বরবন আর ব্লেনভিল স্ট্রিটের কোণার চৌকো মতন আস্তানাটাই অ্যাবসিন্থ হাউজ। চেহারায় জৌলুশ কম কিন্তু ভিতর থেকে বেশ ছড়ানো। কোন ভুঁইফোড় জায়গা নয়, আশি বছরের উপর হল। আঠেরোশ’ ছয় সনের গ্রীষ্মে যখন টৌলন থেকে ভাগ্য ফেরাতে আসা রেইনাল্ড মদের দোকান খুলে বসেছিল, এই কাঠামোটা সেই তখনকার। আড়ে-বহরে বেড়েছে খানিক। সেটা রেইনাল্ডের ককটেলের গুণে। অ্যাবসিন্থ আর চিনির জল গুলে বানানো গ্রিন মন্সটারের খুব কাটতি। তার জোরেই রেইনাল্ডের ব্যাবসা থিতু হয়েছিল। এখনো নেশুড়েদের টানে এই সবুজ দৈত্য।
তবে কিনা, এই ককটেলই এর নামডাকের একমাত্র কারণ নয়। হাওয়ায় কথা ভাসে, যে মেজর জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, অ্যাবসিন্থ হাউজের দোতলার চোরা কুঠুরিতে বসে জিন লাফিতের সঙ্গে যুদ্ধের শলা পরামর্শ করতেন। সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, যারাই অ্যাবিয়েল কিংবা মারিয়ার সঙ্গে আশনাই করতে এই ঘরের বিছানা দখল করে, মদ কিংবা নারীদেহে যতই মজুক সে লোক, ফ্রেম করে রাখা জেনারেলের ছবিটা চোখ এড়াবে না কিছুতেই। এমনকি, কেউ কেউ দাবী করে, মাঝে মধ্যে ফ্রেম থেকে অ্যান্ড্রু বাবাজি নাকি গোঁফ চুমরিয়ে বেরিয়েও এসেছে আর তাদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে বিছানার দখল নিয়ে নিয়েছে। বেশ কয়েক পাত্তর অ্যাবসিন্থ পেটে পড়লে মানুষ এমন অনেক কিছুই দেখে। কিছু লোক অবশ্য মা মেরির নামে শপথ পর্যন্ত করে ফেলে। দোকানের মালিক হেনরি হ্যাঁও করে না, নাকচও করে না এসব গল্পকথা। তাই এর ডালপালা ছড়িয়েই চলে। তবে নাছোড়বান্দা কেউ যদি চোরকুঠুরি থেকে নেমে শরীর লোটার টাকা ফেরত চায়, তখন হেনরি ফুঁ ফুঁ করে উড়িয়ে দেয়। চার পুরুষের ব্যবসা, লোক চরিয়ে খায়। জানে বজ্জাত লোকের অভাব নেই। মেয়ের শরীরটাও চাখবে, তারপর আবার টাকা ফেরত নেওয়ার ধান্দা। এই নিয়ে বচসাও বেধে যায়, হাতাহাতি অবধি গড়ায়নি এখনো। কারণ ওরকম অবস্থা হওয়ার আগেই মারিয়া নিচে নেমে এসে খপ করে লোকটার দু’পায়ের মাঝখানে খামচে ধরবে। ম্যান, সব তো নিকেশ করে তবে নেবেছো, লতপত করছো একেবারে। মারিয়ার মুঠোতেও ডানা ঝাপাটাচ্ছে না আর। তারপরে আবার টাকাও চাই? কোনো মেয়ের কাছে পৌরুষের এমন অবমাননার পরে মুখ চুন করে না বেরিয়ে সে লোক যাবে কোথায়? সত্যি মেজর জেনারেল ছবি থেকে বেরিয়ে আসে কিনা তার হাতেনাতে প্রমাণ এ যাবত এখনো মেলেনি। কোনো কোনো উৎসাহী লোক মারিয়া কিংবা অ্যাবিয়েলকে জানতে চেয়ে খোঁচায়নি কখনো – তা নয়। মারিয়া চোখ টিপে বলে, আমার শরীরে যা ধক, তাতে মরা মানুষ আর একবার মারিয়ার সঙ্গে শোয়ার জন্য উঠে বসে, ছবি ফুঁড়ে মানুষ নাবিয়ে আনাটা আর কি? অ্যাবিয়েলের সাদা সাপটা কথা – ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। একটা কোয়ার্টার ফেলে আমার সঙ্গে নাচতে চাও, না এই প্রশ্নের উত্তর চাও, সেটা তোমার হাতে ম্যান!
