নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
যেদিক দুচোখ যায় আশমানি নীল। তার মধ্যেই রকমফের। এক দরিয়া থেকে আর এক দরিয়ায় পাল্টাতে থাকে রূপ রং। ঠিক যেমনটা তাদের চুঁচড়োর আকাশ। সেও কি সব দিন এক রকমের নীল? কখনো কলকে ফুলের মত মোলাম। দেখ না দেখ ইলিশ মাছের মত ঝাঁ চকচকে, আঁশ বেয়ে আলো টপকাচ্ছে! দরিয়ার বুকে মুখ দেখা আসমানও অমনি নীল। ধরা ছোঁয়ার বাইরে, গভীর, আল আজারক। আবার যখন রং বদলায়, বিস্তীর্ণ জলরাশিতে সেই রং ছড়িয়ে যায়। কোন কোনদিন হয়ে ওঠে বিষফোঁড়ার মাথার মত পাংশুটে নীল, টসটস করে কিসের প্রতীক্ষায়। কখন কী হয় বলা যায় না। এমনটা হয়েছিল দু-একদিন।
জাহাজে আলেফের এই প্রথমবার। সবকটা দিন গুনলে মাসদুয়েক হল কেবল। অথচ তার মনটা দিনভর গুমরায়; ভাবটা সারা জীবন কেটে গেছে জাহাজের ডেকে। এখন যদিও স্টিয়ারেজ সেকশানে আছে, খিদিরপুর থেকে সেই যে চেপেছিল এস এস গোর্খায়, সেখানে জাহাজের উপরের ডেক বরাদ্দ হয়েছিল। শুধু নামেই তারা কেবিন প্যাসেঞ্জার, জায়গা জুটেছিল ডেকে। রোদে ভাজাভাজা হয়ে গিয়েছিল এতগুলো দিন। এখন যেন মনে হয় সেই ছিল ভাল।
আলেফের মন যদি গুমশুম, ফায়জল খুশ মেজাজ। একেকটা নতুন বন্দরে ভিড়ছে, সে ছেলের দেখে দেখে আশ মেটে না। এস এস গোর্খা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশান কম্পানির জাহাজ। প্রথমে ঢুকেছিল মাদ্রাজ বন্দরে, তারপর খানিক উজিয়ে কলম্বো। দু জায়গা থেকেই মেলা লোক উঠল! কামকাজের খোঁজে চলেছে মহারানির কোলিয়ারিতে। জাহাজ যেখানেই নোঙর ফেলে, ফায়জল নেমে দেখার জন্য ছটফটায়। বসিরভাই বলতে ছাড়েনি, কী মিয়া বন্দরে বন্দরে বিবি ঢুনতে তড়প জাগে? হাসনুবিরে ভুলে যেও না য্যানে।
ঘরে ফায়জলের বিবি আছে, হাসনুবির কথা মনে পড়ে তার। তবু হরেক জায়গার মানুষের সঙ্গে স্যাঙ্গাতি করতে ইচ্ছে হয়। যা নতুন, সেসব দেখার জন্য ছটফট করে মন। যা আছে তা তো আছে, যা নেই তার টানেই তো ফায়জল বেরিয়েছে ঘর ছেড়ে। কিন্তু বসিরভাইয়ের উপর কোন কথা চালায় না। ভাইজানের মত নিজের ঘর, বিবি আর বাচ্চা আঁকড়ানো ঘেরাটোপের জীবন তার জন্য নয়।
জাহাজ এরপরে পশ্চিম দিক ধরেছিল, আরব সাগর। একবার দাঁড়াল আডেন বলে এক ইয়েমেনি বন্দরে। মাল্লার দল হই হই করে ছুটে গিয়েছিল বন্দর ঘেঁষা বেশ্যাপল্লীতে। খিদিরপুরে জাহাজঘাটায় নোঙর ফেললেও এমনি ফিরিঙ্গি নাবিকদের ভিড় ভন ভন করে কলিঙ্গাবাজারে, কলিন রোডের বাসা থেকে আলেফ দেখেছে সে সব। আডেনে ওদের মধ্যে থেকে কেউ নাবেনি, মোকসাদ মিয়াও না। তার না হয় দাড়িতে পাক ধরেছে, দড়ির মত শরীরে আর কোন উনিশ বিশ হয় না। আলেফ যাবে না, তার মন রাখা আছে অন্য কারো কুটুরিতে। কিন্তু আর সবাই? ফায়জলের চোখ চকচক করছিল, জনে জনে হদিশ করছিল, কী মিয়া, যাবে নিকি? চলো দেক্কে আসি ক্যামন এই বন্দর। বসিরুদ্দিনেরও যাওয়ার সাধ হয়েছিল। কিন্তু সাহসে কুলায়নি। মনে ভয় যদি জাহাজ ওদের ছেড়ে ভেসে যায়?
