৫ই অগাস্ট, ২০১৯। ভারত রাষ্ট্র এবং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের কাছে নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ভারতের মাননীয় রাষ্ট্রপতির আদেশনামা বলে বিগত ৭০ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীরে লাগু থাকা ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের ঐতিহাসিক বিলুপ্তি। শুধু তাই নয়, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরের অস্তিত্বকে বিলোপ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজন। আশ্চর্যজনক হলেও সেইসঙ্গে একথাও ধ্রুব সত্য যে, তা ঘটানো হয়েছিল কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ করে এবং কাশ্মীরী জনতাকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারে রেখেই। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের এই অবলুপ্তির পক্ষে-বিপক্ষে তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতর্ক নিয়ে কাঁটাছেঁড়ার আগে জম্মু-কাশ্মীরের ঐতিহাসিক অবস্থান এবং জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রবর্তনের সূত্রপাত বিষয়ক কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের সাথে আলাপচারিতা অবশ্য প্রয়োজন।
কাশ্মীরের সুপ্রাচীন ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলে একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রাচীনকাল থেকেই সিংহভাগ সময়কাল ধরে কাশ্মীরের স্থানীয় শাসকেরা স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র কাশ্মীর শাসন করতেন। তবে অবশ্য মাঝেমধ্যেই ভারতবর্ষের প্রবল পরাক্রমশালী শাসকেরা সাময়িকভাবে কাশ্মীর দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুকালের মধ্যে সেই দখলদারি দুর্বল হয়ে পড়তেই কাশ্মীরের স্থানীয় শাসকেরা আবার কাশ্মীরের শাসন পুনরুদ্ধার করে নিতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় শেষ অবধি কাশ্মীরের শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসটা মোটামুটিভাবে এমনটিই ছিল। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের শাসন ব্যবস্থায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। এই সময়ে মোগল সম্রাট আকবর দ্বারা কাশ্মীর দখলীকৃত হওয়ার দরুণ কাশ্মীরে মোগল রাজের সূচনা হয় এবং স্থায়ী বিদেশী শাসনের সূত্রপাত ঘটে। তাই ইতিহাসের পাতার সাথে ঘনিষ্ঠ কাশ্মীরীরা মনে করেন যে, ১৫৮৬ সাল থেকেই কাশ্মীরীদের পরাধীনতার ইতিহাসের সূচনা। তারপরে একে একে কখনো পাঠান, কখনো শিখ, কখনো ডোগরা রাজাদের হাত ধরে কাশ্মীরে বিদেশী রাজের শাসন কায়েম হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে শিখ রাজ কায়েম হয়। ১৮১৯ সালে রণজিৎ সিংহ কাশ্মীরের পাঠান শাসকদের পরাভূত করে কাশ্মীরকে পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীকালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখ রাজা পরাজিত হয়ে ১৮৪৬ সালে লাহোর চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে ইংরেজরা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকা শিখ রাজার কাছে দাবি করে, যা শিখ রাজার পক্ষে দেওয়া কার্যত অসম্ভব ছিল। এমত অবস্থায় শিখ রাজা ইংরেজদের আশীর্বাদধন্য জম্মুর ডোগরা রাজা গুলাব সিংহের কাছে অর্থের বিনিময়ে কাশ্মীর রাজ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ১৮৪৬ সালেই ডোগরা রাজা গুলাব সিংহ এবং ব্রিটিশদের মধ্যে অমৃতসর চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই অমৃতসর চুক্তির বলে কাশ্মীরে চিরকালের জন্যে ডোগরা রাজা গুলাব সিংহ ও তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে বংশানুক্রমিকভাবে কাশ্মীর শাসনের ভার ন্যস্ত করা হয় এবং ডোগরা রাজাকে ব্রিটিশরা করদ রাজ্যের শাসকের স্বীকৃতি দেয়। ইংরেজ শাসকদের পরোক্ষ শাসনাধীন কমবেশি ৫৬০টি করদ রাজ্যের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর ছিল বৃহত্তম করদ রাজ্য। এরপর থেকে ব্রিটিশ শাসনকালের অন্তিম মুহূর্ত অবধি জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজার শাসনাধীন স্বাধীন করদ রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ভারত বিভাজনের সময়কালে, জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজা হরি সিংহের শাসনাধীন স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবেই থেকে যায়।