নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
মারদি গ্রাঁ তখনো কয়েক মাস দূরে, নিউ অরলিন্স-জুড়ে সাজ সাজ রব।
গেলবার যখন হল, আলেফ তখনো আনকোরা। এস্রাকদের মুখে রোজ শুনত, মারদি গেরাস পরব আসচে, আসচে! আসচে তো কি? মাতায় নে নাচি?
আলেফ অত গায়ে মাখেনি। ফিরাঙ্গিদের ব্যাপারে তার কীসের মাথাব্যাথা! তাজিয়া নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়েছে মুহররমে। হিঁদুদের রথযাত্রা, সে-ও দেখেছে। তেমনই কিছু হবে একটা, সে যখন হবে, দেখা যাবে’খন। এই দেশে ক’দিনের অতিথি সে, এদের কায়দা-কেতা বোঝেও না, মনে কোনো আহ্লাদও ছলকে ওঠে না।
তারপর সামনাসামনি দেখল। উই আল্লা! আলেফের চোখ ছানাবড়া। এ কী পেল্লাই জোগাড়! কী তার জাঁক, ঘটাপটা। ইয়াব্বড়-বড় সব রথ আসছে ক্যানাল স্ট্রিট ধরে। কত রকমের সাজসজ্জা, সঙ্গে ঢোল-সহরত। ড্রামে বোল তুলে গান গাইছে। দিকে দিকে সবুজ, সোনালি আর বেগুনি পতাকার ছড়াছড়ি। রথের গায়েও অমনই রঙের কাপড় দিয়ে মোড়া। চূড়া-ওয়ালা রথ নয়, একেকটা চলন্ত বাড়ি যেন। সেই রথে চড়ে আসছে মেলা-ই লোক। হেঁটেও। কিন্তু কারো মুখ দেখার জো-টি নেই। সবার মুখে মুখোশ-পট্টি বাঁধা; বাদশা, উজির সেজে চলেছে। রানীও আছে।
আলেফ, জয়নাল, বসির – পরব উপলক্ষে সাজগোজ করে বেরিয়েছিল। এই ক’টাদিন তাদের কারোর ফিরিতে বেরোবার নেই, গেলেই বা কে কিনবে? শহরের সব লোক এই পরবে। ওরাও একটু দুরস্ত হয়ে, কোট-পাতলুন পরে, টেরিটি বাগিয়ে, চোখে সুর্মা, দাড়িতে মেহেন্দি লাগিয়ে পথে নেমেছিল।
সে কী হুড়োহুড়ি! শহরটা এমনিতেই সদা জমজমাট, পথে-ঘাটে নাচা-গানা-বেলেল্লাপনা চলে হররোজ। কিন্তু এ একেবারে অন্যরকম। মানুষের সঙ্গে আকাশ, বাতাস, গাছপালা, বাড়িঘর – সব কিছুতেই ফুর্তির ফোয়ারা। ইদের খুশি, হিঁদুদের পরব, সে সব দেখেছে ওরা। সম্বচ্ছরের মত পাওয়া নতুন পোশাক পরে খুশি হয়ে ঘোরে লোকজনা। এখানে তা নয়। সবাই পোশাক পরেছে যেন বাজিগর একেকজনা, নিউ অরলিন্স যাদুনগরী আজ।
চারদিকের মহোৎসবে ওদের চোখ যদি ছানাবড়া না হয়ে থাকত, তাহলে নিজেদের সাবেকী পোশাক নিয়ে একটু কিন্তু ভাব জাগতে পারত। বলেছিল একবার বসির, আমাদের একখান করে মুকোশ থাকলে ভাল হত, না রে?
কেন বসির ভাই, মুকোশ পরে বুজি ওই রতে চত্তে আর নাচাগানা কত্তে?
গাইতাম। অম্লান বদনে বলেছিল বসির। দেশে গাঁয়ে কি গাইনি কক্কনো? এই দেশের নোকগুলো আমোদ কত্তে জানে বটে। দেকলে মনে আহ্লাদ জাগে কি না আলেফ?
ইংরিজি গান গাইতে বুজি বসিরভাই?
