

"- যদি সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিকঠাক চলে, তাহলে আর কিছুদিনের মধ্যে কিউবাই হয়তো হবে লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ, কিউবাই হয়তো হবে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ, যে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে নিজের দেশের জনগণের জন্য কোভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরি করবে।"
কিউবার রাজধানী হাভানার সরকারি উদ্যোগে টিকা তৈরির প্রতিষ্ঠান ফিনলে ইনস্টিটিউট অব ভ্যাকসিনস এর মহানির্দেশক ভিনসেণ্ট বেরেজ বেনকোমো কথাটা বলেছিলেন এপ্রিলের শেষে, নেচার পত্রিকাকে। এই ফিনলে ইনস্টিটিউটে তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের করোনার টিকাগুলি। এদের মধ্যে দু'টি, সবার্না ০২, ও আবদালা ২০২১ এর মার্চে ফেজ থ্রি ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ, সারা পৃথিবীতে যে ২৩ টি ভ্যাকসিন এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ফেজ থ্রি ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে কিউবার দুটি ভ্যাকসিন রয়েছে।
লাতিন আমেরিকার ছোট্ট এক দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে সামান্য বেশি। আর, জনসংখ্যা মাত্র ১১ মিলিয়ন, অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার নয়ভাগের একভাগ। কী দরকার ছিল তার ভ্যাকসিন বানাবার ঝক্কি নেওয়ার? সবাই যা করছে, সেভাবে কিনে নিলেই তো হত। দেশিয় প্রযুক্তিতে তৈরি ভ্যাকসিন আবার বিশ্বমানের হবে কিনা, এমন কথাবার্তাও উঠতে শুরু করেছিল। কিন্তু, দেশটা যে ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারার দেশ। নতি স্বীকার করতে তো শেখেনি তারা!
২০২০ সালে যখন সারা পৃথিবীর সামনে করোনা জুজু সবে জুজুৎসুর প্যাঁচ কষতে শুরু করেছে , যখন এই অজানা শত্রুর ভয়ে ঘরে দোর দিয়েছে সারা পৃথিবী, তখন নিজের সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এই কিউবাই। সে সময়ে অভিভূত ইতালি বলেছিল, এদের যেন শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতা মনে রেখে ধনী দেশগুলো যে কিউবাকে ভ্যাকসিন দেবে না, সেটা তারা বেশ বুঝতে পেরেছিল। ওদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে থাকতে গোটা দেশটাই উজাড় হয়ে যেতে পারে। দশকের পর দশক ধরে চলা আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের ফাঁস ট্রাম্প জমানায় আরো কঠিন হয়ে চেপে বসেছে দেশের উপরে। নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় এসেও কোনো নীতির পরিবর্তন করেন নি। মরে হেজে গেলেও কেউ ফিরে চাইবে না। তাই বাঁচতে হলে নিজের শক্তির ওপর ভরসা করা ছাড়া তাদের উপায়ও আর বিশেষ কিছু ছিল না। বরং, ভ্যাকসিন বানাতে পারলে তা লাতিন আমেরিকার অন্য দেশে পৌঁছে দেওয়া যাবে। তাতে সকলের জীবন বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন বিক্রির টাকায় দেশের ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে একটু হলেও সামাল দেওয়া যাবে।
এদিকে প্রতিদিন অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত এদেশে করোনার সংক্রমণ ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু, দেশের অর্থনীতি তো দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনের ওপর। কতদিন দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকা যায়? নভেম্বরে পর্যটনের জন্য খুলে দেওয়া হল দেশ।
পর্যটনের জন্য দেশের দরজা খুলে দিতেই বাড়তে লাগল করোনা। ১৪ মে'র জিনহুয়া লিখছে, কিউবার সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর। কয়েক মাস যাবত করোনা ভাইরাসের বেশ কয়েকটি স্ট্রেন একযোগে আক্রমণ করেছে কিউবায়। এগুলো হল, ব্রিটেন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন। এদের সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি, আক্রান্তের শারীরিক ক্ষতিও অনেক বেশি হয়। আর তাই মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। বর্তমানে যে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও এদের খুব একটা কাবু করতে পারে না। কিউবার আক্রান্তদের ৮৭.৭ শতাংশই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রজাতির শিকার, এমনটাই বলছে রিপোর্ট। আর সারা দেশের মধ্যে হাভানার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। যার ফলে সেখানে স্কুল কলেজ বন্ধ করা, বা লকডাউনের পথে হাঁটতে হয়েছে প্রশাসনকে।
