নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
গোলাপায়রার ডানার রঙের মত আকাশ। আজ আর রোদ উঠবে মনে হয় না। রোজকার মত বেরিয়েছিল আলেফরা। বোঁচকা নিয়ে যে যার পথে। হেঁটে বা সাইকেলে। আলেফ আজ স্টোরিভিল ধরে স্টেশনচত্বর অবধি যাবে।
রাতে একদফা বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু আকাশের দিকে নাক উঁচিয়েও মাটি ভেজার গন্ধ পায় না এখানে। স্টোরিভিলের পথে শুধু তামাক, ফুল আর খারা পানির মাছের বাস, এই সকালেও। জলো বাতাস ভারি চাদরের মত ঝুলছে, গোঁতা মারলে ছ্যাঁদা করা যায়। সারারাতের হইহল্লার পরে চারদিক নিস্তেজ, তার দিন শুরু হলেও এই তল্লাটের অনেকের জন্য এখনো ভোর হয়নি। মেবেল ক্রাঞ্জ প্লেসের সিঁড়ি ভেঙে একটা মোটাসোটা লোক পাতলুনের বোতাম লাগাতে লাগাতে হনহন করে নেমে এল, ওর রাতের জলসা বুঝি এই ফুরাল।
রাস্তার ধারে একদল ছেলেপুলে – ইতালিয়ান ফুলওয়ালিদের বাচ্চা বলে চিনতে অসুবিধা হয় না – কাঠের আগুনে হাত সেঁকছে। মায়েরা সার সার ঠেলা বসিয়ে ফুল সাজাচ্ছে। এখানে সকাল থেকে লাইন লাগানোর খদ্দেরও তো আছে।
এক নিগ্রো হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে আসছে উল্টোদিক থেকে। দু’খানা মাছ ঝুলিয়ে ফিরছে, পালমেটো পাতার দড়ি পাকিয়ে মাছের মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে জোড়া বেঁধে ঝুলিয়েছে দুই আঙুলের ফাঁকে। আর এক নিগ্রো, তার সাথীই হবে, একটা চাকা লাগানো কাঠের বাক্স টেনে আনছে। ঢাকাহীন বাক্সে কাঁকড়াদের কিলবিল, দাঁড়াগুলো জোরদার আন্দোলন করছে জীবনের প্রমাণস্বরূপ। পিছনের লোকটা ডাক পাড়ল, ‘Bill, we be wet as these fellas ’fore the day be out.’
সেটা নিয়ে আলেফেরও চিন্তা আছে। তার বোঁচকায় জলের ছাঁট লাগতে দেওয়া যাবে না, ভিজে গেলে চিকনের জিনিশগুলোকে তরিবতে ফেরাতে অনেক হ্যাপা। ভাবনাটা মাথায় রেখে র্যাম্পার্ট স্ট্রিটে মোড় নিল আলেফ। আরও দুই রাতপাখি নড়বড় করতে করতে এসে আর একটু হলেই আলেফের সঙ্গে ধাক্কা লাগাচ্ছিল। তাদের চোখ ঘষা কাঁচের মত, রাতের খোঁয়ারি কাটেনি। এই রাস্তায় সার দেওয়া মাঝারি আকারের বাড়িগুলো একেকটা ছোট ছোট আখড়া। একজন মাসি আর দুই তিনটে মেয়েকে নিয়ে ব্যবসা চলে এইসব বাড়িতে। এদের অনেকেই তার কাছ থেকে চিকনের সওদা করেছে। যদিও প্রতিটা বাড়িতে ভিন্ন দেশের মেয়ে, চিকনের কদর সব জায়গায়। লুলু হোয়াইটের ম্যানসনে তার কাজের আদর হওয়ার খবরটা আলেফ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। তারই ফল। ওদের ঘরে ঢুকেছে আলেফ। বাসি খাবার, গড়িয়ে পড়া এঁটো মদের গ্লাস, পোড়া তামাকের গন্ধওলা ঘরের কতটা শ্রীবৃদ্ধি তার চিকনের কাজ দিয়ে হয়, সেটা আলেফ বোঝে না।