মোকসাদ আলি সব খোয়াইসে পানি ঢেলে দিল। রেজগি আছে কত জেবে? তোমার কাচে যা আচে এই দেশের হুরী পরীরা একটা সুতোও ছুঁতে দিচ্চে না মিয়া।
কারোরই আর জমিনে পা দেওয়া হল না।
এরপর উত্তর পশ্চিম দিক বরাবর রওয়ানা দিয়ে জাহাজ পেরিয়ে গেল রেড সি। রেড মানে তো লাল, জানে আলেফ। সমুদ্রের জলে তো লালের ছিটেফোঁটাও দেখল না। মাল্লারা না বললে সে তো ফারাকই করতে পারত না। সুয়েজ ক্যানাল পেরিয়ে দাঁড়িয়েছিল পোর্ট সইদে। দেশটার নাম নাকি ইজিপ্ট। হবেও বা। ততদিনে মে মাসের রোদ পুইয়ে আলেফদের শরীর একেবারে শুকনো বাঁশ। মনে শুধু ডাক, কখন লন্ডন আসবে। দিন যেন কাটতেই চায় না। কিন্তু জাহাজ তো জাহাজের মতলব নিয়ে চলবে। আবার দাঁড়াল নেপলসে। নেপলস থেকে উঠেছিল মেলা লোক। ফিরিঙ্গি সব, কাঠখোট্টা, ষণ্ডা। কাজের খোঁজে চলেছে শেফিল্ড আর ম্যাঞ্চেস্টারে। মোকসাদ চাচা আগেও এই পথে গেছে অনেক। তাদের সবাইকে পই পই করে সাবধান করেছিল, এদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করো না মিয়া, কথায় কথায় ছুরি ছোরা চালিয়ে দেয়। শুনে তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল আলেফরা। লন্ডনের ইস্ট এন্ড ডকল্যান্ডে নোঙর ভেড়ালে তবে নিশ্চিন্তি।
নিশ্চিন্তি মানেও তো সেই ছুট। নেমেই চটজলদি দৌড়েছিল ওরা। এতদিন পরে পায়ের তলায় জমিন পেয়ে আলেফরা একেবারে খুশদিল। ফের জাহাজে উঠতে মন চায় নাকি! শহরটা দেখেও কেমন বুকে তরাস, ঠিক যেন কলকাতার মত হাব ভাব, যমজ ভাই যেমন ধারা।
বসির ভাই বলল, হবে না কেন মিয়া? বেগমসাহিবা একই যকোন, কলকেতারও সমান আদর।
মোকসাদ মিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে উঠল। ওটা হক কথা কইলে না বসির। মহারানির নিয়ত ভাল হলে আমাদের নসিব অ্যামন কেন? পেটের তাগিদে নিজের দেশ গাঁ ফেল্যে মার্কিন মুলুকে চিকনের পেটি মাতায় কইরে ছুটছি কোন ভরকিতে?