অ্যাবসিন্থ হাউজ ঘিরে এমনি গল্প কথা ঘুরপাক খায়। এতে হেনরির পোয়াবারো। আজকাল বাইরে থেকে অনেক লোক নিউ অরলিন্সে আসে তো। মার্দি গ্রাঁর সময় তো লোক একেবারে ভেঙে পড়ছে ইদানীং। অন্য সময়েও উঠতি বড়লোকদের মধ্যে দেশ ঘুরে দেখার চল আজকাল। একবার এই শহরে এলে, এইসব গল্পকথা তাদের অ্যাবসিন্থ হাউজে টেনে আনবেই। কেকের মাথায় চেরির মত, পাশেই স্টোরিভিল। সিডনি স্টোরি মিউনিসিপ্যালিটির অল্ডারম্যান হওয়ার পরে থেকেই শহরের আনাচে কানাচে দেহ-ব্যবসার যত ঠেক, সব তুলে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সবাইকে ঠেলে পাঠিয়েছে সাদার্ন রেলের ক্যানাল স্ট্রিট টার্মিনালের ঠিক গা ঘেঁষা চত্বরটায়। এই করে করে জায়গাটার নামই এখন স্টোরিভিল, আইনত শহরের একমাত্র গণিকাপল্লী।
চোরাগোপ্তা কাজ চলে না তা নয়, না হলে হেনরির চোর কুঠুরিতে হয়টা কি? তাই স্টোরিভিল এখনো হেনরির ব্যবসার কোন ক্ষতি করে উঠতে পারেনি। বরং সেখানে ঢোকার আগে দুই এক পাত্তর সবুজ দৈত্য পান করে যায় অনেকেই। এতে নাকি জোশ বেড়ে যায়। অ্যাবসিন্থ পেটে পড়ুক, কি মারিয়ার সঙ্গে দুই-এক পাক নাচ হোক, হেনরির মালের কাটতি বেড়েছে বই কমেনি। অ্যাবসিন্থ হাউজ থেকে টলতে টলতে হেঁটে গেলেও কয়েকশ’ গজ দূরের স্টোরিভিলের দিক-ঠিকানা কোনো মাতালেরও ভুল হবার জো নেই।
রেইনাল্ড এখনকার মালিক হেনরির প্রপিতামহ। হেনরি বেশ করিতকর্মা লোক। শুধু চোর কুঠুরির ঠেক নয়, মদের সঙ্গে টেবিল পেতে জুয়ার ব্যবস্থাও করে রেখেছে। ওটার লাইসেন্স থাকলেও, চোরা-কুঠুরিতে যে দেহ ব্যবসার কাজটা চলে, সেটা নিয়ে আজকাল বড্ড হুজ্জত চলছে। কিন্তু ব্যবসা মন্দ নয়। এখনো শুক্রবারের দিনের আলো মরতে ঢের দেরি, পে-ডের কড়কড়ে টাকা পকেটে পুরে লোক এখনো লাইন লাগায়নি। তবু পাঁড়-জুয়াড়িরা অনেক টেবিলের দখল নিয়ে নিয়েছে।
এতরকমের ব্যবসা চলছে পাশাপাশি, জায়গাটা যে তাই বলে খুব সাজানো-গোছানো – এমনটা বলা যায় না মোটেই। বসার জন্য উল্টে রাখা খালি ফলের ক্রেট, ওদিকে টেবিল বলতে বড় জেলে বোটের থেকে সস্তায় পাওয়া চৌকো কাঠের টেবিল। দেওয়াল ধরে কাঠের ক্রেটে সারি সারি মদের বোতল। তবে জায়গা অনেকটা। এমনকি, সপ্তাহ-শেষে সবাই যখন মজুরির টাকা উড়াতে চলে আসে, অনেকেই মারিয়া কিংবা অ্যাবিয়েলের সঙ্গে নাচতে লেগে যায়, তখনো তেমন ভিড় মনে হয় না। চারদিকে সিগারের ধোঁয়ায় ধোয়াক্কার, তেলের ঝাড় লন্ঠনগুলোর হলদে আলোতে ভিতরটা বেশ ঝাপসাই হয়ে যাবে খানিক বাদে।