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও জম্মু-কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজ্যই থেকে যায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে, যখন পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরের পুঞ্চ সেক্টরে আজাদ কাশ্মীরের দাবিতে মহারাজা হরি সিংহের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সেই সুযোগে পাকিস্তানী পাঠান উপজাতি সম্প্রদায় কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে, যা কিনা অনুঘটকের মত পুঞ্চের বিদ্রোহীদের উৎসাহ ও শক্তি বাড়িয়ে দেয়। কাশ্মীর রক্ষার্থে অন্য কোন অবলম্বন না পেয়ে, মহারাজা হরি সিংহ ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী মেহের চাঁদ মহাজন ভারত রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হন। মহারাজা হরি সিংহের এই সিদ্ধান্তে কাশ্মীরের ভূমিপুত্র শেখ আবদুল্লারও সম্মতি ছিল। এমত অবস্থায় ভারত রাষ্ট্র এই শর্তে মহারাজা হরি সিংহকে সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। উপায়ান্তর না দেখে, মহারাজা হরি সিংহ ভারত রাষ্ট্রের এই শর্ত মেনে নেন।
১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর ভারত সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীর সরকারের মধ্যে ‘অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত দলিল’ (Instrument of Accession) স্বাক্ষরিত হয়। এই দলিলের শর্ত অনুযায়ী, স্বাধীন স্বশাসিত রাজ্য হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি হয়। ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলেও পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ ছাড়া অন্যান্য সকল সরকারী বিষয়গুলো জম্মু-কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী স্বশাসনের পরিচালনাধীন থাকে। সেইসঙ্গে ভারত সরকারের তরফ থেকে একথাও ঘোষণা করা হয় যে, জম্মু-কাশ্মীরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিত অবস্থায় আসার পর রাজ্যের ভারতভুক্তির বিষয়টি গণভোটের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের মতামত নেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত সরকার কখনই এই বিষয়ে জম্মু-কাশ্মীরে গণভোটের পথে হাঁটেনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে অন্তর্বর্তী সময়ে রাষ্ট্রসংঘ জম্মু-কাশ্মীরে গণভোট সংগঠিত করার জন্যে অন্তত আটটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তার মধ্যে একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
জম্মু-কাশ্মীরের ভারত রাষ্ট্রে ‘অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত দলিল’-এর শর্তসমূহের কথা মাথায় রেখে ১৯৪৯ সালে শুধুমাত্র জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের জন্যে ভারতীয় সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার একটি প্রশাখা হল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫এ। অর্থাৎ, ভারত অন্তর্ভুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সমান্তরাল স্বশাসনের বন্দোবস্ত, যা কিনা মান্যতা পায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের প্রবর্তনের