দরবার খান মাঝে মাঝে মহা বিপদে পড়ে যায়। তাকে বাদশা বাহাদুর চোখে হারান। মাথা ধরেছে। দরবার খান। বাগানে হাওয়া খাবো। দরবার খান। হাম্মামে গোসল করব। দরবার খান। আজ বড় ক্লান্ত। দরবার খান। আজ মেজাজটা ফুরফুরে। দরবার খান। অসহ্য লাগছে! দরবার খান কোথায়? যুদ্ধে যাবো। দরবার খান, জলদি আও।
কিন্তু মাঝে মাঝে দরবার খানও বাদশার মনের তলের হদিশ পায় না। বাদশার মনপসন্দ দাস্তাঁ হল দাস্তাঁ-এ-আমির হামজা। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই দরবার খানের সঙ্গে আমির হামজার জগতে ঢুকে পড়েন বাদশা। তলোয়ারের ঝনঝনানি, জাদুর খেল, মহব্বতের নেশা আর ছলচাতুরির মারপ্যাঁচ, বাদশা খুশিতে দুলে ওঠেন!
দরবার খান হল বাদশার গল্পকথক। বাদশার কিসসাগো। বাদশার বড় গল্পের নেশা! বড় নেশা! তাই ছায়ার মত দরবার খান তাঁর পেছনে পেছনে ঘোরে। কখন হুকুম হবে “দরবার খান, শুরু কর”! গল্প ছাড়া বাদশাকে ভাবাই যায় না।
কিন্তু আজ দরবার খানের গল্পে বাদশার মন বসছে না। বারবার তাঁর চোখ ঝরোখার বাইরে চলে যাচ্ছে। দরবার খান গল্পে যথেচ্ছ রঙ, মশলা, আবেগ ঢেলেও বাদশার মন ভোলাতে পারছে না! একসময় দুম করে ফরাশ তাকিয়া ছেড়ে বাদশা উঠে পড়লেন। বাদশা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পেছনে পেছনে চলছে তাঁর ভৃত্যের দল। বাগিচা ছাড়িয়ে ফোয়ারার পাশ দিয়ে ঘুরে বাদশা এসে দাঁড়ালেন একটি মহলের সামনে। মহলের মহিলারা বাদশাকে আসতে দেখে ঘুঙ্ঘট টেনে ভেতর মহলে ছুট্টে চলে গেল। খবর দিতে হবে। বাদশা আসছেন বলে কথা!
বাদশা দেউড়ি ফটক পেরিয়ে, হাবসি খোজার সেলাম নিতে নিতে, উঠোন পেরিয়ে, চিকের পর্দা টানা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দুইধারে দাঁড়ানো মেয়ের দল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে গুটিয়ে দিল দরজার চিক। মাথা নিচু করে সেই ঘরে ঢুকে মিহিন বালুসাহি গলায় বাদশা ডাকলেন,
“ফুফু হজরত। কেমন আছেন আপনি? সব ঠিক আছে তো? নতুন মহলে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
একটা ঢিলেঢালা পেশোয়াজ। হালকা পেস্তা রঙ। শামদানের নরম হলুদ আলোয় আটান্ন বছরের স্নিগ্ধ মুখখানি। চোখদুটি বন্ধ। ঘরের কোণে গুগগুল। হালকা হালকা ধোঁয়া। ধোঁয়ায় মিশে আছে জড়িবুটির গন্ধ আর চাঁপা ফুলের মাদকতা। হিন্দোস্তানের এই ফুলটি ঘরে রাখলে ঘর আপনা থেকেই সুরভিত হয়ে যায়। পেশোয়াজের বাইরে বেরিয়ে থাকা দু’টি কোমল পায়ে জড়িবুটি তেলের প্রলেপ। হালকা হাতে মালিশ করছে একটি মেয়ে। গলার শব্দে চোখদু’টি খুলে যায়।
“আরে! জালালুদ্দিন, আয় আয়। ফুফুকে এতদিনে মনে পড়ল?” ফুফুর গলায় আহ্লাদে যেন মোতিচুর লাড্ডু চুরচুর করছে!
“ফুফু হজরত, আজ আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করল যে! তাই চলে এলাম।”
মালিশের মেয়েটি বিদায় নিয়েছে। ঘরে শুধু পিসি আর ভাইপো। বাতিদানের মৃদু আলো আর মৃদু সৌরভ। এই ভাইপোটিকে বড় ভালোবাসেন ফুফু।
ফতেহপুর সিক্রির নতুন মহলে থাকেন এখন। কত বদলে গেছে জমানা চোখের সামনে। চাঘতাই তুর্ক আর তৈমুরের রক্তে মেশা ঘোড়ার খুরের উদ্দাম নাচন, বড় বড় তাঁবু বসাও আর ওঠাও, এক অর্থে যাযাবর জীবন কেমন আস্তে আস্তে ভোল পাল্টে গেল! এই দেখো, জালালুদ্দিনের মুখটাও কেমন হিন্দোস্থানের মত দেখায়! অথচ তাঁর বাবা বাবর আর ভাই হুমায়ুন মির্জার সমরখন্দী মুখাবয়ব খুব আলাদা। আজ বাবা বা ভাই কেউ বেঁচে নেই। তবে ভাইপো তাঁর খেয়াল রাখে খুব!