শুক্রবার বিকেলে জুয়ার বাজি জমে উঠছে। এমন নয় যে লোকগুলোর পকেটে অনেক টাকা। বেশির ভাগই সাপ্তাহিক মজুরিতে বহাল। সব টাকা এখানে খুইয়ে গেলে বউ একেবারে ধুয়ে রেখে দেবে। সুতরাং হারুক কি জিতুক, কেউ এখানে খেলে আচমকা বড়লোক হয়ে যায় না। আবার একেবারে পথেও বসে না। বড়লোকদের নেশাভাঙের জায়গা নিউ অরলিনের অন্য ধারে।
জ্যাকি কোণায় দাঁড়িয়ে কর্নেট বাজাচ্ছিল। চিমড়ে চেহারার লোকটার বুকে দম নেই অত। এমন কিছু ভালও বাজাচ্ছে না, মাঝে মাঝে তো বেশ কর্কশ সুরে ভেঁপু দিচ্ছে। অপরিশীলিত, কোনোমতে কাজ চলে যাওয়ার মত। হেনরি একটা টাকাও ছোঁয়ায় না ওকে। যারা মদ, জুয়া আর বেলেল্লাপনা করতে এসেছে, তারা যা দু’চার পয়সা হাতে ধরায়। তাছাড়া ভাল কি খারাপ বাজায় – সেটা কেই বা টের পাবে? টেবিলে টেবিলে অ্যাবসিন্থ, ছোট ছোট তেলের লম্ফ ঘিরে জুয়ার বাজি উঠছে। বাজনাটার তবু দরকার আছে। বাজনার তালে তালে কোমর নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মারিয়া আর অ্যাবিয়েল। অ্যাবিয়েল মেয়েটা মুলাটো, ঘন বাদামী কফির কাপে গরম দুধ ছড়িয়ে গেলে যেমন রং হয়, তেমনি। পুরুষ্টু বুক এখনো নবীন, তাই একদম মাথা উঁচিয়ে। পরনে একটা প্রায় নেই হয়ে যাওয়া রক্ত লাল স্কার্ট, উপরে না থাকার মত। যদিও বিনুনি করা আঁকাবাঁকা চুলের ঢাল সাপের ফণা তোলার মত বুক আগলাচ্ছে, ওরকম ভরাট বুক ঢাকার জন্য তা যথেষ্ট নয়। ঢাকার কোন চেষ্টাও তেমন নেই। নাচের তালে তালে থরথর করে কাঁপছিল সে দু’টি। আর মারিয়া? যদিও বয়েসটা একটু বেশির দিকে, শরীর টসটসে। সাদা চামড়ায় যেখানে যেখানে উল্কি নেই, মেচেতার ছাপ বয়েস চেনায়। তাই বলে শরীরে তার যাদু কিছু কম নেই। তার ঈষৎ নোয়ানো বুকে কোন ঢাক-চাপ নেই। বাঁ দিকের গোলাপি স্তনবৃন্তে গাঁথা আংটির মাথায় আবার একটা সবুজ পাথর বসানো। তার নেশা নাকি সবুজ দৈত্যের থেকে কোনো অংশে কম নয়। জ্যাকির সুরের তালে তালে শরীর দুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুইজন, চোখে সাদর আমন্ত্রণ, উদ্ধত বুকে বুনো পায়রার ডানা-ঝাপটানি, হাতে একটা করে উল্টানো হ্যাট। যার যখন নাচতে ইচ্ছা করছে, হ্যাটে একটা কোয়ার্টার ফেলে দু’পাক নেচে নিচ্ছে মারিয়া কিংবা অ্যাবিয়েলের সঙ্গে।
পিয়েরের কাছে কোনোদিনই বেশি কিছু টাকা থাকে না। নাচার জন্য তো নয়ই, মদ খাওয়ার জন্যেও রেজগির অভাব। বোতলের সারির সামনে দাঁড়িয়ে তাই বিড়বিড় করছিল, ধুর! টানার মত একটা ভাল কিচ্ছু নেই এখানে! ভাবটা যেন, এই ঠেকে ও আজ প্রথমবার।
