নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
নতুন দেশে ধাতস্ত হওয়ার আগেই জমিয়ে ঠান্ডা পড়ে গেছে। সকালবেলা উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে কালীপ্রসাদ দেখলেন চারিদিক বরফে সাদা। নতুন চেনা সবুজ আর বাদামী-রঙা পাড়াটা এখন বেশ অপরিচিত। বরফের আস্তরণ চাদরের মত পাতলা নয়, গাছের গুঁড়ির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ফুটখানেক তো হবেই। এর আগে দিনদুয়েক বরফ পড়েছিল বটে, দৃষ্টিশোভনও ছিল বেশ। হালকা। হাঁটা চলায় অসুবিধা হয়নি। আজ কি উপায়ে লেক্সিংটন স্ট্রিট অবধি লোকে এসে পৌঁছাবে সেটা কালীপ্রসাদের জানা নেই।
লেক্সিংটন স্ট্রিটে আজকাল বেদান্ত সোসাইটির শাখা হয়েছে। এমন কিছু বড় পরিসর নয়। অনেক লোকের জন্য ভাষণ থাকলে পাবলিক হল ভাড়া করা হয়। কিন্তু জনা পঁচিশ-তিরিশ লোকের জন্য এটাই যথেষ্ট। তার নিজের থাকাও এখানেই। অতএব কীভাবে বরফ ঠেলে যাওয়া যাবে, সেই বিষয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। তবে কেউ যে এসে পৌঁছাতে পারবে, বাইরে অঝোর বরফধারা দেখে তেমন ভরসা হচ্ছিল না। যদি কেউ না আসে, হয়তো একদিকে ভাল। সেই যে জাহাজ থেকে নেমে ফ্র্যান্সিসের আতিথেয়তায় দিন সাতেক বিশ্রাম হয়েছিল, তারপর থেকে ক্রমাগত ভাষণ আর যোগশিক্ষাতেই দিন কেটে গেছে। ধ্যানমগ্ন হওয়ার সুযোগ কই!
লেক্সিংটন স্ট্রিটে থাকতে শুরু করার আগে অনেকের বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছেন কালীপ্রসাদ। সকলেই সম্ভ্রান্ত, অতি সজ্জন। সবার বাড়িতেই আয়োজন বিশাল, আপ্যায়নেরও অভাব ছিল না। অনেক সময় তাদের পার্লারেই হিন্দুধর্মের কথা আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছে। সেটা বেশিদিন ভাল লাগেনি কালীপ্রসাদের। কালি তপস্বী, নিছক ভিখারির মত দশ বছরেরও বেশি ভারতের দিকে দিকে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। আমেরিকার প্রধান শিষ্যদের প্রাচুর্যের মধ্যে তাঁর হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। চিন্তামগ্ন হওয়ার শান্তি ছিল না। অন্যের বাড়িতে থাকলে সেখানে কৌতূহলী লোকের ভিড় সব সময়। হিন্দুধর্ম আর যোগশিক্ষা নিয়ে এদেশের মানুষের কৌতূহল আর উদ্দীপনা এতটাই বেড়ে গেছে, যে সারাদিন আনাগোনা লেগেই থাকত। ফ্র্যান্সিসের সাহায্যে এরপর কালীপ্রসাদ এই ভাড়াবাড়ির ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের প্রয়োজন অতি সামান্য। এমনকি শোয়া-বসাও কাঠের মেঝেতে। এর বেশি প্রয়োজন তাঁর নেই। জেমস শুনে শুরুতে হেসেছিল। আর ক’দিন যাক, ঠান্ডা যা পড়বে, কাঠের আগুনে মেঝের ঠান্ডা যাবে না। শুনে কালীপ্রসাদ ভেবেছিলেন, ঠান্ডা কি তিনি দেখেননি? যখন ভিখারির মত পদব্রজে ঘুরেছেন, হিমালয়েও তো গেছেন সাধুসঙ্গ করার জন্য। কতরকম যোগসাধনায় প্রস্তুত শরীর তাঁর। হঠযোগীদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন কালীপ্রসাদ। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও তাঁর কিছু না, তেমনি এই কনকনে ঠান্ডায় দরকার হলে খালি গায়েও হেঁটে আসতে পারেন। যদিও সেটা কাউকে মুখে জানান না। বেদান্তকে কেউ যাদুবিদ্যা বলে গ্রহণ করুক, সেটা তাঁর ইচ্ছা নয়।