মোকসাদ আলি অনেক দেশ ঘুরে ঘাঘু। বৃষ্টিধোয়া মাটির মত মুখে পাখির পায়ের ছাপ। সুর্মাটানা চোখের কোলে, সাদা কালো চুলের আনাচে কানাচে হরেক দেশে দিনযাপনের হিসাব কিতাব। দরিয়া পার করে বেচাকেনার কাজ তো তার আজকের নয়! সব ঘাটের হাল হদিশ জানে। আলেফ ভাবত চাচার বুঝি এমনি দেশে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোটাই মনপসন্দ। হয় না অনেক লোক? যেমন তাদের ফায়জল। এখন দেখল মোকসাদ চাচার মুখ রাগে একদম টসটস। দাড়ি চুমরে বলল, এই যে দেকলে এতো বান্দা নেপলস থেকে জাহাজে চাপল, কোতায় যাচ্চে জানো তো মিয়া? আমাদের পেটের ভাত মেরে ম্যানচেস্টারে কাপড় বুনচে সব, রমরমিয়ে মেশিন চলে ওকেনে। বাদেতে আমাদেরই হাটে নে বেচতে লাগে। বোজো সেটা। আর আমরা কী কচ্চি?
অত কথা বলার সময় নেই, সাদাম্পটনে থেকে জাহাজ ছেড়ে দেবে। কিংবা এই কথা মুখে এসেই মোকসাদ আলির মাথা রাগে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। আর কথা না বাড়িয়ে লম্বা লম্বা পায়ে ট্রেন স্টেশনে ঢুকে গিয়েছিল। পিছন পিছন ওরা বাকি এগারো।
কম দূর নয় সাদাম্পটন, চল্লিশ ক্রোশ। সেখানে এসে চেপেছিল এস এস সেন্ট লুইস জাহাজে। এখানে আর ডেক নয়। জায়গা জুটেছিল স্টিয়ারেজে। ডেকের রোদে যদি আগের দফায় চাঁদি ফেটেছে, স্টিয়ারেজে হাওয়া বাতাস না পেয়ে এবারে দম বন্ধ। ডেকের নিচের লম্বা খোলা জায়গাটা, আলো নেই বললেই চলে। এর মধ্যে তিন থাকে সারি সারি বাংক। ওদের শোবার জায়গা। আলেফের ভাল লাগে না ওই অন্ধকূপে থাকতে, তাই পালিয়ে ডেকে চলে আসে।
তার এই প্রথম দরিয়া পার। মোকসাদ আলি ছাড়াও মুসা মণ্ডল, গরান আলি আগে আগেও ভেসেছে দরিয়ায়। স্টিয়ারেজে আলো নেই বাতাস নেই, তবু কেমন ঘুমাচ্ছে টান দিয়ে। জানেও তো কত হাল হদিশ। তবু ওরাও কি পানির উনিশ বিশ দেখে বুঝতে পারে সমুদ্রের হাল হকিকত? পথের হিসাব?
