নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
সবার মুখ তোলো হাঁড়ির মত, ফেরার কথায় শুধু আলেফের মনে খুশির রোশনাই। দেশে ফিরলেই আমিনার সঙ্গে নিকা করবে। ঘর বাঁধবে দুজনায়। চলতে ফিরতে এই খোয়াব আলেফের দিলদুনিয়ায় ঘুরতে থাকে। দেশ ছাড়ার আগে আমিনার আব্বাজান তার আব্বুর কাছে ইজাব নিয়ে এসেছিল। আলেফের আব্বু এই প্রস্তাবনায় নারাজ নয়। কিন্তু ছেলে দরিয়া পার করছে, বিবির হেফাজত নিয়ে আরেক অশান্তি। তাই আলেফ ফিরলে নিকা কবুল করাটাই আকলমন্দির কাজ। আলেফ আব্বুর কথার উপর কথা চালায় না, তাই নিজের খোয়ায়েশ বুকে গুম করে জাহাজে চেপেছে।
দেশ ছাড়ার সময় আমিনা আলেফের জন্য এক পোড়ামাটির ডিব্বাতে করে চিংড়ি মাছের আচার দিয়েছিল। প্রাণে ধরে সেটা খুলতে পারেনি আলেফ, ভেবেছিল কবে দেশে ফিরবে ঠিকঠিকানা নেই, যতদিন জমিয়ে রাখা যায় থাকুক সঙ্গে। এখন যখন ফিরেই যাচ্ছে দেশে, ফেলে রেখে হবেটা কী? ওই আস্তাবলের খানা খেয়ে তার শরীরে আর কোন তরিবৎ নেই। এখন মনে হয় জাহাজের খাবার, সেটাই যেন শতগুণ ভাল। আচার জিভে দিলে একটু চশকা হবে। আলেফ স্টিয়ারেজে গিয়ে নিজের বাক্স প্যাটরা ঘেঁটে আচারের ডিব্বা বের করে নিল। আমিনার কাছ থেকে নিয়ে সেই যে ভিতরে ঢুকিয়ে রেখেছিল, তারপর আর খুলে দেখেনি। এখন সেই ডিব্বা হাতে নিতেই যেন আমিনার ছোঁয়া। কত যত্নে সেই ডিব্বাতে নিজের হাতে চিত্রবিচিত্র করে দিয়েছে আমিনা। সাদা আর নীল রং দিয়ে এঁকেছে সাগরের উথাল পাথাল ঢেউ, সেই ঢেউয়ের মধ্যে ভাসছে মেটে লাল রঙের এক জলকন্যা, ঠিক যেন আমিনাটি। আমিনার অমন লেজ থাকলে সেও হুরী পরীর মত লাগত ঠিক। কালো রং ডুবিয়ে গভীর করে আঁকা সেই জলকন্যার চোখ, এখুনি আলেফের সঙ্গে কথা বলে উঠবে লাগছে।
আলেফ তাড়াতাড়ি সেই ডিব্বা পাতলুনের ভিতরে লুকাল, কেউ চাইলেও আমিনার দেওয়া জিনিস কাউকে ভাগ দিতে পারবে না আলেফ। জান কবুল।
দুই নম্বর ডেকে গিয়ে এক কোনায় গুড়িমুরি দিয়ে বসলো আলেফ। দরিয়া থেকে হু হু করে বাতাস আসছে। জুড়িয়ে যাচ্ছিল তার শরীর। শক্ত করে আঁটা ছিল পোড়ামাটির ডিব্বা। বেশ কসরত করেই খুলতে হল, ভেঙ্গে না যায় সেই দিকেও খেয়াল রাখছিল। খুলেই বেজায় অবাক। চিংড়ির আচার কোথায়? এতো একটা আস্ত চিংড়ি মাছ। দেখে মনে হচ্ছে এখনো নদীর মিঠাপানি লেগে আছে তার গায়ে, তেমনি সজীব। কিন্তু আরো অবাক হওয়া বাকি ছিল আলেফের। সমুদ্রের এক দমকা হাওয়া এলো আর সেই চিংড়ি প্রাণ পেয়ে এক লাফে বেরিয়ে এল সেই ডিব্বা থেকে। আর দ্যাখ না দ্যাখ সে চিংড়ি ধরাক করে বড় হয়ে রূপ নিল আমিনার।
আমিনা!
খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়বে ভাবটা, আমিনারও এমনি ধারা। হ্যাঁ, তার আমিনা। সে মেয়ে গলায় কাপড় জড়িয়ে বাতাস আটকাতে আটাকাতে মুচকি হেসে তাকাল আলেফের দিকে। কী মিয়া? বাক্যি হরে গেল দেকি? আমারে রেকে তুমি নাকি একা দরিয়া পার করবে?
