কী খাবে তোমরা? ... অ্যাঁ, সন্তু, কী খাবি? আগে মোমোটাই নিয়ে নিই, কী বলিস?
বলে তপোব্রত সন্তুর দিকে তাকাল। সন্তু, একবার অপরা একবার তপোব্রতর দিকে তাকিয়ে, রঙিন প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, 'যা তোর খুশি'।
চাণক্যপুরীর এই রেস্তোরাঁগুলো দারুণ। ওপেন এয়ার। ছোট ছোট ঝুলন্ত বাতির তলায় লাল নীল চেয়ার । দিব্যি ঘরোয়া।
সন্তু দোকানের সামনের দেওয়ালে লেখা বিভিন্ন ভাষার আঁকিবুঁকিগুলো পড়ছিল। এখানে সব রেস্তোঁরার দেওয়ালেই, ইংরিজি ছাড়াও আরো কোনও একটা ভাষায় লিখিত বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়বে। অধিকাংশই রুশভাষা। ট্যুরিস্টরাই বেশি আসে চাণক্যপুরীর এই সস্তার তিব্বতি খাবারগুলোর ঠেকে। ওদের পাশের টেবিলেই দুতিনটে ঘোড়ামুখো সাদাচামড়া। রাশিয়ানই হবে। কাছেই একটা এস টি ডির হলুদরঙা বুথ। সন্ধ্যা সাড়ে আটটার পরে এখন হাফ রেটের ভিড় তার সামনে।
তপোব্রত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেনুকার্ড পড়ছিল। চিকেন মোমো পঁচিশ, পর্ক মোমো কুড়ি। পর্কটা অর্ডার দিতে গিয়ে কিছু একটা মনে হওয়ায় থমকে গেল, আর সন্তুর দিকে তাকিয়ে, গেলাসের গায়ে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটায় ব্যস্ত অপরার দিকে তাকিয়ে, তারপর শূন্যে ছুঁড়ে দিল কথাটা : পর্ক মোমোই নেব ত?
আসলে সন্তু পর্ক খায় কিনা সেটা তপোব্রতর মনে পড়ছিল না এই মুহূর্তে। বহু বছর পর সন্তুর সঙ্গে এরকম বাইরে খেতে আসা। কলকাতায় গেলে ওর সঙ্গে খেতেটেতে যাওয়া হয়ই না বড় একটা, আর দিল্লিতে ত সন্তু এল বলা চলে সেভাবে এই প্রথম, মানে তপোব্রত চাকরি পাওয়ার পর প্রথম। তাও আবার একা না, অপরাকে নিয়ে। শেষবার এইট্টি নাইন টাইনে হবে, তখন তপোব্রত দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে। ছাত্রাবস্থা।
তপোব্রত সন্তুর উত্তরের জন্য সন্তুর দিকে তাকালো। অপরা, সন্তুর বান্ধবী, পাশের টেবিলের কীর্তিকলাপ দেখতে ব্যস্ত। সন্তুর মুখ ভাবলেশহীন। ব্যাটা বামুনের ছেলে। অন্তত টাইটেল তাই বলে। পৈতেটা বহুবছর আগেই বিদেয় হয়েছিল। পর্ক? বিফ খেয়েছিল একবার কলুটোলায় আলির দোকানে। সন্তু এমনিই কথা কম বলে। কাজের কথা আরো কম। সুতরাঙ উত্তরটা এল না।
কলকাতায় তুই ত পর্ক সালামি খেয়েছিস লা প্রোটিনার... মনে পড়ছে যদ্দূর। আর ও? ও পর্কটর্ক খায় ত নাকি? অপরার দিকে তর্জনী তুলে তপোব্রত দেখাল।
সন্তু আবার নিরুত্তর। অপরা গেলাসটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। ধূসর হয়ে আসা টেবিল ম্যাটে নৃত্যরত জাপানি মেয়ের ছবির ঊওপ্রে গেলাসের গোল দাগটার ওপরে। তারপর তপোব্রতর দিকে প্রায় না তাকিয়, খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে, প্রায় উড়োমন্তব্যের মত করে বলল, আমি পর্ক খাই কিনা তা ও কি করে জানবে? ও আমার মালিক নাকি?