মাধ্যমে। সুতরাং, কাশ্মীরীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি কাশ্মীরী জনতা ও রাজ্যের প্রতি ভারত রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নটিও কিন্তু কোনমতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তি কিন্তু দেশের সংহতি এবং সমতার পক্ষেই সায় দেয়। যে কোন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র, মূল্যবোধের থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেয় দেশের অখণ্ডতা ও সংহতিকে। ফলে, ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তির স্বপক্ষে বর্তমান ভারত রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের এই ব্যাখ্যা কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না যে, অতীতে সম্পাদিত কোন ভুলের জের টানার থেকে রাষ্ট্রশক্তির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, দেশের সংহতি ও সমতা রক্ষা করা এবং ভারত রাষ্ট্রের আইনের শাসন তার অধিনস্ত সকল রাজ্যগুলোতেই অভিন্নরূপে কায়েম করা। এই লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি ছাড়া অন্য কোন উপায়ান্তরও ছিল না। যদিও এই বর্ণনার পাল্টা বক্তব্যসমূহও যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য। গোয়া, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং উত্তরপূর্বের কয়েকটি রাজ্য সংবিধানের ৩৭১ অনুচ্ছেদের বলে বেশ কিছু পৃথক সুযোগসুবিধা ভোগ করে আসছে। এমনকি উত্তরপূর্বের কয়েকটি রাজ্যে ভারতের অন্য রাজ্যের নাগরিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ আজও বলবৎ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্ন মনের চিলেকোঠায় উঁকি দিতেই পারে যে, তবে কি এইসকল ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের একতা, সংহতি এবং সমতার জিগির তুলে সেইসকল সুযোগসুবিধা এবং বিধিনিষেধ অচিরেই বিলোপ করা হবে? যদিও এইসকল বিধিনিষেধের পক্ষে জাতিসত্তা সংরক্ষিত রাখার বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাহলে তো সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তির সাথে সাথে কাশ্মীরীদের জাতিসত্তাও প্রবলভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে? ফলে, একই যুক্তির ওপর ভিত্তি করে দুই ধরণের ব্যবস্থা জারি কিন্তু রাষ্ট্রের সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিহিংসা পরায়নতার রাজনীতির পক্ষেই সায় দেয়।
একথা সর্বৈব সত্য যে, ১৯৪৯ সালে যখন জম্মু-কাশ্মীরে জন্য সংবিধানের ৩৭০ ধারা বলবৎ করা হয়েছিল, তখন বিষয়টি ভারতীয় পার্লামেন্টের কোন কক্ষেই আলোচিত হয়নি এবং এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ ভারতীয় সংবিধানে ‘সাময়িক’ হিসেবেই চিহ্নিত করা আছে। অর্থাৎ, জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ আদতে একটি অস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবেই লাগু ছিল। সেহেতু, ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি আসলে সেই সাময়িক বন্দোবস্তটিরই সমূলে উৎপাটন, কিন্তু কোন গণভোটের পরিকল্পনা ছাড়াই! ১৯৬৯ সালে, সম্পৎ প্রকাশ মামলায় দেশের শীর্ষ আদালত সংবিধানের এই ৩৭০ অনুচ্ছেদকে সাময়িক বলে মানতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে, ২০১৭ সালে দিল্লির উচ্চ আদালত এবং ২০১৮ সালে দেশের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয় যে, শিরোনামে ‘সাময়িক’ বলে লেখা থাকলেও কাশ্মীরের জন্য সংবিধানের এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ মোটেই সাময়িক নয়।
