নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
মাউন্ট বাউ একটা রূপকতার ঠাঁই ডিওয়েন। হঠাৎ করে নিজেকে কেমন গোটা মানুষ মনে হয় রে আজকাল। কি বলব তোকে।
বাইরে এখন অন্ধকার নেবে এসেছে। রাস্তার বাতি জ্বলছে একটা-দুটো করে। ঘরের হলদে আলোয় ইনোসেন্ট আর ডিওয়েনের ছায়া দেওয়ালের গায়ে দুলছিল। ইনোসেন্টের গলা একটু একটু কাঁপছিল বুঝি সেই ছায়ার সঙ্গে মানানসই।
মনে আছে, আমরা যদি কোনোদিন সাদাদের মহল্লায় ঢুকে যেতাম, হয়তো কোনো কাজ সেরে ফিচ্ছি। কেমন নিজেকে মাটিতে মিশিয়ে নুকিয়ে ফেলার চেষ্টা কত্তাম, যেন আমরা চাইলেই ওমনি অদেশ্য হয়ে যেতে পারি। আর না হোক, বাতাসে গায়েব হয়ে থাকলে যে আখেরে ভাল, সেটা তো পষ্টো বুজতে পাত্তাম। কিংবা পথে যেতে যেতে কোনো সাদা মেয়ে গেলে কেমন চোখ নাবিয়ে পথের ধারে ঠাড়িয়ে যেতাম, যাতে ভুল করেও চোখে চোখ না টসকায়।
তাহলেই তো যোহানের অবস্থা হবে। মনে আছে, ওর শরীরটা যখন ক্যানাল স্ট্রিটের মোড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেল, সমস্ত শরীর ফুলে ঢোল। মুখের একটা জায়গা বাকি ছিল না, যেখানে রক্ত জমাট বাঁধেনি। কি দোষ? না, মিসেস টেডলিংটনের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা কয়েছিল।
চুকচুক করে মুখে আওয়াজ করল ডিওয়েন – দুঃখে নয় – সুতীব্র ব্যঙ্গ কাপাস তুলোর মত ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
যোহানের কথা মনে হলে আমার গা শিউরে ওঠে। দ্যাক, কেমন গাঁয়ে কাঁটা দিচ্চে একনো।
সেই মরণের শোক এতদিন বাদেও ইনোসেন্টের মুখে পাথরে ছেনি মেরে খোদাই হচ্ছিল। একটু নিস্তব্ধতার পর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটার মত মুখে আলোছায়া তৈরি হল।
মাউন্ট বাউতে এমনিধারা ভয় নিয়ে তোকে চলতে হবেনে।
সে তো কোন সাদা মেয়ে ধারেকাছে নেই বলে। হা হা করে হাসল এবার ডিওয়েন। হাসিটা ইনসেন্টের মুখে ছড়াল না; বরং প্রকাশ পাচ্ছিল তৃপ্তি, একটা স্থির বিশ্বাস।
কোনো কিচুর জন্যিই ভয় নে ঘুত্তে হবেনে। ওখানে আমরা সত্তিরকম মুক্তো, স্বাধীন।
বলেই এবার মুচকি হাসল ইনোসেন্ট। চোখ অবধি ছড়িয়ে থামল সেই মজার ঢেউ। হ্যাঁ, আমাদের ভয়ের জায়গা আছে একখান। ইসাইয়া মন্টগোমারি। উফ, যেমন লম্বাচওড়া চেয়ারা, তেমনি কড়া ধাতের মানুষ রে বাপ। ওর কতা কি জানিস? মাউন্ট বাউর নিগ্রোদের দিকে সক্কলে চেয়ে আচে। আমাদের এমনি একটা সমাজ গত্তে হবে, যেকেনে আমরা দেকাবো নিগ্রো সমাজ কেমনি ভাবে সততা আর ধম্মো মেনে বাঁচতে পারে, কেউকেটা হতে পারে। সাদাদের থেকে আমরা এট্টুও কম নই।
এটাতে আমি একমত নই। কেন, সেটা কি আমরা সাদাদের পাশাপাশি থেকে দেখাতে পারতাম না? লড়ে নিতে পারি না?
অমন কত্তে কে দিত ডিওয়েন?
ছিনিয়ে নিতে হবে। যে কোনো পথে, যে কোনো ভাবে।
আচ্ছা, তুই যেমন কচ্ছিস?