ইংরিজি কেন, নিজের ভাষায় গাইতাম। কান পেতে শোন, এখেনে সবাই কি আর ইংরিজিতে গাইছে? এই দেশে কত রকমের লোক, খুশির দিনে যে যার মত করে তান ধরিচে। আমিও ধত্তাম।
কথাটা ঠিক। মারদি গ্রাঁ ফরাসি দেশের উৎসব হলেও, এখন এটা নিউ অরলিন্সের। এখানে তো শুধু ফরাসিরা নেই, সব দেশের সব রকমের মানুষ। তাই যেমন গানের বোল, তেমনি নাচার রকম-সকম। কোনো এক জাতের নিয়ম মেনে চলছে না।
ওরাও একসময় এই জনসমুদ্রে মিশে গেছিল। শরীর বাইরে থেকে না নাচলেও, নাচ ঢুকে গেছিল ওদের মনে। নিউ অরলিন্সের মারদি গ্রাঁ এমনি, ভেতর থেকে টান দেয় এই উৎসব।
রাস্তার দু’ধারের হুড়োহুড়ির মধ্যে কোনোরকমে একটা জায়গা বানিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। লোকের ঢল নেমেছে পথে। হয় রথে চড়ে যাচ্ছে, নয়তো রাস্তায় কি বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা দেখছে। ক্যানাল স্ট্রিটের দু’ধারে যত বাড়ি, সেগুলোতেও সবুজ, সোনালি আর বেগুনি কাপড়ে মুড়ে ভোল পালটে ফেলেছে। কি চেকনাই! সেই সঙ্গে মোচ্ছব, লেন্ট আসার আগে যে যা পারে খেয়ে নিচ্ছে, রোজই বুঝি ওদের ফ্যাট টিউসডে। রথেও, বাড়িতেও। খোলা রাস্তায় মদ টানছে সবাই, পথ চলতি খাবিও খাচ্ছে।
রথে শুধু বাদশা নেই, আছে বেগমও। যদিও সবার মুখে মুখোশ, মেয়ে হলে তাদের আবার বুকের কাপড় আলগা। তোবা! তোবা! বেলুজ্জেরা তার মধ্যেই দু’হাত আসমানে তুলে নাচগান জুড়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে মুঠো-মুঠো পুঁতি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আলেফরা নিচু হয়ে পুঁতি কুড়াবে, না ঘাড় উঁচু করে ফর্সাপানা মেয়েছেলের কেচ্ছাকাণ্ড দেখবে?
এত উৎসব, উত্তেজনা আর খাওয়া দাওয়ার ধূম কোনো বাপের জন্মে দেকিনিকো। রাতে বাড়ির পথ ধরে ওদের মুখে শুধু এই বুলি। মারদি গ্রাঁ দিনরাত মানে না, তেমনি চলছে যেন কারো কোনো ক্লান্তি নেই।
ওদের সঙ্গে এস্রাক ছিল না সেদিন। তার সঙ্গে এখানকার যতেক নিগ্রো মানুষজনার ওঠাবসা। ক্যানালস্ট্রিটে যে শোভাযাত্রা, সব সাদাদের তদ্বিরে। নিগ্রোরা সেখানে কোথায়? তাদের প্যারেড ছিল কঙ্গো স্কোয়ারে। এস্রাকের মতে সেখানে আরও রকমারি কাণ্ড, অনেক তার জাঁক। আর গান? ওখেনে জ্যাজ বলে যে গান হয়, নিত্যিদিনই হয়। উৎসবে আরও বেশি। পথের কোনায় কোনায়, হাঁটতে ফিরতে তার পাঁয়তারা চলচে। নিজের চোকে না দেকলে বিশ্বাস যাবে না। এই নোকগুলো দিনভর খাটে তো, এই ক’দিন দেকগে তার সুদে-আসলে পুইরে নেয়। তবে হ্যাঁ, ওদের চালচলন যেমন ভেন্ন, পরব মানানোর আদব তরিকাও এমনি ধারা নয়।
ওদেরও এমনধারা তাজিয়া থাকে? এখেনকের মত দলে দলে লড়াই?
