নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
এলিস আইল্যান্ড জ্বলছিল।
ডেকে দাঁড়িয়ে তাজ্জব হয়ে দেখছিল ওরা। রাত এখনো বাকি, আগুনের ফুলকি কমলাগুঁড়ির মত ছড়িয়ে পড়ে আসমানে লাল রং ধরাচ্ছে। ওদের মধ্যে ফয়জল সবচেয়ে ছোট, গোঁফ দাড়ি এখনো মোলায়েম। যা দ্যাখে চোখে পলক পড়ে না তার। ঘাবড়েও গেছে বুঝি ছেলেটা। ভয় আর বিস্ময় জড়ানো গলায় বলল, দরিয়ার মাঝখানে যেন চেরাগ জ্বালিয়ে দিয়েছে, একদম আসমান ছুঁয়ে দেবে মনে লাগছে গো।
মোকসাদ আলির কপালে ভ্রুকুটি, গলায় আফসোস। মামুলি আগ নয় এটা ফজলু মিয়া। এদেশের ইমারত কাঠের, এ আগ সব হজম করে নেবে।
মুসা মণ্ডল আলেমদার আদমি। অনেক ঘাটের জল খেয়েছে সেও। দুহাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে বলল, আল্লার লাখ লাখ সুকর, আমাদের জাহাজ এখনো দরিয়াতে। একবার দিমাগ লাগিয়ে ভাবো মোকসাদ ভাই, যদি আর একদিন আগেও সেন্ট লুইসের নোঙর লাগত, এমনকি আমরা কিনারাতেও আসতাম, তাহলে আমাদের কী হাল হত?
মোকসাদের কথা ঠিক। পাইন কাঠের বাড়ি। যত বড় ইমারত হোক আগুন লাগলে বাঁচানো মুশকিল। বিশাল তিনতলা ইমিগ্রেশান দপ্তর দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়েছিল সেদিন।
মুসার কথাও কিছু ভুল ছিল না। যখন আগুন লাগে তখন অন্তত শ দুয়েক লোক ছিল ভিতরে। কোন কোন মুলুক থেকে ঠাঁই পাওয়ার আশায় যে এই ঘাটে এসে জড়ো হয়েছিল! তাদের কতজনকে অক্ষত দেহে বের করে আনা গিয়েছিল সেদিন, তার হদিশ জানা নেই।
বের করে আনবেই বা কে? দমকলের লোকেরা ম্যানহাটান থেকে নৌকায় করে যতক্ষণে হাজির হল চারদিকে শুধু ছাই, পোড়া কাঠের গন্ধ আর দগদগে ঘায়ের মত এখানে ওখানে আগুনের ডাঁই। যে ইমারত বানাতে লেগিয়েছিল দুবছরের বেশি, মিটতে লাগল কয়েক ঘণ্টা। যারা ভিতরে ছিল তারা নিজেরাই হুড়োহুড়ি করে যে যেদিকে পারে পালিয়েছিল।
এসব সেন্ট লুইসে বসে তারা জানতে পারেনি। না হলে বুঝত, ঠিক বলেছে মুসা চাচা। আল্লার দোয়া আলেফরা তার মধ্যে ছিল না। নিজেরা বাঁচলেও তাদের চিকনের সামগ্রী সব পুড়ে আংরা হত সেই রাতে।
তাই বলে তাদের নসিব অত ভাল কিছুও নয়।
দুই মাস জাহাজে জাহাজে কাটানোর পর যখন ওদের নামার জন্য তোড়জোড় করার কথা, এস এস সেন্ট লুইসের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হল নর্থ রিভারের দিকে। আকাশে আগুনের লাল কমে তখন ভোরের সুর্য উঁকি মারার চেষ্টা দেখছে। চারদিক ধোঁয়ায় ধূসর, পোড়া ছাই সমুদ্রের হাওয়ায় যত্রতত্র উড়ছে। চোখ জ্বালা করছিল ওদের! তবু আলেফ, বসির, মকবুল চাচা সব লাইন করে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিল দুপাশটা। সকালের আলোতেও স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেহারা আজ ধোঁয়ায় ম্লান।
ডান দিকে ম্যানহাটানের চকমিলান চেহারা দেখে আলেফ, বসির, রসুল ভাই - ওদের সবার চোখ সত্যি ছানাবড়া। এতো বড় বড় ইমারত! ফায়জলের মনে হচ্ছিল এই দেশে আসা সার্থক তার, জন্নত বুঝি এমনি হয়। বিশ বাইশ মহলা হবে ওই বাড়িটা, তাই না মোকসাদ মিয়া?