গত বছর যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে হাহাকার, কিউবা দাঁড়িয়েছিল তাদের পাশে। তাই বলে নিজের বিপদের সময় পৃথিবীর সাহায্য এই দেশ পায় না। কারণ, এদের ওপর দশকের পর দশক ধরে চেপে বসে আছে আমেরিকার আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধ। কিউবার অপরাধ, এখনো সে নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি। ছোট্ট একটা দ্বীপের এই প্রতিস্পর্ধাকে আঘাত করেই টিকে থাকে ধনী প্রতিবেশীর ঈর্ষা। তার বেঁচে থাকার যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ যাতে সে না পেতে পারে, তার জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে আমেরিকা। তাই কিউবা ক্রমশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, কারো মুখাপেক্ষী হয় নি। আর ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রেও।
ফিনলেতে এই মুহূর্তে হচ্ছেটা কী?
সবার্না গ্রুপের তিনটি ভ্যাকসিন নিয়ে ফেজ থ্রি ট্রায়ালের কাজ শুরু হয়ে গেছে। তবে কাজটা করা খুব সহজ ছিল না। আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টই তারা কিনতে পারে নি। বড়দার চোখরাঙানি উপেক্ষা করে কে তাকে যন্ত্র বেচবে? কিউবা করোনাপীড়িত আমেরিকার দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বছর বছর আমেরিকার ছেলেমেয়েদের স্কলারশিপ দিয়ে ইলাম মেডিক্যাল স্কুল থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে আমেরিকা পাঠাচ্ছে। আর তার প্রতিদানস্বরূপ ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনৈতিক অবরোধের ফাঁস আরো শক্ত করেছে। বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেই সময় সম্পর্ক ভালো করার একটা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু, ট্রাম্পের সময় তার অবনতি হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এখনো পর্যন্ত কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেন নি। গত ষাট বছর ধরে যাদের কাছ থেকে তাঁরা জিনিসপত্র কিনেছেন, ট্রাম্পের জমানা থেকে তারাও দেখলে হাত জোড় করছেন। বলছেন, 'আপনাদের কিছু বিক্রি করা বারণ আছে। আপনাদের জিনিস বিক্রি করলে আমরা উত্তর আমেরিকার সমস্ত অর্ডার হারাব'। কিন্তু, দেশটার নাম তো কিউবা। একের পর এক বাধার পাহাড় পেরিয়ে ওঁরা যে শিখরজয়ী।
ভ্যাকসিনের রাসায়নিক গঠন নির্ণায়ক যন্ত্র স্পেকট্রোমিটার সারা দেশে মাত্র একটা। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে সব বাধা। ওই একটা স্পেকট্রোমিটার নিয়েই বাধার পাহাড় অতিক্রম করতে নামলেন দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, কাজের গতি আশানুরূপ হল না। এদিকে হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। তবু ১০০ মিলিয়ন ডোজ সবার্না ২ তৈরির লক্ষ্য নিয়েছে কিউবা, যাতে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তিটুকু অন্য দেশকে দেওয়া যায়। তার জন্য প্রতি মাসে ১০ মিলিয়ন ডোজ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা এই যে ২০২১ সালের ২১ জুনের রিপোর্ট বলছে, আবদালা ভ্যাকসিন কোভিড ১৯ এর মোকাবিলায় ৯২.২৮ শতাংশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে।
এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পর প্রচুর ডোজ তৈরির প্রয়োজন। প্রয়োজন বিপুল অর্থের। দেশের সম্পদ শেষ। সকলের মুখে খাদ্য জোগাতে প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে। তাই কিউবা চাইছে, যারা তাদের ভ্যাকসিন কিনতে চায়, তারা যদি আগাম অর্থ দিয়ে ভ্যাকসিন বুক করে, তাহলে তাদের কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব।
কেমন এ ভ্যাকসিন?