ওটাও একটা পথ। শয়তানের মোকাবিলা করতে শঠতা কোনো অন্যায় নয়। লোকবল থাকলে লড়াইটাও।
তা’লে মনে কর ইসাইয়ার ভাবনাটা আর একদফা নিশেন। কালোদের জন্য সুযোগ তোয়ের করে দেকিয়ে দেওয়া, যে নিগ্রোরা সবকিছু কত্তে পারে। না হলে আমরা কি কত্তে পারি না বল তো? দ্যাক না একবার, কোতায় ছিল মাউন্ট বাউ? একখান জোলো জংলা খেত্তর, অনাবাদী। জন্তু জানোয়ারে কিলবিলুচ্চে, গাচ থেকে লতা ঝুলচে। অথচ জানের পরোয়া না করে এই ক’বচ্ছরের মদ্যে আমরা একটা পত্তন তুলেচি। শুরুর কাজটা আমি যাওয়ার আগে দিয়ে হয়েচে। ইস্কুল হয়েচে একখান। ব্যাপ্টিস্ট চার্চ লাগু হয়েচিল এক ঘরের মদ্দে, এখন নিজের ইমারত হয়েচে। কটন জিন চালু সেও ধর গোড়ার থিকে। ভুট্টা আর কাপাসের চাষ হচ্চে লাগাতার। ভেবে দ্যাক ডিওয়েন, আমাদের ব্যাঙ্ক, আমাদের নিজেদের লেনদেনের ঠাঁই? বলতে বলতে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল ইনোসেন্টের।
ভাল, খুব ভাল কথা সেসব। শুনতে শুনতে বুক গর্বে ফুলে উঠছে আমার। বোঝাই গেল ডিওয়েন নেহাতই বিদ্রূপ করছে। ইনোসেন্ট রেগে যাচ্ছিল, কিন্তু বাড়ি বয়ে আসা পুরোনো বন্ধুকে এত তাড়াতাড়ি কোনো কড়া কথা বলতে চায় না। বল, কি বলতে চাস এমন একটা ভাব নিয়ে চেয়ে রইল ডিওয়েনের দিকে।
তোর সব কথা যদি বা মেনে নিতে পারি, ইসাইয়া এটা কি করল? ও যে আমাদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে এলো, সেটা বুঝতে পাচ্চিস না? আমাদের জিম ক্রো বানাতে চায় ও?
আমি জানি, তুই কি কইতে চাচ্ছিস। অনেকেই না বুজে এমন কতা কয়।
না বুঝে বলছি? খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল ডিওয়েন। কালোদের লোক করে ওকে মিসিসিপি কনভেনশনে পাঠানো হয়েছিল, মাদারচোতটাকে জিম ক্রো শাসনের পক্ষে ওকালতি করতে বলেছিল কেউ? ওই লোকটা সাদাদের হয়ে ভোট দিয়ে এলো। বিধান হল নিরক্ষর নিগ্রোদের কোন ভোট থাকবে না।
সে তো সাদাদেরও। পড়ালেকা না জানলে তারাও ভোট দেবে না কো।
বোকা হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকিস না। সবাই জানি এর আসল মানে কি। ক’টা কালো মানুষ ভোট দিতে পারবে? ভাল করেনি রে, একদম ভাল করেনি। ঘনঘন মাথা নাড়ল ডিওয়েন। ওর এই এক ভুলে শুধু মিসিসিপি এলাকার নিগ্রোরা নয়, পুরো দেশের নিগ্রোদের জন্যেই খারাপ হল।
ঘর জুড়ে পায়চারি করছিল ডিওয়েন। বোঝাই যাচ্ছে খুব উত্তেজিত। ইনোসেন্ট চুপ করেছিল, কিন্তু ডিওয়েনের গলা চড়ছিল। এই তো ক’বছর হল আমরা স্বাধীন হয়েছি, ব্যস সব ফেরত দিয়ে দিল এক কথায়। বিশ্বাসঘাতক!
না, কতাটা ঠিক নয়। ইসাইয়া কালোদের পড়ালেকা করাতে চায়, ইস্কুল কালেজ কি কচ্চে না লোকটা? একন যদি ও সাদাদের সনে ভোট না দিত, মাউন্ট বাউতে সাদারা ফোঁপর দালালি কত্তে আসত ঠিক। ককনো এক পা এগুতে গেলে দুই পা পিছুতে হয়। তাচাড়া কি দরকার আমাদের সাদাদের ভোটে ভোট দিতে? আমেরিকা সাদাদের দেশ, আমরা নিগ্রোদের জন্য একটা আলাদা ঠাঁই বান্যে নেব। নিজেরা নিজেদের ভোট দেবো। ভোট আগে, না মুকের গরাস?