স্নেহ দানাদার গলায় গুলবদন বেগম বলেন, “বল, কেমন আছিস?”
বাদশা আকবর ফুফুর হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “গল্প শুনতে এসেছি ফুফু হজরত।”
ফুফু এবারে একটু দুষ্টু মিষ্টি হেসে বলে ওঠেন, “কেন রে? দরবার খানকে ছুটি দিয়েছিস নাকি? দরবার খান ছেড়ে শেষে আমাকে নিয়ে পড়লি কেন?”
জালালুদ্দিন আকবর বললেন, “সে আলাদা আর আপনি আলাদা। সে আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় আমি তার হদিশ রাখতে পারি না। উড়িয়ে নেয়, ভাসিয়ে নেয়। একরাশ রঙে সাঁতার কাটি। কখনো রক্তে টগবগে তুফান ছুটিয়ে দেয়। আমাকে খেপিয়ে দেয়, মাতিয়ে দেয়। কিন্তু কখনো মন চায় গাছের ছায়ায় বসতে, শান্ত হতে চায়। জিরোতে চায়, ঘরে ফিরতে চায়, পিদিমের আলোয় বসে থাকতে চায়। আপনি আমার সেই জিরেন, সেই ছায়া, ফুফু হজরত। তা ছাড়া দরবার তো বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনায় শুধু। আমাদের ঘরের কথা, বাবার কথা, দাদুর কথা – এসব আপনি ছাড়া আমাকে আর কে শোনাবে ফুফু হজরত?”
গুলবদন ফুফুর গলার কাছটা একটু ব্যথা করে ওঠে, দু’-কুচি জল চোখে চলে আসে।
কিছুদিন আগে তিনি হজ করে এসেছেন। প্রায় ছয় সাত বছর হিন্দোস্তানের বাইরে ছিলেন। সে এক বিশাল অভিযান। অন্দরের মেয়েদের নিয়ে অতদূরের তীর্থযাত্রায় যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? তিনিই তো সব কিছু সামলেছেন। সঙ্গে অনেক টাকাপয়সা। সুরাট বন্দরে পর্তুগিজদের নানা টালবাহানা! ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন গুলবদন! জালালুদ্দিন, তাঁর ভাইপো, কী করে যে এদের সঙ্গে এত সুন্দর করে মেলামেশা করে, গুলবদন বুঝতেই পারেন না। ওই পর্তুগিজ আর জেসুইট পাদ্রিগুলোর জন্য জাহাজ ছাড়তে বিস্তর দেরি হল। এইসব ঝামেলা মাথায় নিয়ে সমুদ্রপথে চললেন বাহান্ন বছরের গুলবদন। তারপর চার বছর মক্কাবাসের শেষে ফেরার পথে সে আরেক বিপদ! লোহিত সাগরের রাক্ষুসে ঢেউ, গুচ্ছ গুচ্ছ প্রবাল দ্বীপ আর জলের গভীরে ধারালো সব পাথুরে পাহাড়! ঘন কুয়াশা আর উত্তুরে খ্যাপা হাওয়া। প্রার্থনা ছাড়া আর গতি নেই। পর্বতের মত বড় বড় ঢেউ। কোনওরকমে রক্ষা পেয়ে গুলবদন এবং জেনানার দল আডেন বন্দরে থমকে থাকলেন প্রায় একবছর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সুরাট যাবার জাহাজ এল। ফতেপুর সিক্রিতে ফিরে এলেন এতগুলো বছর পরে! ভাইপো জালালুদ্দিন আর যুবরাজ সেলিম খুব ঘটা করে পুরো মহিলাদলকে অভ্যর্থনা করল। কী ঘটা! কী ঘটা! জালালুদ্দিনের আদরের ফুফু হজরত ফিরে আসছেন এতদিন পরে। কী বিশাল কাণ্ড করে ফুফু ফিরে এসেছেন! তিনি ফুফুকে মহাসমারোহে প্রাসাদে নিয়ে এলেন। সারা পথ রেশম দিয়ে মুড়ে দিয়েছেন। অকাতরে মোহর বিলিয়ে দিচ্ছেন বাদশা! খুশিতে সবাই ঝলমল করছে! সেই রাতে পরিবারের সবাই এক সাথে রইল। কেউ ঘুমোয়নি। রাত জেগে তীর্থযাত্রার গল্প শুনিয়েছিলেন ফুফু গুলবদন!
আজ ভাইপোর মাথায় হাত রেখে ফুফু বলেন, কী শুনবি তুই বল?