দরিয়ার পানি এখনো তেমনি নীল। আশমানে এখনো তারা ঝিকমিক করার সময় হয়নি। সেন্ট লুইস জাহাজ তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে উজিয়ে চলেছে। স্টিয়ারেজ থেকে মাঝে মাঝে হল্লা ভেসে আসছে লস্করদের। ডেকের উপর একটু দূরে এক ফিরিঙ্গি তার মেমের হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল জুড়িয়ে বসে আছে চেয়ার পেতে। ডগ ওয়াচে ছোট মালোম চোখে দূরবিন ঠেসে দেখছে হুই দূরে। যেমনটা স্বাভাবিক, এমনি হওয়ার কথা। জাহাজ ছাড়ার পরে পরেই কেউ তো আর গন্তব্যের কথা ভাবে না। তাই কোথাও কোন অস্থিরতা নেই, আরো অনেক দিন এমনি করেই জাহাজে দুলতে হবে এই সত্যকে মেনে নিয়ে সবাই কথা বলছে নিচু স্বরে। গোবিন্দ সারেঙ্গের সঙ্গে ইয়াসিন বলে এক মাল্লাকে চিনে গিয়েছিল আলেফ। সে ডেক দিয়ে যাওয়ার সময় সেলাম আলেকুম আলেফ মিয়া বলে চলে গেল একবারও আমিনার দিকে না চেয়ে। আমিনা তখন ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে দেখছিল আলেফকে। আর আলেফ, তার হাতে ডিব্বা, যেই ডিব্বার গায়ে এঁকে দেওয়া জলপরীর ছবি এখন গায়েব, এমনকি আচারের বদলে যে নধরকান্তি লালচে আভার চিংড়িটা ছিল সেটাও আর ডিব্বার ভেতরে নেই। তার বদলে সামনে দাঁড়িয়ে আমিনা। এ কি আল্লার কেরামত না কি কোন জিনপরীর যাদু? না হলে আচানক এই মাঝ দরিয়ায় এস এস সেন্ট লুইসের ডেকে কেমন করে আসবে আমিনা?
আলেফের মনে পড়ল গোবিন্দ সারেঙ্গের কথা। সে বলেছিল এই যে রাত বিরেতে ডেকে ঘুরে বেড়াও, খুব সাবধান। কোথায় কবে জাহাজডুবি হয়েছে, পানিতে ইন্তেকাম হয়েছে কত জনার। তারা এই নোনা জলে ঢেউয়ের মাথায় ঘুরে বেড়ায়। হাতের কাছে কোন জাহাজ পেলে চেপে বসে নিজের দেশে ফিরবে বলে। আলেফ তখন এসব কথায় ফিকর করেনি। কিন্তু গোবিন্দ সারেং চোখ বড় বড় করে তার দোস্ত আবু হামাদির গল্প শুনিয়েছিল। সে নাকি ছিল এক তাগড়া জোয়ান। কাঁধে যেমন তাকত, তেমনি তার কড়া জান। কোন কিছুতে ফিকর করার লোক ছিল না আরব দেশের লোক আবু হামাদি। সেই আবু হামাদি এক রাতে ডেকে এক সাদা গাউন পরা জেনানাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে। সে আওরত যেমন খুবসুরত, তেমনি তার মিঠি জুবান। ডেকে একা একা ঘুরছিল, গলায় কোন নাম না জানা গানের সুর, হাওয়ায় চুল উড়ে উড়ে মুখে এসে পড়ছিল। মাথায় এক শৌখিন টুপি। আচানক সেই টুপি হাওয়ায় উড়ে গেল, আর এমনি নসিব এলো ঠিক আবুর নাগালের মধ্যে। আবু কোনমতে হাত বাড়িয়ে সেটাকে ধরে দিতে গেল সেই আওরতকে। একটু কাছে গেলেই কী সুবাস তার, যেন আস্ত এক বাগিচা তুলে নিয়ে এসে ডেকের মাঝখানে রেখে দিয়েছে কেউ। কিন্তু টুপি হাতে আবু যত সে আওরতের কাছে যায়, সেও আর একটু দূরে চলে যায়, এমন যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাচ্ছে। এমনি যেতে যেতে একেবারে ডেকের রেলিং পেরিয়ে পানিতে চলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল আবুর দিকে। আর সেই তাগড়া জোয়ান আবু সব আকলমন্দি ভুলে টুপি হাতে জলে ঝাঁপ দিল। এসব গোবিন্দর নিজের চোখে দেখা, অন্য কেউ বললে বিশ্বাস যেতো না। দুই নম্বর ডেক থেকে গোবিন্দ কতবার আবুকে ডাক দিল, কিন্তু সে তখন কিছু শোনার অবস্থায় থাকলে তো। সেই যে পানিতে লাফাল, ঢেউ তাকে হজম করে নিল এক নিমেষে। আবুর আর কোন দিক নিশানা পাওয়া যায় নি।
যখন শুনেছে আলেফ অত কিছু বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এখন সে কথা মনে পড়তেই ভয়ে কেমন সিরসিরিয়ে উঠল শরীর। হতেই পারে আজরাইল ফেরেস্তা আমিনা সেজে এসেছে তার কাছে। ঠিক, এ কিছুতেই আমিনা না। আজরাইল আমিনা সেজে তাকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে এসেছে।
আমিনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার বদলে দুই পা পিছিয়ে এল আলেফ। তাই দেখে আমিনার মুখটা কেমন ছোট হয়ে গেল দুঃখে। আমার কাচ থে পেলিয়ে যাচ্চো আলেফ মিয়া? এই দুমাস দ্যাকা নেই, তোমার কি অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে আশনাই হয়ে গেল?