সে যখন পথে হেঁটে চলে যেতো দূর দূর গ্রামে – সেই চন্দনপুর, আলিপুর, বোরা, দাদপুর, গোপীনাথপুর, মান্দ্রা, সিনহেট, বাবনান – মাথায় কাপড়ের পেটি নিয়ে ঘুরতো। গ্রামের নাম বলে দেওয়া লাগত না। পথের ধুলোর রকমফের, কোথাও আমবাগান, নারকেলকুঞ্জ, তালের সারি এইসব দেখে সে বেবাক বলে দিতে পারত কোন গাঁয়ে ঢুকছে এবার। এই সমুদ্দুরে সেসব কোথায়। পানিই পানি। মাঝে মাঝে কোথাও বড় মাছ ঘাই মারে, হাঙর। তাই দেখে বসিরভাই বলল, এই বার এদের দেশে যেয়ে পড়লুম রে আলেফ। আর গুটিকয় দিন শুধু। কিংবা গরান আলি বলে, এই যে দেখছিস জলের রং কেমন শেওলা পানা হতে নেগেচে, সবুজে নীল। ওই বুঝলি আটলান্টিক ধরল এবার। আর বেশি দূর নেই।
সে বোঝে না। জাহাজে তার ঘুমও হয় না। মাঝরাতে ঘুম না হলে এমনি একা ডেকে ঘুরে বেরায়। আর সবাই ঘুমাচ্ছে। ঘুরনদার ফায়জলও। হয়তো কোন ডেক-জাহাজি পাহারায় আছে। ব্রিজে কখনো থাকে জোসেফ, সে বড় জাহাজি। স্টোক হোল্ডে ফায়ারম্যান। আর ফারনেসে আগুন উসকাচ্ছে কজনা। ওদের মুখগুলো আগুনে ঝলসে উঠলে বোঝা যায় মধ্যরাতে আর কেউ জেগে না থাকলেও, ওরা আছে। আগুনের ঝলকে কখনো হয়তো আক্রাম আলিকে খুঁজে পেয়ে যায়। সিলেটের আক্রাম আলি, জাহাজের মাল্লা হয়ে ঘর ছেড়েছে। আর আছে গোবিন্দ সারেং, তার বাড়িও সিলেটে। কিন্তু সে ঘর ছাড়া আজ কত বছর। গোবিন্দ সারেং আলেফ আর ফায়জলকে জাহাজের কলকব্জা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল একদিন। তার ঘরে এমনি দুটো ছেলে আছে নাকি, আলেফকে বিশেষ করে নেকনজরে দ্যাখে।
এ বাদে সব নিঝুম। এঞ্জিনের শব্দ কেবল উঠে আসে অনর্গল। ডেকের উপর তখন এক মায়াবী জগত। কিনারহীন দরিয়া সাদা জ্যোৎস্নায় ফটফট করে, জল থেকে ঠান্ডা বাতাস উঠে আসে। কম্বল ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে একা একা কাঁপতে থাকে আলেফ। সেই সময় মনে হয় হাত বাড়ালেই আমিনাকে ছুঁতে পারবে।
দাদপুর যাওয়ার পথেই দেখা হয়েছিল আমিনার সঙ্গে। বড় তাতের দিন ছিল সেটা। তিয়াসে গলা যেন বুঁজে আসছিল। একটা অশথ গাছের তলায় মাথার গাঁটরি নাবিয়ে জিরোতে চাইছিল আলেফ। মাথার বোঝা পরিষ্কার শক্ত জমিতে রেখে পা ছড়িয়ে থেবড়ে বসেছিল। গামোছায় গলা, ঘাড়, কপালের ঘাম মুছে ইতিউতি চাইছিল। কোথাও যদি পানি পাওয়া যায়। ঠা ঠা রোদ্দুরে কে আর থাকবে। বেশ অনেকটা দূরে তালগাছের সারি, ওইখানে আছে ফজলু মিয়ার দিঘি। সে বাদে দাদপুর গ্রাম। কিন্তু এই বোঝা মাথায় চাপিয়ে সামনের ধু ধু মাঠ পেরোতে হবে ভাবলেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল আলেফের। মাঠের ধান কাটা শেষ। চড়ুই, পায়রা এদিক ওদিক খুঁটে খুঁটে পড়ে থাকা ধানের ছড়া টুকরাচ্ছে। দূরে একটা গরুর গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে যেতে দেখল। ধানে বোঝাই, মড়াইতে নিয়ে যাচ্ছে। না হলে গিয়ে চেপে বসতো ঠিক। আর কোথাও কেউ ছিল না, শুধু দুপুরের ক্লান্ত হাওয়ায় মাঝে মাঝে ধুলোর ঝড় উঠছে।
কলসি কাঁখে আসছিল আমিনা। আলেফকে দেখে সে মেয়ে একটা আকন্দ গাছের ঝাড়ির পিছনে থমকে দাঁড়িয়েছিল। দূরত্ব বেশি নয়। দুপুরের গরম হাওয়ায় ওর তেতে যাওয়া মুখ ঘিরে চুল উড়ছিল। নতুন পাকের পাটালিরঙা শরীরে বানভাসির টান। নাকের উপর ঘামের ফোঁটা নাকছাবির মত চকচক করছে। চোখে ভাঙা কাচের ঝিকিমিকি তুলে বলল সে মেয়ে, কী মিয়া দাদপুরে চলেচো কি আজ?
