কবি জীবনানন্দ দাশের অসংখ্য লেখা কাগজ ডায়েরি খাতা যা তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে, বহু বহু পরেও আবিষ্কৃত, কীটদষ্ট, তাদের পাঠোদ্ধার পর্বের পরবর্তীতে, দিনলিপির কাগজগুলি আর প্রকাশিত অপ্রকাশিত লেখাগুলি জুড়ে জুড়ে, একটার সঙ্গে আর-একটি মিলিয়ে, গড়ে তোলা এক জীবনানন্দ অবয়ব— এ আলোচনার এক্কেবারে গোড়াতেই এককথায় বলতে পারি এটিই, আমার মতে, গৌতম মিত্রর লেখা ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়ের: জীবনান্দের খোঁজে’ বইটির উদ্দিষ্ট। অতঃপর যা লিখব তা একেবারেই এক মন্ময় বা সাবজেক্টিভ পাঠপ্রতিক্রিয়া।
গৌতম মিত্রের সঙ্গে জীবনানন্দের অসংখ্য অপ্রকাশিত রচনার পুনরুদ্ধারক ভূমেন্দ্র গুহের সম্পৃক্তির কথা আমরা কিছুটা জানি, আর এও জানি যে সেই প্রকল্পে ভূমেনবাবুর সহযোগী থাকাকালীন অর্জিত তাঁর যে ঋদ্ধিসিদ্ধি, সেটাই এতদিন পরে, ভুমেনদার অকালপ্রয়াণের পর, কাজে লেগেছে এই বইতে।
আমার পাঠে, এ বইটিতে গৌতমবাবু প্রশ্ন তুলতেই বেশি চেয়েছেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বা নিরসন করতে চাননি। কিন্তু প্রশ্নগুলো তোলার পথটা অতি মোলায়েম, মরমি, ভাববাদী... বস্তুবাদী নয়। তিনি নিজের পাঠরচনা করতে করতে পথ চলেছেন। তিনি জীবনানন্দকে ডায়েরি ও লেখা মিলিয়ে ভেতরের দিক থেকে পড়েছেন, পড়তে চেয়েছেন।
আর তাই, আমাদের মতো আকাট মূর্খেরা, জীবনানন্দে অধিগৃহীতরা, যাদের কাছে জীবনানন্দ একটি মিস্টিক গুরুপ্রতিম অস্তিত্ব, যাদের কাছে ঐশ্বরিক বলে বলীয়ান জীবনানন্দ এক বিশাল আকাশ রচনা করে, আকাশ ব্যেপে থাকেন, তাদের কাছে এ বই সাধনভজন হয়ে যায়, এ বই মিস্টিক আনন্দদায়ী। এ বই একেবারে রোমাঞ্চে রোমাঞ্চে ছাওয়া। গৌতমবাবু নিজের বইয়ের প্রথম রচনাটিতেই লেখেন, ‘জীবনানন্দকে নিয়ে স্থান-কাল-পাত্র ধরে ধরে একরৈখিক ভাবে কোনো গ্রন্থ নির্মাণ আমার কাছে অকল্পনীয়। যখন যেমন ভাবনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, বিধ্বস্ত হয়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি, লিখে গেছি।’
জীবনানন্দ দাশের ‘মৃত্যু’ কবিতার পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা (আনুমানিক ১৯৩৯)
বইটির মূল আধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডায়েরির পাতার সঙ্গে লেখা কবিতা ও উপন্যাসগুলির সংযোগ স্থাপন এবং একটা বিশাল ক্যানভাসে জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন থেকে কবি-স্রষ্টা জীবনের দিকের যাত্রাপথটাকে মানচিত্রায়িত করার চেষ্টা। খটকার জায়গাগুলো তোলা। এখানে মনে পড়বে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির যে কোডেক্স-এর পাতাগুলি আছে সেগুলির কথা। জাবদা খাতা বা খসড়া খাতার প্রাপ্ত ছেঁড়া পাতাগুলিকে না বাঁধাই করে আলাদা আলাদা করে নম্বর দিয়ে কোডেক্স হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর সেইসব পাতায় তাঁর মনের ছোটো ছোটো ভাবনা, দিনপঞ্জি, উদ্ধৃতি, আঁকা/স্কেচের টুকরো থেকে দা ভিঞ্চিকে বোঝার চেষ্টার বিপুল আয়োজন, তাঁর গোটা জীবনকে ছকে ফেলার প্রচেষ্টা। যেখানে মায়ের শ্রাদ্ধের ফর্দের মোমবাতির সংখ্যাও বাদ যায় না। এই বই বাংলায় জীবনানন্দকে বোঝার জন্য তেমনই এক আয়োজন। হয়তো সম্পূর্ণ বা শেষ কথা না, হয়তো লেখকের তা অভীষ্টও না।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-র কোডেক্স লেস্টার-এর একটি পাতা (প্রকাশ ১৫১০)
