নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
আন্তোনিও টাকা গুনতে খুব ভালবাসে। শুধু গোনা তো নয়, সব ভাগে ভাগে গুছিয়ে রাখতে হয়। টিকিট বেচে যে টাকা আসে, সে তো আসেই; গুছিয়েই পাঠায় ওরা। এক, দুই আর দশ ডলারে ভাগ করে। ডাইম আর কোয়ার্টার আসে কাপড়ের থলে করে। এ বাদে, নাচঘরে লোকের ছুঁড়ে দেওয়া যে টাকা, সেটা তার উপরি। এই আমদানি যত বেশি হয়, আন্তোনিও জানে, নাচে ধক তত বেশি। এই টাকাগুলো অমন গোছানো থাকে না। নাচের শেষে তার দুই মুশকো পাহারাদার মেঝে থেকে এগুলো কুড়িয়ে তোলে, গোছানোর সুযোগ দিলে অর্ধেক ওদের ট্যাঁকে যাবে না? কড়া হুকুম – যেরকম-কে-সেরকম এনে তার ঘরে ঢেলে দিতে হবে। এই নোটগুলো বেশি থাকে গোল্লা পাকানো। সেগুলোকে সোজা করে পাট পাট সাজিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু বড় সুখের কাজ সেটা। বুড়ো আঙুলের চাপে সেগুলোকে সিধে করতে করতে আনন্দে আন্তোনিওর ঠোঁট ভিজে যায়, সবুজ চোখ সজল হয়ে বৈদূর্যমণি। আগে একবার ইস্ত্রি করতে গিয়ে একটা দশ ডলারের পাত্তি পুড়ে গিয়েছিল। বেচারা জেনারেল শেরিডানের অমন পাকানো গোঁফটাই জ্বলে খাক। সে শোক আন্তোনিওর আজও যায়নি। টাকার শোক, শেরিডানের গোঁফের নয়। ইচ্ছা থাকলেও ইস্ত্রি করতে যায় না আর। হাত দিয়ে টেনে টেনে যতটা সোজা করতে পারে, সেটুকুই।
তাও কাজ কিছু কম নয়। ইদানিং টাকা ছোঁড়াটা আরও বেড়ে গেছে। যদিও অনেকে শুধু পেনি আর ডাইম ছোঁড়ে – ঝনঝন আওয়াজ করে পড়ে, ওইটুকুই। শুনতে ভাল, হিসেবের খাতায় যৎসামান্য। তবে সবাই তো এমন চামার নয়। তারা ডলারের নোট দেয় এক, দুই, পাঁচ। খুব মালদার হলে দশ, বিশ – কোনো কোনো দিন। প্রথমে সারি দিয়ে মুদ্রা সাজায় আন্তোনিও। পেনি, ডাইম আর কোয়ার্টারগুলো পাশাপাশি তালগাছের মত বাড়তে থাকে। সব থেকে ডানদিকে ডলারের মুদ্রা। আন্তোনিও খুব খুশি হয়, যখন এক ডলারের গাছটা সবার মাথা ছাড়িয়ে যায়। সেটা সহসা হয় না। বেশিরভাগ দিন কোয়ার্টারের মাথা থাকে সবার উঁচুতে। যদি কোনোদিন পেনি কিংবা ডাইমের মাথা আর সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, আন্তোনিওর দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরনো গালিগুলো দরজার বাইরে ছিটকে পড়ে লুটোপুটি খায়। আজকাল হিন্দু ফকিরের নাচটা এত খোলতাই হচ্ছে, এই নিয়ে পরপর দু’দিন ডলারের মাথা সব চেয়ে উঁচুতে পৌঁছে গেছে। এরকম দিনে আন্তোনিওর আবার করে গান গাইতে ইচ্ছা হয়। এখনকার ধূর্ত, সিড়িঙ্গে আন্তোনিওকে দেখে বোঝার উপায় নেই, যে তার গলায় এমনধারা সুর খেলতে পারে। কিন্তু টাকার এমনই মহিমা, সেই কবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গাইত, সেই সুর গলায় এসে ভর করে। আজ তেমনি একটা দিন। এক, দুই আর পাঁচ ডলারের নোটগুলো দেরাজে সার দিয়ে রাখতে রাখতে গুনগুন করে গাইতে শুরু করে গলা ক্রমে ক্রমে উঁচুতে উঠছিল, হঠাৎ পিছন থেকে বেসুরো গলায় কে বলে উঠল, বেড়ে গাইছ, নাচতেও জান তো?
