যেন সারা আকাশ জুড়ে ওঁত পাতা শকুনের শ্যেন চোখ। মৃত্যুদূত যেন হুকুমের অপেক্ষায় খুর ঠুকছে। চারিদিকে বীজাণুর রক্তচক্ষু, ব্যাধির ক্ষিপ্রতা, মৃত মানুষের অসাড় গন্ধের ভয়াভয়তা। স্বজনহারাদের বুকফাটা আর্তনাদের হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠা চলমান জগৎসংসার। উৎকণ্ঠায় কম্পিত জীবন প্রবাহের অষ্টপ্রহর। বসন্ত বিদায় নিয়েছে সেই কবে। একে একে এত ফুল ফুটে ওঠার পরেও সারি সারি নিথর দেহের স্তব্ধতায় হতবাক প্রজাপতিরাও যেন গুটিসুটি মেরে রয়ে গেছে গুটিপোকার কোঠরেই। শবযাত্রার ছিটকে পড়া খইয়ে ঢেকে যাচ্ছে স্পর্ধিত জীবনের স্পন্দন। মৃত্যু মিছিলের থিকথিকে ভিড় ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে গলিপথের প্রান্ত ছাড়িয়ে রাজপথ অধিকারে। মহামিছিলের শুরুটা দৃশ্যমান হলেও, দূর দূর পর্যন্ত শেষের চিহ্নমাত্রটুকুরও দেখা নেই। যেন এই শোণিত প্রবাহের কেবল শুরু আছে, শেষের সীমা অনির্দিষ্টতার গোলকধাঁধায় বাঁধা। ব্যাধির দাপটে ত্রস্ত সমাজ জীবন তাই এখনও কুয়াশার আবডালে ঢাকা।
এই ব্যাধিগ্রস্ত পৃথিবীর উন্মনা আঙিনায় প্রায়ই ছেলেবেলার বিকেলের উদ্দাম ঝড় ওঠে। দিকচক্রবাল জুড়ে প্রচণ্ড বজ্র নির্ঘোষও। সযত্নে লালিত শৈশবের সুতোটা ধরে কে যেন হ্যাঁচকা টান মারে। বুকের ভেতরের পরিত্যক্ত সাঁকোটা হঠাৎ দুলে ওঠে। দমবন্ধ করা নিদাঘ দুপুর এক ছুটে চলে আসে ঝোড় বিকেলের দোরগোড়ায়। আদিগন্ত জুড়ে দমকা হাওয়ার এলোমেলো প্রতিধ্বনি। আকাশ জুড়ে মেঘরঙা স্বপ্নের ঘরবাড়ী। গাছেরাও ফেটে পড়ে বল্গাহীন উল্লাসে। এ ওর গায়ে ঠেলাঠেলি। শাখায় শাখায় কত না-বলা কথার অস্ফুট কানাকানি। এমনই এক পাতা ওড়া বিকেলে কাঁপা কাঁপা লাজুক ঠোঁটে কি যেন ফিসফিসিয়ে বলে গিয়েছিল সে! শব্দস্রোতের কানাকানি ছাপিয়ে কাঁচের চুড়ির ঠুংঠাং আস্কারায় সবুজ মনে যেন ঝড়ের দুর্মর লুটোপুটি। দুর্নিবার হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সেই লাজুক কথার মালা হয়তো আজও জমা পড়ে আছে মহাকালের শাখাপ্রশাখার গোপন খাঁজে খাঁজে!