আরও কত কিচু। কী সাজ ওদের, এই নম্বা নম্বা পালকের পোশাক, একেকখান মানুষ হয়ে যায় হেই উঁচু! হাত লম্বা করে দেখায় এস্রাক। আর ওদের হয় সাচ্চা লড়াই, ছুরি-ছোরাও বাদ যায় নাকো।
সে কীরকম? যে কাউকে ছুরিছোরাও চাইলে দিতে পারে? এটাতে একটু ভয় পেয়েছিল জয়নাল। সে ছোটখাট চেহারার শান্তিপ্রিয় লোক, বিদেশে এসে এমনিতেই সিঁটিয়ে থাকে। তিন বছর পার করে দিয়েও। কেন সাধ করে এদের দেশের লোকেদের শিয়া-সুন্নি মার্কা লড়াইয়ের মধ্যে সেঁধোনো?
আহা, সত্যি কি আর অতখানি হয়। বেশিটা ধরোগে দেকনদারি। হাতে রঙ-বেরঙের সুতলি দে কাজ করা বর্শা থাকে, সে কি আর বুকে বেঁধানোর মতলবে? কিন্তুক একবার লেইগে গেলে – বলে একটু ফিচেল হাসি হেসেছিল এস্রাক। এবচ্ছর কিচুটি হয়নিকো – কিন্তুক হয় বলে শুনেচি। রক্তপাত কিচু হয়নি কোতাও, পাঁয়তাড়া কষেছিল খুব খানিক।
এস্রাক তারপর ওই এলাকার দলগুলোর বিন্যাস দিয়েছিল। নিগ্রোদের দলগুলো ইন্ডেন টেরাইবদের নামে নামে কিনা। কী যে সব খটোমটো নাম, বলতি গেলে আব্বা ইয়াদ করতি হবে।
নিগ্রোদের শোভাযাত্রা, তাইলে ইন্ডেন বলতেচে কেন এস্রাকভাই?
ইন্ডেন হল এদিগরের দিশি লোক, যাদের মেইরে ফিরিঙ্গিরা দেশটা হাতাল। আমাদের কোম্পানির মতন গো, বুজলে না? এল ব্যাপার কত্তে, দেশটাকে হাবসে নিল। নিগ্রোদের উপরও তো কম অত্যেচার করেনি! তেকন নিগ্রোরা সাদাদের খপর থিকে পেলিয়ে গিয়ে ইন্ডেন টেরাইবদের কাচে নুকোত। কালোরা তাই ওদিগকে বড় মান্যি করে কিনা, এর লেইগে অমনি নাম করেচে – চিটিমাচা ওয়ারিয়ারস, ইওলো পোকাহন্টাস, বেলাক চেরোকে, চেয়েন হান্টারস এমনিধারা।
সে হল গেলবারের কথা। এবছর এস্রাক তো যাবেই, আলেফও দেখতে যাবে নিগ্রোদের শোভাযাত্রা। ট্রেমের রাস্তায় যাবে এবার। এবছর ওদের পোষাকেও একটু রঙ ধরবে। একেকখানা চিকনদারি কাপড় দিয়ে জোব্বা বানিয়েছে নিজেদের। মুখে মুখোশ থাকবে না, কিন্তু মাথায় ফেজ টুপি চড়াবে, তার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে রঙ্গিন কাগজের শিকলি। দুয়ে মিলে নিজেদেরকে কেমন লাগবে সেই নিয়ে রোজ পা ছড়িয়ে খেতে বসে জল্পনা কল্পনা চলে।
ট্রেমের পরব দেখার পিছনে আলেফের একটা বিশেষ কারণ ছিল। সেখানে অ্যাবিয়েল থাকবে, সে এবার ক্রেওল ওয়েস্টের রানী হয়েছে। দেখতে না গেলে হয়? শুনেছে তার অনেক সাজগোজ, রঙঢঙ থাকবে।
কেমন ধারা? ওই যেমনি এখানকার করমোগুলো করে? মুখে মুখোশ এঁটে, বুকের কাপড় আলগা দিয়ে?