টাকার মধ্যে এমন বিভোর হয়ে ছিল আন্তোনিও, প্রথমে কেমন বিভ্রম হল – নোটের মধ্যে আঁকা মেজর শেরিডানই কথা বলে উঠল বুঝি। কিন্তু কথাটা পিছন থেকে আসছে। ‘কে রে!’ বলে পিছন ফিরে তাকাতেই আক্কেল গুড়ুম। নদীর মত বয়ে যাওয়া গানের সুর মোহানায় এসে থমকে গিয়ে হে হে হাসিতে ঘর ভরাট করল। তার হাত তখনো দেরাজের ভিতরে টাকার উপরে – কীভাবে সেই হাত বের করে, টাকা না দেখিয়ে দেরাজটা বন্ধ করে দেওয়া যায়, এই ভাবনাটা মনে গোঁত খেল। এই সময়ে এখানে কারো আসার নিয়ম নেই। এই লোকটাকে কে ঢুকতে দিয়েছে ভেবে মনটা চিড়বিড় করে উঠেছিল। তারপরেই মনে হল, এই লোকটাকে আটকাবে, কারই বা এমন বুকের পাটা। মনের মধ্যে যদি কিছু ফাঁক-ফোকর থাকে, কান-এঁটো করা হাসি দিয়ে ভরাট করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাল আন্তোনিও।
স্যার, নিজে কেন এসেচেন? একবার বললেই আমি গিয়ে হাজির হতাম। হয়েছে কী, এই মাত্তর আমি আপনার কথাই ভাবচিলাম।
আমার কথা ভেবে গানও গাইছিলে? তোমার মতলব তো ভাল নয় হে। তার অট্টহাস্যে ঘর তো নড়ে উঠলই, আন্তোনিওর বুকটা হেঁচকি তুলে কেঁপে উঠল। দুর্জনের হাসির থেকে বড় বিপদ আর কিছু আছে নাকি! হাসলে এনার ডুমো ডুমো লাল গাল উপর পানে উঠে চোখের কিনারায় পৌঁছে যায়, হাসির সঙ্গে যুগলবন্দি করে নাকের ফোঁস ফোঁস নিশ্বাসে মোটা সোনালি গোঁফজোড়া ভুট্টা ক্ষেতের মত মাথা তুলে দোলে।
কি যে বলেন অফিসার! আপনাকে এই হপ্তার টাকাটা পাঠাতে হবে কি না, তাই ভাবছিলাম।
না আর পাঠাতে হবে না হে, সেটাই বলতে এলাম।
বিড়াল বলে মাছ খাবো না! ব্যাপারটা তো সুবিধের ঠেকছে না। আন্তোনিও জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে যতটা সম্ভব অমায়িক সম্ভ্রম বজায় রেখে বলল, এমন কথা বলবেন না স্যার, আপনাকে টাকা না দিয়ে আমরা নিজেরা খাব কোন মুখে?
তোমাদের খাওয়া তো ঘুচল এবারে, বাঁচাতে তো পারব না আর। টাকা নিই কোন সুখে?
এবার আন্তোনিওর টনক নড়ল। কথাটা কেমন যেন ঘুরপথে চলেছে! অথচ সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারছিল না। ফাঁসির হুকুম শোনার ভঙ্গিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হাতে এখনো নোটের গন্ধ টাটকা, অন্যদিন পয়সা-ঘাঁটা হাতের আঙুল শুঁকেই আন্তনিওর মাথা ঝিমঝিম করে উঠত। আজ না শুঁকেই।
তোমার নাচ-গানের আড্ডায় এবার তালা পড়তে চলেছে যে, বড় আফসোসের কথা। আমার পক্ষেও এবারে বাঁচানো মুশকিল। ক্যাপ্টেন উডবার্ন চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে ডান পা, বাঁ পায়ের উপর তুলে নাচাতে নাচাতে বলল। কোনোরকম আফসোস সেই ভঙ্গিতে ছিল না। ভান। খেলিয়ে খেলিয়ে গেঁথে তোলার কায়দা যত।
এই মক্কেল যে মহা ঘাঘু, সেটা আন্তোনিও জানে। ভয়ানক টাকার খাঁই। কারণে অকারণে এসে টাকার অঙ্ক বাড়াতে বলে, অজুহাত থাকে দশরকম। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তার কাছ থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় এমনিতেও নেই। লোকটা টেন্ডারলয়েনের পথে পথে টাকার গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। ঠিক খোঁজ পেয়েছে তার আমদানি আজকাল বাড়তির দিকে। অমনই তাক করে এসেছে। টাকার কথা মনে হতেই, তার সবুজ চোখের তারা হরিণের গতিতে দেরাজের খোলা পাল্লা ছুঁয়ে এল।
লোকটার ধূর্ত চোখে কোনো কিছুই এড়ায় না। দরাজ গলায় বলল, যাও, যাও! ওই দেরাজটা বন্ধ করে দাও গিয়ে। তোমার টাকাপয়সা সাবধানে রাখ আন্তোনিও, রোজগারের পথ বন্ধ হলে খাবে কী?
