থাকত উপরে ওঠার খাড়াই রাস্তাটা, মাথার উপরে থাকত সুনীল আকাশ আর দূর, বহুদূরে পড়ে থাকত শহরের কোলাহল। উত্তরদিকে তাকালে দেখতে পেত বিস্তীর্ণ প্রেয়ারি, আরও দূরে শিকাগোর মাথায় ধোঁয়াশা ঝুলে থাকতে পেত। বেশ ছড়ানো, প্রায় টুয়েল্ফথ স্ট্রিট অবধি চলে গেছে বোধহয়।
ডিওয়েন জানত না কেন, কিন্তু এই উচ্চতায় উঠে তার মনের মধ্যে কেমন একটা বিজয় পতাকা উড়ত পতপত করে। একটা শক্তি ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি শিরায়, ধমনীতে। শুধু এই শহরের লোক নয়, নিউ অরলিন্সের মানুষের কথা উঠে আসত মনের গহন থেকে। যাদের চোখে তার জন্য কোনোদিন কোনো ভালবাসা দেখেনি। তারা যখন পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে, ফিরেও চায়নি, কিংবা তাদের দৃষ্টি ডিওয়েনকে ভেদ করে চলে গেছে। তার নিজের শহরের মানুষের চোখে যদি বিতৃষ্ণা থাকে, শিকাগোর চাহনিতে পেয়েছে উপেক্ষা।
লঙউড ড্রাইভ থেকে নেমে প্রস্পেক্ট অ্যাভেনিউ ধরে হাঁটছিল ডিওয়েন। বেথানি ইউনিয়ান আর ট্রিনিটি মেথডিস্ট চার্চ, নাক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে, পায়ে লাল রাগ জড়িয়ে, মুখে পাইপ নিয়ে চলেছে কেউ রাজার মত, হাতে দপদপাচ্ছে ছড়িখানা। বিশালাকার, বাদামি, মসৃণ চামড়ার সেই ঘোড়াগুলো, সোনালি কেশর ফুলিয়ে চলা তারাও – কোনো নিগ্রোর থেকে উঁচু শ্রেণীর। সোনালি চুলের কোনো মেয়ে রক্তবর্ণ আসনে বসে, মুখের কাছে সযত্নে লালিত হাত এনে, শরীর কাঁপিয়ে হাসছে চলার উত্তেজনায়। সেও কি পারে না, এরকম ভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে, পথের পথিক সরে দাঁড়াবে? নিগ্রো হয়েছে বলে তার কি কিছু পাওয়ার নেই?
ডিওয়েন যদিও তৈরি ছিল, কিন্তু পিছনে একটা ধাক্কার জন্যে অপেক্ষায় ছিল – হয়তো বিবেকানন্দের দিক থেকে কোনো নির্দেশ। সেটা পেল, যখন শিকাগো ট্রিবিউনে খবরটা দেখতে পেল। বিবেকানন্দ এই দেশের মানুষের মনে এমন আলোড়ন তুলেছেন, যে উনি যাই করেন তাই একটা সংবাদ। সেসব যতটা পারে, পড়ত ডিওয়েন। বিবেকানন্দ দক্ষিণের শহরের দিকে যাচ্ছিল সেটা শুনেছিল। কিন্তু খবরের কাগজে যখন দেখল, বিবেকানন্দ টেনেসিতে পৌঁছে সাদাদের কামরায় থাকতে অস্বীকার করে কালোদের কামরায় উঠেছেন, তার মনে অন্য ভাবনা এল। হয়তো ঘুরপথে, ভাবনার গতিপথ কে কবে নির্ধারণ করেছে?
ডিওয়েন বুঝতে পারল, দক্ষিণে গিয়েও বিবেকানন্দের সাদাদের কামরায় যাওয়ার কোনো বাধা ছিল না। ডিওয়েন কালারড, কিন্তু তাঁর গায়ের কফি-রঙে দুধের মিশেল। যদি সেও মাথায় ওই কাপড় বেঁধে নিউ অরলিন্সগামী রেলের কামরায় চেপে বসে, গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে সাদাদের কামরায়, মেনে নেবে সবাই? ওহায়ো নদী পেরিয়ে যাওয়ার পরও? মাথাটা চনচন করে ওঠে উত্তেজনায়। দেখতে হবে, করে দেখতেই হবে। যদি না সফল হয়, তাহলে হয়তো পিঠের চামড়া তুলে নেবে। কিন্তু এই ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। সে নিজের শহরে মাথা উঁচু করে, বুক চিতিয়ে ঘুরতে চায়।
বিবেকানন্দের কাছ থেকে শুধু মাথার পাগড়ি পেয়েছিল। তাতে হবে না। চাই পুরোদস্তুর বেশভূষা। অনেক খুঁজে একটি হলুদ-কুসুম রঙের গাউন কিনল মেয়েদের, সব চাইতে বড় আর লম্বা। নিজেই একটু কাটছাঁট করে বানিয়ে ফেলল হিন্দু সন্ন্যাসীর পোশাক। বিবেকানন্দের মত পা-চাপা পাতলুন জোটাতে পারেনি। কিন্তু আলখাল্লাই সই, পাগড়ির সঙ্গে মিশে একটা অন্য রূপ দিয়েছে ডিওয়েনকে। এইটাই তার অস্ত্র। হিন্দু ফকির দাভে দ রাজা, শিকাগোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে চেপে বসল শিকাগো-নিউ অরলিন্স রেলরোডের সেই কামরায়, যেটায় ওহায়ো নদীর ওপারে শুধু সাদারাই বসতে পারে।