ফিনফিনে রুপোর পরাতে শুকনো ফল খেজুর আখরোট বাদাম খোবানি। আবতাবচি কেওড়া মেশানো পরিশ্রুত ঠান্ডা জল রেখে গেছে। হিন্দোস্তানের বাদশা জালালুদ্দিন আকবর ফুফু হজরতের কোলে মাথা রেখে বলে ওঠেন, “বাবা, আব্বা হুজুরের কথা বল।”
জানিস জালালুদ্দিন, একটা ভারি আশ্চর্য কথা আজ বলি তোকে! “বাগ-এ-জর-আশফা” কাবুলের একটা খুব সুন্দর বাগিচা। বাগিচা দেখে বাবার মন জুড়িয়ে গেল। বাবা বললেন, “আমার ইচ্ছে করছে বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দি। এই নিরিবিলির মধ্যে। সঙ্গে আবতাবচি থাকবে ফাই-ফরমাশের জন্য। বাদশাহি ছেড়ে দেব হুমায়ুনের হাতে।” এই কথা শুনে আম্মা আর বাকি মহিলারা কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন, “এমন কথা বলবেন না হজরত। আপনি দীর্ঘ জীবন লাভ করুন। আপনার ছেলেমেয়েরা সব আপনার সামনেই বুড়ো হোক।”
এমন সময়ে আচমকাই খবর এল, হুমায়ুন মির্জার খুব অসুখ!
সবাই অস্থির হয়ে উঠল। আমরা দলবল বেঁধে রওনা হয়ে গেলাম আগ্রার পথে। আগ্রাতে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল আমাদের! আমার ভাই হুমায়ুন মির্জা, আমার কাছে ফেরেশ্তা, দেবদূত! আমরা ভাইয়ের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী রোগা হয়ে গেছে ভাইটা! মাঝেমাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। যখন জ্ঞান ফিরে আসছে, আধবোজা চোখে বলছেন - বোন তোমরা সবাই আমার কাছে এসো। আমাকে জড়িয়ে ধরো। কতদিন তোমাদের কাছে পাইনি।” ভাইয়ের এই অসুখে বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। আম্মা মাহাম বেগম বললেন “আপনার তো আরো ছেলেমেয়ে আছে। আমার তো ওই একটিমাত্র! আমি কী নিয়ে থাকবো বলুন?”
বাবা বললেন, “হুমায়ুন আমার সেরা সন্তান। ওর মত আর কেউ নেই। আমার পরে হুমায়ুনই বাদশা হবে। আমি ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
কিন্তু ভাইয়ের অবস্থা আর বাবা চোখে দেখতে পারছিলেন না। তারপর দেখলাম বাবা জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে পড়তে ভাইয়ের বিছানার চারিদিকে ঘুরছেন আর বলছেন, “হে ঈশ্বর, যদি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণদান সম্ভব হয়, তবে তুমি আমার প্রাণ নিয়ে আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও।”
এইটুকু এক নাগাড়ে বলে ফুফু গুলবদন একটু থামেন। তাঁর কোলের ওপরে ভাইপো জালালুদ্দিনের মাথা। তাঁর দু’টো হাত ভাইপোর মাথায় আর ঘাড়ে। টের পাচ্ছেন হিন্দোস্তানের বাদশা কেমন তাঁর কোলে শান্ত ছানাটির মত একতাল ফালুদা কুলফি হয়ে এলিয়ে পড়ে আছে, গুটিসুটি। ঘরটি চাঁপার গন্ধে ভারি হয়ে এসেছে।
নিদ্রামগ্নের মত বাদশা বলে ওঠেন, “থামলেন কেন ফুফু হজরত? তারপর?”
ফুফু বলেন, “কী জানি, ভাবলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস! তারপর এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। হুমায়ুন মির্জা ধীরে ধীরে সেরে উঠতে লাগলেন। আর এদিকে বাবাকে ধরল রোগে। পেটের অসুখ আর যায় না! অসহ্য ব্যথা! হুমায়ুন হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন কালিঞ্জর থেকে ততদিনে বাবা রোগশয্যায় থেকেই বোনদের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। হুমায়ুন মির্জা অস্থির হয়ে উঠে হেকিমদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, যে ভাবেই হোক, বাবাকে সারিয়ে তুলতে হবে। তাঁরা বাবাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে, হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “শাহজাদা, আমরা পারলাম না। এখন ঈশ্বরই ভরসা। দৈব কৃপা ছাড়া আর কোনোকিছুই বাদশাকে বাঁচাতে পারবে না। বাদশার শরীরে বিষ ঢুকে গেছে।”
জালালুদ্দিন ফুফুর কোল থেকে মাথা তুলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বিষ?”
গুলবদন বললেন, “হ্যাঁ রে বিষ! এক ডাইন দিয়েছিল। বাবা আবার ওই ডাইনকে মা বলে ডাকত!”
- কে সেই ডাইনি, ফুফু?
