ধু ধু পথ দিয়ে অনেক সময় চলছি। দূর থেকে হাতিপাহাড়ের নীল ছায়া দেখলাম, শুঁড় মুড়ে শুয়ে আছে। কাশের বন আর সবুজ বালক ধানক্ষেত দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে। এইবার ঝোপঝাড়ের মধ্যে ডানদিকে তীরচিহ্ন দেওয়া নীলরঙা বোর্ডটা নজরে এল। ভরতপুর চিত্রকর গ্রাম চার কিমি।
সরু পথে গাড়ী ঢুকল। একটু এগিয়েছি -- বাঁ দিকে দীঘি। হাওয়া দীঘির জলে বিলি কাটছে। পাশে এক আদ্যিকালের তেঁতুল গাছ। ঝিরিঝিরি পাতার কত যে কথা --একটু দাঁড়িয়ে না শুনলেই নয়। ভাদ্দুরে গরমেও এমন শীতল বাতাসের যাদুকথা জানে শুধু জল আর গাছ। পাতিহাঁস একঝাঁক। চান টান করে ধীরে সুস্থে কোমর দুলিয়ে জল থেকে উঠল। পালকের খাঁজে ঠোঁট ডুবিয়ে আদরের ওমে ব্যস্ত। নিস্তব্ধতাকে প্রশ্ন করে একটা ছাগল ডেকে উঠল। গামছার ফেট্টি মাথায় বেঁধে দুজন তেঁতুল গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। পাশে কোনো মানুষ এল কি গেল সে ব্যাপারে নির্বিকার। গুটি গুটি আমরাও এগোই। এসে গেলাম কখন বোঝা গেল না। গুটিকয়েক ভাঙাচোরা কুঁড়ে। ঝোড়ো হাওয়া দিলেই পড়ে যাবে প্রায়।
এটাই নাকি চিত্রকর গ্রাম। ভরতপুর। মোটে পনেরো ঘর চিত্রকর। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে গেলাম প্রথম বাড়িতেই। সঙ্গে দেবাশীষ মুখার্জি ভাই--- আগে এসেছে কিনা। বলল--দাঁড়ান ওই খানটায় , অনিলকে ফোন লাগাই। একটা পুরোনো গরীব কুয়ো --ডুমুর অশথ গাছের শেকড় জল ছোঁয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। ঝুঁকে দেখতে দেখতেই ডাক এল। গাঁয়ের একটি সিমেন্ট বাঁধানো দাওয়ায় ওরা ছবি বিছিয়ে দিচ্ছে। এটাই নিয়ম। বাইরের কেউ এলে পনেরো ঘরে কানাকানি করেই খবর পৌঁছে যায়--যার যেটুকু পুঁজি এনে সাজায় সেই দাওয়ায়।
ওড়িষার রঘুরাজপুর শিল্পগ্রামে যাঁরা গেছেন --ঘরে ঘরে দোকানের আইডিয়াটা জানেন। এরা এত অভাবী যে রঘুরাজপুরে যেমন দেখা যায়--শৈল্পিক নিকানো আঙিনায, ছবি এঁকে সাজানো থাম , প্রবেশদ্বার--হতশ্রী এ গ্রামে সেসব কিছুই নেই। খেজুর পাতার বেড়া দেওয়া উঠোন। ছেঁড়া চট টাঙানো আড়াল। ভাঙা টালি ছাদ।
কিন্তু ওই যে দাওয়ায় বসে আছে --একমুখ দাড়ি , কোটর চক্ষু মুখ --কথা বললেই বুঝতে পারবে তাদের দেমাক। প্রাচীন চিত্রকর যে ! আধুনিক রঙে আঁকলে যে দুপয়সা বেশী রোজগার হয়--সেকথা বললে খেঁকিয়ে তেড়ে আসবে --"আমরা আজ পর্যন্ত প্রাকৃতিক রঙ ছাড়া পটে কিছু ব্যবহার করি না "।
এজন্যই তো খুঁজে খুঁজে আসা। কোনো ঘরের খিড়কি পেরোলেই ভয়ানক একটা পচা গন্ধে গতজন্মের ভাত উঠে আসবে। নাকে কাপড় চাপা দিলেই ওরা বলবে --বলেছিলাম না --চিত্রকর ছাড়া আর কেউ সহ্য করতে পারবেন না। তা-- আমার তো হাসপাতাল, মর্গ-- সব গন্ধই নাকে সওয়া। এসেছি যখন-- উঁকিঝুঁকি মেরে পুরো ব্যাপারটা না বুঝে যাব না। গামলায় থকথকে সবুজ ওগুলো কি ? সীমপাতা আর তেলাকুচো পাতা পচানো হচ্ছে--সবুজ রঙ হবে। 'পচানো ' প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলে ছেঁকে রসটা বের করে নেওয়া হবে।
ওই যে আর এক গামলায় পচতে দেওয়া আছে পুঁই ফল --ম্যাজেন্টা রঙ। চারদিকে ছোট ছোট নারকেল মালা --কোনটাতে বাবলা গাছের আঠা, কোনটাতে তেঁতুল বীজের। ছাঁকা রঙ মেশানো হবে এই আঠার সঙ্গে যাতে কাপড়ে বেশ সেঁটে থাকে বহুদিন।
দাওয়ায় থরে থরে সাজানো বাংলার প্রাচীন পট ---
কত প্রাচীন ? তা-- চিত্রশৈলীর কথা ধরলে প্রায় আড়াই হাজার বছর !!!