মোকসাদ আগেও এসেছে, কিন্তু যতবার আসে নতুন, আরও বড় আরও উজ্জ্বল দেখে এই মানহাটানকে। এলিস আইল্যান্ডের আগুন চকমিলান ওই বাড়িগুলোর মহিমা ম্লান করতে পারেনি।
এটা কি এখানকার বড়লাটের বাড়ি গো মোকসাদ চাচা?
মোকসাদ ভাবছিল এখন কী হবে? এতদূর দরিয়া উজিয়ে আসল, সফর কি বরবাদ হতে চলেছে? নসিবে কী আছে সে খোদাতালাই জানে। মাথা নেড়ে বলল, না ফজলু মিয়া, এখানে বড় ছোট কোন লাটই থাকে না। এটা কাজকামের জায়গা, তাবড় তাবড় কারবারিদের আস্তানা এই মানহাটান।
খুব বড় কারবার এদের? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত?
মোকসাদ মিয়ার কাছে অত খবর তো নেই। তার কাজ মাল এনে নিউ জার্সির সমুদ্রতীরে ফিরি করা। সে চেনে আতলান্তিক সিটি, অ্যাশবেরি পার্ক কিংবা লং ব্রাঞ্চের সমুদ্রতীর। মানহাটানে তো চিকনের বিক্রিবাটা হয় না। একবার জমিনে পা পড়লে সিধা চলে যায় দরিয়া কিনারের বোর্ডওয়াকে। সেখানে গরমের সময় মেলা লোকের ভিড়। মাথায় বোঝা চাপিয়ে বোর্ডওয়াকে ঘুরে ঘুরে ফিরি করে চিকনের রুমাল, বিছানার চাদর, এদের খাওয়ার টেবিলে পাতার আস্তরণ, কখনো দেওয়ালে ঝোলানোর শৌখিন চিকনের কাজ। কিন্তু এই দশজোড়া চোখে মোকসাদ আলি, মুসা মণ্ডল এরা আলেমদার আদমি, দুনিয়াদারি দেখেছে এতো। মোকসাদ আর কী বলে! মেহেন্দি লাগানো দাড়ি চুমরে বলল, আমরা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজে আমাদের কি কামাই হবে কিচু?