শুরুতে এই দেশে আসবার ইচ্ছে মোটেই ছিল না। দেশের মাটিতে, জঙ্গলে, পাহাড়ে মন বাঁধা পড়ে আছে। দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছাটাও প্রবল। এই নিয়ে বিবেকানন্দের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হয়েছে। বিবেকানন্দের কথায়, যদি এশিয়া সভ্যতার শুরু করে থাকে, পুরুষের শক্তির উত্থানের পিছনে ছিল ইউরোপ। আমেরিকা হচ্ছে নারী এবং সাধারণ জনমানসের বিকাশক্ষেত্র। এই দেশ এক উদার সমাজে পরিণত হচ্ছে, যা অন্য কোথাও নেই। এখানে অনেক কিছু শেখার আছে।
তাহলে কি হিন্দু ধর্ম আমরা ছেড়ে দেব আর পাশ্চাত্যের পথে চলব? কি বলতে চাইছে নরেন, এই প্রশ্ন উঠেছিল কালীপ্রসাদের মনে।
না, ছাড়ার প্রশ্ন নয় কালি। উদারতা আর প্রসারের কথা বলছি। আমাদের ধর্মকে গণ্ডিবদ্ধতা ভেঙে বেরোতে হবে, সমাজকে উদার হতে হবে – যার থেকে আমাদের দুখি, নিরন্ন ভাইদের জীবনের বিকাশ হতে পারে।
কিন্তু সেটা দেশে থেকে করতে হবে; বাইরে থাকলে কি ভাবে সেই কাজ করা সম্ভব?
অর্থ এবং প্রশিক্ষণ। ভাল করার জন্য এই দুইয়ের সত্যতা অস্বীকার করা যায় কি?
আমরা সন্ন্যাসী, অর্থে আমাদের কি প্রয়োজন? আর আমাদের প্রশিক্ষণ বেদান্তে।
অর্থ নিজেদের প্রয়োজনে নয়, মানুষের জন্য। আমরা পশ্চিমকে প্রশিক্ষণ দেব। বেদান্ত, যোগ। তার জন্য এই কয়েক বছরে আমি আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছি। সেই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তোমাকে ডাকা। আবার, বড় কিছু গড়ে তোলার জন্য যে লোকমত, সংগঠন গড়ে তোলার শিক্ষা – সেটা এখানে আমি পেয়েছি। কি সুন্দর করে দেশটা গড়ে তুলছে ভাব তো! কি তাদের ইতিহাস! মাত্র দু’শ’ বছরের মধ্যে এদের এই প্রাচুর্য আর বিকাশ সম্ভব হয়েছে। সেখান থেকে কি কিছু শেখার নেই?
কালীপ্রসাদ তাঁর তর্ক ছাড়েননি। ভারতবর্ষে কি বড় কিছু গড়ে ওঠেনি আগে? আমাদের নালন্দা, তক্ষশীলা –
অবশ্যই। সুদূর অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছি তো আমরা, কিন্তু গত কয়েকশ’ বছরের অপশাসন আমাদেরকে নতুন কিছু গড়তে দেয়নি। এগোনোর বদলে পিছিয়ে গিয়েছি। বড় করে ভাবতে দেয়নি, তাই ছোট হতে হতে সর্বক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষুদ্রতাকে প্রকট করেছি। যা গড়েছে, সে তো ওই ব্রিটিশরা। এখন আমাদের শুরু করার সময় এসেছে। বেদান্তের প্রচারের জন্য এদেশে অনেকের সাহায্য পাচ্ছি আমি। তাদের অর্থের অভাব নেই, বেদান্তে প্রভূত আগ্রহ। ওদের প্রাসাদোপম বাড়ি আমাদের জন্য আজ উন্মুক্ত। বড় কাজ করার জন্য অর্থ এবং লোকশক্তির প্রয়োজন কি অস্বীকার করা যায়?