ভুল ইনোসেন্ট, ভুল। নিজেদের অধিকার একবার ছেড়ে দিলে, ফিরে পেতে আবার একশ’ বছর কেটে যাবে রে। দেখছিস না কি হচ্ছে? সবকিছু এইভাবে এখন ফারাক হয়ে যাচ্ছে। প্লেসি আর ফারগুসনের কেসটার কথা তো শুনলি। কি বিধান দিল সুপ্রিম কোর্ট? লুইসিয়ানার অধিকার আছে separate but equal ব্যবস্থা চালু করার। সোনার পাথরবাটি। এখন আর কি - ট্রেনে আলাদা কামরা, বাস আলাদা, এমনকি জল খাওয়ার ট্যাপ সাদা আর কালোদের জন্য দক্ষিণের সবখানে আলাদা করে দিল। সব তোর ইসাইয়ার জন্য, একটা মহল্লা বাঁচাতে গিয়ে একটা দেশের সনদ লিখে দিয়ে এলো।
এটা ওমনিতেও হত। একা ইসাইয়া বাঁচাতে পাত্তো না। মাজকান থেকে মাউন্ট বাউতে হুড়কো দিত সাদারা। দ্যাক না ওই শহরের দেকাদেকি আরও কতগুলো কালোদের শহর তয়ের করার কাজ হচ্চে। মন্দ সেটা?
হ্যাঁ, যেখানে জঙ্গল, পাথর, অনাবাদী জমি পাবে, যাও সেখানে যত নিগ্রোর দল, নিজের জায়গা বানাও। দ্যাখ, এই সেগ্রিগেশানের ধারণাটা যেমন ভুল, ইসাইয়া যেটা করছে সেটারও কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জাতিগত বিদ্বেষ দুটো জাতকে আলাদা করে রেখে দিলেই কি মুছে যাবে? যাবে না। ওটা লড়াই করে আদায় করতে হবে।
তাই কচ্চে বুজি তোদের শিকাগোয়?
হা হা করে হাসল ডিওয়েন। খুব রেগে গেছিস, তোর মাউন্ট বাউর মেয়রকে গালি দেওয়ায়। দ্যাখ মাউন্ট বাউ যেমন তোর নয়, শিকাগোটাও আমার নয়। তুই যেমন ভাগ্যের সন্ধানে গেছিস, আমিও রুজি রোজগারের ব্যবস্থায় গেছিলাম।
একটা ফারাক আচে। আমি চলে আসিনি। কিন্তু তুই তোর স্বপনের দেশ ফেলে চলে এসেচিস। কেন, রুজি রোজগার জুটল না বুজি? না কি সাদাদের সঙ্গে লড়াই কত্তে পারলি না।
ওখানে সাদাদের সঙ্গে লড়াইটা অন্যরকম ছিল। এমন নয়, যে রাস্তায় গেলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, কিংবা তেড়ে আসছে। একদমই নয়। চকচক করে উঠল ডিওয়েনের চোখ হঠাৎ কিছু মনে করে। জানিস তো, আমি একদিন যেচে এক পুলিশের সঙ্গে গিয়ে কথাও বলেছিলাম।
বলিস কি? ইনোসেন্ট এরকম অবাক কোনদিন হয়নি। তোর কি ঘাড়ে দুটো মাতা যে পুলিসের সনে কতা কইতে গেলি?
সেটা কয়েকদিন পরে। একটু সাহস গজাতে একদিন এক পুলিশকে রাস্তার হদিশ জিজ্ঞেস করলাম। দেখিয়েই দিল। ঠিক দেখিয়েছিল, কারণ আমি নিজে তো আগেই জানতাম। ব্যাভারটা কেমন করে সেটা জানার ছিল। দেখছিস তো মাথাটা এখনো কেমন টিকে আছে।
তবে যে বড় ফেরত এলি? কাজ পাচ্চিলি না?