এত দুঃখেও হেসে উঠল মুসা মণ্ডল। এটা কী কইলে মোকসাদ মিয়া। আদা নাই হোক, চিকনের ব্যাপারি তো বটে। জাহাজের খোঁজ তো আমাদের চাই।
সত্যি, জাহাজ এবার কোন মুখো তার হদিশ করা দরকার।
সেন্ট লুইসের মুখ ঘোরাতেই জাহাজ জুড়ে বেদম হইচই লেগিয়েছিল। চেঁচামেচি, হরেক ভাষায় গালাগালি, খেউর, মহিলা আর বাচ্চাদের কান্নাকাটি - সে এক তান্ডব। এস এস সেন্ট লুইসে শুধু তারা বারোজন তো নয়, দেশ বিদেশে থেকে আসা অন্তত শ দুয়েক ভাগ্যসন্ধানী চলেছে নিজেদের তকদির বদলাতে। জার্মান থেকে এসেছে এক কসাই, দশাসই চেহারা, স্টুটগার্ট শহরের লোক। নিউ ইয়র্কের স্টবিজ মার্কেটে কাজের ডাক পেয়ে এসেছে হোলগার। জাপান থেকে আসা সুসি বানানোর রাঁধুনি, ইয়োকোনো আকাহিতো যাবে ম্যানহাটানের কুরুমাজুসির দোকানে। রাশিয়া থেকে আসা ইহুদি দর্জি, নরওয়ে আর সুইডেন থেকে আসা একদল চাষি, সিগার বানানোর কারখানায় যোগ দেবার জন্য ওয়ারশ থেকে আসা আলজি বারটেরিখ, এমনি আরও অনেকে। চিন থেকে আসা ব্যাপারিও আছে, ওদের দেশের হাতের কাজও বেশ বিক্রি হচ্ছে আজকাল। সে যাবে স্যানফ্র্যান্সিস্কোর চায়না টাউনে। কেউ সাদা, কেউ লাল, কেউ হলুদ। আলেফরা পড়ে বাদামির দলে। কিন্তু সবার মুখই এখন উদ্বিগ্ন। নিজের নিজের ভাষায় উষ্মা প্রকাশ করছে। কেউ কেউ এখানে বসত গেড়ে বউ বাচ্চা আনতে নিজের মুলুকে গিয়েছিল। তাদের বউদের মুখে ভয়, সুদীর্ঘ যাত্রায় চেহারা আলুথালু, নিজের মানুষটির হাত জোরতোড়ে পাকড়ে রেখেছে। মায়ের কোলে বাচ্চারা পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। বিশ, ত্রিশ, ষাট কি আরও বেশি দিনে জলে ভেসেছে ওরা। ঝড় ঝঞ্ঝা কাটিয়েছে। এদের বেশির ভাগই তো থার্ড ক্লাসের যাত্রী, কোনমতে গুড়িমুড়ি দিয়ে থেকেছে তিন থাক বাঙ্কের অন্ধকার স্টিয়ারেজ সেকশানে। এখন নামতে না পেরে তাদের শরীরের সব বেদনা ক্লেশ যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এলো। বেশ কিছু আমেরিকানও আছে, কিংবা অনেক রেস্তঁঅয়ালা ভ্রমণপিপাসু। তাদের মধ্যে অতটা ব্যত্যয় হল না। বিরক্তি অবশ্যই, কিন্তু তাদের তো আর এই স্বপ্নের দেশে ঢুকতে পারবে কি পারবে না, সে নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। একটু দেরি হবে, এই পর্যন্ত। তারা নিজের নিজের প্রথম শ্রেণির কেবিনে বিশ্রাম নিতে চলে গেল।
আর রইল জাহাজের মাল্লা, লস্করেরা। তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, এরকম কত ঝক্কি পোহাতে হয় তাদের। যে যার জায়গায় নিজের কাজ করে চলেছে। আলেফ চেনে শুধু গোবিন্দ সারেংকে। সে এতো বছর জাহাজের লস্কর হয়ে দেশে দেশান্তরে ঘুরে চুল পাকিয়ে ফেলেছে। আলেফ এরপর কী হতে পারে জানার জন্য উঁকি মেরেছিল গোবিন্দদার কাছে, আলেফকে কোন কারণে খুব পছন্দ করেছে। জিজ্ঞেস করলে দরিয়ার হাল হকিকত বলে দেয় লোকটা। এখন দেখল গোবিন্দদা ফার্নেসে কাজ করছে নির্বিকার মুখে। ব্যস্ত। গোবিন্দদার সঙ্গে আর এক সিলেটি লস্কর জুড়িদার, আকরাম আলি। তাকে কোথাও খুঁজে পেল না। আলেফ ডেকে ফিরে এসে ফের দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই ডেকে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানহাটান আর স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দূরে সরে যেতে দেখছিল।
বেশি দূরে অবশ্য যেতে হল না। কিনারা এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি। ব্রিটিশ জাহাজ সেন্ট লুইসের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল পিয়ার ১৪, যদিও আমেরিকান লাইনের টার্মিনাল এটা। এই ঠাঁইটাও ওদের চোখে কিছু ছোট ঠেকল না। গোবিন্দদা বলেছে এটা নাকি ওয়েস্ট স্ট্রিটের উপর ফুল্টন থেকে ভাসি অবধি ছড়ানো, তাদের একখানা গোটা গ্রাম যেন একটা। পেল্লাই সব ব্যাপার এদের। বাবনান আর দাদপুরের লোক দুচালা চারচালা ছাড়া দেখেছে আর কী এই জীবনে!
