ইতিহাসের মরচে ধরা পাতা থেকে আজও চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে রক্তের টুপটাপ। ৬৭ বছরের নির্মম ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক বিদ্রূপের নিরবিচ্ছিন্ন বঞ্চনার স্রোতপ্রবাহ আজও চলকে ওঠে শিঙ্গিমারির চরাচরে। দুর্ভাগা বঞ্চিতদের অসহায় আর্তনাদের প্রতিধ্বনি এখনও পাক খায় সাবেক ছিটমহলের অন্তরে-বাহিরে। তবু শরৎ এলেই পূজোর গন্ধে মম করে ওঠে সাবেক ছিটমহলের আনাচ-কানাচ। নিকষ কালো অন্ধকার রাতের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে শারদ সূর্যের ঝলমলে আলো গায়ে মেখে নতুন দিনের আশায় মেতে ওঠে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের প্রান্তে পড়ে থাকা কোচবিহার জেলার দিনহাটা ব্লকের সাবেক বাত্রিগাছ বাংলাদেশী ছিটমহলের প্রান্তিক মানুষগুলো। দেশভাগের নির্মম যাঁতাকলে ভারতের মধ্যে থেকেও এই ‘অধম মানুষগুলো’ অনাহুত বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বেঁচে ছিলেন স্বাধীনতা উত্তর সুদীর্ঘ ৬৭ বছর। ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত ‘ছিটমহল বিনিময় চুক্তি’র সুবাদে আজ কিন্তু তাঁরা সকলেই কাগজে কলমে এবং মননে নির্ভেজাল ভারতীয়। এতদিনের অনাস্বাদিত ‘স্বাধীনতার’ দমকা বাতাসের তরঙ্গে উদ্বেল কাশফুল অনাবিল উচ্ছ্বাসে দুলে ওঠে শিঙ্গিমারির চরাচরে। মেঠো পথের ধারে খুশির শিশির বিন্দু বুকে ভরে ঝরে পড়ে থাকে ‘অবহেলার শিউলি ফুল’। এমনি করেই শারদ উৎসব আচমকা এসে পড়ে সাবেক ছিটের আদিগন্ত জুড়ে। ছিটের মানুষের কাঁধে ভর করে বাঁশের মাচায় চেপে জগৎ জননী মহামায়াও এসে বসেন নিকানো মণ্ডপে। ঝলমলে দিনের শেষে শিঙ্গিমারির বুক উজাড় করে ছিটের শারদ আকাশে একফালি চাঁদও উঁকি মারে। কেবল ‘শিউলি ফুল’ ফুঁপিয়ে ওঠে শিঙ্গিমারির কূলে ক্ষণে ক্ষণে দুলে ওঠা কাশবনের অন্তরালে।
সাবেক বাংলাদেশী বাত্রিগাছ ছিটমহলের মোট আয়তন ৫৭৭ একরের কিছু বেশী। বাত্রিগাছের কেন্দ্রস্থলেই চন্দ্রধরের কাঠের আসবাবপত্র নির্মাণের দোকান। মধ্য যৌবনের চন্দ্রধরের প্রথম পক্ষের একমাত্র মেয়ে শিউলি। এই সবে দশে পা রেখেছে। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা বুকে নিয়ে ছিটের বাসিন্দার পরিচয় গোপন রেখেই চন্দ্রধর ও তাঁর প্রথম পক্ষের বউ ভারতীয় ইস্কুলে ভর্তি করেছিল শিউলিকে। তারপরে শিঙ্গিমারির বুক উপচে বিস্তর প্লাবনের ঘনঘটা বয়ে গেছে। ঘরে শিউলির নতুন মা এসেছে। নতুন মা আসার কিছু সময় পরেই ছোট্ট ভাইও হয়েছে। তিন ক্লাসের পরে শিউলির ইস্কুলের দরজাটাও চিরতরের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে নতুন মা আসার পর থেকেই বাবাও কেমন যেন বদলে গেছে। ভাই হওয়ার পর থেকে