এই সবই চিঠিতে লিখেছে নরেন নানান সময়ে, অস্বীকার করতে পারেননি কালীপ্রসাদ। অন্য গুরুভাইদের মত নরেনের চিন্তাশক্তি আর দূরদর্শিতায় বিশ্বাস আছে তাঁরও। এসে পড়েছেন এই দেশে। গড়ে তুলতে হবে বেদান্ত সোসাইটির শাখা – আমেরিকার শহরে শহরে। গুরুদায়িত্ব। কাজ নরেন শুরু করে দিয়ে গেছে, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এত বড় দেশ, পুরোটাই অচেনা। গুরুভাইরা তাঁর ভরসায় আছে। দেশের লোকের জন্য কত কাজ শুরু হয়েছে। এদেশের লোকের থেকে অর্থ সাহায্য না পেলে এগোবে কি করে? এসে অবধি এই কয়েক মাসে অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন, বহু নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। বেদান্ত সোসাইটির ভিত শক্ত করেছেন। তবু বাইরের শুভ্র পরিবেশের দিকে তাকিয়ে নিজের দেশের ধুলোমাখা রাস্তার জন্য মন মুচড়ে ওঠে কালীপ্রসাদের। দিনান্তে কারো সঙ্গে দুটো বাংলা কথা কইতেও মন চায়।
এর মধ্যে জেমস, ফ্র্যান্সিস আর জো এসে পড়ল। সব ক্লাসেই জেমস থাকে, যা বলা হচ্ছে তার নোট রাখে। জো বেদান্ত সোসাইটিকে যেন দু’হাতে আগলে রেখেছে। তাঁকেও। কালীপ্রসাদ নতুন এসেছেন, তাঁর যাতে কোনোকিছুতে অসুবিধা না হয়, সেদিকে সদাই নজর। ফ্র্যান্সিস বিচক্ষণ মানুষ। বেদান্ত সোসাইটি এখনো কোনো সরকারী স্বীকৃতি পায়নি। একটা স্থায়ী ঠিকানাও প্রয়োজন। এইসব ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করতে ক্লাস শুরুর কিছু আগেই এসে গেছেন ফ্র্যান্সিস লেগেট।
জোর চিন্তা অন্য ব্যাপারে। নিউ ইয়র্কের ইমিগ্রেশান সেন্টারে আগুন লাগার পরে অস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিল, সেখানে সবকিছু সুচারু ভাবে হচ্ছে না। ভিড় সামলাতে রক্ষীদের এমন টালমাটাল অবস্থা ছিল, যে কালীপ্রসাদের একখানা তোরঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্য কারো একটি বাক্সের সঙ্গে বদল হয়ে যায়। জো এই ব্যাপারে খোঁজ খবর করছিল। কিন্তু কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।
তোমার বাক্স যার সঙ্গে গেছে, তার কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।
কার বাক্স সেটা জানা গেছে?
বাক্সের নম্বর মিলিয়ে এতদিনে বের করেছে সে খবর। সে এক ফায়জাল আলি বলে কোনো মানুষের বাক্স।
কালীপ্রসাদ উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। দেশের লোক হবে। তাছাড়া নাম জানা গেছে, লোকটাকেও পাওয়া যাবে। সেই বাক্সে তার অনেক গ্রন্থ রাখা ছিল, কিছু পোশাকও। লোক যখন আছে, তখন তার ঠিকানাও আছে। তাঁর মহামূল্য বই ফেরত পাওয়া যাবে এবার।
ঠিকানা পাওয়া গেছিল। আশবারি পার্কে। আমার চেনা একজন সরকারী আমলা আছে সেই কাউন্টিতে। কিন্তু কের লেনের সেই বাড়িতে থাকে পাঁচকাড়ি মান্ডাল নামে এক লোক, সে বলল ফায়জাল আলি বলে কাউকে চেনে না।
মণ্ডল? এখানে তার দেশের এত লোক থাকে নাকি? কিন্তু লোকটা হয়তো ঠিকই বলেছে। মণ্ডল মানে তো হিন্দু আর ফয়জল হল মুসলমান, তাদের বাস একই বাড়িতে কি করে হয়?