একবার করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীরে এমনিতেই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই ভ্যাকসিনটি সেই ইমিউনিটিকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। স্প্যানিশ শব্দ 'sovereign' থেকে এসেছে 'soberana'. আর কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর কবি হোসে মার্তির কাব্যের নায়ক 'আবদালা'র নামে নামকরণ করা হয়েছে দ্বিতীয় ভ্যাকসিনের। হাভানাতে যখন সংক্রমণ লাগামছাড়া, তখন কিউবার প্রশাসন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই হাভানায় গণটিকাকরণ শুরু করে। তারিখটি ছিল ২০২১ এর ১২ মে। তারপর থেকে হু হু করে বেড়েছে সংক্রমণ বেড়েছে দেশ জুড়ে, আর হাভানায় ক্রমশ তা কমে জুনের শেষে অর্ধেকে নেমেছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে। ১২ মে যেখানে সারা দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১২০৭, সেখানে ২৯ জুন তা বেড়ে হয় ৩০৮০। ২ জুলাই ৩৩০৮। কারণ হাভানা ছাড়া অন্যত্র টিকাকরণ শুরু হয় নি। যেহেতু ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ হবার আগেই ওখানে গণটিকাকরণ শুরু হয়ে যায়, সেহেতু অনেক দেশই কিউবার বিরুদ্ধে নিন্দায় মুখর হয়েছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বাজিতে জিতে গেল কিউবা।
ফেজ টু ট্রায়াল করার সময়ই ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, সবার্না ০২ র দু'টি ডোজে অ্যান্টিবডি রেসপন্স হচ্ছে ৮০ শতাংশ। তাই, এর সঙ্গে তৃতীয় একটি বুস্টার ডোজ দিতে পারলেই অ্যান্টিবডি রেসপন্স পৌঁছে যাচ্ছে ১০০ শতাংশে। এটাকে তাঁরা বললেন, সবার্না প্লাস। অর্থাৎ, ভাইরাস মানবদেহের প্রথম কোষে আক্রমণ করতে এসেই গলাধাক্কা খেয়ে ফিরতে বাধ্য হবে।
তাহলে মৃত্যু আটকানো সম্ভব?
'আলবাৎ সম্ভব!' বললেন, উত্তেজিত ভিনসেণ্ট, 'ফেজ থ্রি ট্রায়ালটা শেষ হতে দিন। আমার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে, আমরা পারব। আশা করছি, জুন মাসের শেষে আমরা ভালো রিপোর্ট দিতে পারব আপনাদের।'
বলতে বলতে ভিনসেন্ট একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যেন । 'তাহলে খুলেই বলি আপনাকে। সময়টা ২০২০ সালের মে মাস। আমাদের এখানে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তখনও খুব কম। দিনে ১৭/১৮, বা ২০/২২ জন। সারা পৃথিবী তখন কোভিড জ্বরে থরথর করে কাঁপছে। আমাদের মেডিক্যাল টিম ইতালিতে, স্পেনে গেছে, চারদিকে শুধু মৃত্যু আর হাহাকার। চিকিৎসা জানা নেই, হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বালার চেষ্টা। সেই সময় শোনা যাচ্ছে, ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করছে। আমরা তখনও কিছু ঠিক করে উঠতে পারিনি। তবে এটা বুঝতে পারছি, আজ তেমন সংক্রমণ নেই, কাল কী হবে কে বলতে পারে? হাজার হোক, আন্তর্জাতিক মহামারী তো! হার্ড ইমিউনিটি না গড়ে উঠলে উপায় নেই। ফলে, ভ্যাকসিন চাই। ঠিক সেই সময় আমাদের প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ ক্যানেল আমাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বললেন, 'আপনাদের মধ্যে যে বা যাঁরা পারবেন, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বানানোর প্রস্তুতি নিন।' এই আহ্বান আমাদের কাছে ছিল অসীম গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখছিলাম, পৃথিবী জুড়ে ভ্যাকসিন বানানোর প্রস্তুতি চলছে ঠিকই, কিন্তু তা আমাদের মত দেশে কেউ কি দেবে? বা, সকলের নেওয়া হয়ে গেলে যদিও বা দেয়, ততদিনে গোটা দ্বীপসুদ্ধ আমরা সবাই মরে হেজে যাব। আমরা প্রেসিডেন্টের আহ্বান শিরোধার্য করে, করোনা ভ্যাকসিন তৈরির কাজে নেমে পড়লাম।