আর একটু এগোলেই কাস্টম হাউজ স্ট্রিট, এইখানে বাড়িগুলো একটু প্রশস্ত। জড়ানো গলায় এই সকালেও কে যেন গান গেয়ে খরিদ্দারের মনোরঞ্জন করছে। এইখানে এখনো তেমন বিক্রি হয়নি আলেফের। সেটা মাথায় রেখে ধীরগতিতে প্যাডেল করছিল, কিন্তু কোনো ডাক পেল না। কারো চোখে পড়লে ডাকত। বিছানায় উপুড় হয়ে খোঁয়ারি কাটাচ্ছে নির্ঘাত। সামনে এগোতেই বেসিন স্ট্রিট। মিনি হোয়াইটের আস্তানায় বাতি জ্বলছে এখনো। এখানে সারা রাত অশ্লীল গানের ফোয়ারা আর বেলেল্লাপনা সেরে বাড়ি ফিরতে না পারা খদ্দেররা সারি দেওয়া খাটে ঘুমটুকু সেরে নিচ্ছে। আলো জ্বলা বা নেভার রেয়াত করার মত অবস্থায় কেউই নেই।
আরও দু’বাড়ি বাদে যেতেই কুইন মলি কিউয়ের দরজা খুলে গেল, দুই সদ্য যুবা বেরিয়ে এল। মলি, মায়ের যত্নে একজনের মাথা থেকে খসে পড়া টুপি পরিয়ে দিল, আরেকটির জামার কলার সিধে করল। মলি পোড় খাওয়া বেশ্যা, এরকম দু’চারটে বাচ্চাকে একসঙ্গে বিছানায় সামলায়। বয়েস বাড়ছে, তাই ঘাঘু মালেদের কাছে তার কদর কমতির দিকে। আলেফের দিকে চেয়ে হাসল মলি, নতুন নতুন জিনিস এসেছে নাকি আ-লেফ?
থাকলেও আলেফ হ্যাঁ বলত না। একবার বেচতে এসে জিনিস পছন্দ করে মলি ডলার না দিয়ে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেই যাত্রা পালিয়েছিল আলেফ। মলি মুচকি হেসে বলল, নতুন কিছু থাকলে দেখাতে এনো একদিন, আমার এখানেও নতুন মেয়ে আছে। বলেই হাসিটা আরও ছড়িয়ে দিয়ে চোখ টিপল। কথা না বাড়িয়ে কান লাল করে আলেফ হাঁটা দিল।
এ আলেফ!
স্কুইরেল। ছেলেটা পথের ধারে বসে হারমনিকা বাজাচ্ছিল। কী বা বয়েস হবে ওর? হয়তো বারো, আবার পনেরো-ষোলোও হতে পারে। চেহারার বাড়বাড়ন্ত হয়নি তেমন। কথায় সেটা পুষিয়ে দেয়, সেটা জানা আলেফের। সারাদিন বাইরেই তো থাকে, শরীরের রং পুড়ে গাঢ় তামাটে। নাক, চোখ বোদা বোদা, পাতলা ঠোঁট। ঘন বাদামী চুলগুলো খাড়া খাড়া। কোথা থেকে এসে জুটেছে, কে ওর বাপ মা কেউ জানে না। জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, এই রাস্তাতেই জন্মেছিল নাকি। বোঝো কাণ্ড! কখন কোথায় ঘুমায় আলেফের জানা নেই। ছেলেটা দিনভর প্রতিটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে কার কী জিনিস এনে দিতে হবে জেনে দোকানে দৌড়ায়। এমন সুরুৎ সুরুৎ করে যায় বলেই নাম হয়ে গেছে স্কুইরেল। আসল নাম কী জানতে চাইলে, মাথা চুলকায়। কেন, এই নামটা খারাপ কিসে?