এমন কেন বলছেন স্যার? আপনি এলাকার মালিক, আপনি থাকতে আমাদের ভাত কে মারে? মোমবাতির মত গলে গলে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছিল আন্তোনিও।
আমার হাতে নয় রে বাবা, এসব আমার নাগালের বাইরে। শরীরটা চেয়ারে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে ‘আমি নিরুপায়, কী যে করি হায়’ ভঙ্গিতে নাটকটা জমিয়ে রাখল পুরোদস্তুর।
ওর এইসব গৌরচন্দ্রিকার মানেই হচ্ছে বড় কোনো দাঁও মারতে এসেছে। কিন্তু কী জন্যে – সেটাই ঠাহর হচ্ছিল না আন্তোনিওর। পেছল বরফে পথ পার হওয়ার সতর্কতায় কথা বলছিল তাই। মহা ধড়িবাজ, বাদামের খোলায় লুকিয়ে রাখা কথা খুলে ভাঙছে না। সেও মচকাবে না, দেখা যাক কী বলে। আপনার কথায় সবাই ওঠে বসে, আপনার নাগালের বাইরে তো চাঁদ-সুয্যি ছাড়া আর কিছু নেই।
হা হা করে খুব একচোট হাসল উডবার্ন। চাঁদ-সুয্যি আমার তাঁবে থাকলে আমি এই টিন প্যান অ্যালে থেকে হে মার্কেট, কোথাও সূর্য উঠতেই দিতাম নাকি? সারাটা সময় এই জায়গা আলোর রোশনাই আর নাচাগানা হুল্লোড়ে ঝলমল করত। ঝপ করে এক ফুঁ-তে মোমবাতি নেভানোর মত মুখটাকে বেগুনি করে ফেলল উডবার্ন। কিছুতেই কিছু হবার নয় হে!
গিরগিটি কোথাকার! মনে মনেই গাল পাড়ল আন্তোনিও। খুব কিছু ধান্দা নিয়ে এসেছে লোকটা আজ। ধেড়ে! ফেরেব্বাজ!
গৌরচন্দ্রিকা সেরে টপ করে কথাটা এবার পেড়ে ফেলল উডবার্ন। জাহাজের লোকেরা তো আমার কথা শুনবে না হে, ওয়ারেন্ট নিয়ে ওরা এই এল বলে। আজই আসছিল, আমি মোটে আটকিয়ে এলাম। তুমি বন্ধু মানুষ, আগে থেকে অন্তত একটু সাবধান করে দিই।
ক্রাম! লোকটা যে জাহাজ-পালানো সেটা আন্তোনিও জানত। কিন্তু নাচ এমন জমে উঠেছে, ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য তো শোনেনি। আজ আবার হঠাৎ করে কী হল রে বাবা! কত টাকা গচ্চা যাবে সেটা মনে মনে হিসাব করছিল। মুখে বলল, ও! আপনি ক্রামের কথা বলছেন?
আর কে আছে তোমার এখানে জাহাজ পালানো? লড়াইয়ের ময়দানে দুই কুস্তিগীরের মত একজন আরেকজনকে মাপছিল। তোমার সম্বুন্ধিরা এই তল্লাটে পালিয়ে এসেছিল চল্লিশ বচ্ছর আগে, আমি কি এখন তাদের খোঁজ করব? পাঁয়তারা চলছে, কথার প্যাঁচ-পয়জার।
যেন কিছুই হয়নি, সেইরকম একটা হাসি মুখে টেনে চিবুকে না থাকা দাড়ি চুমড়াল আন্তোনিও। নিয়ে যাক, আপদ জুড়ায়। ক্রাম এসে অবধি রুথের হামবড়াই খুব বেড়ে গেছে। ক্রামকে রসের নাগর বানিয়েছে। টাকা যদি দিতেই হয় রুথ দেবে, তার তো এখন নিজের থিয়েটারের দল। নাচছে শুধু বেলাসিওতে।
ও, ক্রামকে ধরে নিয়ে জাহাজে পাঠিয়ে দিলে তোমার কোনো ক্ষতি নেই? নির্বিকার মুখে বল আন্তনিও।
ধারাল চোখে মাপছিল উডবার্ন, সত্যিই কি লোকটার কোনো অসুবিধা নেই?