কিন্তু জমিনে পা ঠেকাতে পারলে তবে তো। মুসা মণ্ডল আর মোকসাদ আলি আগেও বার তিনেক এসেছে। তখন ইমিগ্রেশান হত ক্যাসল গার্ডেন ডিপোতে। এলিস আইল্যান্ড তো মোটে কয়েক বছর।
এলিস আইল্যান্ডে যে শুধু বড় ইমারত বানানো হয়েছিল তা তো নয়, এই দেশে ঢোকার নিয়ম কানুন গুলোও আরও শক্ত হচ্ছিল। অ্যালিয়েন কন্ট্র্যাক্ট লেবার ল চালু করেছে ফেডারাল গভর্নমেন্ট, শুনেছে মোকসাদ। তার জেরে ঢোকার পথ পুব দেশের লোকেদের জন্য দিনকে দিন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
মোকসাদ জানে না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। নিজের এই চিন্তার কথা বলেছে শুধু মুসা ভাইকে, আর সবাইকে বললে তারা হরেক সওয়াল তুলে দিমাগ খারাপ করে দেবে। কত রকমের লোভ দেখিয়ে গ্রাম থেকে নতুন লোকদের এই দূরদেশে আনতে হয়! হল্লা বাঁধিয়ে কী লাভ।
জাহাজ নোঙর করল। কিন্তু তাদের জমিনে পা দেওয়ার উপায় নেই। সব যাচাই না করে কাউকে নামতে দেওয়া হবে না। শুধু মাল্লা আর লস্করদের মধ্যে শোর লিভ নিয়ে অনেক নেবে গেল। গোবিন্দদা আর আক্রামভাই শহর দেখতে গেল। যাওয়ার আগে এসেছিল আলেফের কাছে। তাদের মায়া পড়ে গেছে আলেফের উপর, বিশেষ করে গোবিন্দদার। আলেফকে দেখলে তার নাকি নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে।
এর মধ্যে এলিস আইল্যান্ড থেকে সাহেব মুন্সি আর কলমচিরা ইমিগ্রেশানের জন্য পিয়ার ১৪তে চলে আসতেই শুরু হল হাল হকিকত যাচাই করার কায়দা কানুন। হাটে গরু ছাগল কেনার মত শরীরের তত্ত্বতালাশ চলল। একেকটা খাঁচার মত জায়গায় ঢুকছে একজন একজন করে।
সেখানে ঢুকে আলেফের মুখ শুকিয়ে আমসি। পেল্লায় চেহারা লোকটার, গায়েগতরে দুতিনটে আলেফকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে পারে। পরনে কোট প্যান্টুলুন থাকলে কী হবে, আলেফের মনে হল আলমবাজারের ইব্রাহিম কসাইটা। কঠিন মুখ - নির্দয়, নিরাসক্ত। আলেফের থেকে আধ হাত উঁচুতে লোকটার মাথা, পেতে কাটা বাদামি চুল আর সিগারের ধোঁয়ায় আরও বাদামি হয়ে যাওয়া মোটা গোঁফের ফাঁক দিয়ে ফকফক করে কী যে বলে, আলেফ তার এক বিন্দু বুঝতে পারেনি। বিরক্ত মুখে লোকটা আলেফের চুলের মধ্যে চিরুনি চালালো উকুন খুঁজতে। ওর তিন আঙ্গুলে আংটি পরা হাতের তর্জনী দিয়ে বুকে খোঁচা মেরে দেখল হাঁফের রোগ আছে কিনা। এমন কী চোখের পাতা হুক দিয়ে পিছনে টেনে নিল ট্র্যাকোমার খোঁজে। আলেফের সবচেয়ে লজ্জা লাগল যখন প্যান্টালুন নাবিয়ে খোঁজ লাগাল গনোরিয়ার।