গলা এমনিতেই শুকিয়ে কাঠ। এই মেয়েকে দেখে আলেফের ঠোঁট নড়লেও কথা ফুটল না। মুখ দিয়ে কেমন একটা চকচক আওয়াজ বেরিয়েছিল সেদিন।
মেয়ে হেসে উঠলে শরীরে ঢেউ ওঠে, কলসি থেকে জল উপচে বুক ভিজিয়ে দেয়। মেয়ে সচকিত হয়ে আ মরণ বলে জিভ কাটে। ভেজা শাড়িতে ভেসে ওঠা বুকের ভাঁজ লুকানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই বলে লজ্জায় চুপ যাবে এমন মেয়ে আমিনা তো নয়। সেটা ভেবেও আলেফের গলায় এখন বুগবুগে হাসি উঠে এলো। যখন আলেফের হাত টেনে নিজের বুকের মধ্যে ধরে থেকে বলতো, কার জন্যে ধকধক করে বোজো তো মিয়া? আলেফ উল্টে বলতো, তোর লাজ শরম নেই আমিনা? আমি তোর পরপুরুষ না?
কেন আমায় নিকা কবুল করবে না মিয়া? সরল বিশ্বাসে আরও জোরে আলেফের হাত বুকের ওমে নিয়ে নিতো আমিনা।
সে না হয় পরের কথা। কিন্তু ভর দুপুরে ওই দাদপুরের মাঠে যখন আমিনা তাকে সওয়াল জবাব করছিল, সে তো তখন সত্যিই এক পর পুরুষ। মেয়ের চোখের ঝিলিক তাতে কমলো কই, হাসিও ছিল রসে টইটম্বুর।
বাক্যি হরি গেল যে! বেচবে এসব? না সওদা করে ফিরচো?
আলেফের নবীন গোঁফ তিরতির করে কাঁপছিল। শুকনো ঠোঁট জিভে ভিজিয়ে বলেছিল, বেচার লোক পেলে বেচি, কেনার সামগ্রী পেলে কিনেও নি। কিন্তু পানি না পেলে অত কতা কই কেমন করে।
তুমি তো মিয়া ঘাঘু বেপারি। আবার আমাকে ঘাটে দৌড় করাবে। বলল, কিন্তু দু পা এগিয়ে আলেফের বাড়ানো অঞ্জলিতে জল ঢেলেও দিল।
এবার দেকাও দিনি ক্যামন তোমার সামগ্রী।
কিনবে নাকি?
পয়সা কোতায় আমার।
কেন নতুন ধান উটেচে না?
সে তুমি যাও গোলাম শেখের বাড়ি, হদু সীয়ের দালানে, ওদের সম্বৎসরের ধান উঠে গ্যাচে। আমাদের ধান কই। আমরা হলাম তাঁতির ঘর। আমি চিকনসুতোর কাজ করি। পেটে কিল দিয়ে বসে আচি।
দাও কারে?
আসতো এক তারেক মিয়া। ইদানি আর দেকি না। আব্বা হাটে নে যায় বেচতে। আমি ঘরে বসে সুতোর কাজ করি। তাই তো দেখচি, কেমন তোমার সামগ। তুমি নিতে চাইলে আমার বোনা চাদর কটা তোমায় দেব খন।
সেই খোলা মাঠেই আলেফ মেলে ধরেছিল তার পসরা। আমিনা ততক্ষণে সামনে এসে উবু হয়ে বসেছিল। পায়ের বুড়ো আঙুলে শুকনো ঘাসের আঁটি ঠেলতে ঠেলতে বলেছিল, এই মাল নিয়ে বেচো কোতায়? হুগলির হাটে?