বইয়ের শিরোনাম ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি’ আর উপশিরোনাম ‘জীবনানন্দের খোঁজে’। এই উপশিরোনামটাই বলে দেয় যে, গৌতম মিত্র একটা অভিযাত্রায় বেরুচ্ছেন। তিনি কোনো লক্ষ্যে পৌঁছোবেন কি পৌঁছোবেন না সেটা আলাদা কথা। পরের কথা। কিন্তু সব ধাঁধার উত্তর তাঁর কাছে আছে এমন কোনো দাবি তিনি করছেন না। ধাঁধাগুলোকে আগে খুঁজে নেবেন তিনি তারপর উত্তরের কথা পরে।
বইটির এক একটা সেকশন আমার আগে পড়াছিল, কিছু কিছু অসামান্য ফেসবুক পোস্টে। যথেষ্ট চিন্তিত শিক্ষিত অভিধীত নির্মিতির সাক্ষর এই প্রতিটা অংশে বা সেকশনে আছে। কিন্তু সেই শিক্ষার আলুপটলগুলো চেয়ে চেয়ে নেই। সেগুলো রান্না হয়ে মিলেমিশে গেছে। একটা অপূর্ব সম্মেলক সুর আছে সেখানে। নিজের পাঠ, নিজের আগেকার অন্য লেখককে পড়া, জীবনানন্দের ডায়েরির অংশ, জীবনানন্দের নানা লেখার অংশ, মিলেমিশে আছে। এখানে লেখক গৌতম মিত্র কেবলমাত্র সংগ্রাহক ও টীকাকার নন। কালিদাসের মৌলিনাথ না তিনি। তিনি আর-এক কাব্য রচনা করছেন এখানে। একটা বয়ান হয়ে উঠছে যা জীবনানন্দকে উদযাপন করছে।
মনে করুন ভিনসেন্ট ভান গখের ছবির সেলিব্রেশনে তৈরি Loving Vincent ছবিটি (ছবিটি দেখতে আলোচনার শেষে দেওয়া লিঙ্কে যান)। আমার তো এই ২০১৭-র স্বাধীন রচনাটির কথাই মনে পড়ল যা ভিনসেন্ট ভান গখ-কে ট্রিবিউট দিতে দিতে নিজেই হয়ে যায় শিল্প । তার নিজস্ব চলন থাকে। যে ছবির প্রতিটি ফ্রেমই ভান গখের ছবির অবয়ব পায়... অথবা, ফ্যান-শিল্প বা ভালো অর্থে স্পুফ হয়ে ওঠে... । গৌতম মিত্র তেমনি প্রতি অংশে এক একটি স্বাধীন রচনা তৈরি করেন।
বিপুল জনপ্রিয়তা, সংস্করণ শেষ হয়ে যাওয়া, দশমাসের মাথায় দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ, তা তো গৌতমের পদ্ধতির সাফল্যকে দেখাচ্ছে বটেই। আমাদের অধিগ্রহণ করছে কোনো একভাবে। বহুদিন মনে এক বাসনা, আমাদের বাঙালি চেতনায়, কবিতাপ্রেমীর চেতনায় জীবনানন্দ যেমন নেশা, যেভাবে ঝুঁঝিয়ে পড়ে তাঁর হেমন্তবিষাদের মদ, রূপসী বাংলার মদের অসামান্য নেশা আমাদের ভেতরে যেভাবে চারিয়ে রয়েছে আজও... সেগুলো সব নিয়ে তো জীবনানন্দের এক বায়োপিক কেউ রচনা করতেই পারেন। ভাগ্য ভালো সে রচনা কেউ করে ফেলেননি, কারণ পদার্থটা কী দাঁড়াত এখন ভাবতে ভয় করে। তবে গৌতম মিত্রের এই বই যেন সেপথেই খানিকটা হাঁটল। বাস্তবের কবি আর কল্পনার কবিকে খানিক মিলিয়ে দিল অসংখ্য প্রশ্ন তুলে তুলে।
সেঅর্থে গৌতম আর-এক জীবনানন্দ মিশনারি। ভূমেন্দ্র গুহের পর। একথার অর্থ বোঝা যাবে গৌতমের লেখা মিশনারি নিয়ে ওঁর আলোচনায়, সে অংশের নাম ‘সন্দিহান লাক্ষা সৌধ’।
২
‘ইতিহাসের এই পর্যায়ে সাহিত্যে আধুনিকতার বাহক হয়ে উঠল বই। বই তো শুধু লেখা দিয়ে ভরা কিছু পাতার সমাহার নয়। বই আত্মপরিচিতির বাহক। বইয়ের রচনার গায়ে অনুস্যূত হয়ে থাকে রচয়িতার আত্মা। রোমান্টিকদের আগে কবিতা ছিল বার্তাবহ, বক্তব্যনির্ভর, বাগ্মিতাধর্মী। কবি কবিতার মাধ্যমে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি, চিন্তা, কাহিনি ইত্যাদি তুলে ধরতেন। সেখানে কবিতার ‘আমি’ আর কবির মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। কবি যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন শ্রোতা বা পাঠককে তার ভাব ব্যক্ত করবেন বলে। রচনাকারের কাছে পাঠকের একটা স্পষ্ট মুখচ্ছবি ছিল। রচনাকারের ব্যক্তিগত বৃত্তেরই অন্তর্ভুক্ত তারা।