তারপর সন্তুর দিকে ফিরে, এসে বলল, কি , তুমি জানো নাকি , আমি পর্ক খাই কি না? এ নিয়ে কোন কথা হয়েছে বলে ত আমার মনেই পড়ছে না।
চোখা চোখের তলায় ছিলবিল করছিল ব্যঙ্গ। সন্তুর শান্ত চোখেও এবার হাসি ছড়াচ্ছে, মৃদু, খুব মৃদু। তপোব্রত অপ্রস্তুতের মত, সামান্য। অপরার সংগে সন্তুর প্রেম বোধ হয় কয়েক মাসের। অপরাকে সঙ্গে নিয়ে সন্তু দিল্লি এসেছে। এটা ঠিক, সন্তুই বেসিক্যালি তপোব্রতর বন্ধু, আর অপরাকে ও প্রায় চেনেইনা, এটাও ঠিক। তাহলে? প্রশ্নটা সন্তুকে করায় কি দোষ হয়েছে কিছু? সরাসরি অপরাকেই করা উচিত ছিল? অপরার কি খারাপ লাগল ব্যাপারটায়? না এমনি, ফচকেমি করছে শুধু? মুখ দেখে ত বোঝা যাচ্ছে না, অথচ কথাটা আলটপকা বল্লেউ তার মধ্যে এক ধরনের ঠেশ আছে। সামান্য ঝাঁঝালো। "আমি"র ওপর একটু বেশি জোর।
তপোব্রত একটু অফ হয়ে গেল, একটু অন্যমনস্ক। আমি -টা বেশি এই মেয়েটার। কেমন, মেয়েটা? এই অপরা? একটু কৈফিয়ত দেবার মত করে তপোব্রত বলল, আসলে প্যাট্রিয়ারকাল সোসাইটি ত। তাছাড়া তুমি ওর সঙ্গে এসেছো। তাই ওকেই জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবে ভাবলাম, বুঝলে না?
হাসি মেলালো না মুখ থেকে, কিন্তু অপরা যেন কিছু একটা বলতে গিয়েও মুখ বন্ধ করে নিল। কী বলতে যাচ্ছিল সেটা বুঝল তিনজনেই। একটু অস্বস্তিকর নীরবতা এখন খেলা করছে তিনজনের মধ্যবর্তী শূন্যতাটুকুতে। সন্তু এতক্ষণ কিছু না বললেও এখন আরো একটু বেশি চুপ যেন, তার কথা ঘুরে গেল, কথা ঘুরে যাচ্ছে, কথা ঘুরে গেল তপোব্রতর মায়ের দিকেঃ মাসিমা জানেন? আমার মা, বুঝলি ত, বাড়িতে পর্ক ঢুকতে দেয় না, আমার এক চিনেপট্টির বাসিন্দা স্টুডেন্ট একবার অসাধারণ পর্ক চপস দিল, বারান্দায় লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম...
'চাউমিনটা অসামান্য।' গোগ্রাসে খেতে খেতে অপরা বলল।
'মোমোটা চমৎকার।' সন্তু ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁট মুছল। তপোব্রতর একা লাগছিল। সামান্য একা। পুরনো বন্ধুকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। এমনিতেই শান্ত সন্তুকে যেন একটা জবরদস্ত নিষ্ক্রিয়তা পেয়ে বসেছে। এই সন্তু গরম গরম বিপ্লবী কবিতা লিখত! অপরাকে ডিটো দেওয়া ছাড়া যেন এখন ওর কোন কাজ নেই। কেন এমন হয়?
সকালে যখন তপোব্রতকে প্রায় ঘুম থেকে তুলে চমকে দিয়েছে আচমকা দুজনে, তখনই আশ্চর্যভাবে চোখের ওপর ফুটে উঠেছে ব্যাপারটা। কী ব্যাপার, এখুনি রাজধানী থেকে নামলি নাকি? কোন খবর না দিয়ে... হেসেছিল তপোব্রত, সন্তুটা এমন আনপ্রেডিক্টেবল - কাজকম্মোগুলো এমন অদ্ভুত ওর! কিন্তু ওরা যে সেদিনই ট্রেন থেকে নামেনি সেটা বুঝতেও বেশি দেরি লাগেনি ওর, দুজনেই স্নান করে এসেছে, পাটভাঙা জামাকাপড় পরে, তার মানে, তার মানে...।
অপরার সঙ্গে এখুনি ইনট্রোডিউস করান হয়েছে তপোব্রতকে। তবু অনাড়ষ্টভাবে অপরাই বলে দিল, রাজধানী থেকে নামতে যাব কেন, আমরা ত দু'দিন আগেই দিল্লি এসে গেছি...