- ইব্রাহিম লোধির মা। পানিপথের যুদ্ধের পরে ইব্রাহিম লোধির পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব বাবাই নিয়েছিলেন। ইব্রাহিমের মা খুব কৌশল করে রসুইঘরের আহমদ চাসনিগিরকে হাত করে খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। রুটির সামান্য অংশই বাবা মুখে দিয়েছিলেন, তাতেই বিষ শরীরে ঢুকে যায়। বাবা খুব দুর্বল হয়ে পড়লেন। চলাফেরা করার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। অথচ ওই ডাইনিদের বাবা কত যত্নে রেখেছিলেন, জায়গির দিয়েছিলেন। প্রাসাদ দিয়েছিলেন। কত সুযোগ সুবিধা, সব। আবার মা বলেও ডাকতেন। একদিন বাবা সবাইকে ডেকে পাঠালেন। বললেন “মনে বড় সাধ ছিল যে হুমায়ুনের হাতে সব ভার ছেড়ে দিয়ে আমি বাগ-এ-জর-আশফাতে অবসর কাটাব। তা আর হল না। আমি এখন হুমায়ুন মির্জার হাতে এই সাম্রাজ্য দিয়ে যাচ্ছি। সে সব কিছুর দায়িত্ব নিক। প্রজাসাধারণ, আত্মীয় পরিজন ভাইবোনদের নিয়ে সুখে থাকুক। তাদের রক্ষা করুক।”
হঠাৎ চিরাগ নিভে গেল রে জালালুদ্দিন। চোখের জল আর বাঁধ মানে না। কাউকেই খবর দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় একজন হিন্দোস্তানি আমীর পরামর্শ দিলেন, যে বাদশার মৃত্যুসংবাদ বাইরে প্রচার করা ঠিক হবে না। দেশের মধ্যে শত্রুরা সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। একজন লোককে লাল পোশাক পরিয়ে হাতির পিঠে উঠিয়ে বাইরে পথে পথে ঘোষণা করতে বলা হোক, যে বাদশা বাবর এখন থেকে অবসর নিয়ে নিরালায় সময় কাটাবেন আর হুমায়ুন মির্জা হবেন নতুন বাদশা।”
হামিদা বানু বেগম একরাশ মসলিনের মধ্যে বসে আছেন। মুখখানা একেবারে শীরমল রুটির মত আনন্দে ভরপুর। ঢাকা থেকে মসলিন এসেছে। তাদের নামের কী বাহার! আব এ রাওয়ান। দেখলে মনে হবে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে – এত স্বচ্ছ। আরেকটার নাম বাফত হাওয়া - হাওয়ার বিনুনি, ফিনফিনে হালকা! আরেকটার নাম শবনম – সন্ধের শিশির। নরম মোলায়েম। আপাতত হালকা গোলাপি, আসমানি, পেস্তা, ফিরোজা, দুধে-আলতা আর সোনালি – এই ক’টা রঙ তিনি বেছে রেখেছেন। এখন সইয়ের অপেক্ষায় বসে আছেন। হামদা বানুর প্রিয় সই তাঁর ননদ, গুলবদন বেগম।
হুমায়ুন আর গুলবদন এক মায়ের পেটের ভাইবোন না হলে কী হবে, দু’জনায় খুব ভাব ছিল। হুমায়ুনের মা, মাহম বেগম, গুলবদনকে দত্তক নিয়ে বড় করেন। তাছাড়া হুমায়ুন সব বোনেদেরই খুব দেখভাল করতেন। ভাই, ভাইপো আর ভাইয়ের বেগম – তিনজনাই গুলবদনের অত্যন্ত প্রিয়।
গুলবদন বেগম আসামাত্রই হামিদা বানু সোৎসাহে তাকে টেনে নিয়ে মসলিন বাছতে বসেন। নাকের নতুন নথ আসবে। নতুন নকশা!
গুলবদন বলেন, “আমার আর এসব কী দরকার? হজ করে এসেছি। সব পাওয়া হয়ে গেছে। নাও বেগম, তুমিই এগুলো সব রাখো!”
হামিদা হাউমাউ করে বলে ওঠেন, “রাখো তো তোমার যত বাজে কথা। নাও দেখো, কোনটা নেবে বল।”
হিন্দোস্তানের বাতাস বেশ ভারি। জল ধরে রাখে। মাঝে মাঝে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়! মোগরা আর জুঁই – এই দু’টি সাদা ফুল ঘর একেবারে গন্ধে ভরিয়ে দিচ্ছে। গুলবদন, হামিদার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন। গুলবদনের চোখ হাসছে। হামিদা বানু অবাক হয়ে বলেন, “কী হয়েছে বল তো? এত হাসিহাসি মুখ!”
গুলবদন বললেন, “এত রঙের মধ্যে কেমন বসে আছো! তোমার বিয়ের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে যে!”
হামিদা বানু কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, “আবার! খুব খুরাফাতি বেড়েছে তোমার আজকাল!”