প্রথম যুগের রোমান্টিকরাও অনেকাংশে বয়ে চলেছিলেন এই বাগ্মিতার পরম্পরা। ১৮৫০-পরবর্তী যুগে বাগ্মিতা থেকে ঢের দূরে সরে গিয়ে সাহিত্য হয়ে উঠল রচনাধর্মী। তার কেন্দ্রস্থলে বক্তা না, এসে পড়ল রচনা, অনবয়ব অশরীরী এক পাঠকের উদ্দেশ্যে। রচনা পাঠকের কাছে এসে হাজির হল ছাপাখানার মাধ্যমে। উদ্দিষ্ট পাঠকের মুখের মতো রচনাকারের মুখও রচনার মধ্যে ঝাপসা, রচনাকারের সত্তা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে আত্মগোপন করে রইল বইয়ের মার্জিনে, কালো অক্ষরের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে পাতার ভাঁজে ভাঁজে। ঊনবিংশ শতকের প্রথম খণ্ড অব্দি রচনার সাফল্য মাপা হত বইয়ের কাটতির নিরিখে, শতাব্দীর দ্বিতীয় খণ্ডে যে আধুনিক সাহিত্যের প্রাদুর্ভাব হল তার গুরুত্ব মাপা শুরু হল রচনার পেছনে কতটা সময়, কতখানি শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তার নিরিখে। রচনা প্রকাশ করার আগে রচয়িতা সুদীর্ঘ সময় নিচ্ছেন, কাটছেন, জুড়ছেন, বদলাচ্ছেন, মকশো করছেন তাঁর রচনা। তার ফলে প্রকাশিত রচনার পূর্ববর্তী এক বিশাল প্রাকরচনা-সংকলন তৈরি হচ্ছে, যার নাম হতে পারে পাণ্ডুলিপি, ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠিপত্র। সেখানে তারা নিজের লিখন বিষয়ে অজস্র চিন্তাভাবনা লিখে রাখছেন বা আদান-প্রদান করছেন। এই অপ্রকাশিত নিভৃত প্রাক-রচনার মধ্যে প্রকাশিত রচনার অনেক শুলুক রয়ে যাচ্ছে। আধুনিক রচনা যেহেতু এক নৈর্ব্যক্তিক পরিসর, রচয়িতা সেখানে সশরীরে হাজির থাকতে পারেন না। রচয়িতাকে খুঁজে নিতে হয় জলের নিচের হিমশৈলের মত প্রাক-রচনা সম্ভারের মধ্যে।’—তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী, বোদলেয়ার প্রসঙ্গে
গৌতম জীবনানন্দকে নির্মাণ করছেন এইভাবে। জলের নীচে হিমশৈলের বাকিটা। ওপরে আমাদের চেনা ছকের একটা আধটা জীবনানন্দের কবিতার বই অথবা উপন্যাস। গৌতম খুঁজেও খুঁড়ে তুলছেন। মনিয়াকে নিয়ে লেখা ‘পরির সেমিজ থেকে স্খলিত স্বর’ যেমন। Y-কে নিয়ে রচনাগুলো। ‘প্রেতিনীর রূপকথা’-র বিনতা-কে নিয়ে বৃষ্টির আশ্চর্য ছায়া অংশটি। আক্রান্ত করে আমাদের। পাঠকের সঙ্গে জীবনানন্দের একটা আলাদা সেতু তৈরি হয়।
তা কি বাস্তব? তা কি ছায়া? তা কি মায়া? কে বলে দেবে? বাস্তব বলে অসংখ্য সাল-তারিখের অরণ্যে হারিয়ে যেতে আমি কোনোদিনই ভালোবাসিনি। আমি তো জীবনানন্দপ্রেমী, আমি তো জীবনানন্দ গবেষক নই!
তবে অবশ্যই উল্লেখ করব, গৌতমবাবু যোগ্য উত্তরসূরী বা সাধক বা মিশনারি খুঁজে পাননি বলে যে অনুযোগ জানান, সেটা কিছুটা বেশিই ওঁর নিজের মত। আমার তো বেশ মনে আছে, জীবনানন্দকে সেলিব্রেট করা দু–দুটি বই আমার অল্পবয়সকে ঘিরে ফেলেছিল। অন্তত দুটি। আরও থাকলেও জানা নেই। প্রথমটি, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা জীবনানন্দ—বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত। আর দ্বিতীয়টি, পূর্ণেন্দু পত্রীর এক অনবদ্য বই। রূপসী বাংলার দুই কবি। জীবনানন্দের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথকে মেলানো এক আশ্চর্য রচনা।
অসাধারণ আলোচনা