ওরা তো আমার থিয়েটারের নয় ক্যাপ্টেন, রুথের নিজের দল। আমি শুধু শোয়ের কন্ট্র্যাক্ট করেছি ওর সঙ্গে।
মুখের হাসিটা এবার ছড়াল উডবার্নের। সেটাও আমি জানি হে। টেন্ডারলয়েনে যা হয়, সবই আমার গোচরে আসে। তবে নাচছে তো তোমার এখানেই, তুমি সটকে পালাতে পারবে না। নৈবেদ্যতে কলাটা মুলোটা তোমারও থাকবে। তবে আগে নৈবেদ্যর হিসেবটা রুথের সঙ্গে হয়ে যাক, রুথকেই ডেকে আনো একবার।
রুথ তো এখন নাচের জন্য তৈরি হচ্ছে, ওকে কীভাবে ডেকে আনি?
আজকের শো বন্ধ করে দাও। অম্লান বদনে বলল ক্যাপ্টেন উডবার্ন।
এবার একটু ঘাবড়ে গেল আন্তনিও। টিকিট কেটে ফেলেছে লোক, এখন যদি হিন্দু ফকিরের জায়গায় অন্য কোনো নাচ দেখায়, ভাঙচুর হতে বাকি থাকবে না। বেলাসিও থিয়েটারের কিছু হওয়া মানে তার ক্ষতি।
সেটা কী করে হয় স্যার?
রুথকে ডাকো তাহলে।
আমি বলি কি, যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে হাত কচলিয়ে বলল আন্তনিও, আপনি বরং এই শো-টা নিজেও দেখুন। এইটার পরে আজ আর হিন্দু ফকিরের নাচ নেই। তখন নাহয় রুথের সঙ্গে কথা বলবেন।
উডবার্ন যে আন্তোনিওর ঘরে উপস্থিত হয়েছে সেই খবর রুথ পায়নি তেমন নয়। আমান্ডা বুড়ি হলে কী হবে, হাত পা চলে কি না চলে, জিভ তার খড়খড়ে। কান তেমনি টনটনে। উডবার্নকে আন্তোনিওর ঘরে ঢুকতে দেখেই দরজায় টিকটিকির মত সেঁটে গেছিল। ক্রামকে ধরে নিয়ে যাবে সেই খবরটা আঁচ করেই হাঁফাতে হাঁফাতে এসে রুথের কানে তুলে দিয়েছে কথাটা। শুনে প্রথমেই রুথের মুখ শুকিয়ে আমসি। ক্রাম বলেছিল বটে জাহাজ থেকে পালিয়ে এসেছে, সবার সামনে নাচছে, এরকম যে কোনোদিন হতে পারে। সত্যি হয়ে যাবে, সেটা রুথ বিশ্বাস করেনি। এখন শিয়রে শমন। একশ’ গজ কাপড়ের তলায় বুক ঢিবঢিব, মাথা ঝিমঝিম করলেও বাইরে নিজেকে টসকাতে দিল না রুথ।
মিনসেটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, আন্তোনিও বলেছে নাচের পরে। ফিসফিস করে বলল আমান্ডা। খুব টাকার খাঁই লোকটার।
টাকা দিতে হলে দেবে না হয়। মনে মনে সেই অঙ্কটা কষে নিয়েই চিন্তাটা তাড়াল রুথ। ও কী আর হবে, আমাকে কিছু করতে পারবে না ওই উডবার্ন ব্যাটা।
একদম। তুমি তো আর জাহাজ ছেড়ে পালাওনিকো। বিদেশিও নও। তোমার এক গাছি চুলও ছুঁতে পারবে না। নিয়ে যাবে ওই ক্রামকে।
আমান্ডা যদি কীটপতঙ্গ হত, তার ডানাটা এখুনি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেত রুথের চোখের অগ্নিবর্ষণে। কিন্তু সে তো একটা বুড়ি মাগী; তার চামড়া কুঁচকানো, হাত ডানা থোড়াই। রুথ তাই হাতের কাছে পড়ে থাকা চিরুনিটা ছুঁড়ে মারল আমান্ডার মুখে। নেহাত এত পোশাকের আস্তরণ ভেদ করে তাক করা মুশকিল, আমান্ডার এক হাত দূর দিয়ে উড়ে গেল সেটা। বুড়ির এসব অভ্যাস আছে। গজগজ করতে করতে মাটি থেকে সেটা কুড়িয়ে আবার রুথের হাতেই ফিরিয়ে দিল। সে তুমি যাই বল আর তাই বল, কোন এক ভিন দেশের লোক, তার জন্য কি টাকা গচ্চা দেবে তুমি? ন্যায্য কতার সুক নেইকো, গরীবের কতা বাসি হলে মিঠা লাগবে জানি। কিন্তু আমার কতা আমি তো কইবই।
তুই থামবি বুড়ি! নাচের আগে ক্রামের কানে যদি কথাটা যায়, আমি সেই মুহূর্তে তোকে বিদেয় করব বলে রাখলাম। এখন আর একটাও কথা নয়, নিজের কাজ করগে যা।
নাচের শেষেই বলল আক্রামকে। রুথ নিজের ভাবনাটা সেরে ফেলেছিল। আক্রামকে পালাতে বলতে পারত, কিন্তু সে যাবে কোথায়? তাকে ছেড়ে রুথই বা কী করে থাকবে। উডবার্নকে টাকা দিতে হবে কিছু। দেবে সেসব। পরোয়া করে না রুথ।
কথাটা শুনে আক্রামের আক্কেল গুড়ুম। এই ভয়টাই করেছিল। পাঁচকড়িদাও বলেছিল এমনি। এরকম সুখের জীবন ছেড়ে আবার সেই জাহাজি হওয়া?