ওইখানে একটু অসুবিধা ছিল। বললাম না, রেল রোডে লাইন লাগিয়ে সাদাগুলো কাজ করছে। তাহলে যে কাজে সাদাদের পাওয়া যায়, আমাকে কেন দেবে? দিতেই পারে, কখনো দিয়েছে – সেটাও সত্যি। কিন্তু ছাঁটার সময় আবার আমাকেই আগে পাকড়েছে। যে ক’ বছর ছিলাম, কত রকমের কাজই তো করেছি। কালোদের জন্য কম ছিল, ওই সাদারা কাজ পাওয়ার পরে যে ক’টা বাঁচে। জে জে স্মিথের স্লটার হাউজে ছিলাম অনেকদিন।
শিকাগোর প্যাকিং হাউজ? সে তো শুনেছি ইয়া বড়ো।
হ্যাঁ, বিশাল। মনে কর এক মাইল জুড়ে চামড়া ছাড়ানো শুয়োর ঝুলিয়ে রেখেছে, গরুর জন্য ওমনি আরেকটা ব্যবস্থা। সারাদিন হাতে চাপাতি নিয়ে মাংস কাটছি তো কাটছিই। সাদা লোকই বেশি, আমরা গুটিকতক কালো ছিলাম। তবে দিনের শেষে সবাই লাল। পোশাকজুড়ে, মুখে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছিটে।
কাজ তো সরেস, খোরাক জুটচে। ফিরলি কেন?
ব্যবসার উঠাই পড়াই থাকে না? একদিন কাজ গেল। তাতে কিছু না। সেসব দিনে শিকাগোতে কলম্বাস উৎসবের উজ্যুগ চলছে, খুব জোড়তোড়। সেসব এক পেল্লাই ব্যাপার রে ইনোসেন্ট। ইয়া বড় বড় কাঠের দালান কোঠা উঠছে।
সে তো বড় বেপার, কলম্বাস নইলে আমরাও কি আসতাম আর।
তারই চারশ’ বছর উদযাপন। কত দেশ থেকে লোক আসবে। বড় বড় ইমারত বানাচ্ছে, জলের ফোয়ারা – দ্যাখ না দ্যাখ – দাঁড়িয়ে গেল। দেখে মনে হবে নতুন এক শহর বুঝি, কিন্তু সে সবই তোয়ের হল কেবল এই মেলার জন্য। ইয়া বড় একখানা ফেরিস হুইল লাগালাম আমরা, দিনভর কাজ করেছি।
সব দেশের লোক এয়েচে, ওখেনে কালোদের ঢুকতে দিয়েচিল? না কি শুধু ইমারত খাড়া করার তাগিদে ঢুকতে পেয়েচিলি?
মুখটা একটু অন্ধকার হল বুঝি ডিওয়েনের। মিথ্যা বলব না, মেলার সব জায়গায় কালোদের যেতে দিয়েছিল। গানের আসর হল, সাদাদের গান হল, কালোদের গান হল। এমন কি চিন-জাপান থেকেও গান গাইতে এসেছিল সব। শুধু মাঝখানে একটা ইমারত ছিল, সবচেয়ে বড়, চকমিলান। হোয়াইট প্যালেস। সেখানে কোনো কালো যেতে পারেনি।
হা হা করে হাসল ইনোসেন্ট। দ্যাক তাইলে, সাদারাও নিজেদের জন্য একটা আলাদা ঠাই চায়। তাহলে ইসাইয়া সাহেবের কি দোষ? সেই দুক্কেই কি শিকাগো ছাড়লে আমার ভাই?
ইনোসেন্টের গলার বিদ্রূপ গায়ে মাখল না ডিওয়েন। সেজন্য নয়। কারণটা হল সেই হিন্দু ফকির।
সে আবার কে? আমি তো শুনেচি তুই ভোল বদলে হিন্দু ফকির হয়েচিস।
এমন সময় মলি হাজির। হাতে গরুর মাংসের স্টু। টেবিলে পাত্রদু’টো রেখে ডিওয়েনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল, You smellin' yourself kid! Dewaine a’nt never talks like that.
হা হা করে হেসে উঠে মলিকে জড়িয়ে ধরল ডিওয়েন। আমাকে শুঁকে দেখো বিগ মামা, আমি সেই ডিওয়েন কি না।
শিকাগো গিয়ে তোর মুকের ভাষা ফিরকে গ্যাচে যেন। ওখেনে কি নিগ্রোরা সাদাদের মত কতা কয়?
ইনোসেন্ট বলতে যাচ্ছিল, মামা এটা সাদাদের মত নয়, হিন্দুদের মত। যেমন অ্যাবিয়েলের লিটিল ফ্রেন্ড বলে। অ্যাবিয়েল একদিন আলেফ বলে এক হিন্দু মানুষকে নিয়ে এসেছিল। শুরুতে মলির পছন্দ হয়নি মোটে, অ্যাবিকে কত বকাঝকা। কোথায় পেলি এই লিটিল ফ্রেন্ড?
