স্বাভাবিক মাতৃত্ব হোক অথবা সারোগেসি বা আইভিএফ --এখনো পর্যন্ত মানুষ জাতিটাকে টিঁকিয়ে রাখতে গেলে ,জরায়ু একটা প্রয়োজন । জরায়ুর অধিকারী অবশ্যই একজন নারী যিনি সন্তানের জন্ম দেন । তাঁর শরীরটা ঠিকঠাক থাকলে তবেই না অন্যকথা । মেয়েদের বিভিন্ন দাবীদাওয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যের দাবীর সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত --অথচ আমাদের দেশে ,এখনো তা স্থূলতা আর রক্তাল্পতার দুই বিপরীত মেরুতে, রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । পশ্চিমী নারীবাদের এক নম্বর,দু নম্বর,তিন নম্বর ঢেউতে সারা বিশ্ব সামিল হয়েছিলাম বটে, তবে 'নুন আনতে পান্তা ফুরানো' তৃতীয় বিশ্বের অঙ্ক সেইসব ফর্মুলাতে ঠিক মেলে না । 1792 সালে মেরি ওলস্টোনক্রাফট যখন "এ ভিন্ডিকেশন অফ রাইটস অফ ওম্যান " লিখছেন --এখানে তখন কচি কচি মেয়েগুলোকে ধরে বেঁধে পটাপট স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা চলছে । ভাগ্যে রামমোহন,বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া এনারা সব জন্মেছিলেন --সে ফারাকটা যদি বা কিছুটা পেরোনো গেল । বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্বাধীনতার সময়কে পিছনে ফেলে যত এগোচ্ছি আমরা --এক অন্য ব্যবধান ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে । শহরভরা উচ্চবিত্ত বহতলের জঙ্গল । ধরুন কোনো এক সকালে, কোনো এক আটই মার্চের সকালে একেবারে ওপরতলার মালকিন 'টিনা' কথা বলছেন তার ঠিকে গৃহকর্ম সহায়িকা 'পচার মা' র সঙ্গে । আমরা একটু কান পাতলাম । টিনা --আমার শাড়ির কুঁচিটা একটু ধরে ঠিক করে দাও তো মাসি । কি বিপদ, আজ অফিসে শাড়ি পরে যেতে হবে । কেন রে বাপু -আমি জিনস পরব না বিকিনি তা তোরা ঠিক করার কে ! পচার মা --আজ ক্যানিং লোকালে কি ভীড় গো দিদি --টানাটানিতে আমার ন্যাতাকানি পারা শাড়িটা কত্তটা ছিঁড়ে গেল । টিনা--রিয়াকে টিফিনে শুধু একটা ডায়েট বার দিও ,আর কিচ্ছু না -- যা মোটাচ্ছে- পচার মা --আমার পচাটা একদম লম্বা হচ্ছে না গো দিদি, হাড়পাজর গোনা যায় । পচার মা এবার তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায় --তিনতলার সুধা দিদিমণির বাড়িও আজ তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে । ঢুকতেই সুধা দিদিমণি ঝাঁপিয়ে পড়লেন--এই শোন তুই স্যানিটারি ন্যাপকিন ইউজ করিস তো ? পচার মা --সেটা কি গা - সুধা--আরে,মেয়েদের শরীরখারাপের সময় কিনতে পাওয়া যায় যে প্যাড পচার মা একহাত জিভ কেটে কাজে লাগল --ছ্যা ছ্যা,সাতসকালে আর কথা পেলে না । আমার মনমেজাজ ভালো নেই আজ-কাল পচার বাবা খুব গিলে এসেছিল,এই দেখ পিঠে দিয়েছে কাল । এই ভাবে, ঠিক এইভাবে উচ্চবিত্ত আর বৃত্তের বাইরের মেয়েদের সংলাপ এক মধ্যবর্তী শূন্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে । মেয়েদের স্বাস্থ্যের সার্বিক মঙ্গলের কথা নিয়ে এমন কোনো মডেলে তৈরী হচ্ছে না সবাই যার আওতাভুক্ত হতে পারে । ভারতীয় মহিলাদের স্থূলতার হার শতকরা 22 ভাগ !! আর জননক্ষম বয়সী মহিলাদের রক্তাল্পতার হার শতকরা 51 --মানে অর্ধেকেরও বেশী !! সমাজের দুই মেরুতে দুই ভিন্নধর্মী ঘুর্ণীতে ঘুরছে সমস্যা । সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী,15 থেকে 24 বছরর বয়সী মেয়েদের শতকরা 62 ভাগ স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করেন এখনো--- কারণ--গ্রামে গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো সহজলভ্য নয়,যদি বা পাওয়া গেল --লজ্জা সংকোচের বাধা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছানো গেল না । স্বল্পমূল্যটাও দুর্মূল্য সিংহভাগ মেয়েদের কাছে । সবচাইতে বড় কারণ --সচেতনতার অভাব । গৃহকর্ম সহায়িকা যে মেয়েটি ফর্সা হবার ক্রীম কিনতে রুমালে বাঁধা কষ্টের পুঁজিতে হাত দেয়--ন্যাপকিন কিনতে কদাচ নয় । প্রথম ঋতুমতী হবার সময় থেকেই তাকে যদি