দেখো জো, এমন হতে পারে, সরকারি লোক দেখে ঘাবড়ে গেছে। শুনেছি ব্রিটিশ জাহাজের মাঝি-মাল্লা নেমে পড়ে গা ঢাকা দেয়। নিজেদের পরিচয় আড়াল করে থাকাই পছন্দ করে তারা।
ফ্র্যান্সিস ব্যবসায়ী মানুষ, তার আন্দাজ ঠিক হতে পারে। ভাষার অসুবিধা থাকাও বিচিত্র নয়। নাম শুনে মনে হয় না কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি। মাঝি-মাল্লা হলে ইংরাজি কথায় ঘাবড়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। নিজেই একবার যাবে কিনা ভাবছিল কালীপ্রসাদ।
আমি একটা কথা বলি? জেমস এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার নিজের চৌকো থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, একবার বরং ওই বাক্সটা খুলে দেখে নিলে হয় না? হয়তো সেটার মধ্যে কোনো ঠিকানা বা অন্য কোনো পরিচিতি থাকতে পারে।
অন্যের বাক্স খুলতে মন চায়নি কালীপ্রসাদের। কিন্তু তাঁর বইপত্র পাওয়ার যদি এইটাই একমাত্র উপায় হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে বৈকি।
ঠিক আছে, ভেবে দেখি। এবার সবাই আসতে শুরু করবে, আমি পোশাক পরিবর্তন করে নিই।
কালীপ্রসাদ এতক্ষণ সাদা ধুতি, ফতুয়া এবং একটি শাল গায়ে জড়িয়েছিলেন। ঘরে এসে গেরুয়া অঙ্গবস্ত্র ধারণ করে মাথায় পাগড়ি পরে নিলেন। বিবেকানন্দ আর তাঁর গুরুভাইদের এখন সেটাই পোশাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও অভেদানন্দ পথে বেরোলে এই পোশাক পরেন না। সেটা বিবেকানন্দেরই উপদেশ। প্রথম প্রথম ওই পোষাকে বিবেকানন্দ পথে বেরিয়ে নাকাল হয়েছেন। পথে সবাই যদি বারবার ঘুরে ফিরে দেখে – সেটা খুব একটা স্বস্তিকর নয়। অনেক সময় অযথা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। পরের দিকে বিবেকানন্দ নিজেও বাইরে বেরোনোর জন্য কালো গলাবন্ধ ব্যবহার করেছেন, অভেদানন্দও তাই করেন। তবে কোনো অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার থাকলে আর এরকম ক্লাসের সময় গেরুয়া বস্ত্রে থাকাই পছন্দের।
অভেদানন্দ পোশাক পরিবর্তন করে এসে দেখলেন, সবাই একে একে এসে গেছে। কুড়ি জনের আসবার কথা ছিল, এই বরফ আর ঠান্ডা তাদের একজনকেও ঘরে আটকে রাখেনি। সবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন অভেদানন্দ। এরা নতুন মুখ, প্রথমবার এসেছে তাঁর কাছে যোগশিক্ষার জন্য। তাঁর কাছে নতুন হলেও, বেশিরভাগ লোকই ফ্র্যান্সিস আর জোর পরিচিত। আসলে নিউ ইয়র্কের বিত্তবান সম্ভ্রান্ত সমাজের প্রতিনিধি এরা। সবাই সবাইকে চেনেন। এর মধ্যে মহিলাই বেশি। নরেন যে বলত, এদেশে পুরুষ অর্থের পিছনে ছুটছে, মহিলারা সমাজ এবং আত্মবিকাশে, সেটা এই ক’দিনে নিজের চোখেই দেখেছেন অভেদানন্দ।
অভেদানন্দ কাঠের মেঝেতে পদ্মাসনে বসলেন। উপস্থিত সবাই তাঁদের চেয়ারে। তিনি তাঁর ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, যোগা কি?