কাউন্টারে ইসাবেল ওকে এতক্ষণ পাত্তা দিচ্ছিল না তেমন। মেয়েটার চোখের সাদাটা ওর শরীরে জড়ানো পোশাকটার মতই হলদেটে। লম্বা বাদামী চুল একদম সোজা, নেমে গেছে তামাটে পিঠ ছাড়িয়ে। মুখের সিগারটা টানছিল না তেমন, বরং চুষছিল বলা যায়। চেহারাটা কেমন উখরা উখরা, এত যে চারদিকে ভিড়, হইচই – সেসব নিয়ে কীরকম উদাসীন। পিয়েরের কথায় চটেমটে বলল, “If ya don’t like it, ya can drink and not pay some-other-damn-wher.” মুখ বেঁকিয়ে বলল বটে, কিন্তু একটা শট-গ্লাসে মদ ঢেলে এগিয়েও দিল ওর দিকে। বোঝা যায়, এরকম একটা ব্যবস্থা আছে, যার হদিশে ফুটো পকেট পিয়েরে ঢোকে এখানে।
বরাদ্দের মাল পেয়ে পিয়েরের মুখে হাসি ছড়ালো। রোজ না হলেও, এমন বদান্যতা ওর মাঝে মাঝেই জোটে। তবে তার বদলে করার থাকে কিছু। এক টানে মালটা গলায় নামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে চোখ টিপে কাজটা কি জানতে চাইল। ইসাবেলের আড়চোখের ইঙ্গিত একদম কোণার টেবিলটায়। তার মানে, ওখানে কোনো ঝামেলা দানা বাঁধছে। পিয়েরে তার মাথার টুপিটা বাঁ-কাত করে ওই টেবিলের মক্কেলদের ঠাহর করার চেষ্টা করছিল, ততক্ষণে পিছনের দরজায় আওয়াজ।
ট্যাট ট্যাট ট্যাট ট্যাট ট্যাট ট্যাট। কেউ ঘনঘন টোকা মারছে হাতের ছড়ি দিয়ে। কিংবা পিস্তলের বাঁট।
অ্যাবসিন্থ হাউসের ভিতরটা নিমেষে চুপ। আওয়াজ শুনেই সবাই বুঝেছে কপ। ওসব টোকা মারার গাম্ভীর্যেই বোঝা যায়।
অ্যাবিয়েলের কোমর জড়িয়ে নাচছিল ঢ্যাঙা লিওনার্দো। মারিয়া এখন নেই। একটু আগেই তাকে কোলে তুলে থিয়েরি চলে গেছে চোরকুঠুরিতে।
এই আওয়াজে পেয়েই সচকিত অ্যাবিয়েল সটান কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে।
সন অব আ বিচ! সিগারটাকে বাঁদিক থেকে ডানদিকে সরিয়ে বলল মেয়েটা, তবে এমন জোরে, যেটা দরজার ওপারে পৌঁছাবে না।
ক্যাশ থেকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল হেনরি। ইসাবেলের গলা উঁচু তারে উঠল এবার, Don’t be breakin’ my door man! I’m comin’, I’m comin’! বলল, কিন্তু সময় নিচ্ছিল। সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে নেমে এলো থিয়েরি, তখনো প্যান্টের কষি বাঁধছে।
দরজা খুলতেই ঢুকলেন খোদ সিডনি স্টোরি। ছড়ির ঠোকাটা তাঁরই ছিল। সরু করে কাটা গোঁফ, ছুঁচলো দাড়ি। ভদ্রলোকের নাকটা বেশ ধারালো, চুল কম থাকায় কপাল বেশ চওড়া দেখায়। সেই কপালে ভাঁজ পড়েছিল বেশ ক’টা। পিছনে শেরিফ ব্লুমফিন্ডও আছে।
এতক্ষণ হেনরির কোন ব্যত্যয় ছিল না। এবার সে চেয়ার ছেড়ে হাত কচলাতে কচলাতে ছুটে গেল, কী সৌভাগ্য, মিস্টার স্টোরি আমাদের গরীবখানায় পায়ের ধুলো দিয়েছেন। তার মুখের বিগলিত হাসি আর থামতেই চায় না।
হেনরি, এসব কি শুনছি?