ওদিকে আর বেশি বিক্কিরি হয়না কো। বিলেত থেকে মিলের কাপড় আসচে জানো না।
মুখ কালো হয় মেয়েটার। পেটের টানে সব জানতে হয় গো মিয়া। আজকাল আর বিক্কিরি কোথায়? সবাই ওই মিলের কাপড় কিনচে। আব্বা বলল কোন নাকি মানচাস্তি দেশ থেকে কাপড় আসচে সব। সস্তা পেয়ে তাই কিনচে গেরামের লোক। আব্বার কাপড়ের বোঝা যেমন কে তেমন পইড়ে থাকে, মাগ্যি বলে কেউ ঘুরেও দেকে না।
আমিও আর ওই হাটে বেচতে যাই না কো।
তাহলে বেচো কোতায়?
অতসব জানত না কি তখন আলেফ?
তার দৌড় ছিল খিদিরপুরের জাহাজঘাটা অবধি। একটা বড় বাক্স ভরে গেলেই একদিন নৌকায় করে হুগলি নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাও কলিঙ্গা বাজার। খিদিরপুর। কলিন লেন, টার লেনে জাহাজে মাল চড়ানোর জন্য বসে আছে চিকনদারি কাজের ব্যবসাদার। মাল পাঠাবে নিউ অরলিন, চার্লেস্তান, সাভানা আর কীসব খটমটো নামের সব জায়গায়। আলেফ সেসব হদিশ জানত না তখন। কে বিক্রি করে কাকে তাও না। আলেফের চাচা মোকসাদ আলি আগে এই কাজ করত, তারপরে চলে গেল ওই দেশে। তার কাছেই শুনেছে সে নাকি বসেছে এখন নিউ ইয়র্কের ডকে। মাল পৌঁছালে চলে যায় তার কাছে কি তার মত আরও সব লোকজন যে যেখানে আছে। চাচা যে এরপর তাকেও সঙ্গে নিতে চাইবে তখনো খবর ছিল না আলেফের।
লাল মাড়ি বের করে হেসেছিল এবার আলেফ। আজব কাণ্ড না। এধারে বিলেত থেকে আমাদের লেগে মাল আসচে, ওধারে আমাদের মাল আবার বিলেতে যাচ্চে।
আমরা কাচ থেকে নেবে মিয়া? তোমার যা দেকলাম, তার চেইতে আমার কাজ অনেক সরেস।
সেই যে আমিনার কাছে থেকে চিকনদারি রুমাল, চাদর নেওয়া শুরু হল, কেমন করে একদিন আমিনাকেও নিয়ে নিয়েছিল আলেফ।
আমারে ভুলে যাবে না তো মিয়া? আসার দিন ছলছল চোখে তাকিয়েছিল আমিনা।
আল্লার কসম। কেমন করে ভুলবো তোরে আমিনা। আর কদিন গেলেই তো কলমা পোত্তাম তোর সঙ্গে।
তাহলে যাচ্চো কেন?
চাচা ডাকল যে। মোকসাদ চাচা এসেছে এতদিন বাদে। অনেক মাল নিয়ে ফিরবে এবার, সঙ্গে লোক চাই জনা দশেক। আমাকে যেতে বলল তাই। বাইরের লোকরে তো বলতে পারে না। আব্বাও জবরদস্তি করল। এই দেশে আর আমাদের কাজ কেউ পোঁছে না রে আমিনা, বিক্কিরিবাটা কোতায়? ওই দেশে নিকি খুব কদর, যা নে যায় হু হু করে বিক্কিরি।
তারপর তোমার চাচার সনঝে ওখেনেই ঠাই গাড়বে, না মিয়া? পলক না ফেলে মেঘলা চোখে চেয়ে ছিল আমিনা।
আল্লার কসম। ওদের দেশে এখন গরমের কাল, সমুদ্দুরে সিনান করতে আসে যত লোক, মেলা জুটে যায় এক্কেরে। খুব বেচা কেনা হয়, চাচা সামলাতে পারে না। তাই লোক লাগে। আবার যখন জারের সময়, চলে আসব আমরা।
তোমার চাচা তো আসেনি।
সবাই এইয়ে পড়লে ওখেনে ঘুরে ঘুরে বিক্কিরি করবে কে?
