অরুন্ধতী রায় (Arundhati Roy)
আমাদের এখনকার সবচেয়ে বড় সংকট হল আমাদের প্রতিটি আলোচনা এখন শেষ হয় রাষ্ট্রের ভূমিকায় গিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সমস্যাই ঘুরে ফিরে ফিরে আসে, নারীশরীরের ওপর আক্রমণ থেকে শুরু করে মানুষের অসততা এবং হিংসা ঈর্ষার গল্পগুলো সব একই। তথাপি, তফাৎ এখানেই, যে, সমাজের সমস্যা এখন রাজনীতির সমস্যাও এবং রাজনীতির সমস্যার শেষ আশ্রয়স্থল রাষ্ট্রযন্ত্র বা স্টেটক্রাফট নিজেই এখন কাঠগড়ায়। ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের কীর্তিকলাপের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য যোগ সৃষ্টি হয়েছে এই রাষ্ট্রযন্ত্রের। জনগণের যে কোনো দুরবস্থার প্রাকৃতিক ঘটনা, যথা অতিমারী আরো পাঁচ দশগুণ দুরবস্থাদায়ী হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনযন্ত্রের পরিকল্পনাহীনতায়, ২০২০ থেকে লকডাউন ও দরিদ্র জনগণের জীবনের, জীবিকার ওপরে আঘাত তার প্রমাণ। এমনকি, প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যহীনতাতেও সরকার ও বেসরকারি দুই দিকের সাঁড়াশি আক্রমণ এসে পড়েছে – এ কথা নতুন নয়। এই সমস্ত বিষয়ই নানা অ্যাক্টিভিস্টের হাতে পড়েছে, তাঁরা লিখেছেন তাঁদের মতামতগুলি এই বিষয়ে।
এই বইটি আমাদের অতি প্রিয় গল্পকার প্রতিভা সরকারের এই ধরণের কিছু বিষয় নিয়ে একটি নন ফিকশনের বই। প্রতিভার দু’টি গল্পগ্রন্থ, ‘ফরিশতা ও মেয়েরা’ এবং ‘সদাবাহার’ সাংঘাতিক পাঠকপ্রিয় হয়েছে। ভালো লেখা যে পাঠকের চোখে পড়বেই, কখনোই তাকে উপেক্ষা করে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না – তার প্রমাণ বহুদিন ধরে নিজের লেখালেখির জগতে নীরবে কাজ করে যাওয়া প্রতিভা, যাঁকে আবিষ্কার করতে আমাদের বাঙালি পাঠকের বেশ দেরি হয়েছে। দেরিতে হলেও, প্রতিভা has arrived – এ কথা তো অনস্বীকার্য। ইতিমধ্যেই গল্প বাদ দিয়েও, আমি তাঁর প্রচুর নন-ফিকশন নিবন্ধ পড়েছি নেট দুনিয়ার এদিকে ওদিকে, কোথাও কোথাও বিষয়ের প্রচণ্ড অভিঘাতে স্তব্ধ হয়েছি। গুরুচণ্ডালির পাতায় তাঁর এই বইয়ের অধিকাংশ নিবন্ধ আগে পড়া ছিল, তথাপি তারা আবার আক্রান্ত করল আমাকে, পাঠক হিসেবে। বৃক্ষহত্যা, জল নষ্ট করা, নদীখনন/ নদী হনন, বে-আইনি খাদানে মাইনিং, নিলামে তোলা কয়লা ব্লক, পরিবেশ দূষণ, আলোক দূষণ, অতিমারী, অতিমারীতে মেয়েদের অবস্থা, অতিমারীর লকডাউন ও তাতে প্রশাসনের ভূমিকা, পরিযায়ী শ্রমিকদের চূড়ান্ত দুরবস্থা। নানা বিষয়ে লিখিত ১৯টি লিখন এখানে এক মলাটে।
লেখাগুলির অনিবার্য আকর্ষণ ও পাঠযোগ্যতার আমি কতগুলি কারণ বলতে পেরেছি, একে একে বলি।
১। এদের সরাসরি কথা বলার ক্ষমতা, কোদালকে কোদাল বলার ক্ষমতা, সততা, অন্তঃসারে এক বৃহৎ হৃদয়বত্তা। এগুলো শুধু মানবিক হবার লিপ সার্ভিস না। এগুলো কমিটমেন্ট থেকেই লেখা।
২। লেখাগুলি লেখকের ব্যক্তি জীবনের কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে লেখা বলেই আরো বেশি করে মানবিক, চূড়ান্ত রিলেটেবল বা ছুঁয়ে যাওয়ার মত হয়ে ওঠে। এটা তাঁর লেখার একটা স্টাইল আসলে। এইভাবে তিনি নিজের লেখাকে, পাঠকের নিজস্ব ব্যক্তিস্মৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে ফেলেন। বলা চলে, প্রতি লেখায় আছে একেকটি আকর্ষক/হুক/ আঙটা। একটা প্যারাগ্রাফ যা চোখ টেনে নেয়, মন টেনে নেয়।
৩। বিষয়গুলি সাম্প্রতিক বা অতিসাম্প্রতিক এবং এতটাই গুরুত্বের যে এদের অভিঘাত বহুদূর প্রসারী।
৪। ভাষার সারল্য এবং মিষ্টতা আছে। এক একটি গভীর সামাজিক/রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক সমস্যা ধরে ধরে লেখাগুলোকে কাব্যিক বলা যাবে না। অথচ আমরা জানি, প্রতিভা সরকারের লেখা মূলত কাব্যিক... তাঁর গল্পে সে প্রমাণ তিনি রাখেন। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, সপাটে বিষয়ের মধ্যে তিনি আমাদের ঢুকিয়ে নিলেন, কিন্তু গায়ে কোনো ভারি শব্দের আঁচড় লাগল না।