সন্ধ্যা হলে আবার স্কুইরেলকে পাওয়া যায় গলির মুখে। হাতে হরেক মেয়েদের ছবিওয়ালা কার্ড। কারো পছন্দ হলে, সেই মেয়ের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বখশিশ পায় দু’তরফে। এইটুকু পুঁচকে ছেলে, কিন্তু কথাবার্তায় বয়েসকে পিছনে ফেলে এসেছে বহুদিন। মেয়ে শরীরের দালালিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছে। খারাপ লাগে না? একবার জিজ্ঞেস করেছিল আলেফ। অসমান দাঁতগুলো মেলে বলেছিল, পয়সা জমিয়ে একটা ব্যান্ড বানাব, জ্যাজ ব্যান্ড। টাকা ছাড়া হবে? কম বয়সেই জীবনের হাল হকিকত বুঝে গেছে।
প্রেটি অক্টারুন তোমার খোঁজ করছিল।
কেন? বলেই মনে হল, নিশ্চয় চিকনের কাজ কিনবে। আর না হলে তাকে ডাকবে কেন? বেসিন স্ট্রিটের মুখে প্রেটি অক্টারুনের মহল। আসল নাম নাকি কেটি, স্টোরিভিলে এসে নাম নিয়েছে প্রেটি। দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর। একবার বেচতে গেছিল। দেখে শরীরটা কেমন ঝমঝম করে উঠেছিল আলেফের। স্কুইরেল ফিচেল হেসে হাত দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি দেখাল। আলেফের ইচ্ছা হল ধাঁ করে এক ঘা বসিয়ে দেয়। রাগে কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল আলেফের, কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
আর্রে আলেফ, কী হল? প্রেটি অক্টারুনের সঙ্গে দেখা করে যাও। তোমার কাছ থেকে কিনবে কিছু। এখানেও কিছু দাঁও মারার চেষ্টা স্কুইরেলের, যা বিক্রি হবে তার থেকে হিস্যা নেবে। আলেফ ভাবল, যাব পরে। এই ছেলেটাকে দালালির পয়সা কেন দেব? সাইকেলের গতি বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
ওইটুকু ছেলে, মুখ দিয়ে গালাগালির বন্যা ছুটিয়ে দিল। নিজের দেশ হলে এমন একটা ছেলেকে দু’টুকরো করে দিত, এখানে মুখ গুঁজে সরে যেতে হয়। পরের দেশে অশান্তি করে পুলিশের হাতে গেলে আর ছাড়ান নেই, সোজা চালান করে দেবে।
আলেফের হাতে সময়ও বেশি নেই। ইলিনয় সেন্ট্রাল রেলরোডের শিকাগো থেকে আসা ট্রেন পৌঁছাতে আধ ঘণ্টাটাক আছে। দিনে কেবল একটাই ট্রেন। এসে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আবার শিকাগোর পথে রওয়ানা দেবে। এই মাঝখানের সময়টা আলেফের বিক্রিবাটার। শিকাগোর দিকে ট্রেন রওয়ানা দিলে, সব গুটিয়ে চলে যাবে ক্যানাল স্ট্রিটের লুইভিল আর ন্যাশভিল রেলরোড স্টেশানে। ওখানে টেনেসি থেকে লোক এসে পড়বে বিকেল নাগাদ, আসা-যাওয়ার মাঝে বিক্রি মন্দ হয় না।