ইউক্রেনের "Petrykivka" চিত্রশৈলী ও তার জন্য বিখ্যাত গ্রামটি যদি ইউনেস্কো হেরিটেজ স্বীকৃতি পায় , তাহলে বাংলার পটচিত্রও কিছু কম গৌরবের নয়। বাংলার নিজস্ব শিল্পঘরাণা হল বাংলার "পটচিত্র"। Petrykivka পেন্টিং এর শুরু সপ্তদশ শতাব্দীতে আর আড়াই হাজার বছর ধরে বাংলার পটচিত্র আমাদের ঐতিহ্যের বাহক। বাংলার পটের
উল্লেখিত প্রমাণ মেলে প্রথম শতাব্দীতে বৌদ্ধ সাহিত্যে,দ্বিতীয় শতাব্দীতে "হরিবংশ" , চতুর্থ শতাব্দীতে "অভিজ্ঞান শকুন্তলা " ও "মালবিকা অগ্নিমিত্র" --পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে।
রূপ গোস্বামীর 'বিদগ্ধ মাধব' এ প্রমাণ মেলে শ্রীচৈতন্যের আমলে পটচিত্রের উপস্থিতির কথা।
জল জঙ্গলে ভরা বাংলার নাম সেই কবে থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন এই শিল্পীরা। দামী ক্যানভাসে তেলরঙে সাজানো ছবি নয় --সামান্য ঘরোয়া উপাদানে অসামান্য চলমান জীবন এঁকেছিলেন পটুয়ারা।
পৃথিবীর প্রথম ও চিরন্তন মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম চিত্র। এই ভাষাকে দেশ কালের গন্ডি বেঁধে রাখতে পারেনি কোনোদিন--কোনো বিজ্ঞানীকে মাথার চুল ছিঁড়ে এ ভাষা পুনরুদ্ধার করতে হয় না।
পট কথাটি এসেছে সংস্কৃত পট্ট ( বস্ত্র) থেকে। এ ছবি আঁকা হত কাপড়ে। গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে জমি তৈরি করা হত --তার উপর প্রাকৃতিক রঙে ছবি আঁকা হত। আশ্চর্য হবার সীমা থাকে না , যখন দেখি দু'একটা পটুয়া গ্রামে, আজ পর্যন্ত কোনো আধুনিক পদ্ধতি প্রবেশ করতে পারেনি। চরম অভাবের সঙ্গে লড়াই অথচ ঐতিহ্য টিঁকিয়ে রেখেছে ।
পশ্চিমবঙ্গে পটচিত্রের প্রচলন ছিল বর্ধমান, বাঁকুড়া,পুরুলিয়া,পশ্চিম মেদিনীপুর,মুর্শিদাবাদ জেলা অঞ্চলে। বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল গাজীর পট।
আকারগত পার্থক্যে পট হয় দু'রকমের--জড়ানো পট আর চৌকোশ পট।
জড়ানো ( Scroll) পটে উপর নীচে কাঠের সরু লাঠিতে সেঁটে রাখা কাপড় গুটিয়ে রাখা হয়। পনেরো থেকে তিরিশ ফুট লম্বা হতে পারে , দু তিন ফুট চওড়া --ধীরে ধীরে দর্শকের কাছে উন্মোচিত হতে থাকে ধারাবাহিক ভাবে আঁকা গল্প, ঘটনাবলী। বিনোদন মাধ্যমহীন যুগে যেন এখনকার টিভি সিরিয়াল অথবা চলচ্চিত্র !