সে যেন এ সংসারে একেবারেই অপাংতেও। ঘরে সারাদিন নতুন মার ফাই-ফরমাজ খাটা এখন রোজনামচা। আগে এত খাটতে দেখলে বাবা নতুন মায়ের অগোচরে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। লজেন্স আর বাদামও কিনে দিতো। ইদানিং বাবা যেন কত দূরের পৃথিবী! আবছা মার আবছায়া শিউলির থেকে থেকে মনে পড়ে। রাতে একলা বিছানায় ভেজা বালিশে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে কখন যে সহস্র কোটি ঘুমের জোনাকি এসে তাঁর চোখের পাতা ছেয়ে ফেলে, সে তা টেরও পায়না। পরদিন ভোর হতেই আবার সেই বারোমাস্যা।
সমস্ত দিনের ঘর গেরস্থালীর কাজের অন্তে শিউলি ছুটে চলে আসে ছিটমহলের প্রান্তে অন্ধ অকৃতদার বসির চাচার একচালা মুদি দোকানের সামনে। খদ্দের না থাকলে দোকানে বসেই চাচা আপনমনে বাঁশের বাঁশি বাঁজায়। তাঁর বাঁশির সুরের মন্ত্রমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে শিউলি এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁশি থামতেই বসির চাচা যেন শিউলির গন্ধ পায় ... “কোথায় রে তুই? এসেছিস মা? আমার কাছে আয়।” শিউলি চাচার পাশে গিয়ে বসে। অন্ধ বসির মিয়াঁ তাঁর সকল ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি উজাড় করে শিউলির গালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চাচার স্নেহাতুর স্পর্শে শিউলির চোখের পাতা চিকচিক করে ওঠে। বসির চাচারও। যতক্ষণ না দোকানে কোন খদ্দের আসে, শিউলি আর বসির মিয়াঁ অঝোরে কাঁদতে থাকে। খদ্দের চলে যাওয়ার পর মিয়াঁ কাঁচের শিশি হাতড়ে মুঠো ভরে বিস্কুট আর লজেন্স তুলে দেয় শিউলির হাতে। বসির চাচার কাছে এলে শিউলির মন ভরে যায়। পেটও। সারাদিনের হাড়ভাঙা ক্লান্তি যেন নিমেষে উবে যায় চাচার আদুরী পরশে। পূজোতে শিউলিকে এখন আর কেউ নতুন জামা কিনে দেয় না। বসির মিয়াঁ দেখতে না পেলেও পূজোর গন্ধ ঠিক পায়। আগে থেকেই আনসারুলকে দিয়ে দিনহাটার জন্মাষ্টমীর মেলা থেকে শিউলির জন্য কাঁচের চুড়ি আর লাল ফিতে কিনে আনিয়ে রাখে। কাঁচের চুড়ি আর লাল ফিতে পেয়ে শিউলি বারবার গন্ধ শোঁকে। ওঁর সারা মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। শিউলির খুশিতে বসির মিয়াঁরও অন্ধ চোখ যেন প্রশান্তিতে চকচক করে জ্বলে ওঠে। মিয়াঁ তাঁর চক্ষুষ্মান অন্তঃপুরের সমস্ত দোয়া উজাড় করে দেয় শিউলির মঙ্গল কামনায়। দূর থেকে ভেসে আসা মাগ্রিবের আজানের সুর বসির মিয়াঁকে চঞ্চল করে তোলে। লাঠিতে ভড় দিয়ে মিয়াঁ নামাজের জায়গা খোঁজে।