আমিনার চোখে পানি দেখে মনটা ভিজে গেল আলেফের। কিন্তু বিশ্বাস করাও যে কঠিন। কোন ভরসায় সে এগিয়ে যাবে আমিনার কাছে? অনেক ভেবেচিন্তে আলেফ বলল, আচ্ছা তুমি যদি আমার আমিনা হও, তাইলে আমি তোমাকে সওয়াল করি একটা, তার জবাব দাও দেকি নি।
সে মেয়ে ঝর্নার মত হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। তার গায়ের আঁচল জোয়ারের ঢেউয়ের মত উথাল পাথাল হল। তার চোখের তারায় কৌতুক খ্যাপলায় জড়ানো খলিসা মাছের মত খলবলিয়ে উঠল। তাহলে আলেফ মিয়া এই কদিনেই তার দিলরুবাকে ভুলে বসেচে এক্কেবারে। কিন্তু একটা কেন, তুমি তিনটে সওয়াল করো মিয়া। তাতে যদি তোমার আমিনাকে ইয়াদ করতে সুবিধে হয়।
আমিনার গোঁসা হয়েছে না তাকে নিয়ে মশকরা করছে আলেফ বুঝতে পারছিল না। বুক ঠুকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, তুমি যদি আমিনা হও, তাহলে তুমি জানবে আলেফ তোমার কাচ থেকে চিকনের চাদর সওদা করেচিল, তাদের রং কেমন?
ভেবে ভেবে এমন সোজা সওয়ালটা রাকলে আলেফ মিয়া। আমার সে সব চাদর তো এই জাহাজেই আচে, আমি আমিনা না হলেও সে তোমার কাপড়ের পেটি খুলে দেকে নিতে পারি। তবু বলচি তোমায়। একটা চাদর আছে ফিরোজা রঙের। সবুজের ছটা নিয়ে সে এক আশমানি নীল চাদর, যার উপর আমিনা তার সরু সরু আঙুলে খোয়াবের মায়াজাল বুনেচে। এই চাদর দিনের আলোয় গায়ে জড়ালে আলেফের মত ঝকঝক করে ওটে, রাতের আলোয় এই চাদর জোছনার রং চুরি করে আমিনার মত নরম আর কোমলপারা হয়ে যায়। বলতে বলতেই ডেকের উপর এক পাক নেচে নিল আমিনা। আর একটা চাদর আচে আমিনার বুকের খুনের মতন লাল। সেই লালের উপর আমিনা সবুজ আর নীল রেশমি সুতায় গেঁথেচে এক ঝাঁক ময়ূর যারা বর্ষার পানির আমোদে পেখম মেলে দিয়েছে ঠিক যেমনই গাঁয়ের পথে আলেফকে মাতায় কাপড়ের বোঝা নে আসতে দেকলেই আমিনা হাওয়ায় তার বসন উড়োতে দেয়। আমিনা এখন ঠিক সেই ময়ূরগুলোর মত পেখম মেলেছিল। আরো শুনবে? আর একটা চাদর আচে যেটা আমিনার কুমারী মনের মত সফেদ, যার উপরে আলেফের আশনাই লাল, নীল আর সবুজ রঙের ফুল ফুটিয়েচে। আমিনা রেশমি সুতোর ফোঁড় তুলে প্রতিটা ফুল ওখেনে গেঁথে রেকেচে। আরো একটা কই। একটা চাদর আচে গণেশ চাচার সরষে ক্ষেতের মতন –
থাক থাক, আমি বুঝতে পেরেচি। আমিনার কথা আলেফের শুনতে ভাল লাগছিল, এক এক লবজে যেন এই আমিনার জন্যে তার টান আরো বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এমনধারা কথা তো আমিনা আগে বলেনি কক্ষনো। যে কথায় হাজার ফুলের খুশবু, যার আলো তারাভরা আকাশের মত চাঁদোয়া বিছিয়ে দিচ্ছে তার উপরে। এ কি আমিনা হতে পারে?