কি হয়েছে স্যার? আপনি কি শুনলেন?
জানো না, এই শহরের সব জায়গা থেকে বেশ্যাখানা তুলে দেওয়া হয়েছে?
জনকল্যাণের জন্য আপনার এই অবদান – একটা হেঁ হেঁ হাসি হেনরির বাদামী গোঁফের লেজ ধরে নেমে আসছিল।
তাহলে তোমার এখানে এসব এখনো চলে কি করে?
ভুল খবর, একেবারেই ভুল খবর। অ্যাবসিন্থ হাউজ বিখ্যাত তার গ্রিন মনস্টারের জন্য, সে তো আজকের নয়, বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসছে।
হ্যাঁ, তার সঙ্গে দেহ-ব্যবসাটাও তো চালাচ্ছ সেই সময় থেকেই।
সেসব আগে ছিল স্যার, মিথ্যে বলবো না। কিন্তু এখন আর একদমই নয়। লম্বা করে জিভ কাটল হেনরি। চালাতে চাইলেও কি চালাতে পারতাম স্যার, এক পা গেলেই স্টোরিভিল। সেখানে দেশ বিদেশের মেয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কোনো জাতের অভাব নেই সেই বাজারে। আমি ব্যবসা করতে চাইলেও, সেসব ছেড়ে কে আসবে এই মদের আড্ডায়?
হেনরির মুখে স্টোরিভিল নামটা শুনেই একটা অবুঝ যন্ত্রণায় সিডনির চোখের পাশের চামড়া কুঁচকে গেছিল। সে সারা শহর গণিকা-মুক্ত করতে এত লড়াই করছে, সব ক’টাকে নিয়ে এসে ফেলল এই তল্লাটে। কিন্তু ফল কি হল? লোকের মুখে মুখে স্টোরিভিল নামটা এমন চাউর হয়ে গেল, যে এখন জায়গাটার পাকাপাকি নামই হয়ে গেছে ওমনি।
তবে হেনরির কথাটা তার যুক্তিসঙ্গত ঠেকল। শেরিফের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, তবে হয়তো ভুল খবর ছিল।
ভুল না ঠিক সেই খবরের অপেক্ষা না করেই পিঠটান দিয়েছিল পিয়েরে। আরেকটা গ্লাস সাঁটাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু এখন হাওয়া তেমন সুবিধার নয়। শুক্রবারের সন্ধ্যাটা রঙিন করতে অন্য আর একটা ঠেকে ঢুঁ মারতে হবে।
ব্লেনভিল স্ট্রিট ধীরে ধীরে সরগরম হচ্ছে। রাস্তার গ্যাসের বাতি জ্বালানোর এখনো সময় হয়নি। কিন্তু যাদের কাজের ছুটি হয়ে গেছে, পকেটে পয়সা থাকার আনন্দে হই হই করতে করতে আসছে। কেউ কেউ হেঁড়ে গলায় গান গাইছে। ঘোড়ায় টানা ক্যারেজে এক-দু’জন বাবু লোক চলেছে স্টোরিভিলের দিকে। অ্যাবসিন্থ হাইজের উল্টো দিকেই জিন অ্যান্ড টনিক। ওখানে একবার যাওয়া যায় কিনা ভাবছিল পিয়েরে। তখন দেখল আবার এই লোকটাকে।
এই লোকটাকে আগেও দেখেছে পিয়েরে, প্রায় রোজই তো দেখে আজকাল। দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যায় তার। ইস্ট ইন্ডিয়ার থেকে আসে এরা। মুখটা দেখ? বাইরে থেকে নতুন কেউ এসে গেঁড়ে বসার চেষ্টা করছে ভাবলেই রাগ হয় পিয়েরের। এমন নয়, যে তার কোনো কাজ মার যাবে, কিন্তু সব দেশ থেকে হাড়-হাভাতেগুলো এখানে এসে জমাবে, সেটাও তার ভাল লাগে না। এমনিতেই আজকাল নিগ্রোগুলোর বাড় বাড়ছে খুব। ট্রেমের দিকটা তো পুরোটাই ওদের দখলে। এই লোকটার চেহারা যদিও আলাদা। এদের মতন আরও দুই তিনজনকে দেখেছে মার্দি গ্রাঁর সময়। খুব ব্যবসা জমেছে এদের। হিন্দু জিনিস কিনতে লোকের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। এই হিন্দুগুলো নিগ্রোদের