পুজোর দিনগুলিতে সন্ধ্যে নামার আগেই শিউলি চলে আসে শিঙ্গিমারি নদীর কাছে। সাবেক বাত্রিগাছ ছিটমহলের কোল ঘেঁসে শিঙ্গিমারি বয়ে চলেছে ভূগোলের মানচিত্র ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া আর এক বঙ্গদেশের হাতছানির অমোঘ ইশারায়। শিঙ্গিমারির কাছে এলেই শিউলি যেন তাঁর মাকে ফিরে পায়। পূজো আসলেই শিউলির গোলাপি মনটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। দুর্গার মুখ দেখলেই কেবলই মায়ের মুখ মনে পড়ে। ফ্যালফ্যাল করে সে মণ্ডপের দুগগা মার মুখপানে চেয়ে থাকে। শিউলির বিলক্ষণ মনে আছে, এমনই এক শারদ সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে আসার সন্ধিক্ষণে শিঙ্গিমারির কূল ধরে মা চলেছিল বিসর্জনের পথে। বুকের মধ্যে সহস্র কোটি ঢাকের আর্তনাদ। মায়ের নরম শরীরটা যখন গলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল, জ্বলন্ত চিতার শিওরে ঠায় বসে থাকা ছোট্ট শিউলি সেই অস্থিভস্ম গচ্ছিত রেখে গিয়েছিল শিঙ্গিমারির বক্ষ মাঝে। যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট শিঙ্গিমারির কালো জল সেদিন যেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। রক্তপাতে ডুবে যাওয়ার পরেও সেদিনের সূর্যের ঝুঁকে পড়া ঠোঁট বেয়ে ঝরে পড়েছিল বিষাদের অন্তিম রক্তিম আভা। কাশবনের অন্তরে সেদিন থরে থরে জমে ছিল থোকা থোকা অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ। সেই কবেকার মায়ের মমতা মাখা পোড়া ছাই আজও বুঝি পাক খেয়ে চলেছে বিষণ্ণ নদীর নিঃসঙ্গ তরঙ্গের অন্তরঙ্গ ঘূর্ণিপাকে!
মণ্ডপে মণ্ডপে তখন সন্ধিপূজার আয়োজনের ব্যস্ততা। মহল্লায় মহল্লায় উৎসবের আবহে মাতোয়ারা ছিটের আবালবৃদ্ধবনিতারা। চাঁদের আলোয় শিঙ্গিমারির অবারিত দিগন্ত উদ্ভাসিত না হওয়া পর্যন্ত শিউলি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নদীর চোখে চোখ রেখে। ঝিঝি পোকা আর জোনাকির যুগলবন্দীতে মুখরিত শিঙ্গিমারির আঁকাবাঁকা পাড়। অবহেলায় বেড়ে ওঠা মেঠো ফুলের খিলখিল হাসিতেও যেন বিষাদের হাহুতাশ। আশ্বিনের অস্পষ্ট জ্যোৎস্না গায়ে মেখে কুয়াশার আবছায়া হাতড়ে অন্য এক দেশের সুলুকসন্ধানে এগিয়ে চলে একাকিনী শিঙ্গিমারি। জলের ছলাৎ ছলাৎ তরঙ্গ বেয়ে শিউলির খোঁজে কূলে এসে আছড়ে পড়ে শিউলির অভাগী মা। কূলে এসে ফিরে যাওয়া জলতরঙ্গ আঁকড়ে ধরতে প্রাণপণে চেষ্টা করে শিউলি। কিন্তু জলের ঢেউ অধরাই থেকে যায় তাঁর ছোট্ট করতলের নাগালের। ঢেউ ফিরে যেতে যেতে আবার ফিরে ফিরে আসে নতুন আকুতি বয়ে নতুন স্পর্শ নিয়ে। শিউলি আঁজলা ভরে জল তুলে মুখে, ঘাড়ে, মাথায় দেয়। স্বস্তিতে ভরে ওঠে তাঁর অবসন্ন শরীর। এক লহমায় প্রশান্তিতে ভরে যায় তাঁর বিষণ্ণ মন। দূর থেকে ঢাকের বাদ্দির আওয়াজ ভেসে আসে। শিঙ্গিমারির প্রশান্তির জলও আবেগের তরঙ্গে কেঁপে ওঠে। ঢেউয়ের কপালে চাঁদের আলোর সচকিত প্রতিফলনে শিউলি যেন তাঁর মাকে