বার বার বলে শেখানো যায় --কি কি খারাপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এর ফলে,পরবর্তী কালে অনেক বড় সমস্যা ঠেকানো যায় । ঋতুকালে তার মন্দির ঠাকুরঘরে ঢোকা বারণ --সে নাকি অশুচি ! অথচ ব্যাপারটা উল্টো --বাইরের জীবাণু সহজে তার শরীরে প্রবেশের ভয় এই সময়ে বেশী । দীর্ঘদিন অপরিচ্ছন্ন বস্ত্রখন্ড ব্যবহারের কুফল --জননতন্ত্রে এক স্থায়ী সংক্রমণ (Pelvic Inflammatory disease) । তলপেটে ব্যথা, যন্ত্রণাময় সঙ্গম, সাদা স্রাব ,দুর্বল ভাব এমনকি গর্ভধারনে নানাবিধ সমস্যা ও বন্ধ্যাত্ব । চটজলদি চোখে দেখা যায় এমন মারণরোগ নয় বলে ,এগুলোকে অবহেলা করে আসা হয়েছে এতকাল । সুস্থ কর্মক্ষম জীবনধারণ ও অন্য রোগগুলোর কথা মাথায় রেখে খোলাখুলি সোজাকথা সোজা ভাষায় বলতে হবে, 'টার্গেট গ্রুপ' এর মতো করে । আলোচনা মঞ্চের নানারকম পরিসংখ্যান ও তত্ত্বের আলপনা সজ্জিত বক্তব্য ঠিকমত অনূদিত হয়ে যাদের প্রয়োজন,তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে তো ? ভারতে বন্ধ্যাত্বের হার শতকরা 14--একদিকে অপুষ্টি,জননতন্ত্রে সংক্রমণ জনিত কারণ অন্যদিকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (PCOS)। পার্সের ওজন হিসেব করে চলতে হয় না যাদের PCOS সমস্যাটি তাদের --এটাও এক ধরনের অপুষ্টি বইকি । সকালে আগের দিনের মত চিঁড়ে মুড়ি দুধ কলা বা রুটি তরকারি টিফিনের বালাই নেই আজকাল । কোনোমতে কিছু বিজ্ঞাপনে দেখা সিরিয়ালস খেয়ে স্কুল কলেজ বা অফিসে ছোটা । টিফিন বাক্সে চটজলদি ম্যাগি,কেক বা পিৎজা --টিভির ওই বাচ্চারা চেটেপুটে ওগুলো খায় যে । দৈনন্দিন আউটিং এ কত না বাহারি আইসক্রিম, কত রেস্তোরা--যে হাতছানি এড়ানো কঠিন । সারাদিন সারা সপ্তাহ কত চাপ --অগুনতি টিউশন কোচিং নয়তো অফিসের ল্যাপটপ টেবিল । অফিসের পর একটু সিটিং না হলে পরদিন কাজে যাওয়াই সম্ভব নয় । এই পেশাদারী উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের পরিবার ছেড়ে দূরশহরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়েই থাকতে হয় কাজের খাতিরে,অসম্ভব প্রতিযোগিতা আর চাপ অফিসে --এদের সামগ্রিক যাপনও খুব মোলায়েম সুখের নয়। কমবয়সী মেয়েদের সে সব "সিটিং" এর ডায়লগস শুনি মাঝেমধ্যে । আমি রেগুলার জিমে যাচ্ছি এখন --একটু ভদকা চলতেই পারে,সবচেয়ে কম ক্যালরি--বল? একটা ছোট পেগ দে ভাই --মাত্র 55 ক্যালরি । কি বানাবি --ব্লাডি মেরি না স্ক্রু ডাইভার? যাই হোক--সঙ্গে যোগ হল অতিরিক্ত চারশো ক্যালরি । এক দু সিপের পর --'চিকেন উইথ চিজ' এক টুকরো দাঁতে কাটতে নেওয়া হল--আরো অতিরিক্ত চারশো ষাট ক্যালরি । এক পেগের পর--আর একটু--। প্রতিদিন অফিসে কারো না কারো জন্মদিন অথবা প্রমোশন অথবা প্রজেক্ট শেষের পার্টি অথবা অন্য কিছু----। ওয়ার্কং লাঞ্চে পুরোনো ভাত ডাল মাছ তরকারি কোনোমতেই নেই । নেই হাঁটার সময় নেই ঠিক সময়ে রাতে ঘুমোতে যাবার সুযোগ। পরদিনের প্রেজেন্টেশন রেডি করতে হবে নয়তো দূরের বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট ফেসবুক গেমস । ফল মুটিয়ে যাওয়া বা ওবেসিটি । ওবেসিটির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আসে ডায়াবেটিস,উচ্চ রক্তচাপ,হার্টের সমস্যা । বেশী ক্যালরিযুক্ত ভুল খাবারের ছক,শরীর নড়াচড়া কম আর রাতজাগা --এই তিন শলাকার আক্রমণে বর্তমান প্রজন্মের জননক্ষম বয়সী অর্ধেকেরও বেশী উচ্চবিত্ত সমাজের মেয়েরা PCOS এর শিকার । পরিণতি বন্ধ্যাত্ব । তারপর IVF --যার নূন্যতম খরচ আড়াই লাখ টাকা,সঙ্গে কষ্ট ঝুঁকি তো আছেই । এই ভয়ানক ভুল স্বাস্থ্যের আবর্তে ঘুরছে মেয়েরা । ওপরতলার "যা ইচ্ছে করা যায় বা খোলাখুলি কথা বল " ধারনার তলানি যেটুকু চুঁইয়ে নীচের তলায় নামছে তা হল একই ব্রান্ডের ফর্সা হবার ক্রীম অথবা পোষাক । ওবেসিটি আর অ্যনিমিয়ার মাঝের শূন্যস্থানটা লোপাট করা কিভাবে সম্ভব-- আর্থসামাজিক অবস্থা অনুযায়ী যাপনের এক বন্ধু মডেল ছড়িয়ে দাও --যে যেভাবে পার ।