এই সব যখন চুকলো শুরু হল কলমচির প্রশ্নবাণ।
কী কাজে এসেছো? আলেফের নাম কাগজে খশখশ করে লিখতে লিখতেই বলল লোকটা, চোখ না তুলেই। এই লোকটার চেহারা বেশ ছোটখাটো, দড়ির মত পাকানো চেহারা, চুলের রং কাঁচা হলুদ। একচোখে একটা গোল চশমার কাচ। এখানে যে সব লোক কাজ করে তারা অনেক ভাষা কাজ চালাবার মত জানে, একেকটা ভাষার রকমফেরও। এই লোকটা জানে হিন্দুস্তানি। ইংরাজি আর হিন্দুস্তানি মিশিয়ে কথা বলছিল।
আলেফ যে ওর কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারছিল এমনটা নয়। তবে মোকসাদ চাচা আন্দাজ দিয়েছিল কেমন প্রশ্ন হতে পারে, এই দেশে আসার আগে একটু আধটু ইংরাজি বলার পাঠ দিয়েছে তাদের। সেও বলছিল ইংরাজি শব্দের সঙ্গে বাংলায়।
কোনমতে বলল, কারবার।
কী? লোকটা যেন ভাল করে শুনতে পায়নি অথবা বিশ্বাস করেনি? আলেফ জানে না। গলা চড়িয়ে বলল আবার, কারবার।
গলা দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে লোকটা খশখশ করে লিখে নিল। তারপর আলেফের দিকে ওর বিড়াল চোখ তুলে প্রশ্ন করল, কোন দেশের লোক তুমি?
ইস্ট ইন্ডিয়া।
এখানে আসার আগে, শেষ কোন শহরে ছিলে?
সাদাম্পটন।
এখানে নেবে যাবেটা কোথায় শুনি?
লোকটার গলায় তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ছিল। কিন্তু সারা শরীর দিয়ে ওর কথা শোনার চেষ্টায় ত্রস্ত আলেফের তাতে কী! চেনা অচেনা শব্দের মধ্যে থেকে কোনমতে আন্দাজ করে বলল, নিউ জার্সি।
আসার খরচ কে দিয়েছে?
নিজের টাকা। এ কথাটা অবশ্য সত্যি না, কারণ জাহাজের রসদ পানি সব জুগিয়েছে মোকসাদ চাচা।
সঙ্গে কত টাকা এনেছ?
ছয় ডলার।
এই টাকায় কী ব্যবসা করবে শুনি? চিমড়ে মুখে অবিশ্বাসের হাসি আঁকা ছিল একদম।
চিকনের কাজ নিয়ে এসেছি, সেগুলো বিক্রি করবো।
নিজের মাল, না অন্য কারো হয়ে বিক্রি করতে এসেছো?
নিজের।
এর আগে এই দেশে এসেছিলে কোনদিন?
না।
এখানে তোমার কোন আত্মীয় আছে?
না।
থাকবে কোথায়?
বোর্ডিং হাউজে। ১৭ নং বেনহার্ট স্ট্রিট।
জেলে গেছো কখনো? নিজের দেশে?