উত্তরের আশা করেননি। তাই নিজেই ব্যাখ্যা শুরু করলেন।
এ কোনো যাদুবিদ্যা নয়। বিশ্বের সব পুরাতন সভ্যতাতেই, তাদের পুরানে, পুঁথিতে আমরা পাই কোনো না কোনো মহাত্মার কথা, যাঁরা এমন কিছু পারতেন – যেটার সহজ ব্যাখ্যা ছিল না। কেউ অন্যের মনের কথা পড়তে পারতেন, কেউ হাওয়ায় হেঁটে বেড়িয়েছেন। কখনো মানুষ তাঁদের ভগবান ভেবেছে, কখনো শয়তান বলে পুড়িয়ে মেরেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের এই শক্তি এল কোথা থেকে? যে কোনো পুরোনো সভ্যতাতেই কিছু গোপন সংগঠন তৈরি হয়েছিল, যাঁরা এর চর্চা করেছেন, কিন্তু গোপনীয়তার অঙ্গীকার থাকায় বাইরে জানাজানি হয়নি। কোনো গ্রন্থেও এর খবর পাওয়া যাবে না। প্রাচ্যে এই গোপনীয়তার দরকার হয়নি, কারণ কেউ জানলেও তাঁদের পুড়িয়ে মারা হত না। বরং শ্রদ্ধার আসনে রাখা হত। তাঁরা শুধু এর চর্চা করেননি, পুঁথিবদ্ধও করে গেছেন। এই চর্চিত বিদ্যার ফলই হল যোগশাস্ত্র। আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে যার কোনো বিরোধ নেই। ঠিক যেমন বিরোধ নেই হিন্দু ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মচর্চার।
অভেদনন্দ সদ্য তিরিশ পেরিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর গম্ভীর, চিন্তা ও কথন অত্যন্ত সুগঠিত। এই তরুণ সন্ন্যাসীর কথা যারা শুনছেন, তাঁরা বেশিরভাগই মধ্য চল্লিশ বা বেশি। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন, যে অভেদানন্দ থামলে বাইরের বরফ পড়ার শব্দও শোনা যায়।
স্বামী, আপনার ব্যাখ্যা খুবই মনোগ্রাহী। আপনি গ্রন্থের কথা বললেন। সেই গ্রন্থ আমরা কি পেতে পারি না?
অবশ্যই। কিন্তু তা লেখা হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়, আপনাদের সেই ভাষায় জ্ঞান নাও থাকতে পারে। আপনাদের মধ্যে কেউ কি এই ভাষা জানেন?