ছুঁয়ে ফেলে। পরনে লাল পেড়ে ঢাকাই শাড়ি, কপাল জুড়ে টকটকে সিঁদুর, চোখদুটো টলোমলো স্নেহাতুর আকুতির ঝর্ণাধারায়। ঠিক যেন দুগগা মা। শিউলির সকল ক্লেশের অশ্রুধারা শুষে নিতে যিনি আজ ‘জীবন-মরনের সীমানা ছাড়িয়ে’ এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁরই আত্মজার মুখোমুখি। দুবাহু বাড়িয়ে তিনি যেন শিউলিকে কোলে তুলে নিতে চাইছেন। স্বগতোক্তির মতো শিউলির মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে ... “মাগোওও”। প্লাবনের বল্গাহিন উচ্ছ্বাসে শিউলির দুচোখ উপচে পড়ে শব্দহীন জলের অন্তহীন ধারায়। মণ্ডপের সুসজ্জিতা প্রতিমার ঠোঁটও কেঁপে ওঠে। দেবীর চালচিত্র থেকে খসে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র, সাজসজ্জা। তাঁর ত্রিনয়ন চিকচিক করে ওঠে। দমকা হাওয়ায় নিভে যায় মণ্ডপের গৌরবান্বিত পঞ্চপ্রদীপ। নদীতীরের বৃক্ষবন অব্যক্ত যন্ত্রণার ভারে তিরতির করে দুলে ওঠে। বটের স্মৃতির স্তূপের ওপরে জড়সড় হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে থুরথুরে পেঁচা। শারদ সন্ধ্যা যেন থমকে পড়ে শিউলি ফোঁটা শিঙ্গিমারির ইচ্ছেডাঙায়! শিঙ্গিমারি প্রাণপণে আঘ্রান নেয় শিউলিময় বাতাসের। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে ওঠে ... “জ্বালিয়ে দিলাম কষ্টগুলো, ধুপকাঠি হয়ে তোর জন্য”। মায়ের কিনে দেওয়া পরনের একমাত্র ‘ভালো জামাটা’র দিকে চেয়ে দেখে শিউলি। প্রাণপণে জামাটার গন্ধ শুঁকে নেয় সে। তাঁর অভাগী মাকে শিঙ্গিমারির আঁচলে গচ্ছিত রেখে শিউলি এবার পা বাড়ায় ঘরে ফেরার বাধ্যবাধকতায়।
ততক্ষণে মণ্ডপে আবালবৃদ্ধবনিতার ঢল নেমেছে সাবেক ছিটের পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। শিঙ্গিমারি পাড়ে নিজের গন্ধ উজাড় করে পড়শিদের নতুন জামার গন্ধে বিভোর হয়ে পায়ে পায়ে ঘরে ফেরে শিউলি। বিষাদের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ক্লিষ্ট মননে আর এক শিউলি ফোটা ভোরের অপেক্ষায় বয়ে চলে একাকিনী শিঙ্গিমারি। আর তার তরঙ্গের ঘূর্ণিপাকে পাক খেতে খেতে শিউলির মার দুচোখ উপচে পড়ে ছলাৎ ছলাৎ অস্ফুট ক্রন্দনে। শারদ উৎসবের রাতে বাড়ীতে উচ্ছিষ্ট কোন খাবার না থাকায় মায়ের দেওয়া সেই একমাত্র ‘ভালো জামাটা’ পরেই তাঁর একলা বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে অভুক্ত শিউলি। শিঙ্গিমারির কূলে আলো আঁধারের আবছায়ার প্রান্তরে রবি ঠাকুরের দীর্ঘশ্বাস যেন অস্ফুটে ডুকরে ওঠে ... “শূন্য প্রাণে চেয়ে প্রহর গণি গণি, দেখো কাটে কিনা দীর্ঘ রজনী; দুঃখ জানায়ে কি হবে জননী, নির্মম চেতনাহীন পাষাণে ... কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখ পানে!”