সত্যি! এই মেঘ, এই বৃষ্টি, এই পরিষ্কার আকাশ – এসবের ভেতরে হামিদা বানুকেই দেখছেন গুলবদন।
গুলবদনের বেশ মনে আছে, হুমায়ুনের মা, মাহম বেগম, নাতির মুখ দেখবেন বলে দিন গুনতেন আর ভালো মেয়ে দেখলেই হুমায়ুনকে বলতেন, তুমি ওকে বিয়ে করে নাও। এই সময় মেওয়াজান নামে একটি মেয়ের সঙ্গে হুমায়ুনের বিয়ে হল। ওদিকে কাবুল থেকে বেগা বেগম ফিরে এসেছেন। তিনি সন্তান সম্ভবা। তাই শুনে মেওয়াজান বলল সেও নাকি সন্তানের মা হতে চলেছে। মাহম বেগমের খুশি আর ধরে না! বাদাম, পেস্তা, চার মগজ, সোনা রুপোর গুঁড়ো মিশিয়ে মুখরোচক খাবার বানাতে বসে গেলেন। সুন্দর সুন্দর তাকিয়া, বালিশ, আসবাব দিয়ে আঁতুড়ঘর সাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেগা বেগমের একটি মেয়ে হল। নাম রাখা হল আফিফা। এদিকে দশ মাস গড়িয়ে যায়। মেওয়াজানের কোন খবর নেই! সে বললে, “আমার বারো মাস পরে বাচ্চা হবে। আমাদের পরিবারে এমনটি আগেও হয়েছে!”
তারপর জানা গেল, সে সব্বাইকে বুদ্ধু বানিয়েছে! কথাটা মনে পড়তেই আপনা থেকেই গুল বদনের খিলখিলিয়ে হাসি!
হামিদা বানু মজা করে খুনসুটি করেন, “ওই শুরু হল। তোমার মাথার ভেতরে একটা ওয়াকিয়ানবিশ কাগজ কলম নিয়ে বসে আছে তা তুমি জানো? সব কিছু লিখে চলেছে খসখস করে। সুভানাল্লা, কী করে এত কথা মনে থাকে তোমার?”
উত্তর দিলেন না গুলবদন। আগ্রা থেকে পান এসেছে। মালোয়া থেকেও আসে। সেই পান একটা গুছিয়ে মুখে পুরে বললেন, “তুমি যা একখানা মানুষ ছিলে বেগম! ভাইটা আমার তোমাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেলেন। তুমি কী নখরাটাই করেছিলে, মনে পড়ে?
সুফি মীর বাবা দোস্তের বিটিয়া সেই ছোট্ট হামিদা খুব আসা যাওয়া করত আমাদের মহলে। নটখট চুলবুলি আর খুবসুরত। তাকে দেখে হুমায়ুন মির্জা একেবারে সটান বিয়ের কথা পেড়ে ফেললেন। এদিকে মির্জা হিন্দাল বলে কি, এই বাচ্চা মেয়েটাকে আমরা বোন বা মেয়ের মত দেখি। এ আপনার কী রকম কথা বাদশা?
বাদশা তো দুঃখ পেয়ে চলে গেলেন। আমার মা, দিলদার বেগম, হুমায়ুনকে চিঠি লিখে অনেক বোঝালেন। এত মন খারাপ কোরো না। আমরা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছি। পরদিন আমাদের জমজমাট আসরে ভাই বললেন, কাউকে পাঠিয়ে হামিদা বানুকে ডেকে আনুন না! হামিদা বানু কিন্তু এল না! উল্টে বলে পাঠাল, আমি গিয়ে কী করব? সেলাম করব? সেলাম আমি গতকাল করে ফেলেছি। একটা মানুষকে কতবার সেলাম করব? সবাই মিলে বোঝাতে লাগল, কিন্তু মেয়ে একেবারে কঠিন পাথর! বলে বসল, বাদশা তো আমার কাছে পরপুরুষ! পরপুরুষকে বারবার দেখা ঠিক কাজ নয়!
সব শুনে হুমায়ুন মির্জা একটু হেসে বলেছিলেন, ‘বেশ তো, আমি ভিন পুরুষ। কিন্তু আপন হতে আর কতক্ষণ?’
চল্লিশটি দিন ধরে এই তুমি, হামিদা বানু বেগম, মন কষাকষি, দর কষাকষি করে সবাইকে, বিশেষ করে আমার মাকে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিলে!”
হামদা বানু বেগম মনে মনে খুব আনন্দ পাচ্ছেন কিন্তু মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “বল বল, কে আর এখন তোমায় আটকাবে?”
গুলবদন বেগম বলেই চলেছেন, “তারপর আমার মা গিয়ে সাধ্যসাধনা করে বললেন, ‘ওরে মেয়ে, তোকে তো কোন পুরুষকেই বিয়ে করতে হবে। বাদশাকে বিয়ে করতে তোর কী এত অসুবিধে? এর চেয়ে ভালো পাত্র তুই পাবি?’
সেই মেয়ে টকটক করে বলে কি না, ‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, পুরুষকেই তো বিয়ে করতে হবে। কিন্তু এমন পুরুষকে বিয়ে করব, যাকে আমি কাছে পাবো। বাদশার নাগাল পাবার জন্য তো আমাকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে। তাহলে অমন পুরুষকে কেন বিয়ে করব?’