ট্রেন আসবে এই অপেক্ষায় ঘোড়ার গাড়ির লম্বা লাইন। এক লাইনে সব ঘোড়ায় টানা বাগি, যাত্রী নেওয়ার জন্য। অন্য সারিতে কাঠের ওয়াগন, এক ঘোড়ায় টানা। ছোট ব্যবসায়ীরা ওগুলোতে মাল তুলে শহরের দোকানে বিলি করে।
আলেফের মত স্টেশনচত্বরে সওদা নিয়ে আসা ব্যাপারিও আছে কিছু। ফরাসী, স্পেনীয়, চিনা আর ইতালির লোক। নিগ্রোও আছে। পশরা সাজিয়ে বসে গেছে, নিজের নিজের বাঁধাধরা জায়গায়। এতদিনে আলেফেরও একটা ঠাঁই হয়েছে। যদিও রোজ আলেফ এখানে আসে না, কোনোদিন এস্রাক, কখনো বসির। শুরুতে সহজ হয়নি, কেউই চায় না ব্যাপারি বাড়ুক। সময়ে সয়ে গেছে, তাছাড়া আজকাল রেলযাত্রী বাড়ছে দিন দিন, সবার পণ্যের চাহিদাই বাড়তির দিকে। নিউ অরলিন্সের সুনাম ছড়াচ্ছে ফুর্তি লোটার আখড়া হিসাবে। মারদি গ্রাঁর সময়ে তো মাল নিয়ে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। খ্যাতির একটা কারণ স্টোরিভিল। সেখানে গোটা বছর জুড়ে ভিড়। সারা দেশের একমাত্র বৈধ বেশ্যালয়। জাঁকজমক বেড়েই চলেছে, দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের আনাগোনায় লোকও। বিকেলের যে ট্রেনটা ন্যাশভিল থেকে এসে পৌঁছায়, তার অর্ধেক লোক হাঁটা দেয় স্টোরিভিলের পথে। শুধু এই ধান্দাতেই লোকগুলো নিউ অরলিন্সে ঢুঁ মারে কিনা, সেটা আলেফের জানা নেই।
আলেফের পশরা রাখার জায়গাখানা লিউ হাওয়ের পাশে। আগে লোকটা তাকে দেখলেই বেজায় চটে থাকত, সরু চোখদুটো খুঁজে পাওয়া যেত না। আজকাল অতটা নয়। হাবভাবে যেটুকু আন্দাজ পায়, ওর মুখ থেকে খসা কথা বুঝতে আলেফের অসুবিধা হয় খুব। সুবিধার মধ্যে লিউ নিজেও ইংরাজিতে সড়গড় নয় বলে, হাত পা নেড়ে যা বলতে পারে তাতেই কাজ চালিয়ে নেয়।
এখন আলেফকে দেখে একমুখ হাসল। অর্থাৎ তার মেজাজ প্রসন্ন। লিউয়ের বউ লিং পশরা সাজাচ্ছে, বড় বড় ড্রাগনের মুখোশ ঝুলিয়ে দিচ্ছে দড়ি দিয়ে। লিউ আর লিং যখন কথা বলে, নিজেদের মধ্যে খুবই কথা চলে সারাদিন, আলেফ তার কিছুই বোঝে না। ভাষা চীনা, বলেও ঝড়ের বেগে। মাঝে মাঝে কথা খুব উচূ পর্দায় উঠে যায়, তখন ওদের ঠোঁটের ফাঁকে হাসি দেখে বোঝে ব্যাপারটা গুরুতর নয়, ভাষাটাই যা ভজকট।
বরং কথা হয় লিওনার্দোর সঙ্গে। লিওনার্দো পিয়ারস নিগ্রো। মুলাটো বলে নিজেকে, অথবা ক্রিওলস অব কালার। আদতে এস্রাকের চেনা লোক এরা। এস্রাক একটি নিগ্রো মেয়েকে বিয়ে করে এখন ট্রেমের বাসিন্দা। অ্যাবিয়েলরাও থাকে ওদিকে। নিউ অরলিন্সের নিগ্রো মহল্লা। এস্রাক তাই হালহদিশ জানে অনেক। এখানে জাতের রকমফেরগুলো ওর কাছে থেকেই যেটুকু বুঝেছে। মুলাটোরা নাকি সমাজে নিগ্রোদের