থেকে আলাদা, শহরের সব জায়গায় পৌঁছে যায়। ওদের আসা-যাওয়ায় কোন বাধা-নিষেধ লাগেনি। হয়তো চেহারার জন্য। কাটা কাটা চেহারার মাজা রঙের এই লোকগুলো, হয়তো চোখের ওইরকম দৃষ্টি বা মাথার ওই গোল টুপির কারণে কেমন দার্শনিক বা শিল্পী স্বভাবের মনে হয়, কিন্তু আসলে খুব বজ্জাত। সেটা ঠিক বুঝতে পারে পিয়েরে, লোক চেনে তো। ফুটপাথে থুথু ফেলল পিয়েরে। আচ্ছা নিউ অরলিন্সের লোকজনকে কি মনে করে ওরা? কেউ সত্যিকারের উঁচুদরের শিল্পকর্ম বোঝে না! যদিও সে নিজে ছাই বোঝে এসবের, তবু নিজের জাতভাইদের কথা ভেবে একটু আত্মশ্লাঘা বোধ করল পিয়েরে। এই হিন্দুগুলোকে নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করছে এখানকার লোকজন। তার ফরাসী শিল্প আর সভ্যতার কাছে কি এরা? অথচ এই লোকটা কার্পেট আর রাগের নামে কিসব নিয়ে আসে দেশ থেকে আর বিক্রি করে তারই ফরাসী জাতভাইদের কাছে। ছ্যাঃ! নেহাত সে এসব কিনবে না কোনোদিনও, নাহলে ওদের কাছ থেকে না কেনাটা বেশ জুত মত করতে পারত।
আজও আসছিল লোকটা। সাইকেলের পিছনে একটা বিশাল পেঁটরা। কেমন উটের মত বসেছে দ্যাখো সাইকেলের উপরে! কিছুতেই বেচারা কায়দা করতে পারছে না। সাইকেলটা টলমল করতে করতে আসছে। পারবে কি? কোন দেশ থেকে এসেছে, দেখেছে এসব জীবনে?
পিয়েরে ওকে দেখতে এত ব্যস্ত হয়ে গেছিল, সে যে নিজেই রাস্তা আটকে রেখেছে ঠাহর করেনি। হইহই করে লোকটা এসে গেল। কোনমতে এক লাফে পাশে সরতে পেরেছিল পিয়েরে। কি বেয়াক্কেলে অসভ্য লোকটা! কোথায় বলবে, ও সাহেব, একটু সরে জায়গা দাও প্লিজ! তা না খেঁচিয়ে উঠল ‘ওল্ড ফুল!’; বেয়াদব! তাকে কোনমতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেও লোকটা তাল সামলাতে পারেনি। গিয়ে ধাক্কা মারল অ্যাবসিন্থ হাউজের চৌহদ্দিতে। দু’হাত ছড়িয়ে ব্যাঙের মত রাস্তায় উল্টে পড়েছে একেবারে, পড়েই চ্যাঁচানি, ‘শুভানাল্লা’! সাইকেলের পিছনে যত জিনিস ছিল, ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ওইটুকু পেঁটরা, কিন্তু রকমারি জিনিসে বোঝাই ছিল। চিকনের কাজ, টেবিলের ঢাকা, স্কার্ফ। দেখেছিল সব পিয়েরে, লোকটা পড়েওছে তার জন্যে। কিন্তু এখন ওর জিনিস তুলে দিতে গিয়ে হালকা নেশাটা বরবাদ করার কোনো মানে হয় না।
লোকটা নিজেই উবু হয়ে বসে কাপড় সব আবার গাঁঠরিতে বাঁধছিল।
এমন সময় অ্যাবিয়েল দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। সিডনি স্টোরির আগমনে আজ তার শুক্রবারের সন্ধ্যার রোজগার মাটি। এখন তার শরীরে বড় আচকান জড়ানো, কে বলবে ভিতরে সে আগুনের গোলা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বেরিয়েই পেল এই অদ্ভুত চেহারার লোকটাকে। এর আগে কখনো কোনো হিন্দু মানুষ সামনে থেকে দেখেনি অ্যাবিয়েল। তবে শুনেছে এদের কথা।
তবে হিন্দুটার সঙ্গে কথা বলার আগে পিয়েরের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি দেখে চেঁচিয়ে উঠল, এই পিয়েরে, বুড়ো মদ্দা, হাত লাগাতে পারছিস না?