চৌকোপট হল ছোট আয়তক্ষেত্র আকারের ছবি।
পৃথিবীর অন্যান্য সব চিত্রকলার চাইতে পটচিত্র ভিন্নধর্মী। শিল্পী নিজের খেয়ালে যে সৃষ্টি করেন --সেই "Art for Art's sake" বিখ্যাত শব্দবন্ধটি পটচিত্রের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। কারণ--
পটচিত্র বিষয়ভিত্তিক। পটচিত্র প্রয়োজনীয়। পটচিত্র শিল্পীর জীবিকা।
পটচিত্র একটা বিশেষ অঞ্চলের নৃতত্ত্বগত গবেষণার উপকরণ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক হাত থেকে অন্য হাতে এই চিত্রশৈলীর উত্তরাধিকার বয়ে চলে।
প্রাচীন পটচিত্রের অধিকাংশ হত ধর্মীয়। পরে চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশভিত্তিক, বিষয়নিরপেক্ষ পট আঁকার প্রচলন হয়।
ধর্মীয় পটচিত্রের বিষয়ে পুরাণের আনাগোনা চিরকাল--রাবণবধ, সীতাহরণ, রাজা হরিশচন্দ্র খুব কমন টপিক। দেবদেবীর লীলাকাহিনী সব পট শিল্পীদেরই তুলির ডগায় শন শন করে এগোয় --কৃষ্ণলীলা , গৌরাঙ্গলীলা , রামলীলা,শিবপার্বতী লীলা। পটের আর একটি বহুচর্চিত বিষয় বাংলার মঙ্গলকাব্য। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল। অত টুকুন লম্বা পরিসরে তুলিতে কাহিনীর ধারাভাষ্য লেখা হতে থাকে। রেখার কি সরল অথচ আত্মবিশ্বাসী চলন গমন। পটচিত্রের সব ছবি দ্বিমাত্রিক। রেখাগুলির দৃঢ়তা বলিষ্ঠতা ও গতিময়তা পটের সিগনেচার স্টাইল। রেখার মধ্যেকার অঞ্চলে রঙ গাঢ় ও উজ্জ্বল। চরিত্রগুলির হাত পা মুখ নিঁখুত অরিজিনাল ফিগার হয়ে ওঠে না কখনো কিন্তু এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে দর্শকের মনে নাড়া দেয়। দীঘল চোখ , তীক্ষ্ম নাসা , ছুঁচলো চিবুক --ছবিতে একটা নাটকীয়তা আনে। নাটকের মেকআপে গাঢ় করে ভুরু, চোখ , ঠোঁটে রঙ লাগানো হয় তার কারণ সামান্য মুখপেশীর সংকোচনে , মুখের অভিব্যক্তি দূরের দর্শকদের কাছে যাতে বর্ধিতভাবে পৌঁছাতে পারে --পটচিত্রেও তেমনি ভাবে মুখ নাক চোখ আঁকা হয় --মনে হয় চরিত্রগুলি পটুয়ার গানের সঙ্গে নড়ে চড়ে কথা বলে। পটুয়ারা এইসব ছবি দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন --সঙ্গে সেই ছবির গল্প অনুযায়ী গান করতেন।। যিনি চিত্রকর তিনিই গান লিখতেন , সুর দিতেন , গাইতেন। অর্থাৎ একাধারে চিত্রশিল্পী, কবি, গীতিকার ও সুরকার।
এই বিশেষ ঘরানার গানকে বলা হয় "পটুয়া সঙ্গীত "।
আধুনিক বিনোদন জগতের নানা জাঁকজমকে, পটচিত্র ও পটুয়াসংগীতকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছে।
তবু ইতিহাস থেকে যায়। কোথাও কোথাও সশরীরে। ভরতপুর গ্রামে গিয়ে আলাপ পরিচয় হল অনিল চিত্রকর, ভাগবত চিত্রকরের সঙ্গে। আমাদের আসার খবর দিলে সেই যে দু'চারটে পট নিয়ে দাওয়ায় এসে বসলেন। বেশি আঁকার মত কাগজ কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। শিল্পী হিসেবে কেউ এখন পর্যন্ত নিজের নাম নথিভুক্ত করেননি, সুতরাং সরকারি হস্তশিল্প মেলার বিকিকিনিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কিভাবে কোথায় যেতে হবে সব অজানা। শুধু ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঘরানা টুকু। আমরা বিভিন্ন শিল্পমেলায়, আরবান হাটে, যে পটশিল্পীদের দেখি --সবাই অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকেন আজকাল। কারণ --সস্তা, সহজলভ্য, টেঁকসই, রঙের উজ্জ্বলতা, চটপট শুকিয়ে যায়, সব রকম শেডের রঙ রেডিমেড পাওয়া যায় ইত্যাদি। ভরতপুরের মতো কতিপয় গ্রামে এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে শুধু প্রাকৃতিক রঙে পট আঁকা হয়।
কিভাবে তৈরী করা হয় সেইসব রঙ ?