একথাও অকপট সত্য যে, ৩৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যেই এর বিলোপ পদ্ধতির নিদান দেওয়া আছে। ফলে, ভারত সরকার লোকসভা এবং রাজ্যসভায় কোনরকম আলোচনা না করেই শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত আদেশনামার ভিত্তিতে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের যে অবলুপ্তি ঘটিয়েছিল, তা ৩৭০ অনুচ্ছেদের ধারা-৩ মোতাবেকই করা হয়েছে বলে দাবি। অনুচ্ছেদ ৩৭০(৩) অনুযায়ী, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অবলোপনের একতরফা ক্ষমতা দেশের রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত রয়েছে। ১৯৪৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ যখন জম্মু-কাশ্মীরের জন্য বলবৎ করা হয়েছিল, তখনও একইরকমভাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে রাষ্ট্রপতির আদেশনামার বলেই তা প্রবর্তিত হয়। তবে পদ্ধতিটা নিখুঁতভাবে আইনসিদ্ধ কিনা তা নির্ধারণ করার বিষয়টি মহামান্য শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন ছিল। সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলী তাঁদের রায়ে ঘোষণা করেছেন, জম্মু-কাশ্মীরের জন্য প্রবর্তিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বর্তমান সরকার দ্বারা অবলোপন আইন ও সংবিধান সিদ্ধ। স্বভাবতই, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দিনটিও ভারত রাষ্ট্র এবং কাশ্মীরীদের কাছে নিঃসন্দেহে আর একটি ঐতিহাসিক দিন।
এই রায়ের পরেও কিন্তু কিছু মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন, ৭০ বছর ধরে কার্যকরী একটি পরম্পরা (তা ঠিক হোক, বা ভুল) জনপ্রতিনিধিদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, গোটা কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ রেখে, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা না ভেবে, শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অফিস ঘরের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা কি কাশ্মীরী আমজনতার জন্য আদৌ উচিত কাজ হল? আবার অন্যদিক থেকে উল্টো পর্যবেক্ষণটি হল, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ কাশ্মীরে ৭০ বছর ধরে বহাল থাকার ফলস্বরূপ ঐ অঞ্চলের আমনাগরিকদের আত্মায় কোনভাবেই ভারতীয় সত্ত্বার বীজমূল প্রবেশ করানো সম্ভব হয়নি। বরং, এতগুলো বছর ধরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের এই প্রযুক্তি কার্যত অঞ্চলের আমনাগরিকদের আত্মায় কেবলমাত্র কাশ্মীরী সত্ত্বাকেই প্রবলভাবে প্রোথিত করে রেখেছিল। ফলে, একথা মনে করা যেতেই পারে যে, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের এই অবলোপন ঐ অঞ্চলের আমনাগরিকদের আত্মায় কাশ্মীরী সত্ত্বার বেড়ি ডিঙিয়ে ভারতীয় সত্ত্বার ভাবনাকে অনেকটাই সুনিশ্চিত করতে পারবে।
কিন্তু এরপরেও ঝিলামের বক্ষতলে বয়ে যায় বিস্তর প্রশ্নমালার ফল্গুপ্রবাহ। উত্তরণ প্রক্রিয়ায় কাশ্মীরীদের কোনরকমভাবে অন্তর্ভুক্ত না করে এবং সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ রেখে, তাঁদের ভারতীয় সত্ত্বায় উত্তরণ কি আদৌ সম্ভব? এতগুলো বছর তো পেরিয়ে গেল বারুদের গন্ধ আর বন্দুকের শব্দে ত্রস্ত কাশ্মীরের কপাল বেয়ে। কিন্তু মূল সমস্যার কতটুকুই বা সমাধান করা গেল? তবে কি বন্দুক আর বারুদের আস্ফালন পেরিয়ে অন্য কোন এক অজানা বন্ধনশক্তি, কোন একদিন আমকাশ্মীরীদের ঠিক মিলিয়ে দেবে আমভারতবাসীর আবেগের মিলনমেলার আদিগন্ত প্রান্তরে? বহুকাল ধরে রক্তস্রোতের প্লাবন বয়ে গেছে ঝিলামের হৃদয় বিদীর্ণ করে। অনেক রক্তক্ষরণ চলকে পড়েছে আমকাশ্মীরীদের বক্ষ থেকে। অশান্ত কাশ্মীর শান্ত করার ব্রত নিয়ে কর্মরত ভারতীয় সেনানীর পরিজনদের উৎকণ্ঠিত হৃদকম্প সকল সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। আজ স্তব্ধ হয়ে থাক সকল রক্তের নদী-উপনদীর ধারা প্রবাহ। পথ খুঁজতে বার করতেই হবে মানবিক মনন নিয়ে। এক প্রবল মিলনচ্ছ্বাস হুড়মুড়িয়ে এসে মিলিয়ে দিয়ে যাক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ব্যাপী আমাদের প্রাণাধিক অখণ্ড ভারতবর্ষকে।