কেমন, বেগম, মনেপড়ে সে সব কথা? তারপর কত ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিলে, কান্দাহার, পারস্য কত জায়গায় লুকিয়ে বেড়ালে, ভাইকে ছাড়া কখনওই থাকোনি তুমি। কত কষ্ট পেয়েছ। আরাম, আয়েস, বিলাসিতা কিছুই তো ছিল না তোমার। কেবল পালিয়ে বেড়ানো। এমন কি দুধের বাচ্চা জালালুদ্দিনকেও ছেড়ে থাকতে হয়েছে।”
হামিদা বানুর কানে কোনো কথাই আর ঢুকছে না। তিনি এখনকার এত সুখের মধ্যে তাঁর আফিমখোর, খামখেয়ালি, বইপাগল, ছবিপাগল, বেহিসাবি, ভাগ্যহীন প্রেমিক স্বামীর কথা মনে করে ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের ওই একা কবুতরটার মত উদাস হয়ে গেলেন।
আজকাল গুলবদন ফুফু ভাবেন, দিলকাল কত পাল্টে গেছে। এখন সব প্রাসাদ! তারা বড় বড় শিবিরে থাকতেন। শিবির ওঠাও, শিবির পাতো। এই তো ছিল যাযাবরী কাহন। সেবারে হুমায়ুন মির্জার অভিষেক হল। ভাইটা বরাবরের সাদাসিধা। একবার মহলের সব মেয়েরা একত্র হল অভিষেক উপলক্ষে। এর মধ্যে কতগুলো মেয়ে অত্যন্ত গুণের। কী অপূর্ব সেলাই করত, নানান শিল্পকাজ। বাদ্যযন্ত্র বাজানো। আবার কুস্তি, তীরন্দাজি, সাঁতার – এসবেও সমান তুখোড় ছিল।
একবার রাত তিন প্রহর অবধি গান বাজনায় পরিবারের সবাই মেতে গেছিলাম। তারপর বাদশা ভাই বিশ্রাম নিতে গেলেন। আমরা বোনেরা, বেগমরা যে যেখানে বসেছিলাম, সেখানেই ঘুমে কাতর।
শের খানের সঙ্গে চৌসার যুদ্ধে ঘরের কত মেয়ে বন্দী হল। মারা গেল ক’জন, তার মধ্যে ছিল ফুলের মত ছোট্ট শাহজাদিও। যুদ্ধের সময় মেয়েদের বড় কষ্ট! এইভাবে যুদ্ধের সঙ্গে, দামামার সঙ্গে চলা যায় নাকি! পরে ভাই বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়েদের এইভাবে যুদ্ধে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। কত আক্ষেপ তাঁর ছোট্ট শাহজাদির জন্য। হায় হায়!
জালালুদ্দিন জন্মাল এই তো সেদিন! তখন আমার উনিশ বছর বয়স। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে সময়টি সিংহ রাশির। সন্তান হবে সৌভাগ্যবান ও দীর্ঘজীবী। মনে পড়ে নওরোজ উৎসবের কথা! বারোজন মিলে একটা খেলা খেলতাম। কুড়িটি পাতা ও পাঁচ মিশকাল ওজনের কুড়িটি শাহরখি পাথর।
বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস! প্রাসাদের ভেতরে ষড়যন্ত্র। মির্জা কামরানের চতুর বদমাইশি বা নিজের মায়ের পেটের ভাই মির্জা হিন্দালের বিদ্রোহ – কিছুই ভুলতে পারিনি যে!
কাবুলের কাছে, বাগ এ দিলখুশার সেই দিনটি! চোখ বুজলেই নানা রঙের তসবিরনামা।
পাহাড়ের কোলে “রেওয়াজ” ফুলের পশরা। সেই ফুল দেখতে বাদশার সঙ্গে চলেছেন গুলবদন, হামিদা বানু, আরো অন্য বেগমেরা। আমরা সবাই বাদশার কাছে আবদার করেছিলাম, পাহাড়ে ফুল দেখতে যাব। সবাই দল বেঁধে পাহাড়ি পথে চলেছিলাম। বেগমেরা গুন গুন করে গান গাইছিল। আমরা একে অপরকে গল্প শোনাচ্ছিলাম। চাঁদের আলোয় পাহাড় ভেসে যাচ্ছে। চলেছি দল বেঁধে রেওয়াজ ফুল দেখতে।
আজো শুনতে পাচ্ছি, ভাই বলছেন, গুলবদন তোমরা এগিয়ে যাও, আমি একটু আফিম খেয়েই আসছি।
মাথার ভেতরে রিনরিন করে সেই মিঠে সুরটা। আফিমের মতই ঘোর লাগে তাঁর!
শুনেছ, বাজারে চিনি হয়েছে সস্তা।
শুনেছ কি শীত নেই, এসেছে বসন্ত?