৫। চিন্তাকে উশকানি দিতে পারার ক্ষমতা এখন খুব কম লেখাতেই থাকে। প্রতিভার প্রায় প্রতি নিবন্ধ ভাবনার পরিসরকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এবং এই ভাবনাগুলো নানান দিকের। সমস্যা নিয়ে পড়াশুনো করা, তথ্য সংগ্রহ করা – এক ধরণের প্যাশন এই লেখকের, তা অল্প পড়লেই বোঝা যায়। কিছু বিষয় খুব চেনা, যেমন পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়গুলি। কিন্তু এইসব বিষয়ে সচরাচর যেরকম হাহুতাশের সুর আমরা নানা বড় পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় লিখিয়েদের কাছে পাই, তা নেই প্রতিভার লেখায়। তাঁর লেখায় আছে ভেতর অবধি ঢোকার অন্তর্ভেদী বুদ্ধিবত্তার দৃষ্টি, সন্ধানী দৃষ্টি, প্রতি লেখাই এক ধরনের অন্তর্তদন্তের আদলে চলে।
কয়েকটি মাত্র উদাহরণ -
বেঙ্গল কেমিকাল হিসেবে তাঁর লেখার এক ঝলক।
“ওই ঘোড়াগুলো হচ্ছে এক একটি প্রতীক। এক বিরাট দেশের এক অসীম প্রতিভাবান, শুদ্ধহৃদয় বিজ্ঞানসাধকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম ফার্মা কোম্পানিকে অধিগ্রহণের পর কী করে লাটে তুলে দিতে হয় তার প্রতীক, বহুদিন পর বেশ লাভের মুখ দেখা প্রতিষ্ঠানকে কী করে স্ট্র্যাটেজিক সেলের লিস্টে ঢুকিয়ে দিতে হয় তার প্রতীক, কী করে ব্যবসাবিমুখ বাঙালিকে ফার্মার্সিউটিক্যাল কোম্পানি খুলে বসার বদলে চপ তেলেভাজার ঠেক, নিদেনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর চায়ে কা দুকানে ভিড়িয়ে দেওয়া যায়, হয়তো বা সেই মানসিকতারও প্রতীক। কারণ বিদেশির চাকরি নিয়ে দাসত্বশৃঙ্খল পায়ে পরার বিরোধী ছিলেন আচার্য এবং বাঙালিকে স্বাধীন ব্যাবসায় উৎসাহিত করাই তাঁর লক্ষ্য, একথা তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালস প্রতিষ্ঠা করবার সময় বহুবার বলেছেন।”
“আকাশের গায়ে কেন টক টক গন্ধের মত তাই ইদানীং বেঙ্গল কেমিক্যালসের বঞ্চনার গায়েও গুজরাতি গুজরাতি গন্ধ। ঘোড়া চলে যায় গুজরাতি এনজিওতে, ওষুধের বরাত পায় গুজরাতি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। বাংলা শুধুই ঘুমায়ে রয়? বেঙ্গল কেমিক্যালসের কর্মচারী ইউনিয়ন ত্রিধাবিভক্ত। দু’টির মাথায় শাসকদলের দুই মহারথী। একজনের দৌড় বিধানসভায়, তো আর একজনের পার্লামেন্টে। আর-একটি ইউনিয়ন বামপন্থীদের। তিনটে ইউনিয়ন এক হয়ে মামলা লড়ে তবে বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে। কিন্তু অদম্য সরকার বাহাদুর দেশের লাভজনক সংস্থাগুলিকে বিক্রি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ...”
কোভিড সতী নামের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে নারীর মৃত্যুর অস্বাভাবিক বেশি অনুপাত... কোভিড মৃত্যুর সংখ্যাতত্ত্বে, যা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে এবং আরো কিছু প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছে।
“হিসাবের সুবিধের জন্যই বলে রাখি সরকারি হিসাব অনুযায়ীই এই এজ গ্রুপে মারা গেছে ০.৬% এবং এরা সবাই মেয়ে।
বেশ চমকপ্রদ না কোভিডে মেয়েদের মৃত্যুর ব্যাপারটা? কেন বেশি মরছে তারা, এর কারণ কী, নিশ্চিত করে তা বলবার সময় আসেনি। আরও তথ্য চাই, আরও সমীক্ষা। তবে বৈজ্ঞানিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা কতগুলো ইঙ্গিত দিয়েছেন। স্বাস্থ্য পরিসেবার কতখানি নারী হাতের নাগালে পায়, দেহের পুষ্টিতেই কোনো খামতি আছে কিনা, পারিবারিক এবং সামাজিক প্রতিবেশ তাকে কতটা সাহায্য করে বা আদৌ করে কিনা, সব প্রশ্নই উঠছে। মোদ্দা কথা, কোভিডে আক্রান্ত মেয়েরা অভিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় কিনা সন্দেহ তাই নিয়েই।
তাহলে অতিমারিতে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও নির্ধারকের ভূমিকা নিতে পারে লিঙ্গ, এইরকম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যে এজ গ্রুপ দুটিতে মেয়েরা বেশি মরছে, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখলে অনেক চিন্তার খোরাক বেরিয়ে আসবে।”
সামাজিক রাজনৈতিক কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতার লেখা প্রতিভা সরকারের এই আগুনে লেখাগুলি। কিন্তু হৃদয়ের আগুন কখনো তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত যৌক্তিকতাকে আচ্ছন্ন করেনি। এক অন্যতম উজ্জ্বল মননশীলতার উদাহরণ প্রতিভা সরকার। তাঁকে নমস্কার।