নিউমোকক্কাস ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছিল, মুলতুবি করে দেওয়া হল। হুপিং কাশির জন্য এক নতুন ধরনের গবেষণা চলছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়া হল। আমরা তখন বুঝে গেছি, এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি? প্রবল উদ্যমে আমাদের পুরো টিম করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে কোমর বেঁধে নামলাম।
জানেন, সেদিন প্রেসিডেন্ট ডেকে পাঠালেন আমাদের। মিটিংয়ে বসলাম। উনি বললেন, 'মনে রাখবেন, এই ভ্যাকসিন যেন আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।' তারপর আমরা যখন সবার্নার ফেজ ওয়ান ট্রায়াল শুরু করলাম, লোকজনের নামটা এত পছন্দ হল, যে এর বাইরে আমাদের আর কিছু ভাবাই সম্ভব ছিল না। এই নামটার সঙ্গে জুড়ে গেল অনেক কিছু। লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করল, আমরা তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার মূল্য দিতে পারব। বললে বিশ্বাস করবেন না, দেশে দেশে যখন ফেজ ওয়ান ট্রায়ালে লোকজন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আমরা ট্রায়ালের জন্য যখন যত ভলান্টিয়ার চেয়েছি, তার তিনগুণ কি তারও বেশি মানুষ এসে লাইন দিয়েছেন ট্রায়ালে অংশ নেবেন বলে।
দেশবাসীর বিশ্বাস ও ভরসা আমাদের উৎসাহকে প্রবলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের পায়ের তলায় যেন চাকা লাগিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবী যেখানে ইন্টারন্যাশনাল কোভ্যাক্স ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এক দরিদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, দেশবাসীর বিশ্বাস ও ভরসাকে শিরোধার্য করে এক বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেললাম। আমাদের জিততেই হবে। আমরা যে আমাদের দেশবাসীর জীবন বাজি রেখেছি, আরো বাজি রেখেছি সারা পৃথিবীর গরিব মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্নকে।
এই যে সবার্না ০২ আমরা বানালাম, তার প্রযুক্তিও একেবারেই আমাদের নিজস্ব। এটা একটা দুর্বল ও একটা সবল অ্যান্টিজেনের যুগ্ম ভ্যাকসিন, যার ফলে এটা তীব্র ইমিউন রেসপন্স তৈরি করবে। ফিনলের বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে টিটেনাসের নিষ্ক্রিয় টক্সিন মিশিয়ে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিজেন বানাতে সক্ষম হয়েছেন, যা এক শক্তিশালী অনাক্রম্যতা সৃষ্টিতে সাহায্য করবে।'
হাভানায় শুরু হল গণটিকাকরণ:
১২ মে ২০২১, নিজেদের প্রযুক্তিতে তৈরি সবার্না ০২ ও আবদালা দিয়ে হাভানায় শুরু হল গণটিকাকরণ। লক্ষ্য, অগস্ট মাসের মধ্যে এখানকার ১.৭ মিলিয়ন অধিবাসীকে টিকা দেওয়া সম্পূর্ণ করা হবে। কিউবার গবেষণাগারে আরও তিনটি ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট অবস্থান করছে, যারা হল, সবার্না ০১, সবার্না প্লাস ও মামবিসা। এরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। যে দু'টি ক্যান্ডিডেট টিকাকরণে ব্যবহৃত হল, সে দু'টোই সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ভ্যাকসিন। তবে এদের কারো ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ হয় নি। এ নিয়ে প্রতিবেশীদের চেঁচামেচির অন্ত ছিল না। এই অপ্রমাণিত ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিয়ে কিউবার মানুষের অবশ্য কোনো অভিযোগ ছিল না। অবশেষে দেড় মাস ভ্যাকসিনেশন এগোতেই দেখা গেল হাভানায় সংক্রমণের হার কমে অর্ধেক হয়ে গেছে, যেখানে সারা দেশে তা ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়ছে। আবদালা ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ ৯২.