বাগানে এসেছে কত ফুলের পশরা
গোলাপ শোনাচ্ছে আনন্দ সংবাদ
বুলবুল গুনগুন কেয়াবাত কেয়াবাত
বসন্ত পান করে হৃদয় প্রমত্ত?
শুনেছ বাজারে চিনি হয়েছে সস্তা!
উফ। মাথার ভেতরে যেন তসবিরের কাফিলা। শেষ আর হয় না। একা ঘরে রাতে চোখ বুঝলেই স্মৃতির জাম্বিল খুলে জোনাকির মত পুরনো অতীত ঘিরে ধরে ফুফু হজরতকে।
ধুর বাবা, এই আটান্নতেই বাহাত্তুরে ভীমরতি ধরল নাকি আমাকে?
সকালবেলা পুজোপাঠ সেরে ফুফু হজরত দরগায় যাবেন বলে স্থির করেছেন। কিছু দানধ্যান না করলে তাঁর চলে না। সেখান থেকে ফিরে এসে একবার তাঁর নিজস্ব কিতাবখানায় যাবেন। কয়েকটি ফার্সি কিতাব আনিয়েছেন। তাছাড়া ঘরটিকে পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন। বই সংগ্রহ করতে ফুফু হজরত খুব ভালোবাসেন। বই নাড়াচাড়া করে, কবিতা লিখে অনায়াসে দিন কাটিয়ে দিতে পারেন তিনি।
এমন সময় প্রাসাদের হাবসি প্রহরী এসে খবর দেয়, “দরবার থেকে বাদশা সলামত ফরমান পাঠিয়েছেন। আপনি কি একবার আসবেন বেগমসাহিবা?”
গুলবদন অবাক হয়ে যান। শাহি ফরমান? বাদশার আদেশ? আমার কাছে পাঠিয়েছে জালালুদ্দিন?
গলা তুলে বললেন, “আসছি।”
চিকের বাইরে দরবারের দূত। সসম্ভ্রমে এগিয়ে দেয় মোহর লাগানো শাহি ফরমান।
চিকের ভেতরে গুলবদন ফুফুর হাতে এসে পৌছয় সেই আদেশ।
রৌদ্রস্নাত চবুতরায় বসে সেই ফরমান খোলেন ফুফু হজরত। মুখে একটু চিন্তার ছাপ! হঠাৎ ফরমান কেন! তাঁর হজে থাকার সময়েই বাদশা “মজহরনামা” চালু করেছেন অর্থাৎ বাদশার সিদ্ধান্তই শেষ কথা! উলেমাদের দাবিয়ে রাখতেই এই আদেশনামা।
ফরমান পড়তে পড়তে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল গুলবদন ফুফুর।
লেখা আছে, “আপনাকে জানানো হচ্ছে, যে ফিরদৌস মাকাঞ্জ (বাবর) এবং জন্নত আশয়ানি (হুমায়ুন) সম্বন্ধে আপনি যা যা জানেন লিপিবদ্ধ করবেন।”
ফরমান হাতে কিছুক্ষণ হাঁ করে বসে রইলেন ফুফু হজরত! এই সেদিনের ছেলে জালালুদ্দিন, তাকে জন্মাতে দেখলাম, আর সে এখন তার প্রিয় ফুফুকে ফরমান মানে আদেশ দিচ্ছে? ব্যাপারটা কী?
ফুফু নিয়ম-মাফিক আর্জি জানালেন, যে তিনি বাদশার দর্শনপ্রার্থী। ফুফুর আর্জি মঞ্জুর তো হবেই। ফুফুকে নিশ্চয়ই দরবারে ডাকবেন না বাদশা।
বাদশা নিজেই এলেন। ফুফু হজরত আজ সাদা পেশোয়াজ পরেছেন। সঙ্গে জারদৌসি কাজের চাদর। বসে আছেন গম্ভীর হয়ে। জালালুদ্দিন সুগন্ধ ভালোবাসেন। তাই অম্বরগ্রিস, ঘৃতকুমারী আর চন্দনে সুরভিত করেছেন তাঁর ঘরখানি।
“এগুলো কী লিখেছিস জালালুদ্দিন?”
বাদশা মুচকি হাসেন। বললেন, “না লিখলে তুমি যে এক পা-ও এগুবে না ফুফু হজরত।”
ফুফু বললেন, “কেন? তোর কি ওয়াকিয়ানবিশ কম পড়েছে? তোর কান চুলকানো, হাঁচি, কাশিটাও তো লিখে রাখা হয়।”
বাদশা বলেন, “ওয়াকিয়ানবিশরা এসব কাজ পারবে না ফুফু হজরত।”
ফুফু এবারে একটু ঠেস দিয়ে বলেন, “কেন তোমার আবুল ফজল! তিনি কোথায় গেলেন? তিনি তো দিস্তে দিস্তে লিখেই চলেছেন!”