অ্যাবিয়েল শুনে খুব একচোট হেসেছিল। সারা বছর অ্যাবসিন্থ হাউজে বুকের কাপড় খুলে নাচি, আবার মারদি গ্রাঁতেও কি অমনই করব? আমাদের পরবে সাজসজ্জা অন্যরকম। সাদারা যেমন করবে, আমরা তেমনি ধারা করি নাকো। আমাদের সাজ এমন, যে মুক খোলা থাকে, আর সারা শরীর থাকে ঢাকা। তবু আমাকে দেখে আলেফ চিনতেই পারবে না। অ্যাবিয়েলের চোখমুখ রহস্যময় লাগছিল, ঠোঁটের কপাট খুলে ঝিকমিক করছিল দাঁতের সারি।
মুক খোলা থাকবে তো? তাইলে?
তাতে কী, রঙ থাকবে না মুকে? আর সারা শরীরে এইয়া বড় বড় পালকের পোশাক, তাতে কত কারুকাজ, চোখ ধেঁধে যাবে নে তোমার?
রানী তো একটাই, তাই দেকে চিনে যাব।
তোমায় বলেচে! সর্দারের কি একটা রানী হলে হয় কোতাও? একটা রানী সবজে, একটা বেগনে আর একখান সোনালী।
আবিল কোন রঙের রানী হয়েচে?
খিলখিল করে হেসে আলেফের মাথায় আঙ্গুলের গোঁতা মেরেছিল অ্যাবিয়েল। আজকাল মুকে যেমন কতা ফুটেছে, মগজে তেমনি শান হয়েচে তোমার। আগের থিকে জেনে রাকচো, দেকে চিনে বের করার খেমতা নেইকো।
অ্যাবিয়েল হাসে, তার টানা টানা ভুরুতে ঢেউ ওঠে, চোখে এক আকাশ তারা চিকচিক করে। আলেফ হাঁ করে চেয়ে থাকে খুশিয়াল মেয়েটির দিকে।
ইস, কী দেকচো এমন করে, মুখে রঙ লাগালে আমার হদিশ কত্তে পারবে?
মাথা হেলাল আলেফ, পারব। তা তোমাদের এক সর্দার তো থাকবে, আর তিন তিনটে রানী। আর কেউ থাকবে তোমাদের দলে?
ও বাবা, থাকবে না কেন? নইলে লড়াই দেবে কে? চিফের সঙ্গে ছোট, মেজ – এমনিধারা সর্দার থাকে আরও। কিন্তু তাদের কোনো রানী থাকে না। চিফের উপর দিয়ে তারা কিচু কইতেও পারবে না। এবাদে সবার আগে আগে যায় পতাকাধারী সেপাই। সবার হাতে হাতে ক্রেওল ওয়েস্টের পতাকা। তার পিছুতে অন্যসব সান্ত্রী সেপাই।
এত? সত্যি লড়াই কাজিয়া করবে নাকি?
কত্তেও পারে। গুপ্তচরেরা যদি তেমন কোনো খবর নে আসে। কি ধরোগে দুটো দল মুকোমুকি পইড়ে গেল।
গুপ্তচরও থাকবে? যত শুনছিল অবাক হচ্ছিল আলেফ। উৎসবই তো – শুধুই আমোদ, যুদ্ধ নয়। সেখানেও এত ব্যবস্থা?
ও মা, থাকবে না? নাইলে অন্য দল কোথায় আচে, কোদ্দিয়ে এসে পড়চে, তাদের সাজগোজ অস্তরপাতি কেমন ধারা, তার খবর কে আনবে? ওদের অবশ্য কোনো রঙদার পোশাক থাকে না, নুকিয়ে নুকিয়ে ঘুরতে হবে কিনা। অন্যের দলে কেউ যদি বুজে যায় ওরা কে, বেদম মার খায় বেচারারা।
খবর এনে করবেটা কি? শুনতে শুনতে আলেফ উৎসাহে টগবগ করছিল। ঠিক যেমন পালাগানে দেখেছে। মাথার মধ্যে দেশে থাকতে শোনা জগঝম্প বেজে উঠল, গায়ে শিরশিরি দিয়ে ছবির মত মাচার উপর রাজা-বাদশায় যুদ্ধের তরবারি ঝনঝনিয়ে উঠল। মাচার একধার ধরে হাঁ করে শুনছে বালক আলেফ, গিলছে সব কথা। গুপ্তচর দৌড়ে দৌড়ে ঢুকে খবর দিত, শাহেনশা, শত্তুর শিবির ফেলেচে যোমনা পারে। হাজারে হাজারে ফৌজ ঘুচ্চে, আরবী ঘোড়ায় করে নদীর কিনারে টহল দিচ্চে খোলা তরোয়াল নিয়ে। ব্যস! তারপরে শুরু হত মঞ্চ কাঁপিয়ে আস্ফালন আর তরবারি যুদ্ধ।
হিঁদুদের পরবে মহাভারতের কাহিনী হত, সেখানে গদাযুদ্ধও দেখেছে। আলেফের চোখে পলক পড়ত না। এখানে এমনিধারা লড়াই দেখতে পাবে ভেবেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তার।
পথে যেতে যেতে যুদ্ধ হয়? সবাই দেকতে পায়?