ডিওয়েন সময়মত থামিয়ে না দিলে ইনোসেন্ট বলেই ফেলত। কিন্তু ডিওয়েন মধ্যিখানে থামিয়ে বলল, ওখানে কত দেশের লোক থাকে বিগ মামা, কখন কোন ভাবে কথা বলছি, তার কি খেয়াল থাকে?
নিজের জাত বেরাদরিকে ভুলে যাস না যেন। মুখের হাসি ফিরে এলো মলির। তার চে’ চল ইনোসেন্টের সনে আমরা সবাই মাউন্ট বাউ চলে চ।
আমার এই শহরটাই ভাল লাগে যে। দেখছ না কেমন শিকাগো ছেড়ে আবার ফিরে এলাম।
উফ, ঠিক অ্যাবিয়েলের মতন কতা। কতো করে শুদোচ্চি, চল, এই শহরের ঠাই তুলে মাউন্ট বাউ যাই গে চল, সে মেয়ের যে এই শহরে কিসের এতো আটা, কিচুতে যাবে না।
আচ্চা, আচ্চা মামা, আমি তো বলচি অ্যাবিকে, ঠিক মানিয়ে নেবো। আমি আবার বলবো ওকে।
মলির চোখের চিন্তা দূর হল না। তুই নিজের সিস্টাসকে চিনিস নি একনো। এতো একগুঁয়ে। তারপর জুটেচে ওই এক পেদোর ব্যাটা, লিটিল ফ্রেন্ড। কি যে করি আমি। ঘনঘন মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল মলি।
দুই বন্ধুতে খুব একচোট হাসল। ডিওয়েন গলা তুলে বলল, বিগ মামা, তোমার ইস্টুতে কেমন যাদুকাটি আচে দ্যাকো, আমার মুকের কতা ফিরকে দিল।
তোর হিন্দু ফকিরের কতা ক বরন’, ওদের চার্চে গেচিলি বুজি? সে কি আমাদের ফাদার ইমানুয়েলের মত?
চার্চ না রে, ওই উৎসবে দেশ বিদেশের কত লোক এসেছিল ধর্মের কথা বলতে। চিন, জাপান, ইউরোপ। তেমনি এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে, ওরা হিন্দু। ইমারত গড়া হয়ে গেছে। আমার তখন কাজ জুটেছিল সাফসুতরো রাখার দলে। কাতারে কাতারে লোক আসছে তো। খাচ্ছে-দাচ্ছে মজা লুটছে। সবদিক তকতকে রাখতে হবে। আমি সারাদিন ঝাড়ুপোঁছা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমার সেদিন কাজ জুটেছিল যেখানে, সেখানেই হচ্ছিল সমস্ত দেশের এক ধর্মসভা। ওই সারাদিন কচকচি আর কি। আমার ওতে কি কাজ। তবু ভাল লাগছিল শুধু সাদারা নয়, কালো, বাদামী, হলুদ সব রঙের লোকেরা কথা বলছে আর সাদারা সেসব কথা শুনছে। কিন্তু কি যে ছাতার মাথা বলছে আমি কি ছাই বুঝতাম কিছু, নিজের মনে সভাঘরের পাশ ঘেঁষে ঝাড়ু দিচ্ছি। এমন সময় এলো সেই হিন্দু ফকির। গায়ে তাঁর এমনি কমলা রঙের আলখাল্লা, মাথায় কমলা রঙের কাপড় জড়ানো। সেদিন যেমন দেখলি আমায়। চারদিকে মেলা গোল হচ্ছে, তার মধ্যে কি বলবো ইনোসেন্ট, ওই ফকিরের গলাটা গম গম করে উঠল, কি বলল জানিস? My American brothers and sistars!
ব্রাদা’স অ্যান সিস্টাস?
হ্যাঁ, শুনেই আমার মনে হল এই ফকির যেন আমাদের কালোদের লোক। ঠিক নিগ্রোদের মতন বলল ব্রাদারস অ্যান্ড সিস্টারস। আর সেটা শুনে সারা ঘরজুড়ে সে কি হাততালি সেদিন। শুধু আমি না। ওখানে সবাই তারপর কি মন দিয়ে শুনল তার কথা। আমিও আমার ঝাড়ুপোঁছা ফেলে ওর কথা শুনলাম বসে।