না।
কটা বিয়ে তোমার? তোমাদের জাতে তো অনেকগুলো বিয়ে হয়। তাই না? বেশ মুখ কুঁচকে বলল লোকটা, নিজের জাত সম্পর্কে অহং থাকলে যেমন হয়।
আলেফ চোখ নিচু করে বলল, এখনো বিয়ে করিনি। মনে ভেসে উঠল আমিনার মুখ।
এখানে কোন কাজের কন্ট্র্যাক্ট নিয়ে এসেছো?
না।
একই প্রশ্ন করেছিল সবাইকে। জনে জনে এই এক গত। মুসা মণ্ডল, মোকসাদ আলি, মিন্তোজ মণ্ডল, আব্দুল আজিজ, আব্দুল আহমেদ, বাসিরুদ্দিন শেখ, অবিদুল্লাহ, ফায়জল রহমান। আগে থেকেই মকসাদ আলি সবাইকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিল, তাই তাদের কথার খুব উনিশ বিশ হয়নি। তবে যেভাবে প্রশ্ন করছে, হিন্দুস্তানি মিশিয়ে বললেও, এদের কথার টানে সড়গড় তো আর নয় ওরা। লালমুখো দেখে ভয় পাওয়ার অভ্যাসটাও তো জন্মে ইস্তক। তাই বলতে গিয়ে বসির থমকে থমকে যাচ্ছিল, ফায়জল তো ভুল করে বলেই দিয়েছিল যে সে একবার হাজতে গেছে। আসলে এক গরুচুরির কেসে ধরা পড়েছিল বাবনানে। কিন্তু একবার বলে ফেলে তার বেশি ভোগান্তি।
ভোগান্তি হয়েছিল অবিদুল্লাহেরও। ওর চোখ টেনে কী যে দেখেছে, জামার উপর চক দিয়ে দাগ টেনে দিল। ওকে টেনে একদিকে নিয়ে গেল আরও কীসব পরীক্ষা করতে।
এইসব প্রশ্ন, তত্ত্বতালাশ পেরিয়ে জার্মান কসাই, ইহুদি দর্জি, জাপানি সুসি কারিগর, নরওয়ের চাষি, পোলান্ডের সিগার কারখানার কর্মী সবাই নেমে গেল। তারা কেউ যাবে পেনসেলভেনিয়া, কেউ মিশিগান, কারো রাস্তা ভার্জিনিয়ার দিকে। রয়ে গেল শুধু বারো জন চিকনের ব্যাপারি। আর দুজন চিনা। চিনাদের ব্যাপারটা আরও গোলমেলে, চাইনিজ এক্সক্লুসান অ্যাক্টে ওদের এই দেশে ঢোকাই এখন মুশকিল। তার উপর ওদের কথাও কেউ সহজে বুঝতে পারে না।
চিকনদারেরা সেদিক থেকে কথাবার্তায় তরিবৎ। নতুন যারা তারা একটু ঘাবড়ে গেলেও তরিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তবু আটকে গেল।
সবাই এখন মোকসাদ আলির মুখের দিকে চেয়ে। কী হল মিয়াজান, আমাদের যেতে দিচ্চে না যে?
মোকসাদও সেই কথা ভাবছিল। কিছু কি ভুল উত্তর দেওয়া হল? গোলটা হল কোথায়? তারা তো ব্যাপারি, তবে কি কন্ট্র্যাক্ট মজদুর ভেবেছে? আগে তো বার তিনেক এসেছে, এমন ধারা তো হয়নি কখনো। তার মাথায় শুধু ঘুরছিল নামতে না দিলে করবেটা কী? এতগুলো লোকের খরচা তাকে তুলতে হয়েছে। তার উপর কত মাল এসেছে সঙ্গে। এখানে এখন গরমের সময়, নিউ জার্সির বোর্ডওয়াকে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হচ্ছে, কত ব্যবসা হত এবার!
সে মুসা ভাইকে এক দিকে টেনে নিয়ে গেল। কী করবো মুসা ভাই?