দেকানোর জন্যেই তো করা। এক দল আরেক দলকে রাস্তা ছাড়া নিয়েই সে কত লড়াই বেঁদে যায়। এসে দেকো, কত কাণ্ড হয়।
এবার শুধু অ্যাবিয়েল নয়, এস্রাকও থাকবে শোভাযাত্রায়। তার দলের নাম চিটিমাচা ওয়ারিয়ার।
এস্রাক ভাই কি লড়াইতে জুটবে নাকি? তোমারও অমনি সাজসজ্জা হবে?
না, আমি হচ্চি চিটিমাচাদের গুপ্তচর। আমি আগে আগে গে দেকবো, কে কোতায় যাচ্চে, কোন পথে। কারা কেমন দলে ভারী, ওই খপর এনে দিলে আমাদের চিফ যদি বলে, তকন দলটা ওদিকে ঘুরবে, গিয়ে হুম্বা দেবে।
হুম্বা? সেটা কি আবার।
দেকো তো জানো, আসতে দাও না পরবটা। আগের থে বললে তো মজা মাটি। যদিও এস্রাক সবার মনোযোগ খুব উপভোগ করছিল, আর বলবার জন্য মনে মনে ছটফট করছিল।
নিগ্রোদের দলে তোমায় কেমন করে নিল এস্রাকভাই। জ্যানেট বিবির জন্যে?
এবার এস্রাকের তামাটে গালে খানিক রঙ ধরল। তার সঙ্গে জ্যানেট অ্যাডামসের বিয়ের কথা হচ্ছে। এক প্রকারে সেও এখন নিগ্রোদের সমাজের লোক হয়ে গেছে। ব্রাদার।
হ্যাঁ, ওর বড় ভাই নাথান এবার চিফ হয়েচে কিনা। ওর বউ মাইল্ডি ডারডেন নিজেই তো চিটিমাচা জাতের মেয়ে, চার্চে গিয়ে বে করেচে দু’জনায়। সেও থাকবে এক রানী হয়ে। শুধু কালোদের নিয়ে শোভাযাত্রা নয় তো। যাদের সঙ্গে ওঠা-বসা, তাদের সকলকে সঙ্গে রাকে, আমাকেও নিয়েচে। আমি একন ওদের ভাইবেরাদর।
এস্রাক ভাই, তুমিও কি জাত খোয়াবে, চার্চে জে বে করবে?
সে কি হয়? মোকসাদ চাচাকে বলিচি, নিকাহ পড়াতে।
মোকসাদ চাচা ইমাম হবে? রাজি হয়েচে?
হ্যাঁ, আগেও করেচে। তোরা শুনিসনি। আমাদের সোফুর ভাই নিকা করেচিল আমেরিকাকে। তখনো তো মোকসাদ ভাই ইমাম হল, নিকাহ পড়াল।
আয়েষা ভাবী?