কালো রঙ ধরা হয় প্রদীপের উপর নারকেল মালার ভুসোকালি (কার্বন) অথবা বাঁশ পুড়িয়ে। সবুজ রঙ সীম , তেলাকুচো পাতা থেকে। দেশী নীল, গেরিমাটি, হলুদ, সিঁদুর, পাকা পুঁই বীজ ।সত্যিই তো --এমন কোন রঙ আছে যা প্রকৃতিতে মেলে না ? এই প্রাকৃতিক উপাদান গুলো জলে গুলে ছেঁকে মেশানো হয় জোরালো আঠার সঙ্গে। ফেবিকল নয় --এ আঠাও প্রকৃতির দান। বাবলা গাছের আঠা, তেঁতুল বীজের আঠা, বেলের আঠা। পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেওয়া হয় নিমের আঠা। এতসব প্রক্রিয়ায় রঙ তৈরীতে ব্যাপক হাঙ্গামা, প্রচুর সময় নষ্ট। তাই এই শিল্পীরা ছবি কম আঁকেন। ছবিগুলির ঔজ্জ্বল্য অ্যাক্রিলিকে আঁকা রূপান্তরিত পটশিল্পীদের চাইতে কিছু কম। যেমন গিল্টি সোনা আর খাঁটি সোনা।
পটচিত্রশিল্পীরা ধর্ম নিরপেক্ষ। কেউ কেউ বৃহদ্ধর্মপুরাণের রেফারেন্স টেনে বলেন --এরা বিশ্বকর্মার বংশধর। এক নীচু জাতের মেয়ের সঙ্গে মিলনের ফলে বিশ্বকর্মা নয় ছেলে হয়--এদের কনিষ্ঠ সন্তান চিত্রকর।
রুডওয়ার্ড কিপলিং ১৯১৭ সালে পটচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে কিছু ছবি কিনে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে তা রাখা আছে।
পটুয়া গানের সংগ্রাহক গুরুসদয় দত্তের বইতে হারিয়ে যাওয়া পটের গানের খোঁজ পাওয়া যায়। গানের কলি ,শব্দ --দেব দেবীর মুখে কথা বসিয়ে--বাংলার সাধারণ গ্রাম্য মানুষের জীবনযাপনের গল্পই বলে।
রাধার কেশচর্চার কথায় --
"কেশগুলি আঁচুড়িয়ে করেন গোটা গোটা
কেশের মাঝে তুলে দিছে সিন্দুরের ফোঁটা "
শিবপার্বতী লীলার গানে --পার্বতী একবার শিবের কাছে, শাখা পলা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরেছেন। শিব বলছেন তাঁকে --"রূপসোনা পর গৌরী আকালে বেচি খাবি / আঙ্গা ( রাঙ্গা) উলি শঙ্খ পরে কোন সরগে যাবি "
অ্যান্ড্রয়েড ফোনে যখন বিশ্বব্রহ্মান্ড হাতের আঙ্গুলে ধরা আছে , এসব গান এই শিল্পের হৃদয়ের কথা বোঝা কঠিন। ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে --যখন , নিঝুম দুপুরে গৃহবধূরা হয়তো অপেক্ষা করত কবে আসবে পটুয়ারা ! তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা ছোট ঢেউ তুলত বেহুলার দুঃখকথা, শিব পার্বতীর বিয়ের রঙ্গ । ছেলেরা খেলা ফেলে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত পটুয়াকে ঘিরে। ঝোলা থেকে কখন তিনি কৃষ্ণের পট খুলে গান ধরেন --
"
হরি বিনে বৃন্দাবনে আর কি ব্রজে শোভা পায়।
জলে কৃষ্ণ স্থলে কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহিমন্ডলে। "
আদিবাসী গ্রামে আজও চলে পটুয়া গান --তাই একবেলা আধপেটা খেয়েও চিত্রকররা পট আঁকেন।