তখন আলেফ আমিনাকে পরের প্রশ্ন করল। আলেফ যখন আমিনাকে নিকাহ করার কথা বলল, তখন আমিনা কী করেচিল?
এই কথায় ঝর্নার জলের মত স্রোতস্বিনী আমিনা থমকে দাঁড়াল যেন কোন জিন পরী ওকে হঠাৎ পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে, তার আর নড়াচড়ার তাকত নেই, যেন শুধু আমিনা না তার চারপাশের পৃথিবীটাই ওমনি চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বলল আমিনা যার অর্ধেক কথা নোনা বাতাস চুরি করে নিয়ে গেল, আর বাকি আধখানা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেল। তারপর আমিনা ধীর গতিতে নিজের দুই হাতের পাঞ্জা এক করে নিজের মুখের উপর পান পাতার মত ছড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই এক দমকা হাওয়ার মত কোথায় চলে গেল আমিনা, আলেফ আর দেখতে পেলো না।
আলেফ কিন্তু তার দ্বিতীয় সওয়ালের জবাব পেয়ে গিয়েছিল। সে ছিল বকরিদের পরবের সময়। আমিনা আলেফকে কুরবানির গোশত খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। আলেফ বলেছিল আসবো আমিনাবিবি, আগে আমার একটা কতার জবাব চাই। জবাব না দিলে আমি আসব না।
আমিনা বলেছিল, কী সে কথা মিয়া যার জবাব না পেলে তুমি দাওয়াত নেবে না?
তখন আলেফ বলল, আমায় নিকাহ করবে আমিনা?
সেই কথায় ঠিক এইভাবে আমিনার কথার স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারপর লজ্জার লালি ছড়িয়ে পড়েছিল তার বদনে। ঠিক এইভাবে দুইহাতে মুখ ঢেকে ছুট্টে পালিয়ে গিয়েছিল আমিনা মাঠের পথ ধরে। অনেক দূরে গিয়ে পিপুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সেই মেয়ে আর বাতাস চেরা গলায় চেঁচিয়ে বলেছিল –
কবুল মিয়া, কবুল।
পিছন থেকে আমিনার গলা আসতেই চমকে ঘুরে দাঁড়াল আলেফ। কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আমিনা। তার চোখ এখন খেলতে চাওয়া কাঠবেড়ালির মত দুষ্টুমিতে ভরপুর, তাম্বূলবর্ণ ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতের সারি নদীর আঁকা বাঁকা সোঁতার মত চপল হাসিতে ছড়াচ্ছে, শরীরের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এত কাছে এখন আমিনা। এবার তোমার পরের সওয়াল করো মিয়া, আমিনা সাচ্চা না ঝুটা তার একটা ফয়সালা হয়ে যাক।
আমার আমিনাকে আমি চিনে ফেলেচি বলে যেই দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল আলেফ, আমিনা এক পা পিছনে সরে বলল, তাহলে জানবে তুমি যেখেনেই যাবে, তোমার হেফাজত নিয়ে আমিনা চলেচে সঙ্গে সঙ্গে, এই ডিব্বায় বন্দি হয়ে। বলেই সে মেয়ে ভোল বদলে আবার সেই ডিব্বায় যার গায়ে আঁকা জলপরী তেমনি আবার ঢেউয়ের মাথায় নাচছে, আর ভিতরে একটা সতেজ সজীব চিংড়ি মাছ গুড়িমুড়ি হয়ে শুয়ে রয়েছে।
শুধু আলেফ যখন ডিব্বাটাকে একটু ভাল করে নজর করল, স্পষ্ট দেখল যে জলপরীটা আগে ঢেউয়ের ভিতর থেকে শুধু মাথাটা বের করেছিল, এখন সে ঢেউয়ের মাথায় সওয়ার হয়ে আলেফের দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে।
ছবি - দেব বন্দ্যোপাধ্যায়
চমৎকার লাগছে।