থেকে উঁচুতে, যেমন লিওনার্দো। ওর পরিবার সিভিল ওয়ারের আগেই স্বাধীন ছিল। নিউ অরলিন্সে এমন নিগ্রো আছে অনেক, আগে ফরাসী শাসন থাকার কারণে। ওর বাবাও পড়াশোনা জানত, নিজেদের একটা ছোট বাড়িও। গায়ের কফি রঙে দুধের মিশেল আছে অ্যাবিয়েলের মত, যদিও অ্যাবিয়েলের মাও তুলোর চাষে দাস ছিল। এদের মধ্যে কিছু ফারাক আছে। যারা আগেই স্বাধীন ছিল, পড়াশোনা জানে, তারা সদ্য স্বাধীন হওয়া নিগ্রোদের থেকে একটু উঁচুতে। লিওনার্দো নিজেও পড়াশোনা করে, পাশাপাশি এইসব বেচাকেনা। ওর ঠেলাতে নিগ্রো আর এখানকার আদিবাসীদের বানানো জিনিস বোঝাই।
আজ ছেলেটা খুব তিড়িং বিড়িং করছে। রাগে দাপাচ্ছে বল্গা ছাড়া ঘোড়ার মত। আর এক নিগ্রো সামনে দাঁড়িয়েছিল, হাট্টা কাট্টা চেহারা। বয়সে ওর থেকে বেশ বড়। চাপা গলায় কথা বলতে চাইলেও, দু’জনের কথা ক্ষণেক্ষণেই বাতাসে দাগ বসাচ্ছিল। এখনো ট্রেন আসেনি, খদ্দের নেই। আলেফ কান পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বুঝতে পারল না তেমন, শুধু জানতে পারল – নতুন কোনো নিয়ম জারি হয়েছে নিগ্রোদের আলাদা করে দেওয়ার জন্য। একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে দেখবে, কিন্তু ততক্ষণে লোকজন বেরোতে শুরু করেছে, নিজের ব্যবসায় মন দিল আলেফ। লোকজন গেলে না হয় ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করবে।
ব্যবসা রোজকার মতই হল, চিকনের কাজের খদ্দের কিছু কম নেই। লিউয়ের পশরায় অত ভিড় নেই, যত আলেফের কাছে। ব্যাটা চিনা ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে হয়তো। চারিদিকে এত রকমের কথা আর ভাষার খই ফোটে, এসব ঠাহর করার সময় থাকে না। এর মধ্যে আবার সেই লোকটা এসেছিল, দাভে দ্য রাজা। আজকেও যাওয়ার পথে এসে দাঁড়াল, দু’হাত জড়ো করে বলল, নমস্তে। একটা বসার আসন কিনে নিয়ে গেল। আলেফ তো জানে ও নিগ্রো, হিন্দু সেজে ঘোরে। সেদিন এত কথা হল, আজ কিন্তু বেশি কথা বলেনি। লিওনার্দোকে যেন দেখতেও পেল না।
এখানকার ব্যাপার-স্যাপার এখনো সড়গড় হয়নি আলেফ। মাঝে মাঝে বুঝতে না পেরে ভয় লাগে কেমন। এই তো কয়েক মাস আগে কোন এক দরিয়ায় আমেরিকার মেইন নামে এক জাহাজ জ্বলে গেল। কোথায় সে জাহাজ, কোন দরিয়ায় কে জানে। যুদ্ধ লাগল আমেরিকা আর স্পেনের জাহাজে, সে কী হট্টগোল এখানে। আলেফ তার অত কী জানত, রোজকার মত পশরা সাজিয়ে বসেছে। তার থেকে দুটো বাদ দিয়ে বসে হোসে। সেদিন ওই লোকটাকে নিয়ে কী ভীষণ মারাকাট। ওরই পাশের দোকানের লোকটা, আল্ড্রিজ না কি একটা খটোমটো