কোথায় হাত লাগাবো বল? পয়সা দিতে পারবো না কিন্তু।
পিয়েরের এমন রসের কথায় কান দিল না অ্যাবিয়েল। তার দিকে একটা বিতৃষ্ণার দৃষ্টি হেনে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল, হাত লাগাবো না কি?
লোকটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রাগের চোটে নিজের সাইকেলে লাথি কষাচ্ছিল। ঠোকর খাওয়া ইংরাজিতে বলল, দেখলে – চাকা কেমন ফেঁসে গেল? এবার কি করে নিয়ে যাবো এত জিনিস আর সঙ্গে ভাঙা সাইকেল?
জিনিস তো বেশ ভালো মনে হচ্ছে। নিয়ে যাবে কেন, সব বেচে দাও। তাহলেই আর বইতে হবে না।
দাঁত বের করে হাসল লোকটা। বেচার কথা শুনেই বোধহয় রাগ পড়েছে। কোথায় বেচবো? এই দোকানে?
ধুর, এখানে সব জুয়ায় টাকা ওড়াতে এসেছে। আর মালিক হেনরিটা এত কিপ্টে, শুঁড়িখানা সাজানোর জন্যে একটা পয়সা খরচ করতে চায় না।
তাহলে কোথায়? আবার নিরাশা ছড়িয়ে পড়ছিল লোকটার মুখে। অকেজো সাইকেল আর এই গাঁঠরি-বোঝাই মাল নিয়ে কেমন করে ঘরে ফিরবে – ভেবেই মাথা খারাপ লাগছে।
ওই যে সামনে, ওই গলিতে। অ্যাবিয়েল তার ডান হাত তুলে স্টোরিভিলের দিকে দেখাল। ওখানে সবাই ঘর সাজিয়ে খদ্দের ধরে, ঘর সাজানোর জিনিস লাগে তো ওদের। এখনো রাতের ব্যবসা জমে ওঠেনি, তোমার জিনিসগুলো তো খুব সরেস। নিয়ে পৌঁছালে দু’-দশখানা বিক্রি হয়ে যাবে ঠিক।
স্টোরিভিলে গেলে যে বিক্রি হবে, সেটা সে জেনে গেছে এতদিনে, কিন্তু একা কারো ঘরে ঢোকার সাহস হয় না। মেয়েগুলো বড় বেলুজ্জে। এই মেয়েটা নিয়ে গেলে কিছু সুবিধা হতে পারে। তুমিও কি ওদিকে যাবে? এমন নয়, যে লোকটা গুছিয়ে ইংরাজিতে কথা বলতে পারে অত কিছু। যা পারে না, সেটা হাত, চোখ আর হাসি দিয়ে ভরাট করতে থাকে।
চলো আমি তোমায় ম্যাডামের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, সে ডাকলে সবাই ওখানেই হাজির হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কি লাভ থাকবে?
লাভের কথায় লোকটা একটু থমকালো। তারপরে বলল, আমার নাম আলেফ। ভাবটা এমন, যেন নামটা বললেই আর লাভের অংশ দিতে হবে না। অথবা বলতে চেয়েছিল, আলেফকে বিশ্বাস করো। বিক্রি হলে নিশ্চয় ভাগ দেবে, ঠকাবে না।
চোখে ঝিলিক তুলে হাসল মেয়েটা। আচ্ছা, বিক্রি হলে আমি বুঝি আলেফ পাবো?