এমনই ভরা গ্রীষ্মের এক নিঝুম দুপুরে আচমকাই বাঁশপাতা উড়ে এসেছিল চোখের টলোমলো পাতা জুড়ে। নরম পায়ের নূপুরের গন্ধে উবে গিয়েছিল খাঁখাঁ দুপুরের শূন্যতা। খুশিতে কেঁপে উঠেছিল তিরতিরে চারাগাছ। মেঠো ফুলের খিলখিল হাসিতে মেঘেরাও নেমে এসেছিল করতলে। এমনই এক চুপ দুপুরেই বাষ্প হয়ে দুরের আকাশে মিলিয়ে গিয়েছিল ধুপের গন্ধ মাখা নূপুরের কলতান। ঝরে আসা বাঁশপাতাও। তালগাছ বেষ্টিত গহীন পুকুরের ঘন জল বুক পেতে আশ্রয় দিয়েছিল ব্যাথাতুর আকাশের প্রতিবিম্বকে। চিল চিৎকারে দিগন্তের পানে পাখা মেলে উড়েছিল অস্থির পানকৌড়ি। তারপর কত কৃষ্ণচূড়ার মহাজাগতিক আলো পার হয়ে এই বীজাণু জর্জরিত কালবেলায় আবার এসে মুখোমুখি অবিকল সেই নিঝুম দুপুর। জানালার চোখ বেয়ে ঝাঁক ঝাঁক কৃষ্ণচূড়ার আবেগ ঘন গাঢ় উচ্ছ্বাস। কাঁচা আমের গন্ধ মাখা অবরুদ্ধ চুপ দুপুরে অবিকল সেই লাজুক নূপুরের রিনিঝিনি!
যৌবনের এক বন্ধু একদিন আচমকাই পাড়ি দিলো মহাকালের সওয়ারি হয়ে। শুধু কি সে একাই বিলীন হল! সঙ্গে নিয়ে গেল যে কত কি। দূরে কোথাও জড় হয়ে চুপিচুপি সিগারেটের সুখটান। ইস্কুল ফেরত ষোড়শী-সপ্তদশীদের পানে মন আনচান করা চাহনি। কর্মহীন দুপুরের জমাট আড্ডা। সন্ধ্যা ঘনাতেই চায়ের কাপের ধোঁয়ার আবর্তে কার্ল মার্ক্স, রোজা লুক্সেমবার্গ, চে গুয়েভারা, মোজার্ট, লিও তলস্তয়, আকিরা কুরোসাওয়া, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের ভিড় থিকথিক। ধপধপে সাদা ফুলের স্তূপে যখন জ্বলে খাক হয়ে যাওয়া ধুপের গন্ধের নিস্তব্ধতা, ঠিক সেই মুহূর্তে চুপিচুপি বলেছিলাম তোকে, “কাল সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে আসবি তো? ‘রেডবুক’টা সঙ্গে আনিস কিন্তু। আজকের মতো তাড়াহুড়ো করে চলে আসিস না যেন”। মহাকালের রথের ঘোড়া ছুটিয়ে বিলীন হতে পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেগেছিল। সেই চল্লিশ মিনিটের প্রতিটা ক্লিষ্ট মুহূর্ত গলে পড়ছিল দুরন্ত শৈশবের চুপচুপে অবগাহন হয়ে, অবাধ্য কৈশোরের অন্তহীন বৃষ্টিধারা বেয়ে, উদ্দাম যৌবনের আকাশকুসুম স্বপ্নের গাল চুঁয়ে। মরে হয়তো তুই বেঁচে গিয়েছিস রে! তোর শরীরকে তো আর স্থবির প্রৌঢ়ত্বের ভাঁজ ছুঁতে পারলো না কোনদিন! তোর জ্যোৎস্না ঠাঁসা বাবুই বাসার মনটাকে তো আর সোনালী সোনালী দিনগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে স্মৃতির জাবড় কাটতে হল না এক মুহূর্তও! এই হিংস্র বীজাণুর লেলিহান আস্ফালন তো তোর অনন্ত মুক্তি কেড়ে নিতে পারলো না কখনও! তুই টেরও পেলি না রে, আম কুড়ানো কালবৈশাখীর ধুন্ধুমার রাতে ইদানীং আমরা সবাই কত নিঝুম একা!