২৮ শতাংশ সাফল্য দেখিয়েছে। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ হিসাবে সাফল্যের সঙ্গে ভ্যাকসিন তৈরির গৌরবের অধিকারী হল কিউবা। আবদালা এই সঙ্গে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সফল তিনটি ভ্যাকসিনের একটি হল। কারণ, এই মুহূর্তের রিপোর্ট হল, সারা পৃথিবীতে ফাইজার বায়োএনটেকের সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ, মডার্নার ৯৪.১, আবদালা ৯২.২৮, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ৯১.৬ শতাংশ।
হাভানার সাফল্য নিয়ে ১৭ জুন রয়টার্স খবর দিচ্ছে, এক মাস ধরে গণটিকাকরণ শুরু হয়েছে। যে হাভানা সংক্রমণে উথালপাতাল ছিল এক মাস আগেও, সেখানে দৈনিক সংক্রমণ এখন অর্ধেক। অথচ সারা দেশের সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এই বৃদ্ধি কিউবার জনসংখ্যার নীরিখে সারা পৃথিবীর গড় সংক্রমণের দ্বিগুণ। হাভানার ফলাফল অবশ্যই টিকার সাফল্য। সারা দেশ জুড়ে এই ঘটনা এক তীব্র আশার আলোর সঞ্চার করেছে। কর্তৃপক্ষ যদিও সরকারি ভাবে এখনো সাফল্যের তথ্য (এফিকেসি ডেটা) প্রকাশ করেননি, তবুও কিউবার সবচেয়ে খারাপ সংক্রমণের সময়কার এই ফলাফল যে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হবে, তা বলাই বাহুল্য। ভ্যাকাসিনেশনের কাজও চলছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে, জনসংখ্যার ৪.৫ শতাংশ এক মাসের মধ্যেই তিনটি ডোজই পেয়ে গেছেন।
আর এই সাফল্যই বাজিতে জিতিয়ে দিল কিউবাকে। শুধু প্যানডেমিক নয়, প্রবল অর্থনৈতিক দুরাবস্থারও অনেকটা সুরাহা হবে ভ্যাকসিন বিক্রি করে। ইতিমধ্যেই মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, ভিয়েতনাম, ইরান এই ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। সরকারি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন বায়োকিউবাফার্মা দেশের টিকাকরণ শেষ হলেই তা বাইরে বিক্রির জন্য কথাবার্তা বলতে শুরু করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধের অভিশাপ কাটিয়ে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে এঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কিউবা এক আশ্চর্য্য দেশ।
বরুণ ভট্টাচার্য্য | 2401:4900:314d:facc:0:60:b098:***:*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ০৭:৫৭495775চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার মানুষের পিতৃসম। ঐ দুই মহামানব সেদেশের মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা রাখতে শিখিয়েছে। তাদের যে কোন সাফল্যে প্রতিবেশী মহাধনি দেশের ফাটে।সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কাছে কিউবা উদাহরণ । এরকম সুলিখিত নিবন্ধ পড়লে মন চাঙা হয়ে যায়।
জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 117.217.***.*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ০৯:১৯495776সুন্দর লেখা। ভ্যাক্সিনের জাতীয়তাবাদের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে কিউবা কি দাঁড়িয়েছে? কিভাবে?