হ্যাঁ, সাদির সময় ওই নাম নিয়েচে, আগেতে নাম ছিল আমেরিকা সান্তাক্রুজ। ভাবীর দেশ ছিল কিউবা, ওরা ক্রেওল হল কিনা।
জানি, জানি। ওরা একন সাভানায় ব্যাপার দেকে আমাদের। আমি আসার আগের সনে চলে গেচিল। মনে পড়ে জয়নালের। দেখতে দেখতে তারও এই দেশে কতগুলো বছর পার গেল।
তিন বচ্ছর থেকে ওখেনে বসত করেচে। ওদের দুই ব্যাটা ইসাক আর মহম্মদ। গেলবার মাল পৌঁছে দিতে গেচলাম, ছেলেগুলো বেশ বাড়ন্ত হয়েচে। তবে দেকে বাঙালি না ক্রেওল বুজবার জো-টি নেইকো।
তা আর কী করবে, এই দেশে বসে তো আর জাতের মেয়ে পাওয়া যাবেনে। দেশে ফেরার কম ঝক্কি? গেলেও যে ফিরতে দেবে তার কোনো হদিশ নেই।
এইসব কথা উঠলেই আলেফ আনমনা হয়ে যায়। তার অপেক্ষায় আমিনা বসে আছে, নিকাহ করার কথা। ছয় মাসে ফিরে যাবে বলেছিল, দ্যাখ না দ্যাখ দুই বছর পার হয়ে যাবে আর ক’মাস গেলে, ফেরার কোনো কূল-কিনারা নেই। যতদিন যাচ্ছে, ফেরাটা আরও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে তার জন্য।
আর অ্যাবিয়েল? ওর কী হবে? ভেবে ভেবে পথের হদিশ করতে পারে না আলেফ। সেই ভয়ে আমিনার দেওয়া কারুকাজ করা হাঁড়িটাও খোলে না সে কতদিন। কী বলবে আমিনাকে? কী জবাব দেবে যদি ফেরার কথা জানতে চায়?
অবশেষে জানুয়ারি মাস এসে গেল। এস্রাক কাকভোরে বেরিয়ে গেছিল। বলে গেছে ট্রেমের সেন্ট অগাস্টিন ক্যাথলিক চার্চের সামনে চলে আসতে। ওখান থেকেই শুরু হবে চিটিমাচা ওয়ারিয়ারের শোভাযাত্রা।
সেন্ট অগাস্টিন আলেফ দেখেছে, গেছেও অ্যাবিয়েলের সঙ্গে একবার। যেসব নিগ্রোরা স্বাধীন ছিল, তাদের অনেকেই হাইতি কি হ্নডুরাস বা ক্যারিবিয়ান থেকে এসেছিল। এরা কোনোদিন দাস ছিল না, তারাই বানিয়েছিল এই ইমারত, সেই সময়ে নিগ্রোদের নিজস্ব, একমাত্র চার্চ। পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। এখন স্বাধীন হয়ে কালোদের সংখ্যা বেড়েছে। গভর্নর নিকলস স্ট্রিটে এসে ওরা দেখল লোক গিজগিজ করছে। সবার গায়ে সবুজ আর লালের পোশাক, বড় বড় সব পালকের। মাঝখানে একটা বেদির উপর দাঁড়িয়ে আছে চিফ আর কুইন।
চিটিমাচা ওয়ারিয়ারের রানী মাইল্ডি ডারডেন চিটিমাচা জাতের বীরগাথা শোনাচ্ছে সবাইকে। সে নিজেই চিটিমাচা জাতির লোক, সর্দারের মেয়ে। তার কাঁধ উঁচু করে দাঁড়ানো, গলার ভেতর থেকে কথা বলা, কি চিবুক তুলে আকাশের দিকে চোখ রেখে তাকানো – সব কিছুতেই সে যে দলপতির মেয়ে ছিল তার জানান দিচ্ছে। সে শুধু শোভাযাত্রার জন্য রানী নয়।
সেই ভঙ্গিতেই সত্যিকারের যুদ্ধে বেরোনোর মত সবাইকে তাতিয়ে তুলছিল কুইন মাইল্ডি:
অনেক অনেক পূর্ণচন্দ্র আগের কথা। আকাশ-পাতাল-অন্তরীক্ষে চিটিমাচাদের রবরবা। তাদের তেজে সব জাতি উপজাতি থরথর।
গলায় যেন দামামা বাজছিল রানীর, ডিগিডিগি ডিগিডিগি। চিফ কিংবা রানী কথা বললে আর কারো টুঁ শব্দ করার নিয়ম নেই, দলে এমনি কায়দা কানুন। কিন্তু মাইল্ডি কথা বললে, এইসব কানুন মনে রাখতে হয় না। শব্দ হাওয়ায় ভাসার আগেই তুলে নিচ্ছিল অপেক্ষায় দাঁড়ানো চিটিমাচা ওয়ারিয়াররা।
সেবার এসেছিল এক ভয়ানক টেকে। কী বিশাল সে চেহারায়! এত লম্বা, তার যেন শুরুও নেই, শেষও নেই। মাইল্ডির বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পিচ্ছিল বিশাল একটা সাপ সরসরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল জমায়েতে।
কেউ একটা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কত লম্বা হবে রানী?
