‘আছে নাকি? তেমন দু এক পিস?’
ঘেঁটে যাওয়া সাদা চুল দাড়িতে বুড়োটাকে ঝড়ে নেওয়া স্যান্টাক্লজের মত লাগে। পায়ে কাদাছিটে সাদা, ন্যাতানে পাজামা। গায়ে ঘামে লেপটে থাকা খাটোঝুল পাঞ্জাবী।
এদিক ওদিক একটু দেখে নিয়ে, পিঠ নুইয়ে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলা হলো কথাটা। চেক লুঙ্গি দোকানীর কপালে গেরুয়া টিপ। থুতনীতে লম্বা দাড়ি। খালিগায়ে ফুটপাতের ধারে পা মেলে বসে একটা দেশলাইকাঠির মাথা দিয়ে আনমনে কান খোঁচাচ্ছিল। মালপত্তর তার একটা নীলরঙা বড়সড় প্লাস্টিকে ঢেকেঢুকে রাখা।
কথাটা শুনে, কাঠিশুদ্ধ ঘাড় হেলিয়ে, প্লাস্টিকের কোনাটা অল্প তুলে তলা থেকে খ্যাঁচ করে এক ট্রে ডিম বার করে ধরল বুড়োর মুখের সামনে।
‘নিন। চোখ বুজে তুলে নিন৷ শতঞ্জলী ডিম। ও আর দেখতে হবে না। খামারত্যাগী মুরগীদের কথা শুনেছেন? সকাল বিকাল চক্রাসন করে তবে এ ডিম পাড়ে তারা।'
‘ধ্যার মশাই, কে আপনার ডিম চেয়েছে? বলছি আছে নাকি অজ্জিনাল কিছু?’
‘সঅব অজ্জিন মাল, এই দেখুন না। এ মাসেই বেরিয়েছে। টাটকা। বলে প্লাস্টিক হাতড়ে কান ধরে সুড়সুড় করে টেনে আনল একটা হলদে ছেঁড়া পাতা।'
বুড়ো জীর্ণ পাতাখানি কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে ‘ভারততীর্থ! এ কবিতা এখনো ছাপার হরফে পাওয়া যায়? আহা, আহা! কতদিন চোখে দেখিনা এসব। কিন্তুউউ, (কী একটু ভেবে) কবিগুরুর নামখানা যে এমন ঘিচিঘিচি করে কাটা?’
‘হ্যাঁঅ্যা। আড়াল রাখতে ওরকম একটু করতে হয়।' তারপর একচোখ টিপে, ‘এভাবেই এখন চালাতে হচ্ছে। সব ব্যান করে দিচ্ছে যে! বাইরেটা দেখুন না, কভার দেখে মনে হবে কবি সমতার লেখা। ওঁনার বিষয়ে আর কী বলব! উনি নিজেই সাক্ষাৎ কবিতা’। শ্রদ্ধায় কপালে হাত ঠেকে যায় দোকানীর।
বুড়ো একটু চিন্তিত ভাবে, ‘বলছি, এই যে রিস্ক নিয়ে এসব রাখছেন! শান্তিরক্ষাবাহিনী ধরবে না?’
‘ধরলে ধরবে! দেখুন আপনাকে বলছি, পাঁচকান কেন, পারলে পনের কান করবেন। আমার ইউটিউব চ্যানেল, ওয়েবসাইট সবখানে তালা ঝুলিয়েছে। কিন্তু আমাকে এখনো বাগে আনতে পারেনি। সিউয়েজ লাইনের লফটে বই রাখি। তারপর নাম বদলে, কভার বদলে বেচি। খুচরো, পাইকারি। সব৷ এরম পাতা ধরে ধরেও। কখন কোনটার দরকার পড়ে!’
কৌতুহলে উবু হয়ে বসে পড়ে বুড়ো, ‘লোকে পড়ে?’
‘না পড়ে যাবেটা কোথায়? মাথাটা তো বাঁচিয়ে খাঁচিয়ে রাখতে হবে! না পড়ে পড়ে, না ভেবে ভেবে মগজ তো সব মশারির মত জ্যালজেলে হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারে সব প্রেসক্রিপশনে কি দাওয়াই লিখছে আজকাল, দেখেননি? রিজিউম রিডিং। শর্টে লেখে, খেয়াল করে দেখবেন - ডাবল আর। দ্য ওল্ড গোল্ড বং হবি।'
বুড়ো চোখ কুঁচকে, ‘সকাল থেকে আজ বউনি হয়েছে?’
হাতে তালি দিয়ে দোকানী, ‘আলবাত হয়েছে! এই যে, 'অধর্ম'র এ সংখ্যাটা। হেএবি ডিমান্ড। অলমোস্ট সবকটা পাতা আপনারই মত একজন খুঁজে পেতে নিয়ে গেলেন। খেয়াল করে দেখুন, এ সংখ্যাটা আবার পঞ্চমুখী হনুমানের লেখা৷ বাহিনীর লোকেরা কভারে এসব দেখলে খুব খুশি হয়। এরম কিছু থাকলেই হল। ভেতরের ব্যাপার নিয়ে অত মাথা ঘামায় না৷ বাইরের র্যাপারটা সেফ থাকলেই হল - মাল সেফ।'
বুড়ো খুব খুশী হয়ে প্লাস্টিকের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে কী সব ঘাঁটতে লাগল। তারপর একখানা 'হিন্দুপুরুষদিগের জন্য বাহান্নটি যোগাভ্যাস' বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আসা সার্থক হলো। এইটা দিয়ে দিন’।
বাড়ি ফিরে আমরা দেখব, বুড়ো জানালার পর্দা টেনে দিয়ে, সিঙ্গল খাটে উপুড় হয়ে, বইটায় আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে পড়ছেন, যেন কতদিনকার চেনা আপন কেউ -
‘বিশু॥ ‘যক্ষপুরীতে ঢুকে অবধি এতকাল মনে হত, জীবন হতে আমার আকাশখানা হারিয়ে ফেলেছি। মনে হত, এখানকার টুকরো মানুষদের সঙ্গে আমাকে এক ঢেঁকিতে কুটে একটা পিন্ড পাকিয়ে তুলেছে। তার মধ্যে ফাঁক নেই। এমন সময় তুমি এসে আমার মুখের দিকে এমন করে চাইলে, আমি বুঝতে পারলুম আমার মধ্যে এখনো আলো দেখা যাচ্ছে।'
নন্দিনী॥ ' পাগলভাই, এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর-সব বোজা।'
বড়দিনের সকালে বইটা এভাবে আচমকা হাতে পাওয়ার তৃপ্তিতে, আলোয় আলোয় ভরে উঠছে বুড়োর মুখ।