সন্তু ঠান্ডাভাবে বলল, আসলে তোকে করব করব করেও ফোনটা করা হয়নি। ... পরশু থেকে ভাবছি... তারপর ভাবলাম সারপ্রাইজ দেওয়াই ভাল।
ছিলি কোথায়? তপোব্রতর রাগ হয়েছে সামান্য তবু পাল্টে যাওয়া বন্ধুকে নিয়ে রাগ করেই বা কী লাভ, ও বুঝে নিয়েছে যে ওরা কোন একটা হোটেলে গিয়েই উঠেছে... হ্যাঁ বন্ধুর বাড়ির থেকে বেশি প্রেফার করেছে ওরা হোটেল... সন্তু একা এলে তপোর বাড়িতে বডি ফেলা ছাড়া আর কিছু ভাবাই যেত না ...
এই ত, ওখলায়, একটা গেস্ট হাউজে। অপরা অ্যারেঞ্জ করেছে।
ভাল?
হেব্বি! এসি রুম। বত্রিশ পাটি বের করে হাসল সন্তু।
দুপুরে খেতে বসেছে যখন ওরা, তপোব্রতর মা আসল কথাটা না বলে আর থাকতে পারেন নি : সন্তু, এত বছর ধরে তোমাকে বলছি এস, একবার ঘুরে যাও, এতদিনে তোমার সময় হল বন্ধুর বাড়িতে আসার...
তপোব্রতর আঙুল ঘুরছে ভাতের ওপর, ডাল শেষ হয়ে গেছে কখন, মা মাছের ঝোল দিতে ভুলে গেছে, ঈষৎ অধৈর্য, তপোব্রত তাকাল মায়ের দিকে - ছাড় ত মা, অপরা দিল্লিতে কাজে এসেছে তাই ও এসেছে, নইলে থোড়ি না ওর দায় পড়েছে...। দেখি , ঝোলটা দাও...
সকালে চা খেতে খেতে বলা অপরার সেই ধাক্কাদেওয়া শব্দগুলো কান থেকে মুছে যাচ্ছে না কিছুতেই, আর তাই, তেতো গিলে ফেলার মত প্রসঙ্গটা শেষ করতে চায় তপোব্রত।
"আরে আমি আবার কখন সন্তুর সঙ্গে এলাম - সন্তুই আমার সঙ্গে এসেছে - একটা সেমিনার পড়ে গেল , তাই - '
কী ক্যাজুয়াল ভঙ্গি, কী চোখে আঙুল দেওয়া নাক উঁচুমি অপরার কথায়, বিশ্রি লেগেছিল তপোব্রতর। সাময়িকভাবে সন্তুর জন্য মায়া হয়েছিল। এ কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ল?
দুপুরে ওরা বেড়াতে বেরিয়েছিল। অনেকগুলো রাস্তা হাঁটা হল। আজকাল তপোব্রতর একা একা সিনেমা দেখা, একা একা নাটকে যাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে, শুধু বাইরে খেতে যাওয়ার সময়ে একা একা যাওয়া যায় না। কতদিন পরে এভাবে বন্ধুদের নিয়ে বেরন, গোটা রবিবার জুড়ে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি... আজকের দিনটাই শুধু। আগামীকাল ওরা ফিরছে। ঝটিকা সফর।
চাণক্যপুরীতে খেতে যাবার আগে, সরোজিনীনগরে যাওয়া হয়েছিল। মার্কেটিং করবে অপরা।"পকেট সামলে রাখিস" চাপা গলায় বলে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল তপোব্রত... পেছনে অপরারা সেরদরে বিক্রি হওয়া শার্ট পেন্টুলুনের হাঁকাডাকির ভেতরে আস্তে আস্তে আসছিল। তপোব্রতর ভেতরে এখন একটু খানি ফাঁকাভাব। দীর্ঘদিন একটি মেয়ের সঙ্গ না করার জ্বলন। ঈর্ষার ছোট্ট শিখা বুকের মধ্যে ছোট্ট জিভ বুলোচ্ছে। আচমকা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মোমবাতির শিখা। তৃষা চলে গেছে বছর খানেকের ওপর হয়ে গেছে। শেয়ালদা কোর্টে এখন ঝুলছে দুটি দেওয়ানি একটি ফৌজদারি। দুটো মানুষের মধ্যে তৈরি একটা সম্পর্ক, আচমকা তার একার ওপর এক তরফা দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কলকাতায় চলে গেল তৃষা। আর চমৎকার প্রশাসনিক তৎপরতায় আর দ্রুততায় দিল্লিতে তার বাড়িতে চলে এল এক প্রস্ত উকিলের চিঠি। ভারি সুন্দর বন্দোবস্ত। পরে, অনেক পরে, যখন উকিল নিয়োগ করা আর টাকাকড়ির সংস্থান করার ঝামেলায় জেরবার সে, বোঝা গেল আইনগুলো সবই এখন মেয়েদের দিকে...