ভাবো, কত লম্বা?
দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দেখায় আর এক জনা। তার সারা গায়ে পালকের পোশাক, হাত ছড়িয়ে গেল যেন দশ ফুট।
এইটুকু? এককণা হাসি ছিটকে পড়ল রানীর পাতলা ঠোঁটের পাঁচিল পেরিয়ে। কক্ষনো না। মাইল দশেক তো হবেই।
জমায়েতের মধ্যে একটা বড় শ্বাস উঠল।
এত বড় সাপ হঠাৎ কোথা থেকে আসল রানী?
সাপ নতুন নয়, ছিল অনেক বছর ধরেই। এমনিতে ঘুমিয়ে থাকে মাটির তলায়, পাহাড়ের গুহায়, মেঘের আড়ালে। যখন জেগে ওঠে, লেজের এক একটা আছড়ানিতে পৃথিবী কাঁপিয়ে তোলে। সেই সাপ যেই জাগবে-জাগবে করছে, কুটনাকিন খবর পাঠাল বড় সর্দারকে – তৈরি হও, টেকে জাগছে আবার। শুনেই সর্দার সবাইকে হাঁক পাঠাল। হুঙ্কার দিল, তৈরি হও, যুদ্ধের সাজ তুলে নাও। বাঁচতে হলে টেকের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
মাইল্ডি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল এবার। জমায়েতে কারোর চোখে পাতা নেই, মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে এই উপকথা, যেন আগে শোনেনি কখনো। খুশি হয়ে রানী আবার ধরল তার বীরগাথা, তার গলার ডিগিডিগি বোল এখন এক ধাপ উঁচুতে।
না আছে কামান, না আছে গোলা। যে যা হাতিয়ার পারল, হাতে তুলে নিল। কুড়ুল, হাতুড়ি, গুলতি, যে যাতে দড়। তীরন্দাজেরা তুলে নিল তীরধনুক, সেই তীরের মাথায় গার মাছের কাঁটা, তাতে ইয়াকা গাছের বিষ মাখানো। তাদের ছিল বর্শা আর তরবারিও। ব্যস! সেইসব নিয়েই লড়াইতে চলল চিটিমাচার বাহিনী। ছেলে, বুড়ো কেউ বাদ গেল না, ঘরে রইল শুধু মেয়েরা আর বাচ্চারা।
তারপর?
তারপর সে কী লড়াই, কী লড়াই! পৃথিবীর মাটি কেঁপে উঠল। আকাশের এক কোনা থেকে অন্য কোনায় আগুন ঝলকাল। গাছেরা নুয়ে পড়ল, কত কত উইগোয়ার চাল উড়ে গেল, দরজা দেওয়াল নিয়ে মেয়ে-বাচ্চা সমেত কোথায় কোথায় ছিটকে পড়ল। দশ মাইল লম্বা সাপ মারা কি মুখের কথা? সে যেমন লম্বায়, তেমনি তার বেড়। তার মাথাখানা তো ইয়াব্বড়। ফনা তুললে পাম গাছের মাথা ছাড়িয়ে যায়, জোরে নিশ্বাস নিলে আকাশের গায়ে কালো মেঘের ঢল নেবে যায়। আর একবার লেজ তুলে আছড়ালে? মাটি দেবে যায়। কিন্তু চিটিমাচারা কোনোদিন কী হেরে ফিরেছে? রানীর গলার ডিগিডিগি এবার দড়াম করে আছড়ে পড়ল জমায়েতের উপর।
ফেরেনি! সমস্বরে চেঁচাল সবাই। চিটিমাচা ওয়ারিয়ারস!