নাম, হোসের টুঁটি চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিল। সবাই মিলে না আটকালে গুলিগোলা চলে যেতে পারত। এরপর প্রায় দুই মাস হোসে আসেনি, তার জাতের এরকম অনেক লোক ক’দিন গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছিল। যুদ্ধ হচ্ছে কোন দরিয়ায়, এখানে তার আগুনের ফুলকি। মুশকিল হচ্ছে আলেফের মত লোকগুলোর। আছে একটা অন্য দেশে, হাওয়া কখন কোন দিকে চলে, তার খোঁজ না থাকলে কোথায় কখন ফেঁসে যাবে তার ঠিক নেই। এই যদি মহারানীর ফৌজের সঙ্গে এই দেশের কোনদিন লেগে যায়, তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়ার লোককে ধরেও পেটাবে ওরা? অন্যের দেশে থাকলে অমন কত ভয় মাথায় নিয়ে চলতে হয়।
লিওনার্দো আর ওই লোকটার কথা তেমন সুবিধার ঠেকেনি আলেফের। নিগ্রোদের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে, অ্যাবিয়েলের কাছে ভাল করে জেনে নিতে হবে। মনের মধ্যে এই খচখচি নিয়েই সেদিন ঘরে ফিরেছিল আলেফ। ধীরে ধীরে চারদিকের সওদা সেরে এক এক করে হাজির হচ্ছিল সবাই। আলেফ ভাত চড়িয়ে দিয়েছিল ছ’জনার। মুসা ভাই, জয়নাল, বসির, ইদ্দিস। সোফুর আর বাহাদুর চলে গেছে আটলান্টায়, ওখানেও আজকাল বেশ বিক্রিবাটা। এস্রাক ওদের সঙ্গে না থাকলেও বেশিরভাগ দিন রাতের খাবার খেয়ে নেয় এখানেই, ভাত-মাছ। জয়নাল এক ধামা চিংড়ি নিয়ে এসেছিল। আর এখানকার লাল আলু। আলেফ আর বসির চিংড়ির খোলা ছাড়াতে বসে গেল।
এখেনে কী কোনো তোড়জোড় হচ্চে বসির ভাই?
কীসের?
নিগ্রোদের সনঝে কোনো হ্যাপা হচ্চে বলে শুনলে কিচু?
শুনলুম না তো, দেকলুম। পথের ধারে ফোয়ারা থিকে পানি নিচ্চিল এক নিগ্রো, তাকে ধাক্কা মেরে সইরে দিয়েচে, কী হাঙ্গাম! কে জানে কী করেচিল লোকটা।
তা আমাদের কী এল গেল? হুজ্জোত হাঙ্গাম এমন হরদম হচ্চে। আলু কুটতে কুটতে মুখ তুলল জয়নাল। কথায় জোর ছিল না তত, যতটা বিশ্বাস করার তাগিদ।
এস্রাক এসে অবশ্য উল্টো সুর দিল। আমাদেরও একটু সমঝে চলতে হবে, সেটা মগজে রেকো। আমরা কোনো সাদা মানুষ নইকো।
এস্রাক থাকে ট্রেমে, বউ নিগ্রো। নিগ্রোদের সঙ্গে অনেক ওঠাবসা থাকে। সেই কারণে মুসা ভাইও মন দিয়ে শোনে ওর কথা।
ব্যাপারটা কী একটু বিশদ করে কও দিকিন এরশাক, হচ্ছেটা কী আবার?
দেকো, সিবিল ওয়ার হইচিল এখেনে, তারপর যতেক নিগ্রো ছিল সবাইকে বেবাক আজাদ করে দিল। দিল তো? কিন্তু সাদাদের সেটা কদ্দিন সইবে বল দিকিন? সব তো ফিরিঙ্গিদেরই জাতভাই। যা দেছেল, সব কুটুকুটু করে ফেরত নিতে চায়।
সেটা কীরকম? ফের জুতে দেবে ওদের?