মৃত্যু মিছিল কি শুধু বীজাণুই বয়ে আনে! আঁকিবুঁকি কাটা পথ চলতে চলতে শতসহস্র মৃত্যুকে ডিঙিয়ে বারেবারে জীবনকে ছিনিয়ে আনতে হয়নি কি চড়া দামে! শৈশবের টুপটাপ সকালের মৃত্যুর অমূল্য দামে! কৈশোরের হুহু করা চুপ দুপুরগুলোর মৃত্যুর বিনিময়ে! বুকের ভেতরের আঁকাবাঁকা নদীটা তিলতিল করে শুকিয়ে যাওয়ার চড়া দামে! যৌবনের মন কেমনের ঝোড় বিকেলে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসার তীব্র দীর্ঘনিশ্বাসে! টলমলে সাঁকোটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার বুকফাটা হাহুতাশে! সাদা ফুলের তোড়ায় দগদগে ধুপ কাঠির ধোঁয়ার হাত ধরে জীবনের কত মায়া বিলীন হয়ে যাওয়ার হৃদয়বিদারক সন্ধিক্ষণে! তবু তো একটু একটু করে খড়কুটো ঠোঁটে বয়ে আজও বাবুই তাঁর স্বপ্নের অন্তরে জ্যোৎস্না ভরে রাখে। তবু তো গুঞ্জনে গুঞ্জনে সোনালী মৌমাছির শ্বাসপ্রশ্বাসে মধু ঝরে পড়ে। তবু তো আকন্দ ফুলের ঠোঁটে মৌটুসির আকণ্ঠ চুমুকে অদম্য প্রাণ জেগে ওঠে। এতএব জীবন আঁকড়ে বাঁচে জীবনেরই উচ্ছ্বাস বেয়ে। বীজাণু যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে মৃত্যুর চেয়ে তো বড় নয়! জীবনভর মৃত্যুর নুড়ি পাথর ডিঙিয়ে আসা কলকল জীবনকে আর কোন মৃত্যু ভয়ে জড়সড় করে রাখবে এক আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটিন পিণ্ড?
জীবন গুছিয়ে ফেলে স্মৃতির জলছবির গায়ে সঞ্চিত বুদবুদগুলোর আবর্তনকে ঘিরে। আশৈশব কাল থেকে বয়ে চলা ধিকিধিকি আঁচে দমকা হাওয়া জোয়ার আনে! বীজাণুর এই মত্ততা, ব্যাধির এই তীব্রতা, মৃত্যুর এই ক্ষিপ্রতা ... এই সব কিছু অতিক্রম করে মনে মনে তো তাঁর হাতে হাত রেখেই মায়া ঘেরা অন্তহীন পথ চলা! যার চুড়ির ঠুংঠাং শব্দে ফিরে ফিরে উছলে ওঠে নিঝুম দুপুরবেলা। যার ফিসফিসানির কাঁপনে চলকে পড়ে দমকা হাওয়ার হলুদ বিকেলবেলা। যার নরম আঙুলের স্পর্শের আহ্ললাদে বারেবারে ছুঁয়ে ফেলি ঝরঝর সন্ধ্যাবেলা। এই নিদাঘ অবরুদ্ধ দহনকালে মনের মধ্যে আর একটা মন এসে বুকের ভেতরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোড়াটাকে জাগিয়ে তোলে মুলুকের মুসাফির সেজে। যার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে দিগন্তের ঘুঙুর। আঙুলে আড়বাঁশির উচাটন। চোখে সুদূরের নেশা। সুদূরের ডাকে যে নিশি ডাকার গন্ধ লেগে থাকে। বড় ভয় করে। এই নিঃসঙ্গ সাঁঝ বেলায় একা তো পাড়ি দিতে পারবো না এতটা পথ! তার চেয়ে বরং, সঙ্গে চলুক না ছলছল ছেলেবেলা। সাথে চলুক কৈশোরের নিঝুম দুপুরের চুড়ির ঠুংঠাং। সঙ্গে যাক যৌবনের পাতা ওড়া বিকেলের দমকা হাওয়া। আর চলুক যৌবন সাঁঝের অনর্গল ঝরঝর বৃষ্টি ধারা। কোন সে সুদূরের টানে, কে জানে!