আমরা আর কী করবো? ফিরে যেতে হবে।
এমন ধারা এর আগে তো কখনো হয়নি কো। তাইলে?
ভেবে দ্যাখো গেল বার আমরা এয়েছিলাম। তুমি, আমি আর রহমত ভাই। হাতে গোনা তিনজন। হয়তো লোক বেশি দেকে এরা বিশ্বাস যায় নি।
আহাম্মকি হয়ে গেল বলচো? কত গচ্চা গেল বল তো? দশ জনের খোরাকি মামুলি রকম নয়।
এখন থেকে ভেবে কী হবে মোকসাদ ভাই। হয়তো আরও কিছু যাচাই করবে ওরা, হিম্মত রাকো।
এবার কত মাল তুলেছিল! খুব কারবার হবে আশা করে এসেছিল মোকসাদ। তার কপালের ভাঁজ আর জায়গা ছাড়ছিল না।
ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ডিটেনশান সেন্টারে। নাম যাই হোক, হালচাল আস্তাবলের থেকে ভাল কিছু নয়। যেমন নোংরা তেমনি ভ্যাপসা গন্ধ। জন্তু জানোয়াররাও এর চাইতে ভাল থাকে। মোকসাদ চাচা নাক কুঁচকে বলল, এখানে সার্কাস খুলেছে। হিন্দুস্তান থেকে হাতি, ঘোড়া এয়েচিল। তারা নেচ্চয় একেনেই ছিল নাবার আগে!
ঘরগুলো ঘুপচি, হাতি তো সিঁধোবে না। তবে কে জানে ঘোড়া গাধা রেখেছিল হয়তো। এমন বিটকেল বাস ছাড়ছে।
থাকা যেমন, তেমনি এদের খোরাকি। খাবার নামে যা জুটল মুখে তোলার মত নয়, সোনা মুখ করে তাই খেয়ে নিল সবাই। উপায় তো নেই, মুখ বুঁজে পড়ে রইল সেখানেই। গাঁয়ের মানুষ ওরা, বিচালি বিছিয়ে শোবার আদত আছে। ওদের দেওয়া চিটচিটে বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকল। ছুঁচো, ইঁদুর এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, সাপ যে ছিল না সেই ভাগ্যি।
আটদিন পরে এলো আরেক লালমুখো, নতুন লোক। ইনি হচ্ছেন এডোয়ার্ড ম্যাকসুইনি সাহেব, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইমিগ্রেশান কমিশনার। উঁচুতলার সাহেব, এসেই নিজের ঘোষণা দিলেন।
ওরা আগের দিন দেখেনি একে। মাথার টুপিটা বাঁকিয়ে পরা, মুখে সিগার। সিগার দাঁতে চেপে হাঁক দিতে থাকল।
মিন্তোজ মণ্ডল!
মুসা মণ্ডল!
মোকসাদ আলি!
গরান আলি!
আব্দুল আজিজ!
আব্দুল আহমেদ!
আলেফ আলি!
শেখ বাসিরুদ্দিন!
মহম্মদ অবিদুল্লাহ!
ফাজলে রহমান!
সিকান্দার খান!
ওয়াহিদ বক্স!
হুজুর! সবাই নিজের নাম শুনে শুনে গলা ছেড়ে হাজিরা দিল! সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিল একটা করে হলুদ পরচি। তাতে লেখা দেখে মোকসাদের গলা শুকিয়ে গেল – likely to become public charges। আর কেউ একদানা ইংরাজি পড়তে পারে না, মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল শুধু।
ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হও। যেখান থেকে এসেছ, আবার সেইখানে ফিরে যাও দেখি বাপু।
মাথায় বাজ পড়লেও বুঝি এমন দশা হয় না লোকের। হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল ওরা, একে অপরের দিকে চেয়ে।
মোকসাদ আলি এক পা এগিয়ে এলো। সে দলের নেতা, আগে এতবার এসেছে। তাকে তো বলতেই হয়। হুজুর আমাদের গোস্তাকি কোতায় হল?