আজ প্রায় বিলুপ্ত অথচ একসময়ে বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পেত কালীঘাটের পট। সেই "কালীঘাটের পট" এর কথা একটু আলাদা ভাবেই বলতে হবে। ঔপনিবেশিক কলকাতায় উনবিংশ শতাব্দী থেকে তীর্থভ্রমণের তালিকায় শীর্ষে ছিল কালীঘাট। এই তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করেই কালীঘাটের পটের জন্ম। ১৮৫০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত এই পটের চাহিদা তুঙ্গে ছিল। সব তীর্থযাত্রীরা স্মারক হিসেবে স্বল্পদামের এই পট কিনে নিয়ে যেতেন। বাংলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে পটুয়ারা কালীঘাটে কেন্দ্রীভূত হয়। আঁকতে থাকে প্রথমে দেবদেবীর পট। ছোট চৌকো আকার --জড়ানো পটের মতো ধারাবাহিক কাহিনী নয়, বরং কাহিনীর খন্ডাংশ দিয়েই একটি পট। ক্রমশ কালীঘাটের পটের বিষয়বৈচিত্র্যে ফুটে উঠতে লাগল শিল্পীর বুদ্ধিমত্তা। বাঁধা গতের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নকলনবিশ আঁকা ছাপিয়ে এল সামাজিক সমালোচনা, ব্যঙ্গ, রঙ্গ রসিকতা। যেমন --"আলালের ঘরের দুলাল ", "বাবু ও বেশ্যা", হুক্কা বাবু। এই স্বল্প শিক্ষিত শিল্পীরা হয়ে উঠেছিলেন বাংলার নব জাগরণের শরিক। অন্তঃসারশূন্য তৎকালীন বাবু কালচারকে ব্যঙ্গ করে কালীঘাটের শিল্পীরা নানা বিচিত্র পট এঁকেছিলেন। ছোট ছোট মোটা কালো রেখার ছন্দ যেন এক স্যাটায়ার ! ভন্ডামি মিথ্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেন এক সপাট চাবুক ! রক্ষিতাকে জড়িয়ে ধরা বাবুর ,লুটোপুটি খাওয়া ধুতির কুঁচির পাড় আঁকতে শিল্পী যে কালো রেখার হিল্লোল ব্যবহার করতেন --তাতেই যেন সব লাম্পট্যের কথা নীরবে অথচ সোচ্চারে বলা হয়ে যেত। সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিল "মহান্ত-এলোকেশী" সিরিজ। ১৮৭৩ সালের সেই বিখ্যাত রোমহর্ষক খুনের ঘটনাকে , কালীঘাটের পটের শিল্পীরা ধরে রেখেছেন --ঠিক যেন সমকালের সাংবাদিকের ভিডিও ক্লিপিং !
ওরিয়েন্টাল আর্টে উৎসাহী, শিল্প ঐতিহাসিক উইলিয়াম আর্চার সাহেব কালীঘাটের পটকে স্থায়ী ক্যাটালগে ধরে রেখেছেন। এ বিষয়ে তাঁর তিনটি কীর্তি কালীঘাট পটের প্রামাণ্য নথি --Baazar painting of Calcutta : The Style of Kalighat ( 1953), Kalighat Drawings ( 1962) , Kalighat Painting--A Catalogue and Intrduction ( 1971). জহুরি জহর চেনেন কিনা !
তিনি কালীঘাটের শিল্পীদের পাশ্চাত্যের পিকাসো, মাতিসের সঙ্গে তুলনা করতেও দ্বিধা করেননি।
চিত্রশিল্প পোস্ট পোস্টমডার্ন যুগ পেরোচ্ছে -- বিবর্তন প্রবহমান। পটচিত্র বিলুপ্তির পথে , তবু --পটের ছবি কি যেন এক মায়ার টানে আজো পিছু ডাকে।
লেখাটি খুবই ইনফর্মাটেটিভ হয়েছে ।স্টুডেন্টস ফ্রেন্ডলি যাকে বলা যায় ।ভাষাও খুব সুন্দর । বিশেষণ গুলি মৌলিক ।তবে আমার মনে হয় একটি লেখাতে মন ছোঁয়া বিশেষণ ছত্রেছত্রে দেওয়া অনুচিত ,ডিশ এর মধ্যে কিসমিস কম থাকলে খুঁজে পাবার আনন্দভোক্তার আনন্দ যাঁরা বোঝেন তাঁরা জানেন ।যামিনী রায় এর লেখা পটুয়া চিত্র এর সাথে মিলিয়ে পড়লে কালীঘাটের পট ,বাংলার এই লোকশিল্পের বিশ্বপ্রেক্ষিতে যে শ্রেষ্ঠত্ব তার কারণ আরো স্পষ্ট হবে বলে মনে করি। কণিকা বিশ্বাস ।
কোন জেলায় এই পটুয়াদের গ্রাম ? আমরা শহুরেরা কোনো খবরই রাখি না।
ভাল লাগল লেখাটা। কতো অজানারে জানাইলে তুমি...
কত কি জানলাম। থাঙ্কু। কোথায় এটা?