আক্রামের দুই কাঁধে হাত রেখে রুথ নিজের চোখ ভাসিয়ে দিল আক্রামের চোখে। আমি থাকতে তোমাকে কে জাহাজে নিয়ে যায় দেখি একবার। উডবার্নকে সামলাব আমি, তুমি একদম সামনে এসো না যেন। টাকাই তো নেবে, দিয়ে দেব যা চায়।
রুথ উডবার্নকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরি ছিল। তাই বলে গিরগিটিটা যে তার সাজঘরে অপেক্ষায় বসে আছে সেটা ভাবতে পারেনি।
নাচ শেষ করে পোশাক ঝলমলিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই পেলো উডবার্নকে। তাকে দেখেই উডবার্ন নড়েচড়ে বসল, লাল বের করা জিভ বেরিয়ে এল এক হাত। আহা, এমন একটা নধর প্রজাপতি জিভের নাগালে আজ, সড়াত করে গিলে নেওয়াই শুধু বাকি। কথাতে কোনো রাখঢাক রাখেনি উডবার্ন। টাকা তো অনেক আছে, না চাইতেও পকেটে এসে জড়ো হচ্ছে। রুথের টাকায় কোনো লোভ নেই, চাই না মোটে। তাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছাই নেই। তার শুধু চাই রুথকে। ওই শরীরটি একবারটি না চাখলে তার অঙ্গ জুড়াবে না।
সাজঘরে এবার চিরুনি শুধু নয়, চুলের কাঁটা, আতরের শিশি, সাজগোজের বিবিধ সরঞ্জাম ওড়াউড়ি করল।
গিরগিটিটা সামনে দুই পা বাড়িয়ে, জিভ সড়াৎ সড়াৎ করে ঢোকাল আর বের করল। চিরুনির আঘাতে খসে পড়ল লম্বা লেজটা। সে যাক গে যাক, এমন লেজ একটা গেলে আবার গজাবে। সে বরং গোল গোল চোখে পলক না ফেলে চেটে নিল রুথের হাত, পা আর কোমরের ভাঁজ। আনন্দে রং বদলিয়ে কখনো সবুজ, দর কষাকষি করতে করতে পিঙ্গল, বারংবার না শুনতে শুনতে রাগে গনগন করে উঠে নেহাতই কদর্য কালসিটে মার্কা এক সরীসৃপ।
প্রজাপতিটা উড়ে উড়ে দেওয়ালে বসল, কখনো একেবারে ছাদের টঙে। গিরগিটি পিছু পিছু হামা দিল। প্রজাপতি ডানা মেলে ঘরময় উড়ে হাঁফিয়ে গেল। গিরগিটি ধৈর্য ধরে তার সেই প্রাণ বাঁচানো নাচ দেখল। নাচতে নাচতে, উড়তে উড়তে, প্রজাপতির ডানার রেশমি মোড়কে টান পড়ল। একশ গজের আবরণ খসে পড়ল মাটিতে। সেই নিরাবরণ প্রজাপতির দীঘল শরীর লম্বা জিভ দিয়ে চেটে নিল টেন্ডারলয়েনের গিরগিটি। খুঁটে খুঁটে খেল তার সবটুকু। যা শুধু ক্রামের জন্য রেখেছিল রুথ, সেটাই লুটেপুটে নিল ধড়িবাজ সরীসৃপটা।
আক্রামকে বাঁচাতে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে দিতেও রাজি বেলাসিও থিয়েটারের স্কার্ট ডান্সার রুথ।