আবুল ফজলকে হামিদা বানু আর গুলবদন খুব একটা পছন্দ করতেন না।
“আহা, ফুফু হজরত, আবুল ফজল কি বাবা আর দাদুকে দেখেছেন? আপনি দেখেছেন। তাছাড়া রাজনীতি, যুদ্ধ, অর্থনীতি, বাইরের জগতটা ছাড়া আমাদের তো একটা অন্দরের জীবন আছে। মেয়েদের কথা, হারেমের কথা, তাদের সুখ, দুঃখ, আমাদের পরিবারের কথা, কত জন্ম মৃত্যু, ভাব ভালোবাসা, ভাই বোনের প্রীতি – আপনি ছাড়া আর কে লিখবে ফুফু হজরত! এই দেখুন, আমি তো লেখাপড়াই শিখিনি। আর আপনি? আপনি তো বিদুষী! আপনি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারবে না এসব। আম্মিজানও না। কেন জানেন? তার কারণ হল, আপনার স্মৃতিতে সব ধরা আছে। আপনি কিচ্ছুটি ভোলেননি। আর একটা কারণ হল, আপনি চমৎকার দাস্তান বলেন। তাই এই কাজটা আপনাকে করে যেতেই হবে।”
ফুফু বললেন, “ভেবে দেখ। আমি কিন্তু তোর ওই আবুল ফজলের মত অত খুবসুরত লিখতে পারব না। অত জামা, কাপড়, গয়নাগাঁটি, আতর, খুশবু মাখিয়ে লেখা আমার কলম দিয়ে বেরুবে না। ঘরের কথা লিখতে বলেছিস, ঘরেলু করেই লিখব। তাকে অত গয়না পরাতে পারব না।”
“তাই লিখবেন আপনি। সহজ সরল। সোজা সাপটা। ঠিক আপনারই মত করে।”
“আর একটা কথা শোন, আমার লেখায় না, ফার্সির সঙ্গে একটু তুর্কি মিশে যাবে। আমরা তুর্কিতে কথা বলি, কিন্তু ফার্সিটা যত্ন করে শিখেছিলাম, অনেকদিনের অভ্যেস তো! হঠাৎ পাল্টাতে পারবো না।”
“আরে ফুফু হজরত, আপনি যেভাবে পারেন, লিখবেন। মনে রাখবেন, এই লেখা শেষ হলে আপনিই হবেন এই সময়ের প্রথম মহিলা ইতিহাস লেখক! এই দিকটাও ভেবে দেখবেন!”
“কী যে বলিস জালালুদ্দিন! তখন তো আমি খুব ছোট বুঝলি। বছর আটেক বয়স। যা মনে আছে তাই লিখব। আর হুমায়ুন মির্জা আমার প্রিয় ভাই, সে সব কথা তো ছবির মত আঁকা আছে মনে। আমার বাবাও খুব পড়াশোনা করতেন। কবিতা লিখতেন। এসব গুণ তো বংশ থেকেই পাওয়া। পানিপথের যুদ্ধের পরে বাবা সবাইকে অঢেল উপহার দিয়েছিলেন। নর্তকীদের তিনি বেগমদের মধ্যে ভাগ করে দেন। ঢোলপুরের কাছে একটা হৌজ বা জলাশয় বানানো হচ্ছিল। বাবা বললেন, এই হৌজ আমি শরাব দিয়ে ভর্তি করে দেব। কিন্তু তখন রানা সঙ্ঘের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বাবা শরাব ছেড়ে দেন। তাই হৌজ ভরানো হল লেবুর জল দিয়ে। জানিস তো জালালুদ্দিন, একদিন শুক্রবার খুব গরম হাওয়া বইছিল। মা বললেন বাবাকে, আজ আর তোমার ফুফুদের দেখতে যাবার কোনো দরকার নেই। বাবা খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘না, তা হয় না। আমার ফুফুদের দেখাশোনা করা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বেগম।’ আমিও এদিকে তাই ভাবি, আমাদের জালালুদ্দিনও তাঁর ফুফুকে কত আদরে রেখেছে!”
বাদশা একেবারে ইয়াখনি পুলাউয়ের মত মজে যাচ্ছেন ফুফু হজরতের দাস্তানের মজাদার মশলায়! সত্যি কী ভালো গল্প বোনেন ফুফু!
গাছের লম্বা ছায়ায় বেলা ঢলে আসার আভাস। বাদশাও উঠবেন দুপুরের সুফিয়ানা খানা খেতে। তিনি নিয়ম করে নিরামিষ খান।
“কী ভালো গল্প বলেন আপনি ফুফু হজরত! যেন দুধি হালুয়ার মিঠাস। যেন জর্দ বিরিঞ্চের খোশবাই। মনে হয় সব কাজ ফেলে শুনতেই থাকি আর খেতেই থাকি!”
“তাই?” দুষ্টুমির হাসিতে ভেসে যেতে যেতে গুলবদন বেগম শীর খুরমার মত মিঠে গলায় বলে ওঠেন,
“তোর দরবার খানের চেয়ে ভালো? আবুল ফজলের চেয়ে ভালো?”