সুলগ্নাকে আজ আর মনেই পড়েনা। বিয়ের কথা প্রায় ঠিক, সুলগ্না একদিন বলেছিল, তপোব্রত, আমার আর পোষাচ্ছে না। সেও কিন্তু কোন এক্সপ্ল্যানেশন দেয়নি যাবার সময়ে। মেয়েরা দেয়না।
তপোব্রত যখন বার বার ফোন করে সাড়া না পেয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন সকাল সকাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে সুলগ্নাকে ধরেছিল, দাবি করেছিল কী হয়েছে বলতে হবে, সুলগ্না বলেছিল, তোরা ছেলেরা সবাই এক রকম। তোদের অগাধ আস্থা নিজেদের এনটাইটেলমেন্টের ওপরে। সবকিছু পেয়ে যাবি। ছেলের হাতের মোয়া। এভাবে হয়না। এই সম্পর্কে সব অ্যাডজাস্টমেন্টের দায় আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিস কেন? তোরও কিছু করা দরকার। তোকেও কিছু ছাড়তে হবে। আমি একলা ছাড়ব না...
-কী ছাড়তে হচ্ছে তোকে? তপোব্রত বিস্ময়ে আকুল হয়ে যায়। সুলগ্না যে কোথাও ভুল বুঝছে সেটা স্পষ্ট ওর কাছে।
-সবকিছুই। তুই কেড়োরিমল কলেজে চাকরি পেলি, দিল্লিতে সেটল করছিস, তাই আমাকেও দিল্লিতে শিফট করতে হবে। ইকনমিক টাইমস -এর গোয়ালিয়র করেসপন্ডেন্টের পোস্ট ছাড়তে হবে। ওরা জয়েনিং ডেট দিয়ে দিয়েছে আমাকে এদিকে! ছাড়লাম সেটা। বাবার বয়স হচ্ছে, দেখভাল করার লোক নেই, তবু আমার বাবাকেও ছাড়তে হবে। তোর সঙ্গে তোর বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে।
এগুলোকে তুই ছাড়া বলছিস? কী এমন ছাড়া! আমরা একসঙ্গে থাকতে চাইলে এটুকু ত করতে হবেই। বিয়ের জন্য তুই কি এগুলো পারিস না?
কই, তোকে ত চাকরি ছাড়তে হচ্ছে না, তোকে ত নিজের মাকে ছাড়তে হচ্ছে না?
কী ছেলেমানুষি এসব। এটা একটা কম্পেয়ার করার বিষয় হল? হাসতে থাকে তপোব্রত, বিরাট দুশ্চিন্তা আর চাপের মধ্যেও তার অদ্ভুত হাস্যকর লাগে কথাগুলো। এই প্রশ্নগুলো ওঠে কোথা থেকে?