তুমিও তাইলে ঠাঁই গাড়বে। ওখেনে ঘুরে ঘুরে বেচবে। লেচ্চয় জানি ওই দেশের কোন হুরীপরীকে বে করবে। মুখ ভেঙিয়েছিল আমিনা। আসলে কাঁদছিলও।
এরপর আলেফের বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিল আমিনা। আমিনার রেশমি চাদরের মত পিঠে হাত বুলিয়েছিল আলেফ। আর কীই বা করতে পারতো? ফিসফিস করে বলেছিল, আমার আমিনাকে ছেইড়ে আমি যাবো কোন্দে? শীতের ধান ঘরে ঢোকার আগ দেই আলেফ মিয়া আমিনার কু্ঁড়েতে এইসে হাজিরা দিবে।
হক কথা কইচো?
তিন সত্যি।
পীরবাবার কিরা।
দরিয়ার ঠান্ডা বাতাস এসে আলেফের চোখে ঝাপটা মারছিল। তাদের জাহাজ বন্দরে ঢোকার দিন এসে গেল, আর নাকি একদিন। কিন্তু সে থাকবে না এখানে। চাচার মাল যেদিন ফুরাবে সেইদিনই ফিরতি জাহাজে দেশে। একেবারে নিশ্চিত আলেফ। আব্বার হাতে টাকা ধরিয়ে আমিনাকে নিকা করবে।
রাত্রি এখনো গভীর। কিন্তু লাল আলোয় আকাশের নিকষ কালো ভাবটা কেটে যাচ্ছিল। সকাল হতে তো এখনো অনেক দেরি। তাহলে? পশ্চিমের দেশে কি রাত থাকতেই সূর্য উঠে যায়?
ডগ ওয়াচ থেকে এইসময় হেঁকে উঠল কোন এক লস্কর। হুই দিকে আগুন লেগেছে গো? একেবারে লালে লাল হয়ে যাচ্ছে।
তার পরেই ক্যাপ্টেনের হাঁকডাক শোনা গেল, জাহাজের মুখ ঘোরাও। এলিস আইল্যান্ডে আগুন লেগেছে। আমাদের পিছনে সরতে হবে।
নতুন উপন্যাস। দ্বীপরাষ্ট্রের গড়ে ওঠা নিয়ে এই উপন্যাস। আরম্ভেই কৌতুহল জাগিয়েছেন। আমি এই পাণ্ডুলিপির কিছুটা আগে পড়েছি। আশাবাদী।
খুব ভালো লাগলো। অজানা ইতিহাস অবলম্বনে রচিত হবে উপন্যাস তাই অনেকটা কৌতূহল তৈরী হল।
এইটে ভারী ইন্টারেস্টিং তো
উপন্যাস এর প্রারম্ভ তার ব্যপ্তির আভাষ দিয়েছে। প্রতি পর্বে এর ব্যপকতা কি রূপরেখায় উপস্থিত হবে তার কৌতুহল পাঠকের মধ্যে ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেছে।
অন্যরকম; কিন্তু লেখা বেশ সেন্টিমেন্টাল লাগল। গঠনগত দিক দিয়ে একটা উপন্যাসের কাহিনী যেরকম শক্তপোক্তভাবে শুরু হয়, সেটা পেলাম না।
খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।