সাপের সঙ্গে যুদ্ধ চলতে চলতে চাঁদ কতবার আকাশে এল, আবার পাতালে লুকাল। কত সেপাই মারা গেল, কত যে হারিয়ে গেল। কিন্তু চিটিমাচাদের আটাকানো যায়নি। শেষ অবধি কবজা হল সেই সাপ। তবু কি মরতে চায়? চাঁদ তিনবার লুকিয়ে তিনবার ফিরে এল, তবে গিয়ে সেই সাপের কালান্ত হল। যেখানে তার শরীর পড়ল, লেজ আছড়ানি দিল, মাটি গেল দেবে। এইভাবে তৈরি হল বাইয়ু-টেকে, চিটিমাচাদের গর্ব বুকে নিয়ে আজও কুলকুল করে বয়ে চলেছে।
এবার চিটিমাচা ওয়ারিয়ারদের চিফ নাথান গলা তুলল। চিটিমাচাদের সম্মান আজ আমাদের হাতে। আমরা কি হেরে ফিরব?
কক্ষনও না।
তাহলে চল সবাই, আমরা এবার পথে নামব। সামনে যারা আসবে, তাদেরকে ওই সাপের মত আছড়ে আছড়ে মারব। নতুন কোনো বাইউ-টেকে তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু কখনোই পিছিয়ে আসব না। মনে থাকবে সবার?
মনে থাকবে সর্দার।
ওরা যদি হাঁক দেয় হু না নে হুম্বা, আমরা কি বলব? চিফের গলায় এখন যুদ্ধের দামামা।
মি নো হুম্বা, ইউ হুম্বা। এই কথাটাই ঘুরে ফিরে চলতে লাগল জমায়েতে। শুনতে শুনতে আলেফ, জয়নাল, বসিররা থরথর করে কাঁপছিল। কী এক অজানা উন্মাদনা, কী হবে কী হবে ভাব। এটা যে কেবল উৎসব, একটা খেলা – সেসব মনে থাকে না আর। ওদের মনে হচ্ছিল চিটিমাচারা যুদ্ধে যাচ্ছে, কোথাও একটা ভীষণ লড়াই হবে, আর তাদের কী ভাগ্য এসব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
প্রচুর হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে চিটিমাচা ওয়ারিয়ারের সর্দার, রানী আর তাদের পিছন পিছন সব যোদ্ধারা পথে নামল গান গাইতে গাইতে-
Mighty cooty fiyo...
Here comes my big chief,
Big chief, big chief of the Indian Nation,
The whole wild creation.
And he won’t bow down,
Not on that dirty ground.
এইসবের মধ্যে এস্রাক ছিল দলের আগে আগে, সে আর অন্য গুপ্তচরেরা। এস্রাকের শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছিল। সেটা শুধু চিটিমাচা উপজাতিদের গর্বকথায় নয়। সে যে এখন এদের মধ্যে একজন, এই দেশের একজন লোক হয়ে গেছে – সেটা তার মনে এক অদ্ভুত জোর এনে দিচ্ছিল। যেটা নিজের গ্রাম, নিজের প্রিয়জন, নিজের দেশ ছাড়ার পরে আর পায়নি।
কেমন লাগচিল জানো আলেফভাই? ঠিক যেন নিজের দেশে গাঁয়ে ফিরে গেচি। বাইরের নোক মনে হয় না কো।
আমাদের দেশ গাঁ তো ভেন্নই এস্রাক ভাই, অন্য মাটির নোক আমরা।
খাওয়া থামিয়ে সোজা চোখে তাকিয়েছিল এস্রাক। সে যকন ছিল, ত্যাকন ছিল। আঁকড়ে পড়ে ক’দিন থাকবে আলেফ ভাই। এই দেশেই ভাই-বেরাদর বানাতে হবে। শিকড় চারাতে হবে যদি থাকতি চাও।
আলেফ কি চায় সেটা? নিজের খাবার পাত্রে চোখ রাখল। এই দুটো অন্নের জন্যে আর কত কিছু ছাড়তে হবে?