সুলগ্না হাসে না। খুব শান্ত, প্রায় ছুরির মত শীতল ধারাল গলায় বলেঃ তাহলেই দ্যাখ। এগুলো যে ইস্যু হতে পারে, এটাও তোর বোধে আসছে না। তোর কাছে এভরিথিং ইজ টেকেন ফর গ্রান্টেড। এই জন্যেই তো আমার পোষাল না তোর সঙ্গে, তপো। এভাবে প্রেম হয়না।
রাগ, রাগ, অক্ষমের মত রাগ হয়েছিল সুলগ্নার ওপরে তখন। মেয়েটা ভাবে কী? তার আটবছর পর, দ্রুততায় সম্বন্ধ করে বিয়ে করার পর, সুশীলা , গৃহকর্মনিপুণা তৃষাকে অধিকার করার পর, একটি সন্তানের বাবা হবার পর, উকিলের পত্রাঘাত শ্বশুরবাড়ির বানানো দোষারোপ সবকিছুর পর, রাগটাও আর হয়না তপোব্রতর ... মাঝে মাঝে বিশ্রী জ্বালা হয় শুধু। মেয়েদের কিছু একটা হয়েছে।
সন্তু গেছে ওর সঙ্গে কয়েকবার। কোর্টের হিয়ারিং-এ। ও ত সব জানে। অপরা কি জানে? অপরা সত্যি কেমন মেয়ে? সন্তুটা ঠান্ডা, মাঝে মাঝে ফিচলেমি করে। আদার ওয়াইজ দারুণ বুদ্ধিমান। যেটুকু দেখেছে তপোব্রত, অপরার খুব চাকরির গরম। সন্তুর নির্বিরোধ পিসফুল অধ্যাপক জীবন যাপন, কবিতা লেখার সঙ্গে ত প্রথমত সেটাই মেলেনা, তারপর...
কে জানে, ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক। তপোব্রতর এখন মনে হয় সবকিছুই থোড় বড়ি খাড়া - খাড়া বড়ি থোড়। প্রেমট্রেম কিছুই হয়না। শরীরটা ইম্পরট্যান্ট, কিছুদিন সেটা নিয়ে ঠিকঠাক চলে, তারপর সব কলগুলো বিগড়োতে থাকে, তেলহীন যন্ত্রের মত...
তোমার কোর্টশিপ কেমন চলছে? ইয়ার্কি করে বলেছে অপরা। মেয়েটা পাগলের মত বাজার করেছে। শুধু সন্তুর জন্য। প্যান্ট কিনল, দুটো শার্ট। পিঠে ফেলে ফেলে যখন শার্টের মাপ মেলাচ্ছে তখন সন্তুর অমন বাধ্য ভঙ্গিতে পিঠ বাড়িয়ে দেওয়া দেখে হাসি পাচ্ছিল ওর। করে নাও, করে নাও যদ্দিন পারো।
একটা দামি চামড়ার বেল্টও কেনা হল। সত্যি বেল্টটা ভালো। অপরার চয়েস। দেখে লোভ হল। তপোব্রতও কিনল নিজের জন্য একটা, তারপর মন খুঁতখুঁত : ধুর, কী হবে এত দামি বেল্টে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার কিম্ভুত লাগছিল। মেয়েরা এত পণ্য চেনে, এত কিনতে ভালবাসে। অপরা নিজের জন্য কিনছে না অবিশ্যি, তবু একদিনে সন্তুকে ফুলবাবু সাজাবার চেষ্টা কেন?
বেল্টটা ঘ্যাম হয়েছে, না তপোব্রত? অপরা তৃপ্ত গলায় বলল।
হ্যাঁ, ভাল। ঠোঁট দুমড়ে হাসল তপোব্রত। সন্তুর দিকে ফিরে একটু চোখ মেরে বলল: বউ পেটানোর পক্ষে আইডিয়াল।
হেসে উঠল অপরা। "তোমার বেল্টটা ত তাহলে জলে গেল!"
প্রত্যেক ব্যাপারে অপরার একটা করে কমেন্ট করা চাই।
বাড়ি ফেরার পর লম্বা হয়ে শুয়েছিল ওরা বসবার ঘরের মেঝেতে। মাটিতে ম্যাট্রেস পাতা। কয়েকটা কুশন ছড়ানো। তিনজনেই পা ছড়িয়ে। অপরার কোন আড়ষ্টতা নেই। সালোয়ার কামিজ পরা পা দুটো বেতের চেয়ার লটকানো। আগে এসব দেখলে দিব্যি ইম্প্রেসড হত তপোব্রত। এখন মা ঠাকুমার মত কন্টকিত হয়ে ওঠে। একটু বেহায়া অশালীন মনে হয় অপরাকে। মেয়েদের মেয়েমেয়ে থাকাই ভাল বলে মনে হয়। দূরত্ব, সম্ভ্রম, ব্রীড়া...