কেউ হ্যাঁ বলবে ভেবে এই প্রশ্ন করা হয়নি। হলও তাই। মুখে হাসিটি বিস্তৃত করে অভেদানন্দ বললেন, সেই কারণেই আমরা আলোচনার মাধ্যমে এই শিক্ষা দিচ্ছি। মিস্টার গুডউইন এই আলোচনার নথি রাখছেন। একদিন হয়তো বইয়ের আকারে ইংরাজি ভাষায় আপনারা এই তথ্য পেয়ে যাবেন।
মধ্যাহ্ন এইভাবেই গড়িয়ে গেল। প্রায় দুই ঘণ্টার অধিক এই শিক্ষা কর্ম চলল। দুই একটি যোগ প্রক্রিয়া দেখালেন অভেদানন্দ। ফ্র্যান্সিস আর জো আগেই চলে গেছিলেন। সব অতিথি বিদায় গ্রহণ করার কিছুক্ষণ পরে জেমসও বেরিয়ে গেল। অবশেষে অভেদানন্দ পরমাকাঙ্ক্ষিত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ডুবে গেলেন।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। ইদানিং দিন আগে শেষ হচ্ছে। আজ শুক্লা চতুর্দশী, চরাচর জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে। সারাদিন বরফ পড়ে এখন থেমেছে, কিন্তু চতুর্দিক শ্বেতশুভ্র। চাঁদের আলোয় সে বড় মায়াময়। জীবনের প্রতি ভালবাসা বাড়িয়ে দেওয়ার মত এক সন্ধ্যা এসেছে যেন। এক নীলাভ দ্যুতি এই ঐশ্বরিক রূপময়তায় যা কিছু অসুন্দর, তার সবটা ঢেকে দিয়েছে, সর্ব মঙ্গলময় যেন স্বয়ং নেমে এসেছেন। কালীপ্রসাদ এক গভীর ভাবানুভূতিতে আচ্ছন্ন হলেন। সবাই চলে গেছে, তবু তিনি যে কতক্ষণ একাসনে বসেছিলেন, তাঁর জানা নেই। ক্ষুধা, তৃষ্ণা তাঁকে কখনোই বিচলিত করে না। কিন্তু ধ্যানাবেশ ভঙ্গ হলে নিজেকে বড় আবেগতাড়িত পেলেন। এমত অবস্থায় নিজেকে পাঠে নিযুক্ত করেন কালীপ্রসাদ। মনে পড়ল তাঁর গ্রন্থসম্ভার সবই এই অচেনা যাত্রীর সঙ্গে বদল হয়ে গেছে। না, কিছু একটা ব্যবস্থা না হলেই নয়। যেমন জেমস বলল, ওই বাক্স খুলে যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায়, যার থেকে তাঁর নিজের পেটিকাটি উদ্ধার করা যায়, তাহলে তাই করবেন কালীপ্রসাদ।
স্থিরমনস্ক হয়ে সেই কাজেই রত হলেন। স্টিলের কালো তোরঙ্গ একটা। এমন নয়, যে তাঁর খোয়া যাওয়া বাক্সের সঙ্গে একেবারেই একরকম দেখতে। আসলে এতদিন জাহাজে যাত্রা করে তিনি এত ক্লান্ত ছিলেন আর এঁরা সকলে উপস্থিত হয়ে তার জিনিসপত্রের জিম্মা নিয়ে নিয়েছিলেন, তাই কালীপ্রসাদ অত খেয়াল করে দেখেননি। নাহলে চেহারায় অনেক অমিল আছে। এটি যেন কতকাল আগের তৈরি, এর শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন আছে।
কালীপ্রসাদের বাক্সটি ছিল নতুন। যখনই বাড়ি থেকে বাইরে পা দিয়েছেন, একটি বস্ত্র সম্বল করে, পদব্রজে ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীর আর কি লাগে? এইবার নেহাত এতদূরে যাত্রা, আবার কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তাই নিজের সমস্ত অমূল্য গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে আসবার জন্যে তোরঙ্গ কেনা হয়েছিল।