এ প্রসঙ্গ আলোচনায় এলে পূর্ণাঙ্গতর হত।
শর্মিষ্ঠা রায় | 2401:4900:1041:1d75:0:63:645e:***:*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ১০:৩১495779গত ১১ জুলাই, ২০২১, রবিবার কিউবার পশ্চিমে San Antonio de Baños শহর থেকে হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল বেরোয়। তারপর তা কিউবার ৪০ টি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মুখে স্লোগান ছিল, ' আমরা ভয় পাই না', ' প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করুন', ' কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হোক', ' আমরা স্বাধীনতা চাই ' - ইত্যাদি। প্রচুর দোকান ভাংচুর করা হয়, ও কয়েকজন পুলিশ আহত হন। গত ৬২ বছরের ইতিহাসে এমন সরকারবিরোধী মিছিল অভূতপূর্ব। মিছিল বেরোতে না বেরোতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, বিবিসি, সিএনএন, রয়টার সহ ছোটো বড়ো নানা সংবাদমাধ্যম। কোনো কোনো অতি উৎসাহী বলতে থাকে, কাস্ত্রো যখন একটি সরকারকে ফেলে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এখন তেমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং এবার কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটবে। কিউবার জনগণের "স্বাধীনতা" র দাবিকে সমর্থন জানিয়ে মুহূর্তে বিবৃতির ঝাঁক ছুটে আসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রাজিলের বলসেনারো সহ নানা "বন্ধুবান্ধবের"। কিউবার পুলিশ শ'খানেক লোককে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনে। প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন, কিউবার ওপর আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া এমবার্গোকে আরও জঘন্যভাবে বাড়িয়ে দিয়ে গেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাইডেন ক্ষমতায় এসেও তার কোনো পরিবর্তন করেন নি। আজকের কিউবার অর্থনৈতিক দূরাবস্থার জন্য দায়ী এই এমবার্গো। আর করোনা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত কিউবার দুঃসময়ে আমেরিকা সুযোগ নিচ্ছে। বিপ্লবী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে পথে নামতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ভ্যাকসিন তৈরি করে যে প্রতিস্পর্ধা দেখিয়েছে কিউবা, এ কি তার সামান্য প্রতিক্রিয়া?
জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 117.217.***.*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ১০:৪৭495780এটা একটা ব্যাখ্যা হল। ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদ নিয়ে নির্দিষ্ট কোন জবাব হলনা।
কিউবার অসম্ভব সংগ্রাম এবং একটি আলোকবর্তিকা হয়ে বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষের কাছে উপস্থিতি সবার শ্রদ্ধা পায়। কিন্তু ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদকে মোকাবিলা কিভাবে করছে তার উত্তর পেলামনা। COVAX বলে যে আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে ১০০টির বেশি নিম্ন আয়ের দেশে পৌঁছে দেবার জন্য, তার সাথে কিউবা কিভাবে যুক্ত সেটাও পরিষ্কার নয়।
কিউবার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে খোদ নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত লেখার লিংক দিচ্ছি।
https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/nejmp1215226
অন্যরকম এক লেখা। রিপোর্টধর্মী। খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখনও কিউবা অন্য পথ দেখায়। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যখন বিজ্ঞান প্রশ্নের মুখে। ডাক্তারকুল বিভক্ত। বাকি মানুষ বিভ্রান্ত। এমতাবস্থায় কিউবার এই পদক্ষেপ (With the masses from the masses) আলো দেখায়। লেখাটির জন্য সাধুবাদ জানাই।
অনিরুদ্ধ কীর্তনীয়া | 112.133.***.*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ১০:৫৯495782খুব ভালো লিখেছো।
শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | 117.194.***.*** | ১৪ জুলাই ২০২১ ১৪:৪৬495784সবাইকে ডেকে ডেকে পড়ানোর মতো লেখা। খবরের কাগজ তো লিখবে না এসব, যদিও পঞ্চাশটা ভাড়াটে লোকের হৈ হৈ প্রচার পেয়ে যাবে। যাই হোক, সত্যিটা শেষ অবধি চাপা থাকেনা।
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সময় উপযোগী একটা লেখা। পড়তেও খুব ভালো লাগলো ।