কলকাতায় কী কী চলছে রে? সন্তুকে জিগ্যেস করছিল তপোব্রত। অনেকদিন কলকাতা ছাড়া। কারা কবিতা ভাল লিখছে এখন, কারা গান গাইছে? সুমনের কী খবর? জয় গোস্বামী দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার পেলে? ঋতুপর্ণর নতুন সিনেমাটা কেমন হল?
সন্তু বলল, দুহাজার পড়তে না পড়তে বাঙালিরা চমকাবে। কোন একটা কাগজে দিয়েছে যে, যে দশজন বাঙালি দুহাজার সাল শাসন করবেন, তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে জয় গোস্বামী, ইন্টারন্যাশনাল ফিগার হতে আর বেশি দেরি নেই।
তপোব্রত উঠে বসে সিগারেট ঠুকছিল বাক্সের গায়ে। "আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং? আর কে কে আছে রে ঐ দশজনের মধ্যে?"
আছে আছে আরো আছে, ঈষৎ ঢুলু ঢুলু ভাবে বলল সন্তু ... হাত বাড়াল সিগারেটের জন্য। মাসিমা শুতে গেছেন ত? ইশারায় ভেতরদিকে একবার ঘুরিয়ে আনল চোখ। বড় একটা হাই তুলল মুখ বিকৃত করে।
"তুই যাদের কথা ভাবছিস, তপোব্রত চৌধুরী আর সনৎ মুখোপাধ্যায় ত থাকছেই।"
দুজনেই হো হো করে হাসল খানিকটা। তপোব্রত চৌধুরী! বাহ। সনৎ মুখোপাধ্যায়। গপ্পোটা ভালই। এমন নির্দোষ হাসি বহুদিন হাসেনি তপোব্রত। বহুদিন ।
অপরা চুলের ক্লিপ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। হাসতে হাসতে উঠে বসল। সত্যি তপোব্রতর অনেক সম্ভাবনা ছিল কলেজে পড়ার সময়। অর্থনীতি নিয়ে অরিজিনাল কাজ করার ইচ্ছে ছিল। আর সনৎ? অপরা মুঠি করে চুলটাকে একসাথে করে ক্লিপ আটকালো। সনৎ, মিষ্টি ঠান্ডা সনৎ, কবিতা লেখে ত এখনো। অপরা এবার ব্যাগ টেনে নিয়ে কী যেন বের করছিল।
সন্তুর পরস্পর পিঠ চুলকনো সমিতি দারুণ পটকা ফাটিয়েছে। এখনও ওদের ঐ হাসির নরম বুদ্বুদ ঠোঁটের কোনায় কোনায় ... অপরা টুথব্রাশে পেস্ট লাগাতে শুরু করল... তোমাদের মেমরির কী দুরবস্থা! দুহাজার সাল শাসন করার জন্য আর একজন মেজর ক্যান্ডিডেট ছিল কিন্তু - তার নাম করতে তোমরা ভুলেই গেলে!
কে? সন্তু সত্যিই আগ্রহী।
কে বলত মালটা? গদির ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে উঠে বলল তপোব্রত। সত্যিই কোন মূল্যবান কবি বা গায়ক বা সায়েন্টিস্টের নাম ওরা ভুলে যাচ্ছে মনে করে তাকাল সন্তুর দিকে।
কেন? অপরা দাশগুপ্ত?
গজেন্দ্রগমনে অপরা উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। জামা চেঞ্জ করবে, শোবে এবার। হাতে ধরা নাইটি।
যবনিকা পতন। হঠাৎ নীরবতা। বাথরুমে দরজা আটকানোর শব্দ হল শুধু।
আজ বাদে কাল যার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বাজারে বেরোচ্ছে সে ত কথাটা বলতেই পারে। আটলান্টিস মিউজিক। তিরিশ টাকা। তুমি রবে নীরবে।
অপরার দেওয়া ধাক্কাটা তপোব্রতর ভেতরে আর একবার জ্বালা ধরায়।
মেয়েদের যে কী হয়েছে!
( ১৯৯৮ এ প্রথম প্রকাশিত)