মুখ খিঁচিয়ে উঠল ম্যাকসুইনি সাহেব। কন্ট্র্যাক্ট লেবার সব তোমরা, মজদুর। আমরা আর ঢুকতে দিচ্ছি না। নামঞ্জুর!
আমরা মজদুর না স্যার, কাপড়ের ব্যাপারি।
পকেটে ছয় ডলার নিয়ে ব্যাপারি হয়েছো? খুব একচোট হাসল সেই লোক। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, না, মাল তোমাদের বলে আমরা বিশ্বাস করছি না। ব্যবসায়ীরা এমন দল বেঁধে আসে না। আসলে তোমরা অন্যের মাল নিজের বলে দেখাচ্ছ। তলে তলে অন্য কারো হয়ে কাজ করার জন্য এসেছো। আদতে মজদুর। এদেশে এরকমভাবে আসার নিয়ম নেই।
ভূল করচেন হুজুর। মোকসাদের গলা কেঁপে উঠল, চোখ ভরে আসছিল জলে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, আমরা একসঙ্গে এয়েচি কারণ আমরা সবাই এক জায়গার নোক। এতদূরের পথ, অনেক নোক থাকলে বল ভরসা পাই।
নিয়ম হল নিয়ম। আমাদের সেরকম ভাবেই চলতে হবে তো। যা বলে দিলাম, ব্যাস। তোমাদের জাহাজে ফেরত পাঠাচ্ছি, ফিরে যাও। ম্যাকসুউনি আর কোন কথা শোনার জন্য তৈরিই ছিল না। পিছন ফিরে সটান গটগটিয়ে চলে গেল।
মোকসাদ আলি ওখানেই চোখে হাত দিয়ে বসে পড়ল। মুসা সান্ত্বনা দিল। কারবারে এমন বেশি কম হয় মোকসাদ। আজ নোকসান হল, আবার কোনদিন লাভ হবে। এখন জাহাজে করে সাদাম্পটনে ফিরে চলো, শলা পরামর্শ তো চলতেই থাকবে। একটা দিক নিশানা ঠিক বেইরে আসবে খন।
কদিন বাদে রসদ তুলে এস এস সেন্ট লুইস সাদাম্পটনের ফিরতি পথ ধরল। সবাই খুব মুখ গোমড়া করলেও আলেফের যেন কেমন ভাল লাগছিল এই ফিরে যাওয়াটা। সে সাদাম্পটন ফিরবে, তারপর সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতা থেকে দাদপুর। আমিনার কাছে, আমিনার জন্য। ভাবতেই মনটা নেচে উঠছিল তার।
জাহাজ ফেরার পথ ধরল আবার সেই দরিয়া, আবার সেই থইথই পানি। জাহাজের লস্কর, মাল্লা, ফায়ারম্যান, ক্যাপ্টেন সবাই আগের মতই। ওদের সঙ্গে তো পুরো আসা যাওয়ার কাজের কন্ট্র্যাক্ট। শুধু ছিল না দুজন। অন্তত আলেফের চেনার মধ্যে।
আলেফ অনেক খুঁজেও গোবিন্দ সারেং আর আক্রাম আলিকে পেলো না। সোরগোল শুনেছে, কয়েকজন শোর লিভ নিয়ে ঘাটে নেমেছিল, আর জাহাজে ফেরেনি।
কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাদের। ওদের এই দেশে রেখেই জাহাজ উল্টোপথ ধরল।
সাগ্রহে পড়ছি।
ভারী সুন্দর এগোচ্ছে কাহিনী। অধীর আগ্রহে পড়ছি ।
তরতরিয়ে এগোচ্ছে। রেখে যাচ্ছে পরের কিস্তির জন্য সাগ্রহ অপেক্ষা।