না, তা নয়, কিন্তু নতুন আইন করেছে সরকার, অনেক নিগ্রোদের ভোট থাকবে নাকো।
ভোট? সেইটা কি এস্রাক ভাই? প্রশ্নটা জয়নাল করল, কিন্তু শব্দটা অজানা তাদের সবার।
এই দেশের লোক তা আমাদের মতুন নয়কো, এরা নিজেদের পছন্দমত সরকার বানায়, তাকেই বলে ভোট। মাথা চুলকিয়ে এটুকুই বলতে পারে এস্রাক। যা বলেছিল তার বউ-বেরাদর। নিগ্রোদের আর পছন্দ করতে দেবে না, যা করবে সাদারা।
তাতে আমাদের কী নোকসান হল? একটু খোলা গলায় হাসল মুসা, আমাদের তো আর ওইসবের বালাই নেই।
মাথা নাড়ল এস্রাক। না মুসা ভাই, আছে। শুধু তো ভোট নয়। এই ধর এক গাড়িতে নিগ্রোরা যেতে পারবে না, এমনকি নিউ অরলিনেও। দোকান আলাদা, ইস্কুল আলাদা, ধর না কেন পথের ধারে পানি ধরার জায়গাও ভেন্ন।
তাই দেকেচি আজ, বসির নড়েচড়ে বসল। একটা নিগ্রোকে পানির ফোয়ারা থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দিল।
তবেই দেকেচো, শুরু হয়ে গেচে। এই নিয়ে মারপিট হবে খুব, গুলিগোলা ছোটাও বিচিত্তির নয়।
এস্রাক ভাই, আমাদের কী হবে? এই ভাবনাটা মাথায় খেলছিল আলেফের। তারা তো নিগ্রো নয়, ওরা কী সাদাদের পানি ছুঁতে পারে?
এস্রাক নিজেও জানে না। তবে তার বউ নিগ্রো, তাকে তো মেপেজুকে থাকতেই হবে। বুজলে মিয়া, যেখানেই যাবে আশেপাশে নজর জারি রাকো।
যকন নিগ্রো এলাকায়, তখন ওই রকম থাক। আবার অন্য এলাকায় গেলে পর, এমনভাবে থাকো যাতে তোমাকে কেউ নিগ্রো বলে সন্দ না করে। ইব্রাহিম মুসা নিদান দিল, অন্যের দেশে বাঁচতে হলে গিরগিটি হয়ে থাক।
সেটা কেমন করে করব চাচা?
আলেফের মনে পড়ে দাভে দ্য রাজার কথা। ও তো নিগ্রো, বেশ কেমন হিন্দু ফকির সেজে সাদাদের মহল্লায় নাম কিনেছে। মুলাটো বলে ওর রঙটা সাদা-ঘেঁষা, অন্তত মিশমিশে কালো নয়। কিন্তু অমন পুরু ঠোঁট তো সাদাদের হয় না। সেই জন্যেই নিজেকে হিন্দু বলে চালিয়েছে। ও যদি হিন্দু বলে পার পেয়ে যায়, তাহলে তারা নয় কেন? বলল সবাইকে সেই কথা।
তাইলে অমনটাই কর না কেন? যখন সাদা মহল্লায় ঢুকবে, মাথায় একটা কমলা-রঙা কাপড় ফিরিয়ে নাও। আমাদের কাচে অমন কাপড়ের তো অভাব নেই কোনো।
এস্রাক চিন্তিত মুখে বলল, হ্যাঁ করতে পার এমন। তবে নিগ্রোদের মুখে শুনেছি, ওরা দাভে দ্য রাজাকে তেমন সুবিধার চোখে দেখছে না। ও ব্যাটার কপালে দুষ্ক আছে একদিন।
সে থাকুক, কিন্তু ওরা তো আদতে ইস্ট ইন্ডিয়ান, নিগ্রো নয়। এদেশে কে বোঝে, তারা হিঁদু না মোছলমান। মাথায় কমলা কাপড়ের ফেট্টি লাগালে যদি নিজেদের হিন্দু বলে জাহির করে জানে বাঁচা যায়, মন্দ কী তাতে?