এর তালাটিও অন্যরকম। আনন্দের কথা তালাটি খুব বড়সড় কিছু নয়, বেশ দুর্বল চেহারার। তাই সেটা ভেঙ্গে তোরঙ্গ খুলে ফেলতে সেরকম বেগ পেতে হল না। কিন্তু খুলে বড় অবাক হলেন কালীপ্রসাদ। এই বাক্সে কেবল থরে থরে সুদশ্য পোশাক এবং গৃহসজ্জার জিনিস। বেশির ভাগ উত্তম রেশম বস্ত্র। তাতে চিকনের কাজ রয়েছে বিস্তর। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে সেটা কোনো ছেলের হতে পারে না, অথচ বাক্সের মালিক এক ফয়জল আলি! প্রথমে খুব বিস্মিত হলেও ধীরে ধীরে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম হল। এই লোকটি কোনো বস্ত্র ব্যবসায়ী। সে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এই দেশে বস্ত্র বিপননে এসেছে? খুবই চমৎকৃত হলেন কালীপ্রসাদ। এই দেশের মানুষ ভারতীয় রেশমের বস্ত্র, বিশেষত গৃহসজ্জা ব্যবহার করে? তিনি বেশ কিছু উচ্চবিত্তের বাড়িতে অতিথি হয়ে থেকেছেন। কারো বাড়িতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। আবার থাকতেও পারে। বৈষয়িক বিষয়ে বা গার্হস্থে তাঁর কোনো উৎসাহ না থাকায়, তিনি হয়তো খেয়াল করেননি। কিন্তু তাঁর মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্নের উদয় হল। এই যে তাঁরা এসেছেন এই দেশে, বেদান্ত শিক্ষা দিচ্ছেন, তেমনি এই ব্যবসায়ীও তার দেশের বস্ত্র নিয়ে এসেছে। ব্যবসায়ী অর্থ উপার্জন করতে চায়, নিজের জন্য। তিনি এই দেশে বেদান্ত শিক্ষা দিচ্ছেন, অর্থ এবং সাহায্য আশা করেই তো! যদিও তাঁর নিজের সেই অর্থে প্রয়োজন নেই, দেশের আছে। তবু এই কথা মনে করে নিজের মনে কেমন একটা দ্বিধা জেগে উঠল কালীপ্রসাদের। তিনি নিজেকে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসী মনে করেন। তাহলে কি কোনোভাবে তিনি তাঁর জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন? এই ভাবনায় অকস্মাৎ বিচলিত বোধ করলেন কালীপ্রসাদ।
কাপড়, কাঁথা এসব সরিয়ে সরিয়ে দেখছিলেন কালীপ্রসাদ। খুঁজছিলেন কোনো কাগজ, এমন কি চিরকুট – যেখানে হয়তো এই লোকটির আসল ঠিকানা বা অন্য কোনো খবর পাওয়া যাবে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা কাগজ পেয়ে গেলেন। কিন্তু সেই বালি কাগজে কিছু লেখা নেই। অবাক হয়ে দেখলেন, তাতে আছে শুধু দুটি হাতের ছাপ। দুটোই ডান হাতের, একটি বড়। একই ছোট। ছোটটি নিশ্চিত কোনো শিশুর, কররেখা পরিস্ফুট হয়নি। এরা কি এই ব্যবসায়ীর পরিবারের লোক? নিশ্চিত এই ফয়জল আলি তার স্ত্রী ও সন্তানের স্মৃতি হিসাবে তাদের রক্ত রঞ্জিত হাতের ছাপ সঙ্গে নিয়ে এসেছে। প্রবাসে নিজের বাড়ির কথা মনে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
কালীপ্রসাদ নিজের ঘর ছেড়েছেন আঠেরো বছর বয়েস হওয়ার আগে, প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক পরে পরেই। সেই ১৮৮৫ সালে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের কাছে চলে আসেন। বারো বছর। আর বাড়িতে ফেরেননি। বাবা রসিকলাল চন্দ্র বেশ কয়েকবার তার দেখা পেতে এসেছেন, কিন্তু কালীপ্রসাদ কোনোদিন বাড়ি ফিরে যাননি। আজ হঠাৎ এতদিন বাদে এক তীব্র কাতরতা অনুভব করলেন, যা একদম সন্ন্যাসীসুলভ নয়। হয়তো বাইরের এই অপার জ্যোৎস্না তাঁর এই বিভ্রম ঘটাল। কিংবা এই সামান্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে আনা স্মৃতিচিহ্ন তাঁকে উদ্বেল করল। তিনি সাংসারিক আবেগতাড়িত মানুষ নন। তবে আজ হলেন। স্থির করলেন, নিজের তোরঙ্গ ফিরে পান কি নাই পান, যে করেই হোক, এই মানুষটির জিনিস ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি নিজে সেই পাঁচকড়ি মণ্ডলের বাড়ি যাবেন।